শিবরাত্রি ব্রতকথা - অজান্তেই শিব চতুর্দশীতে শিবপূজা করে এক ব্যাধের ভোগ ও মোক্ষ লাভ

 


ধৈর্য্য ধরে সম্পূর্ণ শিবরাত্রি ব্রতকথা পাঠ করুন। এটি শিবমহাপুরাণ থেকে নেয়া হয়েছে। 

🌷সংগ্রহ ও পরিমার্জিত করেছেন শ্রী কৌশিক রায় শৈবজী(নন্দীনাথ শৈব)। 

🔥প্রচার ও কপিরাইট - ISSGT (INTERNATIONAL SHIVA SHAKTI GYAN TIRTHA)

নিম্নোক্ত মহাপবিত্র শিবরাত্রি ব্রতকথা টি ভক্তি সহকারে পাঠ করুন ও অনান্য শিবভক্ত শৈবগণকেও শ্রবণ করান। এটি পঠনকারী ও শ্রবণকারী উভয়েরই সর্বোমনোস্কামনা পূর্ণ করে ও পাপমুক্ত করে থাকে। শিব সহিত সর্বদেবতা প্রসন্ন হন।তাই শিবরাত্রি ব্রতকথা অবশ্য‌ই ভক্তি সহকারে স্বচ্ছ হৃদয়ে পাঠ করা বাঞ্ছনীয়।


॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥


সূতমুনি ঋষিগণেদের কাছে শিবরাত্রির ব্রতকথা বলতে শুরু করলেন। 

সূতমুনি বললেন 

হে ঋষিগণ ! তোমরা সকলে শোনো! আমি শিবরাত্রি বিষয়ে এক প্রাচীন নিষাদের ইতিহাস শোনাচ্ছি, যা সর্বপাপনাশকারী।

বহু পূর্বের কথা(সত্যযুগের) — 

 এক বনে এক ভীল(ব্যাধ) বাস করত, তার নাম ছিল গুরুদ্রুহ। তার পরিবারে অনেক লোক ছিল, সে বলবান এবং ক্রূর স্বভাব হওয়ার সঙ্গে ক্রূরতাপূর্ণ কর্মেও তৎপর থাকত। প্রত্যহ বনে গিয়ে সে মৃগ(হরিণ) বধ করত এবং সেখানেই থেকে নানাপ্রকার চুরি-চামারি করত। অল্পবয়স থেকেই সে কোনো শুভকর্ম করেনি। এইভাবে প্রত্যহ বনে থাকতে থাকতে সেই দুরাত্মা ব্যাধের অনেক বছর কেটে গেল। তারপর একদিন অত্যন্ত সুন্দর এবং শুভকারক শিবরাত্রি এলো। কিন্তু সেই দুরাত্মা ঘন জঙ্গলে বাস করত, তাই সে ব্রত সম্পর্কে কিছু জানত না। সেদিন সেই ভীলের মাতা-পিতা এবং পত্নী ক্ষুধায় কাতর হয়ে তাকে বলল— ‘বনচারী ! আমাদের কিছু খেতে দাও।'


তাদের কথা শুনে সে তৎক্ষণাৎ ধনুক নিয়ে বেরিয়ে গেল এবং মৃগ শিকারের জন্য বনে ঘুরতে লাগল। দৈবযোগে সেই দিন সে কিছুই পেল না, এদিকে সূর্য অস্ত গেল। 

তখন তার খুব দুঃখ হল, সে ভাবতে লাগল— 

  “এবার আমি কী করব ? কোথায় যাব ? আজ তো কিছুই পেলাম না, ঘরে যে বাচ্চারা আছে তাদের আর আমার মা-বাবার কী হবে ? 

সুতরাং আমাকে ঘরে কিছু নিয়েই যেতে হবে; অন্যথা নয়।'

 এই ভেবে ব্যাধ একটি জলাশয়ের কাছে গেল আর জলে নামার ঘাটের কাছে অপেক্ষা করতে লাগল। সে মনে মনে চিন্তা করছিল

  “এখানে কোন না কোন জীব জলপান করতে অবশ্যই আসবে। তাকে মেরে প্রসন্ন মনে গৃহে যাব।”

 এই ভেবে সেই ব্যাধ নিজের জন্য পানীয় একটি জলপাত্র নিয়ে নিজের অজান্তেই একটি বেল গাছের ওপর উঠে বসল। তার মনে শুধু এই চিন্তাই ছিল যে কখন সেখানে কোনও প্রাণী আসবে এবং কখন তাকে বধ করবে। সেই প্রতীক্ষায় সে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে সেখানে বসে অপেক্ষা করতে থাকলো।

 রাত্রের প্রথম প্রহরে সেখানে এক তৃষ্ণার্ত হরিণী এসে জোরে জোরে জলপান করছিল। সেই মৃগীকে দেখে ব্যাধ খুব আনন্দিত হল এবং তাকে মারবার জন্য তাড়াতাড়ি তার বাণে এক শরসন্ধান করল। এটা করতে গিয়ে তার হাতের ধাক্কায় সেই জলেরপাত্র থেকে কিছু পরিমান জল এবং কয়েকটি বেলপাতা নীচে পড়ে গেল। সেই বেলগাছের নীচে একটি শিবলিঙ্গ ছিল। সেই জল ও বিল্বপত্রের দ্বারা শিবের প্রথম প্রহরের পূজা সম্পন্ন হল। সেই পূজার মাহাত্ম্যে ব্যাধের বহু পাপ তখনই নাশ হয়ে গেল। সেখানকার খটখট শব্দ শুনে হরিণী ভয় পেয়ে ওপর দিকে তাকাল। ব্যাধকে দেখেই সে ব্যাকুল হয়ে বলল—

হরিণী বলল —

ব্যাধ ! তুমি কী করতে চাও, আমাকে সত্য করে বলো।

হরিণীর কথা শুনে ব্যাধ বলল – 

আজ আমার পরিবারের সবাই ক্ষুধার্ত হয়ে আছে ; তাই তোমাকে বধ করে তাদের ক্ষুধা মেটাব, তাঁদের তৃপ্ত করব।

ব্যাধের এই ভয়ংকর কথা শুনে এবং যাকে বাধা দেওয়া কঠিন, সেই দুষ্ট ব্যাধকে বাণ লক্ষ্য করতে দেখে মৃগী ভাবতে লাগল যে 

‘এবার আমি কী করব ? কোথায় যাব ? আচ্ছা একটা উপায় বার করি।' 

এই কথা ভেবে হরিণী ব্যাধকে উদ্দেশ্য করে বলল —

হরিণী বলল—

 হে ভীল ! আমার মাংসে তুমি সুখ পাবে, এই অনর্থকর দেহের জন্য এর থেকে বেশি মহাপুণ্য কার্য আর কী হতে পারে ? উপকারকারী প্রাণীর ইহলোকে যে পুণ্যলাভ হয়, শত বৎসরেও তা বর্ণনা করা যায় না। কিন্তু এখন আমার বাচ্ছারা সব আমার আশ্রমেই আছে। আমি তাদের আমার বোন অথবা আমার স্বামীর কাছে সমর্পণ করে ফিরে আসব। বনেচর ! তুমি আমার এই কথা মিথ্যা বলে মনে কোরো না । আমি তোমার কাছে আবার আসব, এতে কোনো সংশয় নেই। সত্যের দ্বারাই পৃথিবী টিকে আছে, সত্য দ্বারাই সমুদ্র নিজ মর্যাদায় অবস্থিত এবং সত্যের দ্বারাই নির্ঝর থেকে জলধারা প্রবাহিত হয়। সত্যেই সব কিছু অবস্থিত।


সূতদেব বললেন—মৃগী একথা বললেও ব্যাধ যখন তার কথা মেনে নিল না, তখন সে অত্যন্ত বিস্মিত এবং ভয়সন্ত্রস্ত হয়ে বলতে শুরু করল।


হরিণী বলল—

ব্যাধ ! শোনো, তোমার সামনে আমি এমন শপথ করছি, যাতে ঘরে গিয়ে আমি তোমার কাছে অবশ্যই ফিরে আসব। ব্রাহ্মণ যদি বেদ বিক্রয় করে এবং ত্রিকাল সন্ধ্যা না করে, তাহলে তার যে পাপ হয়, পতির আদেশ উল্লঙ্ঘন করে স্বেচ্ছাচারিতা করলে নারীদের যে পাপ প্রাপ্তি হয়, উপকারীর উপকার স্বীকার না করলে, ভগবান শংকরের থেকে বিমুখ হয়ে থাকলে, অন্যের সঙ্গে শত্রুতা করলে, ধর্ম লঙ্ঘন করলে এবং বিশ্বাসঘাতকতা ও ছলনাকারীদের যে পাপ হয়, সেই পাপে আমিও লিপ্ত হব, যদি আমি পুণরায় ফিরে না আসি।


এইভাবে অনেক শপথ করে হরিণী যখন চুপ করে দাঁড়াল তখন ব্যাধ তাকে বিশ্বাস করে বলল—

“আচ্ছা, এখন তুমি তোমার ঘরে যাও।' 

তখন সেই হরিণী তখন হর্ষের সঙ্গে জল পান করে তার আশ্রমে চলে গেল। এর মধ্যে জাগ্রত অবস্থায় ব্যাধের রাতের প্রথম প্রহর কেটে গেল। এদিকে সেই হরিণীর বোন, তার দিদিকে খুঁজতে খুঁজতে সেইখানে জল পান করতে এলো। তাকে দেখে সেই ব্যাধ তার তূণীর থেকে বাণ বার করল। তাতে আগের মতোই  শিবলিঙ্গের ওপর আবার কিছুপরিমাণ জল ও বিল্বপত্র পড়ল। তার দ্বারা মহাত্মা শম্ভুর দ্বিতীয় প্রহরের পূজা সম্পন্ন হয়ে গেল। যদিও তা প্রসঙ্গবশতঃ হয়েছিল, কিন্তু তা ব্যাধের পক্ষে সুখদায়ক হয়েছিল। হরিণী তাকে বাণ তুলতে দেখে জিজ্ঞাসা করল — 

'বনচারী ! কী করছ ?' 

ব্যাধ আগের মতোই জবাব দিল, ‘আমি আমার ক্ষুধার্ত পরিজনদের তৃপ্ত করার জন্য তোমাকে বধ করব।' 

তাই শুনে হরিণী বলল। 

হরিণী বলল – 

“ব্যাধ ! আমার কথা শোন। আমি ধন্য। আমার দেহধারণ করা সফল হয়েছে; কারণ এই অনিত্য শরীর দিয়ে উপকার হবে। কিন্তু আমার ছোটো বাচ্ছারা ঘরে আছে। সুতরাং আমি একবার গিয়ে তাদের আমার স্বামীর কাছে সমর্পণ করি, পরে তোমার কাছে ফিরে আসব।’

ব্যাধ বলল – 

তোমার কথা আমি বিশ্বাস করি না,

আমি তোমাকে বধ করব, এতে কোনো সংশয় নেই।


তা শুনে সেই হরিণী ভগবান বিষ্ণুর শপথ করে বলল—

‘ব্যাধ ! আমি যা বলছি শোনো!

 যদি আমি ফিরে না আসি তবে আমার সমস্ত পুণ্য যেন নষ্ট হয়ে যায়; কারণ যে কথা দিয়ে তা রাখে না, তার সব পুণ্য বিনাশপ্রাপ্ত হয়। যে ব্যক্তি তার বিবাহিতা নারীকে ত্যাগ করে অন্যের কাছে যায়, বৈদিক ধর্ম উল্লঙ্ঘন করে কপোলকল্পিত ধর্ম অনুসরণ করে, ভগবান বিষ্ণুর ভক্ত হয়ে শিবনিন্দা করে, মাতা-পিতার মৃত্যু-তিথিতে শ্রাদ্ধ ইত্যাদি না করে এমনিই কাটিয়ে দেয় এবং নিজের দেওয়া কথা পূরণ করতে কষ্ট বোধ করে, সেই সব লোকেদের যে পাপ হয়, আসি।’ সেই পাপ যেন আমারও হয় — যদি আমি ফিরে না আসি।’

সূতদেব বললেন —

হরিণী একথা বলায় ব্যাধ তাকে যেতে দিল। মৃগী জল পান করে আনন্দে আশ্রমে ফিরে গেল। তাতে রাতের দ্বিতীয় প্রহরও ব্যাধের জেগে জেগেই কেটে গেল। এর মধ্যে তৃতীয় প্রহর শুরু হল, হরিণীর আসতে অনেক দেরি হচ্ছে দেখে ব্যাধ সচকিত হয়ে ওখানে বসেই তাকে খুঁজতে লাগল। তখন সে জল খেতে আগত আরেক হরিণকে দেখতে পেল, সেটি অত্যন্ত হৃষ্ট-পুষ্ট ছিল। তাকে দেখে ব্যাধ অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তাকে মারবার জন্য ধনুকে বাণ নিয়ে উদ্যত হল। তা করতে গিয়ে ব্যাধের প্রারব্ধবশতঃ কিছুপরিমাণ জল ও বিল্বপত্র আবার শিবলিঙ্গের ওপর পড়ল। সৌভাগ্য বশতঃ এতে পরমেশ্বর শিবের তৃতীয় প্রহরের পূজা সম্পন্ন হল। পরমেশ্বর লীলাবশত এইভাবে তার ওপর নিজ দয়া দেখালেন। 

পাতা পড়ার শব্দে মৃগ ব্যাধের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল—

‘তুমি কী করছ ?'


 ব্যাধ উত্তর দিল — "আমি আমার আত্মীয়দের আহারের জন্য তোমাকে বধ করব।”


ব্যাধের কথা শুনে হরিণের মনে খুব আনন্দ হল এবং সে ব্যাধকে তৎক্ষণাৎ বলল।


হরিণ বলল — 

 আমি ধন্য। আমার হৃষ্ট-পুষ্ট হওয়া সার্থক ; কারণ আমার শরীরে আপনারা তৃপ্ত হবেন। যার শরীর পরোপকারের কাজে আসে না, তার সব কিছু ব্যর্থ হয়। যে সামর্থ্য থাকলেও কারো উপকার করে না, তার সেই সামর্থ্য বৃথা নষ্ট হয় এবং সে পরলোকে নরকগামী হয়। কিন্তু আমাকে একবার যেতে দাও। আমি আমার বাচ্ছাদের তাদের মায়ের কাছে সমর্পণ করে এবং তাদের ধৈর্য ধারণ করতে বলে এখানে ফিরে আসব।


তার কথা শুনে ব্যাধ মনে মনে বড়ো বিস্মিত হল। এর‌ই মধ্যে তার হৃদয় কিছুটা শুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল নিজের‌ই অজান্তে, তার সমস্ত পাপ বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সে তখন বলল।


ব্যাধ বলল —

 যারা যারা এখানে এসেছে, তারা সকলেই তোমার মতো কথা দিয়ে চলে গেছে, কিন্তু সেই প্রবঞ্চকেরা কেউ ফিরে আসেনি। 

মৃগ ! তুমিও এখন সংকটে রয়েছ, তাই মিথ্যা কথা বলে চলে যাবে। তাহলে আজ আমার জীবন-নির্বাহ কীভাবে হবে ?


মৃগ(হরিণ) বলল —

 ব্যাধ ! আমি যা বলছি শোনো! আমার কথার মধ্যে অসত্য নেই। সমগ্র চরাচর ব্রহ্মাণ্ড সত্যের ওপরেই প্রতিষ্ঠিত। যার বাক্য মিথ্যা হয়, তার পুণ্য তখনই নষ্ট হয়ে যায় ; তবুও হে ভীল । তুমি আমার সত্য প্রতিজ্ঞা শোনো। সন্ধ্যার সময় মৈথুন(সহবাস) বা শিবরাত্রির দিন আহার করলে যে পাপ হয়, সেই পাপ আমারও লাগবে, যদি আমি ফিরে না আসি। যার মুখ থেকে কখনও শিবের নাম বার হয় না, যে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অন্যের উপকার করে না, পর্বের দিন শ্রীফল(বেল) পাড়ে, অভক্ষ্য(যা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা উচিত নয়) ভোজন করে এবং পরমেশ্বর শিবের পূজা না করে, ভস্ম(এবং ত্রিপুণ্ড) কপাল সহ দেহের অনান্য স্থানে না লাগিয়ে আহার করে, তাদের সকলের পাপ আমার লাগবে, যদি আমি ফিরে না আসি।


সূতদেব বললেন —

 তার কথা শুনে ব্যাধ বলল ‘যাও, শীঘ্র ফিরে এসো।' ব্যাধের কথা শুনে সেই হরিণ জলপান  করে চলে গেল। হঠাৎ ই সেই সমস্ত হরিণ তাদের নিজস্ব আশ্রমে মিলিত হল। তিনজনই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল। নিজেরা একে অন্যের কথা ভালোভাবে শুনে সত্যপাশে আবদ্ধ তারা স্থির করল, সেখানে অর্থাৎ ব্যাধের কাছে অবশ্যই যাওয়া উচিত। এরূপ স্থির করে তারা ওই হরিণেরা তাদের বাচ্চাদের আশ্বস্ত করে সকলেই সেখানে যাবার জন্য উৎসুক হল। 

সেইসময় জ্যেষ্ঠা হরিণী তার স্বামীকে বলল—

 ‘স্বামিন্ ! আপনাকে ছাড়া বালকেরা এখানে কী করে থাকবে ? 

হে প্রভো! আমিই ওখানে প্রথমে প্রতিজ্ঞা করেছি, তাই শুধু আমারই যাওয়া উচিত। 

আপনারা দুজন এখানেই থাকুন।' 


তার কথা শুনে কনিষ্ঠা হরিণী বলল—‘ভগিনী ! আমি তোমার সেবিকা, তাই আজ আমি ব্যাধের কাছে যাচ্ছি। তুমি এখানে থাকো।' 


একথা শুনে মৃগ(পুরুষ হরিণ) বলল —

আমিই সেইখানে যাচ্ছি। তোমরা দুজন এখানে থাক; কারণ মায়ের দ্বারাই শিশু রক্ষা হয়ে থাকে। স্বামীর কথা শুনে দুই হরিণী ধর্মের দৃষ্টিতে তা স্বীকার করল না। 

তারা দুজনে তাদের পতিকে বলল—‘প্রভো! পতি বিনা এই জীবনে ধিক্কার।’ 


তখন হরিণেরা বাচ্চাদের সান্ত্বনা দিয়ে তাদের প্রতিবেশী হরিণদের কাছে সমর্পণ করে, নিজেরা সেই স্থানে গেল, যেখানে সেই ব্যাধ তাদের প্রতীক্ষায় বসে ছিল। তাদের চলে যেতে দেখে তাদের বাচ্চারাও তাদের অনুসরণ করল। তারা ঠিক করেছিল যে আমাদের মাতা পিতার যে গতি হবে, আমাদেরও তাই হোক। তাদের সকলকে আসতে দেখে ব্যাধ অত্যন্ত আনন্দিত হল। সে ধনুকে বাণ চড়াল। সেই সময় আবারো কিছুপরিমাণ জল ও বিল্বপত্র শিবলিঙ্গের ওপর পড়ল। তাতে শিবের চতুর্থ প্রহরের শুভ পূজাও সম্পন্ন হয়ে গেল। ফলে ব্যাধের সমস্ত পাপ তৎক্ষণাৎ ভস্ম হয়ে গেল।

 এরমধ্যে দুই হরিণী ও সেই হরিণ বলে উঠল –

 ‘ব্যাধশিরোমণি ! শীঘ্র কৃপা করে আমাদের শরীরকে সার্থক করো।’

তাদের কথা শুনে ব্যাধ অত্যন্ত বিস্মিত হল। শিবপূজার প্রভাবে অজান্তেই দুর্লভ জ্ঞান তার হৃদয়ে প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল। 

ব্যাধ ভাবল— ‘এই জ্ঞানহীন মৃগগুলি পশু হয়েও ধন্য, সর্বতোভাবে আদরণীয়; কারণ তারা নিজেদের শরীর দ্বারাই পরোপকারে ব্যাপৃত হয়েছে। অথচ আমি মনুষ্যজন্ম লাভ করেও আজ পর্যন্ত কোন পুরুষার্থ সাধন করেছি ? শুধুমাত্র অন্যের শরীরকে কষ্ট দিয়ে নিজ শরীর পোষণ করেছি। প্রতিদিন নান পাপ করে নিজ আত্মীয়দের পালন করেছি । হায় ! এমন পাপের ফলে আমার কী গতি হবে ? জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত আমি যত পাপ করেছি, এখন আমার সেসব স্মরণ হচ্ছে। আমার জীবনকে ধিক্কার, ধিক্কার।”


 এইভাবে জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে অনুতপ্ত ব্যাধ তার বাণ সংহত করে বলল –

 ‘শ্রেষ্ঠ মৃগগণ ! তোমরা যাও, তোমাদের জীবন ধন্য।’


ব্যাধ এই কথা বলায় পরমেশ্বর শিব তখনই প্রসন্ন হয়ে গেলেন এবং সেখানেই প্রকট হয়ে নিজের সম্মানিত ও পূজিত স্বরূপ(সদাশিবস্বরূপ) ব্যাধকে দর্শন করালেন, 

তারপর কৃপাপূর্বক ব্যাধের শরীর স্পর্শ করে প্রেমসহকারে বললেন — ‘ভীল ! আমি তোমার ব্রতের দ্বারা প্রসন্ন হয়েছি। বর চাও।' 


ব্যাধ পরমেশ্বরের সেই অপূর্ব অবর্ণনীয় দিব্য রূপ দেখে তখনই জীবন্মুক্ত হয়ে গেল এবং ‘আমি সব কিছু পেয়ে গিয়েছি’ বলতে বলতে প্রভু সদাশিবের চরণে গিয়ে পড়ল। তার এই ভাব দেখে পরমেশ্বর শিবও মনে মনে অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে তাকে ‘গুহক’ নামে সম্বোধন করে কৃপাদৃষ্টিতে অবলোকন করে তাকে দিব্য বর প্রদান করলেন।


পরমেশ্বর প্রভু সদাশিব বললেন —

ব্যাধ! আজ থেকে প্রথমে তুমি শৃঙ্গবেরপুরে উত্তম রাজধানীর আশ্রয়ে দিব্য ভোগ উপভোগ করো। তোমার বংশ নির্বিঘ্নে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে, দেবতাগণও তোমার প্রশংসা করবেন।

 ব্যাধ ! আমার ভক্তদের ওপর স্নেহকারী আমার‌ই পরমভক্ত শ্রীরাম ভবিষ্যতে একদিন অবশ্যই তোমার গৃহে পদার্পণ করবেন এবং তোমার সঙ্গে মিত্রতা করবেন। তুমি আমার সেবায় মন লাগিয়ে অবশেষে অন্তিমে দুর্লভ মোক্ষ লাভ করবে অর্থাৎ আমার সাযুজ্য(শিবসাযুজ্য/কৈবল্যমুক্তি) লাভ করবে ।


সেই সময় ঐসব হরিণেরা পরমেশ্বর সদাশিবের পরমস্বরূপ দর্শন করে ও প্রণাম করে মৃগযোনী থেকে মুক্ত হয়ে দিব্যদেহ ধারণ করে উত্তম দিব্যবিমানে বসে পরমেশ্বরের দর্শন লাভমাত্র শাপমুক্ত হয়ে দিব্যধামে চলে গেল। 

তখন থেকে অর্বুদ পর্বতে ভগবান শিব ব্যাধেশ্বর নামে প্রসিদ্ধ হলেন, যাঁকে দর্শন ও পূজা করলে তখনই ভোগ ও মোক্ষ লাভ হয়। 


হে মহর্ষিগণ ! সেই ব্যাধও ঐদিন থেকে দিব্য ভোগ উপভোগ করে নিজ রাজধানীতে বসবাস করতে লাগল।  শিবভক্ত পরমশৈব শ্রীরামের সাথে মিত্রতা লাভ করে সেই ব্যাধ শেষে শিবকৃপায় শিবের সাযুজ্য প্রাপ্ত করেন। অজান্তেই এই ব্রত অনুষ্ঠান করায় তার সাযুজ্য মোক্ষ প্রাপ্তি হয়; তাহলে যে ভক্তিভাবসম্পন্ন হয়ে এই ব্রত করে, সে শিবের শুভ সাযুজ্য যে লাভ করবে, তাতে তো বলারই কিছু নেই। সম্পূর্ণ শাস্ত্র এবং নানাপ্রকার ধর্মের বিষয়ে ভালো-ভাবে বিচার করে শিবরাত্রি ব্রতকে সব থেকে উত্তম বলা হয়েছে।  ইহলোকে যে নানাপ্রকারের ব্রত, বিবিধ তীর্থ, নানাপ্রকার বিচিত্র দান, অনেক প্রকার যজ্ঞ, বিবিধ প্রকারের তপস্যা ও জপ আছে, সে সবই এই শিবরাত্রির ব্রতের সমান হতে পারে না। তাই নিজ হিতাকাঙ্ক্ষী মানুষদের এই শুভতূর ব্রত অবশ্য পালন করা উচিত। এই শিবরাত্রি ব্রত অত্যন্ত দিব্য। এর দ্বারা সর্বদা ভোগ ও মোক্ষ প্রাপ্তি হয়। মহর্ষিগণ ! এই শিবরাত্রি-ব্রত ব্রতরাজের নামে বিখ্যাত। এর বিষয়ে সব কিছু আমি তোমাদের জানালাম। 


 (তথ্যসূত্র - শিবমহাপুরাণ/কোটিরুদ্রসংহিতা/অধ্যায় নং ৪০)

🔥নন্দীনাথ শৈব কথিত নীতিকথা : প্রভু পরমেশ্বর শিব প্রসন্নতার কারণ হল, নিষ্ঠুর ব্যাধের নিজকৃত কর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়া ও দয়াভাব। নিজকৃ সুতরাং, আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে পাপকর্ম থেকে বিরত হয়ে সৎমার্গে শিবনামের সহিত জীবন অতিবাহিত করা এবং সকলের প্রতি শ্রদ্ধা, সততা, করুণা, সম্মান তথা দয়াভাব রেখে চলা। এতেই প্রভু পরমেশ্বর শিব অতি প্রসন্ন হন। শুধুমাত্র পূজা করলেই প্রভু শিব প্রসন্ন হন না, তিনি ব্যক্তির হৃদয়ে উৎপন্ন হ‌ওয়া সদ্ ভাব কে দেখে তবেই তিনি প্রসন্ন হন। 


☘️ব্রতকথা পাঠ করার পর পরমেশ্বর শিবের উদ্দেশ্যে ধ্বনী দেবেন। 

এবার ধ্বনি দিন জোরে জোরে -

নন্দীনাথশৈবকৃত শিবধ্বনী :


এক অদ্বিতীয় সগুণ নির্গুণ পরমেশ্বর 

হর শঙ্কর কি........ জয়......


ব্রহ্মাবিষ্ণুসেবিত শক্তিপতি মহেশ্বর

প্রভু সদাশিব কি...... জয়......


বেদ বেদান্ত বেদাঙ্গ ইতিহাস পুরাণ 

আগম ধর্মশাস্ত্রবর্ণিত মহাদেব কি...... জয়.....


সন্তানপ্রতিপালনকারী সনাতন ধর্ম

প্রকাশকারী রুদ্রদেব কি...... জয়.......


ভক্তবৎসল আশ্রয়দাতা পরমপিতা

আশুতোষ ত্রিপুরারী কি....... জয়.......


শৈব হো মন.. শৈব হো তন.. শৈব হো জীবন..

শৈব হে ধর্ম.. শৈব হে কর্ম.. শৈব হে বর্ম...

শিব শিব শিব হর হর শঙ্কর হর নীলকন্ঠ মহাদেব

ॐ শান্তি শান্তি শান্তি

ॐ নমঃ পার্বতীপতয়ে হর হর মহাদেব ॥

হর হর মহাদেব ॥

হর হর মহাদেব ॥

ॐ নমঃ শিবায় 🙏


© Koushik Roy. All Rights Reserved https://issgt100.blogspot.com

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত