ব্রাহ্মণের চেয়েও শ্রেষ্ঠ ও বর্ণাশ্রমের ঊর্ধ্বে হলেন অতিবর্ণাশ্রমী শৈব



॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥


প্রথম বলে রাখি 

আমরা শৈবগণ সনাতন ধর্মী, আমাদের দৃষ্টি অনুযায়ী শৈবধর্ম কেই সনাতন ধর্ম বলে। আমাদের ধর্মে বর্ণাশ্রম প্রথা রয়েছে। বর্ণ আশ্রম প্রথার মধ্যে শ্রেষ্ঠ বর্ণ হল ব্রাহ্মণ বর্ণ। এরপর ক্ষত্রিয় বর্ণ তারপর বৈশ্য বর্ণ অন্তে শূদ্রবর্ণের উল্লেখ রয়েছে। সুদূর অতীত থেকে ব্রাহ্মণ জাতিকে শ্রেষ্ঠ এবং তার পরবর্তীতে যথাক্রমে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে এবং শূদ্রবর্ণ কে এর সবচেয়ে অন্তিমে রাখা হয়েছে। পরমেশ্বরের ইচ্ছেয় সমাজের জন্য বর্ণাশ্রম প্রথা এসেছে। কিন্তু এই বর্ণাশ্রমের‌ও ঊর্ধ্বে যে সমস্ত আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি অবস্থান করেন তারাই অতিবর্ণাশ্রমী বলে পরিচিত। 


আমরা আজ সেই অতিবর্ণাশ্রমীদের সম্পর্কে নীচে আলোচনা উপস্থিত করছি।


এখানে ভালো করে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, এখানে বর্ণাশ্রম শুধুমাত্র আত্মজ্ঞানহীন ব্যক্তিদের জন্য‌ই মান্য, সমাজের আত্মজ্ঞানহীন দের জন্য‌ই সাধারণ মানুষের জন্য পরমেশ্বর নিজেই বর্ণাশ্রমের বিধান দিয়েছেন,অর্থাৎ বর্ণাশ্রম‌ও সমাজের জন্য প্রয়োজন, তবে সেটি শুধুমাত্র সেই সমস্ত ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যারা আত্মজ্ঞানী হয়ে উঠতে পারেননি, 

অতিবর্ণাশ্রমী তাদেরকেই বলা হয় যারা চতুরাশ্রম অথবা চারবর্ণের যে কোনো একটি বর্ণের অন্তর্গত হবার পরেও আত্মজ্ঞান লাভ করে বর্ণাশ্রমের নীতি থেকে নিজেকে মুক্ত করেছেন। অর্থাৎ যে ব্যক্তি বর্ণাশ্রম নীতির ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছেন তিনিই অতিবর্ণাশ্রমী।

ISSGT - এর পক্ষ থেকে শাস্ত্রপ্রমাণ সহ সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিবের মুখ নিঃসৃত বানীকে আমি “শ্রী নন্দীনাথ শৈব” এই আলোচনার মূখ্য বিষয় রূপে উপস্থাপন করেছি। যেখানে পরমেশ্বর শিব নিজেই তার পরমভক্ত শ্রীবিষ্ণুজী মহারাজ কে অতিবর্ণাশ্রমী ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য গুলি এক এক করে তুলে ধরে শ্রীবিষ্ণু সহ আমাদের মতো সাধারণ জীবেদেরকেও পরমজ্ঞান প্রদান করে উদ্ধারের মার্গ প্রশস্ত করেছেন।

চলুন শাস্ত্র থেকে দেখে নেয়া যাক অতিবর্ণাশ্রমীর বৈশিষ্ট্য :


উত্তমঃ পঞ্চপা প্রোক্তো গুরুর্ব্রহ্মাত্মবেদিভিঃ ।

ব্রহ্মচারী গৃহস্থশ্চ বানপ্রস্থশ্চ ভিক্ষুকঃ ॥ ৯

অতিবর্ণাশ্রমী চেতি ক্রমাচ্ছ্রেষ্টা বিচক্ষণ ।

অশ্রেষ্ঠানাং হরে শ্রেষ্ঠা গুরবঃ পরিকীর্তিতাঃ ॥ ১০

ব্রহ্মচারী গৃহস্থস্য বনস্থস্য যতেরপি ।

বিদ্যোৎকর্ষবলেনৈব গুরুর্ভবতি নান্যথা ॥ ১১

গৃহস্থোঽপি বনস্থস্য যতেরপ্যম্বুজেক্ষণ ।

বিদ্যোৎকর্ষবলেনৈব গুরুর্ভবতি নান্যথা ॥ ১২

বানপ্রস্থাশ্রমস্থোঽপি তথা সন্ন্যাসিনাং হরে ।

বিদ্যোৎকর্ষবলেনৈব গুরুর্ভবতি নান্যথা ॥ ১৩

অতিবর্ণাশ্রমী প্রোক্তো গুরুঃ সর্বাধিকারিণাম ।

ন কস্যাপি ভবেচ্ছিষ্যো যথাঽহং পুরুষোত্তম ॥ ১৪ 

অতিবর্ণাশ্রমী সাক্ষাৎ গুরুণাং গুরুরুচ্যতে ।

তৎসমো নাধিকশ্চাস্মিঁল্লোকেঽস্ত্যেব ন সংশয়ঃ ॥ ১৫

যঃ শরীরেন্দ্রিয়াদিভ্যো বিভিন্নং সর্বসাক্ষিণম্ ।

পারমার্থিক বিজ্ঞানসুখাত্মানং স্বয়ংপ্রভম্ ॥ ১৬

পরতত্ত্বং বিজানাতি সোঽতিবর্ণাশ্রমী ভবেত্ ।

যো বেদান্তমহাবাক্যশ্রবণেনৈব কেশব ॥ ১৭

আত্মানমীশ্বরং বেদ সোঽতিবর্ণাশ্রমী ভবেৎ ।

যোঽবস্থাত্রয়নির্মুক্তমবস্থাত্রয়সাক্ষিণম্ ॥ ১৮

মহাদেব বিজানাতি সোঽতিবর্ণাশ্রমী ভবেৎ ।

বর্ণাশ্রমাদয়ো দেহে মায়য়া পরিকল্পিতাঃ ॥ ১৯

নাঽঽত্মনো বোধরূপস্য মম তে সন্তি সর্বদা ।

ইতি যো বেদ বেদান্তৈঃ সোঽতিবর্ণাশ্রমী ভবেৎ ॥ ২০

আদিত্যসন্নিধী লোকশ্চেষ্টতে স্বয়মেব তু ।

তথা মৎস্যন্নিধাবেব চেষ্টতে সকলং জগৎ ॥ ২১

ইতি যো বেদ বেদান্তৈঃ সোঽতিবর্ণাশ্রমী ভবেৎ ।

সুবর্ণে হারকেয়ূরকটকস্বস্তিকাদয়ঃ ॥ ২২

কল্পিতা মায়য়া তদ্বজ্জগন্ময্যেব সর্বদা ।

ইতি যো বেদ বেদান্তৈঃ সোঽতিবর্ণাশ্রমী ভবেৎ ॥ ২৩

শুক্তিকায়াং যথা তারং কল্পিতং মায়য়া তথা ।

মহদাদি জগন্মায়াময়ং প্রয্যেব কল্পিতম্ ॥ ২৪

ইতি যো বেদ বেদান্তৈঃ সোঽতিবর্ণাশ্রমী ভবেৎ ।

চণ্ডালদেহে পঞ্চাদিশরীরে ব্রহ্মবিগ্রহে ॥ ২৫

অন্যেষু তারতম্যেন স্থিতেষু পুরুষোত্তম ।

ব্যোমবৎসর্বদা ব্যাপ্তঃ সর্বসম্বন্ধবর্জিতঃ ॥ ২৬

একরূপো মহাদেবঃ স্থিতঃ সোঽহং পরামৃতঃ ।

ইতি যো বেদ বেদান্তৈঃ সোঽতিবর্ণাশ্রমী ভবেৎ ॥ ২৭

বিনষ্টদিগ্ভ্রমস্যাপি যথাপূর্বং বিভাতি দিক্ ।

তথা বিজ্ঞানবিধ্বস্তং জগন্মে ভাতি তত্রহি ॥ ২৮

ইতি যো বেদ বেদান্তৈঃ সোঽতিবর্ণাশ্রমী ভবেৎ ।

যথা স্বপ্নপ্রপঞ্চোঽয়ং ময়ি মায়াবিজৃম্ভিতঃ ॥ ২৯

তথা জাগ্রব্যপঞ্চোঽপি পরমায়াবিজৃম্ভিতঃ ।

ইতি যো বেদ বেদান্তৈঃ সোঽতিবর্ণাশ্রমী ভবেৎ ॥ ৩০

যস্য বর্ণাশ্রমাচারো গলিতঃ স্বাত্মদর্শনাৎ ।

স বর্ণানাশ্রমান্সর্বানতীত্য স্বাত্মনি স্থিতঃ ॥ ৩১

যোঽতীত্য স্বাশ্রমান্বর্ণানাত্মন্যেব স্থিতঃ পুমান্ ।

সোঽতিবর্ণাশ্রমী প্রোক্তঃ সর্ববেদান্তবেদিভিঃ ॥ ৩২

ন দেহো নেন্দ্রিয়ং প্রাণো ন মনো বুদ্ধ্যহংকৃতী ।

ন চিত্তং নৈব মায়া চ ন চ ব্যোমাদিকং জগৎ ॥ ৩৩

ন কর্তা নৈব ভোক্তা চ ন চ ভোজয়িতা তথা ।

কেবলং চিৎসদানন্দং ব্রহ্মৈবাঽঽত্মা যথার্থতঃ ॥ ৩৪

জলস্য চলনাদেব চঞ্চলত্বং যথা রবেঃ ।

তথাঽহঙ্কারসম্বন্ধাদেব সংসার আত্মনঃ ॥ ৩৫

তস্মাদন্যগতা বর্ণা আশ্রমা অপি কেশব ।

আত্মন্যারোপিতা এব ভ্রান্ত্যা তে নাঽঽত্মবেদিনঃ ॥ ৩৬

ষ বিধির্ন নিষেধশ্চ ন বর্জ্যাবর্জ্যকল্পনা ।

আত্মবিজ্ঞানিনামস্তি তথা নান্যজ্জনার্দন ॥ ৩৭

আত্মবিজ্ঞানিনো নিষ্ঠামীশ্বরীমম্বুজেক্ষণ ।

মায়য়া মোহিতা মর্ত্যা নৈব জানন্তি সর্বদা ॥ ৩৮

ন মাংসচক্ষুষা নিষ্ঠা ব্রহ্মবিজ্ঞানিনামিয়ম্ ।

দ্রষ্টুং শক্যা স্বতঃ সিদ্ধা বিদুষঃ সৈব কেশব ॥ ৩৯

যত্র সুপ্তা জনা নিত্যং প্রবুদ্ধস্তত্র সংযমী ।

প্রবুদ্ধা যত্র তে বিদ্ধান্সুষুপ্তস্তত্র কেশব ॥ ৪০

এবমাত্মানমদ্বন্দ্ধং নির্বিকল্প নিরঞ্জনম্ ।

নিত্যং শুদ্ধং নিরাভাসং সংবিন্মাত্রং পরামৃতম্ ॥ ৪১

যো বিজনতি বেদান্তৈঃ স্বানুভূত্যা চ নিশ্চিতম্ ।

সাঽতিবর্ণাশ্রমী নাম্না স এব গুরুরুত্তমঃ ॥ ৪২

স এব বেদবিত্তমঃ স এব মোচকপ্রদঃ ।

স এব সর্বমোচকঃ স এব সর্বকারণম্ ॥ ৪৩

স এব সত্যচিদ্র্ধনঃ স এব মুক্তিরুত্তমা ।

স এব সর্বমুক্তিদঃ স এব সর্বমচ্যুত ॥ ৪৪

ইতি তব পরমার্থঃ সর্ববেদান্তসিদ্ধঃ সকলমুনিবরাণাং দেবাতানাং নরাণাম্

পরমপুরুষ সাক্ষান্মুক্তিসিদ্ধ্যৈ ময়োক্তঃ পরমকরুণয়ৈব প্রার্থিতেন ত্বয়ৈব ॥ ৪৫

সূত উবাচ - 

এবং নিশম্য ভগবান্যাসুদেবো জগন্ময়ঃ ।

স্বমূর্ধ্নি চরণদ্বন্দ্বং শিবস্য পরমাত্মনঃ ॥ ৪৬

বিন্যস্য ব্রহ্মবিজ্ঞানং বেদান্তোক্তং বিমুক্তিদম্ ।

লব্ধ্যা ভূমৌ মহাভক্ত্যা বিবশো গদ্গদস্বরঃ ॥ ৪৭

প্রণম্য বহুশঃ শ্রীমান্সলিলার্দ্রসুলোচনঃ ।

কৃতার্থোঽভবদীশানপ্রসাদাদেব সুব্রতাঃ ॥ ৪৮

ভবন্তোঽপি দ্বিজা এবং  শ্রদ্ধয়া মোচকপ্রদম্ ।

বিদিত্বা তস্য শুশ্রষাং কুরুধ্বং যত্নতঃ সদা ॥ ৪৯

যস্য দেবে পরা শক্তির্যথা দেবে তথা গুরৌ ।

তস্য প্রোক্তা দ্বিজা হ্যার্থাঃ প্রকাশন্তে মহাত্মনঃ ॥ ৫০


[তথ্যসূত্র - স্কন্দমহাপুরাণ/সূতসংহিতা/মুক্তিখণ্ড/অধ্যায় নং ৫] 


💥সরলার্থ -

✅ উত্তম গুরু পাঁচ প্রকারের বলা হয়েছে। তারা হলো - ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্রস্থ, সন্ন্যাসী এবং অতিবর্ণাশ্রমী । ইহারাই যথাক্রমে শ্রেষ্ঠ । শ্রেষ্ঠ অশ্রেষ্ঠের গুরু হয়ে থাকেন ॥ ৯-১০

(নন্দীটিকা - এখানে অতিবর্ণাশ্রমীকে সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে, বর্ণাশ্রমের অন্তর্গত যে কোনো বর্ণের ব্যক্তির আত্মজ্ঞান হলেই তিনি বর্ণাশ্রমের ঊর্ধ্বে উঠে অতিবর্ণাশ্রমী হয়ে যান)


✅ যখন বিদ্যার(জ্ঞানের) বিকাশ হয়, তখন এখানেও বিপরীত হতে পারে, অর্থাৎ একজন ব্রহ্মচারীও গৃহস্থদের গুরু হতে পারেন। গৃহস্থদের ক্ষেত্রেও একইভাবে বোঝা উচিত ॥ ১১-১৩

(নন্দীটিকা - উপরোক্ত আলোচনার তাৎপর্য হল কোনো বর্ণের বা কোনো আশ্রমের ব্যক্তির যদি আত্মজ্ঞান বিকশিত হয় তবে ব্রাহ্মণের গুরুও ক্ষত্রিয় ব্যক্তি হতে পারেন অথবা শুদ্র ব্যক্তিও বৈশ্য বা ক্ষত্রিয় অথবা ব্রাহ্মণের গুরু হতে পারেন, আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি অন্য যে কোন বর্ণের গুরু হতে পারেন। ঠিক এক‌ই ভাবে যিনি আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি তিনি যদি গৃহস্থ‌ও হন তবুও তিনি সন্ন্যাসী বা ব্রহ্মচারী অথবা বাণপ্রস্থ আশ্রমের ব্যক্তির‌ও গুরু হতে পারেন, আবার ব্রহ্মচারী ব্যক্তিও আত্মজ্ঞান লাভ করলে তিনিও বাকি যে কোনো আশ্রমের ব্যক্তির গুরু হতে পারেন। মোট কথা হল যে কোনো বর্ণের বা যে কোনো আশ্রমের যে কোনো ব্যক্তি আত্মজ্ঞান লাভ করলেই তিনি বাকিদের গুরু হয়ে জ্ঞান প্রদান করতে পারেন,এটিই পরমেশ্বর শিবের বানী )

✅ অতিবর্ণাশ্রমীগণেরা তো সমস্ত অধিকারীদের গুরু বলেই সর্বদা সম্মানিত হন, অতিবর্ণাশ্রমীগণেরা কখনোই কারোর শিষ্য হননা । এতে আমি স্বয়ং শংকর ই দৃষ্টান্ত রূপে অবস্থিত আছি ॥ ১৪

(নন্দীটিকা -আত্মজ্ঞানী ব্যক্তিদের অতিবর্ণাশ্রমী বলা হয়েছে, তারা বাকি সমস্ত বর্ণের তথা চতুরাশ্রমী ব্যক্তিদের গুরু বলে সর্বদা সম্মানিত হবেন, আত্মজ্ঞানী অতিবর্ণাশ্রমী হন, সমস্ত ব্যক্তিরা কখনোই অন্য কারোরই শিষ্য হন না, কেননা তারাই শ্রেষ্ঠ পরম তত্ত্বের জ্ঞান উপলব্ধি করেছেন যে জ্ঞানের থেকে চরম জ্ঞান আর কিছুই হতে পারে না, আত্মজ্ঞানই ব্যক্তি সর্বদাই গুরুরূপেই পূজ্য সর্বদা, তাই পরমেশ্বর শিব নিজেকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উদাহরণ দিয়ে পরমশৈব শ্রীবিষ্ণুকে বোঝাতে চাইলেন যে, পরমেশ্বর শিব সর্বদাই সকলের গুরু , পরমেশ্বর শিব কখনোই কারোর শিষ্য হননা না, কারণ পরমেশ্বর শিব জাগতিক সংসারের বর্ণাশ্রম প্রথার ঊর্ধ্বে, আত্মজ্ঞানীরা সেই শিবকেই নিজের আত্মাতে দর্শন করে নিজের আত্মাকেই আমি বলে জানতে সক্ষম হলে সেই শিবের সাথে নিজের একত্ত্বের বোধ করে নিজেকে আত্মজ্ঞান দ্বারা পূর্ণ করে বর্ণাশ্রমের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে নিজেকে আত্মজ্ঞানী করেন, তখন তিনি অতিবর্ণাশ্রমী বলে সম্মোধিত হন)


✅ অতিবর্ণাশ্রমীগন গুরুদের‌ও গুরু হয়ে থাকেন । তার সমান বা তার থেকে শ্রেষ্ঠ সংসারে আর কেউই নেই ॥ ১৫

(নন্দীটিকা - আত্মজ্ঞানী সর্বদাই সমস্ত গুরুদের ও গুরু হয়ে থাকেন, সেই অতিবর্ণাশ্রমীগণ‌ই সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তাদের চেয়ে কেহ‌ই শ্রেষ্ঠ নন, কেননা তারাই সর্বশ্রেষ্ঠ পরম সত্যকে উপলব্ধি করেছেন, অতিবর্ণাশ্রমীদের কে সকলের গুরু বলে উল্লেখিত করেছেন পরমেশ্বর শিব)


✅ শরীর, ইন্দ্রিয় আদি থেকে ভিন্ন, সবার সাক্ষী, পরমার্থিক বিজ্ঞান, তথা পরমানন্দরূপ, স্বপ্রকাশ, পরমাত্মতত্ত্ব সম্পর্কে যার নির্ভ্রান্ত অনুভব রয়েছে তিনিই অতিবর্ণাশ্রমী হয়ে থাকেন ।

যে উত্তম অধিকারী ব্যক্তি বেদান্তের মহাবাক্য কে শ্রবণ মাত্রই নিজের(আত্মা) সাথে পরমেশ্বরকে অভেদ হিসেবে জেনে নিয়েছেন, তিনি অতিবর্ণাশ্রমী হিসেবে পরিচিত । 

যে উত্তম অধিকারী ব্যক্তি বেদান্তের মহাবাক্য কে শ্রবণ মাত্রই নিজের(আত্মা) সাথে পরমেশ্বরকে অভেদ হিসেবে জেনে নিয়েছেন, তিনি অতি বর্ণাশ্রম হিসেবে পরিচিত । তিনঅবস্থা থেকে রহিত এবং তিন অবস্থার সাক্ষী অদ্বিতীয় মহাদেব কে যে ব্যক্তি নিজের মূল স্বরূপ বলে জানেন তিনিই একমাত্র অতি বর্ণাশ্রমী হতে পারেন ।

যে ব্যক্তির মনে অচল নিশ্চয় হয়ে থাকে যে বর্ণাশ্রম আদি নিয়ম মায়া দ্বারা শুধুমাত্র শরীরে কল্পিত হয়ে থাকে, জ্ঞানরূপ আমি অর্থাৎ আত্মাতে সেই বর্ণাশ্রম কখনোই আরোপিত হতে পারে না, সেই ব্যক্তিই অতিবর্ণাশ্রমী হন ॥ ১৬-২০

(নন্দীটিকা - যে সমস্ত ব্যক্তি শুধুমাত্র বেদান্তের জ্ঞান শ্রবণ মাত্র‌ই আত্মাকেই আমি বলে জানবে, আত্মাকে মায়া থেকে ভিন্ন বলে জানব, যে ব্যক্তি নিজের দেহকে আমি না ভেবে দেহের মধ্যে থাকা পরমত্ত্ব আত্মাকে প্রকৃত আমি বলে জানবে তাকেই অতিবর্ণাশ্রমী বলা হয়েছে, নিজেকে শুধু আত্মা বলে জানলেই হবে না বরং আরো কিছু বৈশিষ্ট্য আছে অতিবর্ণাশ্রমী হবার জন্য, সেই লক্ষণগুলিও একজন অতিবর্ণাশ্রমী ব্যক্তির মধ্যে থাকতে হবে তবেই তিনি অতিবর্ণাশ্রমী বলে গণ্য হবেন। যেমন - শুধুমাত্র আত্মজ্ঞানের মধ্যে আমি আত্মা এটি হলেই হবে না বরং সেই আমিরূপ আত্মা যে এক ও অদ্বিতীয় পরমেশ্বর মহাদেব শিব, যে মহাদেব সকলের মূল, যে পার্বতীপতি মহাদেব কে ব্রহ্ম বলে সম্মোধন করা হয়, একমাত্র সেই শিবকেই নিজের আত্মা জেনে তা মান্যকারী ব্যক্তিকেই অতিবর্ণাশ্রমী বলা যাবে, অদ্বিতীয় ব্রহ্ম যে একমাত্র শিব, সেই শিব‌ই সবকিছুর স্বরূপ , সেই শিব‌ই সমস্ত দেবতারূপ ধারণ করেন, সেই শিব‌ই মায়া দ্বারা জীবরূপ ধারণ করেন, তাই যিনি একমাত্র শিবকেই অদ্বিতীয় পরমেশ্বর জেনে নিজ আত্মাতে সেই শিবকেই আমি বলে জানতে পারেন সেই ব্যক্তিই একমাত্র অতিবর্ণাশ্রমী হন, শিবকেই একমাত্র অদ্বিতীয় পরমেশ্বর মান্যকারী ও শুধুমাত্র শিবকেই ধ্যেয় বলে যেসমস্ত ব্যক্তি মান্য করেন তথা অটুট ভাবে বিশ্বাস করেন, তারা নিঃসন্দেহে শৈব বলে পরিচিত, বৈষ্ণবেরা কখনো মহাদেবকে সর্বোচ্চ সত্ত্বা বলে স্বীকার করবে না, স্মার্তিকরাও শুধুমাত্র শিবকে সর্বোচ্চ সত্ত্বা ও অদ্বিতীয় পরমেশ্বর বলে মান্য করে না, তারা পাঁচ দেবতাকেই এক ব্রহ্মের বিভিন্ন রূপ বলেন, শাক্তরাও দেবীকে সর্বোচ্চ সত্ত্বা মানেন, কিন্তু শৈবরাই একমাত্র পরমেশ্বর শিবকেই একমাত্র অদ্বিতীয় ব্রহ্ম বলে মানেন, শৈবগণ বলেন শিব‌ই বিভিন্ন দেবতাদের রূপ ধারণ করেন, কিন্তু বাকি মতাদর্শ গুলো কখনোই এটিকে মানে না, ফলে অতিবর্ণাশ্রমীর লক্ষণ গুলি শৈব ছাড়া বাকি আর কোনো মতের মধ্যে দেখা যায় না, সুতরাং শৈবরাই অতিবর্ণাশ্রমী বলে গণ্য ও শাস্ত্র সম্মত অতিবর্ণাশ্রমী তারাই হন যারা এটি নিশ্চিত ভাবে জানেন যে, বর্ণাশ্রম শুধুমাত্র মায়ার দ্বারা তৈরি এই জাগতিক শরীরের উপরেই কল্পিত হয়, আত্মার উপর বর্ণাশ্রম নীতি আরোপিত হয় না। তাই যারা আত্মজ্ঞানী অর্থাৎ যারা শরীরকে আমি না ভেবে আত্মাকেই প্রকৃত আমি বলে জানেন তাদের ক্ষেত্রে বর্ণাশ্রম নীতি কখনোই মান্য নয় কেননা তারা নিজেদের আত্মা বলে জেনেছেন এবং আত্মার ওপর বর্ণাশ্রম প্রথা কখনোই আরোপিত হতে পারে না তাই তারা অতিবর্ণাশ্রমী হয়ে যান)


✅ যিনি বেদান্ত দ্বারা এই অনুভব প্রাপ্ত করে নিয়েছেন যে আমার সন্নিধি থেকে সংসারের সব চেষ্টা ঠিক তেমন‌ই হয়ে থাকে সূর্যের সন্নিধির দ্বারা চোর তথা মহাজন সকলেই তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে সক্ষম( আমি ঠিক তেমনই সমস্ত চেষ্টা প্রবৃত্তি থেকে অস্পৃষ্ট, যেমন সূর্য) , এই চিন্তাকারী ব্যক্তিই অতিবর্ণাশ্রমী হন ॥ ২১

(নন্দীটিকা - যে ব্যক্তি শুধুমাত্র বেদান্তের জ্ঞান দ্বারা এটি বুঝেছেন যে আমি এই সংসারে থাকলেও তার দ্বারা আমি প্রভাবিত হই না, যেমনটা সূর্যের ক্ষেত্রেও এক । কেননা - সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে বিভিন্ন রকমের ব্যক্তি, সে চোর হোক অথবা মহাজন সকলেই নিজেদের কাজ করছে তাদের স্বভাব প্রবৃত্তি অনুযায়ী, কিন্তু সেই ব্যক্তিদের প্রবৃত্তির প্রভাব সূর্যের উপর পড়ে না, এই রকম চিন্তা যে সমস্ত ব্যক্তি করেন তারাই অতিবর্ণাশ্রমী বলে পরিচিত)


বেদান্তবিচারের ফলস্বরূপ যার এই অনুভব হয়েছে যে, সমস্ত জগৎ আমাতেই সেইভাবে কল্পিত হয়েছে যেভাবে সোনাতে বিভিন্ন রকমের গহনা অলংকার কল্পিত হয়ে থাকে, তিনিই অতিবর্ণাশ্রমী ॥ ২২-২৩

(নন্দীটিকা - বেদান্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন করার পর যার এই অনুভব হয় যে সমগ্র জগৎ সেই আমিরূপী আত্মা পরমেশ্বর শিব‌ই কল্পিত হয়েছে , এই জগতের অস্তিত্বই নেই তা শুধুমাত্র ভ্রম, যেমন সোনা ধাতু দিয়ে বিভিন্ন গহনা অলংকার তৈরি করলেও তা মূলত সোনা ধাতুতেই অবস্থান হয়, পরমেশ্বর শিবের মধ্যেই এই জগত কল্পিত হয় আর সেই জগত আমিরূপী আত্মা তেই যেহেতু কল্পিত হয়েছে তাই সমস্ত জগৎ যেন আমার আত্মার ভেতরেই রয়েছে তা অনুভব হয় তখন সমগ্র জগতে একমাত্র আমিরূপী আত্মা শিবকে অনুভব হয় এই আত্মজ্ঞান লাভ হলে তাকে অতিবর্ণাশ্রমী বলা হয়)


✅ যার উপনিষদলভ্য জ্ঞানের এই নিশ্চয় হয় যে সর্পতে রৌপ্যের ন্যায় মহত্তত্ব আদি সমস্ত মায়াময় জগৎ আমিরূপ অবিকৃত অধিষ্ঠানেই কল্পিত হয়, তিনিই অতিবর্ণাশ্রমী ॥ ২৪

(নন্দীটিকা - উপনিষদের জ্ঞানের মাধ্যমে যে ব্যক্তি জানতে পারেন যে মায়াময় জগত আমিরূপী আত্মাতেই অবস্থান করে তিনি অতিবর্ণাশ্রমী)


✅ তিনিই অতিবর্ণাশ্রমী হন যার অকম্প দৃঢ় নিশ্চয় হয় যে, পশু আদি অর্থাৎ চণ্ডালের শরীর থেকে ব্রহ্মার শরীর পর্যন্ত অন্য বস্তু হোক , বা তার তারতম্যেই অবস্থিত হোক, সেই সমস্ত রকমের বন্ধন থেকে যিনি রহিত সেই পরমেশ্বর মহাদেব আকাশের ন্যায় সকলের মধ্যেই এক আত্মা রূপেই স্থিত, আর সেই পরমেশ্বর মহাদেব আমিই(আত্মারূপে) ॥ ২৫-২৭


(নন্দীটিকা -  জগতের সমস্ত কিছুই মায়া, কিন্তু এই মায়া থেকে যিনি সর্বদাই মুক্ত এবং ব্যোম অর্থাৎ আকাশের ন্যায় চারিদিকে সেই এক পরমেশ্বর শিব ই অবস্থিত, তিনিই আমি রূপে প্রত্যেক জীবে প্রবিষ্ট এই জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি কে অতিবর্ণাশ্রমী বলা হয়েছে)


✅ বেদান্তানুভবের পরবর্তীতে যার এই ভাব তৈরি হয়, যেমন দিগ্ভ্রম নষ্ট হ‌ওয়ার পরেও দিশা দর্শিত হয়ে পূর্বের ন্যায়‌ই হয়ে থাকে , তেমনি আত্মজ্ঞান দ্বারা বাধিত হ‌ওয়া জগতকে আমার অনুভব হলেও তা প্রকৃত পক্ষেই নেই, এই ভাব হ‌ওয়া ব্যক্তিই অতিবর্ণাশ্রমী ॥ ২৮

(নন্দীটিকা - এখানে বলা হয়েছে বেদান্ত সম্পর্কে যার সঠিক জ্ঞানলাভ হয় তিনি জানেন যে , যতই এই জগতের সব কিছু সত্য বলে মনে হোক তা আসলে অসত্য, তিনিই অতিবর্ণাশ্রমী)


✅ যেমন মায়াবশত স্বপ্ন প্রপঞ্চ আমাতে কল্পিত হয়, তেমন‌ই জাগ্রন্প্রপঞ্চ‌ও পরমেশ্বরের মায়া দ্বারা পরমেশ্বরেই কল্পিত হয়(আর সেই পরমেশ্বর আমিরূপী আত্মা), এই গুহ্য বিষয় যিনি বেদান্ত থেকে জেনে নিয়েছেন তিনিই অতিবর্ণাশ্রমী ॥ ২৯-৩০

(নন্দীটিকা - যেমন মায়াবশত তো বিভিন্ন রকম স্বপ্ন আমরা দেখে থাকি, যা আসলেই আমাদের ভ্রমবশত স্বপ্নে আমরা দেখে থাকি, তেমনি মায়া দ্বারা পরমেশ্বরেই জগত কল্পিত হয় । এই গুহ্য বিষয় যিনি বেদান্ত অধ্যয়ন করে জেনে নিতে পারেন তিনিই অতিবর্ণাশ্রমী)


✅ সেই(অতিবর্ণাশ্রমী) ব্যক্তি আশ্রম প্রযুক্ত কোনো আচার পালন করেন না, তিনি বর্ণ তথা বর্ণাশ্রমের নিয়ম আচারের ঊর্ধ্বে উঠে নিজ(আত্ম) স্বরূপস্থিত হন । (অর্থাৎ) যে পুরুষ(তথা মানব) এইভাবে(দেহাভিমানশূণ্য হয়ে) নিজ আশ্রম তথা বর্ণের ঊর্ধে উঠে নিজ স্বরূপস্থিত হন, সেই ব্যক্তিই বেদান্তবেত্তাগণের দ্বারা অতিবর্ণাশ্রমী বলে সম্মোধিত(কথিত) হন ॥ ৩১-৩২

(নন্দীটিকা - ও বিভিন্ন রকম বর্ণাশ্রম প্রথার নিয়ম অথবা বিধি অতিবর্ণাশ্রমীরা পালন করেন না, অতি বর্ণাশ্রমীরা এটি মনে করেন যে তারা অদ্বিতীয় আত্মা এবং আত্মাতে কখনোই বর্ণাশ্রম বিধি আরোপিত হয় না, সুতরাং আত্মজ্ঞানী শৈবগণ বিধিনিষেধের ঊর্ধ্বে )


✅ যেমন হয় যে দেহ ইন্দ্রিয় প্রাণ মন বুদ্ধি অহংকার চিত্ত মায়া আকাশ আদি জগৎকর্তা ভোগ করার কর্তা, যিনি ভোগ করানোর কর্তা সেই সমস্ত কিছুর‌ই অস্তিত্ব নেই, কেবল জ্ঞান, সৎ এবং আনন্দরূপ ব্যাপক আমিই বস্তুত আত্মা ॥ ৩৩-৩৪

(নন্দীটিকা -  দেহগত কোন বিষয়ের‌ই অস্তিত্ব নেই,  তা মায়া মাত্র, এই মায়া ছাড়া যা কিছুর অস্তিত্ব আছে তা হলো একমাত্র সচ্চিদানন্দ পরমাত্মা শিব যাকে আমি রূপে দেহের মধ্যে আত্মা হিসেবে বোধিত হয়)


✅ যেমন জলের চঞ্চলতায় ঢেউ এর দ্বারা তার মধ্যে থাকা সূর্যের প্রতিবিম্বতে চঞ্চলতা অনুভব হয় , তেমনি অহংকার সম্বন্ধ দ্বারা আত্মাতেও সংসরণ(বিচলিত) অনুভব হয় ।

অত‌এব, অন্যত্র অর্থাৎ শরীরাদির ধর্মভূত বর্ণাশ্রমাদি ভ্রমবশত আত্মার উপর আরোপিত করা হয়ে থাকে। যিনি আত্মস্বরূপ উপলব্ধি করে এই ভ্রমকে ছিন্ন করে ভ্রম থেকে মুক্ত হয়েছেন, তার কাছে এই বর্ণাশ্রমের কোনো সত্ত্বাই নেই ॥ ৩৫-৩৬

(নন্দীটিকা - সূর্যের প্রতিচ্ছবিকে জলের ঢেউতে নড়তে বা বিচলিত হতে দেখা যায় কিন্তু আসলে তা ভ্রম মাত্র, কেননা জলের মধ্যে সূর্য আদৌও নেই, ঠিক তেমনি আত্মাকেও দেহের মধ্যে ভেবে জীবেরা তার উপর মায়ার তৈরি জাগতিক  বর্ণাশ্রমকে আরোপিত হয় বলে ভাবে, তারা ভাবে আত্মার সুখ দুঃখ আছে, কিন্তু যে আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি এই ভ্রমণকে কাটিয়ে উঠতে পারেন এবং আত্মাকে সমস্ত মায়া থাকে নির্লিপ্ত জানতে সক্ষম হন তিনি অতিবর্ণাশ্রমী)


✅ আত্মজ্ঞানীর জন্য কোনো বিধি, নিষেধ, বর্জ্জ্য, অবর্জ্জ্য আদি কিছুই থাকে না ॥ ৩৭

(নন্দীটিকা - যিনি আত্মজ্ঞানী অতিবর্ণাশ্রমী তার ক্ষেত্রে বর্ণাশ্রমের বাধা নিষেধ কখনোই প্রযোজ্য হয় না তার ওপর কেননা তিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন তাই আত্মার ওপর কখনোই বিধি-নিষেধ আরোপিত হয় না, যারা আত্ম জ্ঞানহীন তাদের জন্য বর্ণাশ্রম -এর বিধি নিষেধ আরোপিত হয় অর্থাৎ শৈবরা বর্ণাশ্রমগত বিধি-নিষেধের ঊর্ধ্বে)


✅ যে মরণধর্মা মনুষ্য মায়া দ্বারা মোহিত হয়, সেই মনুষ্য কখনোই আত্মজ্ঞানীর ঈশ্বর নিষ্ঠা কে কখনোই বুঝতে সক্ষম হয় না ॥ ৩৮

(নন্দীটিকা - যে ব্যক্তি জাগতিক মায়া দ্বারা ভ্রমে রয়েছেন তিনি কখনোই আত্মজ্ঞানীব্যক্তির উচ্চ পর্যায়ের জ্ঞানের উচ্চতা কে বোধগম্য করতে সক্ষম নন, মায়ায় ভ্রমিত ব্যক্তি অতি বর্ণাশ্রমের ব্যক্তির চিন্তা ধারা ও তার উপলব্ধির বিন্দুমাত্র নিজের মায়া দ্বারা ভ্রমিত বিচার-বিবেচনা দ্বারা তা উপলব্ধি করতে সক্ষম নন তাই তারা অতিবর্ণাশ্রমী হওয়ার পর্যায় পৌঁছাতেও পারেন না এমনকি তারা অতিবর্ণাশ্রমী ব্যক্তির চিন্তা-ধারাকেও বুঝতে অক্ষম, আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি যেভাবে পরমেশ্বরকে জগৎময় চিন্তা করেন এবং নিজের আত্মাতে সেই পরমেশ্বর কে একত্ব ভাবে দর্শনরূপী পূজা করে থাকেন সেই চরম পর্যায়ের চিন্তা কখনোই সাধারণ ব্যক্তি করতে পারেনা)


✅ এই নিষ্ঠা মাংসময়ী চক্ষু দ্বারা বোঝার তো বিষয়‌ই নয়(তথা হতে পারে না)। সেই নিষ্ঠা একমাত্র বিদ্বান্ গণের‌ই স্বানুভবসিদ্ধ হয়ে থাকে ॥ ৩৯

(নন্দীটিকা - আপনি জ্ঞানী ব্যক্তিরা যেভাবে নিষ্ঠা পরমেশ্বরের প্রতি নিজের আত্মায় উপলব্ধি করে থাকেন তা শুধুমাত্র চামড়ার চক্ষু বিশিষ্ট সাধারণ মানুষ বুঝতে সক্ষম নন একমাত্র তা জ্ঞানীদের পক্ষে বোঝা সম্ভব)


✅ উদাহরণস্বরূপ, অজ্ঞানী ব্যক্তি যে বিষয়টিতে ঘুমিয়ে আছে, জ্ঞানীব্যক্তি সেই বিষয়ে জাগরিত হয়ে আছেন, আর যে সংসারবিষয়ে বিষয়ে বিদ্বান ব্যক্তি ঘুমিয়ে পড়েছেন, অজ্ঞানী ব্যক্তি সেই সংসারবিষয়ে জেগে আছেন (অতঃ উভয়ের সমানতা হ‌ওয়া অসম্ভব) ॥ ৪০

(নন্দীটিকা - এর তাৎপর্য হলো : অজ্ঞানী ব্যক্তি মিথ্যা বিষয়তে জীবন অতিবাহিত করছেন ফলে এখানে উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে যে তিনি সেই বিষয়ে জেগে আছেন যে বিষয়ে জ্ঞানীরা জেগে নেই অর্থাৎ জ্ঞানীরা এই মিথ্যা থেকে নিজেদের মুক্ত করে তারা জ্ঞানের পথে চলে গিয়েছেন এবং সেখানে জেগে আছেন কিন্তু সেই জ্ঞানের পথে যেহেতু অজ্ঞানীরা নিজেদের উন্নীত করতে পারেনি, ফলে এখানে উপমা হিসেবে বলা হয়েছে তারা জ্ঞানের বিষয়ে ঘুমিয়ে রয়েছেন, ফলে আত্মজ্ঞানী ও অজ্ঞানী দের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ চিরকাল ই থাকবে )

✅ যিনি অদ্বিতীয় বিক্ষেপশূণ্য, নিরাবরণ, নিত্য, শুদ্ধ, নির্ভ্রান্ত, অমৃত আত্মা কে বেদান্ত দ্বারা উপলব্ধি তথা  স্বানুভব থেকে নিশ্চিত করেছেন, তার‌ই নাম হল অতিবর্ণাশ্রমী এবং তিনি উত্তম গুরু ॥ ৪১-৪২

(নন্দীটিকা - অতিবর্ণাশ্রমী ব্যক্তি বেদান্ত শাস্ত্র দ্বারা জানতে পারেন যে আত্মাই একমাত্র আমি, এই আত্মাই নিত্য ও শুদ্ধ ও অদ্বিতীয় , ফলে এই ব্যক্তিবর্গ‌ই শ্রেষ্ঠ গুরু হন)


✅ তিনি বেদবেত্তা তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, এটি মোচকপ্রদ, তো তিনি স্বয়ং নিজেই মোচক হন, কেননা তিনি সর্বকারণরূপ ঈশ্বর ॥ ৪৩

(নন্দীটিকা - সেই অতিবর্ণাশ্রমী ব্যক্তিই বেদজ্ঞানীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কেননা তিনি নিজেই নিজের উপলব্ধি দ্বারা নিজেকে মায়া থেকে মুক্ত করতে সক্ষম , তাই তিনি নিজ আত্মাকে ঈশ্বররূপে সর্বজগৎময় দর্শন করে তিনি স্বয়ং ই শিবসাযুজ্য লাভ করেন)



✅ সত্য তথা চিন্মাত্ররূপ তিনিই, ব্রহ্মরূপ, কৈবল্য মোক্ষ‌ ও তৎস্বরূপ । সমস্ত প্রকার মুক্তির দাতাও তিনিই ॥ ৪৪

(নন্দীটিকা - অতিবর্ণাশ্রমী শৈব ব্যক্তিই সত্যের আলো স্বরূপ, তিনিই পরমার্থিক পর্যায়ে তৎ শব্দ দ্বারা বোধিত ব্রহ্মরূপ শিব, তিনি স্বয়ং অন্তিম মুক্তি কৈবল্য স্বরূপ, যাকে মোক্ষ বলে, সেই অন্তিম তথা সর্বপ্রকার মোক্ষপ্রদান করতেও তিনিই সক্ষম কেননা তিনি শিবস্বরূপ সম্পর্কে জেনে শিবরূপ প্রাপ্ত করেছেন। শৈবরাই শিবকৃপায় মোক্ষ প্রদানেও সক্ষম, কারণ শাস্ত্র বলছে

 পূজয়া শিবভক্তানাং ভোগমোক্ষৌ ন চান্যতঃ ॥৫৫

[রেফারেন্স - স্কন্দমহাপুরাণ/সূতসংহিতা/শিবমাহাত্ম্যখণ্ড/অধ্যায় ৬]

অর্থাৎ - শিবভক্তের পূজা করলে ভোগ ও মোক্ষ উভয়ই লাভ হয়, শৈবসেবা ভিন্ন তা সম্ভব নয় ॥৫৫

সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে শৈবদের পারম্যতা শাস্ত্র থেকে প্রমাণিত হয়, সব‌ই শিবকৃপা)


তোমার প্রার্থনা অনুসারে আমি সব উপনিষদের প্রসিদ্ধ পরমার্থিক বিষয়ে তোমাকে বলে দিলাম। মুনিগণ দেবতাগণ ওমরের অর্থাৎ সবার মুখের জন্য যে পর্যাপ্ত বিজ্ঞান সেটি, হে পরম উত্তম পুরুষ ! আমি কৃপাবশত তার উপদেশ তোমাকে দিলাম ॥ ৪৫

সূত মুনি বললেন -

এটি শ্রবণ করার পর শ্রীবিষ্ণু পরমেশ্বর শিবের চরণ দুটি নিজের মাথায় ধারণ করলেন এবং মোক্ষফলক বেদান্ত জ্ঞান পেয়ে হর্ষিত হয়ে পরমেশ্বর শিবকে প্রণাম করলেন। তিনি রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলেন শ্রীবিষ্ণুর কণ্ঠস্বর গদগদ হয়ে গেল। তার দুই চক্ষু হতে আনন্দ অশ্রু বইতে লাগলো। পরমেশ্বরের কৃপায় কৃতার্থ হয়ে গেলেন ॥৪৬-৪৮

আপনারাও শ্রদ্ধা পূর্বক আচার্য কে খুঁজে চেষ্টা পূর্বক তার সেবা করুন ॥ ৪৯

শ্রুতি অর্থাৎ বেদশাস্ত্র বলেছে যে, মহাদেব এবং গুরু তে এক সমান পরাভক্তি করেন একমাত্র এমন ব্যক্তিই বেদান্তে উল্লেখিত পরমজ্ঞানের কথা বুঝতে সক্ষম হন ॥ ৫০

☝️উপরোক্ত শ্লোক সহ শব্দ প্রমাণ থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে শৈবদের লক্ষণ ও অতিবর্ণাশ্রমী ব্যক্তির লক্ষণ হুবহু মিল রয়েছে , ফলে পরমেশ্বর শিবের উপাসক অদ্বৈতদর্শী শৈবরা সর্বদাই সমস্ত সনাতনীদের সমান অধিকারে বিশ্বাসী, তারা শিবের এই আত্মজ্ঞানের নীতিতে বিশ্বাসী, বর্ণাশ্রমের মধ্যে ব্রাহ্মণেরা শ্রেষ্ঠ এটিও পরমেশ্বরের‌ই বিধান, কিন্তু আবার পরমেশ্বর নিজেই ব্রাহ্মণ তথা বর্ণাশ্রমের‌ও ঊর্ধ্বে অতিবর্ণাশ্রমী সম্পর্কেও বিধান দিয়েছেন। শৈবরা ধার্মিক ব্রাহ্মণ তথা বর্ণাশ্রমের বিরোধী নয়, তারা অতিবর্ণাশ্রমের পরিপন্থী। আশা করি পরমেশ্বর শিবের কৃপায় এই আলোচনা তে সকলের জ্ঞান অর্জন হয়েছে। সকলে নিজেদের মতামত জানাবেন কমেন্ট করে,  শিবজ্ঞান সকলের কাছে পৌঁছে দিতে এই পোষ্টটি শেয়ার করুন, আমাদের ব্লগ ফলো করতে পারেন, এরম আরো শিবজ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে আমাদের সাথে জুড়ে থাকুন, প্রভু শিব আপনাদের কল্যান করুন ও শিবচরণে মতি প্রদান করুন । 

ॐ শ্রীগুরু দক্ষিণামূর্তয়ে নমঃ 🙏


✍️সংগ্রহে ও লেখনীতে - শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী

©️কপিরাইট ও প্রচারে - International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত