ত্রিংশিকা এবং কাশ্মীর ত্রিক শৈবধারা -

সমগ্র ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে - ষড়দর্শনের বাইরে আরও একটি উচ্চমানের তন্ত্রভিত্তিক অদ্বৈত দর্শন কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে মাথা চারা দিয়ে ওঠে, এই দর্শনের নাম - ত্রিক শৈব দর্শন। এই দর্শনের অপর নাম স্পন্দদর্শন বা প্রত্যভিজ্ঞা দর্শন। এই দর্শন ছিল - অদ্বৈতমার্গী। তাই এই দর্শনকে ঈশ্বরাদ্বয়বাদ বা শিবাদ্বয়বাদও বলা হয়, কেননা শিবশক্তির সামরস্যপূর্ণ প্রকাশ ও বিমর্ষময় অবস্থার সমন্বয়ে সর্বোচ্চ সত্ত্বা পরমশিবই(পরমব্রহ্ম) এই দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য। 


🔘 এই দর্শনের অন্তর্ভুক্ত শাস্ত্র ধারাগুলি হল - 

👉আগমধারা(শৈব আগম ভিত্তিক), 

👉স্পন্দশাস্ত্র ধারা 

ও 👉প্রত্যভিজ্ঞা শাস্ত্র ধারা। 


উপরিউক্ত তিন প্রকারের শাস্ত্র ধারার ভিত্তিতে কাশ্মীর ত্রিক শৈব পরম্পরা মূল চার ভাগে (মতান্তরে তিন ভাগে - স্পন্দ ও প্রত্যভিজ্ঞা- কে একই ধরে) বিভক্ত, যথা -

👉ক্রম পরম্পরা (আগম শাস্ত্র ভিত্তিক মূলত),  

👉কুল পরম্পরা (আগম শাস্ত্র ভিত্তিক), 

👉স্পন্দ (স্পন্দ শাস্ত্র আগম ভিত্তিক) 

ও 👉প্রত্যভিজ্ঞা (প্রত্যভিজ্ঞা শাস্ত্র আগম ভিত্তিক) 


কাশ্মীর শৈবধারার সাধন ক্রমের তিনটি পর্যায় হল- আণবোপায়, শাক্তোপায়শাম্ভবোপায়। এর উর্দ্ধে সর্বোচ্চ মার্গ রয়েছে, যার নাম অনুপায়। (বিশদ জানতে পড়ুন - ভগবান শ্রীমৎঅভিনবগুপ্তপাদাচার্য রচিত শ্রীতন্ত্রালোক)


'ত্রিক' কথাটি 'ত্রিংশিকা'(ত্রিশূলবিশেষ) থেকে এসেছে। এই তিনটি শিকে বাস তিনটি দেবীর - পরাদেবী, পরাপরাদেবীঅপরাদেবীসিদ্ধিযোগেশ্বরীমত তন্ত্র, তন্ত্রসার, পরাত্রিংশিকা বিবরণ,   মালিনীবিজয়োত্তর আগম,  প্রভৃতি কাশ্মীর শৈব শাস্ত্র ঘাঁটলে আমরা এই তিনদেবীর স্বরূপ সম্পর্কে জানতে পারি। 


ষট্-চক্রের/নবচক্রের (গুরুচক্র, সোমচক্র, ললনাচক্র এসব ধরে) ধারণার উপরেও যে আরও ১২টির মতো সূক্ষ্ম স্তর রয়েছে (আজ্ঞাচক্রের উপরে) সেই ধারণা এবং 36 তত্ত্বের ধারণার পাশাপাশি তাঁরও উর্ধ্বে আরো সূক্ষ্ম তত্ত্বের ধারণা এবং তূরীয় অবস্থার উপরে তূরীয়াতীত অবস্থার ধারণা আমরা কাশ্মীর শৈব দর্শনে পেয়ে থাকি। প্রণব ওঁ-কার যে সপ্তঅঙ্গের বেশি অঙ্গ নিয়ে গঠিত সেই ধারণাও আমরা পেয়ে থাকি। 


ত্রিক দর্শন মতে, ত্রিংশিকার মূলদেশ প্রোথিত থাকে একদম মূলাধারে অর্থাৎ ভূমি তত্ত্বে। মহাপ্রেতরূপি সদাশিব/সাদাখ্য তত্ত্ব শায়িত রয়েছেন - আজ্ঞা চক্রের স্থানে। এই সদাশিব তত্ত্বের উপরের তত্ত্ব হল - বিন্দু। তাঁর উপরের তত্ত্বগুলি হল অর্ধচন্দ্র, রোধিনী/নিরোধিকা, নাদ, নাদান্ত, ব্রহ্মবিলশক্তিধাম, ব্যাপিনী, সমনা এবং উন্মনা। এগুলোই হল আসলে প্রণবের অব্যক্ত অঙ্গ/মাত্রা। তাছাড়া এসব এর মধ্যেও আরও সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম স্তর রয়েছে যেগুলি ষড়াধ্ব এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা একান্তই গুরুগম্য।


এই সমনা শক্তিকেই মহাকাল সংহিতার সংকলনকার - কালসংকর্ষনী কালিকা হিসেবে অভিহিত করে গেছেন। কেননা সমনা স্তর পর্যন্তই সময়ের শেষ সীমা। 


স্বচ্ছন্দ তন্ত্রে সংকলনকার বলে গেছেন ব্যাপিনী স্তর থেকে উন্মনা স্তর পর্যন্ত যাওয়ার ক্রম:-

(ব্যাপিনী/ব্যাপক/ব্যাপীশ)-- ব্যোমরূপ--অনন্তেশ--অনাথ--অনাশ্রিত--(অনাশ্রয়/উন্মনা)

[বিস্তারিত আলোচনা ও প্রত্যেকটির স্বরূপ সম্পূর্ণ গুরুগম্য ও শৈব পরম্পরায় সীমাবদ্ধতা]

এই উন্মনী স্তরই হল পরাশক্তি। এই পরাশক্তিরই তিনটি স্বরূপ ত্রিংশিকারূপে প্রকট হয় সেগুলি হল - পরাশক্তি(অঘোরাশক্তি), পরাপরাশক্তি(ঘোরাশক্তি) এবং অপরাশক্তি(ঘোরতরাশক্তি)। এই তিনটি শক্তিকে তিনটি দেবীর স্বরূপে ধ্যান করতে হয় যা সম্পূর্ণ গুরুগম্য (বিশদ জানতে পড়ুন সিদ্ধিযোগেশ্বরীমত তন্ত্র, মালিনী বিজয়োত্তর তন্ত্র এবং পরাত্রিংশিকাবিবৃতি)। 


👉দেবী পরাপরা থাকছেন রতিশেখর ভৈরবের উপর বিপরীতরতি অবস্থায়। তিনি ত্রিশূল এর ডান শৃঙ্গে থাকছেন। তিনি জ্ঞান শক্তির প্রতীক।

👉দেবী পরা থাকছেন সদ্ভাবভৈরবের উপর বিপরীতরতি অবস্থায়। তিনি ত্রিশূলের মধ্যম শৃঙ্গে থাকছেন। তিনি ইচ্ছা শক্তির প্রতীক।

👉দেবী অপরা থাকছেন নবাত্মাভৈরবের উপর বিপরীতরতিতে। তিনি ত্রিশূলের বাম শৃঙ্গে থাকছেন। তিনি ক্রিয়া শক্তির প্রতীক।


এই তিনটি শক্তির সম্মিলিত রূপ উন্মনীই হল সাক্ষাৎ Supreme Goddess/Absolute Consciousness/Shankari/Parvati/Universal Mother এবং তিনিই পরমেশ্বর পরমশিবের শক্তি। তাঁকেই‌‌ শাস্ত্রে মালিনী বলা হয়েছে। পরমশিব পরাভৈরব সকল তত্ত্বের অতীত অবস্থা। ব্রহ্মরন্ধ্রের সর্বোচ্চ স্থানে তিনি থাকছেন। 

কাশ্মীর শৈব ধারার এই অতীব গুরুগম্য গূঢ় তত্ত্বের আমার পক্ষে যতটা সম্ভব ব্যাখ্যা করা হল এবং অত্যন্ত সংক্ষেপিত ভাবে। কোথাও সামান্য ভুল, ত্রুটি হলে মার্জনা করবেন। 

নমঃ শিবায |

নমঃ শিবাযৈ |


👉লেখনীতে -  শ্রীঅভিনব নাথ মহাশয় (ISSGT) 

👉 প্রচারে - International Shiva Shakti Gyan Tirtha 


 (অনুলিপি একান্তই করতে ইচ্ছা হলে কোনো রকমের কাটছাঁট ছাড়াই পুরোটাই কপি করবেন)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত