গোরক্ষ পূর্ণিমা

  (নাথ সম্প্রদায় ভিত্তিক কিছু প্রাথমিক আলোচনা)


শৈবযোগী নাথপরম্পরা হিসেবে বৈশাখী পূর্ণিমাতে

শিবাবতার গুরুগোরক্ষনাথজী মর্তে অবতরণ করেছিলেন লোকশিক্ষার জন্য।


শৈব নাথযোগী পরম্পরার সূচনা পরমেশ্বর শিব থেকে..

নাথ শব্দের অর্থ স্বামী/প্রভু।

নাথ সম্প্রদায়ের সম্প্রদায়গত কথন অনুসারে পরমেশ্বর শিব হলেন জগতের আদি অর্থাৎ পুরাতন। তিনিই সমগ্র ভুবনের স্বামী, তিনিই সর্বোচ্চ প্রভু। তাই নাথযোগী পরম্পরাতে পরমেশ্বর প্রভু শিবকে জগতের আদিনাথ হিসেবে সম্বোধন করা হয়।


এই আদিনাথ শিব পরবর্তীতে দাদাগুরু শ্রীমৎসেন্দ্রনাথজীকে জ্ঞান প্রদান ও বিভিন্ন বরদান সহ আশীর্বাদ ধন্য করেন।

শ্রীমৎসেন্দ্রনাথজীই হলেন নাথ পরম্পরার প্রথম প্রচারক তথা প্রতিষ্ঠাতা। স্বয়ং পরমেশ্বর আদিনাথ শিবের জ্যোতি স্বরূপ সূক্ষ্মশরীরের থেকে বালকরূপী শ্রীগোরক্ষনাথজী প্রকটিত হন। আদিনাথ শিবের বালক স্বরূপী এই শিবজ্যোতি শ্রীগোরক্ষনাথজীই দাদাগুরু শ্রীমৎসেন্দ্রনাথজীর মহান শিষ্য হন।


মহাযোগীবর শ্রীগােরক্ষনাথ জীর আবির্ভাব ও কর্মক্রম উভয় দৈবিকতায় পরিপূর্ণ। তার আবির্ভাব আর পাঁচটা সাধারণ মানবের ন্যায় হয়নি। তিনি স্থূলশরীর ধারণ করে শৈবযােগীনাথ পরম্পার প্রচার করেছিলেন। শিববালকস্বরূপী শ্রীগােরক্ষনাথ জী দ্বারা প্রচারিত শৈবযােগীনাথ পরম্পরার মূল বৈশিষ্ট্য হল এই মতাদর্শে তন্ত্রের থেকে বেশি যােগসাধনা প্রাধান্যতা পায়।


♣(গোরক্ষনাথজীর আবির্ভাব সম্পর্কিত নাথসম্প্রদায়ভিত্তিক আলোচনা)♣


কোনো এক সময়ে কৈলাসে বসে আদিনাথ শিবকে দেবী পার্বতী অহংকারবশত বলেছিলেন যে,

             “ হে স্বামীন ! হে পরমেশ্বর ! হে নাথ ! জগতের সমস্ত জীবজগতকে আমি আমার মায়া দ্বারা আচ্ছন্ন করে পরিচালনা করে থাকি। এমন কি আপনাকেও আমি আমার মায়া দ্বারা আবদ্ধ করে রাখি, ফলস্বরূপ জগতে জীব সৃষ্টি হতে পারে। ”


অতঃপর মৃদ্যু হেসে পরমেশ্বর শিব দেবীকে বললেন –


            ” হে প্রিয়ে ! হে গিরিরাজনন্দিনী ! তুমি হিমালয় পর্বতের ওই গুহা টি দর্শন করে এসো ” দেবী গৌরী যখন কৈলাস হতে প্রস্থান করলেন , তখন পরমেশ্বর আদিনাথ শিব তার জ্যোতি থেকে সূক্ষ্মশরীর ধারনকারী এক বালকযােগী অবধূতকে প্রকট করেন এবং সেই গুহাতে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় সেই বালকযোগীকে বসিয়ে দিলেন। এদিকে দেবী পার্বতী সেই গুহাতে উপস্থিত হন। তিনি দেখতে পেলেন যে এক যোগী বালক ধ্যানমগ্ন অবস্থায় বসে আছেন, যার চারিদিকে জ্যোতির আলোয় আলোকিত। দেবী পার্বতী সেই যোগীবালকের কাছে এসে তার পরিচয় জানতে চাইলেন, কিন্তু সেই যোগীবালকের ধ্যান ভঙ্গ হল না । এরপর দেবী পুনরায় প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। কিন্তু তবুও কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। তখন দেবী গৌরী তার মায়ার জাল বিস্তার করতে তৎপর হলেন এবং সেই যোগীবালকের ধ্যান ভঙ্গ করার বহু চেষ্টা করলেন। কিন্তু দেবী পার্বতী তার ধ্যান ভাঙ্গাতে অসমর্থ হলেন, এরপর দেবী নিরাশ হয়ে কৈলাসে ফিরে এলেন। দেবী কৈলাসে ফিরে পরমেশ্বর শিবকে জিজ্ঞাসা করলেন,


          “হে জগতস্বামী! হে প্রাণনাথ! হে শম্ভু আপনি যে গুহার দর্শন করতে বলেছিলেন সেখানে আমি উপস্থিত হয়ে এক অদ্ভুত যোগীবালকের দর্শন পেলাম, সেই যোগীবালক ধ্যানমগ্ন হয়ে ছিলেন। আমি প্রথমে তার পরিচয় জানতে চাইলাম কিন্তু সে তাতে কর্ণপাত করেনি, তৎপশ্চাৎ আমি তার উপর আমার অভেদ্য মায়া প্রয়োগ করি কিন্তু সেই যোগীবালক তাতে বিন্দুমাত্রও বিচলিত হয়নি।


হে স্বামীন ! আপনি বলুন ওই যোগী অবধূত বালকের পরিচয় কি ? আমার ভীষন কৌতূহল হচ্ছে। আপনি এ বিষয়ে আমাকে অবগত করিয়ে আমার কৌতূহল নিবারণ করুন।


তখন পরমেশ্বর আদিনাথ শিব দেবী পার্বতীকে বললেন,


       ” অয়ি প্রিয়ে দেবী ! তুমি ওই গুহার মধ্যে সূক্ষ্মশরীরে যে অবধূতরূপী যােগী বালককে দেখেছেন, সেই জ্যোতির্ময়রূপধরী বালক আমারই এক স্বরূপ।


আমি আমার স্বেচ্ছায় তোমার মায়াতে আবদ্ধ হই মাত্র, যাতে এই জগতে জীবের সৃষ্টিকার্য হতে পারে এবং জগতে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে পারে।


আমাকে আমার ইচ্ছেতেই তুমি মায়া দ্বারা আবদ্ধ করে রাখো, তাই জীব জগত প্রকাশিত হয়। তোমার মায়ার কারণেই জীব তাঁর নিজের পরমভাব শিব স্বরূপকে জানতে পারে না । কিন্তু জীব যখন নিজের প্রকৃত স্বরূপকে চিনে যায় তখন সে মায়া মুক্ত হয়ে যায় এবং আমার মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।”


এরপর দেবী তাঁর নিজের ভুল বুঝতে পেরে পরমেশ্বরের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।


পরবর্তীতে পরমেশ্বর শিব তাঁর সেই বালকযোগী স্বরূপকে কালান্তরে স্থূলশরীর ধারণ করার আশীর্বাদ প্রদান করেন। এই কথনটি হল শ্রীগােরক্ষনাথ জীর সূক্ষ্মশরীরে প্রকট হওয়ার সংক্ষিপ্ত উপাখ্যান।


এবার নীচের আলোচনাতে শ্রীগােরক্ষনাথ জীর স্থূলশরীর ধারণ করার উপাখ্যানটি বর্ণনা করা হল ।


নাথ সম্প্রদায়গত কথন অনুসারে একদা একসময় দাদাগুরু শ্রীমৎসেন্দ্রনাথ জী ভ্রমণ করার সময় গােদাবরী নদীর তীরে চন্দ্রগিরি নামক স্থানে পৌঁছেছিলেন। সেখানে তিনি সরস্বতী নামক এক নিঃসন্তান মহিলার গৃহদ্বারে উপস্থিত হন এবং ” অলখ নিরঞ্জন ” বলে ধ্বনি দিতে থাকেন। সেই গৃহের মহিলা তখন ভিক্ষা দেয়ার জন্য বাইরে বেরিয়ে এলেন, কিন্তু তিনি যে মনদুঃখে আহত ছিলেন। সেটি বোঝা যাচ্ছিল। তার মনের দুঃখের অবস্থা বুঝে শ্রীমৎসেন্দ্রনাথ জী সেই মহিলাকে কিছু সিদ্ধ বিভূতি দিয়ে বললেন,


   হে মাত ! আমি বুঝেছি আপনার মনের বেদনা, এই নিন, এটা খেয়ে নেবেন, এর দ্বারা আপনার এক মহান পুত্র সন্তান লাভ হবে।

এরপর শ্রীমৎসেন্দ্রনাথ জী সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।

কিন্তু এদিকে সেই মহিলা লােকনিন্দার কথা ভেবে ভীত হয়ে সিদ্ধ বিভূতিটিকে একটি ঝােপের কাছে পড়ে থাকা গােবরের গাদাতে ফেলে দিলেন ।


পরমেশ্বর শিব শ্রীমৎসেন্দ্রনাথজীকে একসময়ে বচন দিয়েছিলেন যে সূক্ষ্মদেহে থাকা তাঁর যােগী বালকস্বরূপটি শ্রীমৎসেন্দ্রনাথ জীর মাধ্যমে স্থূলদেহ লাভ করে প্রকটিত হবেন।


সেই মহিলার গৃহে প্রায় বারাে বছর পরে শ্রীমৎসেন্দ্রনাথ জী আবার সেখানে ঘুরতে ঘুরতে উপস্থিত হলেন। সেই মহিলাকে শ্রীমৎসেন্দ্রনাথ তাঁর সন্তানের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। সেই মহিলা উত্তর দিতে গিয়ে বললেন যে, তিনি সেই সিদ্ধ বিভূতিটি খাননি, বরং লােকলজ্জার ভয়ে ভীত হয়ে সেই বিভূতিসমূহকে এক গােবরের গাদায় ফেলে দিয়েছেন ।


এসব কথা শুনে শ্রীমৎসেন্দ্রনাথ জী বললেন,


       ” হে মাত ! এ আপনি কি করলেন ? সেই পবিত্র বিভূতি যে আসলেই মহাদেবের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলাে, ওটি কিছুতেই নিরর্থক হতে পারে না। ” আপনি অনুগ্রহপূর্বক আমাকে সেই জায়গাটি দেখিয়ে দিন যেখানে আপনি সেই সিদ্ধবিভূতি ফেলে দিয়েছিলেন। সেই সরস্বতী দেবী নামের মহিলাটি তাকে সেই জায়গায় নিয়ে এলেন। অতঃপর শ্রীমৎসেন্দ্রনাথজী সেই স্থানে পৌঁছে “অলখ নিরঞ্জন” বলে একটি জোরালো ধ্বনি দিলেন ।

সাথে সাথে সেই গােবর ভেদ করে একটি দিব্যজ্যোতিসম্পন্ন বারাে বছর বয়সীর এক সুদর্শন বালক বেরিয়ে প্রকট হল।

যেহেতু গরুর গােবরের মধ্যেই এতদিন অপ্রাকৃত ভাবে সুরক্ষিত ছিল সেই দৈবিক বিভূতি। এই কারণে সেই বালকটিকে শ্রীমৎসেন্দ্রনাথ জী ” গােরক্ষনাথ” নাম প্রদান করলেন। তাকে শ্রীমৎসেন্দ্রনাথ জী নিজের শিষ্য হিসেবে সঙ্গে করে নিয়ে চলে গেলেন । এই গোরক্ষনাথজী তাঁর গুরু শ্রীমৎসেন্দ্রনাথজীর সাথে ভারতবর্ষের বিভিন্ন দিকে ভ্রমণ করেন এবং যােগমার্গ কে প্রচার করে ভারতকে শিবের পথে চালিত করেন । অবশেষে তিনি গােরক্ষপুরে পৌঁছে তার পবিত্র চরণধূলি দেন। নাথপন্থায় কথিত আছে, এই স্থানেতেই যােগপীঠ স্থাপন করে, যেটা আজ বর্তমানে গােরক্ষনাথ মন্দির নামে সুবিখ্যাত।


নাথ সম্প্রদায়ের প্রসার ও যােগ সাধনাকে সহজতর করে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেয়াই শিবাবতার শ্রীগােরক্ষনাথজীর স্থূলশরীরে প্রকট হওয়ার মূল হেতু। বর্তমানে গােরক্ষনাথ জী সূক্ষ্মশরীরে এখনাে এই বসুন্ধরা তথা বিশ্বে বিরাজমান আছেন, এই অধর্মের চরমসময় কলিযুগেও বহু নাথজীগণেরা বিশেষ সাধনার মাধ্যমে গােরক্ষনাথ জীর দর্শন ও তাঁর আশীর্বাদ লাভ করে সিদ্ধসাধক হয়েছেন। যেহেতু শৈবযােগীনাথ পরম্পরা অনুসারে শ্রীগােরক্ষনাথজীকে পরমেশ্বর শিব ও জীবের মাঝে অবস্থান করা পরমগুরু হিসাবে মান্য করা হয়। সেহেতু নাথযােগীরা গােরক্ষনাথ জীকে আশ্রয় করে,পরমেশ্বর আদিনাথ শিবের মধ্যে বিলীন হওয়া জীবের জীবনের পরম উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচিত হয় এই শৈবযােগীনাথজীদের কাছে।


ॐ শিব গোরক্ষায় নমো নমঃ ॥


লেখনীতে – শ্রীকৌশিক রায় শৈবজী


Copyright ও প্রচারে - International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত