ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে করা শৈবদর্শনের উপর আরোপিত আপত্তির নিরসন (১)

🚩বিভিন্ন আচার্যদের ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে শৈব সম্প্রদায়কে নিয়ে করা সমালোচনার সঠিক বিশ্লেষণ এবং শৈব সম্প্রদায়ের উপর করা আপত্তির সঠিক জবাব --

এখানে দুটি পর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

লেখনীতে - শ্রী রোহিত কুমার চৌধুরী শৈবজী 

প্রচারে - ISSGT(International Shiva Shakti Gyan Tirtha)


॥ প্রথম পর্ব ॥


আজকাল প্রায়শই বৈষ্ণববাদী আর স্মার্তবাদীদের মুখে একটাই কথা শোনা যায় যে, ব্রহ্মসূত্রের 'পত্যাধিকরণে' নাকি শৈব সম্প্রদায়কে খণ্ডন করা হয়েছে , বিভিন্ন অদ্বৈতবাদী আচার্য, বৈষ্ণব আচার্য এবং ব্যাসদেব স্বয়ং নাকি ব্রহ্মসূত্রে শৈব সম্প্রদায়কে খণ্ডন করে গেছেন। সুতরাং তাদের সেই দাবির প্রত্যুত্তর হবে এই পোস্ট।


♦️তাঁদের দাবি - পূর্ব পক্ষ - 


👉শিব কর্তৃক সৃষ্ট আগম মতালম্বীদের মাহেশ্বর বলা হয়। আর এদের সিদ্ধান্ত অবৈদিক। 


♦️আমাদের তরফ থেকে জবাব (উত্তর পক্ষ) - 


👉ভাষ্যকার/ টীকাকার দাবি করেছেন যে - আগম মতালম্বীদের মাহেশ্বর বলা হয়। কিন্তু এই দাবি মান্য নয়। কেননা মাহেশ্বর নামের কোনো আগমোক্ত শৈব সম্প্রদায় নেই।  কোনো শৈব শাস্ত্রে বা শৈব গুরু পরম্পরাগত কোনো শাস্ত্রে এরকম কোনো শব্দের উল্লেখ নেই, তাই শব্দপ্রমাণহীন দাবি অমান্য। 


♦️পূর্বপক্ষ - 


👉এখানে মাহেশ্বর বলতে অনুমান প্রমাণ এর ভিত্তিতে বুঝতে হবে মাহেশ্বর এর উপাসক অর্থাৎ শৈবদের বোঝানো হয়েছে । যারা অবৈদিক। শব্দপ্রমাণ না থাকলে অনুমান প্রমাণ কাজে আসে।


♦️উত্তর পক্ষ - 


👉ভাষ্যে মাহেশ্বরদের শৈব, পাশুপত, কারুনিক এবং কাপালিক শ্রেণী তে বিভক্ত করা হয়েছে। সুতরাং পাশুপতেরা কি শৈবদের থেকে আলাদা ? এরা কি শৈব নয়? আর মাহেশ্বর মানেই যদি শৈব বোঝায় তাহলে তার অন্তর্গত যে শৈব পরম্পরার উল্লেখ করা হয়েছে ভাষ্যে সেটি কি আলাদা কিছু ? এর উত্তর আপনাদের কাছে অমীমাংসিতই রয়ে গেল।


♦️পূর্ব পক্ষ-  


👉প্রাচীনকালে মাহেশ্বর মতের অনুগামী যেমন - শৈব, পাশুপত, কাপালিক, কারুনিক এরা  সকলেই শিব উপাসক এবং বেদ বিরোধী।  কেননা বেদান্ত মতে ব্রহ্ম (ঈশ্বর) হলেন জগতের নিমিত্ত ও উপাদান উভয় কারণ।  কিন্তু মাহেশ্বর মতে ঈশ্বর হলেন জগতের নিমিত্ত কারণ মাত্র এবং তিনিই প্রধান ও জীবাত্মাগুলির নিয়ন্তা, যাঁরা তাঁর থেকে ভিন্ন।   তাই তাঁদের বিরুদ্ধে বাদরায়ণ বেদান্তসূত্রে  বলেন-


‘পত্যুঃ অসামঞ্জস্যাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৩৭)।।


--  ঈশ্বর জগতের নিমিত্তকারণ মাত্র, উপাদানকারণ নন- পাশুপত শৈব সম্প্রদায়ের শ্রুতিবিরুদ্ধ এই মতবাদ গ্রহণীয় নয় ।


♦️উত্তর পক্ষ -  


👉পাশুপত সম্প্রদায় একটি প্রাচীন শৈব সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায় অদ্বৈতমার্গী ছিল। যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বৈদিক আচার্য শ্বেত ঋষি।  এই পাশুপত সম্প্রদায়ের ভিত্তিই ছিল  শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ( যার মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি হলেন  শ্বেত বা শ্বেতাশ্বতর), কৈবল্য উপনিষদ, অথর্বশির উপনিষদ, জাবাল উপনিষদ প্রভৃতি শ্রুতি শাস্ত্র। তাছাড়া পুরো পাশুপত শৈব ধর্ম  যদি অবৈদিকই হয় তাহলে প্রাচীন বৈদিক ও পৌরাণিক ঋষিরা, মুনিরা  যারা পাশুপত যোগাচার্য ছিলেন, যে পরম্পরায় স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও দীক্ষিত ছিলেন , তাহলে তারাও তো অবৈদিক হিসেবে পরিগণিত হবেন। সুতরাং এই মতকে অবৈদিক বলা কখনো যুক্তিসম্মত নয়।


👉এখন সরাসরি বৈদিক পাশুপতদের মান্য শাস্ত্র থেকে প্রমাণ সহ দেখে নেব যে ব্রহ্ম জগতের উপাদান কারণ কিনা - 


১.  " ॐ অগ্নিরিতি ভস্ম বায়ুরিতি ভস্ম জলমিতি ভস্ম স্থলমিতি ভস্ম ব্যোমেতি ভস্ম সর্বংহ বা ইদং ভস্ম মন এতানি চক্ষূংষি ভস্মানি যস্মাৎ ব্রতমিদং পাশুপতং যৎ  ভস্মনাঙ্গানি সংস্পৃশোৎ তস্মাৎ ব্রহ্ম তদেতৎ পাশুপতং পশুপাশ বিমোক্ষণায় || ৫ || "

"  (অথর্বশির উপনিষদ) 


-🟥-  বিশ্লেষণ ---  অগ্নি , বায়ু , জল , পৃথিবী ও আকাশ এই সকল পদার্থই ভস্ম স্বরূপ (শিবের বিভূতিস্বরূপ) এবং মন ও চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়গণও ভস্ম স্বরূপ । ভস্মধারণই হল আসলে (আমিও সেই শিবস্বরূপ, শিবের বিভূতিস্বরূপ -- জীব ব্রহ্ম অভেদ তত্ত্ব)পশুপতির ব্রত (পাশুপত ব্রত) ।  যেসকল জীব এইরূপ ভস্ম ধারণ ব্রত অবলম্বন করে একাগ্রচিত্তে সেই পরমপুরুষ পরমাত্মাকে ধ্যান করে (আত্ম উপলব্ধি বা প্রত্যভিজ্ঞা) , তারা অনায়াসে এই ভব বন্ধন হইতে মুক্ত হয়ে পরমপদ লাভ করিতে পারে (অর্থাৎ 'অহং ব্রহ্মাস্মি' অবস্থা লাভ করতে পারে) । 



২. " যো দেবো অগ্নৌ যো অপ্সু যো‌ বিশ্ব ভুবনমাবিবেশ‌ |

যো‌ ঔষধীষু যো বনস্পতিসু তস্মৈ দেবায় নমোনমঃ || ১৭ || "

(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/ প্রথম অধ্যায়)


---  যে দেব ( রুদ্র= পরশিব) অগ্নি, জল প্রভৃতি ভূত সহ সমগ্র বিশ্ব চরাচরকে ব্যাপ্ত করে আছেন, যিনি সাক্ষাৎ বনস্পতি স্বরূপ, ঔষধীস্বরূপ সেই পরম দেবকে পুনঃ পুনঃ  প্রণাম করি।


৩. " যোহগ্নৌ‌ রূদ্র যোহপ্-স্বন্তর্য ওষধীর্বীরুধ আবিবেশ |

য ঈমা বিশ্বা ভুবনানি চক্লপে তস্মৈ রুদ্রায় নমোহস্ত্বগ্নয়ে |  "

(অথর্বশির উপনিষদ/‌৬)


-- অগ্নি, জল , বনস্পতি প্রভৃতি সবকিছুই রুদ্র ( পরশিব = ব্রহ্ম) স্বরূপ অর্থাৎ জগতের সকল পদার্থেই সেই রুদ্র প্রবিষ্ট হয়ে রয়েছেন। যে রুদ্র সমগ্র বিশ্ব চরাচর , বিশ্বভুবন জুড়ে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন সেই অদ্বিতীয় রুদ্রকে পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি।


৪. "যোবৈ রুদ্রঃ স ভগবান্‌ যশ্চ‌ বিশ্বং‌ তস্মৈ বৈ নমোনমঃ‌ || ২৫ || ২ ||"

(অথর্বশির উপনিষদ)


- যে রুদ্র ভগবান (পরশিব = ব্রহ্ম) সাক্ষাৎ বিশ্বচরাচর রূপে পরিব্যাপ্ত রয়েছেন সেই রুদ্রকে পুনঃ পুনঃ নমস্কার করি।


-🟥-   সুতরাং, পাশুপত মত যে সম্পূর্ণ ভাবে বেদান্ত এবং বেদের এর পরিপন্থী এবং পারমার্থিক অবস্থায় জীব - ব্রহ্ম অভেদ তত্ত্বে বিশ্বাসী, একথা প্রাচীন বৈদিক পাশুপতদের মান্য শাস্ত্র (শ্রুতিশাস্ত্র) দ্বারাই  প্রমাণিত হল,  সাথে আরো প্রমাণিত হল যে ব্রহ্মই জগতের উপাদান কারণ। ব্রহ্মই জীব রূপে প্রতিভাত হয়েছে।  


 ♦️এই প্রাচীন বৈদিক পাশুপত মতের প্রতিষ্ঠাতা শ্বেত ঋষিরই শিষ্য পরম্পরার একজন ছিলেন - শৈব বৈদান্তিক পণ্ডিত পাশুপত আচার্য শ্রীকণ্ঠ শিবাচার্য তিনি নিজে প্রস্থানত্রয়ীর উপরে শৈবভাষ্য করে গেছেন। অর্থাৎ  পাশুপত জ্ঞানকে তিনি শিবাদ্বৈত  দৃষ্টিকোণে প্রতিভাত করে গেছেন ( নাগালিঙ্গা শাস্ত্রীর মত)। তিনি নিজে তাঁর ভাষ্যে ব্রহ্মকে জগতের নিমিত্ত কারণ এবং উপাদান কারণ উভয়ই বলে গিয়েছেন। 


👉শ্রী কণ্ঠ শিবাচার্য তাঁর ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে বলছেন - 


শিবস্যৈবোপাদানত্বমবগম্যতে |

শক্ত্যাদি চ পৃথিব্যন্তং শিবতত্ত্বসমুদ্ভবম্ |

তেনৈকেন তু তদ্‌ ব্যাপ্তং মৃদা মৃদাকুম্ভাদিকং যথা "

 ইত্যাদিনা তত্রৈব শিবেনোপাদানভূতেন জগদ্ব্যাপ্তম্  মৃদ্ধটাদিন্যায়েনা অবগম্যতে । (ব্রহ্মসূত্র - নীলকণ্ঠভাষ্য /২ / ৩৮) 


---- শিব থেকেই শক্তি তত্ত্ব সহ পৃথিবী তত্ত্ব প্রকটিত হয়। মাটির কোনো পাত্রে যেমন মাটি ব্যাপ্ত থাকে তেমনি জগৎ চরাচরে উপাদান রূপে সেই শিবই ব্যাপ্ত রয়েছেন।


-🟥-   সুতরাং সম্পূর্ণ পাশুপতমত বেদবিরোধী অথবা  পাশুপতিরা ঈশ্বরকে শুধুমাত্র উপাদানকারণ মানেন - পূর্বপক্ষের এই দাবি অসত্য প্রমাণিত হল।


♦️পূর্ব পক্ষ- 


👉 পাশুপত মতের প্রবক্তা লকুলীশ মহারাজ। তাহলে শ্বেত ঋষি পাশুপত সম্প্রদায়ের প্রবর্তক এই কথার শাস্ত্র প্রমাণ কোথায়?


👉 প্রাচীন বৈদিক আর পৌরাণিক ঋষি মুনিরা যে পাশুপত মতের প্রচারক ছিলেন তার শাস্ত্র প্রমাণ কোথায়?


👉 শ্রীকণ্ঠ আচার্যের গুরু পরম্পরা যে ঋষি শ্বেত থেকে এসেছে এসেছে তার শাস্ত্র প্রমাণ কোথায় ? কেননা ওনাদের পরম্পরা তো আলাদা । শ্বেত ঋষি কর্তৃক প্রচারিত পরম্পরা উত্তরপক্ষের দাবি মতে বৈদিক পাশুপত পরম্পরা আর আচার্য শ্রীকণ্ঠ কর্তৃক প্রচারিত পরম্পরা তো শুদ্ধশৈব / শ্রৌত শৈব পরম্পরা। তাহলে উভয়ই এক কেমন করে হয় ? 


♦️ উত্তর পক্ষ-


👉শিব মহাপুরাণের বায়বীয় সংহিতার উত্তর খণ্ডের ৯ নং অধ্যায়ে মহর্ষি উপমন্যু শ্রী কৃষ্ণকে বললেন -


" বারো কল্পের সপ্তম মন্বন্তরে যুগক্রমে আঠাশজন যোগাচার্য প্রকটিত হন।  এনাদের নাম হল- 

শ্বেত, সুতার, মন্দন, সুহোত্র, কঙ্ক, লৌগাক্ষী, জৈগীষব্য ..... সর্বশেষ নকুলীশ্বর প্রমুখ " ।


(শিবমহাপুরাণ/ বায়বীয় সংহিতা/উত্তর খণ্ড/ ৯ নং অধ্যায়)


---- সুতরাং শাস্ত্রে স্পষ্টভাবেই শব্দ প্রমাণ পাওয়া যায় যে, প্রাচীন বৈদিক পাশুপত মতের প্রথম আচার্য তথা প্রতিষ্ঠাতা হলেন ঋষি শ্বেত।


👉 শিবমহাপুরাণের বায়বীয় সংহিতার উত্তর খণ্ডের 9 নং অধ্যায়ে স্পষ্ট ভাবেই বহু বৈদিক ও পৌরাণিক ঋষি, মুনিদেরকে পাশুপত আচার্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন সাক্ষাৎ মহর্ষি উপমন্যু - তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম হল-


" শ্বেত, শ্বেতশিখ, শ্বেতাশ্ব, জৈগীষব্য, কপিল, সনৎকুমার, সনক, সনন্দন, সনাতন, দুন্দুভি, শতরূপ, পরাশর, গর্গ, ভার্গব, অঙ্গিরা, অত্রি, গৌতম, কশ্যপ, বশিষ্ঠ, বিরজা, বেদশিরা মুনি, উশনা, চ্যবন, বামদেব, শম্বুক, আশ্বলায়ন, অক্ষপাদ, কণাদ, শালিহোত্র, জৈমিনী ইত্যাদি।"   


 (শিবমহাপুরাণ/ বায়বীয় সংহিতা/উত্তর খণ্ড/ ৯ নং অধ্যায়)


👉 " রুরুর্দধীচোऽগস্ত্যশ্চ উপমন্যুমহাযশাঃ || ১৫ ||

তে চ পাশুপতাজ্ঞেয়াঃ সংহিতানাং প্রবর্তকাঃ | ১৬ |"


(শিবমহাপুরাণ/ বায়বীয় সংহিতা / উত্তর খণ্ড /৩২ নং অধ্যায়) 


 --- রুরু , দধীচ , অগস্ত্য এবং মহাযশা উপমন্যু । এঁনারা প্রত্যেকে পশুপতির উপাসক এবং পাশুপত সংহিতা সমূহের প্রবর্তক।


👉 শ্বেতাচার্যের সাথে সম্পর্ক নিরূপনার্থে  শ্রীকণ্ঠ শিবাচার্য নিজেই তাঁর ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যের প্রারম্ভেই বলেছেন -


" নমশ্বেতাভিধানায় নানাগমবিধায়িনে |

কৈবল্যকল্পতরবে কল্যাণগুরবে নমঃ || "


(ব্রহ্মসূত্র- নীলকণ্ঠভাষ্য/ মঙ্গলাচরণ/ ৪‌নং শ্লোক)



👉এপ্রসঙ্গে শ্রুত শৈব বিশিষ্টাদ্বৈত আচার্য মুডিগোণ্ডা নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী তাঁর ব্রহ্মসূত্রের টীকায় স্পষ্টভাবেই‌ বলে গেছেন - 


" মহাপাশুপতব্রতদীক্ষাপ্রদং চ দেশিকং নমস্করোতি নম ... অথ পাশুপতদীক্ষাপ্রদত্বং ধ্বনয়তি কৈবল্যকল্পতরব....শ্বেতপদেন শৈবশাস্ত্রপ্রচারণার্থ ভবতীর্ণানাং‌ অষ্টবিংশতের্যোগাচার্যাণাং আদ্যস্য শ্বেতাচার্যস্যাহপি নমস্কারঃ সূচিতঃ । "


(ব্রহ্মসূত্র টীকা - শিব চিন্তামনি প্রভা - নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী)


 ---- অর্থাৎ,  মহাপাশুপতব্রত দীক্ষা প্রদানকারী, কৈবল্য-কল্পতরুস্বরূপ গুরু আচার্য শ্বেতকে প্রণিপাত জানানোর কথা এখানে উল্লেখিত হয়েছে। 'শ্বেত' পদের দ্বারা ২৮ জন পাশুপত শৈব যোগাচার্যের  প্রথম জন শ্বেত আচার্যের কথা বলা হয়েছে এবং তাঁকে নমস্কার জানানো হয়েছে । 


👉অন্যদিকে শৈব বৈদান্তিক পণ্ডিত জগৎগুরু নীলকণ্ঠ শিবাচার্যও যে একজন পাশুপত ব্রতধারী ছিলেন সেটির প্রমাণ নাগালিঙ্গা শাস্ত্রীজিই তাঁর টীকায় দিচ্ছেন - 


" পাশুপতব্রতধারীণাং অষ্টাদশবর্ণানাং‌ অয়মেব শিবাদ্বৈত সিদ্ধান্ত বোধক শারীরীক ব্রহ্মসূত্র মীমাংসা ভাষ্য মেরী রচন্ ।‌‌ এতস্যৈব নীলকন্ঠভাষ্যমিতিনামাংতরম্ " 


(ব্রহ্মসূত্র টীকা - শিব চিন্তামনি প্রভা - নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী)


-🟥-  সুতরাং আপন পরম্পরাভুক্ত শৈব আচার্য নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী কর্তৃক রচিত টীকা থেকে শব্দপ্রমাণ সহ দেখানো হল যে - প্রাচীন বৈদিক পাশুপত শৈবপরম্পরার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ঋষি শ্বেত। তাঁরই শিষ্য ক্রম পরবর্তীকালে এসে পৌঁছেছে শ্রীকণ্ঠ শিবাচার্য পর্যন্ত। সেই জন্য শ্রী কন্ঠ আচার্যও প্রকৃতপক্ষে একজন বৈদিক পাশুপত শৈব ছিলেন, পাশুপত দীক্ষাধারী একজন শৈব ছিলেন। তিনি শুধুমাত্র সেই বৈদিক পাশুপত ঘরানাকেই  পরবর্তীকালে শিবাদ্বৈত দর্শন ভিত্তিক শ্রুত শৈব সিদ্ধান্ত এর রূপ দেন, যাদের শাস্ত্রগত ভিত্তি প্রায় একই ছিল।


♦️পূর্ব পক্ষ- 


👉"সম্বন্ধানুপপত্তেশ্চ।।" (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৩৮)


ভাবার্থ : ঈশ্বর এবং জীবের মধ্যে কোন সম্বন্ধ সম্ভবপর না হওয়ায় এই মত গ্রহণীয় নয় । 


--- সেশ্বর সাংখ্য মত এবং পাশুপত মতে ঈশ্বর, প্রধান(মায়াপ্রকৃতি)এবং পুরুষ (জীবাত্মা) উভয়েই  অংশরহিত, সর্বব্যাপী, অব্যয় এবং পৃথক সত্ত্বা।  সেইজন্য  তাদের পরস্পরের  মধ্যে কোন সম্বন্ধস্থাপন সম্ভব নয়।  বেদান্ত-মত গ্রহণ করলে কিন্তু এজাতীয় আপত্তি উঠতে পারে না। কারণ বেদান্ত মতে ব্রহ্ম আর মায়া-প্রকৃতি এর সম্বন্ধ হলো অনির্বচনীয়-তদাত্ম্য । গন্ধ যেহেতু পুষ্পের আশ্রিত সেই জন্যই তাদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব, নচেৎ তা সম্ভোপর হত না । সুতরাং পশুপতি (ব্রহ্ম) কিভাবেই বা পশুকে(পুরুষ) নিয়ন্ত্রণ করবে? কেননা তারা তো এক সত্ত্বা। তাহলে পাশুপত মত তো বেদান্তের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। সুতরাং সেই মত তো অমান্য।


♦️উত্তর পক্ষ- 


পূর্বেই শাস্ত্র থেকে দেখানো হয়েছে যে বৈদিক পাশুপতরা ঈশ্বর এবং পুরুষ বা জীবাত্মাকে পৃথক মেনে যাননি। পুনরায় প্রমাণ স্বরূপ আমরা দেখে নেবো বৈদিক পাশুপতদের শাস্ত্র  ভস্মজাবাল উপনিষদ কি বলছে এব্যাপারে - 


ভস্ম জাবাল উপনিষদে পরমেশ্বর শিবকে বলা হয়েছে - 

" পশুপাশ বিমোচকং পুরুষং " (ভস্ম.জা.উ/২/৭)। 


--- তিনিই (পশুপতি শিব) একমাত্র পশুপাশ বিমোচনকারী।


👉তাছাড়া শ্রুতি শাস্ত্র পশুপতির সম্পর্ক আরো কি বলছে দেখে নেওয়া যাক ---


" য ঈশে পশুপতিঃ পশূনাং চতুষ্পদামুত যো দ্বিপদাম্ |

নিষ্ক্রীতঃ স যজ্ঞিয়ং ভাগমেতু রায়স্পোষা যজমানং সচন্তাম্ || ১ || 


(অথর্ববেদ সংহিতা / দ্বিতীয়কাণ্ড/ ৩৪ নং সূক্ত)


--- ( যঃ পশুপতিঃ ) সেই পশুপতি ( পশূনাং চতুষ্পদামুত যো দ্বিপদাম্ ঈশে ) সমস্ত দ্বিপদ চতুষ্পদাদি জীবেদের ঈশ্বর । ( সঃ নিষ্ক্রীতঃ ) আপনি পূর্ণ রীতিতে প্রাপ্য ( যজ্ঞিয়ং ভাগমেতু ) এই যজ্য ভাগকে গ্রহণ করুন ( রায়স্পোষা যজমানং সচন্তাম্ ) এবং পুষ্টি ধনাদি যজমানকে প্রদান করুন ।


🔘----(সায়ণ ভাষ্য)---- " যঃ পশুপতি পশূনাং পালয়িতা রুদ্রঃ চতুষ্পদাম্ গবাদীনাং পশূনাম্ ঈশে ইষ্টে নিয়ন্তা ভবতি।‌  উতঃ অপি চ যঃ পশুপতির্দ্বিপদাম্ মনুষ্যাদীনাং চ ইষ্টে । ঈশ ঐশ্বর্যং... ভুবনস্য ভূতজাতস্য রেতঃ কারণং যাগদ্বারেণ উৎপত্তিহেতুম্ । " 


-- সায়ণ ভাষ্যে স্পষ্ট ভাবেই রুদ্র (শিব) কে পশুপতি বলা হয়েছে । তিনি একাধারে যেমন চতুষ্পদ পশুদেরও ইষ্ট আবার একাধারে দ্বিপদী মনুষ্যদেরও ইষ্ট। তিনি সমগ্র বিশ্বভূতের এবং পঞ্চভূত হতে জাত সমগ্র পদার্থের কারণবীজ , উৎপত্তিহেতু।


👉  শ্রুতি থেকে আরো দেখে নেবো --


" নমো হিরণ্যবাহবে সেনান্যে | দিশাং চ পতযে নমো | নমো বৃক্ষেভ্যো হরিকেশেভ্যঃ | পশূনাং পতয়ে নমো | ..... পতয়ে নমো | নমো হরিকেশাযোপবীতিনে | পুষ্টানাং পতযে নমোঃ || ১৭ || ..... ব্যাধিনেহন্নানাং পতযে নমো | ..... জগতাং পতয়ে নমো | নমো রুদ্রাযাততাযিনে ক্ষেত্রাণাং পতযে নমো | ...... বনানাং পতযে নমঃ || ১৮ || ...... বৃক্ষাণাং পতযে নমো | নমো ভুবন্তযে বারিবস্কৃতাযৌষধীনাং পতয়ে নমো | ..... কক্ষাণাং পতযে নমো | ........  নমো নিচেরবে পরিচরাযারণ্যানাং পতয়ে নমঃ || ২০ || "


(কৃষ্ণ যজুর্বেদ/ তৈত্তিরীয়‌ সংহিতা/চতুর্থ কাণ্ড/ পঞ্চম প্রপাঠক/  শ্রী রুদ্রম)


👉 ঈশ্বর গীতায় পরমেশ্বর শিব কি বলছে দেখে নেওয়া যাক ---


" আত্মানঃ পশবঃ প্রোক্তাঃ সর্ব্বে সংসারবর্ত্তিনঃ |

তেষাং পতিরহং দেবঃ স্মৃতঃ পশুপতির্বুধৈঃ || ১৮ ||

মায়াপাশেন বদ্ধানাং মোচকহন্যো ন বিদ্যতে |

মামৃতে পরমাত্মানং ভূতাধিপতিমব্যয়ম্ || ২১ || "


(কূর্মপুরাণ/‌ উপরিভাগ/‌ঈশ্বরগীতা/ ৭নং অধ্যায়-বিভূতিযোগ)


---- সংসারবর্ত্তী সমস্ত আত্মাই পশু নামে অভিহিত , আমিই তাহাদের ঈশ্বর বলিয়া সকলে আমাকে পণ্ডপতি কহে আমি স্বীয় লীলায় মায়াপাশে ঐ পশুদিগকে বন্ধন করি , এবং ভূতপত্তি পরমাত্মা অব্যয় আমি ভিন্ন কেই মায়াপনবদ্ধ পশুগণের মোচনকর্তা নাই।


-🟥- সুতরাং পরমেশ্বর শিবই যে আসলেই সমগ্র বিশ্ব চরাচরের পতি, মুক্তিদাতা, পশুপাশ বিমোচনকারী এই কথা পূর্ণ ভাবে শ্রুতি এবং স্মৃতি সিদ্ধ।


♦️ পূর্বপক্ষ -


👉 ব্রহ্ম বা শিব যদি পশুপতি হন তাহলে নিশ্চয়ই তিনি এবং পশু ( পাশ বদ্ধ জীবাত্মা, পুরুষ) আলাদা সত্ত্বা।

তাহলে কি  বাদরায়ণ‌ এর দাবি ভুল ? বেদান্ত এর দাবি ভুল ? 'অহং ব্রহ্মাস্মি', 'তত্ত্বমসি', 'প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম', 'অয়মাত্মা‌ ব্রহ্ম' প্রভৃতি মহাবাক্যগুলি কি ভুল ? শ্রুতি কি করে পরস্পর বিরোধী হতে পারে, কেননা শ্রুতির স্রষ্টা এক পরমেশ্বর। এরফলে এটা ন্যায় বিরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে ।


♦️উত্তরপক্ষ - 


👉 কখনোই ইহা ন্যায় বিরুদ্ধ হচ্ছে না কেননা শ্রুতি শাস্ত্র কখনই পরস্পর বিরোধী হতে পারে না। কোনো সূক্ষ্ম অর্থকে যখন স্থূল আকারে প্রতিভাত করা হয় তখন এইরূপ আপাত বিরোধাভাস এর সৃজন হয়। এর নিরসন এর জন্যই সঠিক মীমাংসা এর দরকার পড়ে।


🟥মীমাংসা এবং পশুপতি শব্দের যথার্থ অর্থ - 


আসলে শিবমায়ার কারণে আমরা শিবের পশুপতি স্বরূপের অন্তর্নিহিত অর্থ জানতে পারি না। আমরা শিবমায়ার কারণে, অপরাবিদ্যার কারণে দ্বৈতভাবাপন্ন হয়ে মাত্র এটা জেনে থাকি যে, শিব (পশুপতি) হচ্ছেন পশু বা জীবাত্মাদের প্রভু, নিয়ন্ত্রণকারী। উভয়েই হল পৃথক সত্ত্বা। কিন্তু আসলেই এর পেছনে আলাদা অর্থ নিহিত রয়েছে। এখন‌‌ বৈদিক পাশুপত শাস্ত্র এব্যাপারে কি বলছে সেটি দেখে নেবো - 


👉" বিশ্বাত্মানং‌ একং‌ অদ্বৈতং নিষ্কলং‌‌ নিষ্ক্রিয়ং শান্তং‌ শিবং অক্ষরং‌ অব্যয়ম্ ..." (ভস্মজাবাল উপনিষদ‌/২/৭)


👉 " ব্রহ্ম সোমোহং পবনঃ সোমোহং পবতে সোমোহং....  পৃথিব্যা সোমোহং জনিতাহগ্নেঃ‌ সোমোহং জনিতা সূর্যস্য সোমোহং জনিতেন্দ্রস্য সোমোহং জনিতোত বিষ্ণোঃ সোমোহহমেব ....দেবানাং ভূর্ভূবস্বরাদীনাং সর্বেষাং লোকানাং  চ। ......   বিশ্বাধিকো রুদ্রো মহর্ষিঃ।  হিরণ্যগর্ভাদীনহং  জায়মানান্পশ্যামি। যো রুদ্রো অগ্নৌ যো অপ্সু য ঔষধীষু যো রুদ্রো বিশ্বা ভুবনাবিবেশৈবমেব।  অয়মেব আত্মান্তরাত্মা.... সোহহং পৃথিবী।  সোহহমাপ। সোহহং তেজ।  সোহহং বায়ু।  সোহহং কালঃ।  সোহহং দিশ।  সোহহমাত্মা‌।‌ ময়ি সর্বং প্রতিষ্ঠিতম্ । ব্রহ্মাশিবো মে অস্তু সদাশিবোম্ | 


 (ভস্ম.জা.উ/২/১২)


----- উপরইউক্ত শ্লোক গুলিতে স্পষ্ট ভাবেই বলা হয়েছে যে - শিব একাধারে পশুপাশ বিমোচনকারী পশুপতি আবার পরক্ষনেই বলা হয়েছে যে তিনিই - বিশ্বাত্মা (বিশ্ব চরাচরের সকল জীবের অন্তর্নিহিত আত্মা), তিনিই অদ্বৈত, অব্যয়, অক্ষর ব্রহ্ম, তিনিই সোম, সূর্য, চন্দ্র, ইন্দ্রাদি সর্বদেবতা।  ভূলোক, ভূবর্লোক, স্বর্গলোক ইত্যাদি  সমগ্র বিশ্ব চরার তিনিই। তিনিই হিরন্যগর্ভ, তিনিই অগ্নি, জল, বায়ু , তিনি সমগ্র জগতে ব্যাপ্ত। (প্রতিটি দেহধারী জীবের) অন্তরাত্মা তিনিই । তিনিই পৃথিবী, বায়ু, অগ্নি, কাল, দিক, তিনিই আত্মা( জীবাত্মা)। তিনিই সর্বজগতে প্রতিষ্ঠিত, তিনি ভিন্ন দ্বিতীয় কেউ নেই। 


👉সুতরাং, এখানেই প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে যে, স্বয়ং পশুপতি শিব লীলাবশত নিজেকে নিজেই মায়াপাশ অর্থাৎ মায়ার ষট- কঞ্চুকা ( মায়া, কলা, বিদ্যা, রাগ, কাল ও নিয়তি)  দ্বারা বেঁধে, সীমিত করে, সংকুচিত করে পশুস্বভাব প্রাপ্ত হচ্ছেন, নিজেই জীবাত্মারূপে মায়া প্রকৃতির ভোক্তা হচ্ছেন। তিনি নিজেকে নিজেই জীব হিসেবে অনুভব করছেন আবার একাধারে তিনিই পারমার্থিকভাবে পরিণামরহিত থাকছেন, অবিকৃত থাকছেন।  তাই এই ব্যবহারিক জগতে অবিদ্যার পাশ দ্বারা বাধিত পশুস্বভাব প্রাপ্ত জীবাত্মা মল সংযুক্ত হওয়ার দরুন (আনব, মায়ীয় ও কর্ম মল) নিজেকে সেই শিবস্বরূপ হিসেবে অথবা পরমাত্মার সাথে অভিন্ন হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে না, নিজেকে পরমাত্মার থেকে ভিন্ন ভাবতে শুরু করে এবং মনে করে যে ভক্তির দ্বারাই সেই পরমেশ্বর এর পরম পদ লাভ সম্ভব। এটাই দ্বৈত জগৎ। তাই দ্বৈত জগতে জীবকে শিবের অংশ মনে করাটা স্বাভাবিক।  কিন্তু বাস্তবে সেই জীবই যে সাক্ষাৎ ব্রহ্ম শিব সেই প্রত্যভিজ্ঞার জন্য জীবের দরকার আত্মজ্ঞান । আর জ্ঞান লাভ করাটাও হল এক প্রকারের কর্ম। তাই জ্ঞান মার্গ আর কর্ম মার্গই প্রকৃত পক্ষে পশু পাশ বিমোচক। আর জ্ঞান বলুন বা কর্মই বলুন সেটিও  সাক্ষাৎ ব্রহ্মই অর্থাৎ শিবই বটে। (" সত্যং জ্ঞানং অনন্তং ব্রহ্ম " -  তৈত্তিরীয় উপনিষদ -২/১/১)। কেননা শিব ভিন্ন দ্বিতীয় কেউ নেই। তাই শিবই একাধারে পশুপতি। যিনি নিজেকে পাশ দ্বারা বাঁধছেন তিনিও শিব,  বাধিত হওয়ার পর যা হচ্ছেন সেটিও শিব এবং যিনি সেই বন্ধন মুক্ত করছেন তিনিও শিব। এটা প্রকৃতপক্ষে শিবেরই লীলা লীলা। তাই তন্ত্রে সদাশিব নিজে বলছেন -


" জীবঃ শিবঃ শিবো জীবঃ স জীবঃ কেবলঃ শিবঃ |

পাশবদ্ধঃ স্মৃতো জীবঃ পাশমুক্তঃ সদাশিবঃ || ৪২ || "     

( কুলার্ণব তন্ত্রম্ ,  নবমোল্লাসঃ) 


---- জীবই শিব,  শিবই জীব।  সেই জীব অদ্বিতীয় শিব।  পাশবদ্ধ অবস্থায় হয় জীব,  পাশমুক্ত অবস্থায় হয় সদাশিব।


" তুষেণ বদ্ধো ব্রীহিঃ স্যাত্ত্বষাভাবে হি তন্ডুল |

কর্মবদ্ধঃ স্মৃতোঃ জীবঃ কর্মমুক্তঃ সদাশিবঃ" || ৪৩ ||      (- কুলার্ণব তন্ত্রম্ ,  নবমোল্লাসঃ) 

  

 ---- তুষের দ্বারা আবৃত থাকলে ধান্য আর তুষ না থাকলে তন্ডুল।  তেমনই কর্মবদ্ধ অবস্থায় যাহা জীব,  কর্মমুক্ত অবস্থায় তাহাই শিব। 


👉" অচক্ষুর্বিশ্বতশ্চক্ষুরকর্ণো বিশ্বতঃ কর্ণোহপাদো বিশ্বতঃ পাদোহপাণির্বিশ্বতঃ পানণিরাহমশিরা বিশ্বতঃ শিরা ... বিশ্বেশ্বরোऽহমজরোऽহম্  |

 "(ভস্ম.জা.উ/২/১২)


 --- পরম ব্রহ্ম শিব চক্ষুবিহীন আবার সমগ্র বিশ্ব চরাচর জুড়েই তাঁর চক্ষু বর্তমান। তিনি কর্ন বিহীন আবার সমগ্র বিশ্ব চরাচর জুড়েই তাঁর কর্ন বর্তমান।  তিনি হস্ত ও পদ বিহীন হয়েও  সমগ্র বিশ্ব চরাচর জুড়েই তাঁর হস্ত ও পদ বিদ্যমান, তিনি মস্তক বিহীন হয়েও বিশ্বে জুড়ে তারই মস্তক বর্তমান।


👉উপরের শ্লোকেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পরমেশ্বর একাধারে সর্ব ইন্দ্রিয় বর্জিত, তূরীয় ব্রহ্ম স্বরূপ, পশুপতি স্বরূপ আবার তিনিই ব্যবহারিক জগতে পশু রূপে, পুরুষ রূপে, জীব রূপে , প্রত্যগাত্মা রূপে অবস্থান করছেন। তাই সর্ব জীবের হস্ত, পদ, মিস্টিক, ইন্দ্রিয়, অক্ষি সবকিছুই শিব স্বরূপ। তাই শ্রুতি বলছে -


"সর্বাননশিরোগ্রীব সর্বভূতগুহাশয়ঃ |

সর্বব্যাপী স ভগবাংস্তস্মাৎ সর্বগতঃ শিবঃ || " 


(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/ ৩/১১)


 ---- ভগবান শিবই সাক্ষাৎ  সর্বব্যাপী এবং সর্বভূতে বিরাজমান। জগতের সব প্রাণীর শির, গ্রীবা  সবকিছুই   আসলে সেই (পশুপতি) শিবেরই ।


♦️পূর্বপক্ষ- 


👉 শিব মহাপুরাণে মহর্ষি উপমন্যু  শ্রী কৃষ্ণ কে সেই দ্বৈত পাশুপত জ্ঞানই তো দিয়েছেন। তিনি নিজেই সেখানে বলেছেন- পশুপতির অধীনে সকল জীব এবং বিশ্বচরাচর। শিবপুরাণ এর পাশুপত জ্ঞান প্রসঙ্গ থেকে প্রমাণ দেখানো হল নিচে -- 


" পাশের দ্বারা ব্রহ্মা থেকে কীট পর্যন্ত সমস্ত পশুকে বন্ধন করে মহেশ্বর পশুপতিদেব তাঁর কার্য করান । শিবের নির্দেশে একাদশ ইন্দ্রিয় ও পঞ্চতন্মাত্রের সৃষ্টি হয় । পঞ্চতন্মাত্রেরও সেই মহেশ্বরের মহাশাসনে প্রেরিত হয়ে ক্রমশঃ পঞ্চ মহাভূতের উৎপন্ন করে । এই সব মহাভূত শিবের নির্দেশে ব্রহ্মা থেকে পর্যন্ত দেহধারীদের জন্য দেহ সৃষ্টি করে । পরমেশ্বর শিবের শাসনেই আকাশ সর্বব্যাপী হয়ে সমস্ত প্রাণীকে অবকাশ প্রদান করে । বায়ুতত্ত্ব প্রাণাদি নামভেদের দ্বারা বাইরের ও ভিতরের সমস্ত জগৎকে ধারণ করে । অগ্নি তত্ত্ব দেবতাদের জন্য হোম এবং পিতৃপুরুষের জন্য কব্য প্রদান করে । সেই সঙ্গে মানুষের জন্য পাকাদি কার্যও করে জল সকলকে জীবন দেয় এবং পৃথিবী সমস্ত জগৎকে ধারণ করে।

ভগবান সূর্য শিবেরই নির্দেশে নিজ তিন অংশ দ্বারা জগৎ পালন করেন , নিজ কিরণ দ্বারা বৃষ্টির জন্য আছে মেঘ হয়ে বর্ষণ করেন । চন্দ্রভূষণ শিবের শাসন মেনেই চন্দ্ৰ ঔষধি পোষণ ও প্রাণীদের আনন্দ দেন ।  আদিত্য , বসু , রুদ্র , অশ্বিনীকুমার , মরুদ্গণ ,  ঋষি , সিদ্ধ , নাগ , মানুষ , মৃগ , পশু , পক্ষী , কীট আদি , স্থাবর প্রাণী , নদী , সমুদ্র , পর্বত , বন , সরোবর ,  বেদ ,  ভুবন , তার অধিপতি , অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ড , তার আবরণ ,  এই জগতে যা কিছু দেখা ও শোনা যায় , এ সবই ভগবান শংকরের আদেশ বলেই টিকে রয়েছে ।" 


(শিব মহাপুরাণ/ বায়বীয় সংহিতা/ উত্তর খণ্ড/ ২নং অধ্যায়)


---  এইখানে তো জীবের শিবের প্রতি দাসত্ব এর একটা ভাব স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে  । তাহলে তো শিবপুরাণ  অথবা মহর্ষি উপমন্যুর উপরিউক্ত‌‌ কথন খণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয় আপনারা কি বলবেন ? 


♦️উত্তর পক্ষ- 


👉এই প্রশ্নের উত্তর আগেই দেওয়া হয়ে গেছে।  না মহর্ষি উপমন্যুর কথন মিথ্যে, না শিব মহাপুরাণ এর দাবি মিথ্যে, না শ্রুতিশাস্ত্র মিথ্যে, এই দাবির  মীমাংসা পূর্বের অনুচ্ছেদেই করে দেওয়া হয়েছে। তবুও নিম্নে আরও একবার একটু ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হল ।  


পূর্বপক্ষ কর্তৃক প্রদর্শিত শিব মহাপুরানক্ত পাশুপত জ্ঞান সম্বন্ধিত শ্লোকগুলি - স্থূল ব্যবহারিক জগৎ এর সাপেক্ষে , স্থূল অর্থে মহর্ষি উপমন্যুজী বলেছেন।  ব্যবহারিক জগতে জীব পাশবদ্ধ অবস্থায় থাকার দরুন এটাই মনে করবে যে, সমগ্র জগৎ ও জীব শিব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এবং শিব শুধু মাত্র জগতের নিমিত্তকারণ। কিন্তু তাঁরা কখনোই এটা উপলব্ধি করতে পারবে না যে, শিবই নিজেই জীব এবং জগৎ হয়েছেন এবং তিনি জগতের উপাদান কারণও বটে। তাই পশুর মনে দাসত্ববৃত্তির ভাবনা জাগরণ হবে এটাই স্বাভাবিক। এর একমাত্র কারণ অজ্ঞান, যার কারণ হল অপরাবিদ্যা।


এরপরে মহর্ষি উপমন্যু সেই স্থূল পাশুপত জ্ঞানের সূক্ষ্ম অর্থটিও শ্রীকৃষ্ণকে  বুঝিয়েছেন।  তিনি সেখানে বলছেন- 


👉" শর্ব, ভব, রুদ্র, উগ্র, ভীম, পশুপতি ঈশান এবং মহাদেব -  শিবের এই আটটি মূর্তি রয়েছে, এই সমগ্র জগৎ চরাচর  তত স্বরূপই। মহেশ্বরের এই আট মূর্তি দ্বারা  - ভূমি, জল, অগ্নি, বায়ু, ক্ষেত্রজ্ঞ, সূর্য ও চন্দ্র অধিষ্ঠিত হন। " 


👉"শিবের যে তেজময় মূর্তি বিশ্বের বাইরে ও ভেতরে ব্যাপ্ত হয়ে অবস্থান করছে সেই ঘোররূপি মূর্তির নাম রুদ্র।"


👉"ভগবান শিব স্বয়ং বায়ুরূপে গতিমান হয়ে এই জগৎকে গতিশীল করেন, তাঁর এই রূপের নাম উগ্র। "


👉" সমস্ত নেত্রাদিতে এবং সব আত্মায় অবস্থানকারী শিব মূর্তিকে পশুপতি মূর্তি বলে জানতে হয়। 


(শিব মহাপুরাণ / বায়বীয় সংহিতা /উত্তর খণ্ড/ তৃতীয় অধ্যায়)


♦️এই ধারণা শ্রুতিতেও আমরা কিছুটা পেয়ে থাকি ----


👉 " নিধনপতযে নমঃ নিধনপতান্তিকায় নমঃ ঊর্ধ্বায় নমঃ ঊধ্বলিঙ্গায় নমঃ | হিরণ্যায নমঃ | ........ ভবায় নমঃ | ভবলিঙ্গায় নমঃ | শর্বায় নমঃ | শর্বলিঙ্গায় নমঃ | শিবায় নমঃ | শিবলিঙ্গায় নমঃ | জ্বলায় নমঃ | জ্বললিঙ্গায় নমঃ | আত্মায নমঃ | আত্মলিঙ্গায় নমঃ | পরমায় নমঃ | পরমলিঙ্গায় নমঃ | 


( কৃষ্ণ যজুর্বেদ / তৈত্তিরীয় আরণ্যক / ১০ ম প্রপাঠক / ১৬ নং অনুবাক‌- লিঙ্গসূক্ত )


---- নিধন = ধনহীন = ঐশ্বর্য হীন = আত্ম জ্ঞানহীন = পশু বা জীবাত্মা । অর্থাৎ শিব একাধারে যেমন পশুস্বরূপ জীবাত্মা দের পতি , অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে যে তিনি নিজেই আত্মা অর্থাৎ প্রত্যেক জীবের আত্মস্বরূপ, তিনি ভব, শর্ব প্রভৃতি মূর্তি ধারণ করে জগতে ব্যাপ্ত হয়েছেন। তাই পারমার্থিক পর্যায়ে পশু এবং পশুপতি এর মধ্যে কোনো ভেদ নেই। ইহাই সর্ব বেদান্তসম্মত মত।


👉পাশুপতদের শ্রুতি শাস্ত্র থেকে আমরা আরও প্রমাণ দেখে নেব এবার --- 


" যোবৈ রুদ্র স ভগবান্ যশ্চ ব্রহ্মা তস্মৈ‌ বৈ‌‌ নমোনমঃ‌‌ ||

যোবৈ রুদ্রঃ স ভগবান্ যশ্চেন্দ্ৰ স্তস্মৈ বৈ নমোনমঃ‌‌ ||যোবৈ রুদ্রঃ স ভগবান্ যশ্চাগ্নি স্তস্মৈ বৈ নমোনমঃ ||যোবৈ রুদ্রঃ স ভগবান্ যশ্চ বায়ুস্তস্মৈ বৈ নমোনমঃ ||যোবৈ রুদ্রঃ স ভগবান্ যশ্চ সূর্যাস্তস্মৈ বৈ নমোনমঃ ||

যোবৈ রুদ্রঃ স ভগবান্ যশ্চ সোমস্তস্মৈ বৈ নমোনমঃ ||যোবৈ রুদ্রঃ স ভগবান্ যে চাষ্টৌ গ্রহাস্তস্মৈ বৈ নমোনমঃ ||  

যোবৈ রুদ্রঃ স ভগবান যশ্চ তেজস্তস্মৈ বৈ নমোনমঃ ||যোবৈ রুদ্রঃ স ভগবান্ যশ্চ কালস্তস্মৈ বৈ নমোনমঃ || যোবৈ রুদ্রঃ স ভগবান্ যচ্চ বিশ্বং স্তস্মৈ বৈ নমোনমঃ ||

 যোবৈ রুদ্রঃ স ভগবান্ যচ্চ ভূস্তস্মৈ বৈ নমোনমঃ‌‌ ||যোবৈ রুদ্রঃ স ভগবান্ যচ্চ ভূবস্তস্মৈ বৈ নমোনমঃ ||যোবৈ রুদ্রঃ স ভগবান্ যচ্চ স্বস্তস্মৈ বৈ নমোনমঃ ||

যোবৈ রুদ্রঃ স ভগবান্ যচ্চ মহস্তস্মৈ বৈ নমোনমঃ || যোবৈ রুদ্রঃ স ভগবান যা চ পৃথিবী তস্মৈ বৈ নমোনমঃ‌ ||যোবৈ রুদ্রঃ স ভগবান্ যচ্চান্তরীক্ষং তস্মৈ বৈ নমোনমঃ ||     (অথর্বশির‌‌ উপনিষদ / ২)



----- সুতরাং পশুপতি শিবই যে সমগ্র জগৎ, পঞ্চভূত এবং জীবরূপে বিদ্যমান রয়েছেন , অর্থাৎ তিনিই লীলাচ্ছলে নিজে পশু হচ্ছেন একথার সপক্ষে শব্দপ্রমাণ শ্রুতি থেকে আমরা দেখে নিলাম।


👉এবার দেখে নেব বেদ ভাষ্যকার সায়ণ আচার্য কি বলছে পশুপতি শব্দের ব্যাখ্যায় -- 


" নমো হিরণ্যবাহবে হিরণ্যবর্ণায়........পশুপতয়ে‌ নমোনমঃ " ( কৃষ্ণ‌ যজুর্বেদ/ তৈত্তিরীয় আরণ্যক/ ১০ প্রপাঠক/ ২২ নং অনুবাক)


🔘সায়ণভাষ্য - " নমঃ শিবায় | কথং ভূতায় পশূনামব্রহ্মস্তম্বপর্যন্তানাং পতির্নায়ক পশুপতিস্তস্মৈ |

ব্রহ্মদ্যাঃ স্তম্বপর্যন্তাঃ পশবঃ পরিকীর্তিতাঃ |

তেষাং হি নায়কো যস্মাৎ শিবঃ পশুপতিঃ স্মৃতঃ ||‌"


👉--- ভাষ্যানুবাদ --- বেদ ভাষ্যকার  সায়ণাচার্য বললেন, ব্রহ্মা থেকে আরম্ভ করে সমগ্র জগৎ, জীব এবং অন্যান্য দেবগণ পশু হিসেবে পরিগণিত হন, এবং উহাদের অধীশ্বর হলেন পশুপতি শিব। 


♦️তাহলে সায়ণভাষ্যও তো বেদ-বেদান্ত বিরোধী হয়ে যাওয়ার কথা ? কিন্ত আসলেই তা নয়। পরের একটি শ্লোকে তিনি কি ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটা দেখে নেওয়া যাক ---


👉 " সর্বো‌ বৈ রুদ্রঃ তস্মৈ রূদ্রায় নমো অস্তু |

পুরুষ বৈ‌‌ রুদ্রঃ সন্মোহ নমো নমঃ || ( কৃষ্ণ‌ যজুর্বেদ/ তৈত্তিরীয় আরণ্যক/ ১০ প্রপাঠক/ ২৪ নং অনুবাক)


🔘সায়ণভাষ্য - " যো রুদ্রঃ পার্বতীপতিঃ পুরাণেষু প্রসিদ্ধঃ স এব সর্বো জীবরুপেন সর্বশরীরেষু প্রবিষ্টত্বাৎ | তস্মৈ সর্বাত্মকায় রুদ্রায় নমো অস্তু |........যজ্জড়ং বিশ্বমস্তি যচ্চ ভূতং চেতনং প্রাণিজাতমস্তীতি চেতনাচেতনরুপেন বিচিত্রং যদ্ভুবনং জগৎ, ....সর্বোহপি প্রপঞ্চ এষ রুদ্রো হি |.... তদৃশায় সর্বাত্মকায় রুদ্রায় নমস্কারো অস্তু | "


👉--- ভাষ্যানুবাদ --- যে রুদ্রদেব পুরাণে পার্বতীপতি হিসেবে উক্ত হয়েছেন ( অর্থাৎ সদাশিব অর্থে) তিনিই জীবাত্মা রূপে অর্থাৎ প্রত্যগাত্মা রূপে সকল জীবের শরীরে প্রবিষ্ট হয়ে রয়েছেন। সেই সর্বাত্মক রুদ্রকে নমস্কার জানাই,  যার থেকে জড় জগৎ, ভূত, চেতন, অচেতন, ভুবন , প্রাণী সকলই জাত হয়েছে। সমগ্র বিশ্ব প্রপঞ্চ সেই এক রুদ্র স্বরূপই বটে। সেইরূপ সর্বাত্মক রুদ্রকে নমস্কার জানাই।


🔘সুতরাং -  আমাদের , উত্তরপক্ষের দাবি পুনরায় শ্রুতি শাস্ত্র থেকে সঠিক প্রমাণিত হল। পরমেশ্বর সদাশিবই আসলে প্রত্যেক জীবে প্রত্যগাত্মা রূপে অবস্থান করছেন, তিনিই আসলে সর্বভূতে বিরাজিত রয়েছেন। তিনি জগতের উপাদান কারণও বটে।  আমরা পাশবদ্ধ অবস্থায় থাকার দরুন তা বুঝতে পারি না। আমরা শুধু এইটুকু মনে করে থাকি যে, রুদ্র থেকেই সব কিছু এসেছে, রুদ্র শুধুমাত্র জগতের নিমিত্ত কারণ। এটাই ভ্রম, এটাই শিব মায়া।


-🟥-  সুতরাং শাস্ত্র থেকে প্রমাণ হয়ে গেল যে প্রাচীন বৈদিক পাশুপত মত অনুযায়ী ব্রহ্ম জগতের নিমিত্ত আর উপাদান কারণ উভয়ই। 


♦️পূর্ব পক্ষ- 


👉মাহেশ্বরগণের মতে ঘড়া বা গৃহরূপী কার্যের অধিষ্ঠাতা হিসেবে কুম্ভকার ইত্যাদির মতো জগতেরও কোন অধিষ্ঠাতা ঈশ্বর আছেন, কিন্তু বাদরায়ণের মতে এরকম অনুমানের দ্বারা ঈশ্বরের সত্ত্বাকে সিদ্ধ করা যায় না। কেননা, নিরাকার ঈশ্বরকে অধিষ্ঠাতা বলে সিদ্ধ করা যায় না এবং প্রকৃতি মৃৎপিণ্ডের ন্যায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পদার্থ নয়, সুতরাং ঈশ্বর প্রকৃতিতে অধিষ্ঠান করতে পারেন না। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-


"অধিষ্ঠানানুপপত্তেশ্চ"|| (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৩৯)

ভাবার্থ : প্রকৃতিতে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান অসম্ভব l


👉এ প্রেক্ষিতে পাশুপতরা বলেন, নিরাকার জীব (আত্মা) যেমন ইন্দ্রিয়, শরীর ইত্যাদির অধিষ্ঠাতা, এগুলিকে পরিচালনা করেন- পশুপতি ঈশ্বরও তেমনি প্রধান প্রভৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন । এই যুক্তি খণ্ডনে বাদরায়ণ বলেন - 


"করণবৎ চেৎ, ন, ভোগাদিভ্যঃ" || (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৪০)

"অন্তবত্ত্বম্ অসর্বজ্ঞতা বা"|| (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৪১)


ভাবার্থ : জীব অশরীরী হয়েও ইন্দ্রিয়সমূহের অধিষ্ঠাতারূপে যেমন ভোগ করে, ঈশ্বরও সেইরূপ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠান করেন- যদি এরূপ বলা হয়- তা ঠিক নয়। তা হলে ঈশ্বরও জীবের ন্যায় জন্ম-মৃত্যুর অধীন এবং অসর্বজ্ঞ হয়ে পড়েন। অতএব মাহেশ্বর মত অগ্রাহ্য।


♦️উত্তরপক্ষ-


👉দেখা যাক শ্রুতিশাস্ত্র‌ বলছে—


" যো বেদাদৌ স্বরঃ প্রোক্তো বেদান্তে চ প্রতিষ্ঠিতঃ |

তস্য প্রকৃতিলীনস্য যঃ‌ পরঃ স মহেশ্বরঃ || "


( কৃষ্ণ যজুর্বেদ /‌তৈত্তিরীয় আরণ্যক/ ১০ম প্রপাঠক/ ১২ ‌নং‌ অনুবাক)


------ সায়ণ ভাষ্য মতে , বেদে ও বেদান্তে প্রতিষ্ঠিত , প্রতিপাদিত স্বরই হল প্রণব। সায়ন আচার্যের মতে ধ্যান কালে এই প্রণব অব্যাকৃতি-প্রকৃতিতে লীন হয়ে যায়। বিরাটরূপ মকার উকারে লীন হয়, হিরণগর্ভস্বরূপ ওকার লীন হয় মূল প্রকৃতি স্বরূপ মকারে। এই ভাবেই প্রকৃতিতে প্রণব অর্থাৎ পুরুষ লীন হয়ে থাকে অর্থাৎ অধিষ্ঠান করে থাকে। এই প্রণবের তিন মাত্রার চেয়েও উর্ধ্বে অবস্থিত নাদ হলো সেই মহেশ্বর। 



👉 উপরিউক্ত শ্লোকের পাশুপতাচার্য মহর্ষি উপমন্যুকৃত ব্যাখ্যা ---


২৩ তত্ত্বাদির অতীত যে প্রকৃতি বলা হয়েছে, তারও অতীত পঁচিশতম স্থানে পুরুষকে (জীবাত্মা) বলা হয়েছে, যাকে বেদের আদিতে ওঁকাররূপ (কেননা ব্রহ্মই জীব হচ্ছেন ব্যবহারিকে) বলা হয়েছে। তার প্রকৃত স্বরূপের জ্ঞান একমাত্র বেদ থেকেই হয়। সেটিই বেদান্তে প্রতিষ্ঠিত। এই পুরুষ আবার প্রকৃতিতে লীন হয়ে থাকেন, অধিষ্ঠিত হয়ে থাকেন। সুতরাং এই পুরুষেরও (পাশবদ্ধ শিব) অতীত যে পরমপুরুষ (পশুপতি শিব, ব্রহ্ম), তার নাম মহেশ্বর । 


(রেফারেন্স - শিবমহাপুরাণ বায়বীয়সংহিতা/পূর্বখন্ড)



👉” মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িং চ মহেশ্বরম্ ।।১০ “


(শ্বেতাশ্বতর ঊপনিষদ/ অধ্যায় নং ৪)



--- প্রকৃতি হল সাক্ষাৎ মায়া। সেই মায়ার বা প্রকৃতির ঈশ্বর হল সাক্ষাৎ মহেশ্বর । তাকে মায়ী বা মায়াধীশ বলে জানা উচিত ।


👉" ক্ষরং প্রধানম্ অমৃত অক্ষরং হরঃ ক্ষরাত্মানাবীশতে দেব একঃ " | ( শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ / ১ / ১০ ) 


--- ' ক্ষর ' অর্থাৎ প্রধান অর্থাৎ প্রকৃতি কিন্তু ' অক্ষর ' মানে যার ক্ষরণ নেই , অর্থাৎ অমৃত , মৃত্যুঞ্জয় তিনিই হর । অর্থাৎ আনন্দময় পরমব্রহ্ম পরশিব । তিনি‌ই আবার ক্ষরাত্মক প্রকৃতি এবং জীবাত্মা অর্থাৎ পুরুষের নিয়ামক। 


👉 শাঙ্করভাষ্যেও এটা বলা হয়েছে যে - ব্রহ্ম হল পুরুষ এবং প্রধান এর নিয়ামক বা নিয়ন্ত্রণকারী। (" স‌ ঈশ্বরঃ ক্ষরাত্মানৌ প্রধানপুরুষাবীশত ইষ্টে দেব একঃ চিৎঃ সদানন্দঃ অদ্বিতীয়ঃ পরমাত্মা "---- (শাঙ্করভাষ্য/ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ / ১ / ১০)


👉ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে যে ---- 


” এতৎ যোনীনি সর্বাণীত্যুধারয় ।

অহং কৃৎনস্য জগতঃ প্রভবঃ প্রলয়স্তথা ॥ ৬

” মত্তঃ পরতরং নান্যৎকিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয় । ..৭ ॥ “


---- আমার এই দুই অপরা ও পরা প্রকৃতির দ্বারাই সমগ্র জগতের সৃষ্টি হয়েছে। তাই আমি পরমেশ্বরই একমাত্র জগতের সৃজন ও সংহারের কারন। আমার থেকে উপরে কেউ নেই ধনঞ্জয় ।


👉ভগবদগীতার শঙ্কর-অদ্বৈত ভাষ্যে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে —


(” বিশুদ্ধাং প্রকৃতিং মমাত্মভূতাং ….প্রকৃষ্ঠাং জীবভূতাং ক্ষেত্রজ্ঞলক্ষণাং .... ” প্রকৃতী যোনিঃ কারনং সর্বভূতানাম্, প্রকৃতিদ্বয়দ্বারেণাহং সর্বজ্ঞ ঈশ্বরো জগতঃ কারণমিত্যর্থঃ "


---- পরমেশ্বরের অপরাপ্রকৃতি হল জড় বা মায়া‌প্রকৃতি‌‌ এবং‌ পরমেশ্বরের পরাপ্রকৃতি হল সাক্ষাৎ জীব‌‌ বা পুরুষ।

পরমেশ্বরের এই দুই প্রকৃতিই (পরা ও অপরা) সর্বভূতের কারন। এই দুই প্রকৃতিকে দ্বারস্বরূপ রেখে পরমেশ্বরই সাক্ষাৎ সর্বকারণ ও সর্বজ্ঞ। (‌এরফলে‌ বেদান্তের ২৫‌ তত্ত্বের ধারণাও অক্ষুন্ন থাকছে।) 



👉সুতরাং এখানেও দেখা যাচ্ছে যে, শ্রুতিপ্রস্থান, স্মৃতিপ্রস্থান এবং ন্যায় প্রস্থানের মধ্যে আপাত বিরোধ বাঁধছে, কেননা শ্রুতিপ্রস্থান এবং স্মৃতি প্রস্থানে তে বলা হচ্ছে যে, প্রকৃতি ও পুরুষের নিয়ন্ত্রক হলেন ব্রহ্ম, তিনি প্রকৃতি এবং পুরুষের থেকেও শ্রেষ্ঠ কিন্তু ন্যায় প্রস্থান মতে ইহা সম্ভব ধয়।‌ এ প্রসঙ্গে সঠিক ন্যায়সম্মত মীমাংসা শঙ্কর আচার্যও করে যাননি।‌ ‌সুতরাং বাদরায়ণের দাবি কী ভুল‌ ? আর পাশুপতদের দাবি ঠিক ?



-🟥- মীমাংসা - 


কখনই নয়।‌ বাদরায়ণ এবং পাশুপত উভয়ের দাবিই সঠিক। আপাত দৃষ্টিতে প্রস্থানত্রয়ীর মধ্যে বিরোধ মনে হলেও সূক্ষ্ম অর্থে তাদের মধ্যে কোনো ভেদ নেই। এর জন্যে সঠিক মীমাংসা জানতে হবে 



১. বৈদিক পাশুপত মতেও ব্রহ্ম একাধারে নিরাকার , সর্বব্যাপী, অনন্ত এবং সাকারও বটে, এর প্রমাণ পূর্ববর্তী আলোচনায় করা হয়ে গিয়েছে । এই নিরাকার ব্রহ্ম পারমার্থিক অবস্থায় কখনো জড় মায়া প্রকৃতিতে অধিষ্ঠান করতে পারে না। কিন্তু ব্রহ্ম যখন ব্যববহারিক পর্যায়ে‌ সাকার হন তখন তিনি তার বিবিধ কার্যমূর্তিদ্বারা সকল কিছুতেই অধিষ্ঠিত হতে পারেন। এ ব্যাপারে শাস্ত্রপ্রমাণ দিচ্ছে শিবমহাপুরাণ। শিব মহাপুরানে পাশুপত আচার্য মহর্ষি উপমন্যু বলছেন -


 👉" ঈশান , পুরুষ , অঘোর , বামদেব এবং সদ্যোজাত – মহাদেবের এই বিখ্যাত পাঁচ ব্রহ্মমূর্তি । এর মধ্যে ঈশান মূর্তি আদি ও শ্রেষ্ঠতম, এটি প্রকৃতির সাক্ষাৎ ভোক্তা ক্ষেত্রজ্ঞ পুরুষ (জীবাত্মা)কে ব্যাপ্ত করে স্থিত । মূর্তিমান প্রভু শিবের যে তৎপুরুষ নামক মূর্তি , তা গুণাদির আশ্রয়রূপ ভোগ্যা অব্যক্ত ( প্রকৃতি ) তে অধিষ্ঠিত । "

[ শিবপুরাণ মতে - এই তৎপুরুষই হচ্ছেন‌- তিরোভাবকর্তা মহেশ্বর বা ঈশ্বর]


(শিব মহাপুরাণ/ বায়বীয় সংহিতা/ উত্তর খণ্ড/ ৩নং অধ্যায়)


👉তাছাড়া "তস্য প্রকৃতিলীনস্য যঃ‌ পরঃ স মহেশ্বরঃ" ইত্যাদি বাক্য এই সপক্ষে প্রমাণ দিচ্ছে । 

(ব্রহ্ম= নির্গুণ, মহেশ্বর = ইশ্বর, সগুণ ব্রহ্ম, মায়া প্রকৃতির অধীশ্বর, পুরুষ = প্রকৃতিতে লীন জীবাত্মা, নিজের ইচ্ছাতেই পাশবদ্ধ ঈশ্বর )


👉 তাই নিরাকার, নির্বিকার ব্রহ্ম অবশ্যই সরাসরিভাবে প্রকৃতিতে অবস্থান করতে পারে না এবং তিনি পারমার্থিক পর্যায়ে জীবের ন্যায় অসর্বজ্ঞ, জন্ম, মৃত্যুর অধীন নন। ইহাই বাদরায়ণ এর মত, বেদান্তের মত। এই মতকে পাশুপতরা সূক্ষ্মগত ভাবে মেনে চলে, যার শব্দ প্রমাণ উপরের আলোচনাতেই একাধিবার দেওয়া হয়েছে ।


👉আবার সেই ব্রহ্মই যখন ব্যবহারিক পর্যায়ে প্রকৃতিতে অধিষ্ঠান, করছেন তখন তিনিই জীব হচ্ছেন, প্রকৃতির ভোক্তা হচ্ছেন , সীমিত হয়ে যাচ্ছেন, মায়ার পাশ দ্বারা নিজেকে সংকুচিত করে , সেই মায়া প্রকৃতিতেই অধিষ্ঠিত হয়েছেন, এটাও শ্রুতি সম্মত। আর এই মতই পাশুপতরা স্থূলগত দিক দিয়ে মানছে। 



👉তাই মহাভারতে শিব বলছেন- 


 " অর্থোহহমর্থশক্তিস্ত্বং ভোক্তাহং ভোজ্যমেব চ | 

রূপং বিদ্ধি মহাভাগে ! প্রকৃতিস্ত্বং পরো হ্যহম্ || ৩৮ || অহং বিষ্ণুরহং ব্রহ্মা হ্যহং যজ্ঞস্তথৈব চ | 

আবয়োর্ন চ ভেদোহস্তি পরমার্থস্ততোহবলে ! | 

তথাপি বিস্মন্তে ভেদংকিং মাং ত্বং পরিপৃচ্ছসি || ৩৯ || ' 


(সপ্তবিংশত্যাধিকদ্বিশততমোহধ্যায়ঃ, শান্তিপর্ব্বঃ, মহাভারতম্)


--- মহাদেব দেবী পার্বতীকে বললেন- আমিই ব্রহ্ম , তুমিই ব্রহ্মশক্তি , আমিই ভোক্তা , তুমি ভোগ্যা । তুমি প্রকৃতি , আমিই পুরুষ । আমিই বিষ্ণু , আমিই ব্রহ্মা , আমিই যজ্ঞ । পরমার্থে তোমাতে আমাতে ভেদ নাই অথচ ব্যবহারিক জগতে ভেদ আছে ।



👉আর বৈদিক পাশুপত মতে , ঈশ্বরকে কখনো পরিবর্তনশীল ধরা হয় না।

শাস্ত্র প্রমাণ আমরা দেখে নেবো --


"অদ্বৈতং নিষ্কলং নিষ্ক্রিয়ং শান্তং শিবং ...."

( ভস্মজাবাল উপনিষদ / ২ / ৭)


 --- সুতরাং এখানে ঈশ্বরকে নির্বিকার, নিষ্কল বলা হয়েছে, তাই তার পরিবর্তন অসম্ভব।


👉ব্রহ্মসূত্রের নীলকণ্ঠ ভাষ্যের ২.২.৩৮ নং সূত্রের ভাষ্য প্রসঙ্গে পাশুপত শৈব বৈদান্তিক আচার্য শ্রীকণ্ঠ নিজে এই উক্তির সমর্থন করে গেছেন।



- 🟥- তাই ন্যায় অনুযায়ী পাশুপত মত শ্রুতি ও মীমাংসা সম্মতও বটে। সুতরাং পাশুপত মত কখনোই শ্রুতি বিরুদ্ধ নয় এটা প্রমাণিত হল।




২. অদ্বৈত বেদান্ত মতে ব্রহ্ম এবং মায়ার সম্পর্ক অনির্বচনীয় ও তদাত্ম হলেও পাশুপত শিবাদ্বৈত অথবা অদ্বৈত শৈব ত্রিক দর্শন মতে মায়া অনির্বচনীয়া নয়। শিবের সাথে অভিন্ন পরাশক্তিরই (পরাবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা) অপরা স্বরূপ হল মায়া। ইহাই অপরাবিদ্যা আর এই মায়া তার পঞ্চআবরণ এর সহিত সাক্ষাৎ জড় প্রকৃতি হিসেবে বিবেচিত হন। সুতরাং, এই মায়া হল অশুদ্ধ মায়া এবং অন্তিমে এই মায়াই শুদ্ধ মায়া স্বরূপে পরাশক্তি স্বরূপে সাক্ষাৎ ব্রহ্ম পরমশিবের হৃদয়ে সমাহিত হয়ে যান। তাই ব্রহ্মের সাথে সরাসরি কখনো মায়া সংযুক্ত হন না, ব্রহ্মের সাথে সংযুক্ত হন সেই পরাচিতি বা চিৎ বা পরাপ্রকৃতি , যার উল্লেখ ভগবৎ গীতায় আমরা পাই। সুতরাং বলা যেতে পারে এই সুপ্ত বিমর্শ পরাশক্তি সম্পন্ন ব্রহ্ম থেকেই মায়াতত্ত্ব আসছে আর এই মায়ার দ্বারাই সমগ্র জগৎ নির্মিত। এই মায়ার দ্বারাই শিব নিজের ইচ্ছায় পাশবদ্ধ হয়ে পুরুষ অর্থাৎ জীব হচ্ছেন এবং প্রকৃতিকে উপভোগ করছেন, প্রকৃতিতে অধিষ্ঠান করছেন । তাই মায়াকে যদি উপাদান কারণ বলা যায় তাহলে সেই ব্রহ্মকেও ন্যায় অনুযায়ী জগতের উপাদান কারণ বলা যুক্তি সঙ্গত, কারণ মায়ার কারণ পরাশক্তি বা চিৎ/চিতি আর সেই শক্তির কারণ সাক্ষাৎ ব্রহ্ম।


[পরমশিব (ব্রহ্ম)------ শিব(প্রকাশ)----- শক্তি (বিমর্শ)---- সদাশিব---- ঈশ্বর----- শুদ্ধবিদ্যা --- মায়া ও তার পঞ্চআবরণ---- পুরুষ ও‌ প্রকৃতি ----...... পৃথিবী‌ = শৈব দর্শনের ৩৬ তত্ত্ব , 👉 রেফারেন্স - শিবমহাপুরাণ/বায়বীয়‌ সংহিতা]



👉শাস্ত্র কি বলছে দেখে নেওয়া যাক -- 


" এতেষামেব পাশানাং মায়া কারণমুচ্যতে |

মূলপ্রকৃতিরব্যক্তা সা শক্তির্ময়ি‌ তিষ্ঠতি || ৩০ ||

স এব মূলপ্রকৃতিঃ প্রধানং পুরুষোহপি চ | ৩১

স এব বন্ধঃ স চ বন্ধকর্তা |

স এব পাশঃ পশবঃ স এব‌ | ৩২ "


(কূর্মপুরাণ/‌ উপরিভাগ/‌ঈশ্বরগীতা/ ৭নং অধ্যায়-বিভূতিযোগ)


--- মায়াই এই পাশ সকলের কারণ । অব্যক্ত মূলপ্রকৃতিরূপে ( পরাচিতি বা পরা শক্তি) এই মায়া আবার আমাতেই অবস্থান করে । সেই মূলপ্রকৃতিই প্রধান ও পুরুষ নামে অভিহিত (আসলে মূল প্রকৃতি থেকেই প্রধান ও পুরুষ ) । তিনিই বন্ধন ও পাশ আবার তিনিই বন্ধনকর্তা (ব্রহ্মের শক্তি) ।  


👉দেখা যাচ্ছে যে, এক পরমেশ্বরের পরাশক্তিই সব কিছু করছেন। তিনিই এক পর্যায়ে মায়া হচ্ছেন এবং তিনিই নিজেই সেই ব্রহ্মকে নিজের অপরা স্বরূপ মায়ার দ্বারা বেঁধে পুরুষ হচ্ছেন। তিনিই বন্ধন আবার তিনিই বন্ধন কর্তা। এক্ষেত্রে এই ভাবেই ব্রহ্ম এবং তাঁর শক্তির অভেদত্ব প্রমাণিত হল। ব্রহ্মই তাঁর শক্তির দ্বারা নিজেকে নিজে বেঁধে পশু বা পুরুষ হচ্ছেন আবার সেই ব্রহ্মের শক্তিই মায়াপ্রকৃতি হচ্ছে । 



👉তাই মহাভারতে শিব বলছেন- 


 " অর্থোহহমর্থশক্তিস্ত্বং ভোক্তাহং ভোজ্যমেব চ | 

রূপং বিদ্ধি মহাভাগে ! প্রকৃতিস্ত্বং পরো হ্যহম্ || ৩৮ || অহং বিষ্ণুরহং ব্রহ্মা হ্যহং যজ্ঞস্তথৈব চ | 

আবয়োর্ন চ ভেদোহস্তি পরমার্থস্ততোহবলে ! | 

তথাপি বিস্মন্তে ভেদংকিং মাং ত্বং পরিপৃচ্ছসি || ৩৯ || ' 


(সপ্তবিংশত্যাধিকদ্বিশততমোহধ্যায়ঃ, শান্তিপর্ব্বঃ, মহাভারতম্)


--- মহাদেব দেবী পার্বতীকে বললেন- আমিই ব্রহ্ম , তুমিই ব্রহ্মশক্তি , আমিই ভোক্তা , তুমি ভোগ্যা । তুমি প্রকৃতি , আমিই পুরুষ । আমিই বিষ্ণু , আমিই ব্রহ্মা , আমিই যজ্ঞ । পরমার্থে তোমাতে আমাতে ভেদ নাই অথচ ব্যবহারিক জগতে ভেদ আছে ।

তাই প্রকৃতি, মায়া, বিদ্যা, শক্তি সব কিছু সেই এক ব্রহ্মই হয়েছে।‌ এটাই শৈব দর্শন।



👉পারমার্থিক পর্যায়ে ব্রহ্ম কখনো পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ট নয় বা প্রধান ও পুরুষের নিয়ন্ত্রণ কর্তা নন, কেননা তিনি পারমার্থিক পর্যায়ে নিজেই সেটি। কিন্তু ব্যবহারিক পর্যায়ে দেখলে দেখা যাচ্ছে যে, তিনি প্রকৃতি এবং পুরুষের নিয়ন্ত্রক। আসলে ব্রহ্ম নিজেই নিজের নিয়ামক। কেননা শ্রুতি মতে ব্রহ্ম "প্রকৃতি-পুরুষাত্মক " --- "পরংব্রহ্ম পুরুষং‌‌ কৃষ্ণপিঙ্গলং " - ইত্যাদি শ্রুতি বাক্যে যা সিদ্ধ। (কৃষ্ণ পিঙ্গল = উমা মহেশ্বরাত্মক বা প্রকৃতি - পুরুষাত্মক) । সুতরাং একই বিষয়ের এই দুটি পৃথক দৃষ্টিকোন মাত্র ফুটে উঠেছে শ্রুতি, ব্রহ্ম সূত্র এবং ভগবৎ গীতার মধ্যে ।




👉এই সম্পর্কে শৈব আচার্য মুডিগোণ্ডা নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী তাঁর ব্রহ্মসূত্র নীলকণ্ঠভাষ্য টীকায় বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন । তিনি বলছেন -- 


" সূক্ষ্মচিদ্রুপাপন্নচিচ্ছক্তিবিশিষ্ট সকলতত্ত্বাতীত শিব এক এব ... সিসৃক্ষো স্তস্মাৎপ্রথমং শিবতত্ত্ব-পরবিন্দু-পরমায়া-শুদ্ধমায়া-মহামায়া-কুটিলা-কুণ্ডলিন্যা শব্দালম্বনত্বন প্রসিদ্ধাশুদ্ধাধ্বগত সকলভুবনভোগস্যানভোগোপকরণানাং উপাদানভূতা পরাশক্তিরুৎপত্তে। তত শক্তি সদাশিবো মহেশ্বর শুদ্ধবিদ্যেতি ... তদনন্তর অপরামায়া মিশ্রাধ্বগত সকলতনুভুবনাদ্দুপাদানভূতা জায়তে। ততঃ কালো, নিয়তিঃ, কলা, বিদ্যা, রাগঃ পুরুষ ইতি‌ ষট্-তত্ত্বানি‌জায়ন্তে। তদনন্তরং অশুদ্ধাধ্বগত তনুভুবনাদ্দুপাদানভূতং অব্যক্তং আবির্ভবতি।...এবমেতানি পরশক্ত্যয়াদীনি পৃথিব্যন্তানি জড়ানি ষট্-ত্রিংশতত্ত্বানি শিবশাস্ত্রেষু প্রসিদ্ধানি।.... নিবৃত্তিঃ--- প্রতিষ্ঠা--- বিদ্যা--- শান্তি---- শান্ত্যতীতেতি সংজ্ঞাভিঃ প্রসিদ্ধাঃ ... পঞ্চকলা পরশক্তিপ্রভবাঃ। তত্র শতকোটিযোজনমিতব্রহ্মাণ্ডরূপং পৃথিবীতত্ত্বং নিবৃত্তিকলায়ামবতিষ্ঠতে। জলাদ্য-অব্যক্তানি ত্রয়োবিংশতিস্তত্ত্বানি প্রতিষ্ঠায়াং। পুরুষাদীনি মায়ান্তানি সপ্ততত্ত্বানি বিদ্যায়াম্। শুদ্ধবিদ্যামহেশ্বরশ্চ শান্তিকলায়াম্। পরশক্তিস্তু তত্ত্বান্তরাণান্ত... পঞ্চপিকলা ... তত উপর্যুপরিস্থিতা শান্ত্যতীত পদোত্তরা ভবতি....শক্তিশব্দেন শিবতত্ত্বরূপা পরাশক্তিরুচ্যতে। " 


(ব্রহ্ম:সূ: নীলকণ্ঠ: ভাষ্য- শিবচিন্তামণিপ্রভা টীকা/২/২/৩৮, নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী )


👉 অর্থ -- (তত্ত্বাতীত পরাচিৎশক্তি বিশিষ্ট পরমশিব) ------ শিব তত্ত্ব--- শক্তিতত্ত্ব / পরামায়া/ কুণ্ডলিনী--- সদাশিব---- মহেশ্বর------ শুদ্ধ বিদ্যা----- অপরা মায়া/মায়া ----- কাল, নিয়তি, কলা, বিদ্যা, রাগ (মায়ার আবরণ) ----- অব্যক্ত প্রকৃতি এবং পুরুষ ---- তিনটি অন্তঃ কর্ন ---- পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রীয় ----- পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় --- পঞ্চ তন্মমাত্র ---- পঞ্চ ভূত (পৃথিবী তত্ত্ব পর্যন্ত) = ৩৬ তত্ত্ব


নিবৃত্তি কলা - পৃথিবী তত্ত্ব 

প্রতিষ্ঠা কলা - জল থেকে প্রকৃতি তত্ত্ব

বিদ্যা কলা - পুরুষ থেকে মায়া তত্ত্ব

শান্তি কলা- শুদ্ধ বিদ্যা থেকে মহেশ্বর

শান্ত্যতীত কলা - শক্তি, সদাশিব

শান্ত্যতীত্তোরা কলা - শিব তত্ত্ব


👉সুতরাং, দেখা যাচ্ছে পরমেশ্বর শিব কিভাবে জগতের উপাদান এবং নিমিত্ত কারণ হচ্ছেন।



👉শিবের অভিন্না শক্তিই ব্যবহারিক পর্যায়ে মায়া - প্রকৃতি হচ্ছেন এবং শিব নিজে জীব হচ্ছেন অথবা যেকোনো সাকার মূর্তি ধারণ করেছেন। তাই সাকার অবস্থায় তিনি নিজেরই শক্তি-সম্ভূতা প্রকৃতিতে অবশ্যই অধিষ্ঠিত হতে পারবেন । তাই পুরুষকে(পাশবদ্ধ ব্রহ্ম, সাকার)প্রকৃতির‌‌ অধিষ্ঠাতা ও ভোক্তা‌‌ বলা‌ যেতেই পারে।


👉 তাছাড়া ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য থেকে এটাও পুনরায় প্রমাণ হল যে - ব্রহ্মের থেকে অভিন্না শক্তিই যেহেতু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে মায়া হচ্ছেন এবং সেই মায়া দ্বারা সমগ্র জগৎ ব্যাপ্ত, তাই মায়াই সেই উপাদান কারণ, যা পাশুপত মতে স্থূল দৃষ্টিতে মান্য। আবার সেই মায়ার কারণ ব্রহ্মও তাই জগতের উপাদান এবং নিমিত্ত কারণ, কেননা ব্রহ্মই জগৎরূপে ব্যক্ত হয়েছেন। আর এই মতও পাশুপত মতে মান্য। তাই পাশুপত মত কখনোই শ্রুতির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নয়।


-🟥- সুতরাং পাশুপত মত কখনোই শ্রুতি বিরুদ্ধ নয় এটা প্রমাণিত হল। 


এবার অন্তিম পর্বটি এখানে দেখুন 👇

🔥দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্ক 👉 ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে করা শৈবদর্শনের উপর আরোপিত আপত্তির নিরসন (২) 



মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত