কাশ্মীর শৈবপরম্পরার আচার্য শ্রীঅভিনবগুপ্তের সংক্ষিপ্ত জীবনী

 🚩#শৈবাচার্য_ভৈরবাবতার_অভিনবগুপ্তজীর_আবির্ভাব_তিথি উপলক্ষ্যে এই তথ্যগুলি প্রকাশিত হল ISSGT এর পক্ষ থেকে ।


শৈবাচার্য ভৈরবাবতার অভিনবগুপ্তের জীবনী

অভিনবগুপ্ত কবি কালিদাসের মতো আত্মপরিচয়দানে একেবারে নীরব নন। কালিদাস তার স্বরচিত মহাকাব্য গুলিতে নিজের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেন নি। অভিনবগুপ্ত কিন্তু তাঁর তন্ত্রালোক এবং পরাত্রিংশিকাবিবরণ এই দুটি গ্রন্থে নিজের জীবন ও স্বীয় পিতৃপুরুষের সম্পর্কে কিছু তথ্য বিবৃত করেছেন। তাঁর বিভিন্ন টীকাতে তিনি তাঁর শিক্ষাগুরুদের নাম এবং তাদের কাছে তিনি কি কি বিষয় অধিগত করেছিলেন, সে কথাও কয়েকবার উল্লেখ করেছেন। এই সমস্ত টুকরো টুকরো তথ্য একত্র করে এবং সেগুলোকে যথাসম্ভব কালানুক্রমে সাজিয়ে নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের একটি অলেখ্য পরিবেশন করার আন্তরিক প্রচেষ্টা করা হল।

অগস্ত্য গোত্রীয় অত্রিগুপ্তকে অভিনবগুপ্ত তাঁর বংশের আদিপুরুষ বলে উল্লেখ করেন। অত্রিগুপ্ত মধ্যপ্রদেশ বা অন্তর্বেদিতে (বর্তমান উত্তরপ্রদেশ) বসবাস করতেন এবং কনৌজের রাজা যশোবর্মার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। অত্রিগুপ্ত ছিলেন একজন অত্যন্ত পন্ডিত ব্রাহ্মণ। তিনি সাধারণভাবে বিদ্যার সকল শাখাতেই পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন এবং শৈব শাস্ত্রের বিষয়ে ছিল তাঁর অগাধ পান্ডিত্য। কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্য আত্রিগুপ্তের পান্ডিত্যে অতিমাত্রায় মুগ্ধ হয়ে এই পণ্ডিতকে তাঁর সঙ্গে কাশ্মীরে যেতে অনুরোধ করেছিলেন।

নিঃশেষশাস্ত্রসদনং কিল মধ্যদেশস্তস্মিন্নজাযত গুণাভ্যধিকো দ্বিজন্মা।

কোঽপ্যত্রিগুপ্ত ইতি নামনিরুক্তগোত্রঃ

শাস্ত্রাব্ধিচবর্ণকলোদ্যদগস্ত্যগোত্রঃ।।"

তমথ ললিতাদিত্যো রাজা স্বকং পুরমানযত্।

প্রণযরভসানত্ কাশ্মীরাখ্যাং হিমালযমুর্ধগম্।।

(ত. আ., খন্ড XII পৃ. ৪০৪-৫)

যশোবর্মাকে পরাস্ত করে ললিতাদিত্যের বিজয়ের কাল নির্ণয় হয়েছে ৭৪০ খৃষ্টাব্দ নাগাদ, সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, শৈব অভিনবগুপ্ত এই ঘটনার প্রায় দু-শ বছর পরে যে বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই বংশ মধ্যপ্রদেশ থেকে কাশ্মীরে চলে গিয়েছিল অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। রাজা ললিতাদিত্য বিতস্তা নদীর (ঝিলম) তীরে, শীতাংশুমালীর (শিব) মন্দিরের বিপরীতে একটি জমিতে আত্রিগুপ্তের জন্য একটি সুন্দর গৃহ নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন এবং একটি বড়ো জায়গীর ও তাঁকে দেওয়া হয়েছিল জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য।

তস্মিন্কুবেরপুরচারু সিতাংশুমৈলিসাংমুখ্যদর্শনবিরূঢপবিত্রভাবে।

বৈতস্তরোধসি নিবাসমমুষ্য চক্রে

রাজা দ্বিজস্য পরিকল্পিতভূরিসম্পত্।।

(বহী, পৃ. ৪১১)

অত্রিগুপ্ত ছাড়াও অভিনবগুপ্ত তাঁর পিতামহ বরাহগুপ্তের নাম উল্লেখ করেছেন। পান্ডিত্যসাধনার এই ধারাটি তাঁদের কুলে বংশানুক্রমে, অব্যাহতই ছিল। বরাহগুপ্তও মহাপন্ডিত এবং শিবের ভক্ত ছিলেন।

তস্যান্বযে মহতি কোঽপি বরাহগুপ্ত-

নামা বভূব ভগবান্ স্বযমন্তকালে।

গীর্বাণসিন্ধুলহরীকলিতাগ্রমুর্ধা

যস্যাকরোত্পরমনুগ্রহমাগ্রহেণ।।

(বাহী)

অভিনবগুপ্তের পিতার নাম নরসিংহগুপ্ত ওরফে চুখুলক। চুখুলক ও মহাপন্ডিত ছিলেন এবং সকল শাস্ত্রেই ছিল তাঁর সমান দক্ষতা। তিনিও ছিলেন একনিষ্ঠ শিব ভক্ত। অভিনবগুপ্তের মায়ের নাম ছিল বিমলা।

বিমলকলাশ্রয়াভিনবসৃষ্টিমহা জননী

ভরিততনুশ্চ পঞ্চমুখগুপ্তরুচির্জনকঃ।

(ত. আ. I পৃ. ৩)

অস্য হি গ্রন্থকৃতঃ শ্রীনরসিংহগুপ্তবিমলাখ্যৌ পিতরৌ ইতি গুরবঃ।

(বহী, টীকা, পৃ. ১৪)

তিনি ছিলেন ধর্মপ্রানা এবং পূণ্যশীলা রমণী। নরসিংহগুপ্ত এবং বিমলা সুখী দম্পতি ছিলেন এবং তাঁরা পার্থিব কোন কিছুর কামনায় সাংসারিক কর্তব্য পালন করতেন না, কারণ শাস্ত্রে ঐরকমই নির্দিষ্ট রয়েছে। পারিবারিক পরিবেশটি ছিল গভীরভাবে ধর্মপ্রাণ এবং পান্ডিত্যপূর্ণ। ৯৫০ থেকে ৯৬০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে অভিনবগুপ্ত এই পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কাশ্মীরি পরম্পরা অনুসারে মানুষের বিশ্বাস অভিনবগুপ্ত ছিলেন যোগীনিভূ, অর্থাৎ কোনো যোগীনির পুত্র। অভিনবগুপ্তের পিতা-মাতা ছিলেন ভগবান শিবের নিষ্ঠাবান ভক্ত। পরবর্তী জীবনে শৈবদর্শনের ব্যাখ্যা দেওয়ার কারণে এবং শৈবযোগীর ন্যায় জীবন যাপন করার ফলে অভিনবগুপ্ত কাশ্মীরে শৈব সম্প্রদায়সমূহের মধ্যে আচার্য পদে উন্নীত হন। শৈবদের বিশ্বাস শুধুমাত্র কোন যোগীনিভূই শৈব অদ্বৈতবাদের মূল তত্ত্বসমুহ সঠিকভাবে অনুধাবন করতে বা যুক্তি সঙ্গতভাবে তার ব্যাখ্যা করতে সমর্থ। সুতরাং তিনিও যোগীনীভূ ছিলেন এই ধারণা। শৈব তত্ত্ব অনুসারে যে পিতা-মাতা যোগীনীভূ মর্যাদা সম্পন্ন পুত্র-সন্তান আখাঙ্খা করেন, তাঁদের উচিত মিলনকালে সর্বপ্রকার সাংসারিক কামনা বাসনার উর্ধ্বে থাকা। মাতার উচিত নিজেকে শক্তির সঙ্গে একাত্মা অনুভব করা এবং পিতার উচিত শিবের সঙ্গে নিজেকে একাত্মা মনে করা। অভিনবগুপ্তের তন্ত্রালোকের টীকাকার জয়রথের বক্তব্য যে, তাঁর(অভিনবগুপ্তের) নিজের বক্তব্যের মধ্যেই তাঁর যোগীনিভূ হওয়া সম্পর্কিত লোক বিশ্বাসের মূল নিহিত, কারণ জয়রথের ব্যাখ্যা অনুসারে তন্ত্রালোকের প্রথম শ্লোকটিতেই এ ঘটনার উল্লেখ আছে।

শিবশাক্ত্যাত্মকং রূপং ভাবযেচ্চ পরস্পরম্।

ন কুর্যান্মানবীং বুদ্ধিং রাগমোহাদিসংযুতাম্।।

জ্ঞানভাবনযা সর্বং কর্তব্যং সাধকোত্তমৈঃ।

এবম বিধসিদ্ধযোগিনীপ্রাযপিতৃমেলকসমুত্থতযা

তাদৃঙ্মেলককলিকাকলিততনুর্যো ভবেদ্ গর্ভে।

উক্তঃ স যোগিনীভূঃ স্বযমেব জ্ঞানভাজনং ভক্তঃ।।

ইত্যুক্তনীত্যা স্বাত্মনি নিরুত্তরপদাদ্বযজ্ঞানপাত্রতামভিদধতা গ্রন্থকৃতা

নিখিলষডর্ধশাস্ত্রসারসংগ্রহভূতগ্রন্থকরণেঽপ্যধিকারঃ কটাক্ষীকৃতঃ।

(ত. আ. I টীকা. পৃ. ১৪-১৫)

পরবর্তী গ্রন্থকারেরা অভিনবগুপ্তকে অভিনবগুপ্তপাদ নামে সম্বোধন করেছেন। পাদ শব্দটি এখানে সন্মানসূচক হিসাবে ব্যবহৃত। অভিনবগুপ্ত ব্যাকরণে সুপন্ডিত ছিলেন। তিনি পিতা চুখুলকের কাছেই মহাভাষ্য অধ্যয়ন করেছিলেন। তাঁরা রচনাসমূহের প্রতিক্ষেত্রেও ব্যাকরণ জ্ঞানের দক্ষতা পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং এই বিদ্যাতে তাঁর নৈপুণ্যের ইঙ্গিত দেবার জন্যই তাঁর নাম হয়েছিল অভিনবগুপ্তপাদ।

পন্ডিত বামনাচার্য এবিষয়ে আরেকটি কাহিনীর উল্লেখ করেছেন। বাল্যবস্থায় অভিনবকে পাঠশালায় পাঠানো হয়েছিল। তার বহুমুখী বুদ্ধিমত্তা এবং তীক্ষ্ণ স্মৃতি শক্তি দেখে শিক্ষকবৃন্দ অত্যন্ত মুগ্ধ হন। তাঁর সহপাঠীরা সর্প দেখে যেমন ভীত সন্ত্রস্ত হত, তাকে দেখা মাত্রই তারা একই অবস্থায় সন্মুখীন হত। তাই অধ্যক্ষরা তাকে অভিনবগুপ্তপাদ নামে অভিহিত করতেন। প্রথম অথবা দ্বিতীয় যে আখ্যানকেই প্রমাণ্য রূপে গণ্য করা হোক না কেন, এর থেকে আমরা এই ধারণায় উপনীত হই, যে অভিনবগুপ্ত নামটি সম্ভবত তার প্রকৃত নাম ছিল না, তথাপি তার গুরু কর্তৃক প্রদত্ত ছিল। ইহাই যে সত্য, তাহা তিনি তার রচিত তন্ত্রালোক(পৃ -৫০) গ্রন্থে এই বিষয়ে ইঙ্গিত প্রদান করেছেন।

অভিনবগুপ্তস্য কৃতিঃ সেযং যস্যোদিতা গুরুভিরাখ্যা।

(ত. আ. I পৃ. ৫০)

তিনি বললেন :- "এই কীর্তি সেই অভিনব গুপ্তের যার নাম তার গুরু কর্তৃক প্রাপ্ত।"

"ইহা স্মরণ রাখা অত্যন্ত আবশ্যক যে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে যে শৈব অভিনবগুপ্তের বিষয়ে অধ্যায়ন করতে চলেছি, তিনি এবং মাধবাচার্য রচিত শঙ্কর দিগ্বিজয় গ্রন্থে উল্লেখিত ব্যক্তি ভিন্ন। শ্রী শঙ্করাচার্যের জীবনী রচনা প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে অভিনবগুপ্ত কামরূপ (অসম) এর নিবাসী ছিলেন। তিনি শাক্ত মতাবলম্বী ছিলেন এবং বেদান্ত সূত্রের উপর শাক্ত ভাষ্য রচনা করেন। দ্বিগবিজয় কালীন পর্বে শঙ্করাচার্য কামরূপ পৌঁছে তাকে শাস্ত্রার্থে পরাজিত করেছিলেন। এর থেকে স্পষ্টভাবে প্রমানিত হয় যে এই অভিনবগুপ্ত ভিন্ন ব্যক্তি, যার সম্বন্ধে এই অধ্যায়ে আলোচনা করছি। প্রথমত মাধবাচার্যের গ্রন্থে উল্লেখিত অভিনবগুপ্ত একজন শাক্ত মতাবলম্বী ব্যাক্তি যিনি অসমের নিবাসী ছিলেন। ওই অভিনবগুপ্ত শ্রী শঙ্করাচার্যের সমকালীন ৭৮০ থেকে ৮২০ খ্রিস্টাব্দে আবির্ভুত হন, এবং আমাদের অভিনবগুপ্ত ৯৬০ থেকে ১০২০ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীরে আবির্ভূত হন। অতএব যাদের আবির্ভাব কালের মধ্যে দু শতাব্দীর পার্থক্য, শুধুমাত্র একই নামের জন্য দুজনকে একই ব্যক্তি অনুধাবন করা সম্পূর্ন ভ্রান্ত।"

অভিনবগুপ্তের জন্ম এমন এক বংশে হয়েছিল, যারা বংশ পরম্পরায় বিদ্বান ও শৈব ভক্তির শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তার জীবনের প্রত্যেক দিন এমন এক উৎকৃষ্ট পরিবেশে অতিবাহিত হত যেখান পান্ডিত্য, জ্ঞান ও ভক্তি ভাবনার রস প্রবাহে সমৃদ্ধ ছিল। তার পরিবারে তার মাতা-পিতার অতিরিক্ত তার কাকা বামনগুপ্ত এবং ছোট ভাই মনোরথ ও পাঁচ খুড়তুতো ভাই ক্ষেম; উৎপল; অভিনব; চরক; পদ্মগুপ্ত। তার কাকা বামনগুপ্ত ছিলেন একজন বিদ্বান কবি। অভিনবগুপ্ত তার কাকার নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং নাট্য শাস্ত্রের উপর তার রচিত প্রসিদ্ধ টীকায় তিনি কাকা বামনগুপ্তের একটি পদ্য উদ্ধত করেন।

তত্র হাস্যাভাসো যথাস্মত্পিতৃব্যস্য বামনগুপ্তস্য

লোকোত্তরাণি চরিতানি ন লোক এষ

সংমন্যতে যদি কিমঙগ বদাম নাম।

যত্ত্বত্র হাসমুখতত্ত্বমমুষ্য তেন

পার্শ্বোপপীডমিহ কো না জহাসতীতি।।

(আ. ভা. I ২৯)

অভিনবগুপ্তের খুড়তুতো ভাইরা পরবর্তীকালে তার শিষ্যত্ব গ্রহন করেন। সমগ্র পরিবারের অভিরুচি ছিল বিদ্যাচর্চা ও ভক্তিরস আস্বাদন করা। তার পরিবারের অন্তরমহলের পারিবেশ সম্পর্কে অভিনবগুপ্ত উল্লেখ করেন।

পরিবারের সমস্ত সদস্যরা পার্থিব সম্পদকে খড়কুটোর সাথে তুলনা করে এবং সমগ্র চিত্ত শিব ধ্যানে সমর্পন করে দেন।

যে সংপদং তৃণমমংসত শম্ভুসেবাসংপূরিতং স্বহৃদযং হৃদি ভাবযন্তঃ।

(ত. আ. XII. পৃ. ৪১৭)

এইরকম ঘরোয়া পরিবেশে এক শুদ্ধ, সুন্দর মস্তিষ্ক এবং অন্ত:করণের সুবিকাশের জন্য অত্যন্ত আবশ্যক ছিল যা পরবর্তীতে অভিনবগুপ্তকে মহান কার্যে অনুপ্রেরিত করার উদ্দেশ্যে অনুঘটকের কার্য করেছিল। অভিনবগুপ্তের অন্তরে বিদ্যা আহরণের প্রবল তৃষ্ণা বিদ্যমান ছিল। তিনি আচার্যের থেকে শাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য কাশ্মীরের বাইরে ও ভ্রমণ করেছিলেন।

তন্ত্রালোকের(VIII পৃ. ২০৫-২০৬) তিনি বলেছেন, মানুষ সৌভাগ্যবশত যদি এমন গুরুর সান্নিধ্য অর্জন করেন, যিনি নিজে পূর্ণতা অর্জন করেছেন এবং তার শিষ্যকে সরলতার সহিত পূর্ণতার দিকে অগ্রসর করেন, তবুও তার এই অর্থ হয় না যে, সেই ব্যাক্তি অন্য শাস্ত্র অধ্যায়নের জন্য ও অন্য মার্গের জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে ভিন্ন গুরুর সান্নিধ্য লাভে দ্বিধা বোধ করবে। এমনকি তিনি ও নিজে শৈব শাস্ত্রে পূর্ণতা অর্জনের পরে ও তার জ্ঞান তৃষ্ণা নিবারণের উদ্দেশ্যে বৌদ্ধ ও জৈন গুরুর সান্নিধ্য লাভ করেন।

অহমপ্যত এবাধঃ শাস্ত্রদৃষ্টিকুতূহলাত্।

নাস্তিকার্হতাবৌদ্ধাদীনুপাধ্যাযানসেবিষম্।।

(ত. আ. VIII পৃ. ২০৬)

শ্রীচন্দ্রচন্দ্রবরভক্তিবিলাসযোগানন্দাভিনন্দশিবভক্তিবিচিত্রনাথাঃ।

অন্যোঽপি ধর্মশিববামনকোদভটশ্রীভূতশভাস্করমুখপ্রমুখা মহান্তঃ।।

(ত. আ. XII পৃ. ৪১৫)

উনার রচিত গ্রন্থের মধ্যে আমরা উনার আচার্য ও তাদের দ্বারা প্রাপ্ত জ্ঞানের নিন্মলিখিত ধারাবাহিক বিবরণ পাই।

১. নরসিংহগুপ্ত(পিতা) : ব্যাকরণ

২. বামনাথ : দ্বৈত তন্ত্র

৩. ভূতিরাজ : ব্রহ্মবিদ্যা

৪. ভূতরাজতনয় : দ্বৈতাদ্বৈত শৈবাগম

৫. লক্ষ্মণগুপ্ত : ক্রম ও ত্রিক দর্শন

৬. ভট্ট ইন্দুরাজ : ধ্বন্যালোক

৭. ভট্ট তৌত : নাট্যশাস্ত্র

৮. শম্ভুনাথ (জালন্ধর) : কৌলগম

অভিনবগুপ্তের তার মায়ের প্রতি নিবিড় স্নেহ ছিল। তার জীবনের সম্পূর্ন মধুরতা মাতৃ কেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু বাল্যকালে অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাসে মায়ের অন্তর্ধান হয়। নিঃসন্দেহে এই ঘটনা তার জীবনে এক চরম দুর্ভাগ্যপূর্ন ছিল। কিন্তু তিনি এই ঘটনাকে ঈশ্বরের লীলা স্বরূপ অনুধাবন করেন এবং যা মনুষ্যকে তার ভবিষ্যতের কার্যের জন্য প্রস্তুত করে। তাহার শব্দে:-

মাতা ব্যযুযূজদমূং কিল বাল্য এব,

দৈবো হি ভাবিপরিকর্মণি সংস্করোতি।

(ত. আ. XII পৃ. ৪১৩)

মাতার মৃত্যুর পর অভিনবগুপ্তের স্নেহের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন তার পিতা। পিতার স্নেহ তার প্রতি পুত্র এবং শিষ্য দুরূপেই বিদ্যমান ছিল। এর কিছুদিনের মধ্যেই তার পিতা সমস্ত সাংসারিক বন্ধন ত্যাগ করে সন্যাস গ্রহণ করেন। এই ঘটনাক্রম অভিনবগুপ্তের অন্ত:মনে সংসারের প্রতি তীব্র বৈরাগ্যের উদয় করে এবং তিনি প্রভু শিবের প্রতি ভক্তি মার্গে নিজেকে সমর্পন করে দেন। এই পরিবর্তন এতই সুদৃঢ় ছিল যে তিনি আজীবন অকৃতদার থাকার সংকল্প করেন(দারাসূতপ্রভৃতিবন্ধকথামনাপ্তঃ)। এর থেকে উনার জীবনে এক নব ঘটনাক্রমের সূচনা হয়। লৌকিক জীবন পদ্ধতি এবং গার্হস্থ্য জীবন শৈলীতে তার রুচি সম্পূর্ন রূপে লুপ্ত হয়ে যায়। তখন থেকে তিনি নিজের আধ্যাত্মিক প্রবৃত্তির ক্রমবর্ধমানতার জন্য এবং আগম শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জনের অনুসন্ধানে ভিন্ন ভিন্ন গুরুর সান্নিধ্য লাভ করেন। আগম সাহিত্যে অধ্যায়নে উনার আস্থা এবং অর্জিত পাণ্ডিত্যের নিদর্শন হলো তার রচিত মহান গ্রন্থ তন্ত্রালোক। লক্ষ্মণ গুপ্তের তত্ত্বাবধানে তিনি আগম শাস্ত্রের অধ্যায়ন করেন এবং ক্রম দর্শন শাস্ত্রের সঙ্গে পরিচিত হন। অভিনবগুপ্ত আগম শাস্ত্রের তিন শাখা- ১) ক্রম ২) ত্রিক ৩) কুল এর অধ্যায়ন করেন। প্রত্যভিজ্ঞা দর্শন ত্রিক সম্প্রদায়ের একটি শাখা মাত্র। উনার ক্রম স্তোত্র ৯৯০ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয় এবং অভিনবগুপ্ত এই ক্রম দর্শনকে অনুসরণ করে আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ করেছিলেন। এই প্রয়োগের সুতীব্র সফলতা প্রাপ্ত হয়। কিন্তু অভিনবগুপ্ত এই সফলতায় নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখেন নি। এরজন্য তিনি ত্রিক দর্শন ও কুল দর্শনের প্রতি অনুরক্ত হন। নিজের আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসার আকাঙ্খা সম্পূর্ন রূপে পরিতৃপ্ত হয় কুল দর্শন জ্ঞান প্রাপ্তির মাধ্যমে। কুল দর্শন শিক্ষায় তার গুরু ছিলেন জালন্ধর পিঠের শম্ভুনাথ। তন্ত্রালোকের একাধিক স্থানে তিনি গুরু শম্ভুনাথের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এক স্থানে তিনি বলেছেন, তার হৃদয় কমল শ্রী শম্ভুনাথ রুপী সূর্যের কিরণে উদ্ভাসিত হয়েছে।

শ্রীশম্ভুনাথভাস্করচরণনিপাতপ্রভাপগতসংকোচম্।

অভিনবগুপ্তহৃদম্বুজম্......।।

(ত. আ. I পৃ. ৫১)

বোধান্যপাশবিষনুত্তদুপাসনোত্থবোধোজ্জ্বলোঽভিনবগুপ্ত ইদং করোতি।

(বহী, শ্লোক ১৬, পৃ. ৩৩)

তন্ত্রালোক এবং প্রত্যাভিজ্ঞাবিমর্শিনী নামক গ্রন্থ রচনার পূর্বেই অভিনবগুপ্ত আধ্যাত্মিক স্তরে মহত্ত্ব অর্জন করেছিলেন। অভিনবগুপ্তের পরমার্থসার গ্রন্থে যোগরাজের টীকায় এর উল্লেখ রয়েছে। যোগরাজ বললেন অভিনবগুপ্ত ভৈরব অবস্থা প্রাপ্ত করেছিলেন।

অভিনবগুপ্তেন মযা শিবচরণস্মরণদীপ্তেন।

শিবস্য পরশ্রেযঃস্বভাবস্য স্বাত্মস্থস্য চিদানন্দৈকমূর্তেঃ মাতি চরণানি চিদ্রশ্চযঃ তেষাং স্মরণং শব্দাদিবিষযগ্রহণকালে নিভালনং প্রতিক্ষণং স্বানুভবাপ্রমোষঃ তেন দীপ্তঃ পরাহন্তাচমত্কারভাস্বরঃ...ইত্যপদেষ্টুঃ সমাবিষ্টমহেশ্বরস্বভাবোঽনেনোক্তঃ স্যাত্।।

(অভি., পৃ. ১৬-১৭ হতে উদ্ধৃত)

ইহা হলো সেই অবস্থা যা বেদান্তে জীবনমুক্ত নামে পরিচিত। কাশ্মীর পরম্পরা পন্ডিত অভিনবগুপ্তকে ভৈরব অবতার স্বরূপ মনে করেন। যেরূপ প্রগাঢ় পান্ডিত্যের সহিত অভিনবগুপ্ত দর্শনের উপর প্রমুখ গ্রন্থ রচনা করেন তা ভারতবর্ষের দার্শনিক প্রজ্ঞা এবং বাঙ্ময়তার অমূল্য সম্পদ। সংস্কৃত শাস্ত্রে তার প্রগাঢ় জ্ঞান তাকে কাব্যশাস্ত্রের মর্মজ্ঞ বিদ্বান রূপে প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু এসব তার প্রকাণ্ড মহীরুর স্বরূপ কীর্তির এক ক্ষুদ্র সংস্করণ মাত্র। উনার প্রমুখ অবদান কাশ্মীর শিবদ্বয় দর্শনের প্রতি, যার জন্যে তাকে আচার্য রূপে অভিহিত করা হয়। তার এই অবদান পার্থিব জগতে বাস করে সাংসারিক ভাবনায় আপ্লুত হয়ে ভাববার বিষয় নহে। বহু বর্ষ যাবত যৌগিক অভ্যাসের দ্বারা অর্জিত আত্ম অনুভূতির সংকলন হলেন অভিনবগুপ্ত। কখনও কখনও তিনি আধ্যাত্ম জগতে নিজের আত্ম উপলব্ধির কাহিনী উল্লেখ করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ, তন্ত্রালোকের বিষয়বস্তু প্রস্তাবিত করার সময় তিনি বলেছেন যে,

ভগবান শিবের আজ্ঞায় আমি নিজ অনুভুতি, তার্কিক যুক্তি, এবং শৈব শাস্ত্রের আধারে স্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করেছি। অথবা কালতত্ত্বের উপর নিজের বিবেচনা সমাপন করতে গিয়ে বলেন যে,

আগম, শাস্ত্র, এবং নিজ আত্ম উপলব্ধির আধারে এই প্রকার কালতত্ত্বের বিবেচনা করছি।

দশর্যতে তত্ শিবাজ্ঞযা।

মযা স্বসংবিত্সত্তর্কপতিশিস্ত্রত্রিকক্রমাত্।

(ত. আ. I পৃ. ১৪৯)

ইতি কালতত্ত্বমুদিতং শাস্ত্রমুখাগমনিজানুভবসিদ্ধম্।

(ত. আ. IV পৃ. ২০২)

উনার অন্তঃকরণে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পূর্ণতা তিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে প্রাপ্ত হয় :- গুরু, শাস্ত্র, স্বত, অর্থাৎ গুরু কর্তৃক প্রাপ্ত, শাস্ত্রের যুক্তি হতে প্রাপ্ত, এবং স্বয়ী অনুভুতি দ্বারা প্রাপ্ত। নিজ অনুভব দ্বারা প্রাপ্ত জ্ঞানের জন্যই অভিনবগুপ্তকে শিবাদ্বয় দর্শনের শ্রেষ্ঠতম আচার্য রূপে পরিগণিত করা হয়।

যোগাভ্যাসের পরিণাম স্বরূপ অভিনবগুপ্তের মধ্যে লোকোত্তর শক্তি প্রকট হয়। তন্ত্রালোক গ্রন্থে শক্তিপাতের বিষয়ে আলোকপাত করার সময় অভিনবগুপ্ত শ্রীপূর্বশাস্ত্র হতে‌ উদাহরণ প্রস্তুত করেন, সেখানে এরকম যোগীর সম্বন্ধে কিছু সুনিশ্চিত লক্ষনের বিষয়ে বর্ণনা করেন। যা হলো নিন্ম রূপ:-

(ক) রুদ্রের প্রতি নিশ্চল ভক্তি

(খ) মন্ত্র সিদ্ধি

(গ) তত্ত্বের উপর নিয়ন্ত্রণ

(ঘ) অভীষ্ট ফলপ্রাপ্তির সামর্থ

(ঙ) অকস্মাৎ সমস্ত শাস্ত্র জ্ঞানের উদয় এবং কবিত্ব শক্তির স্ফুরণ।

তন্ত্রালোকের টীকাকার জয়রথ উল্লেখ করেন, যে অভিনবগুপ্তের মধ্যে এই সমস্ত শক্তি বিদ্যমান ছিল। নিজের কথনের প্রমাণ স্বরুপ তিনি নিজ গুরুর একটি শ্লোক উদ্ধৃত করেন, যার অর্থ নিন্মরুপ:

লোকে শ্রীপূর্বশাস্ত্রে বর্ণিত লক্ষণ অভিনবগুপ্তের মধ্যে দর্শন করেন।

তস্যৈতত্ প্রথমং চিহ্নং রুদ্রে ভক্তিঃ সুনিশ্চলা।

দ্বিতীয়ং মন্ত্রসিদ্ধিঃ স্যাত্ সদ্যঃ প্রত্যযদাযিকা।।

সর্বসত্ত্ববশিত্বং ত তৃতীয়ং তস্য লক্ষণম্।

প্রারব্ধকার্য নিষ্পত্তিশ্চিহ্ নমাহু শ্চতুর্থকম্।

কবিত্বং পঞ্চমং জ্ঞেয়ং সালঙ্কারমনোহরম্।

সর্বশাস্ত্রার্থবেতৃত্ত্বমকস্মাত্তস্য জানতে।।

সমস্তং চেদং চিহ্নজাতমস্মিন্নেব গ্রন্থকারে প্রাদুর্ভূতমিতি প্রসিদ্ধিঃ।

যদ্গুরবঃ অকস্মাত্সর্বশাস্ত্রার্থজ্ঞত্বাদ্যং লক্ষ্মণপঞ্চকম্।

যস্মিন্ শ্রীপূর্বশাস্ত্রোক্তমদৃশ্যত জনৈঃ স্ফুটম্।।

(ত. আ. VIII পৃ. ১৩৬-১৩৭)

অভিনবগুপ্তের মধ্যে এই অসাধারণ শক্তির অস্তিত্বের বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা ভ্রান্ত।

অভিনবগুপ্তের সাক্ষাৎ শিষ্য মধুরাজ তার গুরুর লোকত্তর শক্তিপাত শক্তির সামর্থের বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। তিনি স্বরচিত গুরুনাথপরামর্শ গ্রন্থে অভিনবগুপ্তের স্তুতিতে এক স্তোত্র রচনা করেছিলেন যার সমাপন নিন্ম দেওয়া হল:-

আমি বেদ ও বেদাঙ্গ অধ্যয়নে কোনো পরিশ্রম করি নি। আমার কোনো তর্ক জ্ঞান নেই, না সাধনার অভ্যাস করেছি, তবুও আমার শ্রদ্ধেয় গুরু আমার অজ্ঞানতার অন্ধকার এই প্রকার অপসারিত করেছেন যে, আমি গুরুদেবের প্রদত্ত জ্ঞানরশ্মি অনুধাবনে সক্ষম হই এবং তাহা দৃঢ়তার সহিত নিজ অন্তরে ধারণ করি।

ন বেদবেদাঙ্গপরিশ্রমো মে ন তর্কশিক্ষা ন চ কাব্যশিক্ষা।

তথাপি তাবত্ পরিমাষ্টি মান্দ্যং গুরূপদেশাপ্রতিপত্তিদার্ঢযম্।।

যেষাং কেষাং কুর্বন্ননুজীবনাং শিবত্বম্।

বাচা হীনো ব্যাজেন নিত্যপূর্ণঃ স দেশিকঃ।।

মুখ হতে কোনোপ্রকার বাণী নি:সরণ না করে, সিদ্ধ গুরু কোনো না কোনো ভাবে, যে কোনো প্রাণীকে অথবা সমস্ত প্রাণীকে শিবত্ব প্রদান করেন।

এখানে কবি স্পষ্ট ইঙ্গিত প্রদান করেছেন যে তার গুরুদেব অভিনবগুপ্ত শক্তিপাতের সাহায্যে তার মধ্যে আধ্যাত্মিক সাক্ষাৎকার সম্ভবপর করেন।

অভিনবগুপ্ত ভৈরব অবস্থা বা জীবনমুক্ত স্থিতি প্রাপ্ত করেছিলেন এবং এই আত্মপোলদ্ধির আলোকে তিনি দর্শনের উপর নিজের লেখনী সঞ্চালন করেন। পরমার্থদ্বাদশিকা এবং অনুভবনিবেদনম শাস্ত্রে তিনি স্বয়ং এই স্থিতি প্রাপ্তির ইঙ্গিত প্রদান করেন।

শব্দঃ কশ্চন তো মুখাদুদযতে মন্ত্রঃ স লোকোত্তরঃ।

শাক্তং নাম পরং মমানুভবতঃ কিন্নাম ন ভ্রাজতে।।

(অনুভবনিবেদনম্)

সোঽহং নির্ব্যাজনিত্যপ্রতিহনকলনানন্তসত্যস্বতন্ত্রধ্বস্তদ্বৈতাদ্বযারিদ্বযমযতিমিরাপারবোধপ্রকাশঃ।

(পরমার্থদ্বাদশিকা)

উনার শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ তন্ত্রালোকে শুধুমাত্র সমগ্র আগম শাস্ত্রের সারবত্তা নিহিত নেই তার সাথে নিজ আধ্যাত্মিক উপলব্ধি, সিদ্ধান্ত, ব্যবহারিক কর্মকান্ডেরও বিবরণ রয়েছে। অভিনবগুপ্ত এই গ্রন্থের সূচনা প্রক্রিয়া সম্বন্ধেও আমাদের অবগত করেন।

এই গ্রন্থের(তন্ত্রালোক) প্রারম্ভের জন্য এই প্রকার বৎসালিকার(ওনার শিষ্যা)গৃহে অবস্থান করে নিজের বুদ্ধি সমাধির স্থিতিতে পৌঁছে, নিজ গুরু প্রদত্ত শাস্ত্র বাণী স্মরণ করেন।

ইত্থং গৃহে বত্সলিকাবাতীর্ণ স্থিতঃ সমাধার মিনিং বহূনি।

পূর্বশ্রুতান্যাকলযন্ স্ববুদ্ধযা শাস্ত্রাণি তেভ্যঃ সমবাপ সারম্‌।।

(ত. আ. XII পৃ.৪২৫)

[ পদটীকায় বর্ণিত বাক্যাংশ "গৃহে বৎসালিকাবতীর্ণে" এর অর্থ "বৎসালিকার গৃহ" হবে না। লেখক স্বয়ং বলেছেন যে, অভিনবগুপ্ত "তন্ত্রালোক" এর রচনা নিজের শিষ্যা "মন্দ্র" এর গৃহে করেছেন। এইজন্য পূর্ববর্তী বাক্যাংশের অর্থ হবে: "মন্দ্রের" গৃহে যেখানে বৎসালিকা ও উপস্থিত ছিল। "বৎসালিকা" "মন্দ্রের" কাকি এবং অভিনবগুপ্ত "তন্ত্রালোক" গ্রন্থে অত্যন্ত স্নেহপূর্বক তার উল্লেখ করেছেন]

অন্য গ্রন্থের ব্যাপক রূপে বৃহৎ সংখ্যায়(২৪৫)এবং অত্যন্ত নিপুণভাবে উদ্ধৃত করেন যার দ্বারা এই নির্ণয়ে উপনীত হওয়া যায় যে, অভিনবগুপ্ত এক অসাধারন মনীষা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

এই চরম উৎকর্ষতা দৈবী শক্তি দ্বারা সম্ভবপর হয়েছে। এই জন্যে মধুরাজ যোগী স্বয়ী রচিত গুরুনাথপরামর্শ গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে অভিনবগুপ্ত ছিলেন দেহধারী শিব।

মধুরাজ যোগী দ্বারা রচিত অন্য এক পদ্য সংগ্রহ যা ধ্যানশ্লোকাঃ নামে খ্যাত, সেখানে অভিনবগুপ্তকে অভিনবক্ষিণামূর্তিদেব রূপে অলংকৃত করেছেন। অদ্বৈত সম্প্রদায়ের সমস্ত আচার্য তাদের নিজ নিজ শাস্ত্রে দিব্য গুরুদক্ষিণামূর্তির স্তুতি করেছেন। শ্রী শঙ্করাচার্য ও দক্ষিণামূর্তিস্তোত্র এর রচনা করেছিলেন। শঙ্করাচার্য কর্তৃক উল্লেখিত দিব্যগুরুর বিশেষণে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তিনি নিজ মুখ হতে এক বিন্দু শব্দের স্খলন না করে নিজ শিষ্যের সমস্ত সংশয় দূরীভূত করেন, অর্থাৎ তিনি শক্তিপাত দ্বারা এই কার্য করে থাকেন যার বিবরণ মধুরাজও নিজ গুরুদেব অভিনবগুপ্তের প্রসঙ্গে অগ্রে উল্লেখ করেছেন। দুর্লভ গুন এবং প্রতিভার যে অনবদ্য সংমিশ্রণ এবং অসাধারণ সাহিত্যিক প্রজ্ঞা ও ব্যাখ্যাকারক গুণ সাধারণ মস্তিষ্কধারী মানুষের মধ্যে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। এই গুনবত্তা একমাত্র সেই আত্মায় বিদ্যমান থাকে, যে নিরন্তন ভগবান শিবের দিব্য চৈতন্যময় সত্তায় নিজেকে বিলীন করেছে। যা অভিনবগুপ্তের ভাষায় রুদ্রশক্তিসমাবিষ্ট নামে পরিচিত। এটি এমন এক অবস্থান্তর যা পূর্বে উল্লেখিত লোকত্তর শক্তির অভিব্যাক্তি মাত্র। শৈবাদ্বৈত তত্ত্বের উপর বহু সুবিস্তৃত ব্যাখ্যা রচনা করার কারণে এবং স্বয়ী আধ্যাত্মিক উপলব্ধি ব্যক্ত করার জন্য, অভিনবগুপ্তকে সমগ্র শৈব সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রমুখ আধ্যাত্মিক আচার্য রূপে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এরকম এক ঘটনার উল্লেখ অভিনবগুপ্তের শিষ্য মধুরাজ দ্বারা রচিত গুরুনাথপরামর্শ গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে, একবার কাশ্মীরে সমস্ত আধ্যাত্মবাদী, সিদ্ধাত্মা, যোগিনীদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে সমস্ত অধ্যাত্মবাদীরা অভিনবগুপ্তকে বড়ই শ্রদ্ধা ও প্রশংসা করেছিলেন। অভিনবগুপ্তের প্রামাণিক ব্যাখ্যার কারণে তাদের অন্তরে বিশ্বাস জন্মেছিল যে অভিনবগুপ্তই শ্রীকণ্ঠ(ভগবান শিব) এর অবতার স্বরূপ। গুরু দ্বারা প্রবাহিত সমস্ত জ্ঞান অভিনবগুপ্তের অন্তরে সমাহিত হয়ে পুঞ্জীভূত হয়। তার শিষ্য অভিনবগুপ্তকে সমগ্র শৈব সম্প্রদায় - সিদ্ধান্ত, বাম, যামাল, ভৈরব কুল ত্রিক, এবং একবীর এর আচার্য রূপে স্বীকার করেন।

শ্রীমানভিনবগুপ্তাচার্যঃ শ্রীকন্ঠনাথ এবেতি।

প্রতিপদ্যতিমিতস্থা ব্যখ্যাতৃত্বং কথং ভবেদিত্থম্।।

K.C Pandey র রচিত অভিনবগুপ্ত বই থেকে ধ্যান শ্লোকের ইংরেজি ব্যাখ্যা দেওয়া হলো।

May the God Daksināmūrti in the form of Abhinava who is an incarnation of Srikantha and has come to Kashmir, protect us. His eyes are rolling with spritual bliss. The centre of his forehead is clearly marked with three lines drawn with sacred ashes(bhasman). His ears look beautiful with Rudrāksa. His luxuriant hair is tied with a garland of flowers. His beard is long. His body is rosy. His neck black because of its being besmeared with paste of camphor, musk, sandal, saffron, etc. looks splendid. His long sacred thread(yajñopavīta) is left loose. He is dressed in slik cloth, white like rays of moon and is sitting in the Yogic posture called vīra (Vīrāsana) on a soft cushion over a throne of gold, with a canopy decked with strings of pearls, in the open hall full of crystals beautiful with paintings, smelling extremely sweet on account of garlands and flowers, incense and lamps, perfumed with sandal etc. Constantly resonant with vocal and instrumental music and dance and crowded with Yoginīs and Siddhas of recognised spiritual powers, in the centre of the garden of grapes. He is attended by all his pupils, such as Ksemarāja who are sitting with their mind concentrated, at the foot, and are writting down all that he says, and by two female messengers (dūtī), who are standing at the sides, each with a kar full of water distilled from the grain kept soaked in water three nights (Siva rasa), and a box full of betels in the right hand and the fruit of citron and lotus in the left. His right hand wearing the rosary of the Rudrāksa is resting on his thigh and his fingers are in a position indicative of the grasp of ultimate reality (jñāmudrā), and he is playing upon the Vīna which is capable of producing original musical sound (nāda) withthe tips of the nails of his lotus like left hand. (Abhi. P.21)

বঙ্গানুবাদ:-

শ্রীকণ্ঠাবতার অভিনবগুপ্তের স্বরূপে কাশ্মীরে অবতরণকারী ভগবান দক্ষিণামূর্তি আমাদের রক্ষা করুন। প্রভুর নেত্র যুগল আধ্যাত্মিক আনন্দে ঘুর্ণয়মান, তার ললাটের মধ্যভাগ পবিত্র ভস্ম দ্বারা রচিত ত্রিপুন্ডে সুশোভিত। প্রভুর কর্নদ্বয় রুদ্রাক্ষে সুসজ্জিত, নিজ ঘনশ্যাম কেশগুচ্ছ পুষ্পমাল্যের বন্ধনীতে সুসজ্জিত। তার শ্মশ্রু সুশোভিত, দেহ রক্তিম আভাময়। কর্পূর, কস্তুরী, চন্দন, কেশর আদি লেপনে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে এবং যজ্ঞপোবীত ধারী, চন্দ্রকিরণ সম শুভ্র ধবল রেশমী বস্ত্র পরিধেয়, এবং মণিমাণিক্য সজ্জিত শামিয়ানা বেষ্টিত স্বর্ণ সিংহসনে সুকোমল গদিতে বীরাসনে অবস্থানরত, মুক্তাঙ্গনে স্ফটিক সজ্জিত চিত্র, পুষ্পমালা, ধুপ, দীপ, সুগন্ধী চন্দনের সুবাসে চতুর্দিক পরিবেষ্টিত। দ্রাক্ষার(আঙুর) উদ্যানের মধ্যে সুসজ্জিত গীত বাদ্য এবং নৃত্যের সতত গুঞ্জনে গুঞ্জায়মান এবং আধ্যাত্মিক শক্তিধর সিদ্ধ পুরুষ এবং যোগিনী দ্বারা মন্ডল পরিবেষ্টিত। ক্ষেমরাজ আদি শিষ্যমন্ডলী দ্বারা পরিবেষ্টিত, এবং সমস্ত শিষ্যরা তার শ্রীচরণে নিজের অন্ত:মন সমর্পন করে, তার মুখ নিঃসৃত প্রত্যেক শব্দ লিপিবদ্ধ করছে। দুজন মহিলা দ্যুতি দু পার্শ্বে পাত্র সহিত দন্ডায়মান। প্রত্যেক পাত্র শিব রসে (তিনরাত ধরে জলে সিক্ত শস্য) পরিপূর্ণ এবং ডান হাতে তাম্বুলে পরিপূর্ণ পাত্র এবং বাম হাতে লেবু ও কমল। প্রভুর দক্ষিণ হস্তে রুদ্রাক্ষের মালা, তার জঙ্ঘায় স্থিত, এবং জ্ঞানমুদ্রায় অবস্থিত। বাম হস্তের কর কমলের নখের অগ্রভাগ দ্বারা বীণার ঝংকার সৃষ্টি করেন, যার নাদে সমগ্র ব্রহ্মান্ড নাদিত হচ্ছে।"

এই শব্দ চিত্রের দ্বারা সিদ্ধ ও যোগিনী পরিবেষ্টিত সভার উল্লেখ আছে।

কাশ্মীর পন্ডিত এবং পুরাতন মুসলিম পরিবার পরম্পারিক বিশ্বাস অনুসারে যখন অভিনবগুপ্ত অনুভব করেন যে ইহজগতে তার লৌকিক জীবনের উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ হয়েছে, তখন একদিন তিনি নিজের ১২০০ হাজার শিষ্যের সহিত হিমালয়ের ভৈরব গুহার (বর্তমান ভীরুবা গুফা) উদ্দেশ্যে প্রস্থান করেন। মার্গে তিনি ভৈরব স্তব গাইতে গাইতে শিষ্যদের সহিত গুহায় প্রবিষ্ট হন এবং আর কখনো পার্থিব জগতে ফিরে আসেন নি।

অবদান

অভিনবগুপ্ত তার তিন গ্রন্থে রচনাকালের উল্লেখ করেছেন। উনি ৬৬ বছরে ক্রমস্তোত্র এবং ৬৮ বছরে ভৈরবস্তব রচনা করেন। বৃহতী বিমর্শিনী গ্রন্থের অন্তিম পদ্যে উনি উল্লেখ করেন যে এই গ্রন্থের রচনাকাল ৯০ বর্ষ অর্থাৎ কলি যুগের ৪১১৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছিল।

ইতি নবতিতমেঽস্মিন্বত্সরেঽন্ত্যে যুগাংশে

তিথিশাশিজলধিস্থে মার্গশীর্ষাবসানে।

জগতি বিদিতবোধিমীশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞাং

ব্যবৃণুত পরিপূর্ণাং প্রেরিতঃ শম্ভুপাদৈঃ।।

এখানে উল্লেখিত ৯০ বর্ষের অর্থ হলো, সপ্তর্ষি যুগ এর ৪০৯০ বর্ষ। এর থেকে এই নিষ্কাশনে পৌঁছায় যে, ক্রমস্তোত্রের রচনাকাল সপ্তর্ষি বর্ষের ৪০৬৬ এবং বিমর্শিনী গ্রন্থের রচনাকাল ৪০৯০ বর্ষ। এর থেকে অভিনব গুপ্তের সাহিত্যিক গতিবিধি ছিল কমপক্ষে পঁচিশ বর্ষের। ওপরে উল্লেখিত সপ্তর্ষি বর্ষের ৯৯০ থেকে ১০৫০ মধ্যে। এই সময়কালে তিনি চল্লিশটি উপর গ্রন্থ লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

নিন্মে তার রচিত গ্রন্থের নাম সহ সারবত্তা উল্লেখ করা হল :

১) বোধপঞ্চদশিকা :

ইহা ষোলো পদ্যের এক লঘু কাব্য। পনেরোটি পদ্য অদ্বৈত শৈব দর্শনের সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করে এবং অন্তিম পদ্য এই রচনার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে। এই রচনার প্রধান উদ্দেশ্য তার শিষ্যকে শৈব দর্শনের আধার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জ্ঞান প্রদান করা।

২) মালিনী-বিজয়-বার্তিকম্ :

এই রচনা মালিনী-বিজয়-তন্ত্রম যাকে শ্রীপূর্বশাস্ত্রম বলে উল্লেখ করা হয়, তার কিছু শ্লোকের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অভিনবগুপ্ত এর রচনা প্রবরপুরে তার শিষ্যা কর্ণ এবং মন্দ্রের প্রার্থনায় লিপিবদ্ধ করেন। দুর্ভাগ্যবশত: সমগ্র শাস্ত্রের কোন হদিশ পাওয়া যায়নি প্রকাশিত অংশে কেবলমাত্র প্রথম শ্লোকের ব্যাখ্যার উল্লেখ পাওয়া যায়। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে অভিনবগুপ্ত আরো কিছু শ্লোকের ব্যাখ্যা এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছিলেন, কারণ এই গ্রন্থে আঠারোতম অধ্যায়ের উল্লেখ তিনি করেছেন।

এতদষ্টাদশে তত্ত্বমধিকারে ভবিষ্যতি।

উপলব্ধ অংশে ন্যায়-দর্শনের বিষয়ে কিছু মহত্ত্বপূর্ন আলোচনা করেছেন

৩) পরাত্রিংশিকা-বিবরণ :

এই গ্রন্থে চৌষটি অদ্বৈত তন্ত্রের মধ্যে এক রুদ্রযামল তন্ত্রের ব্যাখ্যা টিকা ভাষ্য রয়েছে এই গ্রন্থের শীর্ষক নিয়ে ভ্রম রয়েছে। বাস্তবিক নাম পরাত্রিংশিকা এর অর্থ পরা যা তিন শক্তি, ইচ্ছা, জ্ঞান এবং ক্রিয়ার সংমিশ্রণ। পরাকে পরা সংবিদ বলে যা এই শক্তি অপেক্ষা উচ্চতর কিন্তু এই শক্তির সহিত অভিন্ন। পরাত্রিংশিকার মূলপাঠ শৈব অদ্বৈতবাদীদের মধ্যে অতি লোক প্রিয় ছিল, সোমানন্দ থেকে আরম্ভ করে অভিনবগুপ্তের সময় পর্যন্ত অনেক আচার্যরা এর উপর টীকা রচনা করেছিলেন। পরাত্রিংশিকাকে ত্রিকশাস্ত্র নামে অভিহিত করা হয়, মূল গ্রন্থ যার উপর অভিনবগুপ্ত বিবরণ রচনা করেছিলেন তাহা ভৈরব ও ভৈরবীর মধ্যেকার কথোপকথনের রূপকে ভৈরবী প্রশ্ন করছে যে অনুত্তর নামক তত্ত্ব আছে যার জ্ঞান হতে খেচরীর(সংসার থেকে মুক্তি) সমান স্থিতি প্রাপ্ত হয়। এই প্রশ্নে ভৈরবের উত্তর ত্রিক দর্শনের আধার স্বরূপ। এই গ্রন্থের উপসংহার অভিনব গুপ্ত তার জীবনী সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।

৪) তন্ত্রালোক :

অভিনব গুপ্তের গ্রন্থের আকারে বৃহৎ রূপ হল তন্ত্রালোক। ইহা অদ্বৈত আগমের দর্শন এবং কর্মকান্ড এই দুয়ের সম্বন্ধে সমস্ত মহত্ত্বপূর্ণ বিষয়ে চর্চা করেছে। এটা শৈবাগম, মুখ্যত: মালিনী-বিজয়তন্ত্রের পরম্পরাগত ব্যাখ্যানের প্রমাণ্য স্বরূপ এবং গ্রন্থকারের স্বয়ী আত্মনুভূতির সংমিশ্রণে রচিত সর্বাপেক্ষা প্রমানিক গ্রন্থ। ইহা ৩৭টি অধ্যায়ে বিভাজিত। তন্ত্রালোক জয়রথের টীকা সহিত প্রকাশিত।

এখানে আলোচ্য বিষয় :

১) বন্ধনের কারণ

২) মুক্তির মার্গ

৩) বিদ্যা ও অবিদ্যার মধ্যেকার পার্থক্য

৪) মুক্তির ধারণা

৫) সাংসারিক জগতের বাস্তবিকতা

৬) জগতের অভিব্যাক্তি

৭) বিম্ব প্রতিবিম্ব বাদ

৮) শৈব কর্মকান্ড

৯) আত্ম বৃত্ত সম্বন্ধী সূচনা

গ্রন্থের নামকরণ তন্ত্রালোক এই কারণে হয়েছে পাঠককে তন্ত্র দ্বারা রচিত পথে আলোকপাত করা।(আলোকমাসাদ্য যদীযমেষ লোকঃ সুখং সংচরিত ক্রিযাসু)। এই গ্রন্থ মনোরথ এবং অভিনবগুপ্তের খুড়ততো ভাই তথা মন্দ্র এবং শিবভক্ত শিষ্যদের প্রার্থনায় প্রবরপুর (বর্তমান শ্রীনগরের পূর্বভাগ) এ মন্দ্রের গৃহে রচনা করেন।

৫) তন্ত্রসার এবং ৬) তন্ত্রবটধানিকা :

এই দুই গ্রন্থ তন্ত্রালোকের সারাংশ এবং দ্বিতীয় গ্রন্থ প্রথম অপেক্ষা অধিক সংক্ষিপ্ত।

৭) ধ্বন্যালোকলোচনম্ :

ইহা আনন্দ বর্ধনের রচিত ধ্বন্যালোক শাস্ত্রের উপর অভিনবগুপ্তের রচিত প্রসিদ্ধ টীকা। ধ্বনির অবধরনায় অভিনবকৃত ব্যাখ্যান অলঙ্কার শাস্ত্রের পরবর্তী শাস্ত্রকারেরা প্রমাণিক বলে আখ্যা দিয়েছেন।ধ্বন্যালোক এবং তার উপর রচিত লোচন সাহিত্য শাস্ত্রকে মম্মট এবং জগন্নাথ প্রভৃতি সুপ্রসিদ্ধ আচার্যরাও মান্যতা প্রদান করেছেন। এই গ্রন্থে প্রতিপাদিত সিদ্ধান্ত গুলো উনি নিজের শিক্ষণ পুস্তকের জন্য আদর্শ বলে বিবেচনা করেছেন।

৮) অভিনবভারতী :

এই গ্রন্থ ভারতে নাট্যশাস্ত্রের উপর রচিত উৎকৃষ্ট টীকা যাকে নাট্যবেদবিবৃতি বলে আখ্যা দেওয়া হয়। নাট্যশাস্ত্রের উপর রচিত একমাত্র টীকা। নাট্যশাস্ত্রে পরবর্তী আচার্য কর্তৃক বিভিন্ন ব্যাখ্যার পুঙ্খানপুঙ্খভাবে নিরীক্ষণ করে অভিনব গুপ্ত এই টীকা রচনা করেন। আধুনিক বিদ্বানদের জন্য এই টীকা গ্রন্থ নাট্যশাস্ত্রের জ্ঞান অর্জনের একমাত্র পন্থা, যা আজ লুপ্ত হয়ে গেছে।

৯) ভগবতগীতার্থহংগ্রহ :

ইহা ভগবতগীতার উপর রচিত কোনো সাধারণ টীকা নয়। ইহা সমগ্র বিষয়বস্তুর সারবত্তা। নির্দিষ্ট শ্লোকের উপর বিস্তৃত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই গ্রন্থ এইকারণে মহত্ত্বপূর্ণ যে এখানে গীতার সারবত্তাকে শৈবদৃষ্টিকোণ হতে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এই গ্রন্থে গীতার তুলনায় শ্লোক সংখ্যা অধিক এবং এর পাঠ বিধি ও ভিন্ন। ভগবতগীতাকে শৈব সাহিত্যে এই কারণে স্থান দেওয়া হয়েছে, যে পরম্পরা অনুসারে বিশ্বাস করা হয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অদ্বৈত শৈবাগম দুর্বাসা এবং অন্যান্য আগম শাস্ত্রের অধ্যায়ন উপমন্যুর নিকট অধ্যায়ন করেন।

১০) পরমার্থসার :

এই গ্রন্থ ত্রিক দর্শনের মূল সিদ্ধান্তের সার বস্তু। অভিনবগুপ্ত এখানে উল্লেখ করেন যে শেষমুনি, যাকে আধার ভগবান বা অনন্তনাথ রূপে অভিবাদন করা হয়, যিনি আধার-কারীদের রূপান্তর মাত্র।

১১) ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞাবিবৃতিবিমর্শিনী :

এই গ্রন্থ উৎপলাচার্য কর্তৃক প্রত্যাভিজ্ঞাকারিকার উপর রচিত বিবৃতি। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে গ্রন্থ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যদিও এই কারিকা অভিনবগুপ্ত দ্বারা রচিত ব্যাখ্যা সহিত উপলব্ধ যার উপর স্বয়ং উৎপলদেব নিজে বিবৃতি লিখেছেন। এই গ্রন্থ বৃহতীবিমর্শিনী নামে জ্ঞাত।

১২) ঈশ্বরপ্রত্যাভিজ্ঞাবিমর্শিনী :

এই গ্রন্থ উৎপলদেবের প্রত্যাভিজ্ঞাকারিকা উপর রচিত অভিনবগুপ্তের টীকা। এই টীকা বিবৃতিবিমর্শিনীর অপেক্ষা ক্ষুদ্র এবং সেজন্য একে লঘবী বিমর্শিনী নামে অভিহিত করা হয়। এর মধ্যে প্রত্যাভিজ্ঞাদর্শনের বিস্তৃত ব্যাখ্যা রয়েছে। বৃহৎ রচনার পর অভিনবগুপ্ত তার অল্প বুদ্ধি শিষ্যের জন্য তার সারতত্ত্ব ও লিপিবদ্ধ করেছেন। তার শিষ্য মধুরাজ অভিনবগুপ্তের এই প্রবৃত্তির উল্লেখ নিজের রচিত গ্রন্থ গুরুনাথপরামর্শ (শ্লোক-৬) এ উল্লেখ করেন। অভিনবগুপ্ত প্রথমে তন্ত্রালোক এবং পরে তার সংক্ষিপ্ত রূপ তন্ত্রসারে লিপিবদ্ধ করেন। ইহা অভিনবগুপ্তের স্বয়ী কথন হতে স্পষ্ট। অভিনবগুপ্ত ১০২০ খ্রিস্টাব্দে বিবৃতিবিমর্শিনী (বৃহতীবিমর্শিনী নামে প্রসিদ্ধ) সম্পূর্ণ করার পর উনি প্রত্যাভিজ্ঞাবিমর্শিনী (যা লঘু বিমর্শিনী নামে পরিচিত)এর রচনা করেন। অভিনবগুপ্তের উপলব্ধ গ্রন্থের মধ্যে প্রত্যাভিজ্ঞাবিমর্শিনী অন্তিম রচনা।

এই ১২টি গ্রন্থ কাশ্মীর সংস্কৃত সিরিজ রূপে প্রকাশিত হয়।

১৩) পর্যন্তপঞ্চাশিকা :

অভিনবগুপ্তের এই গ্রন্থ সর্বপ্রথম ডঃ বীঃ রাঘবন দ্বারা ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয়। ইহা ত্রিক শাস্ত্রের সিদ্ধান্তের সারবত্তা যা মুখ্যতঃ কুল সম্প্রদায়ের উপর অধারিত। এখানে অভিনবগুপ্ত কর্তৃক রচিত তত্ত্বের সংখ্যা ৩৭। ৩৭তম তত্ত্ব ভৈরবরূপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যাকে কুল সম্প্রদায়ে অনুত্তর বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পরতত্ত্ব সাক্ষাৎকারের সন্দর্ভে তিনি সাধককে কোনো বিশেষ ব্যাখ্যায় নিবদ্ধ থাকতে নিষেধ করেছেন অভিনবগুপ্তের মতে

সকলপ্রকার মত এবং উপায় অনন্ত একই সার্বত্রিক তত্ত্বের অভিব্যাক্তি মাত্র এবং এর সঠিক প্রয়োগে একই লক্ষ্যের পথে অগ্রসর হই।

উপায়ে নাগ্রহঃ কার্য উপেযা ভৈরবী স্থিতিঃ।

যাসৌ স্বসংবিত্ নামেব সর্বোপাযাং সমাবিশোত্।।

এর মাধ্যমে তিনি এই স্পষ্ট ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন যে, যেকোনো উপায়ের অনুসরণকারী ব্যাক্তি তার নিজ য্যোগতার অনুযায়ী সেই উপায়ের চয়ন করে থাকেন।

১৪) ঘটকর্পরকুলক-বিবৃতি :

ইহা ২০ শ্লোকের এক লঘু কাব্য যা অভিনবগুপ্ত ঘটকর্পরকুলকের উপর রচিত টীকা। কাশ্মীর পরম্পরা অনুসারে এই লঘু কাব্য কালিদাসের প্রতি সমর্পিত। এই টীকায় অভিনবগুপ্ত কাব্যশাস্ত্রের উপর রচিত টীকা যা কাব্যশাস্ত্রে পাঠরত শিষ্যের নিকট এক অমূল্য অবদান।

এই ১৪টি গ্রন্থের অতিরিক্ত, ডঃ কান্তিচন্দ্র পান্ডে তার অভিনবগুপ্ত নামক গ্রন্থে অভিনবগুপ্তের লঘু রচনা(স্তোত্র) প্রকাশিত করেন, যা নিন্মে উল্লেখ করা হল :

১৫) অনুত্তরাষ্টিকা

১৬) পরমার্থদ্বাদশিকা

১৭) পরমার্থচর্চা

১৮) মহোপদেশবিংশতিকম্

১৯) ক্রমস্তোত্রম্

২০) ভৈরবস্তোত্রম্

২১) দেহস্থদেবতাচক্রস্তোত্রম্

২২) অনুভবনিবেদনম্

২৩) রহস্যপঞ্চদশিকা

এই প্রকার বর্তমানে অভিনবগুপ্তের ২৩টি রচনার মুদ্রিত রূপ উপলব্ধ রয়েছে। এছাড়া গ্রন্থ সূচিতে পাণ্ডুলিপি রূপে তিনটি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়।

১) তন্ত্রোচ্চয,

২) বিম্ব-প্রতিবিম্ববাদ

৩) অনুত্তরতত্ত্ববিমর্শিনীবৃতি

অভিনবগুপ্তের কিছু অন্য গ্রন্থের উল্লেখ তিনি তার উপলব্ধ রচনায় করে গেছেন যা বর্তমানে লুপ্ত।

১) পুরূরবোবিচার

২) ক্রমকেলি

৩) শিবদৃষ্টযালোচনম্

৪) পূর্বপঞ্চিকা

৫) পদার্থপ্রবেশনির্ণয়টীকা

৬) প্রকীর্ণবিবরণ

৭) প্রকরণবিবরণ

৮) কাব্যকৈতুকবিবরণ

৯) কথামুখতিলকম্

১০) লঘ্বী প্রক্রিয়া

১১) ভেদবাদ-বিদারণ

১২) দৈবীস্তোত্র-বিবরণ

১৩) তত্ত্বাধ্বপ্রকাশিকা

১৪) শিবশাক্ত্যবিনাভাবস্তোত্রম্

এইভাবে অভিনবগুপ্ত মোট ৪০টি গ্রন্থের রচনা করেন। কাশ্মীরি পন্ডিত পরম্পরা মান্যতা আছে যে অভিনবগুপ্ত যোগবশিষ্ঠের সম্বন্ধে টীকা রচনা করেন। বর্তমানকালে ঈশ্বরপ্রত্যাভিজ্ঞাবিমর্শিনী তার গ্রন্থ রূপে বিবেচনা করা হয়। আমাদের কাছে স্পটতঃ কোনো প্রমাণ নেই যে অভিনবগুপ্ত আর কত রচনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন।

এইসব গ্রন্থের বিষয়বস্তুর অধ্যায়ন করার পর এটা স্পষ্ট যে অভিনবগুপ্ত কাব্যশাস্ত্র এবং সংস্কৃতের উপর ৫টি গ্রন্থ রচনা করেন। ১১টি স্তোত্র এবং তার অন্তিম রচনা শৈবাদ্বৈত দর্শন ও তার কর্মকাণ্ডের উপর আধারিত। কিছু দার্শনিক স্তোত্র ও রয়েছে। তার গ্রন্থের কালক্রম অনুসারে পর্যবেক্ষণের মধ্যমে জানা যায় পূর্বের রচনা হতে তন্ত্রের প্রতি তার রুচি প্রকটিত হয়। পরবর্তীতে অভিনবগুপ্তের রুচি কাব্য এবং কাব্যশাস্ত্রে লক্ষ্য করা যায়, তারই পরিণতি স্বরূপ দার্শনিক কৃর্তি প্রকাশিত হয়। এর মাধ্যমে জানা যায় যে উনি একই সাথে একাধিক বিষয়ের উপর গ্রন্থ রচনা করেছেন উনার লেখনীতে এক বিশেষত্ব ছিল, উনি কাব্য শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত গুলিকে নিজের দার্শনিক উপলব্ধির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন এবং একইভাবে দর্শনের সারবত্তা কাব্যিক উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন। অনেক স্থানে উনি নাটক হতে মনোবৈজ্ঞানিক প্রবৃত্তি যুক্ত পদ্য উদ্ধৃত করেন এবং তার উপযোগিতা দার্শনিক সূক্ষতাকে স্পষ্ট করার উদ্দেশ্যে করেন যা বৃহতীবিমর্শিনী অনুধাবনের মাধ্যমে জানা যায়। কাশ্মীরি শৈব মতাবলম্বীদের নিকট এই গ্রন্থের দর্শন এবং কর্মকাণ্ড অন্তিম প্রমাণ স্বরূপ মান্যতা অর্জন করে। কাব্য শাস্ত্রের অধ্যক্ষগণ রস এবং ধ্বনির বিষয়ে উনার বচন ও রচনাকে প্রমাণিক রূপে মান্যতা দেন। দার্শনিক গণ উনাকে প্রত্যাভিজ্ঞা দর্শনের সফল ব্যাখ্যাকার রূপে বিবেচনা করেন। তিনি তার জীবনের প্রতি মুহুর্তের সমষ্টিবদ্ধ- চৈতন্য স্বরূপের সাক্ষাৎকার উপলব্ধি করেছেন, এবং তার জীবনের প্রতি পদে তার ব্যবহার করেছেন। কারণ অভিনবগুপ্তের নিকট পরম শিব বিশ্বময় এবং বিশ্বোত্তীর্ণ উভয় ভাবে অভিব্যাক্তি প্রকাশ করেছে।

🙏🙏🙏 নমঃ শিবায় 🙏🙏🙏

🙏🙏🙏 নমঃ শিবায়ৈ 🙏🙏🙏

📖 (তথ্যসংগ্রহে:

১. Abhinavgupta by K.C PANDEY

২. Abhinavgupta by G.T DESHPANDE )

✍️ লেখনীতে:- শ্রীসোমনাথ দত্ত শৈবজী

©️কপিরাইট- #আন্তর্জাতিকশিবশক্তিজ্ঞানতীর্থ

🚩🚩🚩 প্রচারে:- International Shiva Shakti Gyan Tirtha 🚩🚩🚩

#অভিনবগুপ্ত_আবির্ভাব_তিথি

#অভিনবগুপ্ত

#ISSGT

#শৈবধর্ম

#শৈববিপ্লব চলছে চলবে।

[ 🔴 কেউ কপি করতে চাইলে কোনোরূপ কাটছাট না করে পুরো পোস্টটাকেই কপি করতে হবে। কপিকৃত পোস্টে লেখকের নাম ও মূল পেজ/গ্রুপের নাম থাকাটা বাধ্যতামূলক। ]


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত