শৈব আচমন বিধি ও তার মাহাত্ম্য (শৈব আগমোক্ত)

 


আমরা বঙ্গবাসীরা সাধারণত স্মার্ত মতেই আচমন করে এসেছিন এতদিন। এমনকি শৈবাচারে আচমন থাকা সত্ত্বেও আমরা বেশির ভাগ শিবপূজাতেই সেই স্মার্তাচারেই আচমন করি।

সাক্ষাৎ লিঙ্গরূপি পরমেশ্বরের পূজায় তাঁরই নির্দেশিত পদ্ধতিতে আচমন হবে না তা কি করে হয়। তাই ISSGT এর পক্ষ থেকে সাক্ষাৎ পরমেশ্বর প্রভু শিবের দ্বারাই নির্দেশিত আগমোক্ত তিন পর্যায়যুক্ত একটিই আচমন বিধি সহ তার মাহাত্ম্য নিয়ে আসা হল।

শিবভক্ত শৈবদের জন্য বিশেষ আচমন পদ্ধতি উল্লেখিত আছে বৈদিক শৈব আগম শাস্ত্রে।

তাই সমস্ত শিবভক্তদের স্বার্থে এই আচমন বিধি আনা হল। শৈবদের সর্বদা এই শৈবপূজা পদ্ধতিতেই পরমেশ্বর শিবের উপাসনা করা উচিত।

যে কোনো উপাসনামূলক কার্যে এই শৈব আচমন বিধি অনুসরণ করবেন।



শৈবশাস্ত্রে শৈব আচমনের উল্লেখ :—


” আজানুপাদৌ প্রক্ষাল্য হস্তাবামণিবন্ধনাৎ ।

কুক্কুটাসনসংস্থস্তু জানুমধ্যগ পাণিযুক্ত ।। ১১২

সংযক বদ্ধশিখো ভূত্বা প্রাঙ্মুখো বাপ্যুদঙ্মুখঃ 

হস্তং গোকর্ণ্বত্কৃত্বা মাষমগ্নজলং পিবেৎ ।।১১৩

অপ্রাণিযুগফেনং চ বুদ্বুদাদি বিবর্জনাত্ ।

ব্রহ্মতীর্থেন মূলেন ত্রিঃ পিথ্বা দ্বিঃ প্রমার্জযেত্ ॥১১৪

ওষ্ঠাঙ্গুষ্ঠমূলেনানামিকাঙ্গুষ্ঠ যোগতঃ ।

চক্ষুর্নাসাশৃতী বাহূ বক্ষৌ নাভি শিরঃ স্পৃশেত্ ॥১১৫

সমন্ত্রাচমনং পশ্চাদাত্মবিদ্যা শিবাণুভিঃ ।

স্বধান্তৈস্সলিলং পীত্বা হেতিনোষ্ঠৌ প্রমার্জযেত্ ॥১১৬

হৃন্মন্ত্রেণাক্ষি সংস্পৃশন্ কুর্যাত্ সব্যাপসব্যতঃ ।

অথবান্য প্রকারেণ কুর্যাদাচমনং বুধঃ ॥১১৭

ভাষমগ্ন জলং গ্রাহ্য নির্দোষং ত্রিঃ পিবেত্পুনঃ ।

আস্যং দ্বিঃ প্রমৃজদস্ত্রাত্ সকৃন্মৃজ্য মুখং শতৈঃ ॥১১৮

পদাবভ্যূক্ষ্য মুর্ধানং অঙ্গুষ্ঠানামিকেন তু।

সব্যাত্তু চক্ষুশী স্পৃষ্ট্বা তর্জন্যাঙ্গুষ্ঠকেন তু ॥১১৯

নাসাদ্বারাবুভৌ স্পৃষ্ট্বা কনিষ্ঠাঙ্গুষ্ঠ যোগতঃ।

শ্রোত্রে স্পৃষ্ট্বা জলোপেতাঙ্গুষ্ঠেন তু বাহুকৌ ॥১২০

নাভিং অঙ্গুষ্ঠকেনৈব সর্বাঙ্গুল্যগ্র সন্ধিতঃ।

হৃত্প্রদেশে তু সংস্পৃশ্য সর্বাঙ্গুলা স্বমুর্ধনি ॥১২১


[রেফারেন্স : পূর্ব-কামিকাগম/৩ নং অধ্যায়]



🔘উপরের শ্লোকগুলির পরপর অনুবাদ করলে বোঝা যায় যে আগমোক্ত শৈবাচারে আচমনের তিনটি পর্যায় আছে ।


যথা –


শৈব আচমনের প্রথম পর্যায়


১. আচমনকারীর সবার প্রথমে করণীয় – হাত, পা, মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে ভূমিতে কুক্কুট আসনের ন্যায় বসা।


২. তার মুখ হয় পূর্বদিকে অথবা উত্তর দিকে থাকতে হবে।


৩. দুই হাঁটুর মাঝে তার দুই হস্তে রাখতে হবে ।


৪. তার হস্তদ্বয়ের কবজি পরস্পরের সাথে যুক্ত অবস্থায় অর্থাৎ মণিবন্ধ অবস্থায় রাখতে হবে


৫. ডান হাতের তালুকে গোরুর কানের ন্যায় ভাঁজ করতে হবে।



৬. সেখানে তাঁকে সামান্য পরিমান জল নিয়ে তা পরপর তিনবার হাতের ব্রহ্মতীর্থে মুখ লাগিয়ে ঠোঁট দ্বারা শুষে নিয়ে পান করতে হবে।

সেই জল যেন কীটপতঙ্গমুক্ত, ফ্যানাবিহীন, বুদবুদ বর্জিত ও পরিষ্কার থাকে ।


৭. তৎপশ্চাৎ ডানহাতের বুড়ো আঙ্গুলের গোড়া দ্বারা দুইবার ঠোঁট মুছতে হবে।


৮. বুড়ো আঙ্গুল এবং অনামিকা আঙ্গুল একত্রে যোগ করে ক্রমশ চোখ, নাক, কান, দুই বাহু(হাত), বুক, নাভি ও মাথা স্পর্শ করতে হবে ।


এবার দ্বিতীয় পর্যায়ের পদ্ধতি অনুসরণ করুন।


🌟✅ শৈব আচমনের দ্বিতীয় পর্যায়



৯. পুনরায় ডান হাত পেতে নিয়ে তাতে বিশুদ্ধ জল নিন একফোটা পরিমান ।


১০. এবার ঐ হাতের ব্রাহ্মতীর্থে ঠোঁট লাগিয়ে জল শোষন করতে করতে মনে মনে নিঃশব্দে উচ্চারণ করুন এই প্রথম মন্ত্রটি 👉 ॐ হ্রাং (ह्रां) আত্মতত্ত্বায় স্বধা  


১১. এবার হাতটি মুছে নিয়ে আবার ঐ ভাবে ডানহাতে একফোটা জল নিয়ে ব্রাহ্মতীর্থে ঠোঁট লাগিয়ে জল শোষন করতে করতে মনে মনে নিঃশব্দে উচ্চারণ করুন

এই দ্বিতীয় মন্ত্রটি 👉 ॐ হ্রীং (ह्रीं) বিদ্যাতত্ত্বায় স্বধা ।


১২. পুনরায় হাতটি মুছে নিয়ে আবার ঐ একই ভাবে ডানহাতে একফোটা জল নিয়ে ব্রাহ্মতীর্থে ঠোঁট লাগিয়ে জল শোষন করতে করতে মনে মনে নিঃশব্দে উচ্চারণ করুন

এই তৃতীয় মন্ত্রটি 👉 ॐ হ্রূং (ह्रूं) শিবতত্ত্বায় স্বধা ।


১৩. এইবার ডানহাতের বুড়ো আঙ্গুল দ্বারা ঠোঁট দুবার মুছুন মনে মনে নিঃশব্দে এই কবচমন্ত্র টি পাঠ করতে করতে 


✅আগমোক্ত কবচ মন্ত্র –

👉 ॐ শিং হ্রৈং কবচায় হুং


অথবা

👉 ॐ শিং অনাদিবোধশক্তিধাম্নে কবচায় হুং


১৪. পরিশেষে ডাননহাত দিয়ে নিজের ডান ও বামচোখ একত্রে স্পর্শ করে মনে মনে নিঃশব্দে এই হৃদয়মন্ত্র টি জপ করুন 👉


✅আগমোক্ত হৃদয় মন্ত্র –


👉 ॐ ॐ হ্রাং হৃদয়ায় নমঃ

অথবা

👉 ॐ ॐ অনন্তশক্তিধাম্নে হৃদয়ায় নমঃ


(হ্র এর জায়গায় হ উচ্চারণ করতে পারেন, যেমন হ্রূং থেকে হূং)


এবার তৃতীয় পর্যায়ের নিয়ম অনুসরণ করুন।


শৈব আচমনের তৃতীয় পর্যায়


১৫. পুনরায় পরিষ্কার, ফেনামুক্ত, জীবানুমুক্ত শুদ্ধ একফোঁটা জল ডান হাতের তালুতে নিতে হবে।


১৬. এরপর পূর্বোক্ত একই মন্ত্রে তিনবার আচমন পূর্বক তা পান করতে হবে


১৭. তারপর তাকে অস্ত্রমন্ত্র জপ পূর্বক দুইবার নিজের ঠোঁট মুছতে হবে ।


✅আগমোক্ত অস্ত্রমন্ত্র –


👉 ॐ যং অলুপ্তশক্তিধাম্নে অস্ত্রায় ফট্


অথবা


👉 ॐ যং হ্রঃ অস্ত্রায় ফট্


১৮. তারপর একবার করে ধীরে ধীরে নিজের মুখমন্ডল ও পায়ের পাতা মুছতে হবে।


১৯. এরপর তাঁকে বুড়ো আঙুল ও তর্জনীকে পরস্পর জোড়া করে মাথা স্পর্শ করতে হবে।


২০. তারপর বুড়ো আঙুল ও তর্জনীকে পরস্পর জোড়া করে তাঁকে প্রথমে বাম চোখ তারপর ডান চোখ স্পর্শ করতে হবে।


২১. তারপর বুড়ো আঙুল ও কনিষ্ঠা পরস্পর জোড়া করে তাকে নিজের নাকের ছিদ্র দুটিকে স্পর্শ করতে হবে।


২২. তারপর তাকে বুড়ো আঙুলে জল লাগিয়ে নিজের কান ও বাহু(হাত) দুটিতে স্পর্শ করতে হবে। 


২৩. তারপর বুড়ো আঙুল দিয়ে তাঁকে নিজের নাভি স্পর্শ করতে হবে।


২৪. তারপরে সমস্ত আঙুলের অগ্রভাগ একসাথে করে নিজের হৃদয়ে বা বাম বক্ষস্থলে রাখতে হবে এবং সর্বশেষে সমস্ত আঙুল দিয়ে নিজের মাথাকে স্পর্শ করতে হবে।


অতপর পরমেশ্বর প্রভু শিবের উদ্দেশ্যে প্রণাম করতে হবে।


॥ শৈব আচমন পদ্ধতি সম্পূর্ণম্ ॥


উপরোক্ত আচমন পদ্ধতিটি শুধুমাত্র সহজ সরল ভাবে বোঝার জন্য পর্যায় হিসেবে দেখানো হয়েছে। এখানে সম্পূর্ণ একটিই আচমন বিধি দেয়া হয়েছে, যার ১নং থেকে ২৪নং পর্যন্ত পরপর সমস্ত নিয়মাবলী দেয়া হয়েছে। আচমনের জন্য তিনটি পর্যায়ের সমগ্র বিধিটিই অনুসরণ করবেন।


[যে সমস্ত ব্যক্তির কাছে সময়ের অভাব রয়েছে তিনি শুধুমাত্র🌟দ্বিতীয় পর্যায়টি অনুসরন করতে পারেন।]



🔴শৈব পদ্ধতিতে আচমনের মাহাত্ম্য🔴


” ঋগ্যজুস্সাম বেদানাং ত্রিঃ পানাত্তৃপ্তিরিষ্যতে। ওষ্ঠদ্বিমার্জনাত্তত্র তথাথর্বেতিহাসয়োঃ।। ১২২

আস্যসম্মার্জনাত্তত্র গণেশস্য প্রিয়ং ভবেত্ ।

হৃচ্ছিরোভ্যুক্ষণেনৈব ঋষিণাং তু প্রিয়ং ভবেত্ ।। ১২৩

চাক্ষুষোঃ স্পর্শ্নেনৈব প্রিয়ং স্যাত্সোমসূর্যয়োঃ।

নাসিকা স্পর্শেনেনৈন অশ্বিন্যোস্তু প্রিয়ং ভবেত্ ।। ১২৪

শ্রোত্র সংস্পর্শনেন‌ৈব দিশাং প্রীতিস্তথা ভবেত্ । ইন্দ্রবিষ্ণ্বনলানাং চ বাহ্বোর্নভের্হৃদস্তথা ।। ১২৫ “


(পূর্ব-কামিকাগম/তৃতীয় পটল)


🔷সরলার্থ


✅ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামদেব প্রসন্ন হন যখন শৈবপদ্ধিতে কেউ তিনবার জল পান করেন।


✅তার যখন সে দুইবার নিজের ঠোঁটকে মোছে তখন অথর্ববেদ ও ইতিহাস প্রসন্ন হন।


✅যখন সে তার মুখ মোছে তখন গণেশ প্রসন্ন হন।


✅যখন সে নিজের বক্ষ/হৃদয় এবং মস্তককে স্পর্শ করে তখন মহর্ষিগণ প্রসন্ন হন


✅যখন সে নিজের দুই চোখকে স্পর্ষ করে তখন সূর্য ও চন্দ্র প্রসন্ন হয়।


✅যখন সে তাঁর নাসাছিদ্রদ্বয় স্পর্শ করে তখন অশ্বিনীকুমারদ্বয় প্রসন্ন হন।


✅যখন সে তার কর্ণদ্বয় স্পর্শ করে তখন দিকপালেরা প্রসন্ন হন।


✅যখন সে তাঁর বাহু, নাভি ও হৃৎপিন্ড স্পর্শ করে তখন ইন্দ্র, বিষ্ণু ও অগ্নিদেব প্রসন্ন হন।


🔘সংগ্রহে ও লেখনীতে – Sri Rohit Kumar Choudhury(ISSGT) এবং Sri Koushik Roy(ISSGT)


🔘সম্পাদনায় – Sri Koushik Roy (ISSGT)

🔘প্রচারে ও কপিরাইট – International Shiva Shakti Gyan Tirtha 


© Koushik Roy. All Rights Reserved https://issgt100.blogspot.com

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত