শৈব দর্শনে শক্তি এবং মায়ার স্বরূপ নির্ণয় এবং তার শ্রুতি ও জ্ঞান মীমাংসা সামঞ্জস্যতা নিরূপণ -

 

"ইচ্ছা শক্তিরুমা কুমারী" বা "ইচ্ছা শক্তিঃ উমা কুমারী"

(শিবসূত্র/প্রথম উন্মেষ (শাম্ভোবপায়)/১৩)

ব্যাখ্যা-  যখন কোনো শিবযোগী তাঁর সাধনার চরম অবস্থায় উপনীত হন (কাশ্মীর শৈব দর্শন মতে অনুপায় অবস্থা প্রাপ্ত হন), তখন তিনি সাক্ষাৎ পরভৈরব (পরমশিব) স্বরূপ লাভ করেন এবং সেই যোগীর ইচ্ছাশক্তি সাক্ষাৎ পরাভট্টারিকা উমাস্বরূপ অর্থাৎ শিবের ইচ্ছাশক্তি স্বরূপ লাভ করে,  উভয়ের মধ্যে কোনোরূপ ভেদ দর্শিত হয় না। এই শক্তিই পরমেশ্বর পরমশিবের স্বাতন্ত্র্য শক্তি হিসেবে পরিগণিতা -‌"পরাভট্টারিকা সৈব কুমারীতি প্রকীর্তিতা ।"এই পরাশক্তিকে 'কুমারী' বলা হয়েছে কারণ - কুমারী কন্যা বা কুমার বালক যেমন ক্রীড়া করে থাকে, তেমনই এই ইচ্ছাশক্তির দ্বারাই সৃষ্টি, স্থিতি, লয়, তিরোভাব ও অনুগ্রহ এই পঞ্চক্রীড়াসম্পন্ন হয়ে থাকে। এই শক্তি সর্বদাই কুমারীর ন্যায় ক্রীড়া করে চলেছে। 

অন্যভাবে বিচার করলে - 'কুমারী' অর্থ যিনি কারো সাথে রমণ করেননি, অর্থাৎ যিনি স্বয়ং নিজ প্রকৃতির মধ্যেই পরমানন্দে রমণ করেন এবং যোগীর ইচ্ছাশক্তিও সেইরূপ, শিবযোগী সর্বদা নিজ অন্তরেই পরমানন্দে রমণ করেন এবং কুলামৃত আস্বাদন করে থাকেন। ইহাই আলোচ্য সূত্রের মর্মার্থ

শিবের সাথে অভিন্ন পরাশক্তিরই (পরাবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা) অপরা স্বরূপ হল মায়া। ইহাই অপরাবিদ্যা আর এই মায়া তার পঞ্চআবরণ এর সহিত সাক্ষাৎ জড় প্রকৃতি হিসেবে বিবেচিত হন। সুতরাং, এই মায়া হল অশুদ্ধ মায়া এবং অন্তিমে এই মায়াই শুদ্ধ মায়া স্বরূপে পরাশক্তি স্বরূপে সাক্ষাৎ ব্রহ্ম পরমশিবের হৃদয়ে সমাহিত হয়ে যান। তাই ব্রহ্মের সাথে সরাসরি কখনো মায়া সংযুক্ত হন না, ব্রহ্মের সাথে সংযুক্ত হন সেই পরাচিতি বা চিৎ বা পরাপ্রকৃতি , যার উল্লেখ ভগবৎ গীতায় আমরা পাই। সুতরাং বলা যেতে পারে এই সুপ্ত বিমর্শ পরাশক্তি সম্পন্ন ব্রহ্ম থেকেই মায়াতত্ত্ব আসছে আর এই মায়ার দ্বারাই সমগ্র জগৎ নির্মিত।


শ্রুতি ও পুরাণ ভিত্তিক শাস্ত্র প্রমাণে যাবো এবার -

" মূলপ্রকৃতিরব্যক্তা সা শক্তির্ময়ি‌ তিষ্ঠতি ॥ ৩০ ॥ "

(কূর্মপুরাণ/‌ উপরিভাগ/‌ঈশ্বরগীতা/ ৭নং অধ্যায়-বিভূতিযোগ)

- অব্যক্ত মূলপ্রকৃতিরূপে ( পরাচিতি বা পরা শক্তি) এই শক্তি আবার আমাতেই(পরমেশ্বর বা ব্রহ্ম) অবস্থান করে ।

" ঋতং সত্যং পরং ব্রহ্ম পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলম্ ।

ঊর্ধ্বরেতং বিরুপাক্ষং বিশ্বরুপায় বৈ নমো নমঃ ॥"

(কৃষ্ণ যজুর্বেদ / তৈত্তিরীয় আরণ্যক / ১০ ম প্রপাঠক) 

 কৃষ্ণ --- উমা ভাগ --- শক্তি ভাগ --- পরা প্রকৃতি ভাগ --- প্রকৃতি ভাগ

পিঙ্গল --- সাকার শিব ভাগ --- শিব তত্ত্ব ---- পুরুষ ভাগ

পরমব্রহ্ম -- পরমশিব বা সদাশিব , যিনি বিমর্শ পরাশক্তি বিশিষ্ট। 


"তথাদিউমাসহাযং পরমেশ্বরং প্রভুং ত্রিলোচনং নীলকণ্ঠং প্রশান্তম্ । ধ্যাত্বা মুনির্গচ্ছতি ভূতযোনিং সমস্তসাক্ষিং তমসঃ পরস্তাৎ ॥ ৭ ॥" (কৈবল্য উপনিষদ)

--- সেই পরম প্রভু প্রভু শিব উমার সহিত (ব্রহ্মবিদ্যা) বিদ্যমান, যিনি পরমেশ্বর , প্রশান্ত, ত্রিনেত্রধারী(সদাশিব) , নীলকণ্ঠ, যিনি সমস্ত ভূতের তথা প্রাণীদের মূল কারণ , সবকিছুর সাক্ষী এবং অবিদ্যা রহিত। এভাবে সেই শিবের মধ্যেই যোগীগণ ধ্যানের মাধ্যমে প্রবিষ্ট হন।


" শক্তিঃ স্বাভাবিকী তস্য বিদ্যা বিশ্ববিলক্ষণা ।

একানেকস্য রূপেন ভাতি ভানোরিব প্রভা ॥ ১ ॥

অনন্তাঃ শক্তযো যস্যা ইচ্ছাজ্ঞানক্রিয়াদয়ঃ ।

মায়াদ্দাশ্চাভবন্বহ্নের্বিস্ফুলিঙ্গা যথা তথা ॥ ২‌ ॥

(শিবমহাপুরাণ/ বায়বীয় সংহিতা/ উত্তরভাগ/ অধ্যায় নং ৭)

 উপমন্যু বললেন—পরমেশ্বর শিবের স্বাভাবিক শক্তি হল বিদ্যা(পরা,অপরা,পরাপরা), যা সব থেকে বিশিষ্টরূপে প্রকাশিত, সেটি এক হয়েও বহু রূপে প্রভাসিত ; সূর্যের প্রভা যেমন এক হয়েও বহুরূপে প্রকাশিত হয় । এই বিদ্যাশক্তি দ্বারা ইচ্ছাশক্তি, জ্ঞানশক্তি, ক্রিয়াশক্তি, মায়াশক্তি ইত্যাদি নানা শক্তি উৎপন্ন হয়েছে, ঠিক তেমনভাবে যেমন অগ্নি থেকে নানাপ্রকার ফুলকি প্রকটিত হয়।


কাশ্মীর শৈব আগম শ্রীনেত্র তন্ত্রও একই মত পোষণ করছে- 


"একো হি রুদ্রো ন দ্বিতীয়ায় তস্থূর্য ইমাংল্লোকান্ ঈশত ঈশনীভিঃ।" (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ – ৩/২)

- (পরমেশ্বর) রুদ্রই এক এবং অদ্বিতীয় আছেন, তিনি ভিন্ন দ্বিতীয় কেউ নেই। যিনি নিজ শক্তির দ্বারা নিখিল বিশ্বজগৎ নিয়ন্ত্রিত করেন। সেই রুদ্রই সমস্ত জীবের অন্তরে আছেন। সেই রুদ্রই সৃজন, পালন ও প্রলয় করেন।


"স তস্মিন্নেবাকাশে স্ত্রীয়মাজাগাম্ ।বহুশোভমানামুমাং হৈমবতীং তাং হোবাচ কিমেতদযক্ষমিতি ॥ ১২ ॥"  (কেন উপনিষদ/ তৃতীয়খণ্ড)

- এরপর ইন্দ্রদেব আকাশে একটি দীপ্তিমতী স্ত্রীর অবয়ব দেখতে পেলেন, তিনিই উমা। তিনি হৈমবতী। সেই উমাকে এরপর ইন্দ্রদেব জিজ্ঞেসা করলেন যে কে এই যক্ষ ।

 এ প্রসঙ্গে শৈব পণ্ডিত শ্রীউমচিগি শঙ্কর শাস্ত্রী তাঁর কেন উপনিষদ ভাষ্যে বলছেন -

"স ইন্দ্র তস্মিন্নেবাকাশপ্রদেশে পরশিবব্রহ্ম স্বস্য শিবাং তনুমদর্শয়েৎ , …তাং বিদ্যাস্বরূপিণীং হৈমবতীং হিমবতঃ পুত্রীম্ উমাম্ উমাশব্দবাচ্যাং পার্বতীমাবির্ভূতামুবাচ….."

ভাষ্যের অনুবাদ — যক্ষরূপি পরমশিবরূপি ব্রহ্মের অন্তর্হিত হওয়ার পর ইন্দ্রদেব এরপর সেই আকাশে সেই পরমশিবের শক্তি শিবাকে দর্শন করলেন। তিনি বিদ্যাস্বরূপিণী (পরা বিদ্যা বা পরা শক্তি বা ব্রহ্মবিদ্যা অর্থে), তিনি হিমালয়ের পুত্রী উমা হৈমবতী। উমা শব্দে ‘পার্বতীকে’ বোঝানো হচ্ছে ।

(এখানে ব্রহ্ম স্বয়ং সেই ঈশ্বর এবং উমা হলেন ব্রহ্মবিদ্যা বা ব্রহ্মের-স্বরূপ জ্ঞান প্রদায়িণী বিদ্যা, কেননা তিনি ব্রহ্মের সাথেই থাকছেন।)

উমা/পার্বতী কি সত্যিই ব্রহ্মবিদ্যা?? দেখে নেওয়া যাক তৈত্তিরীয় আরণ্যকে সায়ণভাষ্য ‘এই উমাপতি‘, ‘অম্বিকাপতি‘ প্রসঙ্গে কি বলছে —

সায়ণভাষ্য"অম্বিকা জগন্মাতা পার্বতী তস্যাঃ + পতয়ে ভর্ত্রে। তস্যা একাম্বিকায়া ব্রহ্মবিদ্যাত্মকো দেহ উমাশব্দেনোচ্যতে । তাদৃশ্যা উমায়াঃ পতয়ে স্বামিনে রুদ্রায় পুনঃ পুনর্নমস্কারোহস্তু ।"

(কৃষ্ণ যজুর্বেদ / তৈত্তিরীয় আরণ্যক / দশমপ্রপাঠক/ ১৮ নং অনুবাক)

ভাষ্যের অনুবাদ– অম্বিকা অর্থাৎ জগন্মাতা পার্বতী। অম্বিকাপতি অর্থাৎ সেই জগন্মাতা পার্বতীর পতি। সেই এক ও দ্বিতীয় ব্রহ্মবিদ্যাস্বরূপিণী অম্বিকাই উমা শব্দের দ্বারা বাচিত হয়েছেন (সাকারে)। সেই উমার পতি, স্বামী রুদ্রকে (মহাদেব) পুনঃ পুনঃ নমষ্কার।

ভগবৎ গীতার অভিনবগুপ্ত ভাষ্য–কাশ্মীর শৈব সাধক মহামহেশ্বর অভিনবগুপ্ত তাঁর ভগবদগীতার অদ্বৈত শৈব ভাষ্য ‘গীতার্থ সংগ্রহ’ তে বলেছেন —

"সৈব জীবত্বং-পুরুষত্বং প্রাপ্তা পরা মমৈব নান্যস্য চ । সোভয়রূপা বেদ্যবেদকাত্মকপ্রপঞ্চোপরচনবিচিত্রা …..স্বস্বভাবাত্মিকা সততমব্যভিবারিণী প্রকৃতিঃ | ইদং জগৎ ভূম্যাদি ।"

- সেই জড় প্রকৃতি যখন পুরুষের সাথে একীভূত হন তখন সেই তত্ত্বকেই পরাপ্রকৃতি বলে। পরমেশ্বরের সেই পরাপ্রকৃতি উভয়রূপ অর্থাৎ প্রকৃতি-পুরুষাত্মক ও বেদ্য-বেদকাত্মক জগতের কারন।

আর এই পরাপ্রকৃতিই হল সাক্ষাৎ পরমেশ্বর ব্রহ্মের ইচ্ছাশক্তি বা মহামায়া ব্রহ্মবিদ্যাস্বরূপিণীও বলা যেতে পারে । আসলে পরমশিবের এই পরাপ্রকৃতিই পুরুষ ও মায়া প্রকৃতিরূপে আত্মপ্রকাশ করছেন।  

সুতরাং ব্রহ্ম পরশিবে যে সূক্ষ্ম চৈতন্য বর্তমান সেটাই হল সাক্ষাৎ পরাশক্তি বা নিজা শক্তি বা পরা বিদ্যা। আর পরা বিদ্যা যেহেতু মোক্ষদায়ীনি তাই পরাবিদ্যা কে কখনো মায়া বলা যাবে না, কেননা মায়া সর্বদাই মোক্ষের থেকে জীবকে দূরে সরিয়ে রাখে । এই পরা বিদ্যা থেকে আসে পরাপরা বিদ্যা, সেখান থেকে আসে অপরাবিদ্যা বা মায়া। 


শৈব বিশিষ্টাদ্বৈত বৈদান্তিক পণ্ডিত দের দৃষ্টিকোণ থেকে এবার দেখে নেবো শক্তি ও মায়ার মধ্যে পার্থক্য -

আচার্য্য শ্রীকণ্ঠ (নীলকণ্ঠ) তার ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে শক্তি প্রসঙ্গে বলছেন -

" শক্তিঃ প্রথমসংভূতা শান্ত্যতীতপদোত্তরা |
ততো মায়া ততো অব্যক্তং শিবাৎ শক্তিমতঃ প্রভোঃ ||
ইত্যাদিনা মায়াদি প্রপঞ্চে শক্তিমতঃ শিবস্যৈবোপাদানত্বমবগম্যতে |
শক্ত্যাদি চ পৃথিব্যন্তং শিবতত্ত্বসমুদ্ভবম্ |
তেনৈকেন তু তদ্‌ ব্যাপ্তং মৃদা মৃদাকুম্ভাদিকং যথা
শিবস্যৈবোপাদানত্বমবগম্যতে |
শক্ত্যাদি চ পৃথিব্যন্তং শিবতত্ত্বসমুদ্ভবম্ |
তেনৈকেন তু তদ্‌ ব্যাপ্তং মৃদা মৃদাকুম্ভাদিকং যথা
ইত্যাদিনা তত্রৈব শিবেনোপাদানভূতেন জগদ্ব্যাপ্তম্  মৃদ্ধটাদিন্যায়েনা অবগম্যতে | "

(ব্রহ্মসূত্র / নীলকণ্ঠভাষ্য /২/২ /৩৮)

নীলকণ্ঠ শিবাচার্য্য বলছেন ,  অব্যক্ত পরমশিব থেকে প্রথমে শান্ত্যতীত্তোরা কলা স্বরূপ পরাশক্তিতত্ত্ব উদ্ভূত হয়। এই পরাশক্তিই প্রথম তত্ত্ব শিবতত্ত্বের সাথে অভেদ। এই পরাশক্তি প্রকৃত পক্ষে শিবতত্ত্বই।  এই পরাশক্তি বা শিবতত্ত্ব থেকে এরপর দ্বিতীয় তত্ত্ব শক্তিতত্ত্ব আসে। এরপর ধীরে ধীরে মায়া, মায়ার পঞ্চ আবরণ ইত্যাদি বাকি তত্ত্ব গুলি আসে। এই শক্তি তত্ত্ব থেকে পৃথিবী তত্ত্ব পর্যন্ত সব কিছু প্রকৃত পক্ষে সেই প্রথম তত্ত্ব শিবতত্ত্বই। আচার্যের মতে,  সেই শিবতত্ত্বকেই পরাশক্তি বলা হয়ে থাকে।  মাটির কোনো পাত্রে যেমন মাটি ব্যাপ্ত থাকে তেমনি জগৎ চরাচরে উপাদান রূপে, শক্তিরূপে সেই শিবই ব্যাপ্ত রয়েছেন। ব্রহ্ম শিব এই ভাবেই জগতের উপাদান ও নিমিত্ত কারণ হচ্ছেন যা শ্রুতি ও মীমাংসা সম্মত মত।


এই সম্পর্কে শৈব আচার্য্য মুডিগোণ্ডা নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী তাঁর ব্রহ্মসূত্র নীলকণ্ঠভাষ্য টীকায় বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন । তিনি বলছেন --

" সূক্ষ্মচিদ্রুপাপন্নচিচ্ছক্তিবিশিষ্ট সকলতত্ত্বাতীত শিব এক এব ... সিসৃক্ষো স্তস্মাৎপ্রথমং শিবতত্ত্ব-পরবিন্দু-পরমায়া-শুদ্ধমায়া-মহামায়া-কুটিলা-কুণ্ডলিন্যা শব্দালম্বনত্বন প্রসিদ্ধাশুদ্ধাধ্বগত সকলভুবনভোগস্যানভোগোপকরণানাং উপাদানভূতা পরাশক্তিরুৎপত্তে। তত শক্তি সদাশিবো মহেশ্বর শুদ্ধবিদ্যেতি ... তদনন্তর অপরামায়া মিশ্রাধ্বগত সকলতনুভুবনাদ্দুপাদানভূতা জায়তে। ততঃ কালো, নিয়তিঃ, কলা, বিদ্যা, রাগঃ পুরুষ ইতি‌ ষট্-তত্ত্বানি‌জায়ন্তে। তদনন্তরং অশুদ্ধাধ্বগত তনুভুবনাদ্দুপাদানভূতং অব্যক্তং আবির্ভবতি।...এবমেতানি পরশক্ত্যয়াদীনি পৃথিব্যন্তানি জড়ানি ষট্-ত্রিংশতত্ত্বানি শিবশাস্ত্রেষু প্রসিদ্ধানি।.... নিবৃত্তিঃ--- প্রতিষ্ঠা--- বিদ্যা--- শান্তি---- শান্ত্যতীতেতি সংজ্ঞাভিঃ প্রসিদ্ধাঃ ... পঞ্চকলা পরশক্তিপ্রভবাঃ। তত্র শতকোটিযোজনমিতব্রহ্মাণ্ডরূপং পৃথিবীতত্ত্বং নিবৃত্তিকলায়ামবতিষ্ঠতে। জলাদ্য-অব্যক্তানি ত্রয়োবিংশতিস্তত্ত্বানি প্রতিষ্ঠায়াং। পুরুষাদীনি মায়ান্তানি সপ্ততত্ত্বানি বিদ্যায়াম্। শুদ্ধবিদ্যামহেশ্বরশ্চ শান্তিকলায়াম্। পরশক্তিস্তু তত্ত্বান্তরাণান্ত... পঞ্চপিকলা ... তত উপর্যুপরিস্থিতা শান্ত্যতীত পদোত্তরা ভবতি....শক্তিশব্দেন শিবতত্ত্বরূপা পরাশক্তিরুচ্যতে। "

(ব্রহ্মসূত্র/ শিবচিন্তামণিপ্রভা টীকা/২/২/৩৮, নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী)

 উপরিউক্ত বিষয়ের আরো বিস্তৃত ব্যাখ্যা শৈব বৈদান্তিক পণ্ডিত শিবযোগী মুডিগোণ্ডা নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী তাঁর ব্রহ্মসূত্র টীকায় করেছেন। তিনি বলছেন -  ব্রহ্ম পরশিব  হলেন তত্ত্বাতীত এবং সূক্ষ্ম পরাচিৎশক্তি বিশিষ্ট।  তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর মধ্যে যখন সৃষ্টির ইচ্ছা জন্মায় তখন তাঁর থেকে প্রথমে শিবতত্ত্ব (অনাশ্রিত শিব) প্রকটিত হয়।  নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী এই শিবতত্ত্বকেই পরবিন্দু বা পরামায়া বা শুদ্ধ মায়া বা কুণ্ডলিনী বা মহামায়া বা পরাশক্তি হিসেবে অভিহিত করেছেন। এর পর ধীরে ধীরে সেই  শিব তত্ত্ব থেকে বাকি তত্ত্ব গুলি নিম্নোক্ত ক্রমে প্রকটিত হয় ---- যথা  শক্তিতত্ত্ব --- সদাশিব তত্ত্ব (সাদাখ্য তত্ত্ব)--- মহেশ্বর------ শুদ্ধ বিদ্যা----- অপরা মায়া/মায়া ----- কাল, নিয়তি, কলা, বিদ্যা, রাগ (মায়ার আবরণ) ----- অব্যক্ত প্রকৃতি এবং পুরুষ ---- তিনটি অন্তঃ কর্ণ(মন, বুদ্ধি, অহংকার) ---- পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রীয় ----- পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় --- পঞ্চ তন্মমাত্র ---- পঞ্চ ভূত (পৃথিবী তত্ত্ব পর্যন্ত) = ৩৬ তত্ত্ব।

নাগালিঙ্গা শিবারাধ্য আচার্য্যের  মান্যতা অনুযায়ী - 

নিবৃত্তি কলা - পৃথিবী তত্ত্ব
প্রতিষ্ঠা কলা - জল থেকে প্রকৃতি তত্ত্ব
বিদ্যা কলা - পুরুষ থেকে মায়া তত্ত্ব
শান্তি কলা- শুদ্ধ বিদ্যা থেকে মহেশ্বর
শান্ত্যতীত কলা -  সদাশিব তত্ত্ব, শক্তিতত্ত্ব
শান্ত্যতীত্তোরা কলা - শিব তত্ত্ব অথবা পরাশক্তি তত্ত্ব
আর পরমশিব হল সাক্ষাৎ কলাতীত।

দ্বৈত বৈদান্তিক শৈব পণ্ডিত শ্রীমৎ অপ্পয় দীক্ষিত তাঁর ব্রহ্মসূত্র নীলকণ্ঠ ভাষ্যের 'শিবাকর্মণিদীপিকা' টীকায় একই মত পোষণ করে গেছেন এবং আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে গিয়েছেন। শৈব দর্শন সম্পর্কে অবগত, শাস্ত্রোজ্ঞ এবং সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের জন্য পণ্ডিত অপ্পয় দীক্ষিত এর ব্রহ্মসূত্র টীকা থেকে নীচে পুরো বিশদ ব্যাখ্যার আলোক চিত্র তুলে ধরা হল --


সুতরাং কাশ্মীর অদ্বৈত শৈব দর্শন হউক বা শৈব বিশিষ্টাদ্বৈত বৈদান্তিক দর্শনই হউক, সব স্থানেই যে শক্তি তত্ত্বকে মায়া তত্ত্বের উর্ধ্বে রাখা হয়েছে তা বিভিন্ন শৈব আচার্যগণ রচিত বিভিন্ন শাস্ত্র ও প্রমাণিত করা হল।  বলা বাহুল্য যে শৈব দর্শন 36 তত্ত্বের উপরে আধারিত, 25 তত্ত্বের উপরে নয়, যা শৈব বৈদান্তিক পণ্ডিত সহ শৈব আগমিক/তান্ত্রিক পণ্ডিতদেরও স্বীকার্য।

নমঃ শিবায় |
নম শিবায়ৈ |


লেখনীতে - RohitKumarChoudhury (ISSGT)

প্রচারে - International Shiva Shakti Gyan Titha - ISSGT

©RohitKumarChoudhury. ISSGT. 2022. ARR 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত