নাথ শৈব পরম্পরায় মান্যতা প্রাপ্ত শাস্ত্র সমূহের তালিকা-


প্রাচীন শৈব ঘরানা গুলির মধ্যে অন্যতম এক ঘরানা হল - নাথ পরম্পরা বা নাথ ঘরানা। মূলত যোগ এবং তন্ত্র সাধন মার্গের উপর এই ঘরানা প্রতিষ্ঠিত । আদিনাথ প্রথম অর্থাৎ সাক্ষাৎ শিব এই ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা। নাথেদের দর্শন হল - অদ্বৈত শৈব দর্শন , যা অনেকটা কাশ্মীর ত্রিক শৈব দর্শনের অনুরূপ, ইহার নাম - সিদ্ধসিদ্ধান্ত দর্শন, যা মূলত যোগ ও তন্ত্র ভিত্তিক, সিদ্ধ পুরুষদের বাণী ভিত্তিক।  নাথেদের শাস্ত্র সূক্ষ্মবেদ মতে, নাথ ঘরানা চার যুগেই বিদ্যমান ছিল বলে মনে করা হয় এবং চার যুগেরও আগে অনাদিযুগ বা সূক্ষ্ম যুগ থেকে এই ঘরানা চলে আসছে বলে নাথ সম্প্রদায়ভুক্ত সাধকেরা মনে করে থাকেন। আদিনাথ, গোরক্ষ নাথ, মৎস্যেন্দ্রনাথ এনারাও চার যুগে চার জন ছিলেন বলে মনে করা হয়। সাক্ষাৎ শিব চারযুগেই আদিনাথ স্বরূপে অবতীর্ণ হন বলে মনে করা হয়।তবে এই মত নিয়ে বিভিন্ন স্থানের নাথেদের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে।  এই নাথ পরম্পরা আজও বহাল রয়েছে। এমনকি স্কন্দমহাপুরাণ এর মাহেশ্বরখণ্ডে নাথ পরম্পরার অন্যতম সাধক মহাকৌল মৎস্যেন্দ্রনাথ জীর উল্লেখ পাওয়া যায়। সাথে আচার্য অভিনবগুপ্ত তাঁর তন্ত্রালোকেও মৎস্যেন্দ্রনাথ জীর উল্লেখ অত্যন্ত তাত্ত্বিক ভাবে করেন,  যার স্পষ্ট সংকেত আচার্য জয়রথ কর্তৃক তন্ত্রালোক এর ভাষ্যেই পাওয়া যায়। নাথ পরম্পরা এর মধ্যে যোগাচার, কৌল আচার, অঘোর আচার এবং প্রাচীনকালে কাপালিক আচার (সোম সিদ্ধান্ত) এরও উল্লেখ মেলে। তবে, গুরু গোরক্ষনাথ প্রণীত নাথ ঘরানা গুলিতে যোগাচারই মূল। তাছাড়া অঘোর দীক্ষারও প্রচলন রয়েছে গোরক্ষ পন্থীদের মধ্যে (যেমন- নটেশ্বরী নাথ পন্থে) মৎস্যেন্দ্রপন্থীদের মধ্যে কৌল আচার (বামাচার ভিত্তিক, যদিও কৌল আচারের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, রহস্য আলাদা রয়েছে) এর প্রচলন ছিল। আবার জালন্ধর পন্থীদের মধ্যে কাপালিক আচার বিদ্যমান ছিল বলে মনে করা হয়।  বর্তমানে নাথ ঘরানার 12টি পন্থা পাওয়া গেলেও, নাথ সম্প্রদায়ের অন্তর্গত আরো অনেক পরম্পরা, তাদের শাখা, উপশাখা বিদ্যমান ছিল। বহু ঘরানা লুপ্ত হয়ে যায়। 


এই সুপ্রাচীন নাথ শৈব পরম্পরা মূলত গুরুবাক্য এবং আগম শাস্ত্রের (শিব বাক্য মাত্রই আগম, যেমন- গোরক্ষতন্ত্র, শাবর তন্ত্র, অঘোরতন্ত্র ইত্যাদি) উপর নির্ভরশীল ছিল। নাথ সম্প্রদায়ে গুরুবাক্য, 84 সিদ্ধ নাথেদের বাণী, নবনাথের বাণী, গোরক্ষনাথের বাণী, মৎস্যেন্দ্রনাথের বাণী এবং আদিনাথ  শিবের বাণী এর উর্দ্ধে কোনো কিছু মান্য নয়। তাঁদের এই সকল বাণীরই লিখিত রূপই হল শাস্ত্র এবং আগম। তাই , বলা যায় যে নাথ সম্প্রদায়ও শাস্ত্র, আগম এবং দর্শন এর উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। যদিও শাস্ত্রের লিখিত রূপের বাইরেও  গুরুমুখী বিদ্যা, যোগ, মুদ্রা, বন্ধন, শাবরবিদ্যা রয়েছে, যার কোনো লিখিত রূপ নেই, যা শুধুমাত্র গুরু মুখেই প্রচলিত।  

সে যাই হউক মূল কথায় আসা যাক এবার। নাথ পরম্পরাভুক্ত একদল মানুষ আজকাল নিজেদেরই পরম্পরার শাস্ত্র ধারা সম্পর্ক অবগত নন, বরং তাঁরা নূতন নূতন আবির্ভূত প্রত্নতাত্ত্বিক এবং সাহিত্যিক এবং ঐতিহাসিকদের রচিত কল্প কাহিনীকে ভিত্তি করে স্বপ্নের জগতে গা ভাসিয়ে চলেছেন। এর পেছনে একমাত্র কারণ হল সঠিক পরম্পরাগত শাস্ত্র জ্ঞান বিমুখতা। মানুষ কিছু না জেনেই আজকাল - নাথেদের পৈতে ধারী ব্রাহ্মণ বানাতে সচেষ্ট,  যোগীদের বর্ণধর্ম, গোত্র নির্ণয়ে ব্যস্ত, আবার কেউ নাথ সম্প্রদায়কে নাস্তিক বৌদ্ধ ধর্ম থেকে উদ্ভূত বলে প্রচারে ব্যস্ত, কেউ আবার আদিনাথ শিবের মা, বাবা এবং জন্ম বের করে বসে আছেন, একদল আবার আদিনাথ শিবের বীর্য থেকে এক বিশেষ নাথ পরম্পরার জন্মের কাহিনীর ঢ্যাঁড়া  পিটিয়ে ক্ষান্ত,  আবার একদল মানুষ মহাকৌল মৎস্যেন্দ্রনাথের গুরু হিসেবে দত্তাত্রেয় মুনিকে প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর, নাথেদের মূল শাস্ত্রে যার বিন্দুমাত্র উল্লেখ/শব্দপ্রমাণ পাওয়া যায় না। শাস্ত্র ছাড়া যে মানুষ অনুশাসনহীনতায় ভোগে তার প্রমাণ আজ ঘরে ঘরে। তাই সত্যকে প্রতিষ্ঠা হেতু এই প্রথমবার বাংলায় নাথেদের পরম্পরায় মান্যতা প্রাপ্ত, প্রধান প্রধান এবং উল্লেখযোগ্য শাস্ত্র গুলির তালিকা প্রকাশ করা হল। সেগুলি হল - 


1. সিদ্ধসিদ্ধান্ত পদ্ধতি (গুরু গোরক্ষনাথ কৃত, নাথেদের মূল দর্শন ভিত্তিক শাস্ত্র) 

2. হঠযোগ প্রদীপিকা (স্বাত্মারামযোগী কৃত) 

3. গোরক্ষ তন্ত্র (আগম শাস্ত্র, সাক্ষাৎ আদিনাথ শিবের বাণী)

4. গোরক্ষ সিদ্ধান্ত সংগ্রহ

5. গোরক্ষ সংহিতা (আগম শাস্ত্র, কেননা ইহা শিব বাণী, সংকলনকার গুরু গোরক্ষ নাথ)

6. গোরক্ষ বিজয়

7. গোরক্ষ বোধ

8. গোরক্ষ বাণী  (গুরু গোরক্ষনাথ কৃত)

9. গোরক্ষ শতক

10. মৎস্যেন্দ্র সংহিতা/মচ্ছন্দ সংহিতা

11. হঠসংকেত (গুরু গোরক্ষনাথ কৃত)

12. গোরক্ষ পুরাণ (মূল গোরক্ষ পুরাণ অবলুপ্ত)

13. রাজ গূহ্য (শ্রীকৃষ্ণ রচিত)

14. সূক্ষ্ম বেদ

15. শাবর তন্ত্র (আগম শাস্ত্র, কেননা ইহা শিবের বাণী, অবলুপ্ত)

16. অমনস্ক যোগ গুরু (আগম শাস্ত্র, কেননা ইহা শিব বাণী, সংকলনকার গুরু গোরক্ষ নাথ)

17. অবধূত গীতা (দত্তাত্রেয় অবধূত কৃত)

18. আদিনাথ সংহিতা

19. কৌলজ্ঞাননির্ণয়/মহাকৌলজ্ঞানবিনির্ণয় (আগম শাস্ত্র, কেননা ইহা শিব বাণী, মহাকৌল শৈব যোগী দাদাগুরু শ্রী মৎস্যেন্দ্রনাথ কর্তৃক সংকলিত)

20.কৌলাবলীনির্ণয় (আগম শাস্ত্র)

21. কৌলাবলী তন্ত্র (আগম শাস্ত্র)

22. কৌল উপনিষদ

23. অকুলবীর তন্ত্র  (আগম শাস্ত্র, কেননা ইহা শিব বাণী, মহাকৌল শৈব যোগী দাদাগুরু শ্রী মৎস্যেন্দ্রনাথ কর্তৃক সংকলিত)

24. যোনি তন্ত্র (আগম শাস্ত্র, কেননা ইহা শিব বাণী, মহাকৌল শৈব যোগী দাদাগুরু শ্রী মৎস্যেন্দ্রনাথ কর্তৃক সংকলিত)

25. কুলার্ণব তন্ত্র  (আগম শাস্ত্র, কেননা ইহা শিব বাণী, মহাকৌল শৈব যোগী দাদাগুরু শ্রী মৎস্যেন্দ্রনাথ কর্তৃক সংকলিত)

26. অমরৌঘ শাসনম

27. গোরক্ষ গীতা

28. বিবেক মার্তণ্ড 

29. যোগ বীজ

30. মহার্থ মঞ্জরী (কাশ্মীর শৈবদের গ্রন্থ ইহা মূলত, আচার্য মহেশ্বরানন্দের লেখা )

31. গোরক্ষ কৌমুদী

32.গোরক্ষ কল্প

33. যোগ চিন্তামণি

34. গোরক্ষ কবচ

35. ঘেরণ্ড সংহিতা (ঘেরণ্ড মুনি কৃত)

36. যোগ সিদ্ধান্ত পদ্ধতি

37. যোগ মার্তণ্ড

38. গোরক্ষ গোষ্ঠী

39. গোরক্ষ গণেশ গোষ্ঠী

40. দয়া বোধ

41. জ্ঞান মীমাংসা

42. সিখা দরসা 

43. প্রাণ সংকলি

44. নরবৈবোধ

45. আত্মবোধ ১ 

46. আত্মবোধ 2

47. অভৈমাত্রা জোগ

48. পন্দ্রেহ তিথি

49. সপ্তবার

50. মচ্ছিন্দ্র গোরখ বোধি

51. রোমাবলী

52. জ্ঞানতিলক

53. জ্ঞান চৌতীসা

54. পঞ্চমাত্রা

55. মহাদেব গোরখ মুষ্টি

56. সিষ্য পুরান

57. ছন্দগোরখ

58. নবগ্রহ

59. নবরাত্র

60. অষ্টপারছ্য়া

61. রহরাস

62. গ্যানমালা

63. ব্রত

64. নিরঞ্জন পুরাণ

65. ইন্দ্রা দেবতা

66. মূল গর্ভাবলী

67. গোরখমত

68. অষ্টমুদ্রা

69. চৌবীস সিদ্ধি

70. ষড়ক্ষরী

71. পঞ্চঅগ্নি

72. অষ্টচক্র

73. অবলিসলূক

74. ক্ষুরিকোপনিষৎ

75. খেচরী সংহিতা

76. গরীবনাথ সংহিতা

77. গোরক্ষ কল্পম্

78. গোরক্ষনাথ স্তোত্রম

79. গোরক্ষ পদ্ধতি

80. গোরক্ষ মঞ্জরী

81. গোরক্ষোপনিষৎ

82. জালন্ধর সংহিতা

83. চতুরশীতিসিদ্ধানাম্ ইতিহাস (মানসিংহকৃত)

84. ঘোরংগনাথ কথা

85. নবনাথকথা

86. নাথচরিতম

87. নারসূত্রম্

88.নাথতীর্থাবলী

89.পৃথ্বীনাথ সংহিতা

90. বাতুলনাথ সূত্রম

91. ভর্তৃহরি সংহিতা

92. মহেশ সংহিতা

93. মেঘমালা

94. যোগশাস্ত্রম

95. শিবসংহিতা

96. যোগিবংশাবলী

97. যোগিসম্প্রদায়াবিষ্কৃতি

98. বর্ণ রত্নাকর

99. সিদ্ধকোশ

100. সিদ্ধসিদ্ধান্ত সংগ্রহ 

101. সুধাকরচন্দ্রিকা

102. হঠযোগরত্নাবলী

103. কাফির বোধ

104. শাবর চিন্তামণি (মহাকৌল শৈবযোগী দাদাগুরু শ্রীমৎস্যেন্দ্রনাথ কর্তৃক রচিত)

105. শ্রী কামাখ্যা গূহ্যসিদ্ধি  (মহাকৌল শৈবযোগী দাদাগুরু শ্রীমৎস্যেন্দ্রনাথ কর্তৃক রচিত)

106. অকুলাগম তন্ত্র (নাথ শৈব কৌলদের আগম ইহা)

107. গোরক্ষ ভুজঙ্গম 

108. গোরক্ষ সহস্রনাম 

109. জ্ঞানকারিকা (মহাকৌল শৈবযোগী দাদাগুরু শ্রীমৎস্যেন্দ্রনাথ কর্তৃক রচিত)

110. গোরক্ষ গুটিকা

111. গোরক্ষ মুদ্গর 

112. গোরক্ষ যোগ শাস্ত্রম্

113. কল্পদ্রুম তন্ত্র




ইত্যাদি.... উপরিউক্ত বেশিরভাগ গ্রন্থই অবলুপ্ত। তাছাড়া আরো বহু গ্রন্থ ছিল যেগুলির নাম পাওয়া যায় না ।


শ্রী নাথজীকো আদেশ আদেশ।

নমঃ শিবায়।

সংগ্রহে - ©RohitKumarChoudhury (ISSGT)

প্রচারে - International Shiva Shakti Gyan Tirtha- ISSGT 

©RohitKumarchoudhury. ISSGT. 2022. ARR



মন্তব্যসমূহ

  1. শাস্ত্র গুল কোথা থেকে সংগ্রহ করা যাবে বললে ভাল হত। ওঁ নমঃ শিবায়

    উত্তরমুছুন
  2. কলি যুগের প্রকোপে বেশির ভাগ শাস্ত্রই অবলুপ্ত। তবে কিছু কিছু শাস্ত্র পাওয়া যায়, তবে সংস্কৃত অথবা হিন্দি ভাষায়। এর জন্য online এ সেই শাস্ত্রের নাম লিখে পাশে archrive লিখে search করুন, যদি available থাকে তাহলে pdf ebook পেয়ে যাবেন। তাছাড়া কিছু কিছু শাস্ত্রের হার্ডকপি exoticindia ওয়েবসাইট এ পেয়ে যাবেন ।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত