ব্রাহ্মণ গ্রন্থ এবং অর্থবাদ (গুণবাদ, অনুবাদ, ভূতার্থবাদ) সম্পর্কিত আলোচনা -
ব্রাহ্মণভাগের পরিচয় প্রসঙ্গে মহর্ষি আপস্তম্ব বলেছেন -
"মন্ত্রব্রাহ্মণয়োর্বেদনামধেযম্"
(আপস্তম্ব যজ্ঞপরিভাষাসূত্র - ১.৩৩)
অর্থ- মন্ত্র ও ব্রাহ্মণের নাম বেদ।
পূর্বে বেদের স্বরূপ বিষয়েও মতভেদ ছিল। আপস্তম্ব যজ্ঞপরিভাষা সূত্রের হরদত্তাচার্যকৃত বৃত্তি থেকে জানা যায় -
" কৈশ্চিন্মন্ত্রাণামেব বেদত্বম আখ্যাতম্ |
কৈশ্চিৎ কল্পসূত্রাণামপি | উভযনিরাসার্থমযমারম্ভঃ || "
(হরদত্তাচার্যকৃত বৃত্তি/১/৩৩)
অর্থ- কোনো কোনো ব্যক্তি কেবল মন্ত্রভাগকেই বেদ বলেছেন, কেউ কেউ আবার শ্রৌতসূত্র-কেও বেদ বলে স্বীকার করেছেন। এই উভয় মতের খণ্ডনের জন্য আপস্তম্ব এই সূত্র প্রণয়ন করেছেন।
এখন প্রশ্ন হল 'ব্রাহ্মণ' কাকে বলে?
এর উত্তরে মহর্ষি আপস্তম্ব বলছেন -
"কর্মচোদনা ব্রাহ্মণানি ”
(আপস্তম্ব যজ্ঞপরিভাষাসূত্র - ১.৩৪)
অর্থ - যে বাক্যগুলি যজ্ঞাদিকর্মের বিধি সেইগুলি ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ গ্রন্থ বৈদিক কর্মকাণ্ডেরই বোধক।
সুতরাং, ব্রাহ্মণ অংশ বিধিমূলক বৈদিক ক্রিয়াকর্মের নির্দেশক।
সুতরাং ব্রাহ্মণ শাস্ত্র যে বেদ এর অন্তর্গত এবং ইহাও যে শ্রুতি অর্থাৎ অপৌরষেয়, তার স্বপক্ষে শব্দ প্রমাণ আমরা কল্প বেদাঙ্গ শাস্ত্রেই পেয়ে যাচ্ছি, যা একাধিক প্রাচীন বৈদিক আচার্য দ্বারা স্বীকৃত।
এখন প্রশ্ন হল ব্রাহ্মণ কি শুধুই বৈদিক কর্মকাণ্ডের বোধক? নাকি কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ব্রাহ্মণ শাস্ত্রে অন্যান্য বিষয়ও নিহিত রয়েছে? 'বিধি' ব্যতীত ব্রাহ্মণ আর কোন কোন অংশে বিভক্ত ?
এর উত্তর শাস্ত্রেই নিহিত রয়েছে।
আসলে ব্রাহ্মণের মূল কর্মকাণ্ড অংশ - 'বিধি' হিসেবে পরিচিত। কোন যজ্ঞবিশেষে কোন মন্ত্রবিশেষের বিনিয়োগ হবে তার বিধান দেয়া হয়েছে ব্রাহ্মণের যে অংশে, তাকে 'বিধি' বলা হয়।
" মন্ত্রব্রাহ্মণে যজ্ঞস্য প্রমাণম্ || ১.৩২ || (আপস্তম্ব যজ্ঞপরিভাষা সূত্র) - উক্ত কল্প সূত্র দ্বারা সংহিতা ভাগের পাশাপাশি ব্রাহ্মণের 'বিধি' ভাগকেই আচার্য আপস্তম্ব বুঝিয়েছেন।
'বিধি' প্রসঙ্গে শবর স্বামী তাঁর পূর্ব মীমাংসা ভাষ্যে বলছেন -
"অপ্রাপ্তে শাস্ত্রমর্থবৎ" (শাবরভাষ্য)
অর্থ - বেদের (আসলে ব্রাহ্মণ শাস্ত্র এর) যে ভাগ অজ্ঞাত বিষয়ের জ্ঞাপক, তাকে 'বিধি' বলা হয়।
বিধির লক্ষণে মীমাংসক লৌগাক্ষি ভাস্কর তাঁর 'অর্থসংগ্রহ' গ্রন্থে বলেন -
" তত্রাজ্ঞা-তার্থজ্ঞাপকো বেদভাগোবিধিঃ | "
অর্থ - বেদের যে ভাগ অজ্ঞাত অর্থের জ্ঞাপক তাই 'বিধি'। এখানে ‘অজ্ঞাত’ বলতে বোঝায় অন্য প্রমাণের দ্বারা পূর্বে অপ্রাপ্ত।
'অর্থবাদ' কি ? ইহা কয় প্রকার ?
অন্যদিকে বেদের এই ব্রাহ্মণ অংশে এমন অনেক বাক্য আছে যার মধ্যে কোন বিধির নির্দেশ নেই, 'বিধি' ব্যতীত ব্রাহ্মণ ভাগের এজাতীয় অংশকে বলা হয় 'অর্থবাদ'।
অর্থবাদ প্রসঙ্গে মহর্ষি আপস্তম্ব বলছেন -
" ব্রাহ্মণশেষোঽর্থবাদঃ || "
(আপস্তম্ব যজ্ঞপরিভাষাসূত্র - ১.৩৫)
অর্থ - ব্রাহ্মণ শাস্ত্রের শেষের অংশগুলি (কর্মকাণ্ড ব্যতীত) বাকি অংশ গুলি অর্থবাদ হিসেবে পরিচিত ।
উদাহরণ -
“বায়ব্যং শ্বেতমালভেত |
বায়ুর্ব্বৈ ক্ষেপিষ্ঠা দেবতা |”
(কৃষ্ণযজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয় সংহিতা/২/১/১/১)
অর্থাৎ বায়ুদেবতার উদ্দ্যেশ্যে শ্বেতবর্ণ পশু বধ করবে, অর্থাৎ যজ্ঞে আহুতি দেবে। বায়ু শীঘ্ৰপথগামিনী দেবতা, অতএব যাগফল শীঘ্র প্রদান করেন - ইত্যাদি বাক্য অর্থবাদ।
এই অর্থবাদ কি কি ভাগে বিভক্ত তা এবার দেখে নেওয়া যাক -
" নিন্দা প্রশংসা পরকৃতিঃ পুরকল্পশ্চ || "
(আপস্তম্ব যজ্ঞপরিভাষাসূত্র - ১.৩৬)
অর্থ - এই অর্থবাদ চার প্রকার যথা - নিন্দা, প্রশংসা, পরকৃতি ও পুরাণকল্প।
'বিধির' সহিত যে এই যে 'অর্থবাদ', সেগুলি ব্রাহ্মণেরই অংশ, ব্রাহ্মণের বাইরের কোনো অংশ নয়। যেহেতু ব্রাহ্মণ শাস্ত্র ইতিমধ্যে বেদ হিসেবে প্রমাণিত উহারা বিধিরই উপকারক। সুতরাং অর্থবাদও শ্রুতি বা বেদ।
অর্থবাদ প্রসঙ্গে মহর্ষি জৈমিনি কর্তৃক প্রণীত পূর্ব মীমাংসা সূত্রের ভাষ্যকার শবর স্বামী বলছেন -
" যস্যৈতল্লক্ষণং ন ভবতি,তদ্ ব্রাহ্মণমিতি পরিশেষসিদ্ধং ব্রাহ্মণং । .... হেতুনির্বচনং নিন্দা প্রশংসা সংশযো বিধিঃ । পরক্রিযা পুরাকল্পো ব্যবধারণকল্পনা ॥ উপমানং দর্শেতে তু বিধেযো ব্রাহ্মণস্য তু । এতদ্বৈ সর্ববেদেষু নিযতং বিধিলক্ষণং ॥" (সংক্ষেপিত)
ভাষ্যানুবাদ -
বেদের যে অংশগুলিতে সেইরূপ (মন্ত্র বা সংহিতা বিষয়ক) কোনো লক্ষণ নেই, সেই অংশ গুলিই ব্রাহ্মণ, ইহা পরিশেষ সিদ্ধ ব্রাহ্মণ হিসেবে অভিহিত। হেতু, নির্বচন, নিন্দা, প্রশংসা, সংশয়, বিধি, পরকৃতি, পুরাকল্প, ব্যবধারণকল্পনা এবং উপমান এগুলো ব্রাহ্মণ এর দশ বিধি।
"প্রাশস্ত্যনিন্দান্যতরপরং বাক্যম্ অর্থবাদ"
সুতরাং, মীমাংসা মতে, বিধি ব্যতীত ব্রাহ্মণ ভাগের বাকি অংশ অর্থাৎ অর্থবাদ - নিন্দা, প্রশংসা, হেতু, পুরাকল্প ইত্যাদির সম্মিলিত রূপ এবং এইগুলিও শ্রুতি।
👉নিন্দা - যে অর্থবাদে কোনো একটি নিষিদ্ধ কর্মের নিন্দা বোঝায় তার নাম 'নিন্দা'।
যেমন- যজ্ঞের দক্ষিণারূপে রজত দানের নিন্দা করা হয়েছে।
" যো বহিষি রজতং দদাতি পুরাস্য সংবৎসরাদ্ গৃহে রুদন্তি "
অর্থ- যে কুশলসাধ্যযোগে রজত বা রৌপ্য দক্ষিণা দেয়, একবছরের পূর্বেই তাঁর গৃহে রোদন আরম্ভ হয়।
👉প্রশংসা - যে অর্থবাদ কাহারও প্রশংসার উদ্দ্যেশ্যে প্রবৃত্ত হয় তার নাম 'প্রশংসা' অর্থবাদ।
যেমন- " যজমানো বৈ প্রস্তরঃ " (তাণ্ড্য ব্রাহ্মণ/৬/৭)
অর্থ - দশপূর্ণমাসাদি যোগে বেদীতে আস্তীর্ণ প্রস্তর নামক কুশকে যজমানের সদৃশ বলে প্রশংসা করা হয়েছে।
👉পরকৃতি - পরকৃতি এর বর্ণনা প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সেশ্বর মীমাংসাচার্য ভট্ট কুমারিল তাঁর 'তন্ত্রবার্তিক' এ বলছেন -
" একপুরুষকর্তৃকমুপাখ্যানং পরকৃতিঃ |"
(তন্ত্রবার্ত্তিক'/দ্বিতীয় অধ্যায়/ প্রথম পাদ/ ৩৩ নং সূত্র)
অর্থ - যে অর্থবাদ এমন এক উপাখ্যানকে অবলম্বন করে বর্ণিত হয় যে উপাখ্যানে বর্ণিত কর্তা একজন মাত্র, তাকে 'পরকৃতি' বলে।
👉পুরাকল্প - পরকৃতি এর বর্ণনা প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সেশ্বর মীমাংসাচার্য ভট্ট কুমারিল তাঁর ' তন্ত্রবার্তিক' এ বলছেন -
" বহু কর্তৃকং পুরাকল্পঃ | "
(তন্ত্রবার্ত্তিক'/দ্বিতীয় অধ্যায়/ প্রথম পাদ/ ৩৩ নং সূত্র)
অর্থ - যে উপাখ্যানের বর্ণিত ঘটনার কর্তা এক নয় কিন্তু অনেক, এইরূপ উপাখ্যানের প্রতিপাদক অর্থবাদকে 'পুরাকল্প' বলে।
[ 🔘 বিঃদ্রঃ - 'অনেক' অর্থাৎ এক এর বেশি, মানে দুই ও হতে পারে। ইহা ভট্ট কুমারিল এর মত। কিন্তু কপর্দি স্বামীর মতে অর্থবাদে বর্ণিত ঘটনার কর্তা অনির্দিষ্ট সংখ্যক হলে তবেই তা পুরাকল্প হিসেবে গণ্য, যদি দুইজন হয় তবে তা পুরাকল্প হিসেবে গণ্য নয়। কপর্দী স্বামী পুরাকল্পের উদাহরণ এভাবে দিয়েছেন -
" আপো বা ইদমগ্রে সলিলমাসীৎ ” - সৃষ্টির পূর্বে এই জগৎ জলাকারে ছিল।]
শাস্ত্রে অর্থবাদ একাধিক ভাবে প্রয়োগ হয়ে থাকে - এগুলি হল - গুণবাদ, অনুবাদ এবং ভূতার্থবাদ।
" বিরোধে গুণবাদঃ স্যানুবাদোঽবধারিতে |
ভূতার্থবাদস্তদ্ধানাদর্থবাদস্ত্রিধা মতঃ ||
(বৃহদারণ্যক সম্বন্ধ বার্ত্তিক/৫৬৭)
👉গুণবাদ - যে অর্থবাদ বাক্য (বা শব্দপ্রমাণ) অন্যকোনো প্রমাণের সাথে আপাত বিরোধ বলে প্রতীয়মান হয়, কিন্তু পর্যবসানে তা স্তুতিরূপে পরিণত হয়, সেই অর্থবাদকে তখন ‘গুণবাদ' বলে।
উদাহরণ- “ যজমানো বৈ প্রস্তরঃ " (তাণ্ড্য ব্রাহ্মণ/৬/৭) এখানে যজ্ঞের কর্তা যজমানের সহিত কুশমুষ্টির অভিন্নতা বোঝানো হয়েছে। প্রত্যক্ষ প্রমাণের দ্বারা কুশমুষ্টি যজমান থেকে ভিন্নই প্রতীত হয়। সুতরাং প্রত্যক্ষ প্রমাণের সঙ্গে অর্থবাদের আপাতত বিরোধ বোঝা গেল । কিন্তু উক্ত অর্থবাদের তাৎপর্য হচ্ছে কুশমুষ্টির প্রশংসা। যজমান যেরূপ যাগ ক্রিয়ার নির্বাহক হয়, এই কুশমুষ্টিও সেইরূপ যাগ ক্রিয়ার নির্বাহক ।
👉অনুবাদ - যে অর্থবাদ বাক্য ( বা শব্দপ্রমাণ) অন্য কোনো প্রমাণ দ্বারা জ্ঞাত কোন বস্তুকে প্রকাশিত করে বা অন্য কোনো প্রমাণের অনুকূল হয়, সেই অর্থবাদকে 'অনুবাদ' বলে।
উদাহরণ - “অগ্নিহিমস্য ভেষজম্” - অগ্নি শীতের ঔষধ অর্থাৎ বিনাশক। অগ্নি যে শীতের নিবারক তা প্রত্যক্ষ প্রমাণ দ্বারা সিদ্ধ। তাই এই বাক্য 'অনুবাদ'।
👉ভূতার্থবাদ- যে অর্থবাদের প্রতিপাদ্য পদার্থ, অন্য কোনো প্রমাণের দ্বারা বিরোধ প্রাপ্ত হয়না বা অন্য কোনো প্রমাণের দ্বারা জ্ঞাতও হয় না, সেই অর্থবাদ ভূতার্থবাদ নামে কথিত হয়।
উদাহরণ- "ইন্দ্ৰো হ যত্র বৃত্রায় বজ্রং প্রজহার, স প্রহৃতশ্চতুর্ধাঽভবৎ" (শতপথ ব্রাহ্মণ/১/২/২/১)
অর্থ- ইন্দ্ৰ যে সময় বৃত্রকে বজ্রের দ্বারা প্রহার করেছিলেন, তখন সেই বজ্র বৃত্রের শরীরে অভিহত হয়ে চারভাগে বিভক্ত হয়েছিল।
শাস্ত্রব্যতিরেকে অন্য কোনো প্রমাণের দ্বারা এই ইন্দ্র বৃত্রাসুরের ঘটনা জানা যায় না বলে অন্য প্রমাণের সঙ্গে বিরোধও হয় না এবং অন্য প্রমাণের দ্বারা জ্ঞাতও নয় ইহা। এইজন্য এই অর্থবাদ 'ভূতার্থবাদ' নামে পরিচিত।
👉 “তত্ত্বমসি", “সত্যং জ্ঞানং অনন্তং ব্রহ্ম” ইত্যাদি মহাবাক্যও ভূতার্থবাদ। ।
পরবর্তী প্রতিবেদনে নৈয়ায়িকদের মতে অর্থাৎ ন্যায় দর্শন মতে অর্থবাদ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে
🙏 নমঃ শিবায 🙏
🙏 নমঃ শিবাযৈ 🙏
🙏 শিব ॐ তৎ সৎ 🙏
👉 লেখনীতে - ©RohitKumarChoudhury (ISSGT)
👉 প্রচারে - International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন