শঙ্কর অদ্বৈতবাদ বা কেবলাদ্বৈত দর্শন কি শৈব দর্শনের পরিপন্থী ? বিস্তারিত আলোচনা।


হঠাৎ কিছুদিন ধরে দেখছি ওপার বাংলার কিছু জগাখিচুড়িবাদী ব্যক্তি ব্রহ্মসূত্র শ্রীকণ্ঠ ভাষ্যের উপরে  অদ্বৈত বৈদান্তিক দৃষ্টিকোণে রচিত পণ্ডিত অপ্পয় দীক্ষিত এর টীকা নিয়ে টানাটানি করে এটা দাবী করতে চাইছে যে - শৈব দর্শন আর শঙ্কর অদ্বৈত বৈদান্তিক দর্শনের মধ্যে কোনো ভেদ নেই। অর্থাৎ শৈবদের কে স্মার্তমত মেনে চলতে হবে। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে শৈবদের মধ্যে স্মার্ত আগ্রাসনের একটা ব্যাপার লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যদিও তা শতাব্দী ধরে সমগ্র উত্তর, পূর্ব ভারতে হয়ে আসছে।  এই ব্যাপারে আমি এতদিন কিছু বলিনি কারণ আর্যসমাজী দমন সহ আরো কিছু নিজস্ব কাজে আমি ব্যস্ত ছিলাম। তবে আজ শৈব মত এবং স্মার্ত মতের মধ্যে তুলনামূলক কিছু ব্যাপার আমি তুলে ধরবো যা প্রাচীন শৈব আচার্যরা মেনে গিয়েছেন। শৈব দর্শন অনেক প্রকারের এবং অনেক গভীর। একে সঠিক ভাবে বোঝার জন্য আপনাকে শৈব শাস্ত্র পড়তে হবে, ব্রহ্মসূত্র, বেদান্ত এর শৈব ভাষ্যের পাশাপাশি শিবসূত্র, প্রত্যভিজ্ঞা শাস্ত্র , স্পন্দ শাস্ত্র, নন্দিকেশ্বর কাশিকা, আগম শাস্ত্র এবং সেগুলির উপর শৈব আচার্যগণ কর্তৃক রচিত ভাষ্য, টীকা পড়তে হবে। নিগম (শ্রুতি) ও আগম উভয়ের উপরই জ্ঞান রাখতে হবে। শুধু বেদান্ত বা বেদ দ্বারা শৈব দর্শনকে জানা অসম্ভব। সেই কারণে আচার্য্য গণ আগম গুলির উপর পর্যন্ত ভাষ্য করে গিয়েছেন এবং তৎ সম্বন্ধিত শাস্ত্র রচনা করে গিয়েছেন। এসব শৈব শাস্ত্র অধ্যয়ন না করেই, শৈব আচার্য পরম্পরাগত, দর্শনগত মত সম্পর্কে বিচার না করেই, যারা জ্ঞান বশত বা অজ্ঞান বশত ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে যে শৈব দর্শন আর স্মার্ত দর্শন এর মধ্যে কোনো ভেদ নেই, তারা প্রকৃত পক্ষে শৈব আচার্য, গুরু দের প্রতিই দ্রোহ করে বসছে, শৈব পরম্পরাগত মতের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করে বসছে, যা চরম পাপ। 

♦️ শৈব দর্শন বলতে অনেকে মনে করে শুধুমাত্র শ্রীকণ্ঠ -শিবাদ্বৈত দর্শন অথবা পাশুপত দর্শন। এটি সম্পূর্ণ একটি ভুল ধারণা। দ্বৈত, অদ্বৈত (আদিশঙ্কর কেবলাদ্বৈত থেকে পৃথক), বিশিষ্টাদ্বৈত, বিশেষাদ্বৈত সমস্ত প্রকারের দর্শন শৈব মতের অন্তর্ভুক্ত। 

i. এদের মধ্যে সর্ব প্রাচীন দর্শন ছিল - প্রাচীন অদ্বৈত বৈদিক পাশুপত দর্শন, আচার্য্য শ্বেত দ্বারা যাহা প্রবর্তিত হয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণ, রামচন্দ্র সকলে এই দর্শনেই দীক্ষিত ছিলেন। এই পরম্পরায় (২৮+১১২) = ১৪০ জন বৈদিক ঋষি ও আচার্যগণ দীক্ষিত ছিলেন যার শাস্ত্র প্রমাণ শিবমহাপুরাণ/বায়বীয় সংহিতা/৯ নং অধ্যায়ই পাওয়া যায়। 

ii. এই অদ্বৈত পাশুপত মত থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক পড়ে আচার্য শ্রীকণ্ঠ তাঁর শ্রৌত শৈব বিশিষ্টাদ্বৈত মত বা শ্রীকন্ঠ-শিবাদ্বৈত মত প্রতিষ্ঠিত করেন, ব্রহ্মসূত্রের উপর সর্ব প্রথম শিবাদ্বৈত শারীরিক-ভাষ্য রচনা করেন (শ্রীকণ্ঠ বিজয়ম্ মতে)। তাঁদের মধ্যেও বৈদিক পাশুপত দীক্ষা এর প্রচলন ছিল। 

iii. আবার বৈদিক পাশুপত ঘরানার অন্তিমতম আচার্য নকুলীশ মহারাজের থেকে স্বতন্ত্র ধারা দ্বৈতবাদী লকুল পাশুপত মতের সূচনা ঘটে। 

iv. নন্দি মহারাজ প্রবর্তিত শৈব সিদ্ধান্ত মতেরও অনেকগুলি শাখা রয়েছে। অদ্বৈত নন্দিনাথ শৈব সিদ্ধান্ত পরম্পরা, অদ্বৈত স্কন্দ শৈব সিদ্ধান্ত পরম্পরা, দ্বৈতবাদী রুরু-সদ্যজ্যোতি পরম্পরা (Classical shaiva sidhhanta, শিব সময়াবাদ)  এবং দ্বৈতবাদী কৈলাস পরম্পরা বা মিয়াকাণ্ডার পরম্পরা (শিবানন্দবাদ)। এদের মূল ভিত্তিই ছিল শৈব সিদ্ধান্ত আগম।

v. বীরশৈব-শিবাদ্বৈত দর্শন বা শক্তি বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শন, যার উপর ভিত্তি করে ব্রহ্মসূত্রের উপর আচার্য্য শ্রীপতি পণ্ডিত আরাধ্যের শ্রীকর ভাষ্য এবং পরবর্তীকালে পণ্ডিত উমচিগি শঙ্কর শাস্ত্রী এর দ্বারা ব্রহ্মসূত্রের 'শাঙ্করীবিবৃতি' রচিত হয়েছে। এই দর্শন ভেদ-অভেদ ভিত্তিক। এই দর্শনের অপর নাম বিশেষাদ্বৈত দর্শন

vi. সর্বশ্রেষ্ঠ অদ্বৈত শৈব দর্শন এর স্থাপন হয়েছিল কাশ্মীর প্রদেশে, যার নাম শৈব পরমাদ্বৈতবাদ বা ত্রিক বা প্রত্যভিজ্ঞা বা আভাসবাদ। ইহার মূল ভিত্তিই ছিল শিবসূত্র এবং অদ্বৈত কাশ্মীর শৈব আগম

vii. তাছাড়া নাথ, কৌল,  রসেশ্বর, অবৈদিক লিঙ্গায়েৎ এরাও শৈব পরম্পরার অন্তর্ভুক্ত ছিল।  উপরিউক্ত কোনো পরম্পরাই কেবলাদ্বৈত বেদান্তের মতকে সমর্থন করে না। কেননা প্রত্যেকের নিজস্ব নিজস্ব দর্শন রয়েছে ।

[অদ্বৈত দর্শন বলতে অনেক শুধু শঙ্কর অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনকেই বুঝে থাকে। ইহা একটি মস্ত বড় ভুল ধারণা। কারণ, অদ্বৈতবাদ, অদ্বৈত দর্শন শৈবদের মধ্যে আদি শঙ্করাচার্য এর আবির্ভাবের বহুকাল আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। যেমন - কাশ্মীর শৈব পরম্পরা, নন্দিনাথ অদ্বৈত শৈব পরম্পরা  এসব। আদি শঙ্করাচার্যের দর্শনের নাম হল - কেবলাদ্বৈত দর্শন।]

♦️ শৈব দর্শন গুলির সাথে শঙ্কর কেবলাদ্বৈত এর মধ্যে পার্থক্য - 

👉A.  প্রাচীন নন্দিনাথ পরম্পরা অদ্বৈত শৈব সিদ্ধান্ত বাদী একটি পরম্পরা। এই অদ্বৈত নন্দিনাথ শৈব সিদ্ধান্ত পরম্পরার একজন বিখ্যাত আচার্য ছিলেন নায়নার তিরুমুলার, এই পরম্পরার মূল দর্শন ভিত্তিক শাস্ত্র হল নন্দিকেশ্বর কাশিকা
নন্দিনাথ পরম্পরাগত দর্শনকে আপাত দৃষ্টিতে অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের ন্যায় মনে হতে পারে অনেকের। কেননা নন্দিকেশ্বর কাশিকা মতে - ব্রহ্ম হলেন নির্বিশেষ, নির্গুণ,  প্রকাশ স্বরূপ । তিনি কার পদ বাচ্য। তিনি যখন কার স্বরূপ চিৎকলা বা মায়ার সাথে সংযুক্ত হন, তখন উণ্ স্বরূপ হয়ে যান অর্থাৎ সগুণ ঈশ্বর(মহেশ্বর) পদ বাচ্য হন। (অইউণ্ - প্রথম সূত্র)

তাহলে অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের সাথে নন্দিকেশ্বর দর্শনের ভেদ কোথায় ? ভেদ আছে। 

i. নন্দিকেশ্বর দর্শন মতে কারকে ব্রহ্মের মায়া শক্তি বা প্রকৃতি বা চিৎ কলা বলা হলেও, নন্দিকেশ্বর কাশিকায় ব্রহ্মের সিসৃক্ষা বা ইচ্ছা শক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সূক্ষ্ম এবং শুদ্ধ চিৎ শক্তিই আসলে ব্রহ্মের সাথে অভিন্না বিমর্শ শক্তি, যার উল্লেখ সেই পরম্পরার আচার্যগণ তাদের শাস্ত্রে করে গিয়েছেন।

ii. এই বিমর্শ শক্তি না থাকলে, ব্রহ্মে সিসৃক্ষাই জন্মাতো না। এই সূক্ষ্ম পরা চিৎশক্তির থেকেই মায়া তত্ত্ব আসে। সেই মায়ার দ্বারাই ব্রহ্ম সগুণ হন, ব্যাপক হন। ব্রহ্মকে শক্তি বা মায়ার সাথে নতুন করে যুক্ত হতে হচ্ছে জগৎ সৃষ্টির নিমিত্তে, এমনটা নয়, কারণ ব্রহ্ম নির্গুণ হওয়া সত্ত্বেও সূক্ষ্ম পরাচিৎ শক্তি বিশিষ্ট, যার ব্যাখ্যা ৩৬ তত্ত্বের ধারণা দ্বারা সিদ্ধ, (এর ব্যাখ্যা পরে করা আছে)। স্থূল জগৎ সৃষ্টির জন্য সেই সূক্ষ্ম পরাশক্তিরই অপরা স্বরূপ মায়ার সাথে ব্রহ্ম সম্পর্ক স্থাপন করছেন।

iii. নন্দিকেশ্বর কাশিকা মতে ব্রহ্মই নিজের অভ্যন্তরে নিজেকে জগৎরূপে বিস্তৃত করেন। জগৎ ব্রহ্ম এর থেকে ভিন্ন নয়, তাই জগৎ এক্ষেত্রে সত্য। এইরূপ অবিকৃত পরিণামবাদ নন্দিকেশ্বর কাশিকায় স্বীকৃত।

iv. অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে  নির্গুণ ব্রহ্ম কে ব্রহ্ম নামেই ব্যক্ত করা হয়েছে, আলাদা করে শিব বা পরমশিব বা সদাশিব এমন কোনো শব্দের প্রয়োগ নেই সেখানে। কিন্তু নন্দিকেশ্বর অদ্বৈত শৈব সিদ্ধান্ত মতে পরমব্রহ্ম সাক্ষাৎ পরমশিব, যা আগম সম্মত। অর্থাৎ দর্শন, আচার গত দিক দিয়ে নন্দিকেশ্বর পরম্পরা শিববাক্য শৈব আগম শাস্ত্রকে প্রামাণিক মানেন, কিন্তু অদ্বৈত বেদান্তিরা শৈব আগমকে মানেন না, তারা আগমকে অপ্রমাণ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। আশাকরি উভয় দর্শনের মধ্যে পার্থক্যটা কি সেটা সকলের নিকট সুস্পষ্ট হয়েছে। প্রমাণ স্বরূপ নীচে কিছু আলোক চিত্রের উপস্থাপন করা হল - 




👉B. স্কন্দ শৈব সিদ্ধান্ত পরম্পরাও একটি অদ্বৈত শৈব পরম্পরা। এই পরম্পরার একজন উল্লেখযোগ্য আচার্য্য ছিলেন শ্রী শিবাগ্রযোগীঅদ্বৈত শৈব আগম, ২৮টি আগমের সার সর্বজ্ঞানোত্তর আগমের উপর এবং পৌষ্কর আগমের উপর  তিনি টীকা রচনা করেন এবং অদ্বৈত শৈব সিদ্ধান্ত (আগমান্ত) এর উপর তাঁর লেখা বিখ্যাত গ্রন্থের নাম - শৈব পরিভাষা, যেখানে অদ্বৈত শৈব সিদ্ধান্তকে পুরো ন্যায় শাস্ত্র এবং আগম শাস্ত্রের দ্বারা তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই  পরম্পরাও আচারগত ভাবে সিদ্ধান্ত আগম শাস্ত্রের উপর নির্ভরশীল এবং আগম শাস্ত্র তাঁদের কাছে প্রামাণিক।

সুতরাং আচার, দর্শন, শাস্ত্র উভয় দিক থেকেই যে শঙ্কর অদ্বৈত পরম্পরার সাথে অদ্বৈত শৈব সিদ্ধান্ত পরম্পরার পার্থক্য রয়েছে তা সুস্পষ্ট।


👉 C. কাশ্মীর ত্রিক শৈব ধারা অদ্বৈত সিদ্ধান্ত ভিত্তিক - পরমাদ্বৈতবাদ বা ঈশ্বরাদ্বয়বাদ বা প্রত্যভিজ্ঞাবাদ। এরা কাশ্মীর অদ্বৈত শৈব আগম, শিব সূত্র, স্পন্দশাস্ত্র এবং প্রত্যভিজ্ঞা শাস্ত্র ভিত্তিক, আভাসবাদ ভিত্তিক, বিম্ব-প্রতিবিম্ববাদ ভিত্তিক, ব্রহ্ম পরমশিবে সূক্ষ চিৎরূপা বিমর্শময় পরাশক্তি বর্তমান - এই মতাদর্শ ভিত্তিক। চাইলে উপরিউক্ত শৈবপরম্পরা গুলোর দর্শনকে বেদান্ত, ব্রহ্মসূত্র, বেদশাস্ত্র দ্বারা অদ্বৈত শৈব দৃষ্টিকোণে ব্যাখ্যা করাই যেতে পারে, কিন্তু তাই বলে শৈব অদ্বৈত দর্শন আর শঙ্কর অদ্বৈত দর্শন এক হয়ে যাবে, শৈব আর স্মার্ত দর্শন, আচার এক হয়ে যাবে তার কোনো কথা নেই, পার্থক্য ছিল, আছে ও থাকবে।

i. শঙ্কর অদ্বৈত দর্শনে নির্বিশেষ, নির্গুণ, নিরাকার ব্রহ্মই মূল বিচার্য এবং সত্য যা সৎ-চিৎ-আনন্দময়, ব্রহ্ম শুধু মাত্র প্রকাশ স্বরূপ, ব্রহ্মের সগুণত্ব ঔপাধিক । মায়াশক্তি যুক্ত সগুণ ব্রহ্ম অর্থাৎ ঈশ্বরের পাঁচ স্বরূপ - গণেশ, বিষ্ণু, দুর্গা, সূর্য ও শিব, এই সাকার স্বরূপ গুলি কিন্তু সত্য নয় বরং অনির্বচনীয়া মায়ার দ্বারা ব্রহ্মের বিবর্তিত মিথ্যা প্রতিরূপ মাত্র। সুতরাং শঙ্কর অদ্বৈত দর্শনে শিবের বা সদাশিবের আলাদা কোনো স্থান নেই , না থাকাটাই স্বাভাবিক, অর্থাৎ সদাশিব বা শিব ইহা নির্গুণ ব্রহ্মের একটি উপাধি মাত্র, ব্যবহারিক রূপ মাত্র, মায়ার তৈরি একটি মিথ্যা ভ্রম মাত্র, সত্য একমাত্র সেই নাম, রূপ হীন ব্রহ্ম। অদ্বৈত শৈব দর্শনের সাথে এখানেই আদিশঙ্কর অদ্বৈতবাদের মত-পার্থক্য

ii. অদ্বৈত শৈব দর্শন অনুযায়ী সদাশিব ব্রহ্মের কোনো স্বরূপ বা প্রকাশ বা কোনো উপাধি নয় বরং সদাশিব নিজেই সেই অদ্বিতীয় ব্রহ্ম। পারমার্থিক পর্যায়ে এক ও অদ্বৈত নিরাকার ব্রহ্ম পরমশিবই বিদ্যমান যা - " একো হি রুদ্র ", " শান্তং শিবং অদ্বৈতং ",  " পরংব্রহ্ম পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলম্ ঊর্ধ্বরেতং বিরূপাক্ষং ", " যো সর্বেষু বেদেষু পঠ্যতে হ্যজ ঈশ্বর ", " অকাযো নির্গুণোহধ্যাত্মা তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু " - প্রভৃতি একাধিক নিগমবাক্য (বেদ) এবং বিবিধ আগম বাক্য দ্বারা সমর্থিত। এই শিবই একাধিক স্বরূপ এবং নাম ধারণ করেন এবং ব্যবহারিক, গুণযুক্ত এই স্বরূপ গুলির সাথে সেই ব্রহ্ম পরমশিবের অবশ্যই ব্যবহারিক পার্থক্য রয়েছে, যার কারণ মায়ায় কঞ্চুকা। ব্রহ্মকে যদিও নাম দ্বারা আবদ্ধ করা যায় না কিন্তু বেদ ও আগম তাঁকে শিব, সদাশিব, রুদ্র, ঈশান, মহেশ্বর, পরমশিব, বিরূপাক্ষ প্রভৃতি নামে সম্বোধন করছে। 

[যদিও পূর্বপক্ষ এই নাম গুলিকে বিশেষণ আর অর্থবাদ (স্তুতি বা প্রশংসা বাক্য সূচক অর্থবাদ) বলে পাশকাটিয়ে দেবে, সেই জন্যই শৈব দর্শনে উপরিউক্ত শ্রুতি বাক্য গুলিকে সঠিক বিশ্লেষণ করতে আগম শাস্ত্রের প্রয়োজন পড়ে, যা একাধিক শৈব আচার্য্য কর্তৃক স্বীকৃত, পণ্ডিত অপ্পয় দীক্ষিতও যার অন্যথা করেননি।  যদিও স্মার্তবাদীদের দাবী ধরে চললে একই যুক্তিতে নামহীন ব্রহ্মকে ব্রহ্ম নাম দ্বারা আবদ্ধ করাটাও হবে একধরনের মূর্খামি। এখন তারা এক্ষেত্রে ব্রহ্ম শব্দের ভূতার্থবাদ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করতেই পারে, সেক্ষেত্রে সদাশিব, পরমশিব ইত্যাদি শব্দও ভূতার্থবাদ, কেননা শ্রুতি বাক্য অর্থাৎ আগম এবং আগমান্ত দ্বারা সেগুলি ইতিমধ্যে প্রমাণিত/সিদ্ধ । "আপ্তোপদেশঃ শব্দ" - এই ন্যায়বাক্য শ্রুতি পরম্পরা অর্থাৎ আগমোক্ত পরম্পরার ক্ষেত্রেও একই ভাবে প্রযোজ্য। এই জন্য পুরাতন বেদ ভাষ্যকার সায়ণাচার্যও রুদ্র, সদাশিব, ঈশান প্রভৃতি শব্দকে অর্থবাদ বলে বা গুণবাদ বলে ফেলে দিতে পারেননি বা লক্ষণাবৃত্তির দ্বারা অর্থের পরিবর্তন করতে পারেননি, বেদের সায়ণভাষ্য পড়লেই তা প্রত্যক্ষ করা যায়।]

iii. কাশ্মীর অদ্বৈত শৈব দর্শন মতে, ব্রহ্ম পরমশিব শুধু প্রকাশ স্বরূপ নয় বরং বিমর্শময়ও বটে।  শঙ্কর অদ্বৈত বেদান্ত মতে ব্রহ্মের বিমর্শময়তা হল উপাধিক, ব্রহ্ম শুধুই প্রকাশ স্বরূপ। কিন্তু অদ্বৈত শৈব দর্শন মতে ব্রহ্মের বিমর্শময়তা স্বাভাবিক অর্থাৎ মূল, যা একাধিক শ্রুতিবাক্য দ্বারা সমর্থিত। আদিশঙ্করের অদ্বৈত বেদান্ত মতে মায়া হল  না সৎ, না অসৎ, ইহা অনির্বচনীয়া। মায়া আর ব্রহ্ম ভিন্ন, উহারা কদাপি এক নন, কিন্তু মায়ার সাথে ব্রহ্মের সম্পর্ক তাদাত্ম। কিন্তু, কাশ্মীর অদ্বৈত শৈব দর্শনে ব্রহ্ম পরমশিব প্রকাশ- বিমর্শময়, পরমশিবে অবস্থিতা সূক্ষ্ম চিৎ শক্তিই পরাশক্তি,  ইহা শিবের থেকে অভিন্না, যা " পরংব্রহ্ম পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলম্ " , " পরাস্য শক্তির্বিবিধৈব শ্রূয়তে,স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চ ", " অম্বিকা পতযে উমা পতযে ", " উমাসহাযং পরমেশ্বরং ত্রিলোচনং ", " তস্মিন্নেবাকাশে স্ত্রীয়মাজাগাম্ .. বহুশোভমানামুমাং হৈমবতীং " - ইত্যাদি শ্রুতিবাক্য দ্বারা সমর্থিত।

iv. অদ্বৈত বেদান্তের সৎ-চিৎ-আনন্দময় ব্রহ্মের সৎ স্বরূপকেই অদ্বৈত শৈব দর্শনে প্রকাশময়তা এবং চিৎ কে বিমর্শময়তা বলা হয়। যেহেতু এই চিৎশক্তি পারমার্থিক পর্যায়ে ব্রহ্মের থেকে অভিন্না অর্থাৎ সাক্ষাৎ শিব, পূর্ণোঽহং, তাই অদ্বৈত শৈব দর্শন মতেও ব্রহ্ম পরমশিবকে নির্গুণ নিরাকার বলা অযৌক্তিক কিছু নয়, ব্রহ্মে চিৎ শক্তি সুপ্ত স্বরূপে বিদ্যমান থাকছে, কোনো জীবন্ত বীজের সুপ্ত অবস্থার ন্যায়।তাই এক্ষেত্রে ব্রহ্ম নিষ্ক্রিয় হয়েও পূর্ণ নিষ্ক্রিয় নয়। ব্রহ্ম সে সময় কোনো কার্য করেনা, শক্তি এই সময় সুপ্ত অবস্থায় শিব অভ্যন্তরে বিদ্যমান থাকে। তাই এই অবস্থাকে আপাতভাবে নিষ্ক্রিয় বলা যেতে পারে। এই অবস্থাকেই পঞ্চম অবস্থা তূরীয়াতীত বলা হয়, যার ব্যাখ্যা অদ্বৈত বেদান্ত করতে অসমর্থ, বেদান্ত দর্শন চতুর্থ অবস্থা তূরীয় পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।

" যথা ন্যগ্রোধ বীজস্থঃ শক্তি রূপো মহাদ্রুমঃ | 
তথা হৃদয় বীজস্থং বিশ্বমেতচ্চরাচরম্ || ২ || "
 
('পরাপ্রবেশিকা - আচার্য্য ক্ষেমরাজ রচিত )  - যেরূপ একটি বৃহৎ বৃক্ষ একটি ক্ষুদ্রবীজের মধ্যে নিহিত থাকে ঠিক সেরূপ এই বিশ্ব চরাচরও পরমেশ্বর পরমশিবের চিদাকাশরূপি হৃদয়বীজ মধ্যে সূক্ষ্মভাবে বিদ্যমান থাকে । পরমেশ্বরের বিমর্শরূপিণী সেই হৃদয় থেকেই শক্তির স্ফুরণ ঘটে এবং সেই চৈতন্যশক্তিই জগদাকারে প্রকাশ পায় । (তাই জগৎ সত্য।)

v. অদ্বৈত শৈব দর্শন মতে এই পরমশিব সর্বদা অবিকৃতই থাকে এক অদৃশ্য সর্বব্যাপী ক্ষেত্র রূপে যা " সর্ব বৈ রুদ্র ", " সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম ", " ঈশবাস্যমিদং সর্বং ", " সর্বব্যাপী স ভগবান্ তস্মাৎ সর্বগতঃ শিবঃ ", " সর্বভূতেষু গূঢ় " ইত্যাদি শ্রুতি বাক্য দ্বারা সিদ্ধ। এই পরম শিবের হৃদয় দর্পণ স্বরূপা হলেন তাঁর সেই অভিন্ন চিৎশক্তি। পরমশিব তাঁর হৃদয়েই যখন নিজেকে দেখবার ঈক্ষণ/সিসৃক্ষা প্রকাশ করেন, তখনই সেই দর্পণে ৩৬ তত্ত্বময় সমগ্র জগৎ প্রতিবিম্বিত হয় এবং এই আনন্দ স্বরূপ প্রতিবিম্বিত চিত্র সেই পরম সৎ থেকে ভিন্ন কিছু নয়। আবার সেই আনন্দ স্বরূপ প্রতিবিম্ব বস্তুত সেই চিৎ স্বরূপ ত্রিকোণ (ইচ্ছা-জ্ঞান-ক্রিয়া) দর্পণ ভিন্ন অপর কিছু নয়। 
গজ-বৃষভ ন্যায় অনুসার পরমশিবই একাধারে শিবভাব প্রাপ্ত হন এবং শক্তিভাব প্রাপ্ত হন, তিনি একাধারে অবিকৃত বিশ্বোত্তীর্ণ শিব স্বরূপ আবার একাধারে আনন্দময় চিৎ শক্তি স্বরূপ । " স এব বিশ্বমেষিতুং জ্ঞাতুং কর্তুং চোন্মুখো ভবন্ শক্তিস্বভাবঃ কথিতো হৃদয়ত্রিকোণমধুমাংসলোল্লাসঃ || "  (মহার্থমঞ্জরী/১৪ - শ্রীমহেশ্বরানন্দ রচিত ) - তিনি (পরমশিব) যখন নিজের হৃদয়ের ইচ্ছা - জ্ঞান - ক্রিয়া রূপি ত্রিকোণের মাধুর্যমণ্ডিত উল্লাস দ্বারা নিজ হৃদয়ে স্থিত সূক্ষ্মরূপি জগতকে ঈক্ষণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তখন তিনিই শক্তিস্বভাব সম্পন্ন হন অর্থাৎ স্বয়ং শক্তি (বিমর্শ) হয়ে যান ।

পরমশিবের নিজের অভ্যন্তরেই এই 'অহং' ভাব সম্পন্ন চিৎ শক্তি স্বরূপ দর্পণে (I-Counsciouness) প্রবিম্বিত প্রসারণই হল এই জগৎ। সুতরাং এই জগৎ শিব থেকে ভিন্ন নয়, শিবের অভ্যন্তরেই অবস্থিত। একেই বলছে - আভাসবাদ, পরমশিব একাধারে অবিকৃতই থাকছেন এবং অপর দিকে নিজ চিৎ দ্বারা জগৎ রূপে ও জীব রূপে প্রতিভাত হচ্ছেন , তাই অদ্বৈত শৈব দর্শন অনুযায়ী জগৎও সত্য, মিথ্যা নয়। ত্রিক  দর্শনের এই আভাসবাদের ধারণা আর বীরশৈব শক্তিবিশিষ্টাদ্বৈত দর্শনের অবিকৃত পরিণামবাদ এর ধারণা এর মধ্যে তাই সাদৃশ্যতা দেখতে পাই আমরা। ত্রিক  দর্শনের এই আভাসবাদের ধারণা থেকেই শাক্ত আচার্য ভাস্কররায় তাঁর অবিকৃত পরিণামবাদ কে স্থাপনা করেন।
এখন এই অবিকৃত পরিণামবাদকে মীমাংসা করে অদ্বৈত বেদান্তের বিবর্তবাদের সাথে এক করে দিলেই যে শৈব দর্শন আর স্মার্ত দর্শন এক হয়ে যাবে তার কোনো মানে নেই। 

আচার্য অভিনবগুপ্ত তাঁর 'বোধপঞ্চাদশিকা' তে বলছেন - 
" স এব সর্বভূতানাং স্বভাবঃ পরমেশ্বরঃ | 
ভাবজাতং হি তস্যৈব শক্তিরীশ্বরতামযী || ২ || 

আলোচ্য শ্লোকের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কাশ্মীর শৈবাচার্য আচার্য লক্ষ্মণজু বলছেন - ' সর্বভূতানাংস্বভাব ' শব্দমালা দ্বারা পরমেশ্বর শিব বাচিত হয়েছেন এখানে । পরমেশ্বর শিব সমগ্র বিশ্বভূতস্বরূপ এবং জড় , চেতন , সবকিছুরই অস্তিত্ব স্বরূপ । এই ব্যবহারিক জগৎ সেই পরমেশ্বর শিবেরই শক্তির স্ফূরণ মাত্র , প্রসারণ মাত্র (পরা --- পরাপরা --- অপরা বা মায়া এই ক্রমে) , এই সূক্ষ্ম বিমর্শ - চিৎ শক্তির থেকে পরমেশ্বর আলাদা নন , তাই ব্যবহারিক জগৎও সেই পরমেশ্বরের থেকে ভিন্ন নন বরং পরমেশ্বরের হৃদয় দর্পণেই তা প্রতিবিম্বিত হয় । এই শক্তিই পরমেশ্বরের ঐশ্বর্য্য , স্বাতন্ত্র্য , পরাচিৎ এইসব নামে অভিহিত হয় । সুতরাং এটাই সিদ্ধান্ত যে , পরমেশ্বর শিব সাক্ষাৎ শক্তির অধিষ্ঠাতা , শক্তিমান এবং সমগ্র বিশ্বজগৎ সেই শক্তিরই প্রকাশ । 

" শক্তযশ্চ জগৎ সর্বং শক্তিমাংশ্চ মহেশ্বরঃ | " ( তন্ত্রালোক / জয়রথ বিবেক টীকা ৫/৪০ ) 

- ব্রহ্মের উপাদান ও নিমিত্ত কারণত্ব এই ভাবেই ত্রিক অদ্বৈত শৈব দর্শনে প্রতিপাদিত হয়ছে , যা শ্রুতি ও জ্ঞান মীমাংসা শাস্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যতাপূর্ণও বটে

vi. আদি শঙ্কর অদ্বৈত বেদান্ত মতে বা পঞ্চদেবতার ধারণা অনুযায়ী শৈব দর্শনের কৈলাসপতি রুদ্রদেবকেই তারা সরাসরি শিব/সদাশিব হিসেবে অভিহিত করে। নিরাকার ব্রহ্ম এর গুণ যুক্ত স্বরূপ হল - শিব, শক্তি, বিষ্ণু, গণেশ, সূর্য ইত্যাদি। কিন্তু অদ্বৈত শৈব দর্শনে সদাশিব আর রুদ্রের মধ্যে ব্যবহারিক পার্থক্য রয়েছে । কেননা, শৈব দর্শন মতে ত্রিগুণ এর অতীত পরমেশ্বর সদাশিব বা পরমশিবে  যখন জগৎ সৃষ্টির সৃসিক্ষা জন্মায়, তথন‌‌ তিনি একাধারে বিশ্বোত্তীর্ণ, অবিকৃত থেকেও, একই সাথে নিজ শক্তির দ্বারা বিশ্বময় অবস্থায় ভাসিত হচ্ছেন এবং ধীরে ধীরে সদাশিব তত্ত্ব, রুদ্র তত্ত্ব, বিষ্ণু তত্ত্ব ইত্যাদি তত্ত্বে তিনি নিজেকেই নিজে মায়ার ষট্-কঞ্চুকা দ্বারা  সংকুচিত করে অনুভব করছেন নিজ বিমর্শ হৃদয়েই, ইহাই আভাসবাদ। এই 36 তত্ত্বময় জগৎ সেই অবিকৃত পরমশিবের প্রতিবিম্বিত আভাস ছাড়া আর কিছু নয়, যা শিবের অভ্যন্তরেই অবস্থিত। তাই অদ্বৈত শৈব দর্শনে মূল সেই এক ব্রহ্ম শিব, বাকি স্বরূপগুলো গৌণ। 

vii. শৈব মতে পঞ্চদেবতার কোনো ধারণা পাওয়া যায় না বরং অকল জীব, মন্ত্রমহেশ্বর প্রমাতা, মন্ত্রেশ্বর প্রমাতা, মন্ত্র/বিদ্যেশ্বর প্রমাতা, বিজ্ঞানকল প্রমাতা, প্রলয়াকল প্রমাতা, সকল প্রমাতা এসবের উল্লেখ রয়েছে যেগুলো শিবের বিভিন্ন ব্যবহারিক পর্যায়ের প্রতিবিম্বিত স্বরূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। আর পঞ্চদেবতা সহ যেকোনো সগুণ সাকার দেবতা বা জীব এদের মধ্যে সর্বশেষ স্তর সকল প্রমাতা এর মধ্যেই পড়ে যাকে, এক্ষেত্রে শৈব দর্শনে বেদান্তের বা সাংখ্যের ন্যায় কারণদেহধারী জীব, লিঙ্গদেহধারী জীব, পঞ্চভূতাত্বক সাকার সগুণ দেহ ধারী জীব, সগুণ নিরাকার জীব এরকম কোনো ধারণা নেই। কারণ গুণ আসে প্রকৃতি তত্ত্ব বা অব্যক্ত তত্ত্ব থেকে, বেদান্তে একই মায়াশক্তি বলা হয়, তাই অদ্বৈত বেদান্ত মতে শক্তি যুক্ত ব্রহ্ম মানে সে সগুণ হবেই, সাকার আর নিরাকার এসব পরের কথা । কিন্তু শৈব দর্শন মতে প্রকৃতি তত্ত্বের উর্ধ্বে মায়া, আর মায়া তত্ত্বের অনেক উর্ধ্বে শক্তিতত্ত্ব আর এই সূক্ষ্ম চিৎশক্তি সম্পন্ন ব্রহ্ম পরমশিব তাই ত্রিগুণ এর অতীত, নির্গুণ এবং নিরাকারও। তাই অদ্বৈত শৈব দর্শনেও ব্রহ্ম নির্গুণ, নিরাকার কিন্তু বিমর্শময়ও বটে। তাই অদ্বৈত বেদান্তের সাথে অদ্বৈত শৈব দর্শনের কিছু জায়গায় মিল থাকলেও, ব্যাখ্যাগত পার্থক্য রয়েছে, তত্ত্বগত পার্থক্য রয়েছে এবং স্বীকার্যগত পার্থক্য রয়েছে । 

viii. অদ্বৈত বেদান্ত মতে ব্রহ্ম শুধু মাত্র সৎ-চিৎ-আনন্দ লক্ষণযুক্ত। ইচ্ছা, জ্ঞান এবং ক্রিয়া জীবের লক্ষণ, ব্রহ্ম এর নয়। কিন্তু অদ্বৈত শৈব দর্শন মতে ব্রহ্ম - সৎ-চিৎ-আনন্দ-ইচ্ছা-জ্ঞান-ক্রিয়া। ইচ্ছা অর্থাৎ সিসৃক্ষা, জগৎ আকারে প্রকাশিত হওয়ার ইচ্ছা, যা " একো অহং বহু স্যাং " প্রভৃতি শ্রুতি দ্বারা সিদ্ধ। পরমশিব জ্ঞান স্বরূপ - " সত্যং জ্ঞানং অনন্তং ব্রহ্ম "। জগদাকারে প্রকাশ হওয়ার সক্ষমতা কেই ক্রিয়া বলা হয়। অদ্বৈত শৈব দর্শন মতে পরমেশ্বর স্বতন্ত্র্য, জগৎ সৃষ্টির জন্য তাঁকে কারো অপেক্ষা করতে হয়না। পরমেশ্বরের এই স্বাতন্ত্র্যতা কেই অর্থাৎ ইচ্ছাকেই শক্তি বলা হয়।  " ইমাংল্লোকান্ ঈশত ঈশনীভিঃ |(শ্বেতাঃ .৩.২)
--- (পরমেশ্বর) রুদ্রই  নিজ (ঈশানী) শক্তির দ্বারা নিখিল বিশ্বজগৎ নিয়ন্ত্রিত করেন - প্রভৃতি শ্রুতি দ্বারা যা সিদ্ধ। সুতরাং অদ্বৈত শৈব দর্শনে পরমেশ্বরের স্বাতন্ত্র্যবাদ স্বীকৃত ।



👉D.  জগৎগুরু পঞ্চাচার্য প্রবর্তিত বীরশৈব শিবাদ্বৈত বা শক্তি বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শন হল এমন এক প্রকারের ভেদাভেদ দর্শন (বৈষ্ণব ভেদাভেদ এর থেকে পৃথক) যা শুরু ভেদ অর্থাৎ দ্বৈত অবস্থা থেকে হলেও শেষে গিয়ে ওই অভেদ বা অদ্বৈত পরশিবেই বিলীন হয়।

i.  মূলধারের ভক্তস্থল বোঝায় দ্বৈত অর্থাৎ ভেদ দশাকে  এবং আজ্ঞাচক্রের ঐক্যস্থল চিহ্নিত করে অভেদ দশাকে অর্থাৎ মুক্ত অবস্থায় জীব-শিব ঐক্যতা (লিঙ্গস্থল - অঙ্গস্থল সামরস্য, মহালিঙ্গ স্থল এবং ঐক্যস্থলের মিলন) বীর শৈব দর্শনেও স্পষ্ট। তাই বলে আমরা বীরশৈব দর্শন আর শঙ্কর অদ্বৈত দর্শন কে এক বলে দিয়ে পরস্পর জুড়ে দিতে পারি না, পার্থক্য রয়েছে। কেননা বীরশৈব দর্শন ষট্-স্থলবাদে বিশ্বাসী, যা অপর‌‌ কোনো  দর্শনেই‌ লক্ষ্য করা যায় না। এই ষট্-স্থলবাদের ধারণা নীচের আলোক চিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হল -

ii. বীরশৈব দর্শনও শ্রীকণ্ঠের দর্শনের মতই নির্বিশেষ (শক্তিহীন, নিষ্ক্রিয়) ব্রহ্মবাদে বিশ্বাসী নয়। শৈব দর্শনে ব্রহ্ম সূক্ষ্ম পরাচিৎ বিমর্শ শক্তি যুক্ত অথচ নির্গুণ , কেননা গুণতত্ত্ব বা প্রকৃতি তত্ত্ব শক্তি তত্ত্বের অনেক নীচের স্তরে আসে।

iii. বীরশৈব দর্শন মতেও ব্রহ্ম পরশিব সূক্ষ্ম চিৎশক্তি বিশিষ্ট, যা স্বাভাবিক, ঔপাধিক নয়, যা শিবের থেকে অভিন্না। ব্যবহারিক পর্যায়ে, দ্বৈত অবস্থা প্রবল অর্থাৎ জীব ব্রহ্মের অংশ স্বরূপে পাশবদ্ধ অবস্থায় বিদ্যমান থাকে, দ্বৈত অবস্থায় জীব এবং ব্রহ্মের মধ্যে ভেদ বর্তমান কিন্তু মুক্ত অবস্থায় জীব সাক্ষাৎ শিব হয়ে যায়, উভয়ের মধ্যে কোনো ভেদ থাকে না।





👉E.  নীললোহিত রুদ্রের অবতার জগৎগুরু শ্রীকণ্ঠ শিবাচার্য প্রণীত দর্শনের নামও শিবাদ্বৈত বা শক্তি বিশিষ্টাদ্বৈত (বীরশৈব শক্তি বিশিষ্টাদ্বৈত হতে পৃথক) । তবে ইহার মূল নাম - শৈব বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শন। এই দর্শন অনুযায়ী পারমার্থিক পর্যায়েও জীব এবং শিবের মধ্যে সূক্ষ্ম ভেদ বর্তমান, জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে পূর্ণ একতা সম্ভব নয়। 

এই দর্শন অনুযায়ী জীব এবং শিবের মধ্যে স্বগত আর বিগত অভেদত্ব থাকলেও, স্বকীয় ভেদ বিদ্যমান। শ্রীকণ্ঠের এই শৈব বিশিষ্টাদ্বৈত ভাষ্যের উপর অদ্বৈত দৃষ্টিকোণ দ্বারা পুনঃ টীকা করেন - অপ্পয় দীক্ষিত এবং পরবর্তীকালে পুনঃ শৈব বিশিষ্টাদ্বৈত দৃষ্টিকোণে টীকা করেন - শিবযোগী মুডিগোণ্ডা নাগালিঙ্গা শিবারাধ্য। তাছাড়া শ্রীকণ্ঠ ভাষ্যের উপরে ১৪ শতকে নীলকণ্ঠ আচার্য II একটি কারিকা রচনা করেন, যার নাম ক্রিয়াসার।  সুতরাং একটি ভাষ্যেকে বা দর্শনকে অন্যকোনো দৃষ্টিকোণ interprete করা যেতেই পারে, মীমাংসা করাই যেতে পারে। তার জন্য যে দুই দর্শনের মূল স্বীকার্য গুলি এক হয়ে যাবে তার কোনো মানে নেই। 

শ্রীকণ্ঠ এবং নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী তাঁদের শৈব বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শন ভাষ্যে ব্রহ্ম পরশিবকে নির্গুণ, নির্বিশেষ বলে যাননি, এটা যদিও তাঁদের ব্যাখ্যাগত দৃষ্টিকোণ। তবে শ্রীকণ্ঠের দর্শনকে অদ্বৈত এর সাথে মীমাংসা করলেও, শৈব দর্শন আর স্মার্ত দর্শনের মধ্যে পার্থক্য ছিল, আছে এবং থাকবে। নীচে শ্রীকণ্ঠ এবং নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী এর কিছু মতাদর্শ উপস্থাপন করা হল আলোক চিত্রের মাধ্যমে -


(যদিও জীব ও ব্রহ্ম এর মধ্যে ভেদ ISSGT স্বীকার করে না, কারণ ISSGT অদ্বৈত শৈব দর্শনের উপর বিশ্বাসী)

এবার দেখে নেবো যে শৈব বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শন মতে শক্তি এবং মায়ার স্বরূপ কি ?

আচার্য্য শ্রীকণ্ঠ (নীলকণ্ঠ) তার ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে শক্তি প্রসঙ্গে বলছেন -

" শক্তিঃ প্রথমসংভূতা শান্ত্যতীতপদোত্তরা |
ততো মায়া ততো অব্যক্তং শিবাৎ শক্তিমতঃ প্রভোঃ ||
ইত্যাদিনা মায়াদি প্রপঞ্চে শক্তিমতঃ শিবস্যৈবোপাদানত্বমবগম্যতে |
শক্ত্যাদি চ পৃথিব্যন্তং শিবতত্ত্বসমুদ্ভবম্ |
তেনৈকেন তু তদ্‌ ব্যাপ্তং মৃদা মৃদাকুম্ভাদিকং যথা
শিবস্যৈবোপাদানত্বমবগম্যতে |
শক্ত্যাদি চ পৃথিব্যন্তং শিবতত্ত্বসমুদ্ভবম্ |
তেনৈকেন তু তদ্‌ ব্যাপ্তং মৃদা মৃদাকুম্ভাদিকং যথা
ইত্যাদিনা তত্রৈব শিবেনোপাদানভূতেন জগদ্ব্যাপ্তম্ মৃদ্ধটাদিন্যায়েনা অবগম্যতে | "
(ব্রহ্মসূত্র / নীলকণ্ঠভাষ্য /২/২ /৩৮)

জগৎগুরু নীলকণ্ঠ শিবাচার্য বলছেন --  অব্যক্ত পরমশিব এর সিসৃক্ষা হেতু সর্বপ্রথম প্রকটিত (হৃদয় থেকে) হন শক্তি (অর্থাৎ পরাশক্তি)(ইহাই আগমে মহাবিন্দু বা পরাবিন্দু বা পরকুণ্ডলিনী পদ বাচ্য)। (প্রাচীন শৈবাচার্য শ্রীমায়িদেবের 'অনুভবসূত্র' মতে ইহাই আবার শান্ত্যতীত্তোরা পদ বাচ্য।)  এরপর এই  শক্তি/পরাশক্তি থেকে শান্ত্যতীত কলা  প্রকটিত হয়। এরপর ধীরে ধীরে সেখান হতে মায়া, (সাথে মায়ার পঞ্চ আবরণ/ কঞ্চুক),  অব্যক্ত প্রকৃতি ইত্যাদি বাকি তত্ত্ব গুলি সহ পুরো জগৎ প্রপঞ্চ প্রকটিত হয়।  সুতরাং পরশক্তি  থেকে পৃথিবী তত্ত্ব পর্যন্ত সব কিছু প্রকৃত পক্ষে সেই পরমশিবই (পরমশিবের বিশ্বময় অবস্থা)।  মাটির কোনো পাত্রে যেমন মাটি ব্যাপ্ত থাকে , তেমনি জগৎ চরাচরে উপাদান রূপে, শক্তিরূপে (মহাবিন্দু বা পরবিন্দুরূপে) সেই ব্রহ্ম পরশিবই ব্যাপ্ত রয়েছেন।

এই সম্পর্কে শৈব আচার্য্য মুডিগোণ্ডা নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী তাঁর ব্রহ্মসূত্র নীলকণ্ঠভাষ্য টীকায় বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন । তিনি বলছেন --

" সূক্ষ্মচিদ্রুপাপন্নচিচ্ছক্তিবিশিষ্ট সকলতত্ত্বাতীত শিব এক এব ... সিসৃক্ষো স্তস্মাৎপ্রথমং শিবতত্ত্ব-পরবিন্দু-পরমায়া-শুদ্ধমায়া-মহামায়া-কুটিলা-কুণ্ডলিন্যা শব্দালম্বনত্বন প্রসিদ্ধাশুদ্ধাধ্বগত সকলভুবনভোগস্যানভোগোপকরণানাং উপাদানভূতা পরাশক্তিরুৎপত্তে। তত শক্তি সদাশিবো মহেশ্বর শুদ্ধবিদ্যেতি ... তদনন্তর অপরামায়া মিশ্রাধ্বগত সকলতনুভুবনাদ্দুপাদানভূতা জায়তে। ততঃ কালো, নিয়তিঃ, কলা, বিদ্যা, রাগঃ পুরুষ ইতি‌ ষট্-তত্ত্বানি‌জায়ন্তে। তদনন্তরং অশুদ্ধাধ্বগত তনুভুবনাদ্দুপাদানভূতং অব্যক্তং আবির্ভবতি।...এবমেতানি পরশক্ত্যয়াদীনি পৃথিব্যন্তানি জড়ানি ষট্-ত্রিংশতত্ত্বানি শিবশাস্ত্রেষু প্রসিদ্ধানি।.... নিবৃত্তিঃ--- প্রতিষ্ঠা--- বিদ্যা--- শান্তি---- শান্ত্যতীতেতি সংজ্ঞাভিঃ প্রসিদ্ধাঃ ... পঞ্চকলা পরশক্তিপ্রভবাঃ। তত্র শতকোটিযোজনমিতব্রহ্মাণ্ডরূপং পৃথিবীতত্ত্বং নিবৃত্তিকলায়ামবতিষ্ঠতে। জলাদ্য-অব্যক্তানি ত্রয়োবিংশতিস্তত্ত্বানি প্রতিষ্ঠায়াং। পুরুষাদীনি মায়ান্তানি সপ্ততত্ত্বানি বিদ্যায়াম্। শুদ্ধবিদ্যামহেশ্বরশ্চ শান্তিকলায়াম্। পরশক্তিস্তু তত্ত্বান্তরাণান্ত... পঞ্চপিকলা ... তত উপর্যুপরিস্থিতা শান্ত্যতীত পদোত্তরা ভবতি....শক্তিশব্দেন শিবতত্ত্বরূপা পরাশক্তিরুচ্যতে। "
(ব্রহ্মসূত্র/ শিবচিন্তামণিপ্রভা টীকা/২/২/৩৮, নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী)

 উপরিউক্ত বিষয়ের আরো বিস্তৃত ব্যাখ্যা পরম শৈব পণ্ডিত অপ্পয় দীক্ষিত এবং বিদগ্ধ শৈব বৈদান্তিক পণ্ডিত শিবযোগী মুডিগোণ্ডা নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী তাঁদের ব্রহ্মসূত্র শ্রীকণ্ঠভাষ্য টীকায় করেছেন। তাঁরা লিখছেন   ---

ব্রহ্ম পরশিব হলেন তত্ত্বাতীত এবং সূক্ষ্ম পরাচিৎশক্তি বিশিষ্ট। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর মধ্যে যখন সৃষ্টির ইচ্ছা জন্মায় তখন তাঁর থেকে প্রথমে শিবতত্ত্ব (অনাশ্রিত শিব) প্রকটিত হয়। 

(অপ্পয়‌ দীক্ষিত এবং নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী এই শিবতত্ত্বকেই পরবিন্দু বা পরামায়া বা শুদ্ধ মায়া বা কুণ্ডলিনী বা মহামায়া বা পরাশক্তি হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই পরাশক্তিই পরমশিবের প্রথম স্পন্দন স্বরূপিণী, তাই নাগলিঙ্গা শাস্ত্রী ও অপ্পয় দীক্ষিত উভয়ই এই পরাশক্তি-কে প্রথমতত্ত্ব শিবতত্ত্বের সাথে অভেদ হিসেবে মেনেছেন তাঁদের টীকায়। এই পরাশক্তি প্রকৃতপক্ষে অনাশ্রিত শিবতত্ত্বই।)

এই পরাশক্তি বা শিবতত্ত্ব থেকে এরপর দ্বিতীয় তত্ত্ব শক্তিতত্ত্ব আসে।  এর পর ধীরে ধীরে সেই শক্তি তত্ত্ব থেকে বাকি তত্ত্ব গুলি নিম্নোক্ত ক্রমে প্রকটিত হয় ---- যথা  সদাশিব তত্ত্ব (সাদাখ্য তত্ত্ব)--- মহেশ্বর------ শুদ্ধ বিদ্যা----- অপরা মায়া/মায়া ----- কাল, নিয়তি, কলা, বিদ্যা, রাগ (মায়ার পঞ্চ আবরণ বা কঞ্চুক) ----- অব্যক্ত প্রকৃতি এবং পুরুষ ---- তিনটি অন্তঃকর্ণ (মন, বুদ্ধি, অহংকার) ---- পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রীয় ----- পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় --- পঞ্চ তন্মমাত্র ---- পঞ্চ ভূত (পৃথিবী তত্ত্ব পর্যন্ত) = ৩৬ তত্ত্ব।

অপ্পয় দীক্ষিত এবং নাগালিঙ্গা শিবারাধ্যের মান্যতা অনুযায়ী -

নিবৃত্তি কলা - পৃথিবী তত্ত্ব
প্রতিষ্ঠা কলা - জল থেকে অব্যক্ত প্রকৃতি তত্ত্ব
বিদ্যা কলা - পুরুষ থেকে মায়া তত্ত্ব
শান্তি কলা- শুদ্ধ বিদ্যা থেকে মহেশ্বর
শান্ত্যতীত কলা - সদাশিব তত্ত্ব (সাদাখ্য), শক্তিতত্ত্ব
শান্ত্যতীত্তোরা কলা - শিবতত্ত্ব অথবা পরাশক্তি তত্ত্ব (সিসৃক্ষা)  আর পরমশিব হল সাক্ষাৎ কলাতীত।

🔘 শুধু আচার্যদের সিদ্ধান্তে নয় এই প্রমাণের মান্যতা সাক্ষাৎ শ্রুতিসার শিবমহাপুরাণ হতেও সিদ্ধ করা যায় -

" শক্তিঃ প্রথমসংভূতা শান্ত্যতীতপদোত্তরা |
ততো মায়া ততো অব্যক্তং শিবাৎ শক্তিমতঃ প্রভোঃ || ৩ ||
শান্ত্যতীতপদং শক্তেস্ততঃ শান্তিপদং ক্রমাৎ |
ততো বিদ্যাপদং তস্মাৎপ্রতিষ্ঠাপদসম্ভবঃ || ৪ ||
নিবৃত্তিপদমুৎপন্নং প্রতিষ্ঠাপদতঃ ক্রমাৎ |
এবমুক্তা সমাসেন সৃষ্টিরীশ্বরচোদিতা || ৫ || "

(শিবমহাপুরাণ/ বাযবীয় সংহিতা/ পূর্বখণ্ড/ ৯ নং অধ্যায়)

👉অর্থাৎ পরমশিবের শান্ত্যতীতোত্তরা ইচ্ছাশক্তিই ক্রমশ শান্ত্যতীত কলা, তারপর শান্তিকলা, বিদ্যাকলা, এরপর প্রতিষ্ঠাকলা এবং শেষে নিবৃত্তিকলা - এই পঞ্চকলা স্বরূপে ভাসিত হন। এই ভাবেই ৩৬ তত্ত্বাত্বক বিশ্বপ্রপঞ্চের সৃজন ঘটে।

এই ভাবেই ব্রহ্ম পরমশিবের জগতের নিমিত্ত ও উপাদান উভয় কারণত্ব প্রতিপাদিত হয়েছে শাস্ত্রে।


সুতরাং শৈব বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শনেও  শক্তি তত্ত্বকে মায়া তত্ত্বের উর্ধ্বে রাখা হয়েছে, ইহাও শঙ্কর অদ্বৈত বেদান্তের মতের বিরুদ্ধ।



♦️ ১৬ শতকের একজন অদ্বৈত বৈদান্তিক  পণ্ডিত ছিলেন শ্রীমৎ অপ্পয় দীক্ষিত, তাঁর পিতাও ছিলেন একজন অদ্বৈত বৈদান্তিক। সেই জন্যই অদ্বৈত বেদান্তের উপরে তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ। এরসাথে বৈদান্তিক শৈব দর্শনগুলির মধ্যে অন্যতম  শ্রীকণ্ঠ - শিবাদ্বৈত (শৈব বিশিষ্টাদ্বৈত) মতের প্রতিও  তাঁর টান ছিল। উভয় দর্শন যে পারমার্থিক দিক দিয়ে একই অদ্বৈত ব্রহ্ম শিবকেই উদ্ভাসিত করে, তিনি সেটা বুঝেছিলেন। তাই classical অদ্বৈত বেদান্তের বা সাংখ্যের ২৫ বা ২৪ তত্ত্বের উর্ধ্বে তিনি ৩৬ তত্ত্বের ধারণাকে, ষট্-কলার ধারণাকে তাঁর ব্রহ্মসূত্র টীকায় তিনি বিশেষ স্থান দেন। শৈব সিদ্ধান্ত আগম এর শ্রুতি সামঞ্জস্যতা প্রমাণে তিনি শ্রীকণ্ঠের ব্যাখ্যাকে বিশদ ভাবে উপস্থাপন করেন। প্রাচীন অ-শৈব আচার্যগণ কর্তৃক ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে পাশুপত শৈব মতের উপরে উত্থিত আপত্তির সঠিক মীমাংসা করেন। হরি-হর তত্ত্বকে পারমার্থিক দৃষ্টিকোণে অভেদ প্রমাণ করেন এবং সকলের অভ্যন্তরে যে এক শিবই ব্রহ্মরূপে বিদ্যমান তা অকপটে স্বীকার করেন, যার প্রমাণ শৈব দর্শনের ৩৬ তত্ত্ব। ৩৬ তত্ত্ব ভিত্তিক শৈব দর্শন অনুযায়ী ব্যবহারিক পর্যায়ে, হরি, হর এনারা সকল প্রমাতা কিন্তু শিব হলেন অকল প্রমাতা। একজন অদ্বৈত বৈদান্তিক যে শিব ভক্ত থেকে শৈবও হয়ে উঠতে পারেন , তাঁর নিদর্শন পণ্ডিত অপ্পয় দীক্ষিত। তিনি অদ্বৈত বেদান্ত, শিবাদ্বৈত, ব্যাকরণ সব কিছুর উপরেই অসংখ্য কাজ করে গিয়েছেন।

এখন এই অপ্পয় দীক্ষিতকে ঢাল বানিয়ে আজ একদল পূর্ব বঙ্গীয় তথাকথিত শৈব-স্মার্তের hybrid কিছু জীব নিজেদের অপ্পয় দীক্ষিত ভেবে নিয়ে দাবী করছেন যে, অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন এবং শ্রীকণ্ঠ শিবাদ্বৈত দর্শন নাকি পরস্পর বিরোধী নয়। যদি সেটাই হয়, তাহলে তাদের অনুরোধ রইল যে তারা তাদের ব্রহ্মসূত্র, বেদান্ত ভাষ্য থেকে ৩৬ তত্ত্বের ধারণা পারলে দেখাক ? ব্রহ্মসূত্র অদ্বৈত ভাষ্যে শৈব আগমকে শ্রুতি বিরোধী তকমা দেওয়া হয়েছে, আগমোক্ত পুরো মাহেশ্বর সম্প্রদায় অর্থাৎ শৈব উপাসকদের অলীক মতালম্বী বলে দাবী করা হয়েছে। এর মীমাংসা শ্রীপতি পণ্ডিত এবং অপ্পয় দীক্ষিতের আগে কোনো স্মার্ত আচার্য কেন তাদের ব্রহ্ম সূত্র ভাষ্য বা টীকাতে করে যাননি ? এই প্রশ্নের উত্তর আছে তাদের কাছে ? যে শৈব আগম গুলিকে প্রাচীন বৈদিক ঋষিরাও সমর্থন করে গেছেন, একাধিক পুরাণ শাস্ত্র যাদের সমর্থন করে গেছে, যা সাক্ষাৎ সদাশিব বাক্য , সেই আগম শাস্ত্র গুলিকে যারা শূলবিদ্ধ করে থাকে, সেই আগম মতে শিবের পুজো পর্যন্ত যারা করতে নাক সিটকোয়, তাদের সাথে শৈবদের মিল কদাপি সম্ভব নয়।

শ্রীবিদ্যারণ্য মুনি যদিও শৈব আগম শাস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করে গিয়েছেন, তাঁর 'জৈমিনীয় ন্যায়মালা'তে, কিন্তু তার থেকে এটার প্রচার স্মার্ত মহলে বেশি যে, শৈব আগম শাস্ত্র মাত্রই শ্রুতি বিরোধী। যদিও এনারা আবার তন্ত্র মতে শ্রী বিদ্যা উপাসনা করে থাকেন, সেই ক্রমে দীক্ষাও দিয়ে থাকেন এমন কি শ্রীবিদ্যার্ণব তন্ত্র স্মার্ত পরম্পরা থেকেই উদ্ভূত (রচনাকার- শ্রীবিদ্যারণ্য মুনি) কিন্তু এনারা ভুলেই গিয়েছে যে এই শ্রীবিদ্যা ক্রম কাশ্মীর শৈবদের বামাকেশ্বর মত থেকে উদ্ভূত, ত্রিক শৈব ধারা থেকেই এই ত্রিপুর সিদ্ধান্ত এর উৎপত্তি। বিশ্বাস না হলে - প্রাচীন কাশ্মীর ক্রম এর তন্ত্র নিত্যষোড়শীকার্ণব যোগিনী হৃদয় এবং কামকলাবিলাস প্রমুখ তন্ত্র পড়ে দেখুন, টীকাকাররা  ত্রিক শৈব শাস্ত্র ও শৈব আগম থেকেই সেই সব তন্ত্রের উপরে টীকা করে গিয়েছেন। শৈবদের থেকেই এই সাধনা ক্রম শাক্ত এবং স্মার্ত পরম্পরায় যায়। এরা শ্রীবিদ্যা সংক্রান্ত তন্ত্র মানবে, সেই অনুযায়ী উপাসনাও করবে, শ্রী যন্ত্রও অঙ্কন করবে,  কিন্তু শিবের বেলায় শৈব তন্ত্র , শৈব আচার অমান্য। নমো নমো করে, আর বিষ্ণু স্মরণ, কৃষ্ণ স্মরণ করে আচমন, শুদ্ধি আর সংকল্প করে, অষ্টগন্ধা আর সিঁদুর মেখে ত্রিপুণ্ড্র কেটে, বেল পাতায় রামনাম লিখে, শিবকে বিষ্ণু ভক্ত বানিয়ে - ব্যাস শিব অর্চনা শেষ, যে নিয়ম নীতি গুলো শৈবশাস্ত্র বিরুদ্ধ, এমনকি শ্রুতি বিরুদ্ধও বটে। শিব বাক্য বিরুদ্ধ তাদের এই সব রীতিনীতি যেগুলো আগম শাস্ত্রে তো দূর, শিব মহাপুরাণে বা শৈব উপনিষদে পর্যন্ত পাবেন না কেউ আপনারা। দুই দিন পর এটা না হয় যে, বিষ্ণু বা কৃষ্ণের বীজে এরা শিবের পূজা করছে। শিবের যন্ত্র পূজন, আবরণ অর্চন, বৃষভ ধ্বজ পূজন,  ভস্ম ত্রিপুণ্ড্র ধারণডমরু পূজন, পঞ্চাক্ষরী ন্যাস, ৩৮ কলা ন্যাস, গর্ভন্যাস, রত্ন ন্যাস, মাতৃকা ন্যাসমূর্তি মন্ত্র ন্যাস এসবের আর বালাই নেই। এনারা শ্রীবিদ্যার উপাসনা করবেন, শাক্ত আগম এবং বেদাচার মেনে শিব মন্দিরে শ্রীচক্রের স্থাপনা করবেন, সে করুক ভালো কথা, কিন্তু আগম মতে শিবের সম্মেলন চক্রের স্থাপন করার সময়, শৈবাগমোক্ত আচার অনুসরণ করে শিব উপাসনার সময়, শিবযন্ত্র প্রতিষ্ঠার সময়, এনাদের গাত্র জ্বালা করে কেন সেটা বোঝা দায়।  আজকে বেশির ভাগ জ্যোতির্লিঙ্গ গুলিও এনাদের আগ্রাসনে একদম শেষ, অনাচারে ভরা, শিববাক্য যেখানে উপেক্ষিত কিন্তু অন্যদের বাক্য সমাদৃত। আপনি নিশ্চই লৌহকার এর কাছে গিয়ে স্বর্ণ সংক্রান্ত কাজ করাবেন না, তেমনই শিব উপাসনার বিধি আমরা নিশ্চই বৈষ্ণব শাস্ত্র বা স্মার্ত মতে করতে যাবো না, শিব বাক্য, শৈব আচার্যদের বাক্য মেনেই করবো। আগমের শাক্ত ধারা মানবো কিন্তু শৈব আগম মানবো না, স্মার্তবাদীদের এই দাবী অর্ধজড়তীয়তা দোষ যুক্ত।


♦️আদিশঙ্করাচার্যের কেবলাদ্বৈত দর্শন মতে শৈব পরম্পরা এবং শৈব আগমগুলি অমান্য কেননা সেগুলি শ্রুতি বিরুদ্ধ এবং অন্যোন্যাশ্রয় দোষযুক্ত, নীচের আলোক চিত্রে তার স্পষ্ট প্রমাণ দেখানো হল ---




শৈব আগম শাস্ত্রের উপরে আরোপিত উপরিউক্ত দাবী গুলির সঠিক মীমাংসা চাইলে আদি শঙ্করাচার্য্য করতেই পারতেন‌, কিন্তু তিনি সেটা করেননি। যে আগম শাস্ত্র গুলি সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিবের বাক্য, যেগুলিকে সাক্ষাৎ পুরাণ শাস্ত্র, একাধিক ঋষি মুনিরা  সম্পূর্ণ বেদ সম্মত/শ্রৌত আখ্যায় আখ্যায়িত করে গিয়েছেন, যে আগম শাস্ত্র গুলি শ্রুতির/বেদের ন্যায় নিজস্ব এক একটি আচার্য্য পরম্পরা অনুযায়ী ক্রম প্রবাহমান হিসেবে চলে আসছে সাক্ষাৎ পরমেশ্বর দক্ষিণামূর্তি শিব থেকে (যেমন - মহর্ষি রুরু থেকে রৌরবাগম পরম্পরা, স্বায়ম্ভুবাগম পরম্পরা ইত্যাদি), যে আগম শাস্ত্র গুলির পরম্পরা আদি শঙ্কর আচার্যের জন্মের বহু আগে থেকে চলে আসছে,  যে আগম শাস্ত্র গুলির মান্যতা জগৎগুরু রেণুকাচার্য থেকে আরম্ভ করে, নন্দিমহারাজ, আচার্য্য সদ্যোজ্যোতি (6th century), আচার্য্য রুরু (before 5th century), আচার্য্য উগ্রজ্যোতি, নায়নার তিরুমুলার (before 2nd century, চারযুগেই অমর), ঋষি শ্বেত (সত্য যুগ), ঋষি উপমন্যু (দ্বাপর যুগ), জগৎগুরু নীলকণ্ঠ শিবাচার্য (3200BC as per Srikantha Vijayan), ভট্ট রামকণ্ঠ, ভট্ট বিদ্যাকণ্ঠ, ভট্ট নারায়ণ কণ্ঠ, ভট্ট ভাস্কর, শিবাগ্রযোগী (16th century) অকপটে স্বীকার করে গিয়েছেন, সেই মহামূল্যবান রত্নস্বরূপ আগমকে যিনি যা যারা কোনো মীমাংসা ছাড়াই কলঙ্কিত করে গিয়েছেন তিনি বা তারা বা তাদের প্রতিষ্ঠিত দর্শন  কিভাবেই বা শৈব মতের পরিপন্থী হতে পারে ? এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। বুদ্ধিমানেরা ভেবে দেখবেন - আদৌ কি তাহলে শৈব পরম্পরার সাথে স্মার্ত পরম্পরার বিরোধ নেই ?

আগম শাস্ত্রকে অপমান অর্থাৎ শিব বাক্যকে অপমান অর্থাৎ সাক্ষাৎ শিবকে অপমান এবং শৈব পরম্পরাকে অপমান অর্থাৎ প্রাচীন শৈবাচার্যদের অপমান অর্থাৎ শিবজ্ঞানীদের অপমান অর্থাৎ শিবকেই অপমান, অর্থাৎ শিব অবতার আদিশঙ্কর আচার্যকেই অপমান। কিন্তু আদি শঙ্কর আচার্য কেনোই বা নিজেকে বা নিজের বাক্যকে অপমান করতে যাবেন কোনো মীমাংসা ছাড়াই। এখানেই চক্রাশ্রয় দোষের সৃজন হয়। তাই তো শঙ্কর পূর্ববর্তী বা শঙ্কর পরবর্তী কোনো শৈব আচার্যই তাঁকে শিব অবতার বলে স্বীকার করেননি কোনো স্থানে। পুরাণের বিশেষ বিশেষ অংশকে যে পরিবর্তন করা হয়েছে, তার প্রমাণ এর থেকেই মেলে আর শৈবদের কাছে তাঁর আচার্য এর বাক্যই শিববাক্য


🔘💥 কি শৈব বন্ধুগণ এবার বুঝতে পারলেন তো আপনারা যে কেন পুরো শৈবসমাজ শঙ্করপন্থীদেরকে কোনো পাত্তা দেয় না এবং শঙ্কর মতকে 'শৈবমত বিরোধী' তকমা দেয় ?   কি কারণে ভারতবর্ষের পুরো শৈব সমাজ, শৈব আচার্যগণ আদি শঙ্করাচার্যকে জগৎগুরু বা শিব অবতার মানেন না ? আশাকরি কারণ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে সবার কাছে।

[আমাদের কথা বিশ্বাস না হলে কাশী জঙ্গমবাড়ি মঠ, দক্ষিণ ভারতের শ্রীশৈলম অথবা রম্ভাপুরী মঠ, তামিলনাড়ুর ধর্মপুর আদিনাম মঠ অথবা মাদুরাই আদিনাম মঠ প্রভৃতি শৈব মঠ গুলিতে গিয়ে আপনারা নিজেদের শঙ্কা দূর করে নিতে পারেন। আমাদের দাবী মিথ্যা প্রমাণিত করতে পারলে, এই পোস্ট delete করে অনলাইনে এসে ক্ষমা চেয়ে নেবো, কথা দিলাম।]

এতদিন ধরে যে মা আপনাকে লালন পালন করলো, যে মায়ের আদেশে আপনার জীবনের নিয়মানুবর্তীতা পরিচালিত হত, হঠাৎ একদিন নব্য উত্থিত কোনো ব্যক্তি এসে যদি আপনার কাছে সেই মায়েরই সম্মানহানি করার চেষ্টা করে, সেই ব্যক্তিকে কি আপনি মেনে নিতে পারবেন ? সে আপনার হিতৈষী ? কক্ষনো নয়। আশাকরি বুদ্ধিমান যারা আছেন তাঁরা ব্যাপারখানি বুঝতে পারবেন। সুতরাং শঙ্করমত যে শৈব মতের অনুকূল নয় সেটা স্পষ্ট ভাবেই প্রমাণিত হয়ে গেল।

 
👉  শ্রীকণ্ঠ শিবাচার্য্য যদিও বহু পূর্বেই তাঁর ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে শৈব আগম ও শৈব সম্প্রদায়ের উপর আরোপিত শ্রুতি বিরোধীতা সহ অন্যান্য সকল আপত্তির নিরসন করে গিয়েছেন ---



👉 দ্বাদশ শতকে আবির্ভূত বিখ্যাত শৈব পণ্ডিত শ্রীপতি পণ্ডিতারাধ্যও তাঁর ব্রহ্মসূত্র শ্রীকর ভাষ্যে শৈব আগমের উপর এবং শৈব সম্প্রদায়ের আরোপিত সমস্ত প্রকার দোষকে শাস্ত্রসম্মত ভাবে খণ্ডন করেন এবং আগম শাস্ত্রের মান্যতা স্থাপনের পাশাপাশি শ্রুতি সামঞ্জস্যতাও প্রতিপাদন করেন। সাথে অশ্রৌত শৈবদের সাথে শ্রৌত শৈব মতের পার্থক্য নিরূপণ করে ব্যাস সূত্রের পত্যাধিকরণের সঠিক মীমাংসা করেন। নীচের আলোক চিত্র গুলিতে তাঁর প্রমাণ দেখানো হল --- 






এরপর ষোড়শ শতকে দক্ষিণ ভারতে স্মার্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে আবির্ভূত অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের বিদগ্ধ কিন্তু সাথে শৈব মতাদর্শে অনুপ্রাণিত বিশিষ্ট পণ্ডিত, শিবগণ/ ত্রিশূল এর অবতার শ্রী অপ্পয় দীক্ষিত পুরো অদ্বৈত  দৃষ্টিকোণে কিন্তু মূলে শৈব মতকে অক্ষুন্ন রেখে শ্রীকণ্ঠের শৈব-বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শনকে বিশ্লেষণ করার সংকল্প নেন। পরমেশ্বর শিবের আশীর্বাদে তিনি রচনা করেন ব্রহ্মসূত্র শ্রীকণ্ঠ ভাষ্যের উপরে কালজয়ী এবং বিস্তারিত এক টীকা, নাম দেন তিনি সেটির - 'শ্রীশিবাকর্মণিদীপিকা' , যেখানে তিনি নিজে শৈব আগমের শ্রুতি সামঞ্জস্যতা, শৈব আগমের শ্রেষ্ঠত্ব, শৈব দর্শনের ৩৬ তত্ত্ব, নিবৃত্তি, বিদ্যা আদি ষট্-কলার ধারণাকে  আরো বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং প্রতিষ্ঠিত করেন।  নীচের আলোক চিত্রগুলিতে তারই কিছু নমুনার প্রদর্শন করা হল - 




i. শুধু তাই নয়, অদ্বৈত বৈদান্তিক পণ্ডিত অপ্পয় দীক্ষিত শৈব ভাবাদর্শে এতটাই অনুপ্রাণিত ছিলেন যে নিগম-আগম ভিত্তিক কর্মকাণ্ডের উপর ভিত্তি করে তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত বই 'শিবার্চনচন্দ্রিকা', যা শৈব মহলে আজও সমাদৃত।  

ii. মানসিক ভাবে শিব উপাসনার উপর তিনি রচনা করেন 'শিব ধ্যান পদ্ধতি'। 

iii. জ্ঞানমার্গে অগ্রসর শৈব সাধকদের জন্য তিনি রচনা করেন - 'শিখরিণীমালা' ও তার উপর ' শিবতত্ত্ববিবেক' এবং 'শিবাদ্বৈতনির্ণয়' যেখানে তিনি শ্রীকণ্ঠ শিবাদ্বৈত মতকে অদ্বৈত শৈব দৃষ্টিকোণে অত্যন্ত তাত্ত্বিক ভাবে উপস্থাপন করেন। একদম ব্যবহারিক স্থূল পর্যায়ে দ্বৈত, তারপর বিশিষ্টাদ্বৈত_শিবাদ্বৈত এবং শেষে অদ্বৈত_শিবাদ্বৈত। ইহাই অপ্পয় দীক্ষিতের মূল সিদ্ধান্ত। এর জন্য তিনি আলাদা করে একটি বিশেষ গ্রন্থ রচনাও করেন, নাম - 'আনন্দলহরী' এবং উহার উপরে 'চন্দ্রিকা' টীকা রচনা করেন।

iv. পুরো রামায়ণ এবং মহাভারতে সাক্ষাৎ শিবই যে পরমব্রহ্ম পরমেশ্বর হিসেবে প্রতিপদিত হয়েছেন এবং ভগবদ্গীতাতেও যে  সেই এক পরমেশ্বর শিবই বাচিত হয়েছেন, সেই মত প্রতিষ্ঠার্থে তিনি 'রামায়ণ তাৎপর্য্য দীপিকা' এবং 'ভারত তাৎপর্য্য দীপিকা' রচনা করেন।

v. মধ্বাচার্যের শিববিদ্বেষী ভণ্ডমতকে পুরো খণ্ডন করেন‌ তিনি তাঁর 'মধ্বতন্ত্রমুখ মর্দনম্' নামক গ্রন্থে।

vi. পরশিব, শক্তি, নারায়ণ,  বিষ্ণু/হরি, রুদ্র/হর এই তত্ত্ব গুলোর উপরে ব্যবহারিক এবং পারমার্থিক উভয় দৃষ্টিকোণগত তুলনামূলক আলোচনা করেন তাঁর 'রত্নত্রয় প্রকাশ' গ্রন্থে। পারমার্থিক দৃষ্টিতে সব কিছুই যে সেই এক ব্রহ্ম পরশিব এটাই তাঁর অদ্বৈত সিদ্ধান্ত।

সুতরাং ভাবুন, ভাবার চেষ্টা করুন যে, একজন অদ্বৈত বৈদান্তিক সিদ্ধান্তবাদী হওয়া সত্ত্বেও কেন শৈব সমাজে পণ্ডিত অপ্পয় দীক্ষিতের গুরুত্ব এতটা বেশি ? যিনি শৈব মতাদর্শে বিশ্বাসী, শিবাদ্বৈত দর্শনে বিশ্বাসী, শৈব আগম শাস্ত্রে আস্থাবান, শিবপরমত্ব বাদে বিশ্বাসী, নিগম-আগমোক্ত শৈব আচারে বিশ্বাসী এবং সর্বোপরি একজন শিব-গণাবতার, তাকে যদি একজন শৈব হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়া যায়, তাহলে সেই স্বীকৃতি নিশ্চয় আপনি তাদের দিতে যাবেন না যারা শৈব আগম শাস্ত্রকে শূলে বিদ্ধ করে, শিবকে পরম বৈষ্ণব এবং সর্বদা নারায়ণ এর ধ্যানরত হিসেবে দাবী করে, শৈব পরম্পরাকে অবৈদিক বলে কটাক্ষ করে, শ্রীবিষ্ণুকে প্রীতির উদ্দ্যেশে শিব পূজার বিধান দিয়ে শিবকে পরোক্ষভাবে বৈষ্ণব প্রমাণ করার চেষ্টা করে, শিব স্মরণ ছেড়ে শিব পূজায় শ্রী বিষ্ণুকে স্মরণ করে,  কেশবকে স্মরণ করে আচমন করে, সংকল্প করে, শুচি করে, যেগুলি সর্বথা অশাস্ত্রীয় এবং শৈব পুরাণ শাস্ত্র, শৈব উপনিষদ, আগম শাস্ত্র বিরুদ্ধ। বুদ্ধিমানেরা নিজেরাই বিচার করুন। 

♦️যদিও পাশুপত শৈব এবং শৈব আগমের উপর যাবতীয় আপত্তির নিরসন বহু আগেই ISSGT করে রেখেছে, দুইটি পর্বে। নীচের লিঙ্ক দুটোয় গিয়ে পড়ুন -  





শঙ্কা ১ - ISSGT তো অদ্বৈত শৈব দর্শনবাদী ? তাহলে তাদের সাথে শঙ্করপন্থীদের/স্মার্ত ভেদাভেদ এর কোনো মানে আছে কি ?

শঙ্কা নিবারণ - 
তেল ও জল উভয়েই তরল। কিন্তু তবুও উভয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। ঠিক তেমনই অদ্বৈত শৈব দর্শন এবং আদিশঙ্কর অদ্বৈত দর্শন  এর মধ্যে পার্থক্য অবশ্যই আছে, থাকবে। উপরে যা সম্পর্কে ইতিমধ্যে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া শাস্ত্র, আচার, তত্ত্বজ্ঞান, আচার্য্য মান্যতা - সব কিছুর দিক থেকেই উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। আর নিজেদের দর্শন ছেড়ে ISSGT যদি অপর কোনো অশৈব দর্শনের পরিপোষকতা করে, তাহলে সেটা শৈব গুরুদের অপমান বলে আমরা মনে করি। 

শঙ্কা ২ - শঙ্করমত কি শৈবমত বিরোধী ?

শঙ্কা নিবারণ - 
কোনো মত অপর কোনো মতের বিরোধী কিনা সেটা বিচার হয় চারটি মানদণ্ড এর উপর - দর্শনগত, আচারগত, শাস্ত্রগত এবং আচার্য্য পরম্পরার মান্যতাগত।

👉দর্শনগত ভেদ সম্পর্কে উপরে ইতিমধ্যে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়ে গিয়েছে ।

👉আচার নিয়ম কানুন এসবের দিক থেকে বিচার করলে, স্মার্তরা মূলত স্মৃতি শাস্ত্র, পুরাণ শাস্ত্র, কল্পশাস্ত্র এবং শ্রুতিশাস্ত্রের উপর নির্ভশীল। কিন্তু আচারগত দিক দিয়ে শৈব পরম্পরা গুলি মূলত আগম শাস্ত্র বা তন্ত্র এবং নিজস্ব গুরুপরম্পরাগত শাস্ত্রের উপর নির্ভরশীল। তাছাড়া শৈবরা শিবমহাপুরাণ, লিঙ্গমহাপুরাণ, শৈব উপনিষদ এসবের উপর নির্ভরশীল। শৈব পরম্পরা গুলিতে স্মৃতি শাস্ত্রের চেয়ে আগম শাস্ত্রের মান্যতা ও প্রচলন বেশি। 

👉শাস্ত্রগত ভেদ অবশ্যই আছে যা উপরেই বর্ণিত হয়েছে।

👉এবার আসা যাক আচার্য্য/গুরু পরম্পরাগত মান্যতার কথায়।  বিভিন্ন শৈব পরম্পরার প্রাচীন যারা শৈব আচার্য্য ছিলেন যেমন - সদ্যোজ্যোতি শিবাচার্য, শিবাগ্রযোগী শিবাচার্য, জগৎগুরু শ্রীকণ্ঠ শিবাচার্য, নীলকণ্ঠ শিবাচার্য IIহরদত্ত শিবাচার্যউমচিগী শঙ্কর শাস্ত্রী, নায়নার তিরুমুলার, ভট্ট রামকণ্ঠ, শ্রীপতি পণ্ডিতারাধ্য, পাম্বান স্বামী, থিরুজ্ঞান সংবন্দর,   অঘোর শিবাচার্য, মিয়াকাণ্ডার, অরুলনন্দী শিবাচার্য, উমাপতি শিবাচার্য, মহামহেশ্বরাচার্য শ্রীঅভিনবগুপ্ত, আচার্য্য ক্ষেমরাজ সহ পরবর্তীকালের যারা শৈব আচার্য যেমন - আচার্য্য স্বামী লক্ষ্মঞ্জু, টি সিদ্ধপারাধ্য শাস্ত্রী, জগন্নাথ শাস্ত্রী তৈলঙ্গ, মুডিগোণ্ডা নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী, সদাশিব শিবাচার্য ইত্যাদি কোনো আচার্যই শঙ্কর মতের সমর্থন করে যাননি। বরং শ্রীপতি পণ্ডিত, নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী, উমচিগী শাস্ত্রী, উমাপতি শিবাচার্য, অঘোর শিবাচার্য, অভিনবগুপ্ত সহ অনেকেই শঙ্কর মতের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ বিরোধীতা করে গিছেন। 

তাই উপরিউক্ত চারটে মানদণ্ড এর ভিত্তি করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, স্মার্ত মত একটি অশৈব মত এবং শৈব মতের বিরোধী মত। এটা ISSGT বা আমাদের কোনো নিজস্ব সিদ্ধান্ত নয়, বরং প্রাচীন শৈবাচার্যদের সিদ্ধান্ত। আর শৈব হয়ে শৈব গুরুদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাওয়া মানে গুরুদ্রোহ করা যা ক্ষমার অযোগ্য একটি পাপ।

শঙ্কা ৩ - স্মার্ত আচারে শিব পূজা শৈবদের ক্ষেত্রে কতটা  মান্য?

শঙ্কা নিবারণ -
স্মার্ত আচারে শিব পূজার ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি বা যে যে মন্ত্র বা ধাপ অনুসরণ করা হয় সেগুলোর মান্যতা কোনো শৈব পুরাণ, শৈব উপনিষদ, শ্রুতিশাস্ত্র এবং আগম শাস্ত্র দেয়না, যেগুলি কোনো শৈব আচার্য্য পরম্পরাতেই অনুসরণ করা হয় না। সুতরাং স্মার্তদের সেই সকল আচার, নিয়ম শৈব মতের সাপেক্ষে শাস্ত্রবিরুদ্ধ এবং অমান্য হিসেবেই পরিগণিত হয়।

শঙ্কা ৪ - শৈবদের কাছে জগৎগুরু কে ?

শঙ্কা নিবারণ -
শৈবদের কাছে সাক্ষাৎ দক্ষিণামূর্তি শিবই জগৎগুরু। গুরু তত্ত্বই সাক্ষাৎ শিব তত্ত্ব এবং শিব তত্ত্বজ্ঞ গুরুই দীক্ষা দানের যোগ্য - এমনটা আগম শাস্ত্রে নির্দেশিত রয়েছে। অন্যদিকে শিব বাক্য শৈব আগমকে যে সম্প্রদায় বা যারা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, সেই সম্প্রদায়ের কোন আচার্যই স্বাভাবিক ভাবে শৈবসমাজের নিকট  জগৎগুরু হিসেবে পরিগণিত হতে পারেন না।  বৈদান্তিক শৈব পরম্পরায় পঞ্চাচার্যদের এবং তাঁদের উত্তরসূরী সিংহাসন পীঠাধীশ্বরদের জগৎগুরু পদে সম্মানিত করা হয়।  








শঙ্কা ৫ - শিব মন্দির গুলোতে স্মার্ত আচার্যদের মূর্তি রাখা, ফটো রাখা, তাদের পূজা করা কতটা মান্য ?

শঙ্কা নিবারণ -
শৈব মতের বিরোধী বা শিব বাক্য আগম শাস্ত্রের বিরোধী কোনো আচার্য এর ছবি বা মূর্তি শিব মন্দিরে রাখা শৈব মত বিরুদ্ধ। একজন বৈষ্ণব বা স্মার্তবাদী ব্যক্তি কখনো কিন্তু নিজ পরম্পরার আচার্যকে ছেড়ে শৈব পরম্পরার কোনো আচার্য যেমন - জগৎগুরু রেণুকাচার্য, মহামহেশ্বরচার্য অভিনব গুপ্ত বা আদিগুরু গোরক্ষ নাথের মূর্তি বা ফটো নিজ গৃহ মন্দিরে রাখবেন না। সেই একই যুক্তি শৈবদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। শৈব সিদ্ধান্তবাদী বিখ্যাত পণ্ডিত আচার্য্য Dr. T. Ganeshan সম্প্রতি দক্ষিণভারতের কিছু শিব মন্দিরে স্মার্ত আচার্যদের মূর্তি প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন এবং আগম বিরোধী ক্রিয়াকলাপ এর তকমা দিয়েছিলেন। সুতরাং শৈব আচার্য্য ও আগম মতে শৈবদের চলা উচিৎ, কাল্পনিক ভাবনায় নয়।

শঙ্কা ৬  - আগম শাস্ত্রকে কি শ্রুতি, স্মৃতি, ব্রহ্মসূত্র, ন্যায় আর মীমাংসা দ্বারা বিচার করা যায় ? এ ব্যাপারে শৈব পরম্পরা কি বলছে ?

শঙ্কা নিবারণ - 
আগম শাস্ত্র সাক্ষাৎ শিব বাক্য - " আগতং শিববক্ত্রেভ্য " এবং শিব থেকে সৃষ্ট গুরু শিষ্য পরম্পরাগত ভাবে ক্রম প্রবাহমান। তাই আগম শাস্ত্র শ্রুতি বাক্য। ভট্ট কুল্লুক তাঁর মনুসংহিতার ভাষ্যে তাই আগম শাস্ত্রকে শ্রুতি আখ্যায় আখ্যায়িত করে গিয়েছেন - " বৈদিকী তান্ত্রিকী চৈব দ্বিবিধা শ্রুতিকীর্তিতা "  । তাছাড়া অঘোর শিবাচার্য একাধিক স্থানে আগমকে শ্রুতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গিয়েছেন। শাস্ত্রে আগম শাস্ত্রকে মহাশ্রুতি বলা হয়েছে। বৈদান্তিক আচার্য্য শ্রীকণ্ঠ, শ্রীপতি পণ্ডিত আগম এবং বেদের অভেদত্ব প্রতিপাদন করে গিয়েছেন, পণ্ডিত অপ্পয় দীক্ষিত, শিবাগ্রযোগী শিবাচার্য এবং মুডিগোণ্ডা নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী শৈব আগমের শ্রেষ্ঠত্ব এবং প্রামাণিকতা স্থাপন করে গিয়েছেন। শিবমহাপুরাণ, সূত সংহিতা, শঙ্কর সংহিতা, স্কন্দ পুরাণ, শিবধর্মোত্তর পুরাণ, কামিকাগম, পৌষ্করাগম প্রভৃতি শাস্ত্রে শৈব আগম শাস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করা হয়েছে।  সুতরাং শৈব সিদ্ধান্ত পরম্পরাগত মত অনুযায়ী আগম হল স্বতঃসিদ্ধ। তাই শিব বাক্য আগমকে শ্রুতি বা ব্রহ্মসূত্র বা কোনো স্মৃতি বা ন্যায়, মীমাংসা দ্বারা বিচার করা যায় না। বরং শৈব সিদ্ধান্ত আচার্য্য পরম্পরার মান্যতা অনুযায়ী, বেদের কোনো অংশ যদি শৈব আগমের বিরোধীতা করে, তখন বেদের সেই অংশ অপ্রমাণ হিসেবে স্বীকৃত হবে, মান্যতা পাবে না। এই মতের সমর্থন ভগবান সদ্যোজ্যোতি শিবাচার্য, শিবাগ্রযোগী শিবাচার্য, অঘোর শিবাচার্য, উমাপতি শিবাচার্য প্রমুখ সিদ্ধান্ত আচার্যগণ করে গিয়েছেন, তাঁদের কথা অনুযায়ীই শৈব সিদ্ধান্ত সমাজ চলবে, কোনো স্মার্ত আচার্যের কথায় নয়।





শঙ্কা ৭- তাহলে সেই যুক্তি তে তো শাক্ত আর বৈষ্ণব আগম গুলিকেও তো প্রামাণিক/ স্বতঃসিদ্ধ বলা যায় ? ওগুলো না মানলে তো শৈবদের উপর অর্ধজড়তীয়তা দোষ আরোপিত হয়। এই প্রসঙ্গে আপনাদের কি বক্তব্য ? 

শঙ্কা নিবারণ -
শাক্ত আগমগুলি যে শিব বাক্য এবং সেগুলি যে প্রমাণ হিসেবে মান্য, তার উল্লেখ প্রাচীন কোনো শাক্ত আচার্য্য করে যাননি। শিব থেকে সৃষ্ট কোনো নির্দিষ্ট আগম পরম্পরা তাদের নেই। পুরাণ শাস্ত্রেও এই সব শাক্ত তন্ত্রের একটির নামও পাওয়া যায় না, যেমনটা শৈব তন্ত্রের নাম পাওয়া যায়। মোহনাত্মক পাঞ্চরাত্র মতকে একাধিক পুরাণ শাস্ত্রেই খণ্ডন করা আছে, যার সমর্থন প্রাচীন শৈব আচার্যরা পর্যন্ত করে গিয়েছেন। এই পাঞ্চরাত্র তন্ত্র গুলির আদৌ কি কোনো গুরু পরম্পরা আছে কিনা সন্দেহ, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ নিজেই শৈব আগম পরম্পরায় পাশুপত দীক্ষা নিয়ে বসে আছেন, যার প্রমাণ একাধিক পুরাণ শাস্ত্র ও মহাভারত। সুতরাং শাক্তবৈষ্ণব আগম গুলিকে শ্রুতি বললে তা ন্যায় সঙ্গত হবে না। কিন্তু শৈব আগম গুলির প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা গুরু পরম্পরা রয়েছে। তাই সেগুলিই একমাত্র শ্রুতি হিসেবে গণ্য।
যেমন -

রৌরবাগম পরম্পরা - পরমেশ্বর ----ব্রহ্মনেশ/অনন্তেশ----নন্দীকেশ্বর--- মহর্ষি রুরু --- বৈদিক ঋষিগণ অঙ্গিরস, অত্রি, ভার্গব --- সদ্যোজ্যোতি শিবাচার্য্য 

কামিকাগম পরম্পরা - পরমেশ্বর--- প্রণবশিব--- ত্রিকাল--- হর

কারণাগম পরম্পরা -  পরমেশ্বর---কারণ---শর্ব --- প্রজাপতি

অজিতাগম পরম্পরা- পরমেশ্বর ----সুশিব----শিব(মতান্তরে উমেশ) ----অচ্যুত

বাতুলাগম পরম্পরা - পরমেশ্বর ----শিব----মহাকাল

ইত্যাদি।


শঙ্কা ৮ - কোন পরম্পরা অধিকতর প্রাচীন শৈব না স্মার্ত ?

শঙ্কা নিবারণ -
অবশ্যই শৈব পরম্পরা। শাস্ত্র মতে শৈব ধর্মকেই সনাতন ধর্ম বলা হয়, এই সনাতন ধর্মের প্রতীক সাক্ষাৎ ধর্ম বৃষভ নন্দী। পরবর্তীকালে এই শৈবদের থেকেই বাকি ঘরানা গুলি এসেছে।
শাস্ত্রে আমরা প্রাচীন বৈদিক পাশুপতদের ১১২+২৮=১৪০ জন বৈদিক আচার্যের নামও পেয়ে থাকি। 
 
শঙ্কা ৯ - শৈব দীক্ষা বা শিব মন্ত্রে দীক্ষা দেওয়ার অধিকার কার রয়েছে ?

শঙ্কা নিবারণ -
শৈব আগম শাস্ত্রে শিব বলছেন -  দীক্ষাগুরু যদি সঠিক শিব তত্ত্বজ্ঞ হন , তবেই তিনি শৈব প্রতীক্ষা প্রদানের যোগ্য, অপর কেউ নন। " দীক্ষকস্তু গুরুশ্রেষ্ঠঃ শিবতত্ত্বস্য পারগঃ | অন্যথা ন গুরুর্ভেয়ো ন দীক্ষা ন চ মুক্তিদা || ২৮ ||"  (নিঃশ্বাসতত্ত্ব সংহিতা -শৈবাগম / নয়সূত্র / প্রথম পটল)  - দীক্ষা প্রদানকারী সেই গুরু তখনই গুরু শ্রেষ্ট হিসেবে বিবেচিত হবেন যখন তিনি শিবতত্ত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অবগত থাকবেন । অন্যথা তিনি গুরু বলে গণ্য হবেন না এবং তাঁর দ্বারা প্রদত্ত দীক্ষা , দীক্ষা হিসেবে গণ্য হবে না এবং তা মোক্ষের পথেও সহায় হবে না।  সুতরাং শৈব দীক্ষা সঠিক শৈব আচার্যের কাছ থেকে সঠিক শৈব আগমোক্ত রীতি মেনে, ষড়াধ্ব শোধন পূর্বক হওয়া উচিত, অশাস্ত্রীয় ভাবে নয়। তাছাড়া সাধকের কাছে যদি সাক্ষাৎ শিবের আদেশ থাকে, সাধক যদি সাক্ষাৎ শিব সিদ্ধ হন, তবেই তিনি নিজ শক্তির দ্বারা শিষ্যের ষড়াধ্ব শোধন ও শক্তিপাত ঘটিয়ে শৈব দীক্ষা প্রদান করতে পারেন।

শঙ্কা ১০ - শঙ্করপন্থীরা কি আগম শাস্ত্র একদমই মানে না ?
 
শঙ্কা নিবারণ -
এনারা শাক্ত আগম মানেন। সেই রীতিতে শ্রীবিদ্যাক্রমে দীক্ষাও দিয়ে থাকেন। প্রখ্যাত অদ্বৈত বৈদান্তিক শ্রী বিদ্যারণ্য মুনি রচিত শ্রীবিদ্যার্ণব তন্ত্র, আদি শঙ্করাচার্য কর্তৃক রচিত সৌন্দর্য্যলহরী ইত্যাদি পড়লে তা স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়। দশনামী আখড়া গুলিতে শাক্ত আগম গুলি বেশ সমাদৃত। কিন্তু শৈব আগমের বেলায় এনাদের যত সমস্যা। এর ফলে এনাদের উপর অর্ধজড়তীয়তা দোষ আরোপিত হয়।


শঙ্কা ১১ - ভারত সেবাশ্রম সংঘ, রামকৃষ্ণ মিশন, সারস্বত মঠ এরা কি শৈব দীক্ষা দেয় ? 

শঙ্কা নিবারণ - 
এনারা শিব মন্ত্রে দীক্ষা দেয় ঠিকই কিন্তু কেউই শৈব দীক্ষা দেয় না। কেননা এনারা কেউই কোনো শৈব পরম্পরার নয়। তাই শিব উপাসনার, পূজার কোনো সঠিক বিধি, মন্ত্র, আচার আপনারা এই সব সংগঠনে পাবেন না। এই মঠগুলির প্রতিষ্ঠাতারা দশনামী পরম্পরাভুক্ত ছিলেন এবং পরবর্তী কালে স্মার্তশাক্ত মিশ্র ভাবধারায় গড়ে ওঠে যা আজও বহাল।  আর শৈব তন্ত্র ব্যতিরেখে, শিব তত্ত্বজ্ঞ গুরু, শৈব আচার্য্য ব্যতিরেখে, ষড়াধ্বশোধন ব্যতিরেখে শৈব দীক্ষা প্রদান সম্ভব নয় অথবা কেউ সেই দীক্ষা দিলেও তা অনর্থক। 


শঙ্কা - ১২ শাক্ত আগম গুলি তো সাক্ষাৎ শিব বাক্য । শৈবরা কিভাবে শিব বাক্যের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে, এতে তো তাদের উপর আত্মাশ্রয় দোষ আরোপিত হচ্ছে ?

শঙ্কা নিবারণ -
শাক্ত আগমগুলি যে শিব বাক্য এবং সেগুলি যে প্রমাণ হিসেবে মান্য, তার উল্লেখ প্রাচীন কোনো শাক্ত আচার্য্য করে যাননি। শিব থেকে সৃষ্ট কোনো নির্দিষ্ট আগম পরম্পরা তাদের নেই। পুরাণ শাস্ত্রেও এই সব শাক্ত তন্ত্রের একটির নামও পাওয়া যায় না, যেমনটা শৈব তন্ত্রের নাম পাওয়া যায়। এক শাক্ত তন্ত্রে এক কথা বলা রয়েছে তো অপর তন্ত্রে অন্য কথা বলা রয়েছে, স্ববিরোধী মত পোষণ করে সেগুলি। এর থেকে এটা বোঝা যায় যে এই শাক্ত তন্ত্র গুলির কয়েকটাকে ছেড়ে বাকি গুলো অনেক পরের রচনা। মধ্যযুগে রচিত বৃহৎ তন্ত্রসারে উল্লেখিত ৬৪ তন্ত্রের নাম, মহাসিদ্ধিসারস্বত তন্ত্রে উল্লেখিত তিন ক্রান্তার মোট (৬৪x৩) = ১৯২ টি তন্ত্রের নাম এবং শক্তিসঙ্গম তন্ত্রের ছিন্নমস্তা খণ্ডে উল্লেখিত শাক্ত তন্ত্র গুলির নাম প্রাচীন কোনো আচার্য্য দ্বারা কোথাও লিপিবদ্ধ হয়নি, সেই নামগুলির মধ্যেও ভিন্নতা লক্ষ করা যায়, একটির সাথে অপরটির তেমন কোনো মিল পাওয়া যায় না। এসব থেকেই বোঝা যায় যে, শাক্ত আগমগুলিকে (কয়েকটিকে ছেড়ে) পরবর্তী কালে শৈব বাম তন্ত্র, ভৈরব আগম, কাপাল আগম, লাকুল আগম, ভূত তন্ত্র, শৈব নাথ কৌলদের নিজস্ব তন্ত্র এসব থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা হয়েছে। তাই ওগুলো প্রত্যক্ষ শ্রুতি নয়, বরং স্মৃতি। তাই উহা শৈবদের কাছে অপ্রমাণ হিসেবে স্বীকৃত। তাই আত্মাশ্রয় দোষের কোনো প্রসঙ্গই আসছে না। মুডিগোণ্ডা নাগালিঙ্গা শাস্ত্রীও তাঁর 'বিদ্যাস্থানবিনির্ণয়'তে শাক্ত আগম গুলিকে অপ্রমাণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গিয়েছেন। প্রাচীন যারা তন্ত্রাচার্য ছিলেন যেমন - আচার্য্য অভিনব গুপ্ত, মহাযোগী মহাকৌল শ্রীমৎস্যেন্দ্র নাথ, শিবানন্দ নাথ, মহেশ্বরানন্দ তাঁরা কিন্তু তাদের রচনায় কোনো শাক্ত তন্ত্রের উল্লেখ করে যাননি, 
যেগুলির নাম আজ শাক্ত মহলে বহুল প্রচলিত। 

শঙ্কা - ১৩ স্মার্ত আচার্যদের কোনো মতমত শৈব মতে গ্রহণীয়?

শঙ্কা নিবারণ
স্মার্ত আচার্যদের মতামতকে গ্রহণ করলে, শৈবদের কাছে শৈব আগম শাস্ত্রগুলি অগ্রাহ্য হয়ে যায় অর্থাৎ শিব বাক্য অগ্রাহ্য হয়ে যায় এবং প্রাচীন শৈব আচার্যদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় এবং গুরুদ্রোহ হল সবচেয়ে বড় পাপ কেননা  ইহা শিবদ্রোহের সমতূল্য। তাই এই দোষ এড়াতে কোনো স্মার্তবাদীদের যেকোনো মতামতকেই শৈব পরম্পরায় অগ্রাহ্য হিসেবে ধরা হয় যদি তা শৈব মতাদর্শের বিরুদ্ধাচারণ করে।

শঙ্কা - ১৪ শৈব সমাজের উত্থানের জন্য স্মার্ত আচার্যদের অবদান ঠিক কতখানি ?

শঙ্কা নিবারণ - 
কোনো অবদান নেই। শৈব মতের মূল ভিত্তিই হল আগম শাস্ত্র এবং শৈব দর্শন ভিত্তিক গুরু পরম্পরাগত শাস্ত্র। যেহেতু স্মার্তরা শৈব আগমকে অপ্রমাণ/অমান্য হিসেবে দাবী করে এবং শিবের পূজায় শৈব শাস্ত্র বিরুদ্ধ মতে, নিগম-আগম বিরুদ্ধ মতে পূজা করে এবং বাংলায় যাদের আগ্রাসনে শৈব আচারের লেশ মাত্র চিহ্ন মন্দির গুলোতে পাওয়া যায় না, সেহেতু স্মার্তবাদীদের  শৈব মতের হিতৈষী বলা যুক্তিযুক্ত নয়।


শঙ্কা - ১৫ স্মার্তরা তো বৈদিক এবং স্মৃতি মতে শিব পুজো করে, তাদের নিয়মের বিরোধিতা করা মানে সনাতন শাস্ত্রের বিরোধিতা করা। এ প্রসঙ্গে আপনারা কি বলবেন ?

শঙ্কা নিবারণ -
বর্তমান বাংলায় স্মার্ত পুরোহিতেরা যে মতে, আচারে, নিয়মে শিবের পুজো করে, সেই পদ্ধতি কোনো শাস্ত্রেই নেই। বৈদিক শিব পূজা বিধি সাক্ষাৎ শিব-মহাপুরাণেই দেওয়া রয়েছে। পৌরাণিক নিত্য পূজা বিধি লিঙ্গমহাপুরাণে দেওয়া আছে। তাছাড়া সায়ণ আচার্য্য বিরচিত বৈদিক শিব পূজা বিধি রয়েছে। কাশী জগৎগুরু চন্দ্রশেখর শিবাচার্য মহাস্বামীজি রচিত বেদ-আগম ভিত্তিক শিব পূজা বিধি রয়েছে। কিন্তু কোথাও, কোনো শাস্ত্রে আপনি বঙ্গীয় খিঁচুড়ি মতের শিব পূজা বিধি পাবেন না, যেটা না পুরাপুরি বৈদিক, না পুরোপুরি তান্ত্রিক, পুরোটাই মনগড়া। আচার্য্য পরম্পরা এবং শাস্ত্র বিরুদ্ধ এই তথাকথিত শিবপূজা পদ্ধতির বিরুদ্ধে আমরা। 

🔘 বিঃদ্রঃ

i. উপরিউক্ত আলোচনার উদ্দ্যেশ্য কোনো মত বা সম্প্রদায়কে ছোট বা নিচু করে দেখানোর জন্য নয়, কেননা প্রত্যেক সম্প্রদায়ই শিব থেকেই এসেছে এবং শিবই আদি জগৎগুরু। এই কথা অকাট্য। শৈবমত প্রতিষ্ঠা হেতু এই আলোচনা।

ii. বাংলায় একদল মানুষ শৈব পরম্পরার নামে স্মার্ত পরম্পরার প্রচার করে সাধারণ মানুষকে ভ্রমিত করছে এবং উভয় পরম্পরাকে এক হিসেবে, একই দর্শনভুক্ত হিসেবে দাবী করছে। তাদের এই সকল কুকর্ম ও মিথ্যাচারকে জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্য উপরিউক্ত প্রবন্ধটি আনতে আমরা বাধ্য হই।

iii.  শৈব সমাজ ও স্মার্ত সমাজের মধ্যে দর্শনগত, আচারগত, শাস্ত্রগত এবং আচার্য্য মান্যতা গত যে একটি বিস্তর ফারাক রয়েছে, সেটি জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্যই এই আলোচনা।

iv. বাংলায় শিবভক্ত এবং শৈব মতের উপর আস্থাবান ব্যক্তিবর্গ আজও মনে করেন যে আদি শঙ্করাচার্য্য হলেন একজন শৈব, শৈব মতের প্রচারক, কেননা তিনি ত্রিপুন্ড্র, রুদ্রাক্ষ ধারণ করতেন। তাদের সেই ভুল ধারণার নিরসন ঘটাতে এই আলোচনা।

v. বাংলার ৯৯% শিবভক্ত মানুষই শৈব পরম্পরা, শৈব দর্শন, শৈব আচার, শৈব শাস্ত্র,  শৈব আচার্যদের নাম সম্পর্কে অজ্ঞ। এই জন্যই তো তারা স্মার্ত, বৈষ্ণব, শাক্তদের প্ররোচনায় পা দিয়ে দেয় এবং শৈব মতের গভীরতা পর্যন্ত আর যেতে পারে না। তাদের স্বার্থেই এই পোস্ট। 

vi. অদ্বৈত দর্শন বা বেদান্ত দর্শন বা ব্রহ্মসূত্র বলতেই বাংলার লোক আদি শঙ্কর আচার্যকেই সাধারণত বোঝেন। এর কারণ হল প্রচার। অন্যদিকে শৈব বৈদান্তিকদের নাম, ব্রহ্মসূত্র এর শৈব ভাষ্যকারদের নাম, অদ্বৈত শৈব দর্শন গুলির নাম সম্পর্কে মানুষ বিন্দুমাত্র অবগত নয়, শুধুমাত্র প্রচারের অভাবে, শৈব পরম্পরার অভাবে। তাই এই গুরু দায়িত্ত্ব পালনের উদ্দ্যেশে উপরিউক্ত আলোচনা।

vii. শৈব মতাদর্শ নিয়ে বাংলার জনসমাজ আগ্রহ বাড়ানোর হেতু এই আলোচনা।

viii. উপরিউক্ত আলোচনায় কারো কোনো ব্যক্তিগত মনগড়া মত পোষণ করা হয়নি। ইহা ISSGT কর্তৃক রটানো কোনো নিজস্ব দাবী নয়,  এই দাবী গুলি পুরো শৈব সমাজের, শৈব পরম্পরার, প্রাচীন শৈব আচার্যদের। সুতরাং ISSGT এর দিকে আঙুল তোলার আগে আপনাদেরকে পুরো শৈব আচার্য সম্প্রদায়ের উপরে আঙুল তুলতে হবে, যেগুলি আপনাদের পরম্পরার অস্তিত্বে আসার বহু আগে থেকে জগতে বিদ্যমান ছিল, তাই আঙুল তোলার দশবার ভেবে নেবেন। 

ix. বাংলায় শৈব সমাজের উত্থান, সশক্তিকরণ এবং ভিত্তি স্থাপনই ISSGT এর একমাত্র উদ্দ্যেশ্য আর সেই জন্যই দিনরাত এক করে, নিঃস্বার্থ ও নিরলস ভাবে আমাদের এত অক্লান্ত পরিশ্রম। আমরা কোনো নতুন মতের আমদানি করছি না, বরং জগতের সর্বপ্রাচীন, সহস্রকোটি আচার্য্য সিদ্ধ শৈব সনাতন ধর্মের প্রচার করছি, তাই আমাদেরকে 'উগ্র শৈব', 'ইস্কনী টাইপের শৈব', 'নব্য শৈব' হিসেবে কটাক্ষ করা অযৌক্তিক। এই কটাক্ষ আপনারা ISSGT কে নয় বরং প্রাচীন শৈব আচার্যদেরকেই করছেন, ভেবে দেখবেন।

x. সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধটি অধ্যয়ন করার পর যদি কারো ভাবাবেগে আঘাত লেগে থাকে, তাহলে আমাদের কিছু করার নেই। কারণ সত্য কথা অপ্রিয় এবং তিক্ত হয় আর শৈবরা মিথ্যার সাথে আপোস করে চলে না। বাংলায় শশাঙ্কের আমলের পর থেকেই শাক্ত, বৌদ্ধ এবং বৈষ্ণবদের আস্ফালনে শৈব সমাজের ভাবাবেগ ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়, কেউ তাদের পাশে দাঁড়ায়নি, স্মার্তরা বরং সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে নিজ স্বার্থ সিদ্ধির জন্য, নিজ মত প্রচারের জন্য। শৈবরা  একটি টু-শব্দও করেনি, নিঃশব্দে সব কিছু মেনে নিয়েছে এতদিন। যার ফল আজকের বাংলায় আপনার  নিজেরাই প্রত্যক্ষ করতে পারছেন।কিন্তু আর নয়। কলির প্রকোপ এবং বিরোধীদের আস্ফালন স্বরূপ জগদ্দল পাথর ভেদ করে বাংলায় শৈব সনাতন ধর্মের হারানো গৌরবের পুনরুত্থান হবেই।

👉 উপরিউক্ত বিষয় নিয়ে facebook live আলোচনা দেখতে নিম্নে প্রদত্ত লিঙ্কে ক্লিক করে দেখুন - 

 
নমঃ শিবায়।
নমঃ শিবায়ৈ।

লেখনীতে - ©RohitKumarChoudhury(ISSGT)
RohitKumarChoudhry. ISSGT. 2022. ARR














মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত