🚩ন্যায় শাস্ত্রের আধারে শক্তিপারম্যবাদমুখমর্দন এবং বিশেষ কিছু ব্যক্তিবর্গ দ্বারা কৃত কাশ্মীর ত্রিকধারার শৈবত্ব নিরাস খণ্ডন

ভারতবর্ষের কিছু প্রান্তে আজকাল হঠাৎ কিছু P.hd-ধারী স্কলার আর তাদের তোষামোদকারী কিছু ব্যক্তিবর্গ জুটেছে যারা অদ্বৈত শৈবাগম ভিত্তিক ও শিবসূত্র ভিত্তিক প্রাচীন ত্রিকধারা- কে শৈব ধারা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অপ্রস্তুত। এদেরই কিছু ব্যক্তি আবার ত্রিক পরম্পরা আর সেই পরম্পরার আচার্যদের শৈব নয় বরং শাক্ত অথবা কৌল প্রমাণ করতে ব্যতিব্যস্ত।  এদের দাবী ত্রিকধারায় পরমতত্ত্ব না শিব না শক্তি, বরং শিব শক্তিরও অতীত এক পরম সত্য , যা অনুত্তর তত্ত্ব হিসেবে পরিগণিত, ইহাই কৌলমত। কৌল মতকে এরা শৈবমত বহির্ভূত একটি মত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যতিব্যস্ত।  অথচ তাদের এসব বাক্যের আড়ালে মূল লক্ষ্য ত্রিক ধারার নামে প্রচ্ছন্ন শাক্তবাদ এর প্রচার যা বাংলায় এতবছর ধরে চলেই আসছে। 

প্রথমত এদের শুধুমাত্র নিজেদের লক্ষ্য (agenda) ও স্বার্থ চরিতার্থ করার নিমিত্তেই ত্রিক দর্শন নিয়ে চর্চা, যা বাংলার শাক্তকুল তথা শ্রীকুল এর উপাসকরা বহু আগে থেকেই করে আসছে। এদের কারোরই উপাস্য ইষ্ট শিব নয় বা এরা কেউই শৈব আগমোক্ত ক্রমে দীক্ষিত নয়। এদের বেশিরভাগই দীক্ষিত শাক্ত পরম্পরা থেকে, তাছাড়া এদের বেশভূষায় শাক্তের ও শাক্তাচারের লক্ষণ অত্যন্ত সুস্পষ্ট।  শৈব সমাজে তথা শৈব মতাদর্শের প্রতিষ্ঠায় এদের অবদান শূণ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। জনসমক্ষে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই, দুটো সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলার সাহস নেই, যাকে বলে এককথায় অসামাজিক, অথচ এদের জ্ঞানের দৌড় ওই বাতানুকূলিত ঘরে বসা জনাকয়েক কিছু স্কলার আর কনফারেন্স পর্যন্তই। শৈব দর্শন নিয়ে চর্চা করছে অথচ নিজেকে শৈব হিসেবে পরিচয় দেওয়ার লজ্জায় এরা সেই ত্রিক পরম্পরাকেই একটি শৈব পরম্পরা হিসেবে স্বীকার করতে অনিচ্ছুক, যদি সেটি মূল ত্রিক আচার্য পরম্পরার মান্যতার বিরুদ্ধেও চলে যায় , তবেও তারা সেটিই করবে। ত্রিক পরম্পরায় এইরূপ ব্যক্তিদের অস্তিত্ব আজকে নতুন নয়, বরং সেই বসুগুপ্ত, সোমানন্দপাদের সময়কালেও ছিল। ত্রিক পরম্পরার সর্বশেষ সিদ্ধ আচার্য স্বামী রাজনক লক্ষ্মণ জূ যেখানে ত্রিক মতকে অদ্বৈত শৈব ধারা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গিয়েছেন তাঁর একাধিক শাস্ত্রের ও live সাক্ষাৎকারগুলিতে, সেখানে আজকালকার নব্যরা পরম্পরার আচার্য এর বিরুদ্ধে নিজস্ব মত পোষণ করে নিজেদের হাসির খোরাক ছাড়া আর কিছু বানায় নি। আর এদের ইন্ধন যোগাচ্ছে একদল ছাগমুণ্ডধারী, গিরগিটের ন্যায় চরিত্রবদলকারী গণ্ডমূর্খ কিছু ব্যক্তি, যারা‌ 'ত্রিক' শব্দটির বানানটিও বোধহয় লিখতে অক্ষম, দর্শন, আগম এসব তো অনেক দূরের কথা। এরা আদৌ ত্রিকের একপাতা কোনো শাস্ত্র চোখে দেখেছে বা নাম শুনেছে কিনা সন্দেহ।  ওই ছাগেদের দলের সর্দার মহাছাগ। যিনি নৃত্য করছেন তিনিও ছাগু আর যারা হাততালি দিচ্ছেন তারাও ছাগু। ছাগুদের সর্দার নিজের দলের সামনে এখন নিজেকে যদি বাঘ বলে ঘোষণা করে, তাহলে সেক্ষেত্রে বাঘের মহিমা কোনো অংশে কমে যায় না।

আজকের এই পোস্টে এইসব ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক উত্থিত বেশ কিছু দাবীর আপাদমস্তক ধরে ধরে খণ্ডন করা হবে। 

পূর্বপক্ষ (দাবী) -

শক্তিই মুখ্য। শক্তিই একমাত্র পরমতত্ত্ব, শিব নহে। শিব গৌণ, কেননা শিব রূপটি মূলত শক্তিই ধারণ করিয়া থাকেন, তিনি স্বতন্ত্রা। সুতরাং ত্রিক পরম্পরায় শাক্তপারম্যবাদ স্বীকৃত হইয়াছে। বসুগুপ্ত-জীর প্রশিষ্য আচার্য ভট্ট প্রদ্যুম্ন তাঁর 'তত্ত্বগর্ভস্তোত্র'-তে কহিয়াছেন - 

" যস্যা নিরুপধিজ্যোতীরুপাযাঃ শিবসংজ্ঞযা |

 ব্যপদেশঃ পরাং তাং ত্বামম্বাং নিত্যমুপাস্মহে || "

 - অর্থাৎ হে পরা অম্বা ! আপনি অসীমপ্রকাশ স্বরূপে দীপ্তমানা, আপনিই 'শিব' নামে বাচিতা, আপনাকে নিত্য উপাসনা করি।  

তিনি আরো বলিয়াছেন -

" কিঞ্চিদুচ্ছুন্নতাপত্তির উন্মেষাদিপাদাভিধাঃ |

প্রবর্ততে ত্বয়ি শিবে শক্তিত তে যদাম্বিকে ||

জ্ঞানক্রিযাস্বরূপেন প্রবৃত্তযাস্তুতে শিবে |

সদাশিবত্বং জগদুর্ভোগভ্যম্ তত্ত্ববেদিনা || "

- অর্থাৎ হে শিবে! , হে অম্বিকে! তোমার শক্তির দরুণই এই সৃষ্টির উন্মেষাদি কার্য ঘটিয়া থাকে, তোমার-ই সেই চৈতন্যের সূক্ষ্ম পরিস্ফুরণ এর পরিণাম এই জগৎ। সেই সদাশিবও তোমারই চৈতন্যের একটি স্তর মাত্র, যে স্তরে তোমা হইতে জ্ঞান ও ক্রিয়াশক্তির অভিব্যক্তি ঘটিয়া থাকে - ইহাই তত্ত্ববেত্তাদিগের স্বীকৃতি। 

সিদ্ধান্তপক্ষ (দাবীর খণ্ডন) - 

যাহারা ভক্তি নিমিত্ত পরাশক্তি-কেই পরমতত্ত্ব মানিয়া তাহার উপাসনা করিয়া থাকেন, তাহারা প্রকৃতপক্ষে প্রকারান্তরে সেই শক্তিমান শিবের-ই গায়ন করিয়া থাকেন। ' ধর্মী ' এর অনুকরণকর্তারা যেরূপ ' ধর্মী ' কে অনুসরণ এর আড়ালে প্রকৃতপক্ষে 'ধর্ম'কেই আশ্রয় করিয়া থাকেন সেই একই ন্যায়ানুসারে 'উচ্ছুনতা' ( সূক্ষ্ম স্ফূরণ/Subtle Swelling of Consciousness) আদি দশা শক্তির আলোকে মূলত সেই এক শক্তিমানদেবই প্রতিপদিত হইয়া থাকেন, কারণ অদ্বৈত শৈব দর্শনানুসার শক্তি শক্তিমানেরই স্বরূপলক্ষণ। সুতরাং " ধর্মভূতযা ধর্মী স্বাশ্রযঃ স্বতন্ত্রো বাস্তবাভেদযুক্ত্যো দেবঃ শিবঃ প্রকাশিতঃ " - অর্থাৎ ধর্মের সাশ্রয়ভূতা ধর্মী - এর স্বাতন্ত্র্য দ্বারা বাস্তবে ধর্মের অর্থাৎ শিবের স্বাতন্ত্র্যই উপপন্ন হইয়া থাকে। শক্তিমানের স্বাতন্ত্র্য শক্তিকেই একমাত্র স্বতন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করিয়া স্বয়ং শক্তিমানকে পরতন্ত্র সাব্যস্ত করিলে " বহ্নের্দাহিকাশক্তিঃ পৃথঙনির্দেষ্টুমর্হতি " - উক্ত ন্যায়ানুসার সেই অগ্নির স্বাতন্ত্র্য এর উপর ব্যাঘাত হানি ঘটিয়া থাকে অর্থাৎ দাহিকা শক্তির উপরেই ব্যাঘাত আসিয়া থাকে অর্থাৎ প্রকারন্তরে শক্তিমানের স্বাতন্ত্র্য অর্থাৎ সেই শক্তির উপরেই ব্যাঘাত ঘটিয়া থাকে। ফলত উক্ত মন্তব্যের উপর ইতরেতাশ্রয় অনিষ্টাপত্তি (দোষ) আরোপিত হইয়া থাকে ।

আচার্য উৎপলদেব বলিতেছেন - " স্ত্রীলিঙ্গেন পরমশিবসৈব ব্যপদেশো যতশ্চেৎ সোহপি ব্যপদেশ উক্তন্যাযাৎ শিবশব্দাত্মকঃ কার্যঃ । " - অর্থাৎ পরমশিব অর্থাৎ ব্রহ্মকে যদি স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবে কল্পনা করা হইয়া থাকে, তবুও উহা শিবাত্মক-ই বটে ।  কেননা,  শিব নিজে শক্তি স্বরূপ এ ভাসিত হইয়াছেন  অর্থাৎ পরমশিব নিজে বিশ্বোত্তীর্ণ অবস্থা থেকে বিশ্বময় অবস্থায় নিজেকে experience করিতেছেন, লীলাবশত। তাই শক্তিটা-ও শিবই, শিবের স্বরূপ লক্ষণই বটে। তাই ভাষ্যকার বলিতেছেন - " শিবসৈব শক্তিরিতি নাম স্যাদিতি।"

আচার্য সোমানন্দপাদ স্পষ্টভাবেই বলিতেছেন - 

" ন শিবঃ শক্তিরহিতো ন শক্তির্ব্যতিরেকিণী || 

শিবঃ শক্তস্তথা ভাবানিচ্ছযা কর্ত্তুমীদৃশান্ |

শক্তিশক্তিমতোর্ভেদঃ শৈবে জাতু ন বর্ণ্যতে || "

- অর্থাৎ শিব কখনও তাহার সেই নিজা শক্তি হতে পৃথক হইয়া থাকে না আর শক্তি ব্যতিরেকে শিবের কল্পনা করা অসম্ভব। শিব সাক্ষাৎ শক্তিমান জন্যই তিনি স্বেচ্ছায় কার্য করতে সক্ষম। শৈব দর্শনে শক্তি আর শক্তিমান এর মধ্যে কোনো ভেদ স্বীকার্য নহে।

পূর্বপক্ষ (দাবী) -

আপনারা নিজেরাই বলিয়াছেন যে শক্তিব্যতীত শিবের অস্তিত্ব সম্ভবপর নহে। শিব শক্তিমান অর্থাৎ শক্তি যুক্ত জন্যই তিনি কার্য সম্পাদনে সক্ষম হইয়া থাকেন, নচেৎ তাহার পক্ষে কার্য সম্পাদন কদাপি সম্ভবপর হইত না। এক্ষেত্রে শিবের শক্তি-আশ্রয়তা পুনঃ সিদ্ধ হইয়া থাকে।

সিদ্ধান্তপক্ষ (দাবীর খণ্ডন) - 

" লক্ষণপ্রমাণাভ্যাং হি বস্তুসিদ্ধি " - কোনো পদার্থের সিদ্ধি এর নিমিত্ত তাহার কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষণ থাকাটা জরুরি। আগম ও নিগম মতে ব্রহ্মের স্বরূপ লক্ষণ হইল - সৎ চিৎ ও আনন্দ। এক্ষেত্রে কেহ যদি বলিয়া থাকেন যে, ব্রহ্ম তাহার লক্ষণের উপরেই আশ্রিত অর্থাৎ সৎ, চিৎ ও আনন্দ এই তিন লক্ষণের উপর আশ্রিত, তবে ইহা স্বীকার্য নহে, কারণ ব্রহ্ম সর্বদাই পরাশ্রয় দোষমুক্ত, ব্রহ্ম স্বতন্ত্র, কারণ তিনি ব্যতীত দ্বিতীয় কিছুরই অস্তিত্ব নেই, যাহাকে তিনি আশ্রয় করিয়া থাকিবেন। তেমনই পরমশিব ব্রহ্ম এর স্বরূপ লক্ষণই হইল সৎ, চিৎ আনন্দ, এগুলো কোনোটাই আলাদা নহে, বরং এক শিব-ই  আলাদা আলাদা level of experience এ নিজেকেই নিজে অনুভূত করিতেছেন, ভাসিত করিতেছেন।   ত্রিক মতে এই সৎ ই হইল প্রকাশ - অনাশ্রিত শিব এবং চিৎ ই হইল- সেই শিবের অহং বিমর্শমযতা, চিৎ হইতেই আসে ইচ্ছা, জ্ঞান ক্রিয়া, যা ব্রহ্মের আনন্দময়তা এরই নির্দেশক। অর্থাৎ ত্রিক মতে পরমশিবের প্রকাশ ও বিমর্শময়তা ব্রহ্মের স্বরূপ লক্ষণ হিসেবে সিদ্ধ হইয়া থাকে কোনোরূপ অদ্বৈতহানি ছাড়াই, স্বগতভেদ ছাড়াই, কেননা প্রকাশভাব (Consciousness) আর বিমর্শভাব (awarenes of that consciousness) পরমশিবের level of experience ছাড়া আর কিছুই নহে। পরমশিব এর অহং বিমর্শাত্মকতা-ই শক্তিপদ বাচ্য, সুতরাং এক্ষেত্রে অদ্বৈতহানি ঘটিতেছে না কোনো। ইহা ক্রম পরম্পরার আচার্য শ্রীশিতিকণ্ঠ বিরচিত " তসৈকা সহজাহম্ভাবভূমিশ্চিৎশক্তিঃ " ইত্যাদি কৌলসূত্র সম্মতও বটে। কিন্তু ' শক্তি ' এই শব্দটিকে  শিব অপেক্ষা  পৃথকভাবে বেশি বড় করিয়া দেখাইবার প্রচেষ্টা বরং দ্বৈতাপত্তি দোষে দুষ্ট। ব্রহ্মের অন্দরে সৃষ্টির ইচ্ছা জন্মিলে এই জগৎ নির্মিত হইয়া থাকে যা " একো অহং বহু স্যাং " ইত্যাদি শ্রুতিবাক্য দ্বারা এবং " অভিধ্যোপদেশাচ্চ" || (ব্রহ্মসূত্র - ১/৪/২৪) - ইত্যাদি ন্যায়প্রস্থান বাক্য দ্বারা সিদ্ধ হইয়া থাকে। ব্রহ্মের এই "অহং" ভাব (অহন্তা) তথা ইচ্ছা- ই শক্তিপদ বাচ্য হন, যা ত্রিক দর্শন মতে ব্রহ্মের স্বরূপ লক্ষণ (তটস্থ লক্ষণ নহে) এবং ব্রহ্ম হইতে অভিন্না। ব্রহ্মের এই স্বাতন্ত্র্যই শক্তিপদ বাচ্য। তাই শিবসূত্রে কথিত হইয়াছে রয়েছে - " ইচ্ছাশক্তিরুমাকুমারী " তথা শ্রুতিতে কথিত হইয়াছে " পরাঽস্য শক্তির্বিবিধৈব শ্রুযতে স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিযা চ " । এই ইচ্ছাশক্তিটা সাক্ষাৎ শিবেরই, তাই তাহাকে এই শক্তির উপর পৃথকভাবে আশ্রয় করিবার কোনো প্রয়োজন পড়িবে না , কেননা শক্তি ব্রহ্মের "অহং বিমর্শময়তা" বা "অহং প্রত্যবিমর্শাত্মকতা" ছাড়া আর কিছুই নহে। 

ব্রহ্ম পরমশিব যদি শক্তির সাথে যুক্ত হইয়া থাকেন, তবেই তিনি জগজ্জন্মাদিকারণত্ব অর্থাৎ পঞ্চকৃত্য করতে সমর্থ হইবেন। পরন্তু উক্ত অর্থ গ্রহণ করিলে  দ্বৈতাপত্তি দোষ আরোপিত হইয়া থাকে। কেননা, এক্ষেত্রে পারমার্থিক অবস্থায় দুইটি পৃথক সত্ত্বার অস্তিত্ব স্বীকার করা হইতেছে। এক্ষেত্রে শক্তি (পরাশক্তি) শিব অথবা পারমার্থিক ব্রহ্ম হতে পৃথক সত্ত্বা বলেই তাহাকে সৃষ্টি নিমিত্ত শিবের সাথে সংযুক্ত হইতে হইতেছে, এক্ষেত্রেই অদ্বৈতহানি হইয়া থাকে, কারণ শ্রুতি কহিয়া থাকে, ব্রহ্ম "একোমেবাদ্বিতীয়ম্", "একো হি রুদ্র ন দ্বিতীযায তস্থুঃ" ।  তাছাড়া, শ্রুতি কহিয়া থাকে, " সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম ", " সর্বো বৈ রুদ্রঃ "  " ঈশবাস্যমিদং সর্বং " - অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বপ্রপঞ্চ সাক্ষাৎ ব্রহ্মই। সর্বত্রই সেই ব্রহ্মই রহিয়াছেন, এক্ষেত্রে শক্তি শিব তথা ব্রহ্ম হইতে পৃথক হইয়া যাইবেন কোথায়? কারণ সবকিছুই যে সেই এক ব্রহ্ম। আর সেই একোমেবাদ্বিতীয় ব্রহ্ম ভিন্ন দ্বিতীয় কিছুর পৃথক উপস্থিতি শ্রুতি বিরোধী, আর শ্রুতি বিরোধী মত কদাপি স্বীকার্য নহে। তাই । তাই ব্রহ্মের শক্তি-আশ্রয়বাদ সম্পূর্ণরূপে শ্রুতি (বেদ ও আগম) বিরুদ্ধ।

পূর্বপক্ষ (দাবী) -

শক্তি স্বতন্ত্র জন্যই শক্তিমান স্বতন্ত্র, অন্যথা শক্তিমানের স্বাতন্ত্র্য সম্ভবপর নহে।

সিদ্ধান্তপক্ষ (দাবীর খণ্ডন) - 

উক্ত বাক্যেও শক্তি - শক্তিমানের ভেদ স্পষ্টরূপে বিদ্যমান, অর্থাৎ এক্ষেত্রেও দ্বৈতাপত্তির উদ্ভব হইয়া থাকে। পারমার্থিক অবস্থায় একাধিক স্বতন্ত্র নায়কের উপস্থিতি সম্ভবপর নয়। কেননা একাধিক স্বতন্ত্র নায়কের উপস্থিতির ফলস্বরূপ একাধিক পঞ্চকৃত্য একাধিক প্রকারে ঘটিয়া থাকিবে, উহার ফলস্বরূপ মূলত কোনো কার্যই সম্পাদিত হইবে না,  সৃষ্টির উদ্ভবই ঘটিবে না। তাই একাধিক স্বতন্ত্র নায়কের উপস্থিতি কদাপি সম্ভব নহে।

পূর্বপক্ষ (দাবী) -

শক্তিই মূলা স্বতন্ত্রা। কারণ চিত্রকার- কে চিত্র অঙ্কন নিমিত্ত তুলির আশ্রয় গ্রহণ এর দরকার পড়িয়া থাকে। কার্য করিতে গেলে  হস্তের দরকার অবশ্যম্ভাবী। 

সিদ্ধান্তপক্ষ (দাবীর খণ্ডন) - 

কথিত বাক্য দ্বারা পারমার্থিক ব্রহ্মে বিজাতীয় ও স্বগত ভেদ এর অস্তিত্ব স্বীকার করা হইতেছে। কেননা তুলি ও চিত্রকার ভিন্ন সত্ত্বা (বিজাতীয় ভেদ যুক্ত) এবং হস্ত ও দেহ পরস্পর স্বগত ভেদ যুক্ত। তাছাড়া, চিত্রকারের ইচ্ছে বিনা, তুলি নিজ ইচ্ছায় চিত্রাঙ্কনে অসমর্থ।

আপনারা যদি একান্তই শক্তিকে পরতন্ত্র না মানিয়া, স্বতন্ত্র মানিয়া থাকেন, সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠিবে যে, সেই শক্তি সামর্থ্য রহিত হইয়া এই জগৎ এর সৃজন করতেছেন নাকি সামর্থ্যবতী হইয়া?  

যদি উত্তরে বলা হইয়া থাকে যে, তিনি সামর্থ্য রহিত রহিয়া জগৎ এর সৃজন করতেছেন, সেক্ষেত্রে ইহাতে অসম্ভব দোষ আরোপিত হইয়া থাকবে, কারণ অসামর্থ্যবশত কোনো কার্য সম্পাদনই সম্ভবপর নহে।  

যদি উত্তরে বলা হইয়া থাকে, যে তিনি সামর্থ্যবতী হইয়া জগৎসৃষ্টি করিয়া থাকেন, তবে তাহার সেই সামর্থ্য অপর দ্বিতীয় কোনো সামর্থ্যের অপেক্ষাধীন হইবে এবং সেই দ্বিতীয় সামর্থ্য তৃতীয় কিছুর সামর্থ্যের অপেক্ষাধীন হইবে, ফলত উক্ত অনিষ্টাপত্তির দরুণ অনাবস্থা দোষের সৃষ্টি হইবে। সুতরাং অদ্বৈত শৈব দর্শনে শক্তি এবং শক্তিমানের অভেদত্ব পূর্ণত সিদ্ধ হইয়া থাকে, শক্তিমানই সাক্ষাৎ শক্তি - " শক্তিমানেব শক্তি স্যাৎ । শিবভট্টারক ইতি - করণলক্ষণেনার্থেন শক্ত্যা যথা শিবভট্টারকস্য কর্তৃত্বমিত্যর্থঃ । "

যদি শক্তিমান এবং শক্তি পূর্ণত অভেদ না হইয়া থাকেন তবে এই সংশয়োৎপত্তি হয় যে সৃষ্টি স্থিত্যাদি কার্য মূলত কে করিয়া থাকেন শক্তি নাকি শক্তিমান ?

যদি উত্তর শক্তি হইয়া থাকে, তবে উহা প্রকারান্তরে শক্তিমান শিব এরই বোধক রূপে সিদ্ধ হইয়া থাকে। অর্থাৎ শাক্তসিদ্ধান্তীগণ প্রকারান্তরে শিবভট্টারকের-ই কর্তৃত্ব স্বীকার করিয়া থাকেন। কেননা শক্তিরূপ কারণ দ্বারা কার্য নিমিত্ত কোনো না কোনো করণ-নিয়ন্তা অর্থাৎ কর্তার প্রয়োজন অনিবার্য। যদি শক্তি স্বতন্ত্র ভাবে কার্য সম্পাদন করিয়া থাকে তবে উহার শিব অপেক্ষা ভিন্ন অস্তিত্ব স্বীকার অনিবার্য, সেক্ষেত্রেও দ্বৈতাপত্তি আরোপ ঘটিয়া থাকিবে আর যদি শিব তাঁর স্বাতন্ত্র্য শক্তি অপেক্ষা ভিন্ন হন অথবা শিব নিজের শক্তিকে  অর্থাৎ স্বাতন্ত্র্যকে পরিত্যাগ করিয়া দেন, তবে সেই স্বাতন্ত্র্যই জ্ঞানের বিষয় হিসেবে পরিগণিত হইবে, শিব আর জ্ঞানের বিষয় হিসেবে পরিগণিত হইবে না, সেক্ষেত্রে পুরো অদ্বৈত শৈব দর্শনের ভিত্তিই বিকৃত হইয়া যাইবে। তাই অদ্বৈত শৈব দর্শনানুযাযী, শিব ও শক্তির অভেদত্ব চির স্বীকৃত, উহাদের পৃথকীকরণ সম্ভব নহে, ঠিক যেমনটা হিম হইতে শীতলতার এবং অগ্নি হইতে উষ্ণতার। 

পূর্বপক্ষ (দাবী) - 

আপনাদিগেরই শাস্ত্রে তো কথিত হইয়াছে - "  এই সমগ্র ৩৬ তত্ত্বাত্বক জগৎ সেই এক শক্তিরই রূপ "।  জগৎসৃষ্টি নিমিত্ত শিব কেন তবে শক্তি স্বরূপ ধারণ করিতেছেন ? কি প্রয়োজন তাহার ? এক্ষেত্রেও তাহাকে শক্তিস্বরূপাপেক্ষী হয়ে থাকিতে হইতেছে ? ইহাও তো প্রকারান্তরে শিবের একটি পরতন্ত্রতা হিসেবেই বিবেচিত হইয়া থাকবে। 

 

সিদ্ধান্তপক্ষ (দাবীর খণ্ডন) - 

এই বিশ্বপ্রপঞ্চ যদি শুধু সেই শক্তির - ই স্বরূপ হইয়া থাকে তবে ব্রহ্মের জগতের উপাদান কারণত্ব সিদ্ধান্ত খণ্ডিত হইয়া থাকে এবং ফলস্বরূপ " সর্বদং সর্বদেহস্থং " ইত্যাদি আগম বাক্যের তথা " তৎসৃষ্ট্বা তদেবানুপ্রবিশাৎ " , " একো দেবঃ সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ", "সর্বগতো শিবঃ"  ইত্যাদি শ্রুতি বাক্যের তথা " কারণত্বেন চাকাশাদিষু যথাব্যপদিষ্টোক্তেঃ" || (ব্রহ্মসূত্র - ১/৪/১৪),  " সাক্ষাচ্চোভয়াস্নানাৎ " ||  (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২৫) - ইত্যাদি ন্যায়প্রস্থান সূত্রের তথা "  ভাবস্বভাববৎ স্বতঃ স্বাতন্ত্রং কুলেশিতুঃ ... ব্যুত্থানবত্তু শিবাদ বিশ্বোদযঃ || "  ইত্যাদি কৌলসূত্রের,   হৃদযং পরমেষ্ঠিন ", " বিশ্বমিদং নাথে ভৈরবীযচিদম্বরে ", " স এক সর্বভূতানাং স্বভাবঃ পরমেশ্বরঃ " - ইত্যাদি ত্রিক শৈব প্রকরণ শাস্ত্র বাক্য এর ব্যাকোপ ঘটিয়া থাকে ফলত ব্যভিচারণ দোষাপত্তি হইয়া থাকে।

পিণ্ড (স্বর্ণপিণ্ড) এবং স্বর্ণ-কটকে সুবর্ণত্ব বিদ্যমান কিন্তু কর্ণ-কুণ্ডল তথা কেয়ুরে (গহনা বিশেষ) সুবর্ণত্ব এর লোপ পাইয়া থাকে - ইহা যেরূপ অমান্য, সেইরূপ এই বিশ্বপ্রপঞ্চ-তে শিব বিদ্যমান নেই, ইহাও অমান্য। সুবর্ণত্ব যেইরূপ উক্ত সকল গহনাতে বিদ্যমান, অর্থাৎ সুবর্ণ যেইরূপ স্বর্ণকার এর ইচ্ছার দরুণ ভিন্ন ভিন্ন গহনা হিসেবে ভাসিত হইয়াছে (সুবর্ণের নিজ ইচ্ছায় নয়), সেইরূপ শক্তির অধীশ্বর শিব নিজ স্বাতন্ত্র্য এর দরুণ সর্বত্র ব্যাপ্ত হইয়া স্থিত রহিয়াছেন এবং জগতের অভিন্নোপাদাননিমিত্তকারণ হিসেবে শাস্ত্রে প্রতিপাদিত হইয়াছেন, সর্বজগত-ই শিবাত্মক। কৌলসূত্রে তাই আচার্য রাজানক শিতিকণ্ঠ বলিয়াছেন - " ভাবস্বভাববৎ স্বতঃ স্বাতন্ত্রং কুলেশিতুঃ ... ব্যুত্থানবত্তু শিবাদ বিশ্বোদযঃ || " -- অর্থাৎ - কুলেশ্বরের (অর্থাৎ শিব) এই ভাব-স্বভাব-ই (অহমতা) তথা স্বাতন্ত্র্যই স্বাভাবিকী  শক্তি হিসেবে পরিগণিতা হইয়া থাকেন (এবং এই শক্তির দ্বারাই) (সেই পরমব্রহ্ম) শিব হইতে (সমগ্র) বিশ্ব উদিত হইয়া থাকে। ।

  পরমগুরু উৎপলাচর্য তাই বলিতেছেন - " এবং সুবর্ণবৎ পরমেশ্বর এব পূর্বোক্তেচ্ছাদিশক্তিমান্ তথা তত্ত্বভুবনকার্যকরণাদিপ্রকারবৈচিত্র্যেণ সর্বেঃ পদার্থেরিৎথংভূতলক্ষণৈঃ স্থিতঃ ; অতঃ শিবাত্মকমেব সর্বং ন তু শক্ত্যাত্মকম্। ব্যবহারিকশক্তিভেদাশ্রযণে তু শক্ত্যাত্মকমুক্তম্ - 'শক্তযস্তু জগৎ কৃৎস্নং....' - ইতি। বস্ততস্তু শিবাত্মকমেব। "

- অর্থাৎ সুবর্ণের ন্যায়ই সেই এক ব্রহ্ম শিবই সর্বত্র বিদ্যমান, তত্ত্ব, ভুবন, কলা, মন্ত্র, পদ, মন্ত্র সমগ্র ষড়াধ্ব জুড়ে, কার্য-কারণাদি বৈচিত্রে, সর্বভূতে, সর্ব পদার্থে সেই এক শক্তিমান শিবই বিদ্যমান, তাই সমগ্র জগৎ পরমার্থত শিবাত্মক, পৃথকভাবে শক্ত্যাত্মক নহে। ব্যবহারিক পর্যায়ভেদে সেই জগৎ শক্ত্যাত্মক হিসেবে উক্ত হইলেও, পরমার্থত বস্তুত উহা শিবাত্মকই বটে সুতরাং 'শক্তযস্তু জগৎ কৃৎস্নং....' - ইত্যাদি বাক্য পারিমার্থিক পর্যায়ে শিবাত্মকতাকেই সূচিত করিয়া থাকে।

পূর্বপক্ষ (দাবী) -

শক্তি স্বরূপটি যদি সাক্ষাৎ শিবের-ই হইয়া থাকে তবে পারমার্থিক " শান্তং শিবং অদ্বৈতং " অবস্থায় শক্তির উপস্থিতি তথা স্পন্দন কেনই বা স্তব্ধ হইয়া যায় ? সেক্ষেত্রে তবে ব্রহ্মের স্বরূপ লক্ষণেই ব্যাঘাত আসিয়া থাকে ? অর্থাৎ শিবের শিবত্বই প্রশ্নবিদ্ধ হইয়া পড়ে।

সিদ্ধান্তপক্ষ (দাবীর খণ্ডন) - 

শান্ত অবস্থায় ব্রহ্ম শিবাত্মক কিন্তু গতিয়মান অবস্থায় উহা কেবলই শক্ত্যাত্মক অথবা গতিয়মান অবস্থায় উহা শিবাত্মক কিন্তু শান্ত অবস্থায় উহা শিবাত্মক নহে অথবা পারমার্থিক ব্রহ্ম পূর্ণত নিষ্ক্রিয়, স্পন্দনরহিত --- এহেন দাবী কিদাপি অদ্বৈত শৈব দর্শনে স্বীকার্য নহে। অঙ্গাররূপ অগ্নিতেও যেমন অগ্নিত্ব বিদ্যমান তেমন জ্বলনক্রিয়াশীল অগ্নিশিখাতেও অগ্নিত্ব বিদ্যমান। সেইরূপ শান্তব্রহ্ম অবস্থাতেও শিবত্ব বিদ্যমান এবং উল্লাসময় ব্যবহারিক পর্যায়েও সেই এক শিবই বিদ্যমান। নিশ্চল, পরিত্যক্ত ঘট এবং জলপূর্ণ ঘট এর মধ্যে যেইরূপ কোনো ভেদ বিদ্যমান নহে, সেইরূপ শিবের বিশ্বোত্তীর্ণ ও বিশ্বময় (শক্তি অবস্থা) এই উভয় অবস্থার মধ্যে কিঞ্চিৎ ভেদও বিদ্যমান নহে।

স্পন্দশক্তি বিহীন পারমার্থিক শিব আসলেই শবতূল্য - এই বাক্যও যথার্থ নহে। কেননা সেই শান্ত পরমশিব অবস্থায় ভবন-কর্তৃত্বতা বিদ্যমান, স্থিতিরূপি ইচ্ছা, স্থিতিরূপি জ্ঞান ও স্থিতিরূপি ক্রিয়া অনাদিকাল ধরে শাশ্বত ভাবে পরশিবেই বিদ্যমান।  অদ্বৈত শৈব দর্শন মতে ব্রহ্মের পারমার্থিক নিস্তরঙ্গতাও এক ধরণের স্পন্দ (Vibrationless vibration) , যা 'সামান্য স্পন্দ ' অবস্থা বা ' পরং বিশ্রান্তি স্থান ' অবস্থা হিসেবে অভিহিত হইয়াছে। এই অবস্থাই " মহাকাশে প্রলীনশশিভাস্করে সৌষুপ্তপদবন্মূঢ়ঃ প্রবুদ্ধঃ " ইত্যাদি স্পন্দসূত্র দ্বারা ব্যক্ত হইয়াছে। ইহাই পরমেশ্বরের বিশ্বোত্তীর্ণ স্বরূপ। তাঁর মনে জগৎ সৃষ্টির নিমিত্ত সেই সুপ্ত চিৎ শক্তির যখন ইচ্ছাশক্তি রূপে যখন জাগরণ ঘটিয়া থাকে, সেই উল্লাস/আনন্দময়ত-ই হল - 'বিশেষ স্পন্দ' বা 'ঔন্মুখ স্পন্দ' বা 'বিমর্শ সম্বিৎ স্পন্দ'। সাগরের উর্মিই বিশেষ স্পন্দ অবস্থা এবং সাগরের প্রশান্ত নিস্তরঙ্গতাই সামান্য স্পন্দ অবস্থা, তাই সাগরে যেই রূপ একই সাথে উভয় অবস্থা-ই বিদ্যমান, সেই রূপ পরমশিবেও। সুতরাং এক্ষেত্রে ব্রহ্মের স্বরূপলক্ষণ এর কোনোরূপ ব্যাঘাত ঘটিতেছে না।

" সংবিত্তি শূণ্য ব্রহ্মত্ববাদিনাং জড়তৈব সা "- ব্রহ্মে যদি সম্বিৎ বা চিৎশক্তি না থাকে, ব্রহ্ম যদি পূর্ণত নিষ্ক্রিয় হইয়া থাকে, তবে সেই ব্রহ্ম জড় ব্রহ্ম হিসেবে পরিণত হইবে। আর এই জড় নিষ্ক্রিয় ব্রহ্মবাদ কদাপি কোনো শৈব দর্শনে মান্য নহে, যা " নর্তক আত্মা ", " রঙ্গোঽন্তরাত্মা " ইত্যাদি শিবসূত্র অর্থাৎ শিব বাক্য বিরুদ্ধ এবং " তদৈক্ষত বহুস্যাং প্রজাযেযেতি ", " স ঈক্ষত লোকান্নু সৃজা ইতি ", " স ঈক্ষাংচক্রে স প্রাণমসৃজৎ " ইত্যাদি শ্রুতি বাক্য বিরুদ্ধও বটে।

পূর্বপক্ষ (দাবী) -

শিব-শক্তৈক্যরূপি সৎ চিৎ আনন্দ স্বরূপ পরমশিব পরভৈরব (ব্রহ্ম) যদি ৩৬ তত্ত্বোপরি ৩৭ নং তত্ত্ব হইয়া থাকে, তবে তাঁরও উর্ধ্বে ৩৮ নং অন্তিম চরম তত্ত্ব হিসেবে মহাশূণ্যা, শূণ্যাতীতা কালসংকর্ষিণী কালী বিদ্যমানা, তিনিই বিসর্গান্ত সপ্তদশীকলা । এই কালী স্বয়ং ব্রহ্মাতীতা। ইহাই তন্ত্রে উক্ত হইয়াছে। (এমনটাই আজকাল কিছু নব্য শাক্ত দাবি করে থাকে)। 

সিদ্ধান্তপক্ষ (দাবীর খণ্ডন) - 

স্বয়ং ব্রহ্মের উর্ধ্বে কোনো তত্ত্ব এর উপস্থিতি সমগ্র সনাতন মত বিরুদ্ধ, এরফলে সমগ্র সনাতন দর্শনেরই ভিত্তি বিকৃত হইয়া থাকে। ব্রহ্মের উর্ধ্বে কোনো তত্ত্বের উপস্থিতি সেই তত্ত্ব হতে ব্রহ্মের উৎপত্তিকে দর্শাইয়া থাকে যা " জন্মাদস্য যতঃ " ইত্যাদি ন্যায়প্রস্থান সূত্রের বিরুদ্ধ। উপনিষদে তথা তন্ত্রে ব্রহ্মের স্বরূপ-লক্ষণ সম্পর্কে কথিত হইয়াছে - " সৎ চিৎ আনন্দ ", " সত্যং জ্ঞানং অনন্তং ব্রহ্ম "। তাছাড়া আরো বলা হইয়াছে -, " পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমদুচ্যতে | পূর্ণস্য পূর্ণমাদায পূর্ণমেবাবশিষ্যতে | "‌‌  ত্রিক মতে জগজ্জন্মাদিকারণত্ব  ব্রহ্মের স্বরূপলক্ষণ (শিবাদ্বৈত বেদান্ত মতে ইহা ব্রহ্মের তটস্থলক্ষণ) কেননা, যাহা পূর্ণ এবং সম্বিৎ স্বরূপ তাহা হইতেই সৃজন সম্ভব। যাহা শূণ্য তথা পূর্ণত জড়, অচিৎ - তাহা হইতে কিরূপে জগজ্জন্মাদিকারণত্ব সম্ভব? একবিন্দু জলকে জলাশয়ের আকার দেওয়া যেরূপ সম্ভবপর নহে, সেইরূপ সর্বথা শূণ্য হইতেও সর্বব্যাপকতা সম্ভব নহে। পূর্ণতাই সর্বব্যাপকতার হেতু। সেই কারণে শ্রুতিতে বলা হয়েছে - " অসদ্বা ইদমগ্র আসীৎ | ততো বৈ সদজায়ত |তদাত্মানং স্বয়মকুরুত | তস্মাৎ তৎ সুকৃতমুচ্যতে ইতি || "- এই জগৎ সৃষ্টির পূর্বে অসৎ-ই ছিলো’- এর অর্থ এই নয় যে সৃষ্টির পূর্বে জগৎ ছিলো না। তা ব্রহ্মে সূক্ষ্মরূপে লীন হয়ে ছিলো তা।  মহর্ষি বাদরায়ণ ন্যায় প্রস্থানে বলছেন - " অসদ্ব্যপদেশান্নেতি চেৎ, ন, ধর্মান্তরেণ বাক্যশেষাৎ ||" (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৭), " যুক্তেঃ শব্দান্তরাচ্চ || " (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১৮) ----  অর্থাৎ, ‘অসৎ’ এই শব্দটি সম্পূর্ণ অনস্তিত্বকে বুঝায় না, কিন্তু জগৎ পৃথক কোন সত্তারূপে ছিলো না- তাই বুঝায়। তা অভিন্ন অবস্থাতেই ছিলো- তখন পর্যন্ত কোন নাম-রূপের উদ্ভব হয়নি- এই অর্থে জগৎকে ‘অসৎ’ বলা হইয়়াছে। তখন তা সূক্ষ্ম অবস্থায় ছিলো এবং সৃষ্টির পর তা স্থূল আকার ধারণ করিলো এবং নাম-রূপেরও উদ্ভব হইলো। তন্ত্রে মহাশূণ্য অর্থ - মহা + অশূণ্য = মহাশূণ্য অর্থাৎ যাহা শূণ্যনয়, পূর্ণ, great wholeness. সুতরাং পরমার্থ এর স্বরুপ লক্ষণ এর বিচার হেতু শূণ্যবাদের অবতারণা-য় সেই লক্ষণ এর উপর অসম্ভব দোষ আরোপিত হইয়া থাকে, সুতরাং সেই মতের মান্যতা কদাপি স্বীকার্য নহে। আর যেসকল মধ্যযুগীয় শাক্ত তন্ত্রে ইহা উল্লিথিত হইয়াছে তাহা অপ্রমাণ হিসেবে সিদ্ধ হইবে। এইভাবেই শূণ্যবাদী বৌদ্ধ প্রভাবিত নব্য শাক্তবাদ খণ্ডিত হয়।  আর এই নব্যশাক্তবাদ অসনাতনী প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ নাস্তিক্যবাদ হিসেবেই পরিগণিত হইয়া থাকে। 

কালীই সেই পরাশক্তি, সেই সপ্তদশী কলা, যা বিসর্গ এরও অন্তে অবস্থানকারিনী, যিনি সর্বশেষ এবং পরমকলা স্বরূপে বিদ্যমানা,  ক্রমসদ্ভাব শাস্ত্রেও ইহা উল্লিখিত হইয়াছে - " বিসর্গান্তকলারুঢ়া ষোড়শস্বরমধ্যগা | সপ্তদশীতি সা কালী ক্রিযা সর্বান্তকী কলা || " - কিন্তু ইহা কদাপি পরমশিবের উর্ধ্বে শূণ্যব্রহ্মবাদের দ্যোতক নহে। কেননা -

 "  বিসর্গস্যেইব বিশ্লেষ ইতি সপ্তদশীকলা | ক্বচিদষ্টাদশী সৈব পুনঃ প্রক্ষোভযোগতঃ || অনুত্তরস্যাকারস্য পরভৈরবরূপিণঃ | অকুলস্য পরা যেযং কৌলিকী শক্তিরুত্তমা ||" ‌- ইত্যাদি আগম বাক্য দ্বারা সেই সপ্তদশী কলা তথা অষ্টাদশী কলা-এর  অনুত্তরতত্ত্ব পরমশিব পরভৈরবের শক্তিপদ বাচ্যতা সিদ্ধ হইয়া থাকে, ইহা আচার্য ক্ষেমরাজেরও মত। তাই আগম বাক্য ও প্রাচীন আচার্যের মান্যতার নিরিখে নব্য শাক্ত মত পুনঃ খণ্ডিত হইল।

এবারে আসিব ৩৮ নং তথা ৩৭ নং তত্ত্বাবতারণার নিমিত্ত প্রসঙ্গে।

একাধিক প্রামাণিক আগম শাস্ত্রের মান্যতা অনুযায়ী তত্ত্ব এর সংখ্যা ৩৬ টিই বটে, উহার অতীত যে বিশ্বোত্তীর্ণ সত্ত্বা উহা কোনো তত্ত্ব এর অন্তর্গত নহে, উহা তত্ত্বাতীত অনুত্তর সত্ত্বা, উহা পরমশিব পদবাচ্য। ইহাই পরমসত্য, পরমব্রহ্ম। ইহা মূলত প্রথম তত্ত্ব অনাশ্রিত শিবের- ই বিশ্বোত্তীর্ণ অবস্থা, ইহাই আচার্য শ্রীজয়রথ এর মান্যতা। 

তবে তন্ত্রালোকের একাদশ আহ্নিকের ২১ (শ্রীতন্ত্রালোক/১১.২১) এবং তদুত্তর শ্লোকানুসার, 

যাহারা অবিদ্যাবশত অন্তিমতম  36 নং তত্ত্ব শিব এর তত্ত্বাতীত বিশ্বোত্তীর্ণ এবং বিশ্বময়তা এই উভয়াবস্থাকে যুগপৎভাবে স্বীকার করিতে পারেন না, তাহাদের আত্মতুষ্টি নিমিত্ত স্বতন্ত্রবোধ স্বরূপ ৩৭ তম একটি তত্ত্বের অবতারণা করা হইয়া থাকে, ইহাই পরমশিব। 

আচার্য জয়রথের ভাষ্যানুযায়ী, প্রকৃতপক্ষে ৩৭ নং তত্ত্ব বলিয়া কোনো তত্ত্ব নেই বাস্তবে, নইলে ইহা " ষট্-ত্রিংশতত্ত্বমুখানি " , " ষট্-ত্রিংশৎতত্ত্বভেদেন ন্যাসোহযং "  ইত্যাদি আগম বচনের বিরুদ্ধে চলিয়া যায় এবং অমান্য হিসেবে পরিগণিত হইয়া থাকে। আচার্য জয়রথ বলিয়াছেন, পরমতত্ত্ব অনুত্তর তত্ত্ব পরশিব এর দৃষ্টিকোণে বিশ্ব এর কোনো বস্তুরই পৃথক কোনো অস্তিত্ব থাকেনা সেই পরম অবস্থায়, সেক্ষেত্রে উহাকে কোনো তত্ত্ব দ্বারা সীমাবদ্ধ করা তথা উহার উত্তীর্ণ কোনো সত্ত্বার উপস্থিতি এর কল্পনা করা নিরর্থক। তাই মীমাংসা নিমিত্ত ইহা বলিলে কোনো অত্যুক্তি হইবে না যে সেই ৩৭ নং তত্ত্ব মূলত সেই ৩৬ তম শিব তত্ত্বেরই সার্বাত্ম্যাত্মক একটি রূপ মাত্র। 

যদি ৩৬ তত্ত্বের উর্ধ্বে, ৩৭ তত্ত্ব এর অবতারণা করা হইয়া থাকে। তবে বিশ্বোত্তীর্ণ পারমার্থিক স্বতন্ত্রবোধাত্মক ৩৭ নং তত্ত্বের উর্ধ্বে অনবচ্ছিন্নবোধমাত্রাত্মক ৩৮ তম তত্ত্বের কেন অবতারণা করা যাইবে না ? সুতরাং, এক্ষেত্রেও অনাবস্থা দোষ আরোপিত হইয়া থাকে। তবে এই ৩৮ নং তত্ত্বকে যদি সেই পরমশিবেরই চরম অবস্থা হিসেবে মানিয়া নেওয়া যায়, তবে দণ্ডাপুপিকা ন্যায়ানুসার সেক্ষেত্রে অনাবস্থা দোষ এর উৎপত্তি হইবে না। কেননা ৩৭ নং বা ৩৮ নং যাহাই হউক না কেন উহা ৩৬ নং তত্ত্ব শিব তত্ত্বেরই বিশ্বোত্তীর্ণ পরম অবস্থাকে দর্শাইয়া থাকে। সুতরাং ব্রহ্মের উর্ধ্বে ব্রহ্মই বিদ্যমান, অপর কেহ নহে - এই সিদ্ধান্ত অনাবস্থা দোষ মুক্ত। তাই  মালিনীশ্লোকবার্তিকে আচার্য অভিনবগুপ্ত কহিতেছেন -

" এবং চৈস্বপ্রকাশাত্মা সপ্তত্রিংশাত্মকতাৎ পরাঃ |

বৈচিত্র্যাভাসানাং কুর্বান কালং ভাসযতি প্রভু || "

(মালিনীশ্লোকবার্তিক/২/৯৯)

- অর্থাৎ এইভাবেই সেই পরমপ্রভু (শিব) নিজেই ৩৭ তত্ত্বের অতীত (অর্থাৎ ৩৮ নং তত্ত্ব) হিসেবে ভাসিত হইয়া থাকেন।

তাই আগমে সদাশিব কহিয়াছেন - " শিবতত্ত্বাৎ পরং তত্ত্বং ন চৈবেশ্বরগোচরে || " - অর্থাৎ শিবতত্ত্বের উর্ধ্বে আর কোনো তত্ত্ব নেই। 

সুতরাং ন্যায়শাস্ত্রের নিরিখে তথা প্রাচীন আচার্য বচনের নিরিখে এবং প্রামাণিক প্রাচীন আগম বাক্যের নিরিখে কালী তথা কালসংকর্ষিণীর শিব অপেক্ষা পরমত্ববাদ খণ্ডিত হইল।

পূর্বপক্ষ (দাবী)- 

ত্রিক পরম্পরা কোনো শৈব পরম্পরা নহে, ইহা মূলত কৌল পরম্পরা। কেননা এই পরম্পরায় ব্রহ্ম তথা অনুত্তর তত্ত্ব হিসেবে শিব এর উল্লেখ নেই। ত্রিকে অনুত্তর তত্ত্বকে শিব ও শক্তির অতীত একটি অনামা অনুত্তর পরমসত্য হিসেবে কল্পনা করা হইয়া থাকে, যার মধ্য শিব ও শক্তি উভয়ের স্বরূপই বিদ্যমান। ইহা শৈব অদ্বৈত নয়, বরং ইহা পরমাদ্বৈত- কেই তথা অনুত্তরাদ্বৈত মত-কেই দর্শাইয়া থাকে।

সিদ্ধান্তপক্ষ (দাবীর খণ্ডন) - 

আপনার দাবী সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত, স্বপ্রসবিত এবং প্রাচীন ত্রিক আচার্যদের মান্যতা বিরুদ্ধ। যদি ইহা বলা হইয়া থাকে যে সেই অনুত্তর সত্ত্বাই কালসংকর্ষিণী কালী, তবে আপনাদিগের মুখমণ্ডল হর্ষে উৎফুল্লিত হইয়া থাকে কিন্তু যদি তাহাকে শিব বলা হইয়া থাকে তবে তাহা আপনাদিগের তীব্র অসন্তুষ্টির তথা আপত্তির কারণ হইয়া দাঁড়ায়, যাহা আপনাদিগের একাধিক সাক্ষাৎকার হইতে প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণিত। ইহা হইতে আপনাদের প্রচ্ছন্ন শাক্তবাদী চরিত্র-ই উদ্ভাসিত হইয়া থাকে। 

যেথায় প্রাচীন ত্রিকাচার্য সোমানন্দপাদ নিজে শাক্তসিদ্ধান্ত খণ্ডন করিয়া গিয়াছেন, সেক্ষেত্রে প্রচ্ছন্ন শাক্তবাদী কোনো ব্যক্তির নিজস্ব মতামত কদাপি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করিতে পারে না, সে যতবড়ই পণ্ডিত তথা উপাধিধারী হউক না কেন। কেননা ন্যায়ানুসার, আপ্ত পুরুষ তথা প্রাচীন পরম্পরাগত আচার্যদের বক্তব্যই প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করিয়া থাকে।

খণ্ডন পর্বের অন্তিম অংশে আসিয়া অধিক বাক্যব্যয় ব্যতীত আলোকচিত্রের মাধ্যমে দর্শিত শব্দপ্রমাণ তথা প্রাচীন আচার্য বচনের মান্যতানুসার আপনাদের মত নিরসন করিবার চেষ্টা করিব। 

কাশ্মীর ত্রিক দর্শন আসলেই কোন দর্শন শৈব, শাক্ত নাকি কৌল তার যাচাই সরাসরি ত্রিক আচার্য বচন, প্রামাণিক পণ্ডিতদের মান্যতা এবং ত্রিক শাস্ত্রের নিরিখে নিম্নে করা হইল -

উপরে প্রদত্ত প্রমাণ হইতে অর্থাৎ সাক্ষাৎ আচার্য বচন হইতে এই কথা স্পষ্ট যে তাহাদিগের দ্বারা প্রতিপাদিত যে দর্শন, যেই দর্শন প্রতিপাদন হেতু তাহারা উক্ত ন্যায়প্রকরণ শাস্ত্রের (শিবদৃষ্টি) সৃজন করিয়াছেন, সেই দর্শন তাহাদিগ কর্তৃক 'শৈব' নামে উল্লিখিত হইয়াছে অর্থাৎ শৈব  দর্শন/ শিব শাসন হিসেবে কথিত হইয়াছে। ' শৈব ' যার ব্যুৎপত্তি - শিব+অণ্ - অর্থাৎ ইহা শিব হইতে সম্বন্ধিত, শিব উপাসক গুরুপরম্পরা। 

নিম্নে আরও দেখিব -

সুতরাং উপরে প্রদত্ত ত্রিক পরম্পরার একাধিক বিদগ্ধ পণ্ডিত তথা আচার্যদিগের মান্যতার নিরিখে ইহা স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হইয়া থাকে যে ত্রিক একটি শৈব দর্শন, ইহার অন্তর্গত একটি আচার তথা উপঘরানা হল কুল তথা কৌলঘরানা। সুতরাং, ত্রিক দর্শন তথা পরম্পরাকে একটি অশৈব পরম্পরা বলিয়া ঘোষণাকারী ব্যক্তিবর্গের দাবী সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বলিয়া পরিগণিত হইল।

এবার আসিব ত্রিক মতের অনুত্তরতত্ত্ব প্রসঙ্গে।

তাছাড়া ভগবান অভিনবগুপ্ত তাহার যে পরাত্রিশিকা বিবৃতি শাস্ত্রে অনুত্তর এর স্বরূপ সম্পর্কে ১৬ প্রকার বর্ণন করিয়া গিয়াছেন, সেই শাস্ত্র থেকেই এবার আমরা দেখে নেব, কে সেই অনুত্তর সত্ত্বা -

এবার এনারা দাবী করিতে পারেন যে, পরমশিব শৈব দর্শনের শিব নহে, ইহা শিবের অতীত একটি সত্ত্বা। সেক্ষেত্রে তাহাদের এইরূপ অনাবস্থা দোষ পূর্ণ দাবীর নিরাকরণ আচার্য জয়রথ তাঁর তন্ত্রালোক ভাষ্যে নিজেই করিয়া গিয়াছেন -

উপরে প্রদত্ত একাধিক প্রামাণিক আচার্য বচনানুসার ইহা স্পষ্টভাবেই সিদ্ধ হইয়া থাকে যে পরমাদ্বৈত বা অনুত্তরাদ্বৈত প্রভৃতি শব্দমালা প্রকারান্তর সেই শৈবাদ্বৈত-কেই উদ্ভাসিত করিয়া থাকে, ইহাই শাস্ত্র সিদ্ধ এবং প্রাচীন আচার্য পরম্পরা সিদ্ধ মান্যতা। আচার্য শিতিকণ্ঠও তাই কৌলসূত্রে বলিয়াছেন -

" তদুপলব্ধমেব তত্ত্বমেকো দেবঃ || "  - অর্থাৎ - কেবল সেই এক ও অদ্বিতীয় দেব-ই (পরমব্রহ্ম) রয়েছেন, যাহাকে কেবলমাত্র গুরুপরম্পরা গত ভাবে প্রাপ্ত চৈতন্যের কিরণ দ্বারাই উপলব্ধি করা সম্ভব হইয়া থাকে, তিনিই শিব।

' ভাবস্বভাববৎ স্বতঃ স্বাতন্ত্রং কুলেশিতুঃ ... ব্যুত্থানবত্তু শিবাদ বিশ্বোদযঃ || "  - কুলেশ্বরের (অর্থাৎ শিব) এই ভাব-স্বভাব-ই (অহমতা) স্বাভাবিকী স্বাতন্ত্র্য শক্তি হিসেবে পরিগণিতা হইয়া থাকেন (এবং এই শক্তির দ্বারাই) (সেই পরমব্রহ্ম) শিব হইতে (সমগ্র) বিশ্ব উদিত হইয়া থাকে ।

সেই একোমেবাদ্বিতীয় অনুত্তরসত্ত্বাকে বোঝাইতে আচার্য সোমানন্দপাদ তথা উৎপলদেবও " ইদং স একো রুদ্রঃ", "পুরুষ এবেদং সর্বম্ " ইত্যাদি শ্রুতি বাক্যের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন।

সুতরাং ত্রিক দর্শনের শৈবত্ব নিরাস পুরোপুরি ভাবে খণ্ডিত করা হইল। ইহা যে সম্পূর্ণরূপে একটি শৈব দর্শন তা প্রতিপাদিত হইল। সুতরাং বিরোধীপক্ষের এহেন ভ্রান্ত দাবী তাহাদের শৈব-বিমুখতা এবং শৈব দর্শন, ধারা এসব সম্পর্কে সামগ্রিক অজ্ঞতা- কেই দর্শাইয়া থাকে। লৌহকারের স্বর্ণ বিষয়ক অভিমত যেমন শোভনীয় নহে, তেমনই প্রচ্ছন্ন শাক্তবাদীগণ কর্তৃক উত্থিত শৈব পরম্পরা বিষয়ক কোনো মন্তব্যও শোভনীয় নহে। এক্ষেত্রে উপাধি তথা বাহ্যিক দলিল নয়, বরং প্রাচীন আচার্য পরম্পরা সম্মত জ্ঞান ও মান্যতাই মূল বিচার্য।  

শেষে প্রখ্যাত ত্রিক স্কলার নবজীবন রাস্তগী মহাশয়ের স্বীকারোক্তি দেখিয়া আজকের আলোচনার ইতি টানিব -

পরিশেষে শ্রীমৎ অভিনবগুপ্তাচার্যপাদপদ্মে সমগ্র‌ খণ্ডন-মণ্ডন পর্বটি সমর্পিত করিলাম |

তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু |

শিব ॐ তৎসৎ |

👉মূল খণ্ডনে - ভগবান শ্রীসোমানন্দপাদ, উৎপলাচার্য এবং আচার্য শ্রী জয়রথ।

👉বিস্তারিত খণ্ডন, ব্যাখ্যা ও অনুবাদে - শ্রীশনিরাজ

👉 প্রচারে - © International Shiva Shakti Gyan Tirtha