পরমেশ্বর শিব বৈষ্ণব নন
(সম্পূর্ণ আলোচনাটি ধৈর্য সহকারে ধীরে ধীরে পড়ুন এবং শেষে নিজের বিচার বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে ভাবুন)
আজকাল বৈষ্ণব গণের মুখে মুখে একটি বচন খুব বেশি প্রচলিত। তারা যতটা না প্রভু শ্রীহরির নাম করেন বরং তার চেয়েও বহুগুণ বেশি একটি শ্লোক বেশি বেশি আওড়ান। সেটি হল,
“ বৈষ্ণাবানাং যথা শম্ভু ”
[তথ্যসূত্র - ভাগবত পুরাণ - ১২/১৩/১৬]
এই শ্লোকটি শাস্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞ জনসাধারণের কাছে বৈষ্ণবগণ বারংবার বলতে থাকেন।
এর দ্বারা তারা সিদ্ধ করতে চান যে শিব হল বৈষ্ণবদের শ্রেষ্ঠ।
এখন প্রশ্ন হল বৈষ্ণবগণ কেন এটি বারংবার প্রচার করেন ? তাদের উদ্দেশ্য টি কি ?
আগে জানতে হবে যে বৈষ্ণব কাদের বলা হয়।
যে ব্যক্তি ভগবান শ্রীবিষ্ণুর ভক্ত তাকেই বৈষ্ণব বলা হয়।
আমরা জানি একজন ভক্ত সর্বদাই তার আরাধ্যের চরণে নিজেকে সমর্পণ করে দেন এবং সর্বদা আরাধ্যকে ভজনা করেন।
আর বৈষ্ণবগণ এই শ্লোকটির মাধ্যমে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বোঝাতে চান যে শিব হল শ্রীবিষ্ণুর চরণে পড়ে থাকা একজন ভক্ত। যাকে বৈষ্ণবগণ লোকদেখানো আদর করে আহ্লাদিত করে দাস বলে থাকেন। অর্থাৎ বৈষ্ণবগণ এই শ্লোকটির ব্যবহার করে সর্বদাই শিবকে বিষ্ণুদাস বলে প্রচার করে থাকেন। তারা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পরমবৈষ্ণব হিসেবে শিবকে একজন দাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর থাকেন। যখনই কোনো জিজ্ঞাসু ব্যক্তি এই সমস্ত বৈষ্ণবদের কাছে এসে শিব সম্পর্কে কিছু জানার জন্য প্রশ্ন করলেই , এই বৈষ্ণবেরা সর্বদা সরসরি এই ধরণের কথা বলেন, শিব তো পরমবৈষ্ণব, তিনি সারাদিন পঞ্চমুখে রামনাম/হরিনাম করেন, ভাগবতে বলা হয়েছে বৈষ্ণাবানাং যথা শম্ভু , তাই শিব হল পরমবৈষ্ণব।
- এই ধরণের কথাবার্তা বৈষ্ণবদের মুখের বুলি হয়ে সবসময়ে জিহ্বার অগ্রভাগে ঝুলতে থাকে। এককথায় তারা শিবের পরিচয় ওই পরমবৈষ্ণব হিসেবে আখ্যা দিয়ে সীমাবদ্ধ করে দিতে চায়, যাতে শিবের চেয়ে হরি শ্রেষ্ঠ বলেই প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শিবভক্তরাও যাতে শিব ছেড়ে একমাত্র হরি/কৃষ্ণ - এর ভক্ত হয়ে ওঠে সেই উদ্দেশ্যে এই কলিরচর বৈষ্ণবেরা কৌশলতার সহিত শিব নিন্দা করে মিষ্টি মুখে। যাতে সাপও মরে আর লাঠিও না ভাঙ্গে। অবুঝ সনাতনীরা ও শিবজ্ঞানশূণ্য শিবভক্তরা মায়ার বশে ঐ কলিরচর বৈষ্ণবদের মিষ্টি ভাষা শুনে বিশ্বাস করে এবং ভ্রমবশত শিবকে বৈষ্ণব ভাবতে শুরু করে, বর্তমানে বৈষ্ণবরা যতটা না হরিনাম করে, তার চেয়ে শিবনিন্দা করে ঢের বেশি। এই সব বৈষ্ণবেরা তাদের পালাকীর্তনে বা অনান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গিয়ে ধর্মীয় জ্ঞান দিতে গিয়ে বারংবার পরমেশ্বর শিবকে বৈষ্ণব বলে প্রচার করতে থাকে আর তখর সাথে থাকে তাদের মস্তিষ্ক থেকে আমদানি করা নূতন নূতন কাল্পনিক গল্পের ভাণ্ডার, যার দ্বারা তারা গরুকে গাছেই নয় সোজা মঙ্গল গ্রহে পাঠিয়ে দেয়। সেই স্থানের দর্শকরাও তা বিশ্বাস করে নেয়, এই ভাবে গত পাঁচশত বছর ধরে আমাদের সনাতনীদের এই এক কথা শুনিয়ে গেছে বৈষ্ণবেরা, শিব পরম বৈষ্ণব, ভাগবতে বলা আছে বৈষ্ণাবানাং যথা শম্ভু , ফলে শোনা কথা বিশ্বাস করে করে সূদূর অতীত থেকে একটা ভ্রান্ত ধারণা চলে এসেছে যে শিব হল পরমবৈষ্ণব।
চলুন তবে দেখা যাক ওই শ্লোকটির অন্তর্নিহিত অর্থ আসলেই কি ?
🔲 বৈষ্ণবদের আক্ষেপ নিবারণ ১ —
“ বৈষ্ণাবানাং যথা শম্ভু ”
– ভালো করে দেখুন এখানে ‘শিব’ বলা হয়নি বরং এখানে “শম্ভু” বলা হয়েছে।
হ্যা.. শিবের অসংখ্য নামের মধ্যে একটি বিশেষ নাম হল “শম্ভু”।
কিন্তু এখন একটা কথা বিচার করুন। জগতের কোনো ব্যক্তির নাম যদি শম্ভু হয় তবে সেই শম্ভু আর স্বাক্ষাৎ পরমেশ্বর শম্ভু কি এক ?
শম্ভু নামটি কি শিব ভিন্ন দ্বিতীয় অন্য কোনো ব্যক্তির নাম হতে পারে না ?
অবশ্যই হতে পারে।
তাহলে যদি “ বৈষ্ণাবানাং যথা শম্ভু ” – এর শম্ভু আসলে পরমেশ্বর শিব না হয়ে থাকে তবে এই শম্ভু নামক ব্যক্তিটি কে এটাই প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ভাগবত পুরাণের “ বৈষ্ণাবানাং যথা শম্ভু ” – এই শ্লোকের শম্ভু হল শ্রীবিষ্ণুর পরমভক্ত ধ্রুবের বংশধর পুত্র। এই শম্ভু একজন মনুষ্য। ইনি স্বাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিব নন।
এই পরমবৈষ্ণব ধ্রুবের বংশধর পুত্র মনুষ্য শম্ভু নিজেও একজন তেজস্বী পরমবিষ্ণুভক্ত বৈষ্ণব।
প্রমাণ দেখবেন ?
চলুন দেখা যাক এই “ বৈষ্ণাবানাং যথা শম্ভু ” -এর ‘শম্ভু’ নামক ধ্রুবের পুত্র পরমবৈষ্ণব শম্ভুর নামে উল্লেখিত কিছু পৌরাণিক শ্লোকের প্রমাণ। যা থেকে প্রমাণিত হয়ে যাবে যে
“ বৈষ্ণাবানাং যথা শম্ভু ” – এর এই শম্ভু আসলে পরমেশ্বর শিব নন।
🔷প্রথম প্রমাণ কূর্মপুরাণ থেকে👇
সুত উবাচ ।
প্রিয়ব্রতোত্তানপাদৌ মনােঃ স্বায়ম্ভুবস্য তু ।
ধৰ্ম্মজ্ঞৌ তৌ মহাবীর্যৌ শতরূপা ব্যজীজনৎ ॥১
ততস্তূত্তানপাদস্য ধ্রুবাে নাম সুতােঽভবৎ ।
ভক্ত্যা নারায়ণে দেবে প্রাপ্তবান্ স্থানমুত্তমম্ ॥২
👉ধ্রুবাচ্ছিষ্টিশ্চ ভব্যশ্চ ভব্যাচ্ছম্ভুর্ব্ব্যজায়ত ।
শিষ্টেরাধত্ত সুচ্ছায়া পঞ্চ পুত্রানকল্মষান্ ॥৩👈
🔵সরলার্থ ➡ সুত বলিলেন ,
স্বায়ম্ভব মনুর শতরূপা নাম্নী ভাৰ্য্যাতে অতীব বীৰ্য্যবান ধৰ্ম্মনিরত প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ নামে দুইটী পুত্র জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন ॥১
উত্তানপাদের ধ্রুবনামে যে একটী পুত্র হয় , দেব নারায়ণে ভক্তিহেতু সেই ধ্রুব উত্তম স্থান প্রাপ্ত হইয়াছেন ॥২
👉ধ্রুব হইতে শিষ্টি ও ভব্য নামে দুইটী পুত্র জন্ম গ্রহণ করিয়াছিল,ভব্য হইতে শম্ভু জন্মিয়াছিলেন ।
শিষ্টির সুচ্ছায়ানামী পত্নী পাপরহিত পাঁচটি পুত্রের জন্ম দেন ॥৩👈
[রেফারেন্স : কূর্মপুরাণ/পূর্বভাগ/১৪অধ্যায়]
🔖প্রমাণিত হল যে পরমেশ্বর শম্ভু ছাড়াও অন্য কোনো ব্যক্তির নামও শম্ভু হতে পারে।
চলুন দ্বিতীয় প্রমাণ দেখা যাক।
🔷🔷দ্বিতীয় প্রমাণ বিষ্ণুপুরাণ থেকে👇
শ্রীপরাশর উবাচ
👉ধ্রুবাচ্ছিষ্টিং চ ভব্যং চ ভব্যাচ্ছম্ভুর্ব্যজায়ত ।
শিষ্টেরাধত্ত সুচ্ছায়া পঞ্চপুত্রানকল্মষান্ ॥১👈
রিপুং রিপুঞ্জয়ং বিপ্রং বৃকলং বৃকতেজসম্ । রিপােরাধত্ত বৃহতী চাক্ষুষং সর্বতেজসম্ ৷৷ ২
🔵সরলার্থ➡ শ্রীপরাশর বললেন,
👉হে মৈত্রেয় ! ধ্রুবের পত্নী থেকে শিষ্টি ও ভব্য জন্মলাভ করেন এবং ভব্য থেকে শম্ভুর জন্ম ও শিষ্টির দ্বারা তার পত্নী সুচ্ছায়া পাঁচ পুত্রের জন্ম দেন ॥১👈
রিপুঞ্জয় , বিপ্র , বৃকল এবং বৃকতেজা নাম তাদের। এঁদের মধ্যে রিপুর দ্বারা বৃহতীর মহাতেজস্বী চাক্ষুষের জন্ম হয় ॥২
(রেফারেন্স : বিষ্ণুপুরাণ/১৩অধ্যায়)
🔖এখানেও প্রমাণিত হল যে পরমেশ্বর শম্ভু ছাড়াও অন্য কোনো ব্যক্তির নামও শম্ভু হতে পারে। এবং সেই শম্ভু নামক ব্যক্তি হল পরমবৈষ্ণব ধ্রুবের বংশধর পুত্র।
চলুন তৃতীয় প্রমাণ সৌরপুরাণ থেকে দেখা যাক।
🔷তৃতীয় প্রমাণ সৌরপুরাণ থেকে👇
সেখানে সেই ধ্রুবপুত্র শম্ভু “ বৈষ্ণাবানাং যথা শম্ভু ” শ্লোকের কথিত পরম বৈষ্ণব কি না।
👉ধ্রুবস্য পুত্রাশ্চত্বারঃ সৃষ্টির্ধন্যস্তথা পরঃ ।
হর্য্যঃ শম্ভুর্মহাত্মানো বৈষ্ণবাঃ প্রথিতৌজসঃ ॥৩👈
👉ধ্রুবের বংশজ পুত্র – সৃষ্টি , ধন্য , হৰ্য্য এবং শম্ভু ;
ইহারা সকলেই প্ৰথিততেজা পরম বৈষ্ণব ।👈
[রেফারেন্স : সৌরপুরাণ/২৭অধ্যায়]
🔖এখানেও স্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত হল যে পরমেশ্বর শম্ভু ছাড়াও অন্য কোনো ব্যক্তির নামও শম্ভু হতে পারে। সেই শম্ভু নামক ব্যক্তি হল পরমবৈষ্ণব ধ্রুবের বংশধর পুত্র এবং সেই পরমবৈষ্ণব ধ্রুবের বংশোদ্ভূত বৈষ্ণব শ্রেষ্ঠ মনুষ্য শম্ভুই হলেন “বৈষ্ণাবানাং যথা শম্ভু” – এর প্রকৃত শম্ভু। এই ধ্রুবের বংশধর শম্ভু আর পরমেশ্বর শিব এক নয়, ভিন্ন তারা ।
তাছাড়া সমস্ত শাস্ত্রে পরমেশ্বর শিব কে অজন্মা বলা হয়েছে। কারণ তিনি অদ্বিতীয় ব্রহ্ম।
অতএব, কেউ যদি এই সত্য জানার পরেও ধ্রুবের বংশজ পুত্র শম্ভুকে সেই পরমেশ্বর শিব বলে প্রচার করে তবে তার এটাও জেনে রাখা উচিত যে, শাস্ত্রে কোথাও ধ্রুব হল পরমেশ্বর শিবের পিতা এমনটা উল্লেখিত নেই।
অতএব পরমেশ্বর শিবকে বৈষ্ণব বলা একটি কুরুচিকর ষড়যন্ত্র মাত্র। যার দ্বারা পরমেশ্বর শিবকে দাসত্বের অধীনস্থ করে ফেলার চক্রান্ত চালানো হয় মাত্র। যে সমস্ত বৈষ্ণবগণ প্রভু পরমেশ্বর শিবকে বৈষ্ণব শ্রেষ্ঠ বলে চিহ্নিত করতে থাকে তারা ওটা লোক দেখানো শ্রদ্ধা করে মাত্র, আসলেই তারা নিজ ইষ্ট শ্রীবিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণ কে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য কলে কৌশলে পরমেশ্বর শিবকে বৈষ্ণব বলে ছোট করে বেড়ায়। আর শাস্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞ সাধারণ মানুষ সেই ষড়যন্ত্র বুঝতে না পেরে এই অশাস্ত্রিয় গুজব গুলিকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে ফেলেন। তারা শুধুমাত্র বৈষ্ণববেশধারী পাখণ্ডীদের কে সাধুব্যক্তি মনে করে তাদের কথা শুনে বিশ্বাস করে নেন ফলে আজকে বহু মানুষ এই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পরমেশ্বর শিবকে বৈষ্ণব বলেন। অথচ তাদের কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা উত্তর দিতে পারেন না। কেউ কেউ ওই ভাগবতের “বৈষ্ণাবানাং যথা শম্ভু” শ্লোক টি উল্লেখ করেন।
কিন্তু তারা জানেন না যে এই শম্ভু নামক ব্যক্তিটি আসলে কে? স্বাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিব নাকি অন্য কেউ।
সাধারণ মানুষ শাস্ত্রের এত গভীরতা বোঝেন না ফলে বর্তমানের তথাকথিত বৈষ্ণবগণের মুখস্থ করা ওই শম্ভু শব্দটির অর্থ - শিব বলেই ভাবেন সাধারণ মানুষ। আর এটি বেশি বেশি করে বৈষ্ণবগণেরা বোঝান। ফলে মানুষ শিবকে বৈষ্ণব ভাবেন। কিন্তু এখন প্রমাণিত হল যে ভাগবত পুরাণের উক্ত শম্ভু কখনোই পরমেশ্বর শিব নন। ফলে পরমেশ্বর শিব বৈষ্ণব নন।
🔲 বৈষ্ণবদের আক্ষেপ নিবারণ ২ —
এছাড়াও
শিবকে বৈষ্ণব প্রমাণ করার জন্য বৈষ্ণবদের পঞ্চরাত্র ব্যবহার করতে দেখা যায়।
কিছু অতিপাকা বৈষ্ণবরা তাদের বৈষ্ণবআগম-পঞ্চরাত্রশাস্ত্রের অন্তর্গত নারদপঞ্চরাত্রের কিছু শ্লোক তুলে এনে বলেন যে, শিবকে নাকি দেবর্ষি নারদজী কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন। তাই শিব সারাদিন কৃষ্ণ নাম করেন। তাই শিব নাকি বৈষ্ণব।
এবার চলুন আমরা বৈষ্ণবদেরই আরাধ্য বিষ্ণুর মুখনিঃসৃত কূর্মপুরাণের কিছু শ্লোক তুলে দেখাই।
কাপিলং পাঞ্চরাত্রঞ্চ ডামরং মোহনাত্মকম্
এবংবিধানি চান্যানি মোহনার্থানি তানি তু ॥২৫৮
যে কুশাস্ত্রাভিযোগেন মোহন্ত হ মানবানু।
ময়া সৃষ্টানি শাস্ত্রাণি মোহায়ৈয়াং ভবান্তরে ॥২৫৯
(রেফারেন্সঃ কূর্মমহাপুরাণ/পূর্বভাগ/অধ্যায় ১২)
সরলার্থ : কাপিল, পঞ্চরাত্র, ডামর শাস্ত্র মোহাত্মক, এই সমস্ত শাস্ত্র এবং এধরনের অনান্য শাস্ত্র (অসুরদের) মোহনের জন্য ॥২৫৮
এই জগতে যে সকল ব্যক্তি কুশাস্ত্রযোগে মানুষকে মোহিত করে থাকে, আমার সৃষ্ট সেই সমস্ত শাস্ত্র সৎসারের মধ্যে তাদেরকেই মোহন করার জন্য ॥২৫৯
উপরোক্ত শ্লোকে দেবি বলছেন যে, এই জগতে যে সমস্ত ব্যক্তি শাস্ত্র দ্বারা মানুষকে বিভ্রান্ত করে থাকে, সেই সমস্ত কু শাস্ত্র সেই ব্যক্তিদের ওই মোহন করার জন্য যারা অন্য মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।
অর্থাৎ এখানে আমরা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছি যে, মোহনাত্মক শাস্ত্র হলো পঞ্চরাত্র, এতে কোন সন্দেহ নেই। আর সেই পঞ্চরাত্রকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে বৈষ্ণবরা বিভ্রান্ত করছে। যারা শাস্ত্রবিরোধী কথা সেগুলিকে পঞ্চরাত্র -এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে। দেবী নিজেই এই সমস্ত অসুরদের জন্যই বলেছেন যে তার তৈরি পঞ্চরাত্র আসলেই মোহনাত্মক এবং এই পঞ্চরাত্র সম্পর্কিত শাস্ত্র গুলি যারা ব্যবহার করে তারাও এতে মোহাচ্ছন্ন হয়।
সুতরাং , পঞ্চরাত্র যদি পরমেশ্বর শিবকে বৈষ্ণব বলে উল্লেখ করেও থাকে তবে তা মায়া মাত্র অর্থাৎ সর্বথা মিথ্যা । এটি যদি বিশ্বাস করা হয় তবে তা মায়ার বশবর্তী হয়েই বিশ্বাস করা হচ্ছে বলে জানতে হবে। যারা বিশ্বাস করছে তারা মায়াচ্ছন্ন বলেই জ্ঞাত হন। তাই বৈষ্ণবদের পঞ্চরাত্র যে মোহনাত্মক ও কুশাস্ত্র যা অধর্মের পথে চালিত করে অসত্যের দিকে ঠেলে দেয় তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।
🔲 বৈষ্ণবদের আক্ষেপ নিবারণ ৩ —
শাস্ত্র প্রমাণ দেখুন 👇
পরমেশ্বর সদাশিব ব্রহ্মাকে বলছেন -
মদ্রুপং পরমং ব্রহ্মন্নীদৃশং ভবদঙ্গতঃ।
প্রকটীভবিতা লোকে নাম্না রুদ্রঃ প্রকীর্তিতঃ ॥
[তথ্যসূত্র : শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/সৃষ্টিখণ্ড/৯.৩০]
সরলার্থ : পরমেশ্বর সদাশিব বললেন, হে ব্ৰহ্মা! আমার এমন পরম অংশস্বরূপ তোমার শরীর থেকে ইহলোকে প্রদর্শিত হবে, যাকে 'রুদ্র' বলা হবে।
সুতরাং এখানে প্রমাণিত হচ্ছে যে পরমেশ্বর শিব ব্রহ্মাজী কে বলছেন তাঁর একটি অংশস্বরূপ পিতামহ ব্রহ্মার শরীর থেকে সম্ভূত হবে, যার নাম 'রুদ্র' হবে ।
এই একই কথা বৈষ্ণবদের মান্য ভাগবতপুরাণও স্বীকার করেছে -
ধিয়া নিগৃহ্যমাণোহপি ভ্ৰুবোৰ্মধ্যাৎ প্রজাপতেঃ।
সদ্যোহজায়ত তন্মন্যুঃ কুমারো নীললোহিতঃ ॥৭
স বৈ রুরোদ দেবানাং পূর্বজো ভগবানভবঃ।
নামানি কুরু মে ধাতঃ স্থানানি চ জগদগুরো ॥৮
[তথ্যসূত্র : ভাগবতপুরাণ/৩.১২.]
সরলার্থ : নিজের বিচারবুদ্ধিদ্বারা সেই ক্রোধ দমন করার সত্ত্বেও ব্রহ্মার ভ্রূযুগলের মধ্যস্থান থেকে সেই ক্রোধ এক নীললোহিত বর্ণ বালকরূপে তৎক্ষণাৎ উৎপন্ন হল ॥৭
দেবগণের অগ্রজ ষড়ৈশ্বর্যশালী ভগবান রুদ্র রোদন করে করে বলতে লাগলেন 'হে জগৎ গুরু ব্রহ্মা! আমার নাম এবং থাকবার স্থান নির্দেশ করুন' ॥ ৮
সুতরাং, দেখুন... উভয় শৈব ও বৈষ্ণব পুরাণ একই কথা বলছে যে পরমেশ্বর শিব হল পরমেশ্বর, কিন্তু কৈলাসপতি ভগবান রুদ্র বা হর হল সেই পূর্ণব্রহ্ম শিবের একটি অংশস্বরূপ গুণাত্মক সত্ত্বা। তাই পরমেশ্বর শিব ও ভগবান রুদ্র গুণভেদের কারণে এক নয়।
🟥 মায়াযুক্ত গুণসত্ত্বা 'হর/রুদ্র' স্বরূপে শিব বিভিন্ন লীলা করেন যা তার গুণসত্ত্বা কে ধারণ করার কারণেই সম্ভব। এই হর বা রুদ্রদেব অনেক সময় এমন কিছু লীলা করেন যা দেখে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় যে, যিনি পরমেশ্বর পরমব্রহ্ম তার পক্ষে এমন কার্য করা কখনোই শোভনীয় নয়।
কিন্তু মজার বিষয় এই, পরমেশ্বর শিবের গুণাতীত সদাশিব সত্ত্বাকে সাকার ব্রহ্ম বলা হয় । শৈবরা শিবের এই গুণাতীত সদাশিব সত্ত্বাকেই আরাধ্য বলে মানেন। তারা রুদ্রদেবের গুণাত্মক সত্ত্বাকে নয় বরং তার অন্তরের সদাশিব সত্ত্বাকেই আরাধ্য মানেন।
অতএব, আপনারা পরমেশ্বর শিবের গুণাত্মক সত্ত্বা তমঃগুণ ধারণ করা হর স্বরূপকেই সম্পূর্ণ শিব বলে ধারণা করেন, অথচ শাস্ত্র বলছে অন্য কথা।
শিবমহাপুরাণে বলা হয়েছে সাক্ষাৎ সদাশিব হল গুণাতীত, তিনি মায়াগুণ যুক্ত হয়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও হর এই ত্রিদেবরূপে প্রকটিত হন।
গীতাপ্রেসের সংক্ষিপ্ত শিবপুরাণের রুদ্রসংহিতার দ্বিতীয় খণ্ডের ১৬নং অধ্যায় থেকে একটি ছবি তুলে ধরা হল, পৃষ্ঠা নং সহ👇
এবার প্রমাণ দেখুন বৈষ্ণবদের পদ্মপুরাণ থেকে 👇
'যএকঃ শাশ্বতোদেবোব্রহ্মবন্দ্যঃ সদাশিবঃ ।
ত্রিলোচনোগুণাধারো গুণাতীতোহক্ষরোব্যয়ঃ ॥৩
পৃথকৃত্বাত্মনস্তাততত্র স্থানং বিভজ্য চ ।
দক্ষিণাঙ্গে সৃজাৎপুত্রং ব্রহ্মাণাং বামতো হরিম্ ॥৫
পৃষ্ঠদেশে মহেশানংত্রীপুত্রান্ সৃজিদ্বিভুঃ ।
জাতমাত্রাস্ত্রয়োদেবা ব্রহ্মাবিষ্ণুমহেশ্বরাঃ ॥৬”
(তথ্যসূত্র - পদ্মপুরাণ/ পাতালখণ্ড/১০৮ নং অধ্যায়)
সরলার্থ - সেই এক সদাশিবই শাশ্বত, ব্রহ্মা দ্বারা অৰ্চিত, ত্রিলোচন, ত্রিগুণধারী, ত্রিগুণাতীত, অক্ষর (অক্ষর ব্রহ্মস্বরূপ) এবং অব্যয়। তিনি নিজ ইচ্ছায় নিজেকে তিনভাগে বিভক্ত করেন। তিনি তাঁর দক্ষিণ(ডান)ভাগ থেকে পুত্রস্বরূপ ব্রহ্মাকে, বামভাগ থেকে শ্রীহরিকে এবং পৃষ্ঠদেশ থেকে মহেশ্বরকে (অর্থাৎ রুদ্র) সৃষ্টি করেন। এই ভাবে সদাশিবের তিনপুত্র ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বর ত্রিদেব হিসেবে পরিচিতি পায়। [ তাই সদাশিবকে ত্রিদেবজনক বলা হয়]
পদ্মপুরাণও বলছে যে সদাশিব তিনগুণের অতীত। কিন্তু তার থেকে উৎপন্ন হওয়া ত্রিদেব, অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ও মহেশ/রুদ্র হলে গুণযুক্ত(মায়ায় প্রভাবিত হওয়া) সত্ত্বা । ত্রিদেবের মধ্যে থাকা কৈলাসপতি “হর বা রুদ্র/মহেশ” গুণযুক্ত সত্ত্বা আর তিনগুণের ঊর্ধ্বে যিনি আছেন তিনি হলেন পরমেশ্বর সদাশিব।
🟪 এই শিবের অংশস্বরূপ অবতার সংহারকর্তা রুদ্রই কৈলাসপর্বতে থাকেন — একথা শিবমহাপুরাণেই পরমেশ্বর সদাশিব বলেছেন। প্রসঙ্গ টি হল, কুবেরকে সখা হিসেবে তার বাসস্থানের পাশেই তিনি বাস করে থাকার জন্য বরদান দিয়েছিলেন সদাশিব, এই বরদান দেবার পর তিনি ভাবলেন যে, তিনি তো মায়ার জগতের সমস্ত মায়ার প্রভাবের অতীত অর্থাৎ গুণাতীত সদাশিব। তাহলে মায়ার জগতে থাকা কুবেরের বাসস্থানের পাশে সদাশিব কিভাবে বসবাস করবেন ? তখন পরমেশ্বর সদাশিব একটি উপায় বের করে ভাবলেন যে, যেহেতু আমার হৃদয় থেকে প্রকটিত হওয়া রুদ্রদেবই আমার পূর্ণাবতার, সেহেতু সেই রূপেই আমি রুদ্রকে ওখানে থাকার ব্যবস্থা করবো, এতে রুদ্রের দ্বারাই আমার বরদান অনুযায়ী কুবেরের পাশে থাকাও হয়ে যাবে আবার গুণাতীত সদাশিব রূপেই মায়ার জগতে প্রবেশও করতে হবে না।
তাই পরমেশ্বর সদাশিব অংশস্বরপে গুণযুক্ত রুদ্রদেবরূপে কৈলাসে বসবাস করে কৈলাসপতিরূপে থাকেন সর্বদা।
প্রমাণ — পরমেশ্বর সদাশিব ভাবলেন,
বিধ্যঙ্গজস্স্বরূপো মে পূর্ণঃ প্রলয়কার্যকৃৎ।
তদ্রুপেণ গমিষ্যামি কৈলাসং গুহ্যকালয়ম্ ॥ ৩
রুদ্রো হৃদয়জো মে হি পূর্ণাংশো ব্রহ্ম নিষ্কলঃ ।
হরিব্রহ্মাদিভি সেব্য মদভিন্নো নিরঞ্জনঃ ॥ ৪
তৎস্বরূপেণ তত্রৈব সুহৃদ্ভূত্বা বিলাস্যহম্ ।
কুবেরস্য চ বৎস্যামি করিষ্যামি তপো মহৎ ॥ ৫
সঞ্চিন্ত্য রুদ্রোঽসৌ শিবেচ্ছাং গন্তুমুৎসুকঃ ।
ননাদ তত্র ঢক্কাং স্বাং সুগতিং নাদরূপিণীম্ ॥ ৬
[তথ্যসূত্র - শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/সৃষ্টিখণ্ড/অধ্যায় ২০]
অর্থ — ব্রহ্মার ললাট থেকে যিনি প্রাদুর্ভূত হয়েছেন তথা প্রলয় কার্যের দায়িত্ব পালন করছেন, সেই রুদ্রদেব আমার পূর্ণ স্বরূপ । অতঃ সেই রুদ্রদেবের রূপেই আমি সদাশিব গুহ্যগণের অন্তিমকালের আশ্রয়রূপী নিবাসস্থান কৈলাস পর্বতে যাবো । রুদ্র আমার(সদাশিবের) হৃদয় থেকেই প্রকট হয়ে প্রলয় কার্য সামলান, সেই রুদ্রই প্রকৃত পক্ষে আমার পূর্ণ অবতার, নিষ্কল, নিরঞ্জন ব্রহ্ম আর অন্তর থেকে সে আমার(সদাশিবের) থেকে অভিন্ন। হরি, ব্রহ্মা আদি দেবতারা সেই রুদ্রের সেবা করে থাকে নিরন্তর। সেই রুদ্রদেবের রূপেই কুবেরের মিত্র হয়ে সেই কৈলাস পর্বতেই বিলাসপূর্বক থাকবো আর মহান তপস্যা করবো। শিবের অন্তরের এই ইচ্ছা কে চিন্তন করেই সেই রুদ্রদেব কৈলাস যাবার জন্য উৎসুক হয়ে উত্তম গতি প্রদানকারী নাদস্বরূপ নিজের ডমরু বাজালেন।
সুতরাং রুদ্রদেবই কৈলাসপর্বতে কৈলাসপতি হিসেবে ঐ পর্বতে থেকে লীলা করছেন মাত্র ।
🟪 এই অংশস্বরূপ কৈলাসবাসী রুদ্রদেবই পরমেশ্বর সদাশিবের আজ্ঞা অনুসারে বিষ্ণুকে আরাধ্য হিসেবে প্রশংসা করে থাকেন জগৎবাসীর সামনে।
প্রমাণ — শিবলোকবাসী পরমেশ্বর সদাশিব শ্রীবিষ্ণু ও কৈলাসপতি রুদ্রদেবকে আদেশ দিয়ে বলেছেন,
যে —
গুণরূপো হ্যহং রুদ্রো হ্যনেন বপুষা সদা ।
কার্যং করিষ্যে লোকানাং তবাশক্যং ন সংশয় ॥ ৫
রুদ্রধ্যেয়ো ভবাংশ্চৈব ভবদ্ধ্যেয়ো হরস্তথা ।
যুবয়োরন্তরং নৈব তব রুদ্রস্য কিঞ্চন ॥ ৬
[তথ্যসূত্র — শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/সৃষ্টিখণ্ড/১০ অধ্যায়]
অর্থ — হে হরি ! যে কার্যগুলি করতে তুমি সমর্থ হবে না, গুণযুক্ত রুদ্ররূপ ধারণ করে আমি নিশ্চিতভাবে আমার এই গুণযুক্ত রুদ্রদেবরূপী শরীর দ্বারা সমস্ত সংসারের প্রাণীদের উদ্ধার করবার জন্য তোমার সেই কার্য করবো। হে হরি ! তুমি রুদ্রের ধ্যেয় হবে এবং রুদ্র তোমার ধ্যেয় হবে । তোমারা দুজনেই গুণযুক্ত হবার কারণে গুণাত্মক রুদ্রের সাথে তোমার কোনো ভেদ নেই ।
বৈষ্ণবরা বলেন শিব সারাদিন রামনাম/হরিনাম করেন, চলুন এর সত্যতা আমরা বৈষ্ণবদের প্রাণপ্রিয় সাত্ত্বিকপুরাণ পদ্মপুরাণ থেকেই উন্মোচন করে দেখিয়ে দিচ্ছি —
শঙ্করউবাচ্-
" ধ্যায়েনকিঞ্চিৎ গোবিন্দননমস্যেহকিঞ্চন ॥২৪৮
নোপাস্যেকিঞ্চনহরেনজপিষ্যেহকিঞ্চন
কিন্তু নাস্তিকজন্তুনাং প্ৰবৃত্ত্যৰ্থমিদংময়া ॥২৪৯"
(রেফারেন্স - পদ্মপুরাণ/পাতাল খন্ড/ ১১৪ নং অধ্যায়)
সরলার্থ : হে গোবিন্দ! বস্তুত আমি কারোরই ধ্যান করিনা, কাউকে প্রণাম করিনা, কাউকে উপাসনা করিনা এবং কারও জপ করিনা। নাস্তিকদেরকে এবং জগৎবাসিকে শিক্ষা প্রদানের নিমিত্তে আমি নিজ ইচ্ছায় নিজ বিধি নিয়মে আবদ্ধ হই মাত্র। কেননা আমিই পরমেশ্বর।
পরমেশ্বর শিব শ্রীহরির প্রশ্নের উত্তরে বললেন যে, শিব কাউকে ধ্যান করে না বা প্রণাম করে না কারো উপাসনা করে না তিনি কারণ নাম জপও করে না শুধুমাত্র তিনি নাস্তিক ও অন্যান্য সমগ্র জগত বাসি কে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি নিজের ইচ্ছেমতো নিজের বিধিতে তিনি আবদ্ধ হন অর্থাৎ সকলকে তিনি শুধুমাত্র শিক্ষা দেবার কার্যটুকু করেন,যা শিবেরই লীলামাত্র। তাই পরমেশ্বর শিব কখনোই রাম নাম জপ ও করেন না তিনি রাম কে প্রণাম ও করেন না তিনি রামের ধ্যান করেন না তিনি রামকে পুজো করেন না, তিনি শুধুমাত্র লীলাবশত নিজের ভক্তের উচ্চ প্রশংসা করেন মাত্র। কারণ তিনি তাঁর ভক্তদের প্রতি স্নেহ করেন এবং ভালবাসেন তাই তিনি স্নেহবশত তো তার ভক্তদের স্মরণ করে থাকেন বা তাদের গুণগান গেয়ে থাকেন।
এই একই কথা শিবমহাপুরাণে পরমেশ্বর শিব বলেছেন।
চলুন দেখে নেওয়া যাক -
সর্বে রুদ্রং ভজন্ত্যেব রুদ্রঃ কঞ্চিদ্ভজেন্ন হি ।
স্বাত্মনা ভক্তবাৎসল্যাদ্ভজত্যেব কদাচন ॥ ১৫
[রেফারেন্স – শিবমহাপুরাণ/কোটিরুদ্রসংহিতা/অধ্যায় ৪২]
☘️সরলার্থ – সবাই ভগবান রুদ্র তথা পরমেশ্বর শিবের ভজনা করেন, কিন্তু পরমেশ্বর শিব কারোর ভজন করেন না, কখনো কখনো ভক্তবৎসলবশত তিনি নিজেই নিজের ভক্তের প্রশংসা রূপে ভজনা করে থাকেন ॥ ১৫
অতএব, পরমেশ্বর শিব বা কৈলাসপতি রুদ্রদেবও কখনোই বৈষ্ণব নন, শিব কখনোই পঞ্চমুখে রামনামও করেন না। তিনি রামের গুণগান করেন শুধুমাত্র রামের শিবভক্তির মহানতার কারণে। কিন্তু কলিরচর বৈষ্ণবেরা সেই পরমসত্যকে ধামাচাপা দিয়ে অসত্য কাল্পনিক গল্পের ভাণ্ডার খুলে পরমেশ্বর শিবকে বিষ্ণুদাস/কৃষ্ণদাস/রামদাস বানানোর অপপ্রচেষ্টা করে চলেছে।
অথচ শাস্ত্র কি বলছে দেখা যাক -
নাস্তিশৈবাগ্রণীর্বিষ্ণো ॥৫৬
(রেফারেন্স - স্কন্দমহাপুরাণ/মাহেশ্বরখণ্ড/অরুণাচমাহাত্ম্যম/উত্তরার্ধ্ব/অধ্যায় নং ৪)
☘️সরলার্থ : শ্রীবিষ্ণুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ শৈব আর কেউ নেই।
অর্থাৎ প্রমানিত হল যে শ্রীবিষ্ণুই পরমশৈব। তার চেয়ে বড় শৈব আর কেউ নেই। আশা করি কলির চর বৈষ্ণবদের চোখ খুলে গেছে এবার। যদি চোখ না খোলে তবে তাদের জন্য বেদ থেকে হরির চেয়েও পরম হল পরমেশ্বর শিব, এটিই প্রমাণ করে দেয়া হল। চলুন দেখে নিই বেদশাস্ত্র কি বলছে -
পরাৎপরতরো ব্রহ্মা তৎপরাৎপরতো হরিঃ ।
তৎপরাৎ হ্যেষ তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্ত ॥১৮
[রেফারেন্স - ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/১৮ এবং ঋগ্বেদোক্ত শিবসংল্পসূক্ত - ঋগ্বেদ সংহিতা/খিলানি/চতুর্থ অধ্যায়/১১ নং খিলা]
☘️সরলার্থ : সর্বোপরি হলেন ব্রহ্মা, তাঁরও উপরে হরি এবং এদের চেয়েও যিনি পরমতম ঈশ (ঈশান/মহাদেব) সেই শিবের প্রতি মন সংকল্পবদ্ধ হোক ॥১৮
বেদের উপরোক্ত এই মন্ত্রই আরো কট্টরভাবে বেদের শরভ উপনিষদে উল্লেখ হয়েছে। সেখানে সরাসরি হরিকে শ্রেষ্ঠ বলার নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রভু শিব ছাড়া আর কেউ শ্রেষ্ঠ নয় তাও বলে দেওয়া হয়েছে।
দেখুন 👇
পরাৎপরতরং ব্রহ্মা যৎপরাৎপরতো হরিঃ ।
পরাৎপরতরো হীশস্তস্মাত্তুল্যোঽধিকো ন হি ॥ ২৯
এক এব শিবো নিত্যস্ততোহন্যৎসকলং মৃষা ।
তস্মাৎসর্বাপরিত্যজ্য ধ্যেযান্বিষ্ণবাদিকারান্ ॥ ৩০
(শরভ উপনিষদ/২৯ নং মন্ত্র)
সরলার্থ – যিনি পরাৎপর ব্রহ্মা, তাঁর থেকেও অধিক পরাৎপর হলেন হরি। কিন্তু হরির থেকেও অধিক যিনি পরাৎপর তিনিই হলেন ঈশ(সদাশিব), সেই প্রভু শিবের সমান তথা তাঁর চেয়ে অধিক কেউ নেই (কারণ শিবই সর্বোচ্চ সত্ত্বা পরমব্রহ্ম) ॥২৯
শিবই একমাত্র নিত্য, অন্য সকল কিছুই মিথ্যা। এই কারণে বিষ্ণু আদি সকল দেবতাকে পরিত্যাগ করে শিবকেই ধ্যেয় বলে জানা উচিত ॥৩০
আশা করি কলিরচর বৈষ্ণবদের চোখ এবার নিশ্চয়ই খুলে গিয়েছে।
আর যারা এখানে একতার জ্ঞান দিতে আসবে, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, আমরা শৈবরা সকল দেবতাকেই এক শিবের রূপ মানি, কোনো দেবতাকে ছোট করা হয় না , কিন্তু শিব রূপই মূল তাই বেদে শিবকেই পরমেশ্বর ঘোষনা করা হয়েছে। হরি হল পরমেশ্বর শিবের একটি গুণপ্রকাশ , হরি সত্ত্বগুণসম্পন্ন। ব্যবহারিক পর্যায়ের বিচারে শিবের আশ্রয়ে সমস্ত দেবতারা থাকেন, যা শাস্ত্রেও উল্লেখ আছে। তাই এখানে কোনো ভেদাভেদ করা হয়নি, পরমার্থিক পর্যায়ের বিচারে সব দেবতাই পরমেশ্বর শিবের বিভিন্ন স্বরূপ বলে বিবেচিত হয় তাই সব দেবতার অস্তিত্ব একমাত্র শিব জেনে শিবকেই পরম ও অদ্বিতীয় সত্ত্বা বলা হয়েছে। আশা করি একতাবাদীরা ভুল করেও আমাদের একতা শেখাতে আসবেন না আর বৈষ্ণবদের উপরোক্ত সমস্ত বিষয়ের উপর আলোচনা সমাপ্ত হল। এবার সিদ্ধান্তের পালা।
💥 সিদ্ধান্ত : যারা সম্পূর্ণ আলোচনাটি পড়লেন, তারা যখনই পরমেশ্বর শিবকে বৈষ্ণব বলে আখ্যায়িত হতে শুনবেন তখন অবশ্যই অবশ্যই তার প্রতিবাদ করবেন। পরমেশ্বর শিব হলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ সহ সমস্ত জীবজগতের পিতা। অতএব সর্বদা প্রস্তুত থাকুন প্রতিবাদ করার জন্য।
🔸মহাভারতের দ্রোনপর্বের ঊনসপ্তত্যধিকশততমোঽধ্যায়ে(১৬৯ অধ্যায়) উল্লেখিত আছে যে……..
🔴 স এস রুদ্রভক্তশ্চ কেশবো রুদ্রসম্ভবঃ।👈
সর্ব্বরূপং ভবং জ্ঞাত্বা লিঙ্গে যোঽর্চ্চয়ত প্রভুম্॥৬২
☘️সরলার্থ : যিনি জগদীশ্বর শিবকে সর্বময় জেনে, তার লিঙ্গে পূজা অর্চনা করতেন, সেই শিব অংশস্বরূপ থেকে উদ্ভব হয়েছেন যে নারায়ণ কৃষ্ণ, তিনিই পরমশিবভক্ত শৈবচূড়ামণি ॥৬২👈
অর্থাৎ স্বয়ং ব্যাসদেব বলছেন যে কৃষ্ণ স্বয়ং শিবভক্ত। সেই শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর কে সর্ব জগতময় হিসেবে দর্শন করে পূজার্চনা করতেন।
আবার শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর শিব থেকে উৎপন্ন হয়েছেন।
অতএব, যে বৈষ্ণবগণ আপনার সামনে শিবকে বৈষ্ণব বলে গুজব রটাবে তার সামনে গিয়ে তার বক্তব্য কে খণ্ডন করে শেষে মহাভারতের
“স এস রুদ্রভক্তশ্চ কেশবো রুদ্রসম্ভবঃ”
নাস্তিশৈবাগ্রণীর্বিষ্ণো ॥
এই শ্লোকদুটি উল্লেখ করে বলবেন শ্রীকৃষ্ণ নারায়ণ স্বয়ং পরমেশ্বর শিব থেকে জন্মেছেন এবং তারা পরমশৈব। বিষ্ণুর চেয়ে পরমশৈব শ্রেষ্ঠ শিরোমণি আর কেউ নেই।
শিব পরমবৈষ্ণব ❌
শিব পরমব্রহ্ম ✅🌷
শ্রীহরি পরমশৈব ✔️
এবার প্রকৃত সত্য শৈবজ্ঞান দ্বারা ধ্বংস করুন অসত্যকে।
জাগো শৈববীরেরা জাগো…✊
শিবনিন্দুকেরা যেন বুঝতে পারে,
শৈবরা ভীতু নয়,আগুন শৈবরা জলন্ত আগুন…🔥
আর যারা অপপ্রচার করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে “হরি হর এক” - বুলি আওড়াতে আওড়াতে নিজেদের দোষ ঢেকে পরোক্ষভাবে পরমেশ্বর শিবের স্বতন্ত্রতাকে খর্ব করবার অপপ্রয়াস করে তাদের জন্য এই নীচের লিঙ্কে রইল হরিহর এক বুলির বিশ্লেষন 👇
👉 হরি হর সংক্রান্ত প্রশ্ন ও তার উত্তর
(লেখাটি আপনার কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে জানাবেন, অন্যদেরকে এই সত্যের আলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য অবশ্যই পোষ্টের লিঙ্ক টি শেয়ার করুন, ফলো করুন আমাদের ব্লগ টি।লেখাটি কপি পেস্ট করতে চখিলে সমগ্র লেখাটি কপি করে পোষ্ট করবেন, অনুগ্রহ করে লেখা থেকে লেখকের নাম ও কপিরাইট কেটে বাদ দেবেন না, আপনাদের জ্ঞান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে অতি পরিশ্রম করে এই লেখা গুলি ISSGT পোষ্ট করে, তাই লেখক ও সংগঠনকে তার প্রাপ্য সম্মান দেবেন, নমঃ শিবায়)
🔥 অপপ্রচার দমনে লেখক – শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
কপিরাইট ও প্রচারে – International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
© Koushik Roy. All Rights Reserved https://issgt100.blogspot.com
দারুন লেখা , এটাই আমি চাইছিলাম, এবার দেখছি ওই ইস্কনি দের । ধন্যবাদ দাদা, হর হর মহাদেব ।
উত্তরমুছুনবাঃ, কমেন্ট বিবাদ করায় কি ভক্তদের কাজ
মুছুনধন্যবাদ শৈব জী কৌশিক রায় এবার ইসকনের ভন্ডামি সমাপ্ত
উত্তরমুছুনহবে হর হর মহাদেব শম্ভু 🙏
নমঃ শিবায়। জীবন খুজে পেলাম। কৃষ্ণের ভন্ড ভক্তদের কাছে প্রচুর লাঞ্ছিত হয়েছি আর নয় ।হরহর মহাদেব
উত্তরমুছুনহর হর মহাদেব 🙇♂️🙏🙏
মুছুনকেন কৃষ্ণ ভক্তরা আপনার কি ক্ষতি করেছে, বক্তার প্ররচনায় কেন মূর্খ পশুদের মত বক্তব্য করছেন যদি শিব পরম বৈষ্ণব না হবেন তবে, শ্রী হরি ও পরম শৈব নন, আমি শিব ভক্তদের সর্বাধিক সম্মান করি কিন্তু, বক্তাকে ভুল ব্যাখ্যা কারী ছাড়া আর কিছুই বলা গেল না
মুছুনহর হর মহাদেব 🙇♂️🙏🙏
উত্তরমুছুনএকটা জিনিস জানতে চাই, যে গীতায় শ্রী কৃষ্ণ যখন অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখাচ্ছেন, তখন তো তাঁর শরীরে শিব, বিষ্ণু, ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবদেবী সকলেই বিদ্যমান দেখিয়েছেন। এর কি অর্থ? আপনার পোষ্টে পড়েছি যে ব্যাস দেব শ্রী কৃষ্ণকে পরামেশ্বর শিব থেকে উৎপত্তি। তাহলে দুটো কথা একে অপরের বিপরীত হয়ে গেলো না? আবারও বলছি যে আমি শিব ঠাকুরকে খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করি। মনে প্রাণে পূজা করি। আবার শ্রী কৃষ্ণের ও একই ভাবে পূজা করি। তাই প্রশ্নটা করলাম।
উত্তরমুছুনশৈব ও বৈষ্ণব আমাদের ব্রেন খালি ওয়াশ করতেছে।
মুছুনকেউ বলে পরমেশ্বর শিব আবার কেউ বলে পরম ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণ। কেউ বলে শিব থেকে কৃষ্ণ উৎপন্ন হয়েছেন আবার কেউ বলে কৃষ্ণ থেকে শিব উৎপন্ন হয়েছে । সঠিকটা কোনটা ?
ধন্যবাদ সুন্দর দেখনি 🙏🙏
উত্তরমুছুনসঠিক দাদা
উত্তরমুছুন