হরি হর সংক্রান্ত প্রশ্ন ও তার উত্তর
বর্তমানে আমাদের সনাতন ধর্ম সমাজে কিছু ব্যক্তি সর্বদাই "হরি হর" এই শব্দটা ব্যবহার করে এমনভাবে একত্ব সিদ্ধ করে যেন একজন পুত্রের জন্মদাতা পিতা ও জন্মদাতা পিতার ভ্রাতা উভয়েই এক, কোনো ভেদ নেই।
আমাদের উদ্দেশ্য কোনো কটুক্তি করা নয়, শৈব সনাতন ধর্মের শাস্ত্রনির্দেশকে তুলে ধরার মহান যজ্ঞে আমরা সর্বদা বদ্ধপরিকর ।
সুতরাং, ISSGT -এর পক্ষ থেকে হরি হর সম্পর্কিত ভ্রান্তির নিরসন করা হচ্ছে নিম্নোক্ত প্রশ্ন-উত্তর -এর মাধ্যমে । লিখেছেন - শ্রীকৌশিক রায় শৈবজী
প্রশ্ন নং ১) হরি আর হর কি এক ?
উত্তর : অবশ্যই এক । কিন্তু আমাদের প্রথমে মনে রাখতে হবে হরি অর্থাৎ বিষ্ণু হল সত্ত্বগুণধারী, আর হর হল তমগুণধারী। যদিও শিবমহাপুরাণ রুদ্রসংহিতার নবম অধ্যায়ে উল্লেখিত হয়েছে, ত্রিপালক শ্রীহরি বিষ্ণু সর্বদা অন্তরে তমোগুণ ও বাইরে সত্ত্বগুণ প্রকাশ করেন। ত্রিলোকের সংহারক রুদ্রদেব অন্তরে সত্ত্বগুণ ও বাইরে তমোগুণ ধারন করেন । তাই হরি এবং হর হলেন গুণযুক্ত সত্ত্বা । সুতরাং, হরির কার্য আর হরের কার্য আলাদা আলাদা।
প্রশ্ন নং ২) হরি অর্থাৎ বিষ্ণু আর হর অর্থাৎ শিব যদি এক হয় তাহলে আপনরা এটা মানেন না কেন ?
উত্তর : হরি আর হর এক এটা মান্য তবে তাদের গুণসত্ত্বার ভিত্তিতে তারা ভিন্ন ভাবে দিব্য দেহধারণ করেছেন, তা নাহলে হরি আর হর এই আলাদা আলাদা দুটি শব্দের উৎপত্তিই হতো না, জগতের কার্য সম্পাদনের জন্য পরমেশ্বর শিব নিজেই এই দুটি গুণযুক্ত সত্ত্বার রূপ ধারণ করেন।
এখন আপনাদের একটা ছোট্ট বিষয়ে জানিয়ে রাখি, আমাদের শৈবশাস্ত্র তথা সনাতন ধর্মের শাস্ত্র অনুসারে পরমেশ্বর শিব তিনটি স্বরূপে প্রকটিত হয়ে লীলা করেন।
শিবের নিরাকার নির্গুণ সত্ত্বার নাম হল - পরমশিব,
শিবের সাকার সকল সত্ত্বার নাম হল - সদাশিব,
শিবের মায়াযুক্ত গুণসত্ত্বার নাম হল - হর/রুদ্র/মহেশ ।
পরমেশ্বর শিব নিরাকার পরমশিব থেকে সাকার হয়ে সদাশিবরূপে প্রকটিত হন, এরপর তিনি শক্তিকে প্রকট করেন, সেই শক্তির প্রকৃতিভাগ থেকে উদ্ভূত মায়ারূপী রজঃগুণ দ্বারা ব্রহ্মা ও সত্ত্বঃ গুণ দ্বারা বিষ্ণুকে প্রকট করেন। পরবর্তীতে ব্রহ্মার সৃষ্টি কার্যে সহায়তা করার জন্য ব্রহ্মার প্রার্থনায় পরমেশ্বর সদাশিব সরাসরি নিজ হৃদয় থেকে রুদ্রদেবকে প্রকটিত করে, তিনি ব্রহ্মাকে বলেন, হে ব্রহ্মা তুমি পুনরায় সন্তান উৎপাদন করার চেষ্টা করো, যখন তুমি অসমর্থ হবে তখনই আমি এই রুদ্রদেব স্বরূপে গুণকে ধারণ করে তোমার পুত্ররূপে প্রকটিত হবো।
পরবর্তীতে যখন ব্রহ্মা মরণশীল জীব উৎপন্ন করতে অসমর্থ হন, তখন তার দুই ভ্রুর মাঝে তমঃগুণ প্রকাশ পায়, ঠিক তখনই ব্রহ্মার ইচ্ছে অনুসারে রুদ্রদেব ব্রহ্মার কপাল থেকে প্রকটিত হন তমঃগুণ কে আশ্রয় করে। তিনি ব্রহ্মার পুত্র রূপে প্রকটিত হয়ে কৈলাস পর্বতে অবস্থান করেন।
শাস্ত্র প্রমাণ দেখুন 👇
পরমেশ্বর সদাশিব ব্রহ্মাকে বলছেন -
মদ্রুপং পরমং ব্রহ্মন্নীদৃশং ভবদঙ্গতঃ।
প্রকটীভবিতা লোকে নাম্না রুদ্রঃ প্রকীর্তিতঃ ॥
[তথ্যসূত্র : শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/সৃষ্টিখণ্ড/৯.৩০]
সরলার্থ : হে ব্ৰহ্মা! আমার এমন পরম অংশস্বরূপ তোমার শরীর থেকে ইহলোকে প্রদর্শিত হবে, যাকে 'রুদ্র' বলা হবে।
সুতরাং এখানে প্রমাণিত হচ্ছে যে পরমেশ্বর শিব ব্রহ্মাজী কে বলছেন তাঁর একটি অংশস্বরূপ পিতামহ ব্রহ্মার শরীর থেকে সম্ভূত হবে, যার নাম 'রুদ্র' হবে ।
এই একই কথা ভাগবত পুরাণও স্বীকার করেছে -
ধিয়া নিগৃহ্যমাণোহপি ভ্ৰুবোৰ্মধ্যাৎ প্রজাপতেঃ।
সদ্যোহজায়ত তন্মন্যুঃ কুমারো নীললোহিতঃ ॥৭
স বৈ রুরোদ দেবানাং পূর্বজো ভগবানভবঃ।
নামানি কুরু মে ধাতঃ স্থানানি চ জগদগুরো ॥৮
[তথ্যসূত্র : ভাগবতপুরাণ/৩.১২.]
সরলার্থ : নিজের বিচারবুদ্ধিদ্বারা সেই ক্রোধ দমন করার সত্ত্বেও ব্রহ্মার ভ্রূযুগলের মধ্যস্থান থেকে সেই ক্রোধ এক নীললোহিত বর্ণ বালকরূপে তৎক্ষণাৎ উৎপন্ন হল ॥৭
দেবগণের অগ্রজ ষড়ৈশ্বর্যশালী ভগবান রুদ্র রোদন করে করে বলতে লাগলেন 'হে জগৎ গুরু ব্রহ্মা! আমার নাম এবং থাকবার স্থান নির্দেশ করুন' ॥ ৮
সুতরাং, উভয় শৈব ও বৈষ্ণব পুরাণ একই কথা বলছে যে পরমেশ্বর শিব হল পরমেশ্বর, কিন্তু ভগবান রুদ্র বা হর হল সেই পূর্ণব্রহ্ম শিবের একটি অংশস্বরূপ গুণাত্মক সত্ত্বা। তাই পরমেশ্বর শিব ও ভগবান রুদ্র এক নয়।
উপরোক্ত মায়াযুক্ত গুণসত্ত্বা 'হর/রুদ্র' স্বরূপে শিব বিভিন্ন লীলা করেন যা তার গুণসত্ত্বা কে ধারণ করার কারণেই সম্ভব। এই হর বা রুদ্রদেব অনেক সময় এমন কিছু লীলা করেন যা দেখে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় যে, যিনি পরমেশ্বর পরমব্রহ্ম তার পক্ষে এমন কার্য করা কখনোই শোভনীয় নয়।
কিন্তু মজার বিষয় এই, পরমেশ্বর শিবের গুণাতীত সদাশিব সত্ত্বাকে সাকার ব্রহ্ম বলা হয় । শৈবরা শিবের এই গুণাতীত সদাশিব সত্ত্বাকেই আরাধ্য বলে মানেন। তারা রুদ্রদেবের গুণাত্মক সত্ত্বাকে নয় বরং তার অন্তরের সদাশিব সত্ত্বাকেই আরাধ্য মানেন।
অতএব, আপনারা পরমেশ্বর শিবের গুণাত্মক সত্ত্বা তমঃগুণ ধারণ করা হর স্বরূপকেই সম্পূর্ণ শিব বলে ধারণা করেন, অথচ শাস্ত্র বলছে অন্য কথা।
শিবমহাপুরাণে বলা হয়েছে সাক্ষাৎ সদাশিব হল গুণাতীত, তিনি মায়াগুণ যুক্ত হয়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও হর এই ত্রিদেবরূপে প্রকটিত হন।
গীতাপ্রেসের সংক্ষিপ্ত শিবপুরাণের রুদ্র সংহিতার দ্বিতীয় খণ্ডের ১৬নং অধ্যায় থেকে একটি ছবি তুলে ধরা হল, পৃষ্ঠা নং সহ👇
এবার প্রমাণ দেখুন বৈষ্ণবদের পদ্মপুরাণ থেকে 👇
'যএকঃ শাশ্বতোদেবোব্রহ্মবন্দ্যঃ সদাশিবঃ । ত্রিলোচনোগুণাধারো গুণাতীতোহক্ষরোব্যয়ঃ ॥৩ পৃথকৃত্বাত্মনস্তাততত্র স্থানং বিভজ্য চ ।
দক্ষিণাঙ্গে সৃজাৎপুত্রং ব্রহ্মাণাং বামতো হরিম্ ॥৫
পৃষ্ঠদেশে মহেশানংত্রীপুত্রান্ সৃজিদ্বিভুঃ । জাতমাত্রাস্ত্রয়োদেবা ব্রহ্মাবিষ্ণুমহেশ্বরাঃ ॥৬”
(তথ্যসূত্র - পদ্মপুরাণ/ পাতালখণ্ড/১০৮ নং অধ্যায়)
সরলার্থ - সেই এক সদাশিবই শাশ্বত, ব্রহ্মা দ্বারা অৰ্চিত, ত্রিলোচন, ত্রিগুণধারী, ত্রিগুণাতীত, অক্ষর (অক্ষর ব্রহ্মস্বরূপ) এবং অব্যয়। তিনি নিজ ইচ্ছায় নিজেকে তিনভাগে বিভক্ত করেন। তিনি তাঁর দক্ষিণ(ডান)ভাগ থেকে পুত্রস্বরূপ ব্রহ্মাকে, বামভাগ থেকে শ্রীহরিকে এবং পৃষ্ঠদেশ থেকে মহেশ্বরকে (অর্থাৎ রুদ্র) সৃষ্টি করেন। এই ভাবে সদাশিবের তিনপুত্র ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বর ত্রিদেব হিসেবে পরিচিতি পায়। [ তাই সদাশিবকে ত্রিদেবজনক বলা হয়]
সেই ত্রিদেবের অন্তর্গত বিষ্ণু অর্থাৎ হরি এবং ত্রিদেবের মধ্যে থাকা হর বা রুদ্র/মহেশ এক হতে পারে, কেননা উভয়েই গুণযুক্ত সত্ত্বা।
কিন্তু পরমেশ্বর শিব এই গুণসত্ত্বার ঊর্ধ্বে। তাই শিবের লোকশিক্ষার জন্য প্রকট করা কৈলাসপতি রুদ্রদেব কে ইঙ্গিত করে তার তমঃগুণাত্মক ত্রিদেব সত্ত্বাকে শিব বলাটা যুক্তিযুক্তি নয়। কেননা, এই হররূপটি শিব লীলাবশত ধারণ করেছেন, তিনি এই হররূপে কখনো বিষ্ণুর মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন, কখনো শক্তির মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন, কখনো কার্তিকের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন আবার কখনো ব্রহ্মার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন।
এখন অনেক বৈষ্ণবেরা কৈলাসপতি ভগবান হর -এর মুখ থেকে প্রকটিত হওয়া বিষ্ণুর প্রশংসা বাক্যকে দেখিয়ে বলে যে, শিব বিষ্ণু/কৃষ্ণের অথবা রামের প্রশংসা করেছেন, তাই শিব হল বৈষ্ণব, শিব রামনাম করেন, শিব হল শ্রীকৃষ্ণের আজ্ঞাবহ দাস এসব দাবী করে বসে।
একইভাবে শাক্তরা কৈলাসপতি হর -এর মুখ থেকে প্রকটিত হওয়া আদ্যাশক্তির প্রশংসা বাক্যকে দেখিয়ে বলে যে, শিব আদ্যাশক্তির প্রশংসা করেছেন, তাই শিব হল শাক্ত, শিবের চেয়ে শক্তি শ্রেষ্ঠ ।
কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সদাশিব শিবলোকে অবস্থান করেন, এই শিবলোক জ্ঞানকৈলাস নামেও পরিচিত, সদাশিব দেবকার্য সিদ্ধ করার জন্য রুদ্র/হর রূপ ধারণ করে কৈলাসে অবস্থান করেন।
সদাশিব কখনো কোনো যুদ্ধও করেন না, কারোর প্রশংসাও করেন না, তিনি পরমব্রহ্ম তাই তিনি অবিকৃত থাকেন, তিনি তার রুদ্র বা হর নামক সত্ত্বা স্বরূপকে দিয়েই যুদ্ধ করান, প্রশংসা করান, সর্বোপরি সমস্ত লীলা করান । কিন্তু সাধারণ মানুষ গুণভেদে শিবতত্ত্বকে জ্ঞাত না হয়ে হর = শিব ইঙ্গিত করে হরি-হর এক বলে প্রচার করে ।
সর্বদা মনে রাখবেন, সদাশিব থেকে হরি-হর প্রকট হয়েছেন। সুতরাং শৈবদের আরাধ্য হল হরের মূল স্বরূপ সদাশিব ।
প্রশ্ন নং ৩) তাহলে কি আপনারা হরি হর আলাদা - এটা বলতে চাইছেন ?
উত্তর : হরি আর হর এক, সদাশিব হরির হরের ঊর্ধ্বে। শিব গুণের ঊর্ধ্বে, শিব গুণের অতীত গুণাতীত।
প্রমাণ দেখুন গীতাপ্রেসের সংক্ষিপ্ত শিবপুরাণের রুদ্র সংহিতার প্রথম খণ্ডের ৯নং অধ্যায় থেকে একটি ছবি তুলে ধরা হল, পৃষ্ঠা নং সহ👇
প্রশ্ন নং ৪) আপনি কি জানেন হরি ও হর দুজন পরস্পর পরস্পরের আরাধ্য ?
উত্তর: হ্যা ভুল কিছু নয়, কারণ পরমেশ্বর সদাশিব ভগবান বিষ্ণুকে বলছেন -
রুদ্রধ্যেয়ো ভবাংশ্চৈব ভবদ্ধ্যেয়ো হরস্তথা।
[তথ্যসূত্র : শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/সৃষ্টিখণ্ড.১০.৬]
সরলার্থ : তুমি (বিষ্ণু) রুদ্রের আরাধ্য হবে এবং রুদ্র তোমার(বিষ্ণুর) আরাধ্য হবে।
এখানে সদাশিব বলছেন বিষ্ণু(হরি) রুদ্রদেবের(হর) ভক্ত হবেন , আবার রুদ্রদেবের শ্রীহরি বিষ্ণুর ভক্ত হবেন। কিন্তু সদাশিব এর ঊর্ধ্বে। কারণ শিবের কোনো আরাধ্য নেই, তিনি কারোর ভজনাও করেননা, তিনি কারোর ধ্যানও করেন না।
আরো একটি মজার বিষয় হল - রুদ্রদেব লীলাবশত বিষ্ণুর মাহাত্ম্য বর্ণনা করেন এবং তাকে আরাধ্য বলেন, কিন্তু সেই রুদ্রদেব পারমার্থিক বিচারে মূলত গুণাতীত সদাশিব, তাই রুদ্রদেবেরও কোনো আরাধ্য নেই, তিনি লোকচার বশত নিজের বানানো নিয়মে নিজেকে আবদ্ধ করেন মাত্র।
🔥শাস্ত্র প্রমাণ দেখুন বৈষ্ণবদের পদ্মপুরাণ থেকে 👇
শঙ্করউবাচ্- " ধ্যায়েনকিঞ্চিৎ গোবিন্দননমস্যেহকিঞ্চন ॥ ২৪৭ নোপাস্যেকিঞ্চনহরেনজপিষ্যেহকিঞ্চন ।
কিন্তু নাস্তিকজন্তুনাং প্ৰবৃত্ত্যর্থমিদংময়া ॥ ২৪৮ "
(তথ্যসূত্র - পদ্মপুরাণ/ পাতাল খন্ড / ১১৪ নং অধ্যায়)
সরলার্থ: হে গোবিন্দ! বস্তুত আমি কারও ধ্যান করিনা, কাউকে প্রণাম করিনা, কাউকে উপাসনা করিনা এবং কারও জপ করিনা। নাস্তিকদেরকে এবং জগৎবাসিকে শিক্ষা প্রদানের নিমিত্তে আমি নিজ ইচ্ছায় বিধি নিয়মে আবদ্ধ হই। কেননা আমিই পরমেশ্বর।
🔥একই প্রমাণ দেখুন শিব মহাপুরাণ থেকে 👇
সর্বে রুদ্রং ভজন্ত্যেব রুদ্রঃ কঞ্চিদ্ভজেন্ন হি ।
স্বাত্মনা ভক্তবাৎসল্যাদ্ভজত্যেব কদাচন ॥ ১৫
[রেফারেন্স – শিবমহাপুরাণ/কোটিরুদ্রসংহিতা/অধ্যায় ৪২]
☘️সরলার্থ – সবাই পরমেশ্বর শিবের ভজনা করেন, কিন্তু পরমেশ্বর শিব কারোর ভজন করেন না, কখনো কখনো ভক্তবৎসলবশত তিনি নিজেই নিজের ভক্তের প্রশংসা রূপে ভজনা করে থাকেন ॥ ১৫
সুতরাং, পরমেশ্বর শিব কখনোই কারোর ভক্ত নন, তার কোনো আরাধ্যও নেই ।
প্রশ্ন নং ৫) হরি হর একে অপরের পরিপূরক। বিষ্ণু ছাড়া শিব অপূর্ণ, শিব ছাড়া বিষ্ণু অপূর্ণ , আপনি কি সেটা মানেন ?
উত্তর : সৃষ্টি করতে ব্রহ্মার প্রয়োজন বিষ্ণুকে অর্থাৎ হরিকে, কারণ হরি সেই সৃষ্টির পালন পোষন করেন, ঠিক তেমনি সেই পালন করা সৃষ্টিকে বিনাশ করে নূতন ভাবে সৃষ্টি করতে গেলে প্রয়োজন রুদ্র অর্থাৎ হর কে, একইভাবে পুনরায় সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন ব্রহ্মাকে।
এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আপনি বলতে পারেন যে, হরি হর একে অপরের পরিপূরক, তবে সে ক্ষেত্রে শুধু হরি হর নয় বরং ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্র তিনজনই তিনজনের পরিপূরক বা সহায়ক।
কিন্তু শিব হল ব্রহ্ম , ব্রহ্ম স্বয়ং সম্পূর্ণ, সমস্ত শক্তি তার অধীনে তাই তাকে সর্বশক্তিমান বলা হয়, এখন প্রশ্ন হল, যদি আপনি হর বলতে গুণাতীত শিবকে ইঙ্গিত করেন, তবে সেক্ষেত্রে হর হল পরমেশ্বর , তাহলে একটু বিচার করুন, যদি ব্রহ্ম অন্য কারোর সহায়তা ছাড়া স্বয়ং সম্পূর্ণ না হন তবে ব্রহ্ম তো সর্বশক্তিমান নন। আর এটাই যদি হয় তবে তা বেদ বিরুদ্ধ সিদ্ধান্ত, বেদ অর্থাৎ শ্রুতি বিরুদ্ধ সিদ্ধান্ত কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ, বেদ বলছে ব্রহ্ম স্বতন্ত্র সর্বশক্তিমান। তিনি কারোর সহায়তা ছাড়াই সমস্তকিছু করতে সক্ষম।
পরমেশ্বর শিব সর্বদাই স্বয়ং পরিপূর্ণ, তাকে পূর্ণ করবার জন্য আলাদ কারোর সহযোগিতার প্রয়োজন নেই, কারণ, পরমেশ্বর শিব ছাড়া দ্বিতীয় কোনো সত্ত্বাই নেই।
প্রমাণ 👇
শিবস্য পরিপূর্ণস্য স্বতন্ত্রস্য বিভোর্যতঃ ।
কঃ কর্তা ক্ষোভকঃ কো বা তস্মাদদ্বৈততা শিবে ॥৪১
[নেত্র তন্ত্র (কাশ্মীর ত্র্যম্বক শৈব পরম্পরার তন্ত্র)/ ২১ অধিকার]
অর্থ : যেহেতু শিব নিজেই পরিপূর্ণ, স্বতন্ত্র। তাই তাঁর আর কেউ কর্তা, ক্ষোভক, নিয়ন্তা থাকতে পারে না। সেই শিবই অদ্বৈত অর্থাৎ অদ্বিতীয় পরমব্রহ্ম পরমসত্ত্বা ।
পরমেশ্বর শিব স্বতন্ত্র স্বপ্রকাশ পরমেশ্বর পরমব্রহ্ম - এটা ভাগবত পুরাণও বলছে, দেখুন 👇
মুখাগ্নি পঞ্চোপনিষদস্তবেশ যৈস্ত্রিংশদষ্টোত্তরমন্ত্রবর্গঃ ।
যৎ তৎ শিবাখ্যং পরমার্থতত্ত্বং দেব স্বয়ংজ্যোতিরবস্থিতিস্তে ॥ ২৯
[তথ্যসূত্র : ভাগবত পুরাণ/৮ম স্কন্ধ/৭ম অধ্যায়]
✅বাংলা অর্থ👉হে প্রভু ! তৎপুরুষ, অঘাের, সদ্যোজাত, বামদেব এবং ঈশান — এই পঞ্চোপনিষদ্ (বৈদিক পঞ্চব্রহ্ম উপনিষদ) আপনার পাঁচটি মুখ । এইসব মন্ত্রের পদচ্ছেদ থেকে আটত্রিশ কলাত্মক মন্ত্র উৎপন্ন হয়েছে । আপনি যখন সমস্ত প্রপঞ্চ থেকে স্বতন্ত্র হয়ে স্বরূপে স্থিত হন তখন সেই স্থিতির নাম হল ‘ শিব '। বাস্তবে এটিই হল স্বপ্ৰকাশ পরমার্থতত্ত্ব ॥ ২৯ ॥
আরো একটি প্রমাণ দেখুন, শিব স্বতন্ত্র 👇
অহং কলানামৃষভো.. স্বতন্ত্রাঃ ।। ৪৩
[তথ্যসূত্র : ভাগবত পুরাণ/৮ম স্কন্ধ/১২নং অধ্যায়]
অর্থ — মহাদেব বললেন, হে দেবী! শোনো, আমি সমস্ত বিদ্যা ও কলাকৌশলের অধীশ্বর এবং স্বতন্ত্র ॥ ৪৩
দেখুন দেখুন ! ভাগবত পুরাণেও পরমেশ্বর রুদ্র নিজেকে স্বতন্ত্র বলে দাবি করেছেন। যার অর্থ হল — ভগবান রুদ্র কারোর অধীনস্থ নন, তিনি স্বাধীন ও নিজের ইচ্ছে মত লীলা করেন । তাছাড়া তাকে “ শিবাখ্যং পরমার্থতত্ত্বং দেব ” বলে রুদ্রদেবের অন্তস্থ পরশিব কে পরমতত্ত্ব বলে স্বীকার করে নিয়েছে ভাগবত পুরাণ।
সুতরাং পরমেশ্বর শিব কখনোই অপূর্ণ নন, তাই তার পরিপূরকের প্রয়োজন নেই। যিনি অপূর্ণ একমাত্র তারই পূরকের সহায়তা প্রয়োজন। যখন শিব স্বয়ং সম্পূর্ণ তবে তার পরিপূরকের কি প্রয়োজন ?
প্রশ্ন নং ৬) ‘শিবস্য হৃদয়ং বিষ্ণুর্বিষ্ণোশ্চ হৃদয়ং শিবঃ’ এটা কি আপনি সমর্থন করেন ? তাছাড়া স্কন্দ উপনিষদেও এই একই কথা বলা হয়েছে। তাহলে অস্বীকার কিভাবে করছেন ?
উত্তর : হ্যা অস্বীকার করার উপায় নেই, বরং আপনি যে দৃষ্টিকোণের থেকে এই শ্লোক গুলি বিচার করছেন তার অর্থ প্রকৃত পক্ষে অন্যরকম।
স্কন্দ উপনিষদের
'শিবায় বিষ্ণুরূপায় শিবরূপায় বিষ্ণবে।
শিবস্য হৃদয়ং বিষ্ণুঃ বিষ্ণোশ্চ হৃদয়ং শিবঃ ॥৮॥'
অর্থাৎ, পরমেশ্বর শিবই বিষ্ণুরূপী এবং বিষ্ণুই পরমেশ্বর শিবের রূপ। পরমেশ্বর শিবের হৃদয়ে বিষ্ণুদেবের নিবাস এবং বিষ্ণুদেবের হৃদয়ে পরমেশ্বর শিব বিরাজমান ॥৮॥
এই শ্লোকটির ন্যায় পরমেশ্বর শিব শিবমহাপুরাণে বলেছেন,
মমৈব হৃদয়ে বিষ্ণুবিষ্ণোশ্চ হৃদয়ে হৃহম্।
উভয়োরন্তরং যো বৈ ন জানাতি মতো মম।
(তথ্যসূত্র : শিবপুরাণ/রুদ্র স্.৯।৫৫-৫৬]
অর্থাৎ আমার হৃদয় বিষ্ণু এবং বিষ্ণুর হৃদয়ে আমি, যারা এই দুটির মধ্যে পার্থক্য মনে করে না তারা আমার বিশেষ প্রিয় । - এটি বলেছেন।
এবার শ্লোকটির ভাবার্থ হল - শিবের হৃদয়ে শ্রীবিষ্ণু আছেন, কারণ পরমেশ্বর শিবের সবচেয়ে প্রিয়তম ভক্ত শ্রীবিষ্ণু। এই কারণ স্কন্দপুরাণে বলা হয়েছে 👇
নাস্তি শৈবাগ্রণীবিষ্ণো ॥৫৬
[তথ্যসূত্র - স্কন্দমহাপুরাণ/মাহেশ্বরখণ্ডঅরুণাচলমাহাত্ম্যম/উত্তরার্দ্ধ/অধ্যায় নং ৪]
সরলার্থ – শ্রীবিষ্ণুর থেকে শ্রেষ্ঠ শৈব আর কেউ নেই ॥৫৬
এছাড়াও বৈষ্ণবদের পদ্মপুরাণেই স্বয়ং শ্রীহরি পরমেশ্বর সদাশিবের কাছে শিবভক্তি প্রার্থনা করছেন।
প্রমাণ দেখুন 👇
সদাশিব উবাচ — বরং বৃণু মহাভাগ মনসা যৎ ত্বমিচ্ছসি। শিবেরিতমথাকর্ণ হরির্ব্বব্রে বরোত্তমম্ ॥২৩৯
হরিরুবাচ – ত্বৎপাদযুগলে শম্ভো ভক্তিরস্তু সদা মম। অথ দত্ত্বা বরং শম্ভুরিদমাহ বচো হরিম্ ॥২৪০
(তথ্যসূত্র - পদ্মপুরাণ/পাতালখণ্ড/চতুঃষষ্টিতমোহধ্যায়)
সরলার্থ - সদাশিব বললেন, হে মহাভাগ! তুমি মনে মনে যে বর ইচ্ছা কর,তাই প্ৰাৰ্থনা কর, ঈশ্বর শিবের বাক্য শ্রবণ করে শ্রীবিষ্ণু উত্তম বর প্রার্থনা করলেন।২৩৯ পরমশৈব শ্রীহরি বললেন, হে শম্ভো! আপনার পদযুগলে আমার সর্বদা যেন ভক্তি থাকে,আমি এই বর প্রার্থনা করি।২৪০
সুতরাং, শৈব ও বৈষ্ণব উভয় পুরাণ থেকে প্রমাণিত হল যে হরি পরমেশ্বর শিবের ভক্ত ও শ্রেষ্ঠ শৈব ।
আর শ্রীবিষ্ণুর হৃদয়ে সদাশিব রয়েছেন, কারণ শ্রীবিষ্ণুর আরাধ্য হল পরমেশ্বর সদাশিব । কারণ, ভক্তের হৃদয়ে ভগবান থাকবেন এটা তো স্বাভাবিক।
আর শিব যে বিষ্ণুরূপ ধারণ করেন তা তো শ্রুতিতেই প্রমাণ আছে,
যোবৈ রুদ্রঃ স ভগবান যশ্চ বিষ্ণুস্তস্মৈ বৈ নমোনমঃ॥
[অথর্ব-শির উপনিষদ - ২|২]
যিনি বিষ্ণুরূপ ধারন করে অনন্ত জগৎ পালন করছেন সেই পরাৎপর পরব্রহ্ম শিব কে পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি।
এছাড়াও বৈষ্ণবদের পদ্মপুরাণ থেকেই প্রমাণ দেয়া হয়েছে যে শ্রীহরি সদাশিব থেকে প্রকট হন।
তাই বিষ্ণুর রূপটা শিবই ধারণ করেন সত্ত্বগুণকে আশ্রয় করে। তাই ব্যাপ্ত পরমেশ্বর শিবকে বিষ্ণু বলা হয়, বিষ্ণুরূপ হলেও তিনি মূলত শিব তাই তার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে,
'শিবায় বিষ্ণুরূপায় শিবরূপায় বিষ্ণবে '
এবার আলোচনায় আসি স্কন্দ উপনিষদের ৯নং শ্লোকের বিচারের বিষয়ে 👇
যথা শিবময়ো বিষ্ণুবেরং বিষ্ণুময়ঃ শিবঃ ৷
যথান্তরং ন পশ্যামি তথা মে স্বস্তিরাুযুষি ॥৯
অর্থাৎ—‘বিষ্ণু যে প্রকার শিবময়, শিবও সে প্রকার বিষ্ণুময় ৷ তখন আমাকে এখানে কোনো অনন্তর দেখা দেয়না তখন আমি এই শরীরেই কল্যাণরূপ হয়ে যাই।’
উপরোক্ত শ্লোকের বিচার করলে দেখা যায় পরমেশ্বর শিব নিজেই বিষ্ণুময় অর্থাৎ পরমেশ্বর শিব নিজেই ব্যাপ্ত পরমেশ্বর অর্থাৎ বিষ্ণু। আবার এই সমগ্র ব্যাপ্তিই অর্থাৎ বিষ্ণুর অভ্যন্তরিন সত্ত্বা প্রকৃত পক্ষে শিবময়। কারণ, শিবই অদ্বিতীয় পরমেশ্বর। সুতরাং ইহার মধ্যে কোনো ভেদ কিছুই নেই, কারণ এক পরমেশ্বর শিবই বিষ্ণুরূপ ধারণ করছেন পালনের জন্য।
আমাদের ব্যাখ্যা যথাযথ কি না সেটা যাচাই করে দেখা যাক, স্কন্দমহাপুরাণের সূতসংহিতার যজ্ঞবৈভবখণ্ডের অধ্যায় নং ২ -এ বলা হয়েছে
শিবরুদ্রমহাদেবব্রহ্মেশানাদিনামতঃ ।
বিষ্ণবাদিদেবতাঃ পশ্যন্ক্রমান্মুচ্যেত বন্ধনাৎ ॥ ৬৪
শিবং সর্বোত্তমং বিপ্রা হরিবিষ্ণবাদিনামতঃ ।
চিন্তয়ন্ঘোরসংসারে পতত্যেব ন সংশয়ঃ ॥ ৬৫
যথাঽমাত্যাদিবুদ্ধিস্তু রাজ্ঞি বাধায় দেহিনাম্ ।
তথা বিষ্ণবাদিবুদ্ধিস্তু শিবে বাধায় দেহিনাম্ ॥ ৬৬
অতঃ শিবঃ সদা ধ্যেযঃ প্রধান্যেন মনীষিভঃ ।
জ্ঞানযজ্ঞাৎপরো যজ্ঞো নাস্তি নাস্তি শ্রুতৌ স্মৃতৌ ॥ ৬৭
সরলার্থ - যে সমস্ত ব্যক্তি বিষ্ণু আদি দেবতাকে শিব, রুদ্র, মহাদেব, ব্রহ্ম, ঈশান আদি নামের বিষয় বলে বোঝেন সেই সমস্ত ব্যক্তিই ক্রমমোক্ষ প্রাপ্ত করতে সক্ষম হন । ৬৪
সর্বোত্তম শিবকে যারা হরি, বিষ্ণু আদি নামের বিষয় মনে করে তারা ঘোর সংসারে ঘুরে বেড়ায় হয়রানির শিকার হতে থাকে । ৬৫
যেমন রাজাকে মন্ত্রী মনে করলে রাজকোপের কারণে কষ্ট হয় তেমনি শিবকে বিষ্ণু মনে করলে কষ্ট হয়। ৬৬
সুতরাং, মনীষিদের প্রধানত শিবকেই ধ্যান করা উচিত। শ্রুতি, স্মৃতি অনুসারে জ্ঞানযজ্ঞ থেকে বড়ো কোনো যজ্ঞ নেই। ৬৭
এর তাৎপর্য হল - যদি কেউ শিবকে বিষ্ণুর একটি নাম ভাবে তবে তারা মায়ার ফাঁদে পড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে শাস্ত্রে। কিন্তু যারা বিষ্ণু নামটি পরমেশ্বর শিবের, পরমেশ্বর শিবই ব্যাপ্তরূপে পরমেশ্বর বলেই তিনি বিষ্ণু বলে কথিত হন, এমনটা ভাবনা করলে তারা প্রকৃত পক্ষেই সত্যের পথে রয়েছে বলেই উল্লেখ করা হয়েছে শাস্ত্রে।
☀️উপরোক্ত শ্লোকগুলিকে শ্রুতিশাস্ত্র অর্থাৎ বেদশাস্ত্র সমর্থন করেছে। বেদের অন্তর্গত শরভ উপনিষদের ৩০ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, চলুন দেখে নিই 👇 -
এক এব শিবো নিত্যস্ততোঽন্যৎসকলং মৃষা ।
তস্মাৎসর্বান্পরিত্যজ্য ধ্যেযান্বিষ্ণবাদিকান্সুরান্ ॥ ৩০ ॥
[তথ্যসূত্র - শ্রুতিশাস্ত্র(বেদ)/শরভ উপনিষদ]
☘️ সরলার্থ – শিবই একমাত্র নিত্য, অন্য সকল কিছুই মিথ্যা । এই কারণে বিষ্ণু আদি সকল দেবতাকে পরিত্যাগ করে শিবকেই ধ্যেয় বলে জানা উচিত ॥ ৩০ ॥
ব্যাখ্যা - যেহেতু বিষ্ণু সহ সমস্ত দেবতার স্বরূপ পরমেশ্বর শিব নিজেই ধারণ করেন তাই একমাত্র শিবকেই ধ্যেয় এবং সত্য বলা হয়েছে , বাকি সবকিছুকেই মিথ্যা বলেছেন স্বয়ং বেদ শাস্ত্র।
উপরোক্ত সূতসংহিতার শ্লোকের উপর শ্রুতিশাস্ত্রের সমর্থন পাওয়া গিয়েছে । তাই এই শ্লোকগুলি ও আমাদের ব্যাখ্যা যে চিরাচরিত সত্য তা দিনের আলোর ন্যায় পরিষ্কার।
কেননা ব্যাস সংহিতায় বলা হয়েছে,
মহর্ষি ব্যাসদেব তার ব্যাস সংহিতা ১.৪ তে বলেছেন -
"শ্রুতি স্মৃতি পুরাণানাং বিরোধো যত্র দৃশ্যতে ।
তত্র শ্রৌতং প্রমাণস্তু তয়োর্দ্বৈধে স্মৃতিব্বরা ॥"
সরলার্থ : যেখানে শ্রুতি, স্মৃতি ও পুরাণের বিরোধ দেখা যায়, সেখানে শ্রুতির কথনই বলবান এবং যেস্থলে স্মৃতি ও পুরাণের বিরোধ দেখা যায়, সেখানে স্মৃতির কথনই বলবান।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে যে, বেদের সহিত পুরাণ শাস্ত্রের বাক্যের উপর সমর্থন রয়েছে, কোনো বিরোধ নেই। তাই এই শ্লোকগুলির অর্থ নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য। তারই সাথে আমাদের প্রত্যেকটি ভাবার্থ তথা ব্যাখ্যাও শাস্ত্র সম্মত ।
সিদ্ধান্ত :
১) হরি ও হর হল গুণাত্মক সত্ত্বা, তাই শিবের হর স্বরূপটি গুণযুক্ত হলে সেই গুণযুক্ত সত্ত্বা আমাদের শৈবদের কাছে প্রকৃত শিব বলে গন্য করা হয় না, কারণ ওই গুণে আবদ্ধ করে শিব নিজেই নিজের ব্রহ্মসত্ত্বার বিপরীত কার্য করে থাকেন। পরমেশ্বর শিব গুণের অতীত,তাই ত্রিদেবের অন্তর্গত হর সত্ত্বার বাহ্যিক লোকাচার বশতঃ কার্য ও লক্ষণগুলি কখনোই শিবের লক্ষণ বলে গণ্য হয়না, বরং রুদ্রদেবের অন্তরে থাকা গুণাতীত সদাশিব সত্ত্বাকেই শিব রূপে গণ্য করি আমরা।
২) আমরা কোনোভাবে কোনো ভেদাভেদ কে প্রশ্রয় দিইনা, আমাদের দর্শন হল - অদ্বৈত শৈব দর্শন, আমাদের দৃষ্টিতে আমরা একমাত্র শিবকে পরমসত্ত্বা মানি, অনান্য দেবদেবী সকলেই শিবের বিভিন্ন স্বরূপ। আমরা কখনো কোনো দেবতার সাথে পরমেশ্বর শিবের তুলনা করি না, কারণ সকল দেবতাই এক শিবের স্বরূপ, এই কারণে আমরা সকল দেবতাকে সম্মান করি এবং দেবতার মধ্যে শিবসত্ত্বা বিরাজমান এই ভাবধারা পোষন করি, আমাদের কাছে শাস্ত্র যা বলছে আমরা সেই আধারেই চলি। যেহেতু পরমেশ্বর শিব ছাড়া বাকি সমস্ত দেবতাদের স্বরূপ গুলি অনিত্য, তাই একমাত্র শিবকেই ধ্যেয় বলে গন্য করি, শরভ উপনিষদেও তাই বলা হয়েছে। পারমার্থিক বিচারে একমাত্র শিব ই নিত্য , ব্যবহারিক পর্যায়ের বিচারে শিব হতে অনান্য দেবদেবী ভিন্ন মনে হয়। সুতরাং ব্যবহারিক পর্যায়ের বিচার আমরা করি না, বরং আমরা সকল দেবদেবীর মধ্যে পারমার্থিক বিচার করেই শিবকে ধ্যেয় বলে গন্য করি।
৩) শিবের কোনো পরিপূরকের প্রয়োজন নেই, তিনি নিজেই স্বয়ং সম্পূর্ণ, কারণ তিনিই পরমেশ্বর পরমব্রহ্ম। বর্তমানে ত্রিদেবের অন্তর্গত গুণাত্মক রুদ্রদেবকেই পূর্ণশিব বলে প্রচার করে করে সদাশিবের গুহ্য রহস্যটাই সামনে আসেনি, ফলে শাস্ত্রের ভেতরের প্রকৃত জ্ঞান জনসাধারণের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। স্মার্তরা, বৈষ্ণবের, নব্য শাক্তরা ত্রিদেবের অন্তর্গত রুদ্রদেবকেই পূর্ণ শিব বলে তুলে ধরে তার লোকশিক্ষা দেবার তথ্য গুলিকে ধরে শিবের আসল মহিমাকেই চাপা দিয়ে ফেলেছে। যদি সাধারণ মানুষের কাছে সদাশিবের সম্পর্কে তথ্য পৌঁছে যেতো তাহলে আজ এত হরিহর করে করে শিব মহিমাকে চাপা দেওয়া দেওয়া যেত না, কারণ, মানুষ জানতে পারতো সদাশিব, হরি, হর -এর প্রকৃত পরিচয়।
৪) সমস্ত শাস্ত্রের আধারে যা আলোচনা হল তাতে বোঝা গেল যে, একজন পুত্রের জন্মদাতা পিতা আর জন্মদাতা পিতার ভ্রাতা এক হলেও সেটি জিনগতভাবে, কারণ তারা একই পিতার দুই সন্তান, কিন্তু তাদের দুজনের জন্ম ও প্রকৃতি ভিন্ন। তাই পুত্রের জন্মদাতা পিতার সাথে অন্য কাউকে জন্মদাতা পিতা সর্বপ্রকারে এক বলা যায় না।
সদাশিব
↙ ⬇ ↘
ব্রহ্মা রুদ্র/হর বিষ্ণু/হরি
[বিঃদ্রঃ - যারা শৈবদের কাছে একতার জ্ঞান দিতে আসছেন তারা আমাদের কাছে একতার জ্ঞান দিয়ে সময় অপচয় না করে বরং যে সমস্ত পাষণ্ডব্যক্তিরা ভেদাভেদ করে অনান্য দেবদেবীদের অপমানিত করছে তাদের একতার জ্ঞান দিন, না জেনে বুঝে আমাদের জ্ঞান দেবার আগে একটু বিচার বিবেচনা করে নেবেন]
প্রচারে - International Shiva Shakti Gyan Tirtha -ISSGT
আরো দেখুন
এখানে ক্লিক করে
👉 শৈবপুরাণ সাত্ত্বিক, বৈষ্ণবপুরাণ গুলি তামসিক
অসংখ্য ধন্যবাদ শৈবজী। এতো সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে বলার জন্য। খুব দরকারি জিনিষ। এখন হরি ও হর এক ,এই নিয়ে খুব লাফালাফি দেখতে পাচ্ছি । পূর্ণ সত্য না জেনেই । তাই এই blog লেখাটি সত্যিই অনেক সাহায্যকারী। ॐ নমঃ শিবায়। 🙏🏻🙏🏻🙏🏻
উত্তরমুছুন🔱🕉️🙏🙏🙏🙏🙏
উত্তরমুছুন