ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে করা শৈবদর্শনের উপর আরোপিত আপত্তির নিরসন (২)

🔥প্রথম পর্বের লিঙ্ক 👉 ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে করা শৈবদর্শনের উপর আরোপিত আপত্তির নিরসন (১) 


॥ দ্বিতীয় পর্ব ॥


 ♦️পূর্বপক্ষ- 


👉মায়াকেই ব্রহ্মের শক্তি বলা হয়। আর মায়া কখনও ব্রহ্মে মিশে যেতে পারে না, সেক্ষেত্রে ব্রহ্ম নিজেই মিথ্যা হয়ে যাবে । মায়া এবং মায়ার সাথে ব্রহ্মের সম্পর্ক হল অনির্বচনীয়। আর পরা প্রকৃতি মানে পরা শক্তি নয়, বরং পরা প্রকৃতি মানে পুরুষ (২৫ নং তত্ত্ব) বা ক্ষেত্রজ্ঞ জীব। সুতরাং শৈব মত বেদ বিরুদ্ধ। 




♦️উত্তর পক্ষ- 


এই প্রশ্নের উত্তর পূর্বের অংশেই দেওয়া হয় গেছে ।

শিবের সাথে অভিন্ন পরাশক্তিরই (পরাবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা) অপরা স্বরূপ হল মায়া। ইহাই অপরাবিদ্যা আর এই মায়া তার পঞ্চআবরণ এর সহিত সাক্ষাৎ জড় প্রকৃতি হিসেবে বিবেচিত হন। সুতরাং, এই মায়া হল অশুদ্ধ মায়া এবং অন্তিমে এই মায়াই শুদ্ধ মায়া স্বরূপে পরাশক্তি স্বরূপে সাক্ষাৎ ব্রহ্ম পরমশিবের হৃদয়ে সমাহিত হয়ে যান। তাই ব্রহ্মের সাথে সরাসরি কখনো মায়া সংযুক্ত হন না, ব্রহ্মের সাথে সংযুক্ত হন সেই পরাচিতি বা চিৎ বা পরাপ্রকৃতি , যার উল্লেখ ভগবৎ গীতায় আমরা পাই। সুতরাং বলা যেতে পারে এই সুপ্ত বিমর্শ পরাশক্তি সম্পন্ন ব্রহ্ম থেকেই মায়াতত্ত্ব আসছে আর এই মায়ার দ্বারাই সমগ্র জগৎ নির্মিত।



♦️শাস্ত্র প্রমাণে আমরা যাবো এবার।


👉" মূলপ্রকৃতিরব্যক্তা সা শক্তির্ময়ি‌ তিষ্ঠতি || ৩০ || "


(কূর্মপুরাণ/‌ উপরিভাগ/‌ঈশ্বরগীতা/ ৭নং অধ্যায়-বিভূতিযোগ)


----- অব্যক্ত মূলপ্রকৃতিরূপে ( পরাচিতি বা পরা শক্তি) এই মায়া আবার আমাতেই অবস্থান করে ।




👉” ঋতং সত্যং পরং ব্রহ্ম পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলম্ |

ঊর্ধ্বরেতং বিরুপাক্ষং বিশ্বরুপায় বৈ নমো নমঃ ॥ “


 কৃষ্ণ --- উমা ভাগ --- শক্তি ভাগ --- পরা প্রকৃতি ভাগ --- প্রকৃতি ভাগ


পিঙ্গল --- সাকার শিব ভাগ --- শিব তত্ত্ব ---- পুরুষ ভাগ


পরমব্রহ্ম -- পরমশিব বা সদাশিব , যিনি বিমর্শ পরাশক্তি বিশিষ্ট। 



👉তথাদিউমাসহাযং পরমেশ্বরং প্রভুং ত্রিলোচনং নীলকণ্ঠং প্রশান্তম্ ।

ধ্যাত্বা মুনির্গচ্ছতি ভূতযোনিং সমস্তসাক্ষিং তমসঃ পরস্তাৎ || ৭ || ( কৈবল্য উপনিষদ)


--- সেই পরম প্রভু প্রভু শিব উমার সহিত (ব্রহ্মবিদ্যা) বিদ্যমান, যিনি পরমেশ্বর , প্রশান্ত, ত্রিনেত্রধারী(সদাশিব) , নীলকণ্ঠ, যিনি সমস্ত ভূতের তথা প্রাণীদের মূল কারণ , সবকিছুর সাক্ষী এবং অবিদ্যা রহিত। এভাবে সেই শিবের মধ্যেই যোগীগণ ধ্যানের মাধ্যমে প্রবিষ্ট হন।



👉" শক্তিঃ স্বাভাবিকী তস্য বিদ্যা বিশ্ববিলক্ষণা |

একানেকস্য রূপেন ভাতি ভানোরিব প্রভা || ১ ||

অনন্তাঃ শক্তযো যস্যা ইচ্ছাজ্ঞানক্রিয়াদয়ঃ |

মায়াদ্দাশ্চাভবন্বহ্নের্বিস্ফুলিঙ্গা যথা তথা || ২‌ ||


(শিবমহাপুরাণ/ বায়বীয় সংহিতা/ উত্তরভাগ/ অধ্যায় নং ৭)


----- উপমন্যু বললেন—পরমেশ্বর শিবের স্বাভাবিক শক্তি হল বিদ্যা(পরা,অপরা,পরাপরা), যা সব থেকে বিশিষ্টরূপে প্রকাশিত, সেটি এক হয়েও বহু রূপে প্রভাসিত ; সূর্যের প্রভা যেমন এক হয়েও বহুরূপে প্রকাশিত হয় । এই বিদ্যাশক্তি দ্বারা ইচ্ছাশক্তি, জ্ঞানশক্তি, ক্রিয়াশক্তি, মায়াশক্তি ইত্যাদি নানা শক্তি উৎপন্ন হয়েছে, ঠিক তেমনভাবে যেমন অগ্নি থেকে নানাপ্রকার ফুলকি প্রকটিত হয়।



👉একো হি রুদ্রো ন দ্বিতীয়ায় তস্থূর্য ইমাংল্লোকান্ ঈশত ঈশনীভিঃ।(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ – ৩/২)


---- (পরমেশ্বর) রুদ্রই এক এবং অদ্বিতীয় আছেন, তিনি ভিন্ন দ্বিতীয় কেউ নেই। যিনি নিজ শক্তির দ্বারা নিখিল বিশ্বজগৎ নিয়ন্ত্রিত করেন। সেই রুদ্রই সমস্ত জীবের অন্তরে আছেন। সেই রুদ্রই সৃজন, পালন ও প্রলয় করেন।



👉” স তস্মিন্নেবাকাশে স্ত্রীয়মাজাগাম্ |

বহুশোভমানামুমাং হৈমবতীং তাং হোবাচ কিমেতদযক্ষমিতি || ১২ || “


(কেন উপনিষদ/ তৃতীয়খণ্ড)


---- এরপর ইন্দ্রদেব আকাশে একটি দীপ্তিমতী স্ত্রীর অবয়ব দেখতে পেলেন, তিনিই উমা। তিনি হৈমবতী। সেই উমাকে এরপর ইন্দ্রদেব জিজ্ঞেসা করলেন যে কে এই যক্ষ ।



👉 এ প্রসঙ্গে শৈব পণ্ডিত শ্রীউমচিগি শঙ্কর শাস্ত্রী বলছেন ---


“স ইন্দ্র তস্মিন্নেবাকাশপ্রদেশে পরশিবব্রহ্ম স্বস্য শিবাং তনুমদর্শয়েৎ , …তাং বিদ্যাস্বরূপিণীং হৈমবতীং হিমবতঃ পুত্রীম্ উমাম্ উমাশব্দবাচ্যাং পার্বতীমাবির্ভূতামুবাচ….. “



👉ভাষ্যের অনুবাদ — যক্ষরূপি পরমশিবরূপি ব্রহ্মের অন্তর্হিত হওয়ার পর ইন্দ্রদেব এরপর সেই আকাশে সেই পরমশিবের শক্তি শিবাকে দর্শন করলেন। তিনি বিদ্যাস্বরূপিণী (পরা বিদ্যা বা পরা শক্তি বা ব্রহ্মবিদ্যা অর্থে), তিনি হিমালয়ের পুত্রী উমা হৈমবতী। উমা শব্দে ‘পার্বতীকে’ বোঝানো হচ্ছে ।



👉এমনকি আদিশঙ্কর আচার্যের শাঙ্কর ভাষ্যেও(অদ্বৈত ভাষ্য) পর্যন্ত বলা আছে — “উমাং… শোভনতমাং বিদ্যাং……উমৈব হিমবতো দুহিতা হৈমবতী নিত্যমেব সর্ব্বজ্ঞেন ঈবরেণ সহ বর্ত্তত….”


---- অর্থাৎ উমা হলেন সর্বশোভা সম্পন্না, হেমাভরণসম্পন্না ও বিদ্যাস্বরূপিণী (ব্রহ্মবিদ্যা অর্থে) । উমা অর্থাৎ হিমালয়ের কন্যা হৈমবতী যিনি সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের সাথে নিত্যা বিরাজিতা ।

(এখানে ব্রহ্ম স্বয়ং সেই ঈশ্বর এবং উমা হলেন ব্রহ্মবিদ্যা বা ব্রহ্মের-স্বরূপ জ্ঞান প্রদায়িণী বিদ্যা, কেননা তিনি ব্রহ্মের সাথেই থাকছেন। এই ধারণাও শৈবমতের পরিপন্থী ।


♦️উমা/পার্বতী কি সত্যিই ব্রহ্মবিদ্যা?? দেখে নেওয়া যাক তৈত্তিরীয় আরণ্যকে সায়ণভাষ্য ‘এই উমাপতি‘, ‘অম্বিকাপতি‘ প্রসঙ্গে কি বলছে —



👉সায়ণভাষ্য — ” অম্বিকা জগন্মাতা পার্বতী তস্যাঃ + পতয়ে ভর্ত্রে। তস্যা একাম্বিকায়া ব্রহ্মবিদ্যাত্মকো দেহ উমাশব্দেনোচ্যতে | তাদৃশ্যা উমায়াঃ পতয়ে স্বামিনে রুদ্রায় পুনঃ পুনর্নমস্কারোহস্তু | “


(কৃষ্ণ যজুর্বেদ / তৈত্তিরীয় আরণ্যক / দশমপ্রপাঠক/ ১৮ নং অনুবাক)


👉ভাষ্যের অনুবাদ– অম্বিকা অর্থাৎ জগন্মাতা পার্বতী। অম্বিকাপতি অর্থাৎ সেই জগন্মাতা পার্বতীর পতি। সেই এক ও দ্বিতীয় ব্রহ্মবিদ্যাস্বরূপিণী অম্বিকাই উমা শব্দের দ্বারা বাচিত হয়েছেন (সাকারে)। সেই উমার পতি, স্বামী রুদ্রকে (মহাদেব) পুনঃ পুনঃ নমষ্কার।

তো পরিষ্কার হয়েগেল এখান থেকে কে আসলে ব্রহ্মবিদ্যা এবং কে তাঁর পতি (স্বয়ং ব্রহ্ম)।



👉তাছাড়া ভগবদগীতাতেও সাংখ্যের জড় অপরা প্রকৃতি থেকে উর্ধ্বে এক পরা প্রকৃতির কথা বলা হয়েছে। ভগবদগীতার সপ্তম অধ্যায়ে ৫-৭ নং শ্লোকে বলা আছে যে — পরমেশ্বরের অষ্টধাজড়প্রকৃতির (পঞ্চভূত + তিনটি অন্তঃকর্ণ) চেয়েও আরও একটি সূক্ষ্মপ্রকৃতি আছে তাঁর নাম পরাপ্রকৃতি। এই পরাপ্রকৃতি হল ‘জীবাভূতাং’ অর্থাৎ ইহাই জীব বা পুরুষ হয়েছেন।

। এই পরাপ্রকৃতিই জীব সৃষ্টির নিমিত্ত কারন। এই পরাপ্রকৃতিই জগতকে ধারণ করে আছেন। পরমেশ্বরের এই অপরা ও পরাপ্রকৃতিই হল সর্বভূতের উৎপত্তির কারন ।


👉 ভগবৎ গীতার অভিনবগুপ্ত ভাষ্য–কাশ্মীর শৈব সাধক মহামহেশ্বর অভিনবগুপ্ত তাঁর ভগবদগীতার অদ্বৈত শৈব ভাষ্য ‘গীতার্থ সংগ্রহ’ তে বলেছেন —


” সৈব জীবত্বং-পুরুষত্বং প্রাপ্তা পরা মমৈব নান্যস্য চ |

সোভয়রূপা বেদ্যবেদকাত্মকপ্রপঞ্চোপরচনবিচিত্রা …..স্বস্বভাবাত্মিকা সততমব্যভিবারিণী প্রকৃতিঃ | ইদং জগৎ ভূম্যাদি | “


--- সেই জড় প্রকৃতি যখন পুরুষের সাথে একীভূত হন তখন সেই তত্ত্বকেই পরাপ্রকৃতি বলে। পরমেশ্বরের সেই পরাপ্রকৃতি উভয়রূপ অর্থাৎ প্রকৃতি-পুরুষাত্মক ও বেদ্য-বেদকাত্মক জগতের কারন।



👉আর এই পরাপ্রকৃতিই হল সাক্ষাৎ পরমেশ্বর ব্রহ্মের ইচ্ছাশক্তি বা মহামায়া ব্রহ্মবিদ্যাস্বরূপিণীও বলা যেতে পারে । আসলে পরমশিবের এই পরাপ্রকৃতিই পুরুষ ও মায়া প্রকৃতিরূপে আত্মপ্রকাশ করছেন।  



👉 ভগবৎ গীতার শাঙ্করভাষ্যের আনন্দগিরি টীকায় স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে --


"অচেতনবর্গমেকীকর্ত্তুং প্রকৃতেরষ্টধা .... চেতনবর্গমেকীকর্ত্তুং পুরুষস্য চৈতন্যস্য বিদ্যাশক্ত্যবচ্ছিন্নস্যাপি..."


-- অর্থাৎ অচেতন জড় প্রকৃতিই হল অষ্টধাপ্রকৃতি বা মায়া (অপরা বিদ্যা) । কিন্তু চেতন প্রকৃতি হল জীব বা পুরুষের চৈতন্যস্বরূপ, তিনি সাক্ষাৎ বিদ্যাশক্তি (পরাবিদ্যা)।



👉সুতরাং ব্রহ্ম পরশিবে যে সূক্ষ্ম চৈতন্য বর্তমান সেটাই হল সাক্ষাৎ পরাশক্তি বা নিজা শক্তি বা পরা বিদ্যা। আর পরা বিদ্যা যেহেতু মোক্ষদায়ীনি তাই পরাবিদ্যা কে কখনো মায়া বলা যাবে না, কেননা মায়া সর্বদাই মোক্ষের থেকে জীবকে দূরে সরিয়ে রাখে । এই পরা বিদ্যা থেকে আসে পরাপরা বিদ্যা , সেখান থেকে আসে অপরাবিদ্যা বা মায়া। তাই শৈব মতের খণ্ডন কদাপি হচ্ছে না।


♦️পূর্ব পক্ষ-  


👉তাহলে কি মহর্ষি বাদরায়ণ ভুল আর আপনারাই ঠিক ?


♦️উত্তর পক্ষ- 


👉 একদমই না। বাদরায়ণ‌ সঠিকই ছিলেন বরং ভাষ্যকারেরা পূর্ণ বিশ্লেষণ করেননি। তারা বরং এক দুইটি শিব উপাসক অবৈদিক পরম্পরার দর্শনগত ত্রুটিকে পুরো শৈব পরম্পরা এবং পুরো পাশুপত শৈব পরম্পরার উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁদের ভাষ্যে।



🟥সঠিক মীমাংসা ও বিশ্লেষণ-  


আসলে মাহেশ্বর বলতে বোঝানো হয় - মাহেশ্বর যোগ ধারণকারী শৈবদের। (লিঙ্গ পুরাণ)


এদের মধ্যে প্রাচীন অদ্বৈতমার্গী বৈদিক পাশুপত ঘরানা ছিল। ( যার কথা ভাষ্যকার উল্লেখ করেননি।)


 দ্বৈতবাদী পাশুপত ঘরানা ছিল।


কালামুখ (কারুনিক)ঘরানা ছিল।


অতিমার্গীক কাপালিক ঘরানা ছিল । 


আসলে, শুধুমাত্র শেষের তিনটি পরম্পরা ছিল অবৈদিক পরম্পরা। তাদের কর্মকাণ্ড এবং দ্বৈতবাদী দর্শন ছিল বেদান্ত ও বেদবিরোধী। । কিন্তু তাই বলে পুরো শৈব সম্প্রদায় বা পুরো পাশুপত সম্প্রদায় কেই বেদ বিরোধী বলা যায় না, কেননা প্রাচীন অদ্বৈত পাশুপত মার্গ ছিল বৈদিক। ব্রহ্মসূত্রে খণ্ডন করা হয়েছে অবৈদিক পাশুপত মত যেমন কাপালিক, কারুনিক, ক্ষপণক, দিগম্বর এসব মতের দর্শনকে মাত্র। কেননা তাদের দর্শন ছিল বেদান্ত বিরোধী। শৈব বৈদান্তিক আচার্যরাও তাঁদের খণ্ডন করে গেছেন। সাথে ন্যায়, বৈশেষিক, পাতঞ্জল প্রভৃতি মতকেও খণ্ডন করা হয়েছে একই কারণের জন্য। সুতরাং ভাষ্যকার এর অসামঞ্জস্যতা প্রমাণ হয় এখানে।



♦️পূর্ব পক্ষ- 


👉 আপনাদের কথার সপক্ষে প্রমাণ কোথায় ? প্রমাণ ছাড়া আপনাদের এই দাবিকে কিভাবে মানা সম্ভব ? আর তাছাড়া শৈবদের আগমগুলিও তো বেদ ও বেদান্ত বিরোধী।



♦️উত্তর পক্ষ - 


👉মহেশ্বররা (শৈবরা) শিব কর্তৃক সৃষ্ট আগম এর অনুসারী এবং শৈব আগমগুলি যে বেদ বিরোধী- এই দাবিও অমান্য। কেননা, শৈব সম্প্রদায় হল নিগম-আগমোক্ত সম্প্রদায় অর্থাৎ তারা যেমন আগম মত অনুসারী তেমনি তারা শ্রুতি শাস্ত্র কেও অনুসরণ করে চলে। আগম প্রধানত দুই প্রকার - 


1. শ্রৌত আগম বা বেদানুকুল আগম (28টি শৈব আগম, 107 টি উপআগম, বীরশৈব আগম, প্রভৃতি) 

 

2. অশ্রৌত আগম বা বেদ বহির্ভূত আগম ( লাকুলাগম, বামতন্ত্র, কাপাল আগম, পাশুপত তন্ত্র)। এসব শাস্ত্র দ্বৈতবাদী হওয়ায় এবং বামাচারী কর্মকাণ্ডের পরিপোষক হওয়ায় সেগুলি মান্যতা পায় না খুব একটা।


3. তাছাড়া রয়েছে 64 টি ভৈরব আগম । এগুলির মধ্যে প্রধান প্রধান ভৈরব আগম গুলির জ্ঞান কাণ্ড সম্পূর্ন বেদের অনুকূল, তারা অদ্বৈত এরই বোধক। আর সেই সব আগম গুলির উপরে শৈব আচার্য দের ভাষ্যও রয়েছে। 


👉কথা না বাড়িয়ে‌ শাস্ত্রপ্রমাণ কি বলছে শৈব আগমের ব্যাপারে দেখে নেওয়া যাক --


" ইতিহাস পুরাণাভ্যাং কথংচিদুপবৃংহিতঃ || ৯ ||

শৈবাগমৈস্তু সংপন্নঃ সহাংগোপাংবিস্তরঃ || ১০ ||

শৈবাগমো হি দ্বিবিধঃ শ্রৌতহশ্রৌতশ্চং সংস্কৃতঃ |

শ্রুতিসারময়ঃ শ্রৌতস্বতংত্র ইতরো মতঃ || ১১ ||

স্বতংত্রো দশাধা পূর্বং তথাষ্টাদশধা পুনঃ |

কামিকাদিসমাখ্যাভিসিদ্ধঃ সিদ্ধান্তসংজ্ঞিতঃ || ১২ ||

শ্রুতিসারময়ো যস্তু শতকোটিপ্রবিস্তরঃ | ১৩ 

পরং‌ পাশুপতং যত্র‌‌ ব্রতং জ্ঞানং চ‌ কথ্যতে || ১৮ || "


(শিবমহাপুরাণ/ বায়বীয় সংহিতা/ পূর্বখণ্ড/ ৩২ নং অধ্যায়)



----- ভগবান শিবের প্রতিপাদিত যে পরম ধর্ম, তার নাম শ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠান। ইতিহাস এবং পুরাণাদি দ্বারা কোনো রকমে তার বিস্তার করা হয়েছে, কিন্তু শৈব-শাস্ত্রাদি দ্বারা তার বিস্তারের যথাযথ নিরূপণ করা হয়েছে। সেখানেই তাঁর স্বরূপ সম্যক্ভাবে প্রতিপাদিত হয়েছে। শৈব আগমের দুটি ভাগ—শ্রৌত (ঊর্ধ্বস্রোত, তন্ত্ররাজি, superior) এবং অশ্রৌত (অধ স্রোত, তন্ত্র নিচয়, inferior)। শ্রুতির সারতত্ত্ব দ্বারা যা সম্পন্ন তা শ্রৌত ; আর যা স্বতন্ত্র, তাকে অশ্রৌত মানা হয়। স্বতন্ত্র শৈবাগম পূর্বে দশ প্রকারের ছিল, পরে আঠারো প্রকারের হয়। সেটি কামিক ইত্যাদি সংজ্ঞায় সিদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত (সিদ্ধান্ত‌ আগম) নাম ধারণ করে, যা শ্রুতিসার ময় এবং তা শতকোটি শ্লোকে বিস্তারিত করা হয়েছে। তাতেই উৎকৃষ্ট পাশুপত ব্রত এবং পাশুপত-জ্ঞানের বর্ণনা করা হয়েছে।



👉 এ প্রসঙ্গে শ্রীপতি পণ্ডিত তাঁর শ্রীকর ভাষ্যে বিস্তারিত বলে গেছেন ----


" পরমেশ্বরস্য জগদুভয়কারণত্বং বিধায়ক।‌ ভূতপতেশিবস্য জগদুভয়কারণত্ব বিধায়ক শুদ্ধসাত্তিক শৈব মতস্য প্রাধান্যং উত শৈবমতাভাসক মিশ্ররৌদ্র পাশুপত গাণাপত্য সৌর শাক্ত কাপালিক বৈষ্ণবাদি মতানাং বেতিবিষয়ঃ। ...

পাঞ্চরাত্রং চ‌ চার্বাকমঘোরং ক্ষপণং তথা‌ |

শাক্তং কাপালিকং মিশ্রং‌ তন্ত্রং‌‌ পাশুপতং‌ তথা |

চকার মোহশাস্ত্রাণি বেদবাহ্যানি সাদরাৎ‌ ||

পুরা দানবমোহার্থং‌ কেশবেন‌ শিবেন চ |

পাঞ্চরাত্রং‌ চ‌ কাপালং‌ যাম্যং‌ লোকায়তং‌ তথা || "


---- শুদ্ধ সাত্ত্বিক , বৈদিক, আগমিক শৈব মতে পরমেশ্বর শিবের জগতের উভয় কারণনত্ব ( নিমিত্ত আর উপাদান) প্রাধান্য পায়। কিন্তু মিশ্ররৌদ্র, পাশুপত (অবৈদিক), গাণপত্য, সৌর, শাক্ত, কাপালিক বৈষ্ণব মতের ক্ষেত্রে সেটা আলাদা ব্যাপার। পাঞ্চরাত্র, চার্বাক, মিশ্ররৌদ্র তান্ত্রিক, পাশুপত (অতিমার্গীক, অবৈদিক) প্রভৃতি সম্প্রদায় হল মোহশাস্ত্র ভিত্তিক, প্রাচীনকালে দানবদিগের মোহনার্থে এসব শাস্ত্রসমূহ কে নির্মাণ করা হয়েছিল ।


(শৈব বৈদান্তিক শ্রীপতি পণ্ডিতারাধ্যের শ্রীকরভাষ্য/২/২/ ৩৭-৪১ সূত্রাদির ভাষ্য‌‌ থেকে সংগৃহীত।)



👉 শৈব পণ্ডিত মু ডিগোণ্ডা নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী স্পষ্ট ভাবেই তাঁর গ্রন্থ ' বিদ্যাস্থানবিনির্ণয় ' তে এপ্রসঙ্গে বলেছেন যে -


" অবৈদিক পাশুপত মার্গও শাস্ত্রে উল্লেখিত আছে। সেগুলি হল বামাচারী। তাদের যে সকল আগম আছে যেমন - পাশুপত, কালামুখ, লাগাডা এসব আগম ২৮টি শৈব আগমের মধ্যে পড়ে না, এগুলি অবৈদিক। ২৮ টি শৈব আগম পুরোপুরি ভাবে বৈদিক।

যদিও এই সকল আগমগুলি পুরোপুরি ভাবে অবৈদিক নয়, কেননা এগুলো শুধুমাত্র (কর্মকাণ্ডগত ভাবে) বেদকে মেনে চলে না। "


(বিদ্যাস্থানবিনির্ণয় / পৃষ্ঠা- ১০৮)




👉 শ্রীপতি পণ্ডিতারাধ্য তাঁর ব্রহ্মসূত্র শ্রীকর ভাষ্যে জগৎগুরু রেণুকাচার্যের (সিদ্ধান্তশিখামণির শ্লোক)উক্তি উল্লেখ করে বলছেন - 


" আগমা বহুধা‌ প্রোক্তাঃ শিবেন পরমাত্মনা।

শৈবং পাশুপতং সোমং লাকুলং চেতি ভেদতঃ ||

তেষু শৈবং চতুর্ভেদং তন্ত্রং সর্ববিনিশ্চিতম্‌ |

বামং চ দক্ষিণং চৈব মিশ্রং সিদ্ধান্তসংজ্ঞিতম্ ||

শক্তিপ্রধানং বামাখ্যং দক্ষিণং ভৈরবাত্মকম্ |

সপ্তমাতৃপরং মিশ্রং সিদ্ধান্তং বেদসম্মতম্ || "


(শৈব বৈদান্তিক শ্রীপতি পণ্ডিতারাধ্যের শ্রীকরভাষ্য/২/২/ ৩৭-৪১ সূত্রাদির ভাষ্য‌‌ থেকে সংগৃহীত।)


----- শেষের অংশেই স্পষ্টভাবে বলা আছে যে, আগম বহু প্রকারের, তাদের মধ্যে শৈব সিদ্ধান্ত আগমগুলি বেদসম্মত।



👉 নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী তাঁর ' বিদ্যাস্থানবিনির্ণয় ' এ আরো উল্লেখ করেছেন যে -


" পাশুপত ব্রত শুভ, অত্যন্ত গুহ্য, সূক্ষ্ম, বেদের সার এবং মোক্ষমার্গিক। " 

আবার পরক্ষনেই তিনি বলছেন -


" মানুষের কখনো বাম, পাশুপত, লকুলিশ এবং সোমপন্থা (সোম সিদ্ধান্ত= কাপালিক) প্রভৃতি অ বৈদিক মার্গ অনুসরণ করা উচিত নয় "।


(বিদ্যাস্থানবিনির্ণয়/ পৃষ্ঠা - ১০৫-১০৬)



---- সুতরাং শ্রৌত এবং অশ্রৌত পাশুপতমতের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে সেটা একদম পরিষ্কার হয়ে গেল।

অশ্রৌত পাশুপত মত ছিল অতি মার্গীক, বামাচারী এবং দ্বৈত পন্থা।




👉 " শৈবাগমোদিতো ধর্মো বরিষ্ঠো ন সংশয়ঃ | "

(স্কন্দপুরাণ/ সূতসংহিতা/‌‌ যজ্ঞবৈভব খণ্ড/ ২০ নং‌ অধ্যায়)


---- শৈব আগমোক্ত ধর্ম যে বরিষ্ঠ (শ্রেষ্ঠ‌ ও প্রাচীন)‌‌সে‌ ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই।


👉অনুবাক স্বামী সয়ম্প্রকাশ গিরি (অদ্বৈতবাদী) এপ্রসঙ্গে আরও বলছেন -- বৌদ্ধ, জৈন বা ক্ষপণক আগম, বৈষ্ণব আগম(‌পাঞ্চরাত্র)‌ এসবের থেকে শৈবাগম অধিক শ্রেষ্ঠ, কেননা শৈবরা ভেদের ঊর্ধ্বে গিয়ে অভেদকে স্বীকার করে।



👉 শৈব আগমের মান্যতা প্রদর্শনার্থে নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী তাঁর ব্রহ্মসূত্র নীলকণ্ঠ ভাষ্যে টীকায় এবং 'বিদ্যাস্থানবিনির্নিয়' গ্রন্থে বলছেন -


 " অতএব‌ শ্রীবিদ্যারণ্যৈ জৈমিনীয় ন্যায়মালায়াং‌ সর্বাসুপনিষৎসু প্রতীয়মান যৎপরংব্রহ্ম তদৈব শৈবাগমেষু প্রতিপাদ্যত ইতি শিবাগমানাং প্রামাণ্যপরিগ্রহমুপপদ্যতে । 


"(নীলকণ্ঠভাষ্য / শিবচিন্তামণিপ্রভা‌ টীকা/ ২ / ৩৮)


----- বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদী আচার্য শ্রীবিদ্যারণ্য (মতান্তরে মাধবাচার্য, শ্রীবিদ্যার্ণব তন্ত্রের রচয়িতা) তাঁর 'জৈমিনীয় ন্যায়মালা' গ্রন্থে বলেছেন যে - সর্ব উপনিষদে যে তৎ ব্রহ্মের কথা বলা হয়েছে শৈব আগমগুলিতেও সেই ব্রহ্মই প্রতিপাদিত হয়েছেন - এই বাক্য শৈব আগমের প্রামাণিকতা এবং সার্বজনীন মান্যতাকেই পরিগ্রহণ করে।



👉 শ্রীকণ্ঠ শিবাচার্য এ প্রসঙ্গে বলছেন -


" বেদশিবাগমোয়ো ভেদং‌ ন পশ্যামঃ । .... উভয়ো রেক এব শিব শিবঃ‌ কর্তা। ঈশান সর্ববিদ্যানাং, অস্য মহতো ভূতস্য নিঃশ্বসিত, ইত্যাদি‌ শ্রুত্যা ..। "


(ব্রহ্মসূত্র/ নীলকণ্ঠ ভাষ্য‌/‌২ / ২/ ৩৮)


----- বেদ এবং শৈব আগম এর মধ্যে কোনো ভেদই নেই। উভয়ের স্রষ্টাই হলেন সাক্ষাৎ শিব।




👉তাছাড়া শৈব আগম, শিব সূত্র, মহেশ্বর সূত্রের উল্লেখ পাওয়া যায় বিভিন্ন পুরাণে। কার্তিক দেব নিজে শিব সূত্রের উল্লেখ করেছেন শিব পুরাণে এবং মহর্ষি উপমন্যুজী বিভিন্ন পুরাণে আগমোক্ত বিধানে শিবের অর্চনার উপদেশ দিয়ে গিয়েছেন, তিনি মহেশ্বর সূত্র এর উপর ভাষ্য পর্যন্ত করে গিয়েছেন (তত্ত্ববিমর্শিনি) । সুতরাং শৈব আগম, মহেশ্বর সূত্র এবং শিবসূত্রের উপরে প্রতিষ্ঠিত শৈব পরম্পরা কখনো অবৈদিক হতে পারে না একথা প্রমাণিত হল।


 [ বলা বাহুল্য যে বিশেষ বিশেষ কিছু শৈব পরম্পরা আছে যেমন অঘোর , কৌল, ভৈরব ইত্যাদি এদের কর্মকাণ্ড শুধুমাত্র অবৈদিক কিন্তু জ্ঞানকাণ্ড গত ভাবে তারা শ্রুতির অনুকূল। কেননা সেই এক অদ্বৈত শিবই সমগ্র জগতে বিরাজমান, এটাই তাঁদের উপলব্ধি। ]



👉সুতরাং সিদ্ধান্তে আশা যায় যে, কয়েকটি অবৈদিক শৈব পরম্পরার দর্শনকে খন্ডন করাকে কখনোই পুরো শৈব পরম্পরার খণ্ডন বলে দাবি করা যায় না। আর পশুপতি শব্দ টি সম্পূর্ন ভাবে বৈদিক এবং তিনি সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিব। তাই শৈব মতে কোনো অলীক ঈশ্বরকে কল্পনা করা হয় না। দর্শনগত মত ভেদ থাকতেই পারে । সুতরাং ব্রহ্মসূত্রের দুটি পাতা পড়ে সেখানে শৈব শব্দটি দেখে যারা দাবি করছেন যে ওখানে পুরো শৈব পরম্পরারই খণ্ডন করা আছে, তাদের সেই দাবিকে নস্যাৎ করা হল। তাছাড়া, পাশুপত ধারা সম্পর্কে অজ্ঞ যেসকল ব্যাক্তি দাবি করেছিলেন যে, ব্রহ্ম সূত্রে পুরো পাশুপত মত কেই খণ্ডন করা আছে , সেই দাবিকেও নস্যাৎ করা হল।


👉তারা হয়ত এটা জানে না যে, ভগবান শিবের নির্দেশেই ব্যাসদেব ব্রহ্মসূত্রের রচনা করেছিলেন -


ব্যাস উবাচ -

" আজ্ঞয়া কেবলং শম্ভোরহং বেদার্থবেদনে || ৭২ ||

সংপূর্ণঃ সর্বেবেদান্তব্যাখ্যার্থং নিশ্চয়ে |

সমর্থশ্চ নিযুক্তশ্চ সূত্রারম্ভকৃতেऽপি চ || ৭৩ || "


( স্কন্দপুরাণ / সূতসংহিতা/ যজ্ঞবৈভব খণ্ড)


----- ব্যাসদেব বললেন কেবল শিবের আজ্ঞাতেই আমি বেদার্থ বুঝতে সক্ষম হয়েছি, উপনিষদ- বাক্যের নিশ্চয় করতে সক্ষম হয়েছি এবং ব্রহ্মসূত্র রচনায় উদ্যত হয়েছি। ।


সুতরাং শৈব পরম্পরার উপরে ব্রহ্মসূত্রকে ভিত্তি করে আঙ্গুল তোলার পূর্বে দশবার ভাবা উচিত।



🙏নমঃ শিবায়🙏

🙏নমঃ‌ শিবায়ৈ🙏



👉অপপ্রচারের জবাব প্রদানে - ©RohitKumarChoudhury (ISSGT)


👉প্রচারে - International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত