কেন শিবভক্তবৃন্দ সর্বদা মায়ামুক্ত বিশুদ্ধতাযুক্ত ?

 


 

ত্বং দৃষ্ট্বা ভগবান্ ব্রহ্মা মামুবাচ জগৎপতিম্ । মােহায়াশেষভূতানাং নিযােজয় সুরূপিণীম্ ॥১০

যেনেয়ং বিপুলা সৃষ্টির্বর্দ্ধতে মম মাধব ।

যথােক্তোহহং স্ত্রিয়ং দেবীমব্রবং প্রহসন্নিব ॥১১

দেবীদমখিলং বিশ্বং সদেবাসুরমানুষম্।
মােহয়িত্বা মমাদেশাৎ সংসারে বিনিপাতয় ॥১২

জ্ঞানযােগতরান্ দান্তান ব্রহ্মষ্ঠিন্ ব্রহ্মবাদিনঃ অক্রোধনান্ সত্যপরান দূরতঃ পরিবর্জ্জয় ॥১৩

ধ্যায়িনাে নিৰ্ম্মমাঞ্ছন্তান্ ধাৰ্ম্মিকান্ বেদপারগান্
যাজিনন্তাপসান্ বিপ্রান্ দূরতঃ পরিবৰ্জ্জয় ॥১৪

বেদবেদান্তবিজ্ঞান - সঞ্ছিন্নাশেষসংশয়ান্ । মহাযজ্ঞপরান্ বিপ্রান্ দূরতঃ পরিবৰ্জ্জয় ॥১৫

যে যজন্তি জপৈর্হোমৈর্দেবদেবং মহেশ্বরম্ ।
স্বাধ্যাবেনেজ্যয় দূরাৎ তান্ প্রযত্নেন বৰ্জ্জয় ॥১৬

ভক্তিযােগসমাযুক্তানীশ্বরার্পিতমানসান্ ।

প্রাণায়ামাদিষু রতান্ দুরাৎ পরিহরামলান্ ॥১৭

প্রণবাসক্তমনসাে রুদ্রজপ্যপরায়ণান ।
অথৰ্বশিরসাে বেত্তৃন ধৰ্ম্মজ্ঞান পরিবৰ্জ্জয় ॥১৮

বহুনাত্র, কিমুক্তেন স্বধৰ্ম্মপরিপালকান । ঈশ্বরারাধনরতান মন্নিযােগান ন মােহয় ॥১৯

(রেফারেন্স : কূর্মপুরাণ/পূর্বভাগ/অধ্যায় ২)

-------------------------সরলার্থ‌‌‍-------------------------

ভগবান ব্রহ্মা শ্রীবিষ্ণুকে বললেন,
হে জগতপতে সমুদয় ভূতের মােহের নিমিত্ত এই আত্মস্বরূপিণীকে(লক্ষ্মী) নিয়ােগ করুন ॥১০

হে মাধব ! যার ফলে আমার এই বিপুল সৃষ্টি পরিবর্ধিত (পরিচালিত) হয়।
এই কথা শুনে, শ্রীবিষ্ণু ঈষৎ হেসে লক্ষ্মীদেবীকে বললেন -  হে দেবি ! দেব অসুর মানুষসহ এই সমগ্র বিশ্বকে আমার(বিষ্ণুর) আদেশে মােহিত করে বিনিপাতিত করো ॥১১ - ১২॥

কিন্তু জ্ঞানযােগরত দান্ত ব্রহ্মনিষ্ঠ ক্রোধশূন্য সত্যধৰ্ম্মা ব্রহ্মবাদীদেরকে দূরে ত্যাগ কোরো(মায়া থেকে দূরে রেখো) ॥১৩

ধ্যানশীল, মায়াশূন্য, শান্ত, ধাৰ্মিক, বেদপরাগ, যাগ কারী ও তাপস ব্রাহ্মণদের দূরে ত্যাগ করবে(মায়া থেকে দূরে রাখবে) ॥১৪

বেদ বেদান্ত ও বিজ্ঞানের অনু যাদের অশেষ সংশয় তিরােহিত হয়েছে, মহাযজ্ঞই যাদের পরম আশ্রয়, সেই সকল ব্রাহ্মণদেরকে দূরে ত্যাগ করবে ॥১৫

যারা জপ, হােম, বেদপাঠ ও পূজাদি দ্বারা দেবদেব মহেশ্বরকে অর্চনা করেন, তাদের দূরে ত্যাগ করবে(যারা শিবভক্ত তাদের মায়াতে মোহিত করবে না) ॥১৬

ভক্তিযােগযুক্ত ঈশ্বরে(শিবের ঈশানরূপ) সমর্পিতহৃদয়ে, প্রাণায়ামাদিতে রত ও নিস্পাপ ব্যক্তিদের (শিবভক্তদের) দূরে পরিত্যাগ করবে ॥১৭

ওঙ্কারে সমাসক্ত রুদ্রজপপরায়ণ(ॐকারসহ শিবনামজপকারী ব্যক্তি) , অথৰ্ব্বশির(শৈবউপনিষদ)অধ্যায়নকারী ও ধৰ্ম্মজ্ঞ ব্যক্তিদের পরিত্যাগ করবে(মোহিত করবে না) ॥১৮

এ বিষয়ে আর অধিক বলবো কি, আমার(বিষ্ণুর) আদেশে স্বধৰ্ম্ম - পরিপালক ও ঈশ্বরারাধনে(শিবারাধনে) রত ব্যক্তিদের মােহিত করিও না ॥১৯

৹➖🌺🌻🌸🍀🌳মীমাংসা🌳🍀🌸🌻🌺➖৹

উপরোক্ত কূর্মপুরাণের দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে পরিষ্কার হল যে, জগত কে সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনা করার জন্য পালনকর্তা শ্রীহরিবিষ্ণু ব্রহ্মার অনুরোধে নিজ আত্মস্বরূপিণী শ্রীলক্ষ্মীদেবীকে বলছেন বিশ্বে যেন লক্ষ্মী দেবী তার মায়া দ্বারা আচ্ছন্ন করে রাখেন।

এর ফলে মানুষ তথা সমগ্র জীব কামনা বাসনা লোভ মোহ অহংকার দ্বেষ হিংসা ঘৃণা ভয় প্রভৃতির বশীভূত হয়ে সাংসারিক কর্মে লিপ্ত হয়ে জাগতিক সুখ পেতে চাইবে। ফলে স্ত্রীর প্রতি কামভাব তথা পুত্রকন্যার উপর মায়া করেই জগতের মধ্যে বদ্ধ হয়ে তথা আরো বিভিন্ন উচিত অনুচিত কার্য করে পাপপূণ্যের ভাগীদার হয়ে বারংবার জগতে ফিরে এসে জগতের সঞ্চালনার কার্যে সহায়ক হবে।

এই উদ্দেশ্যেই দেবী লক্ষ্মী জাগতিক জগতের মানুষকে ধন দৌলত প্রদান করেন যার মোহে পড়ে মানুষ জগতের মায়াতেই ভ্রমিত হতে পারে। কেননা, ধন দৌলত সবই নশ্বর। এই নশ্বর বস্তু গুলোর আশা করলে মানুষ লোভ মোহ কামনা বাসনার ফাঁদে পড়ে প্রকৃত নিত্যধন কে জানতে পারে না।

যে ব্যক্তি সেই নিত্যধনের সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জেনেছে সেই ব্যক্তিই এই মোহে আবদ্ধ জগতের বাইরে যাওয়ার মার্গ খুঁজে পেয়েছেন।

আর এই  মার্গ হল সেই মোক্ষের মার্গ। একমাত্র পরমজ্ঞান উপলব্ধি করার পরই এই মোক্ষ পাওয়া সম্ভব। সেই মোক্ষের পথ গুলোর কথা উপরোক্ত শ্লোকে বলা হয়েছে।

যে ব্যক্তি জ্ঞানযোগে রত হন অর্থাৎ জ্ঞানের সহিত যুক্ত হয়ে অজ্ঞান কে নাশ করেন, সত্যবাদী হয়ে শুধুমাত্র ধর্মপথে চলেন, নিজ মনের সমস্ত সংশয়ের সঠিক উত্তর গ্রহণ করে বেদের অর্থ বুঝতে সক্ষম,শান্ত,নিষ্ঠাযুক্ত, বেদপাঠ,জপ,হোম,ভক্তি দ্বারা পরমেশ্বরের শিবের প্রতি সমর্পিত হন, যে ব্যক্তি ॐকাররূপ পরমেশ্বর শিবের ভক্ত হন, সর্বদা রুদ্রনাম জপ করেন, অথর্বশির উপনিষদ অধ্যয়ন করে বেদান্তসারের উপলব্ধি করে মায়াশূন্য হন। তাদেরকেই এই মায়া আবদ্ধ করতে পারেনা।
তাই শ্রীবিষ্ণু দেবী লক্ষ্মী কে এই সমস্ত ব্যক্তিদের থেকে মায়াকে থেকে দূরে রাখতে বলেছেন।

কারণ, যখন কোনো ব্যক্তি সর্বোতভাবে পরমেশ্বর শিবের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে উত্তম জীবনযাপন করেন তখন স্বয়ং মায়ারূপী কামনা বাসনা হিংসা লোভ মোহ অহংকার সেই শিবভক্তকে গ্রাস করতে পারে না। এই কারণেই শাস্ত্রের বিভিন্ন স্থানে শৈববৃন্দগণকে বিশেষ বলা হয়েছে। কারণ শৈবগণ সর্বদা মীমাংসা সহ শাস্ত্রের সমস্ত উপযুক্ত বিষয়কে গ্রহণ করেন এরং অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পারেন। এই কারণেই ভক্তশৈবগণ সর্বোত্তম এবং বিশুদ্ধতায় পরিপূর্ণ হন। কিন্তু যে ব্যক্তিগণ সর্বদা কলে কৌশলে সেই পরমেশ্বর শিব ও তার পরমপবিত্র ভক্তদের নিন্দা করেন, মুখে বলেন বেদ মান্য করেন অথচ বেদের নিন্দুক তারাই।অতএব ইহারাই প্রকৃত মায়ায় আবদ্ধ জীব। এদেরকেই শ্রীলক্ষ্মীদেবী মায়া মোহিত করে মহাদেবের উত্তর যশ ও ঐশ্বর্য সম্পর্কে জানতে দেন না।ফলে নিন্দুক সহ সাধারণ জীবও শিব সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকে।

সিদ্ধান্ত -

জীবকে সর্বদা মহেশ্বরের ভজনা করা উচিত। মহেশ্বর ভিন্ন অন্য কিছু চিন্তাও করার প্রয়োজন নেই। কারণ, মহেশ্বরকে ভজনা করলে জ্ঞান স্বয়ং ভক্তের হৃদয়ে প্রকটিত হয়।ফলে অজ্ঞান দূর হয়। অজ্ঞান দূর হলেই সেই ভক্তশৈবের সমস্ত জাগতিক মায়ার বন্ধন কাটিয়ে মোক্ষ অর্থাৎ পরমপদ লাভের মার্গ প্রশস্ত হয়।

✍️লেখনীতে - শ্রী কৌশিক রায় শৈবজী 

🚩প্রচারে - International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত