পরমেশ্বর শিবের শরভেশ্বর স্বরূপ ধারণ ও নৃসিংহ দমন


ব্রহ্মার কাছ থেকে বরদান পেয়ে হিরন্যকশিপু দেবতা ও ঋষিদের উপর অত্যাচার করতে লাগলেন। নিজ পুত্র হরিভক্ত প্রহ্লাদকে দ্বেষ করতে প্রারম্ভ করলে শ্রীবিষ্ণু ক্রোধিত হয়ে নৃসিংহ শরীরে প্রকট হন (বিকরাল তথা ভয় দায়ক রূপ) এবং হিরন্যকশিপুকে বধ করেন। কিন্তু বধ করার পর‌ও নৃসিংহদেবের ক্রোধের অগ্নিজ্বলা শান্ত না হ‌ওয়ায় ব্রহ্মদেব ও অন্যান্য দেবতারা প্রহ্লাদকে নৃসিংহের কাছে পাঠালেন নৃসিংহ প্রহ্লাদকে হৃদয়ে লাগালেন যার দ্বারা তার হৃদয় শান্ত হলেও ক্রোধের জ্বালা শান্ত হতে পারেনি। দেবতারা শিবের শরণে গিয়ে শিবের স্তুতি করতে লাগলেন। জগৎ রক্ষার স্বার্থে শিব প্রসন্ন হয়ে নিজ স্বরূপ ভৈরব বীরভদ্রকে বলেন "সেখানে গিয়ে প্রথমে নৃসিংহ দেবের ক্রোধ শান্ত করার প্রচেষ্টা করো তারপরেও যদি শান্ত না হয় তাহলে আমার(শিবের) পরম ভৈরব রূপ দেখাবে" এই আদেশ দেন।

শিবের আজ্ঞায় বীরভদ্র পরম শান্তি রূপ ধারণ করে নৃসিংহের কাছে পৌঁছায় এবং নৃসিংহ দেবকে শান্ত হবার জন্য বোঝাতে লাগলেন (যেমন পিতা পুত্রকে বোঝায়) কিন্তু এতেও নৃসিংহ দেব শান্ত না হয়ে আগের তুলনায় আর‌ও বেশি ক্রোধিত হয়ে নিজ দাঁত দিয়ে বীরভদ্রকে ভয় দেখাতে লাগলেন এবং বললেন " তুমি যেখানে থেকে এসেছ সেখানে চলে যাও আমাকে লোকহিতের কথা বলোনা। আমি এখুনি এই সময় এই চরাচর জগৎকে বিনষ্ট করে দেব, আমি(নৃসিংহদেব) স্বয়ং সংহারকর্তা আমি এই সংসারের শাসক, আমার উপর শাসন করার কেউ নেই। তুমি(বীরভদ্র) আমার শরণে এসে নির্ভয় হয়ে যাও এই বিশ্ব আমার"।


বিষ্ণুর এরকম অহংকারযুক্ত বচন শুনে বীরভদ্র হেঁসে বললেন "আপনি কী সংসারের ঈশ্বর তথা সংহারকর্তা পিনাকধারী কে জানেন না? আপনার ভেতর কেবল মিথ্যাচার বিবাদ ভরে আছে, যা আপনার বিনাশের কারন। আপনি তো কেবল তার(শিবের) শক্তির কলামাত্র দ্বারা যুক্ত হয়ে এক রাক্ষসের বধ করেছেন কিন্তু এখন অসাবধান হয়ে অহংকারের প্রভাবে পড়ে করছেন। হে! নৃসিংহ আপনি না স্রষ্ঠা না ভর্তা না সংহার কর্তা আপনি কোনো প্রকারে স্বতন্ত্র নন আপনি সর্বদা মহাদেবের শক্তি দ্বারা কুলালচক্রের মতো তার(শিবের) অধীনে থেকে অনেক অবতার ধারণ করেন। আপনি যে চক্রের দ্বারা নিজ পুরুষার্থ প্রকট করেন সেই চক্রের কার দ্বারা প্রাপ্ত করেছিলেন‌? তা ভূলে গেছেন?


আমি তো‌ সম্পূর্ণ লোককে ধারণ করে রেখেছি আপনিতো ক্ষীরদসাগরে নিদ্রায় পরবশ ‌হয়ে ঘুমোতে থাকেন‌ এই স্থিতিতে আপনি‌ সাত্ত্বিক কীভাবে হন? শিবের শক্তিতেই আপনি শক্তিমান, অন্যথা আপনি লিঙ্গাকার তেজের প্রকটে মোহিত হয়ে পরেছিলেন। সেই তেজকে সূক্ষ্ম বুদ্ধিমতি জন ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ সেই সর্বব্যাপীর পরম পদকে দেখতে পারেনা।


হে‌! নৃসিংহ‌ এইসব বিচার করে আপনি নিজেই শান্ত হোন, হে! অবোধ এভাবে আপনি নিজেকে বিনষ্ট করুন, অন্যথা এই সময় যেমন সূক্ষ্ম বৃক্ষের উপর বিদ্যুৎ পড়ে সেভাবেই মহাভৈরব রূপ সেই রুদ্রের ক্রোধ মৃত্যুরূপ হয়ে আপনার উপর পড়বে।

নৃসিংহ এইসব বচন শুনে ক্রোধিত হয়ে বীরভদ্রের দিকে অগ্ৰসর হলে সেইসময় মহাঘোর, ভয়ের কারণ, অত্যন্ত প্রচন্ড, আকাশব্যাপী, দুধর্ষ, শিবতেজ থেকে উৎপন্ন, আগে কখনো না দেখা বীরভদ্রের অদ্ভূৎ রূপ প্রকট হয় যা না হিরন্ময়, না সৌম্য ছিল, সেই তেজ না সূর্য না অগ্নি দ্বারা উৎপন্ন হয়েছিল, না বিদ্যুতের সমান না চন্দ্রমার সমান সেই শিবতেজ অনুপম ছিল।সেইসময় সকল তেজ শিবে লীন হয়েছিল । সেই তেজ প্রকট কালরূপ ছিল যা রুদ্রের সাধারন চিহ্ন মাত্র ছিল।


দেবতাদের জয় জয় ধ্বনীর সঙ্গে সঙ্গে পরমেশ্বর সংহার রূপে প্রকট হন। হাজার বাহুর সমন্বিত, জটাধর, ললাটে ভালচন্দ্র ধারণ করে উগ্ৰ শরীরযুক্ত দুটি ডানা এবং চোঁচযুক্ত পক্ষীর মতো দেখাচ্ছিল। তার দাঁত অত্যন্ত বিশাল ও তীক্ষ্ম ছিল। তার নেত্রর কৃতাগ্নির সমান এই প্রকারে উগ্ৰস্বরূপ ধারণ করে বিকটরূপ ধারণকারী শিব নৃসিংহের সামনে প্রকট হন।


সেই রূপকে দেখে নৃসিংহদেবের সমস্ত পরাক্রম লুপ্ত হয়ে যায়। এরপর সে দুটি থাবা দ্বারা নৃসিংহের নাভি ও চরণে বিদীর্ণ করতে থেকে নিজের লেজ দিয়ে নৃসিংহের চরণ তথা হাত দ্বারা তার ভূজাকে বেঁধে দেন, এরপর ভূজা দ্বারা হৃদয় বিদীর্ণ করতে করতে শিব নৃসিংহ কে ধরে রাখেন তারপর দেবতা ও মহর্ষিদের নিয়ে আকাশে চলে যান। তিনি নৃসিংহ দেবকে ডানা দ্বারা মেরে আহত করে দেন এবং সেই অনন্ত ঈশ্বর নৃসিংহ কে বৃষভের উপর নিয়ে চলে যান। তারপর সমস্ত ঋষি ও দেবতাগণ পরমেশ্বর শিবের স্তুতি করতে লাগলেন। 


এইপ্রকারে নিয়ে যাওয়ার সময় নৃসিংহ দেব হাত জোড় করে সেই পরমেশ্বরের স্তুতি করতে শুরু করেন। শিবকে ১০৮ নমঃ দ্বারা শরভেশ্বরের স্তুতি করে নৃসিংহ দেব প্রার্থনা করেন, হে! পরমেশ্বর যখন যখন আমার এই মূঢ় বুদ্ধি অহংকারে দূষিত হবে তখন তখন‌ আপনি সেই অহংকার দূর করবেন।


এই প্রকার প্রীতিপূর্বক শিবের কাছে প্রার্থনা করে নৃসিংহ রূপধারী শ্রীবিষ্ণু আজীবনপর্যন্ত নিজের পরাধীনতা স্বীকার করে বার বার প্রনাম করেন।বীরভদ্র ক্ষণমাত্রতে নৃসিংহের মূখসহিত সমস্ত শরীরের শক্তি নিজের মধ্যে সমাহিত করেন। তারপর ব্রহ্মা সহিত সমস্ত দেবতাগণ শিবের শরভরূপ ধারণকারী সমস্ত লোকের কল্যাণকারী একমাত্র ভগবান শিবের স্তুতি করতে লাগলেন। পরমেশ্বর শিব প্রসন্ন হয়ে অন্তর্ধান হয়ে যান এবং বীরভদ্র নৃসিংহের চর্ম তুলে এবং তা নিয়ে কৈলাসে চলে যান।


সেইসময় থেকেই পরমেশ্বর শিব নৃসিংহের চর্ম ধারণ করেন এবং নৃসিংহের মুখ নিজের মুণ্ড মালার সুমেরু বানান। এরপর সমস্ত দেবতাগণ নির্ভয়ে সেখান থেকে চলে যান।

যে ব্যক্তি এই বেদসার যুক্ত আখ্যান শুনে তার সমস্ত কামনা পূরণ হয়ে থাকে।


[রেফারেন্স- শিব মহাপুরাণ/শতরুদ্রিয় সংহিতা/ ১১,১২ অধ্যায়]

লেখনীতে - শ্রীনমিতা রায় দেবীজী

🌷নমঃ শরভেশ্বরায়🙏

🌷নমঃ শিবায়🙏

কপিরাইট ও প্রচারে- International shiva shakti gyan tirtha-#ISSGT ©Namitaroy(ISSGT)

#শৈববিপ্লব #ISSGT

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত