পদ্মপুরাণে ভগবদ্গীতা সাক্ষাৎ শিবস্বরূপ‌ ও সদাশিব‌ বিষ্ণুর চেয়ে পরম বলে শ্রীবিষ্ণুর স্বীকারোক্তি - (ভাবার্থ বিশ্লেষণ ও টীকা সহ)



এখানে বৈষ্ণবদের পরমপ্রিয় সাত্ত্বিকপুরাণ পদ্মপুরাণ থেকে প্রমাণসহ দেখানো হল যে, বিষ্ণুর চেয়ে‌ও পরম হলেন শিব ও অন্তিমে এই শিব‌ই একা থাকেন, তখন বিষ্ণুর দেহ‌ও শিবে বিলীন হয় যা শ্রীবিষ্ণু নিজেই স্বীকার করেছেন। এছাড়াও শ্রীবিষ্ণু আরো বলেছেন যে তার দেয়া(কৃষ্ণরূপে) গীতা অর্থাৎ ভগবদ্গীতার ১৮ অধ্যায়ের দ্বারা যিনি প্রতিপাদিত হন তিনি একমাত্র সদাশিব। অর্থাৎ ভগবদ্গীতা যে শিব মাহাত্ম্যের প্রকাশকারী মহারত্ন তা উপলব্ধ করা যায়। নীচে এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ আছে। এখানে পরমসত্যের গুহ্য রসহ্যকে উন্মোচন করা হয়েছে, কেউ আবার বিভেদ করা হচ্ছে বলে বৃথা বাক্য প্রয়োগ করবেন না। ধৈর্য্য সহকারে সম্পূর্ণ অধ্যয়ন করবেন। আশা করি পদ্মপুরাণের এই নির্দেশনা দর্শন করবার পর বৈষ্ণবগণেরা আর কখনো শিবনিন্দা করবে না, ভগবদ্গীতা যে সাক্ষাৎ শিবের এটিও অস্বীকার করার দুঃসাহস দেখাবে না। কেননা পদ্মপুরাণ তাদের কাছে পরমসাত্ত্বিক পুরাণ বলে গণ্য। সুতরাং, পদ্মপুরাণ কথিত এই শিবমাহাত্ম্য কেও বৈষ্ণবগণেদের অবশ্য‌ই স্বীকার করে নিতে হবে ।


🌷এবার আসা যাক মূল আলোচনায়


🚩আলোচ্চ বিষয়ের মূল শ্লোকের রেফারেন্স - পদ্মপুরাণ/উত্তর খণ্ড/১৭৫ নং অধ্যায়


----------------------------------------------------------


🔘শ্রীরুবাচ –


" শয়ালুরসি দুগ্ধাব্ধৌ ভগবন্-কেন হেতুনা উদাসীনইবৈশ্বর্যং জগংতিস্থাপযন্নিব || ৫ || "


👉বঙ্গানুবাদ- 


লক্ষ্মীদেবী শ্রীবিষ্ণুদেবকে বললেন যে – কোন কারণে আপনি সর্বদাই ক্ষীর সাগরে শায়িত অবস্থায় (যোগনিদ্রামগ্ন) থাকেন? জগতে ঐশ্বর্য স্থাপনকারী আপনি কেনই বা এত উদাসীন থাকেন?


🔘শ্রীভগবানুবাচ্ –


" নাহং সুমুখি নিদ্রালুর্নিজং মাহেশ্বরং বপুঃ |

দৃশাতত্ত্বানুবর্ত্তি ন্যাপশ্যাম্যংতর্নিমগ্নযা || ৭ ||

কুশাগ্রয়াধিযা দেবি যদংতর্যোগিনোহৃদি |

পশ্যন্তি যচ্চ বেদানাং সারং মীমাংসতেমৃশম্ || ৮ ||

তদেবমক্ষরং জ্যোতিরাত্মরুপমনামযম্ |

অখংডানংদ সংদোহনিষ্পাদিদ্বৈতবর্জিতম্ || ৯ ||

যদাশ্রয়া জগদ্বৃত্তির্যন্ময়াচানুভূযতে |

নযেনরহিতংকিংচিতজ্জগত্তত্বং চরাচরম্ || ১০ || "


👉বঙ্গানুবাদ –


উত্তরে ভগবান বিষ্ণু বলেন – হে সুমুখি! আমি কদাপি শয়ন করি না। আমি ধ্যান নেত্রে (নিজেরই অন্তরস্থ) আত্মস্বরূপ মহেশ্বরকে অনুভব করে থাকি। হে দেবি! কুশাগ্রের ন্যায় (তীক্ষ্ণ) (দৃষ্টিসম্পন্ন) যোগীগণ নিজের হৃদয়ে সেই মহেশ্বরকেই অনুভব করে থাকেন। (সকলের হৃদয়ে অবস্থিত সেই অখণ্ড চৈতন্য) সমগ্র বেদের সার এবং মীমাংসা স্বরূপ। সেই দেব (মহেশ্বর) অক্ষর, জ্যোতিরূপ, অরূপ এবং অনামেয়।তিনি অখণ্ড, অনন্ত এবং অদ্বৈত(অদ্বিতীয় পরমেশ্বর)। যার আশ্রয়ে সমগ্র জগৎ, যাকে আমিও(শ্রীবিষ্ণু) অনুভব করে থাকি (ধ্যাননেত্রে), যার বিনা এ জগত-চরাচরের কোনো অস্তিত্বই নেই।


🔴ভাবার্থ –


শিবতত্ত্ব থেকে পৃথিবী তত্ত্ব এবং তাঁরও নীচে পাতালাদি লোক পর্যন্ত যত রকমের প্রমাতারা বা দেবতারা বা বিদ্যমান রয়েছেন প্রত্যেকের অন্তরেই প্রত্যগাত্মারূপে সেই এক ও অদ্বিতীয় পরাচৈতন্য বিদ্যমান। প্রলয়ের পর সেইসকল জীবেদের দেহ নষ্ট হয়ে গেলেও সেই আত্মচৈতন্য সর্বদাই অবিনশ্বর, সেই চৈতন্যই সাক্ষাৎ পরমশিব। এই শিবকেই 'মহেশ্বর' নামে বহু নামে ব্যক্ত করা হয়েছে। ত্রিদেব (ব্রহ্মা, বিষ্ণু, হর) যেহেতু মায়াপ্রকৃতি/অব্যক্ত প্রকৃতি থেকে গুণক্ষোভের দরুণ নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট গুণে আবদ্ধ হয়ে জাত হন তাই তাঁদের দেহও প্রলয়কালে নষ্ট হয়ে যায়। শুধুমাত্র নিরাকার পরমেশ্বরই অবশিষ্ট থাকেন। সেই পরমাত্মা পরমশিবকেই ধ্যান নেত্রে শ্রীবিষ্ণুদেব আত্মস্বরূপে অনুভব করে থাকেন। যোগীরাও ধ্যান নেত্রে নিজেদের ব্রহ্মরন্ধ্রে স্থিত পরমধাম জ্ঞানকৈলাস/পরাকৈলাস সহস্রার পদ্মে সেই অদ্বৈত সদাশিবকেই অনুভব করে থাকেন।



🍀🍀টীকা - 👉 "প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম" (ঐতরেয় উপনিষদ/৩/১/৩) ---ব্রহ্ম বা পরমাত্মা সাক্ষাৎ প্রজ্ঞান স্বরূপ অর্থাৎ চৈতন্যস্বরূপ। অখণ্ড চৈতন্যময় যে সত্ত্বা দ্বারা জগতচরাচর ব্যপ্ত হয়ে আছে সেটিই ব্রহ্ম। যা একাধারে সৎ বা প্রকাশস্বরূপ বা সত্যস্বরূপ, একাধারে চিৎ স্বরূপ বা বিমর্শময় বা চৈতন্যময় এবং আনন্দস্বরূপ বা স্ফুূরণের ইচ্ছাময়।


এই ব্রহ্মই যে সাক্ষাৎ প্রকাশ ও বিমর্শময় পরমশিব তাঁর প্রমাণ দিচ্ছে শিবসূত্র 

👉 "চৈতন্যং আত্মা" - (শিবসূত্র/১.১) ---- প্রত্যেক জীবের আত্মস্বরপ সাক্ষাৎ সেই পরাচৈতন্যের সাথে অভেদ)


একই কথা বলছে - কৌষিতকী উপনিষদ 

👉 "প্রজ্ঞানাত্মা" (কৌষিতকী উপনিষদ/৩)--- প্রজ্ঞান বা চৈতন্যই সেই আত্মা।


সমগ্র জগৎ সেই অখণ্ড পরাচৈতন্য বা চিৎ দ্বারাই ব্যাপ্ত।  

👉" চিতি প্রত্যবমর্শাত্মা পরাবাক্-স্বরসোদিতা | স্বাতন্ত্র্যমেতন্মুখ্যং তদৈশ্চর্যং পরমাত্মনঃ ||" (কাশ্মীর শৈব পণ্ডিত উৎপলদপব রআিত 'ঈশ্বর প্রত্যভিজ্ঞা কারিকা/ প্রথম খণ্ড/জ্ঞানাধিকার/৫/১৩)


----- পরমাত্মা পরমশিবের যে স্বাতন্ত্রতা তাকেই পরাবাক বা পরাচিতি বলা হয়। এই অহম্ বিমর্ষময়ী চিতিই পরমেশ্বরের ঐশ্বর্যের প্রকাশক। এই চিতির/পরাশক্তির দ্বারাই পরমেশ্বর সমগ্র জগতে ব্যাপ্ত হন। 

(পরাবাক---পশ্যন্তি----মধ্যমা-----বৈখরী)


👉" সা চিতিঃ পরমেশস্য ক্রিয়াস্ফূর্তিঃ সুখাহত্মতা | সা শক্তিঃ পরমেশস্য বিমর্শাহখ্যা মহত্তরা || " (দত্তাত্রেয় অবধূত রচিত ত্রিপুরারহস্য)


---- পরমেশ্বরের ক্রিয়াস্ফূর্তি বা স্ফূরণ বা আনন্দময়তাকেই তাঁর বিমর্শরূপা মহত্তরা শক্তি বলা হয়, যার দ্বারা জগৎ আরাচর ব্যাপ্ত। 


👉" শক্তয়শ্চ জগৎ সর্বং শক্তিমাংশ্চ মহেশ্বরঃ | " (তন্ত্রালোক/ জয়রথ বিবেক টীকা/৫/৪০)


---- সমগ্র জগৎই সেই শক্তি/পরাচিতি দ্বারা ব্যাপ্ত এবং সেই শক্তির অধীশ্বর /শক্তিমান হলেন সাক্ষাৎ মহেশ্বর। অদ্বৈত বেদান্ত মতে সমগ্র শক্তি হল মায়া বলে বিবেচিত। তাই বলা হয় - 👉 " মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িং তু মহেশ্বরম্ || " (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৪/১০) 


---- অব্যক্ত প্রকৃতি হল মায়া। সেই মায়া প্রকৃতি থেকেই সমগ্র জগৎ জাত হয়। সেই মায়ার অধীশ্বরকে মায়ি/মহেশ্বর বলে জানা উচিত।


সেই পরাচৈতন্য অর্থাৎ অবিনশ্বর আত্মাই যে মহেশ্বর শিব তার প্রমাণও শাস্ত্রে দেওয়া রয়েছে --

👉" যৎ ব্রহ্মণঃ পরং জ্যোতিঃ প্রবিষ্টাক্ষরমব্যয়ম্ |যোন্তরাত্মা পরং ব্রহ্ম স বিজ্ঞেয়োমহেশ্বরঃ || এষ দেবো মহাদেবঃ কেবলঃ পরমং শিবঃ | " (পদ্মপুরাণ/স্বর্গখণ্ড/৬০/৩৪-৩৫)


--- অব্যয়, অক্ষর, পরম জ্যোতি স্বরূপ ব্রহ্মই সকলের অন্তর আত্মা। তিনিই পরম ব্রহ্ম, তাঁকেই মহেশ্বর আখ্যায় আখ্যায়িত করা হয়। তিনিই মহাদেব, তিনিই পরমশিব।


👉" যো বৈ বেদাদিষু গায়ত্রী সর্বব্যাপী মহেশ্বরাৎ |

তদ্বিরুক্তং তথাদ্বৈশ্যং তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু || "

(শিবসংকল্প সূক্ত- ঋগ্বেদ সংহিতা /খিলানি/৪ নং অধ্যায় /১১ নং খিলা /২১)


----যিনি সমগ্র বেদের গায়ত্রীস্বরূপ, যিনি বেদে সর্বব্যাপী মহেশ্বর বলে উক্ত হয়েছেন, সেই শিবের প্রতি মন সংকল্পিত হউক।


👉 " যৎ পরং ব্রহ্ম স একঃ য একঃ স রুদ্রঃ যঃ রুদ্র যো রুদ্রঃ স ঈশানঃ যঃ ঈশানঃ স ভগবান্ মহেশ্বরঃ || " (অথর্বশির উপনিষদ/৩ )


--- যিনি পরম ব্রহ্ম তিনি এক ও অদ্বিতীয়। যিনি অদ্বিতীয় সত্ত্বা তিনিই সাক্ষাৎ রুদ্র। সেই রুদ্রই ঈশানদেব, সেই ঈশানদেবই সাক্ষাৎ মহেশ্বর।


👉 " অব্যাকৃতব্রহ্মরূপো জগত্কর্ত্তা মহেশ্বরঃ |" (শ্রীশিবগীতা/১০/১৩)


এই মহেশ্বর/শিবকেই শ্রীবিষ্ণুদেব যোগনিদ্রার দ্বারা চিন্তন করে থাকেন। তথ্য প্রদানে মহাভারত ----👉" ঋতে নারায়ণাৎ পুত্র! শঙ্খচক্রগদাধরাৎ || এষ বিদ্বান্ গুণশ্রেষ্ঠো বিষ্ণুঃ পরমদুর্জ্জয়ঃ || দিব্যচক্ষূর্মহাতেজা বীক্ষতে যোগচক্ষূসা || " (মহাভারত/অনুসাশন পর্ব/১৩/৮-৯) 


--- ভীষ্ম বললেন, শঙ্খ চক্র গদাধারী মহাতেজা দিব্যচক্ষু নারায়ণ তাঁর ধ্যান নেত্রে সেই পরমেশ্বর শিবকেই দর্শন করে থাকেন। 


👉" যাং বিচিন্ত্য মহাদেবী জলশায়ী স্বয়ং হরিঃ | " (শক্তিসঙ্গম তন্ত্র/ ছিন্নমস্তা খণ্ড/৮/৪)


--- অক্ষোভ্য বললেন - সেই নির্গুণ ব্রহ্ম পরমশম্ভু এর চিন্তাতেই শ্রীহরি জলে শয়ন করে থাকেন। "


অন্যান্য যোগীপুরুষগণও সেই মহাদেবকেই ধ্যান করে থাকেন - 👉" ধ্যানিনো নিত্য যোগাশ্চ সত্যসত্ত্বাজিতেন্দ্রিয়াঃ || " (মহাভারত /অনুশাসন পর্ব /১৩/৪১৮)


--- জিতেন্দ্রিয় সাত্ত্বিক যোগীগণ আপনাকেই(শিব) নিত্য ধ্যানের দ্বারা অনুভব করে থাকেন।


👉" সহস্রারপুর সদাশিবপুর " (শাক্তানন্দতরঙ্গিণী)


👉"সহস্র নাড়ী প্রাণং কা মেলা, জহা অসংষ কলা সিব থানং || " (গোরক্ষবাণী/সবদী/৯৩) ---- সহস্রনাড়ি সুষুম্না যে স্থানে মিলিত হয়েছে সেই ব্রহ্মরন্ধ্র সহস্রার পদ্মে অসংখ্য কলাযুক্ত পরমেশ্বর শিব অবস্থান করছেন। (সিব = শিব)


🔘শ্রীরুবাচ-


" তস্মাত্ত্বত্তঃ পরং যত্তচ্ছ্রোংতু কৌতুহলংহিমে || ১৪ ||

চরাচরাণাং লোকানাং কর্ত্তা হর্ত্তা স্বযং প্রভুঃ |

যথাস্থিত স্ততোহন্য ত্বং যদি মাং বোধযাচ্চুত || ১৫ || "


👉বঙ্গানুবাদ-


লক্ষ্মীদেবী বললেন, আপনিই তো জগতের প্রভু তথা সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহার কর্তা। তো আপনার চেয়েও পরমতম তত্ত্ব আর কিই বা আছে? হে অচ্যুত! যদি কেউ থেকেও থাকে তবে তার সম্পর্কে জানতে আমি কৌতুহলী।

🔘শ্রীভগবানুবাচ্ –


" মাযামযমিদং দেবি বপুর্মেন তু তাত্ত্বিকম্ |

সৃষ্টিস্থিত্যোপসংহার ক্রিয়াজালোওবৃংহিতম্ || ১৬ ||

অতোহন্যদাত্মনোরূপং দ্বৈতাদ্বৈত বিবর্জিতম্ |

ভাবাভাব বিনির্মুক্তমাদ্যংতরহিতং প্রিয়ে || ১৭ ||

শুদ্ধ সংবিৎপ্রভালাভং পরানংদৈকসুন্দরম্ |

রূপমৈশ্বরমাত্মৈক্যগম্যং গীতা সুকীর্তিতম্ || ১৮ || "



👉বঙ্গানুবাদ-


ভগবান বিষ্ণুদেব বললেন , আমার এই দেহ মায়ার তৈরি। সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের মায়াজালে আবদ্ধ আমার দেহ(বিষ্ণুরূপীদেহ)।কিন্তু আমার আত্মরূপ (অর্থাৎ আত্মা)এই মায়াদেহ হতে পৃথক, সেটি অদ্বৈত, বিকাররহিত, আদি-অন্ত শূণ্য এবং ভাব-অভাব এবং অদ্বৈত এরও উপরে। সেই আত্মা শুদ্ধ সম্বিত্ স্বরূপ(পরাচৈতন্য), পরমানন্দময় এবং সুন্দর। আত্মস্বরূপ সেই ঈশ্বরই (পরমেশ্বর) গীতার(ভগবদ্গীতা) দ্বারা ব্যক্ত হয়েছে।



🔴ভাবার্থ –


শ্রী বিষ্ণুদেব বাইরে সত্ত্বগুণ ধারণ করে থাকেন।তিনি জগতের পালনকর্তা, তিনি জলতত্ত্বকে প্রকাশ করেন। তাই তাঁকে নারায়ণও বলা হয়ে থাকে। তিনি দ্বাদশ আদিত্যের মধ্যে একজন। তিনি বলতে চেয়েছেন তিনি যে সৌম্য দেহ ধারণ করেন সেটিও মায়ার দ্বারা তৈরী এবং প্রকৃতি থেকে জাত। সুতরাং সেটিও নশ্বর এবং সৃষ্টি ও স্থিতির পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময় পর একদিন সেটিও ধ্বংস হয়ে যাবে।কিন্তু তাঁর অন্তরেও যিনি পরাচৈতন্যরূপে বিরাজিত আছেন তিনি অবিনশ্বর, নিত্য এবং মহেশ্বর নামে অভিহিত হন। তিনিই সাক্ষাৎ শিব। অদ্বৈত পরশিবস্বরূপ চৈতন্যের কথাই ভগবদ্গীতায় ব্যক্ত হয়েছে। তাই এখানে ‘আমি' বলতে বা ভগবদগীতায় ‘আমি' বলতে দেহধারী কৃষ্ণ বা শ্রীবিষ্ণু নন বরং তাঁর দেহগহ্বরের অন্তরে নিবাসকারী আত্মার পরম স্বরূপ মহেশ্বর সদাশিবকেই বোঝানো হয়েছে। কেননা সদাশিব নিরাকারও বটে।



🍀🍀টীকা - শ্রীবিষ্ণুদেবও যে প্রকৃতি থেকে জাত হন, তিনিও যে মায়ার তৈরী দেহধারী এবং বাকিদের ন্যায় তাঁরও যে পরিণাম রয়েছে সেটি এবার আমরা দেখে নেব----------


"👉ব্রহ্মাদ্যাস্ত্রিগুণাধীশাঃ শিবস্ত্রিণতঃ পরঃ |

নির্বিকারী পরব্রহ্ম তূর্যঃ প্রকৃতিতঃ পরঃ || " (শিবমহাপুরাণ/কোটিরুদ্রসংহিতা/৪১/৫)


---ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্রাদি দেবগণ ত্রিগুণধারী কিন্তু সদাশিব ত্রিগুণের ঊর্ধ্বে । তিনি নির্বিকার, পরমব্রহ্ম, তূরীয় এবং প্রকৃতিরও ঊর্ধ্বে।


👉" ব্রহ্মাংডমালাভরণে মহেশস্যমমৈবতু |

চতুর্নিঃশ্বাসমাত্রেন বিষ্ণোরায়ুরুদাহৃতম্ || "

(পদ্মপুরাণ/ পাতাল খণ্ড/ ১০৮/ ৭০)


--- মহেশ্বর(রুদ্র) এবং আমার (সদাশিবের) চারটি নিঃশ্বাসের সমান হল বিষ্ণুদেবের আয়ু। (ভেবে দেখুন - বৈষ্ণব শাস্ত্র স্বীকার করছে যে বিষ্ণু হতেও পরম হলেন প্রভু শিব, বিষ্ণু একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ, কিন্তু পরমেশ্বর শিব তার ঊর্ধ্বে )


👉" ব্রহ্মাবিষ্ণুসুরেশানাং স্রষ্টা চ প্রভুরেব চ | " (মহাভারত/ অনুশাসন পর্ব /১৩/৪)


---- সেই শিবই ব্রহ্মা, বিষ্ণু সহ অন্যান্য দেবতাদের স্রষ্টা।


👉" য একঃ শাশ্বতোদেবোব্রহ্মবন্দ্যঃ সদাশিবঃ | ত্রিলোচনগুণাধারো গুণাতীতোহক্ষররোব্যয়ঃ || ৩ ||....দক্ষিণাঙ্গে সৃজাত্পুত্রং ব্রহ্মাণাং বামতো হরিম্ || ৫ || " (পদ্মপুরাণ/ পাতালখণ্ড/১০৮/৩-৫)


-- ত্রিগুণধর, ত্রিলোচন আবার একাধারে ত্রিগুণাতীত অক্ষর অব্যয় সদাশিব নিজের ডান ভাগ থেকে ব্রহ্মাকে এবং বামভাগ থেকে হরি/বিষ্ণুদেবকে সৃজন করেন। (ভেবে দেখুন - বৈষ্ণবদের পরমপ্রিয় সাত্ত্বিকপুরাণ পদ্মপুরাণ বলছে শৈবদের আরাধ্য সদাশিবের থেকে বৈষ্ণবদের আরাধ্য শ্রীহরি জন্ম নেন, অর্থাৎ বৈষ্ণব পুরাণ‌ও গুপ্ত ভাবে বলেই দিয়েছে যে পরমেশ্বর একজন‌ই)


👉"অদ্বৈতং নিষ্কলং নিষ্ক্রিয়ং শান্তং শিবং অক্ষরং অব্যযং হরি-হর-হিরণ্যগর্ভ স্রষ্টারং " (ভস্মজাবাল উপনিষদ /২/৭)


-- সেই অদ্বৈত শান্ত নির্গুণ নিষ্ক্রিয় সদাশিবই সাক্ষি অক্ষর ব্রহ্মরূপ, অব্যয় , তিনিই হরি(শ্রীবিষ্ণু), হর(সদাশিবেরলীলামূর্তি) এবং হিরণ্যগর্ভ(ব্রহ্মা) এনাদের স্রষ্টা।



👉 শৈবদের শাস্ত্র প্রমাণ ছাড়াও যদি অদ্বৈত স্মার্ত আচার্য শঙ্করের রচনাতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তবে দেখা যাবে --

 "বিরিঞ্চিঃ পঞ্চরত্নং ব্রজতি হরিরাপ্নোতি বিরতিং, বিনাশং কীনাশো ভজতি ধনদা যাতি নিধনম্ |......মহাসংহারেহমিন্ বিহরতি সতি ত্বৎপতিরসৌ" (সৌন্দর্যলহরী, আদিশঙ্করাচার্য/২৬)


---- মহাপ্রলয় কালে ব্রহ্মা পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হন(পঞ্চভূতে বিলীন) , শ্রীবিষ্ণুরও শরীর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়..... সেই সময় একমাত্র সতিপতি সদাশিবই বিহার করতে থাকেন।

সুতরাং দেখাগেল যে বিষ্ণুদেব, ব্রহ্মা সকলেই নিয়তির অধীন, তাঁরা কেউই অবিনশ্বর নয়। এখন তাঁদের সহ সর্বপ্রাণীর অন্তরে যে অবিনশ্বর পরমাত্মা রয়েছেন তিনি আসলে কে -


👉" হৃদয়ং সর্বভূতানাং ক্ষেত্রজ্ঞস্ত্বমৃষিস্তুতঃ | সর্বতঃ পাণিপাদস্ত্বং সর্বতোহক্ষিশিরোমুক্ষঃ || (মহাভারত/অনুশাসন পর্ব/ ১৩/৪১৫ )


--- শ্রীকৃষ্ণ বললেন সর্বভূতে এবং সর্বপ্রাণীর হৃদয়ে আপনিই (শিব) পরাচৈতন্য রূপে বাস করেন। ক্ষেত্রজ্ঞ ঋষিগণ আপনাকেই স্তুতি করে থাকেন। সর্ব জায়গায় সর্বজীবদেহেই আপনার হস্ত, পদ, শির , চক্ষু এবং মুখ অবস্থিত।


👉" সর্বাননশিরোগ্রীবঃ সর্বভূতগুহাশয় | 

সর্বব্যাপী স ভগবাংস্তস্মাৎ সর্বগতঃ শিবঃ ||" (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৩/১১)


--- সর্বভূতে সমগ্র জীবেদের মুখ, গলা, ঘাড় রূপে সেই সর্বব্যাপী শিবই আছেন এবং তিনিই প্রত্যেকের হৃদয়গুহায় প্রত্যগাত্মারূপে বিরাজিত।


👉" নানাবিদ্যাসমাযুক্তো জীবত্বেন বসাম্যহম্ |

তত্রাবিদ্যাসমাযুক্তং চৈতন্যং প্রতিবিম্বিতম্ |

ব্যবহারিকজীবন্তুঃ ক্ষেত্রজ্ঞঃ পুরুষোহপি বা || " (শ্রীশিবগীতা/১০/১৫ & ১৭)


--- মায়া, বিদ্যা, রাগ, কলা এই সকল মায়া কঞ্চুকা এবং অবিদ্যার সাথে সংযুক্ত হয়ে আমক শিব নিজে জীবাত্মা বা জীব রূপে বাস করি। সেই পরম চৈতন্যস্বরূপ আমি যখন এই সকাল অবিদ্যা সংযুক্ত হই তখন আমিই জীব/ক্ষেত্রজ্ঞ/পুরুষ নামে আখ্যায়িত হই। (এই পুরুষ হলেন সাক্ষাৎ জীবাত্মা/প্রত্যগাত্মা যা প্রকৃতির ভোক্তা। )---

👉" পুরুষো বৈ রুদ্র সন্মহো নমো নমঃ" (কৃষ্ণ যজুর্বেদ /তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/১৬)


👉" যং বেদাদৌ স্বরং প্রাহুর্বাচ্যবাচকভাবতঃ |

বেদৈকবেদ্যযাথাত্ম্যাদ্বৈদান্তে চ প্রতিষ্ঠিতঃ ||

তস্য প্রকৃতিলীনস্য যঃ পরঃ স মহেশ্বরঃ | "


(শিবমহাপুরাণ/বায়বীয় সংহিতা/পূর্বখণ্ড/৩২/৩২- ৩৩ এবং প্রায় একই রকমের শ্লোক আছে কৃষ্ণযজুর্বেদ/ তৈত্তিরীয় আরণ্যক /১০/১২ এ)


---- যে পুরুষের (পরমপুরুষ) সম্পর্কে যথার্থ ও সম্যক জ্ঞান বেদ ও বেদান্তে পাওয়া যায়, যিনি বেদের স্বর (বেদ কর্তৃক গীত হয়েছেন), যিনি বেদান্তে প্রতিষ্ঠিত সেই পুরুষই জীবাত্মারূপে প্রকৃতিতে লীন হয়ে প্রকৃতিকে ভোগ করে থাকেন। সুতরাং তিনি স্বয়ং আবার এই প্রকৃতি ও পুরুষেরও(জীবাত্মা) ঊর্ধ্বে। তাঁকেই মহেশ্বর বলা হয়। (পুরুষের ঊর্ধ্বে পরমপুরুষ = মহেশ্বর= ব্রহ্ম )


👉" জীবঃ শিবঃ শিবো জীবঃ স জীবঃ কেবলঃ শিবঃ |

পাশবদ্ধঃ স্মৃতো জীবঃ পাশমুক্তঃ সদাশিবঃ || " (কুলার্ণব তন্ত্র/৯/৪২)


সুতরাং এক পরমেশ্বর শিবই জীবাত্মারূপে পারমার্থিক পর্যায়ে বিভিন্ন স্তরে অবস্থান করছেন একথা প্রমাণিত হয়ে গেল।



🔘শ্রীভগবানুবাচ্ –


" অহমাত্মা পরেশানি পরাপর বিভেদতঃ |

দ্বিধাততঃ পরঃ সাক্ষী নির্গুণোনিষ্কল শিবঃ || ২১ ||

অপরঃ পঞ্চবক্ত্রোহহদ্বিধা তস্যাপি সংস্থিতিঃ |

শব্দার্থভেদতো বাচ্যো যথাত্মাহং মহেশ্বরঃ || ২২ ||

বক্ত্রাণিপঞ্চ জানীহি পঞ্চাধ্যাযানুক্রমাত্ |

দশাধ্যাযাভুজাশ্চৈক উদরংদ্বৌ পদাংবুজে || ২৭ ||

এবমষ্টাদশাধ্যাযাবাঙময়ী মূর্তিরেশ্বরী |

বিজ্ঞেযা জান মাত্রেণ মহাপাতকনাশিনী || ২৮ || "



👉বঙ্গানুবাদ –


ভগবানশ্রীবিষ্ণুদেব বললেন, আমার আত্ম স্বরূপের দুইটি ভেদ – পর ও অপর। ‘পর' স্বরূপই হচ্ছে নির্গুণ নিষ্কল শিবস্বরূপ (পরমশিব) এবং ‘অপর' স্বরূপ হচ্ছে পাঁচটি মস্তক যুক্ত (সদাশিব অর্থে)। আমার আত্ম স্বরূপই শব্দার্থ ভেদে মহেশ্বর নামে বাচিত হয়। (ভগবগীতার)পাঁচটি অধ্যায় সাক্ষাৎ পাঁচটি মস্তক স্বরূপ (সদাশিবের), (পরের)দশটি অধ্যায় দশটি বাহু স্বরূপ, পরের অধ্যায়টি উদর এবং তারপরের দুটো অধ্যায় তাঁর দুই পাদপদ্ম স্বরূপ।(ভগবদ্গীতার)এই অষ্টাদশ অধ্যায়কে যাঁরা এইরূপভাবে জানতে সক্ষম হন তাঁরাই মহাপাতক হতে উদ্ধার পান।


🔴ভাবার্থ –


আমার আত্মস্বরূপ অর্থাৎ সেই অদ্বৈত শিবের কথা বলা হয়েছে। শুধু বিষ্ণুদেব কেন আব্রহ্মকীটাদি সমগ্র জগতচরাচর ব্যাপ্ত সকল প্রমাতার আত্মস্বরূপই হলেন সাক্ষাৎ শিব। তাই পাশমুক্ত জীবই শিব, জীবই ব্রহ্ম 👉"তত্ত্বমসি" (তৎ+তম্+অসি)= তুমিই সেই ব্রহ্ম (ছান্দোগ্য উপনিষদ/৬/৮/৭)


👉নদী, নালা, পুকুর, খাল, বিল, হ্রদ, পুকুর, কলসী, পাত্র == ব্যবহারিক পর্যায় == ভেদভাব == ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, ইন্দ্র, দেবতা, গন্ধর্ব, অসুর জীব-জন্তু ইত্যাদি == মায়া প্রকৃতি থেকে সৃষ্ট, পাশবদ্ধ


👉জল == পারমার্থিক পর্যায় == অদ্বৈতভাব == পরমশিব(পরাচৈতন্য বা পরমাত্মা) == মায়া-প্রকৃতির ঊর্ধ্বে == পতি (পাশের সৃজাতা, নিয়ন্ত্রক, পরমেশ্বর শিব) 


🔻" স ব্রহ্মা স শিবঃ সেন্দ্রঃ সোঽক্ষরঃ পরমঃ স্বরাট্ |

স এব বিষ্ণুঃ স প্রাণঃ স কালোহগ্নিঃ স চন্দ্রমাঃ || " " (কৈবল্য উপনিষদ /১/৮) -------- সেই অদ্বিতীয় পরমেশ্বর সদাশিবই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, ইন্দ্রাদি দেবতার স্বরূপ ধারণ করেন। তিনিই পরম সত্য।


বিষ্ণুদেব সহ যে কোনো প্রমাতা বা জীবের (স্বেচ্ছায় পাশবদ্ধ শিব=জীব) মূল আত্মস্বরূপের দুইটি অবস্থা বর্তমান। একটি 'পর' অবস্থা অর্থাৎ নির্গুণ, নিষ্কল, পূর্ণব্রহ্ম পরমশিব অবস্থা এবং 'অপর' অবস্থাটি হল – পাঁচ মস্তক যুক্ত সাকার অবস্থা। ইনিই মহেশ্বর সদাশিব।তিনি সাকার হওয়া সত্ত্বেও মায়া এবং প্রকৃতি-পুরুষের ঊর্ধ্বে। তিনি শব্দব্রহ্মময়, সূক্ষ্মপ্রণব ও স্থূলপ্রণব দ্বারা বাচ্য এবং সাকার পরমেশ্বর। তিনি আসলে নিরাকার ও সাকারের মধ্যবর্তী অবস্থা, অদ্বৈত বেদান্তও যাঁকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে অসমর্থ কেননা বেদ/বেদান্ত সাক্ষাৎ তাঁরই বাণী/নিঃশ্বাস। তিনি সর্বশাস্ত্রময় এবং তাঁর পাঁচ মস্তক ভগবদ্গীতার পাঁচটি অধ্যায় স্বরূপ, তাঁর দশটি বাহু ভগবদগীতার দশটি অধ্যায় স্বরূপ, তাঁর উদর এবং চরণদ্বয় ভগবদগীতার শেষ তিনটি অধ্যায়স্বরূপ। সুতরাং তিনিই ভগবদ্গীতার ১৮টি অধ্যায় দ্বারা বাচিত হন, সমগ্র বেদ/বেদান্তের সারও তিনি। সুতরাং সেই অদ্বৈত শিবজ্ঞান এবং ভগবদ্গীতার জ্ঞানকে যিনি অভেদ দৃষ্টিতে অনুধাবন করবেন তিনিই নির্বাণ মোক্ষলাভের বা কৈবল্য লাভের বা পরমশিবপদ লাভের অধিকারী হবেন।


🍀🍀টীকা -


শ্রীবিষ্ণুদেব বলছেন "আমার দুটি স্বরূপ আছে"। ভগবদগীতায় কৃষ্ণ বলছেন - "আমি ভিন্ন অপর কেউ নেই"। এখানে 'আমি' কথাটির অর্থ বুঝতে হবে আগে। 


👉"অহং ব্রহ্মাস্মি" (বৃহদারণ্যক উপনিষদ/১/৪/১০) -- সেই ব্রহ্ম স্বয়ং আমি 👉" অহমস্মি পরং ব্রহ্ম পরাপরপরাৎপরম্ " -- আমিই পর, অপর এবং পরের থেকেও পরতম ব্রহ্ম। 👉" অযমাত্মা ব্রহ্ম " (মাণ্ডূক্য উপনিষদ ২ এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪/৪/৫) --- আমার আত্মস্বরূপই সেই ব্রহ্ম। 👉"আত্মা চিত্তম্"(শিবসূত্র/৩/১) - আত্মাস্বরূপ চিৎ ই শিব।


সুতরাং আমি অর্থাৎ আমার আত্মা অর্থাৎ 'আমি' শব্দে পরমেশ্বর শিব বাচিত হচ্ছেন।

👉"অহংপদস্যার্থভূতঃ সত্যাত্মা শিব ঈরিতঃ |" (শিবহাপুরাণ/কৈলাস সংহিতা/১৯/১৯)--- সুতরাং অহং বা আমি বা সোহহং বা অহং ব্রহ্মাস্মি প্রভৃতি বাক্যগুলির ক্ষেত্রে অহং বলতে তা শিবকেই বোঝানো হবে। সেই পরমেশ্বর শান্ত কারণত্রয় শিবের স্তুতি করে মাণ্ডূক্য উপনিষদ বলছে - "শান্তং শিবং অদ্বৈতং চতুর্থং মন্যন্তে | স আত্মা | স বিজ্ঞেযঃ || " ( মাণ্ডূক্য শ্রুতি/৭)


সেই নির্গুণ শিবই পরমশিব। 👉"অস্তি দেবি পরব্রহ্মস্বরূপি নিষ্কল শিবঃ |" (কুলার্ণব তন্ত্র/ ১/৭)

👉" নিষ্কলং সকলং ব্রহ্ম নির্গুণং গুণগোচরম্ | " (মহাভারত/অনুশাসন পর্ব /১৫/তণ্ডি ঋষির শিবস্তব) 👉 " ....শুদ্ধং শিবং শান্তং নির্গুণং ইত্যাদিবাচকং অনির্বাচং চৈতন্যং ব্রহ্মং...|| " (শুক্ল যজুর্বেদীয় নিরালম্ব উপনিষদ/৩)


সুতরাং পরমেশ্বর সদাশিবের নিষ্কল , নির্গুণ পরমব্রহ্ম এবং পরমাত্মা স্বরূপের প্রমাণকে একাধিক শাস্ত্রবচন ও শব্দপ্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করা হল।


🔴সেই পরমাত্মা যখন পূর্ণস্বরূপে সাকার হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তখন তিনি প্রথমে নিষ্কল-সকল মধ্যবর্তী অবস্থায় আসেন - তাকে যিনি সদাশিব।

👉 "শিবঃ সদাশিবশ্চৈব মহেশশ্চ ত্রিধা ভবেত্ ||

শিবং পরমসংযুক্তং নির্গুণং নিষ্কলং ধ্রুবম্ | ৬

তস্মাৎ সদাশিবং তত্ত্বং সকলং নিষ্কলান্বিতম্ |

ব্যক্তাব্যক্তময়ং সূক্ষ্মং নাদরূপমনামযম্ ||"

(দীপ্ত আগম/প্রথম পটল/ ৫, ৬ & ৮)


-- শিব(পরমশিব), সদাশিব ও মহেশ্বর(রুদ্রদেব) -- এই তিনতত্ত্ব শৈবসিদ্ধান্তে মান্য।একেই সমগ্র শাস্ত্রে গুপ্তভাবে বর্ণনা করেছে। পরমশিব পূর্ণ নির্গুণ, নিষ্কল ও পরমতত্ত্ব। তিনি সদাশিব স্বরূপে ব্যক্ত হন। সদাশিব হলেন সগুণ ও নির্গুণের মধ্যবর্তী অবস্থা, ব্যক্ত ও অব্যক্তের অন্তর্বর্তী অবস্থা। তিনি নাদরূপী।


সেই সদাশিবকে স্তুতি করে(পঞ্চবক্ত্র, দশভূজ) শ্রুতিশাস্ত্র বলছে - 👉"ঈশান সর্ববিদ্যানাং ঈশ্বর সর্বভূতানাং.. " (কৃষ্ণ যজুর্বেদ /তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/৪৭) --- সেই সদাশিবই যে ভগবদ্গীতাসহ বেদ, বেদান্ত আদি সমগ্র বিদ্যার অধিপতি এবং সাক্ষাৎ বেদ ও গীতাস্বরূপ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। 👉"বেদকর্ত্তা বেদপতিস্তস্মাচ্ছংভুরুদাহৃতঃ" (শিবমহাপুরাণ/কোটিরুদ্র সংহিতা/৪২/২৩)


এখন দেখে নেব সেই ওঁকারে স্বরূপ কি। 👉"সুক্ষ্মমেকাক্ষরং বিদ্যাৎ স্থূলং পপঞ্চাক্ষং বিদুঃ |

স্থূলপ্রণবরূপং হি শিব পঞ্চাক্ষরং দ্বিজা" || (শিবমহাপুরাণ/বিদ্যেশ্বর সংহিতা/১৭/৯ & ৩৩) ------প্রণব ওঁকারের পাঁচটি মাত্রা (অ, উ, ম, বিন্দু ও নাদ) যখন সূক্ষ্ম ভাবে অবস্থান করে তখন তা সূক্ষ্ম একাক্ষর প্রণব ॐ (পরমশিব) । 


যখন সেই প্রণবের মাত্রাগুলি যখন ব্যক্ত হয় তখন তাঁকে স্থূল প্রণব বলে। এই স্থূল প্রণবই সাক্ষাৎ শিব পঞ্চাক্ষর মন্ত্র ।

(নমঃ শিবায়, নকার =অ=সদ্যোজাত, মকার=উ=বামদেব , 

শিকার=ম=অঘোর,

বাকার = বিন্দু = তৎপুরুষ

যকার = নাদ = সদাশিব, নমঃশিবায়= ॐকার = পরমেশ্বর সদাশিব)


👉"শিবো মা প্রণবো হ্যেষ প্রণবো বা শিবঃ স্মৃতঃ |

বাচ্যবাচকযোর্ভেদো নাত্যন্তং বিদ্যতে যতঃ || ৭ ||" (শিবমহাপুরাণ/কৈলাসসংহিতা/৩/৭) - প্রণব ওঁকারই সাক্ষাৎ শিব এবং শিবই প্রণব। শিব বাচ্য এবং প্রণব বাচক। এই বাচ্য ও বাচকের মধ্যে কোনো ভেদ নেই।


সুতরাং শাস্ত্র থেকে এটাও প্রমাণ করা হল যে - সেই নির্গুণ পরমাত্মা পরমশিবই সাকারে পঞ্চব্রহ্ম, ৩৮কলাময় সদাশিব। তিনিই প্রণব দ্বারা বাচ্য, তিনিই সর্ববিদ্যার ঈশ্বর(শক্তিরপতি)। সুতরাং তিনিই সাক্ষাৎ ভগবদ্গীতা সহ বেদ, বেদান্ত ও বেদাঙ্গেরও সার(বেদসার শিব স্তব - আদিশঙ্করাচার্যকর্তৃক অনুদিত) ।


💥🔵সিদ্ধান্ত:-


শ্রুতি, পুরাণ, ইতিহাস ও আগমের নিরিখে উপর যে তাত্ত্বিক বিশ্লেষ বিশ্লেষণ করা হল তাতে একটি কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে সকল জীব, দেবতা, দানব, মনুষ্য সবাই সেই অদ্বিতীয় শিবের থেকে অভিন্ন। কেননা শিব ব্যতীত অপর কেউ নেই। ("একো হি রুদ্র ন দ্বিতীযায তস্থুর্য" -- শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৩/২)। অজ্ঞানতা, মায়া ও মলসংযুক্ত হওয়ায় জীব নিজের তূরীয় শিব স্বরূপ অন্তরাত্মাকে উপলব্ধি করতে পারে না। তাই যোগী ,ঋষি ও সাধকগণ মায়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে নিজের আত্মার মধ্যেই সেই পরমেশ্বর শিবকে প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হন এবং মোক্ষলাভ করে থাকেন অর্থাৎ ব্রহ্মে বিলীন হয়ে নিজেই ব্রহ্মস্বরূপ হয়ে যান(পরমহংস)। যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণও যোগযুক্ত অবস্থায় পরমব্রহ্ম পরমাত্মা সেই শিবের সাথে একাত্ম হয়েই সেই ভগবদ্গীতা জ্ঞান প্রদান করতে সক্ষম হয়েছিলেন (👉" পরং হি ব্রহ্ম কথিতং যোগযুক্তেনতন্মযা" -- মহাভারত/আশ্বমেধিক পর্ব/১৭/১৩- আমি গীতাজ্ঞান প্রদানের সময় যোগযুক্ত হয়ে পরমব্রহ্মের স্বরূপ সম্পর্কে বলেছিলাম। ) সুতরাং ভগবদ্গীতা জ্ঞান যে আসলেই শিবতত্ত্ব ও শিবস্বরূপ পরমেশ্বরের বাচক সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একই কথাই শ্রীবিষ্ণুদেব তাঁর পত্নী লক্ষ্মী দেবীকে বুঝিয়েছেন। শ্রীবিষ্ণুর অন্তরেও যে আত্মচৈতন্য রয়েছেন তিনিই তৎ পদ বাচ্য এবং সচ্চিদানন্দ বেদান্ত বেদ্য ব্রহ্ম, তিনিই পরমশিব। সেই নিরাকার নির্গুণ নিরঞ্জন তূরীয়/তূরীয়াতীত পরমশিবেরই স্থূলরূপ সদাশিব, তিনি সহস্রার জ্ঞানকৈলাস নিবাসী, নিরকার হয়েও সাকার। তিনি প্রকৃতি-পুরুষের ঊর্ধ্বে, শুদ্ধসাত্ত্বিক ও শুদ্ধস্ফটিক বর্ণের যার অর্থ হল - তিনি পঞ্চভূতাত্মক দেহধারী এমনকি লিঙ্গশরীরধারী প্রমাতাদেরও ঊর্ব্বে। তাই তাঁকে নিষ্কল-সকল অবস্থা স্বরূপে বর্ণিত করা হয়েছে শাস্ত্রে। অদ্বৈতবেদান্তও এই অবস্থাকে সঠিক ব্যাখ্যা করতে সক্ষম নয়। ভগবদ্গীতার মূল আলোচ্চ বিষয়টি যে একমাত্র পরমেশ্বর শিব, যা স্বয়ং বৈষ্ণবদের পরমপ্রিয় সাত্ত্বিকপুরাণ পদ্মপুরাণ শব্দপ্রমাণ সহ প্রকাশিত করেছে। 


👉সংগ্রহ, লেখনী ও বিশ্লেষণে - ©RohitKumarChoudhury(ISSGT)


👉সম্পাদনায় - শ্রীকৌশিক রায়


👉কপিরাইট ও প্রচারে - International Shiva Shakti Gyan Tirtha- ISSGT

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত