পরমশিব এবং কালসংকর্ষণী কালিকা তত্ত্ব এবং শিব সম্পর্কিত যাবতীয় অপপ্রচারের জবাব -

 


ॐ গুরবে নমঃ |

ॐ পরভৈরবায় নমঃ‌ |

ॐ‌ নমঃ শিবায় |


পোস্টটির উদ্দ্যেশ্য

আজকাল বহু শাক্ত মতালম্বী মানুষকে দেখছি যে তারা প্রচার করছেন - কালসংকর্ষণী কালিকা হচ্ছেন পরমশিব পরাভৈরবেরও উর্ধ্বেকার তত্ত্ব। পরমশিব যদি 37 নং তত্ত্ব হন তাহলে কালসংকর্ষণী হচ্ছেন নাকি 38 নং তত্ত্ব। সুতরাং এসব গুজব বহুদিন ধরে সহ্য করার পরে আজ আবার কলম তুলে নিতে বাধ্য হলাম। ধন্যবাদ জানাই ISSGT কে আমার এই প্রতিবেদনকে সকলের সামনে তুলে ধরার জন্য। সুতরাং আলোচনা একদম গোড়া থেকে শুরু করা যাক। সুতরাং সকলে পুরো প্রবন্ধটি পড়বেন মন দিয়ে।


কাশ্মীর শৈব ধারা নিয়ে সম্যক ধারণা-

কালসংকর্ষণী সম্পর্কে জানার জন্য আমাদেরকে আগে জানতে হবে কাশ্মীর শৈব দর্শনের ধারা গুলির ব্যাপারে।

কাশ্মীর শৈব ধারা এর অন্তর্গত বিভিন্ন উপধারা গুলি হলো -


1. কুল/ কৌল ধারা -  

ইহা হল ভৈরব আম্নায় (শিবের 'যোগিনী বক্ত্র' কর্তৃক প্রকটিত কৌল মার্গিক ভৈরব স্রোত এর শৈব তন্ত্র , এদের অনুত্তর আম্নায় বলে), পূর্বাম্নায়, পশ্চিমাম্নায়, উত্তর আম্নায়, দক্ষিণাম্নায়, ঊর্ধ্বাম্নায়, পাতাল/রহস্যাম্নায় (অধঃআম্নায়) শৈব তন্ত্র ভিত্তিক শৈব কৌল পরম্পরা। আচার্য অভিনব গুপ্ত এবং আচার্য জয়রথ 'অর্ধত্র্যম্বক মঠিকা' অর্থাৎ ত্র্যম্বকনাথের কন্যাকে (মতান্তরে মাতামহী) এই ত্রিক কুলমতের প্রবর্তক মেনে গেছেন। শ্রীকণ্ঠনাথ শিব থেকে মহর্ষি দুর্বাসা হয়ে, ত্র্যম্বকাদিত্যের কাছ থেকে অর্ধত্র্যম্বক মঠিকা এই কৌলজ্ঞান প্রাপ্ত করেন। তবে কৌল শৈব ঘরানার আদি প্রবর্তক  প্রবর্তক দাদাগুরু মহাকৌল শ্রী মৎস্যেন্দ্রনাথজী ছিলেন, যিনি সাক্ষাৎ আদিনাথ শিব হতে কৌলজ্ঞান প্রাপ্ত করেন। 

[মীমাংসা করলে দেখা যায় যে‌, যিনি শ্রীকণ্ঠনাথ তিনিই আদিনাথ, পরম্পরা ভেদে তাঁর নামের পরিবর্তন হয়েছে মাত্র।] 

ত্রিক কৌল মতে দীক্ষিত ছিলেন সাক্ষাৎ অভিনবগুপ্ত, এই পরম্পরায় তাঁর গুরু ছিলেন- জালন্ধর পীঠবাসি শম্ভুনাথ। এই ধারার অন্তর্গত কুল গুলি হল - কালীকুল, শ্রীকুল, ত্রিককুল, ভৈরবকুল, বামাকুল, দক্ষিণাকুল, নেত্রকুল, কুব্জিকা কুল, যামল কুল, নিশাকুল, ইত্যাদি। এই ধারা থেকেই পরবর্তী কালে শাক্ত কৌল পরম্পরা গুলি এসেছে। যদিও অতিমার্গিক শৈব কাপালিক, কারুনিক, কালামুখ, লাকুল, কালানল প্রভৃতি শৈব পরম্পরাগুলি ত্রিক পরম্পরারও বহু আগে থেকে বিদ্যমান ছিল বলে পণ্ডিত মহলে বিতর্ক রয়েছে।


2. ক্রম ধারা - 

এই পরম্পরার উদ্ভাবক হলেন শ্রী শিবানন্দনাথ (মতান্তরে তাঁরও পূর্বে নিষ্ক্রিয়ানন্দনাথ)। বিশেষ কিছু ভৈরব স্রোতের শৈব আগম যেমন - ব্রহ্মযামল, জয়দ্রথযামল (শিরচ্ছেদ তন্ত্র বা তন্ত্ররাজ ভট্টারক), সাথে আরো কিছু শাস্ত্র যেমন - ক্রমকেলি, কালিকাক্রম, ক্রমরহস্য, ক্রমসদ্ভাব, স্বামী লক্ষ্মণজু রচিত‌ ক্রমন্যায় প্রদীপিকা, পরাত্রিংশিকা, বাতুলনাথ সূত্র, শিতিকণ্ঠাচার্যের মহান্যায়প্রকাশ, ক্রমস্তোত্র, মহার্থমঞ্জরী ইত্যাদি এর উপর এই ধারা প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই ধারারই মূল ভিত্তি হল দ্বাদশ কালী। এই ক্রম ঘরানা উত্তর আম্নায় এর মধ্যে পড়ে।


3. স্পন্দ ধারা - 

 এই ধারার প্রবর্তক ছিলেন শ্রী বসুগুপ্ত। এই ধারার মূল দর্শনগত শাস্ত্র হল- শিব সূত্র, শিবসূত্র‌ বিমর্শিণী, শিবসূত্র বৃত্তি, শিবসূত্র বিবৃতি,   স্পন্দকারিকা, স্পন্দ সন্দোহ, স্পন্দ প্রদীপিকা, স্পন্দ নির্ণয়, স্পন্দকারিকা বৃত্তি, স্পন্দকারিকা বিবৃতি, স্পন্দ সর্বস্ব ইত্যাদি।‌ সাথে‌‌ একাধিক উচ্চমার্গিক আগম (যেমন- নেত্র তন্ত্র/ মৃত্যুঞ্জয় ভট্টারক, স্বচ্ছন্দ তন্ত্র, বিজ্ঞান ভৈরব তন্ত্র, মালিনীবিজয়োত্তর তন্ত্র, মৃগেন্দ্র আগম, নিঃশ্বাস সংহিতা ইত্যাদি।)


4. প্রত্যভিজ্ঞা ধারা -  

সর্বাধুনিক এবং আগেকার সর্ব দর্শনের সার। আদি প্রবর্তক ছিলেন সোমানন্দপাদ এবং মূল স্তম্ভ ছিলেন আচার্য অভিনবগুপ্ত। এদের শাস্ত্র গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল - শিবসূত্র, শিব দৃষ্টি, ঈশ্বর প্রত্যভিজ্ঞা কারিকা, ঈশ্বর প্রত্যভিজ্ঞা বিমর্শিনি, ঈশ্বর প্রত্যভিজ্ঞা বিবৃতি বিমর্শিনি ইত্যাদি। সাথে‌‌ একাধিক উচ্চমার্গিক আগম (যেমন- নেত্র তন্ত্র/ মৃত্যুঞ্জয় ভট্টারক, স্বচ্ছন্দ তন্ত্র, বিজ্ঞানভৈরব তন্ত্র, মালিনী বিজয়োত্তর তন্ত্র, মৃগেন্দ্র আগম, নিঃশ্বাস সংহিতা ইত্যাদি।)

(👉সুতরাং বোঝা গেল যে ত্রিক দর্শনের শাস্ত্র তিন প্রকারের , যথা - আগমশাস্ত্র, স্পন্দশাস্ত্রপ্রত্যভিজ্ঞা শাস্ত্র)


দ্বাদশ কালী এবং কালসংকর্ষণী -

উপরে উল্লেখিত ক্রম পরম্পরায় দ্বাদশ কালীর উল্লেখ মেলে। যার উল্লেখ আচার্য অভিনব গুপ্তের তন্ত্রালোকেও পাওয়া যায়। স্বামী লক্ষ্মণজু সহ একাধিক শৈব আচার্য যেই মতকে সমর্থন করে গেছেন, কেননা পরমেশ্বর শিবের শক্তিও শৈব দের কাছে সমান ভাবে গুরুত্বপূর্ণ । এই দ্বাদশ কালী হলেন যথাক্রমে -- 


1. সৃষ্টি কালী,

2. রক্ত কালী 

3. স্থিতিনাশ কালী

4. যমকালী

5.সংহার কালী

6. মৃত্যু কালী  

7. রুদ্র কালী তা আর উল্লেখ হলো না।)

8. মার্তণ্ড কালী

9. পরমার্ক কালী

10. কালাগ্নি রুদ্র কালী

11. মহাকাল কালী

12. মহাভৈরবঘোরচণ্ড কালী -  সর্বোচ্চ অবস্থা। ইনিই আসলে কালসংকর্ষণী তত্ত্ব। এই কালসংকর্ষণীই দ্বাদশ কালিকা এর স্বরূপ ধারণ করে জগৎ চরাচর এর সৃষ্টি, পালন, সংহার করে থাকেন।

(👉দ্বাদশ কালিকা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা পরবর্তীতে করা হবে)                       

সুতরাং বলা যায় যে, এই দ্বাদশ কালিকার সূত্রকে যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন তিনিই কালসংকর্ষণী, তিনি নিরাকারা। তিনি কালচক্রের প্রবাহকে গতিমান করেন আবার নিজের মধ্যে গুটিয়ে নেন, অর্থাৎ কালের সংকর্ষণ করেন জন্য তাঁর নাম কালসংকর্ষিণী । উত্তর কৌল শাক্ত ধারার আরাধ্যা গুহ্য কালিকার ঊর্ধ্বতম মুখটিকে অনেকসময় কালসংকর্ষণী কালিকা হিসেবে ধরা হয়, অর্থাৎ এই কালসংকর্ষণী হলেন সর্বোচ্চ কালিকা তত্ত্ব। কাশ্মীর কালীক্রম পরম্পরার সর্বোচ্চ আরাধ্যা হলেন ইনিই। তিনি নিরাকারা। এই পরাশক্তি/ আদ্যাশক্তিই পরা, পরাপরা এবং অপরা দেবী হিসেবে আত্ম প্রকাশ করেন , এই তিন দেবীই‌ ত্রিশিকার/ত্রিশূলের অগ্রভাগে অবস্থান করেন। তাই ত্রিক কুলের এই তিন দেবীর উর্ধ্বে অবস্থান করেন কালসংকর্ষিণী। তাঁরই অপর নাম মালিনী

এই কালসংকর্ষণী কালিকা হলেন নির্গুনা শক্তি। তাহলে সেই শক্তিকে ধারণকারী কে সেই অদ্বৈত পরমেশ্বর?? কে সেই নির্গুণ পরম ব্রহ্ম?  

উত্তর একটাই, তিনি সাক্ষাৎ পরমেশ্বর পরমশিব। অনুত্তর ভট্টারক পরমশিবের উর্ধ্বে কোনো কোনো তত্ত্ব নেই, তিনিই অনুত্তর তত্ত্ব। তাঁরই নিজা শক্তি অথবা পরাশক্তিকেই কালিক্রম পরম্পরায় কালসংকর্ষণী কালিকা রূপে আরাধনা করা হয় । 

কাশ্মীর শৈব সাধক, আচার্য স্বামী লক্ষ্মঞ্জু বলেছেন -

"এই কালসংকর্ষনী কালিই মহাকালী স্বরূপে শিবের বুকে নৃত্য করে চলেছেন" ।


মূল সমস্যা-

এখন আমরা যদি পারমার্থিক অবস্থায় পরাশক্তি কে পরমশিবের থেকে অভিন্ন মনে করি, তাহলে এই কালসংকর্ষিণী কালিকা হলেন নির্গুনা শক্তি। তাহলে কালসংকর্ষণী কালিকা আর পরভৈরব (অনুত্তর ভট্টারক বা পরম শিব) তত্ত্বকে এক মানা যেতেই পারে। কিন্তু, আজকালকার বহু ব্যক্তি কালসংকর্ষণী কালিকা তত্ত্ব কে পরভৈরব তত্ত্বের উপরে বলে গুজব রটাচ্ছেন, যে মত শ্রুতিশাস্ত্রের জ্ঞানকাণ্ডের বিরোধী। তাই আমরা শাস্ত্র থেকে প্রমাণ করবো যে, পরমেশ্বর শিবের উর্ধ্বে কোনো তত্ত্ব নেই।

অনুত্তরতত্ত্ব পরমশিব(‌পরভৈরব) আর কালসংকর্ষণী এর মধ্যে সম্পর্ক নিরূপণ শাস্ত্র থেকে -

আচার্য অভিনবগুপ্ত তাঁর 'তন্ত্রসার' গ্রন্থের চতুর্থ‌‌ অধ্যায়ে স্পষ্টভাবেই বলেছেন -

" তত্র‌ পরমেশ্বরঃ পূর্ণসম্মিৎস্বভাবঃ, পূর্ণতৈব‌ অস্য‌ ‌শক্তিঃ‌ কুলং সামর্থ্যং‌‌ ঊর্মিঃ‌ হৃদয়ং‌‌ সারং স্পন্দঃ‌ বিভূতিঃ ত্রিশিকা কালী কর্ষিণী চণ্ডী‌ বাণী.....তেন‌ তেন রূপেণ ধ্যায়িনাং হৃদি আস্তাম্‌ ইতি | ‌সা চ সমগ্রশক্তিতা দর্শনেন পূর্ণতাসম্বিৎ প্রকাশতে | শক্তয়শ্চ অস্য অসংখ্যেয়াঃ | কিং বহুনা, যৎ বিশ্বং তা অস্য শক্তয়ঃ..... অবিকল্পসংবিন্মাত্ররুপতয়া বিভর্তি চ পশ্যতি চ ভাসয়তি চ পরমেশ্বরঃ সা‌‌ অস্য শ্রীপরাশক্তিঃ | যয়া চ‌‌ দর্পণ হস্ত্যাদিবৎ ভেদাভেদাভ্যাং সা‌‌ অস্য শ্রীপরাপরাশক্তি। যয়া পরস্পরবিবিক্তাত্মনা ভেদেনৈব সা অস্য শ্রীমদপরাশক্তিঃ | এতৎ ত্রিবিধং যয়া ধারণম্ আত্ম্ন্যেব ক্রোড়ীকারেণ অনুসন্ধানাত্মনা গ্রসতে, সা‌ অস্য ভগবতী‌ শ্রীপরৈব শ্রীমন্মাতৃসদ্ভাব- কালকর্ষিণ্যাদিশব্দান্তরনিরুক্তা | তা এতাঃ চতস্রঃ শক্তয়ঃ স্বাতন্ত্র্যাৎ প্রত্যেকং‌ ত্রিধৈব.....সৃষ্টৌ,‌ স্থিতৌ, সংহারে চ ইতি‌ দ্বাদশ ভবন্তি‌ |

(মহামহেশ্বরাচার্য শ্রী অভিশবগুপ্ত‌‌ রচিত 'তন্ত্রসার'/ চতুর্থ আহ্নিক)

🔘 বঙ্গানুবাদ এবং‌ আচার্য পরমহংস মিশ্র কর্তৃক রচিত 'নীরক্ষীরবিবেক' টীকা - 

পরমেশ্বর (পরমশিব) সর্বদাই পূর্ণসম্বিত স্বভাব। তাঁর এই পূর্ণতাকেই শক্তি বলা হয়। (অর্থাৎ পরমেশ্বর যদি বিশেষ্য হন, পরাশক্তি হবেন তাঁর বিশেষণ।)

সেই শক্তিই কুল, সামর্থ্য, উর্মি, হৃদয়, সার, স্পন্দ, বিভূতি, ত্রিশিকা, কালী, কর্ষণী, চণ্ডী, বাণী, ভোগ, দৃক, নিত্য ইত্যাদি নামে অভিহিত হন। পরমেশ্বর পরমশিবের শক্তি অনন্ত। অর্থাৎ, পরমেশ্বর থেকে তার সেই এক পূর্ণসম্বিৎ সর্বশক্তি রূপে প্রকাশিত হয়। পরমেশ্বরের সেই শক্তিই এই সমগ্র বিশ্ব। 

👉পরমেশ্বর পরমশিব সদাশিব তত্ত্ব ( সাদাখ্য) থেকে পৃথিবী তত্ত্ব পর্যন্ত যে অবিকল্প শক্তির দ্বারা নিজেকে প্রসারিত করেন, ভাসিত করেন, অনুভব করেন, দর্শন করেন, সেই শক্তিই পরাশক্তি (পরা দেবী, ত্রিশূলের মধ্যমশৃঙ্গে অবস্থানকারিণী, সাক্ষাৎ ইচ্ছাশক্তি, ভৈরবসদ্ভাবের উপর অবস্থিতা)।

👉পরমশিবের যে শক্তির দ্বারা বিম্ব এবং দর্পণে সৃষ্ট প্রতিবিম্ব এর ন্যায় ভেদ -অভেদ (দ্বৈতাদ্বৈত) অবস্থার সূচনা হয় সেই শক্তির নামই পরাপরা শক্তি (পরাপরা দেবী, ত্রিশূলের ডানশৃঙ্গে অবস্থানকারিণী, সাক্ষাৎ জ্ঞানশক্তি, রতিশেখরভৈরবের উপর অবস্থিতা)।   

👉 পরমশিবের যে শক্তির প্রভাবে ব্রহ্ম এবং জগৎ এর মধ্যে ভেদ অবস্থা অনুভূত হয় তাঁর নাম অপরাশক্তি ( অপরা দেবী, ত্রিশূলের বামশৃঙ্গে অবস্থানকারিণী, সাক্ষাৎ ক্রিয়াশক্তি, নবাত্মা ভৈরবের উপর অবস্থিতা)

♦️ উপরিউক্ত এই তিন প্রকারের শক্তিকে যিনি এক সূত্রে ধারণ করে রাখেন তিনিই সেই পরমশিবের পরাভগবতী। তিনিই মাতৃসদ্ভাব এবং কালকর্ষণী‌ (অর্থাৎ কালসংকর্ষিণী) নাম‌ দ্বারা অভিহিত হন। শারদাতিলক তন্ত্রে ইনিই পরাবিন্দু হিসেবে অভিহিত হয়েছেন।

(মহা ডামরক যোগ অনুযায়ী এই পরাশক্তি  কালকর্ষণী‌   ত্রিশূলের‌ তিন শৃঙ্গে অবস্থিতা তিন দেবীরও উর্ধ্বে অবস্থান করেন। তাঁকে মালিনীও বলা হয়ে থাকে।) 

উপরে বর্ণিত পরা, পরাপরা, অপরা, মাতৃসদ্ভাব-কালকর্ষণী এই চার প্রকারের দেবী প্রত্যেকে তিন তিনটি করে অর্থাৎ সর্ব মোট 12 টি স্বরূপ ধারণ করেন সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয়ের নিমিত্তে। এই দ্বাদশ শক্তিস্বরূপই হল আসলে ক্রম দর্শনের দ্বাদশ কালিকা


মহাকাল সংহিতা ( শাক্ত তন্ত্র) এর কামকলা কালী খণ্ডের ভূমিকায় টীকাকার আচার্য শ্রী রাধেশ্যাম চতুর্বেদী বলছেন -- 

 " কালসংকর্ষণী কালীই পরমেশ্বর পরমশিবের সমনা শক্তি। নির্গুণ নিষ্ক্রিয় তূরীয়াতীত বিশ্বোত্তীর্ণ পরমশিব অবস্থায় এই সমনা শক্তিই উন্মনারূপে, মহাবিন্দু রূপে পরমশিবে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। "

(রেফারেন্স- মহাকাল সংহিতা/ কামকলাকালী খণ্ড, চৌখাম্বা সুরভারতী প্রকাশন, ভূমিকা অংশ)


কালসংকর্ষণী তত্ত্বের অবস্থান আমরা শাস্ত্র থেকে দেখে নিলাম। এবার শাস্ত্র দেখে নেব পরমশিব পরমভৈরব এর অবস্থান কোথায় -


শ্রীভৈরব উবাচ্ -

 " স্থূল সূক্ষ্ম পরশ্চৈব পরাতীতো নিরঞ্জনঃ || ব্যোমরূপস্বরূপেন সমনোন্মন এব চ | 

উন্মনাতীতো দেবেশি শিবো জ্ঞেয়ঃ শিবাগমে || ১৫ || "

[স্বচ্ছন্দ তন্ত্র ( কাশ্মীর শৈবতন্ত্র )/একাদশ পটল] 

অর্থ-  দেবেশি ! শিব হচ্ছেন একাধারে স্থূল , সূক্ষ্ম এবং পরম আবার অন্যদিকে তিনি এসবেরও অতীত অর্থাৎ পরমেরও অতীত পরাতীত । তিনিই নিরঞ্জন ব্রহ্ম । তিনি একাধারে ব্যোমরূপি অপরদিকে সমনারূপি ও উন্মনা রূপিও বটে । আবার তিনি সর্বোচ্চ স্তর উন্মনারও ঊর্ধ্বে । 

(কাশ্মীর শৈবতন্ত্র অনুযায়ী অনুগ্রহ কর্তা সদাশিবের উপরে বিন্দু , অর্ধচন্দ্র , রোধিনী , নাদ , নাদান্ত , শক্তি , ব্যাপিনী , সমনা -- এসবেরও উপরে সর্বোচ্চ স্তর হল -- উন্মনা স্তর , এই স্তরে এসেই আত্মার নির্বাণ লাভ ঘটে । তাঁর উর্ধ্বে রয়েছে মহাবিন্দু। পরমশিব পরাভৈরব এসবেরও উর্ধ্বে।)

 সুতরাং উন্মনা স্তরের উর্ধ্বে পরমশিব, একথা শাস্ত্র‌ থেকে  প্রমাণিত হয়ে গেল । সুতরাং একথা বলার অপেক্ষা থাকেনা যে শাস্ত্রগত ভাবে বিচার করলে পরমশিবের স্থান কালসংকর্ষণী পরাশক্তিতত্ত্বেরও উর্ধ্বে। আর পরমশিবই যে সাক্ষাৎ সেই অদ্বিতীয় তৎব্রহ্ম‌ সেই মতকে বেদান্ত আর বেদ শাস্ত্রও সমর্থন করে। আর শ্রুতি শাস্ত্রের মত সর্বোচ্চ।


তাছাড়া আচার্য‌ অভিনবগুপ্তের 'পরাত্রিংশিকা বিবৃতি' তে স্পষ্টভাবেই বলা আছে‌ যে-

" অমতীতি অমা,‌‌ অ-মা-ইতি, অবিদ্যমানং মা-মানং, নিষেধঃ নিত্যোদিব্যাৎ সংহারশ্চ যত্র‌‌ সা ভগবতী অমা ইতি উত্যতে | হৃদয়স্থা তু যা শক্তি কৌলিকী কুলনায়িকা ....

(পরাত্রিংশিকা বিবৃতি)

অর্থ- অমা অর্থাৎ অমাকলাই (ঊর্ধ্বকুণ্ডলিণী সপ্তদশীকলা)‌সাক্ষাৎ ভগবতী পরাশক্তির বাচক। হৃদয়াস্থিতা (পরমেশ্বরের) সেই শক্তিই কৌলিকী, কুলনায়িকা নামে‌ অভিহিত হন।

অর্থাৎ অভিনবগুপ্ত এখানেও স্পষ্ট করেছেন যে পরমেশ্বর পরমশিবের হৃদয়ে অবস্থিত শক্তিই পরাশক্তি , ঊর্ধ্বকুণ্ডলিণীস্বরূপা‌।


" শক্তয়শ্চ জগৎ সর্বং শক্তিমাংশ্চ মহেশ্বরঃ |

(তন্ত্রালোক/ জয়রথ বিবেক টীকা/৫/৪০)

- আচার্য অভিনব গুপ্তের তন্ত্রালোকের টীকতেও স্পষ্ট ভাবেই উল্লেখ রয়েছে যে শক্তির অধীশ্বর সাক্ষাৎ মহেশ্বর। এই উক্তি বেদান্ত সম্মতও বটে।


কাশ্মীর কালী ক্রম পরম্পরা এর শাস্ত্র মহান্যায় প্রকাশে শিতিকণ্ঠাচার্য নিজেই উল্লেখ করেছেন -


" যোহসৌ পরাপরঃ শান্তঃ শিবঃ সর্বগতো মহান্ অপ্রমেয় হ্যনন্তশ্চ ব্যাপী সর্বেশ্বরেশ্বর || তস্যাস্তি সহজা শক্তিঃ সর্বশক্তিমযি পরা | ইচ্ছাজ্ঞানক্রিয়াত্বেন সৈবৈকা বহুধা স্থিতা || "


রেফারেন্স - আমাবস্যাত্ৰিংশিকা (শ্রীশিতিকণ্ঠাচার্য বিরচিত 'মহান্যায়প্রকাশ' হতে সংগ্রহীত


👉 ভাবার্থ - যিনি (পরমেশ্বর পরমশিব) পর (পরম, ব্রহ্ম) ও অপর (পরম নন, অব্রহ্ম) উভয় স্বরূপ, যিনি শান্ত, শিব, (শান্তং শিবং অদ্বৈতং) সর্বগত (সর্বব্যাপী স ভগবান্ তস্মাৎ সর্বগতঃ শিব), যিনি মহান, অপ্রমেয়, অনন্ত (সত্যং জ্ঞানং অনন্তং ব্ৰহ্ম), সর্বব্যাপী, সকল ঈশ্বরদেরও ঈশ্বর (সর্বেশ্বরেশ্বর), সেই পরমেশ্বরের সহজা শক্তিই (নিজা শক্তি) সর্বশক্তির আঁধার, তিনিই পরাশক্তি। সেই পরাশক্তিই ইচ্ছা, জ্ঞান, ক্রিয়া ইত্যাদি বহু রূপে জগতে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন।


♦️ এ প্রসঙ্গে শ্রুতি বলছে -


পরাহস্য শক্তিবিবিধৈব শুয়তে স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্ৰিয়া চ || ৮ || " 

- (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/ ৬নং অধ্যায়)


👉 অর্থ - (সেই পরমেশ্বরের) পরাশক্তিই জ্ঞান, বল, ক্রিয়া ইত্যাদি বিবিধ প্রকারে বর্ণিত হয়েছে শাস্ত্রে।


কাশ্মীর কালী ক্রম পরম্পরা এর আচার্য মহেশ্বরানন্দ নিজেই বলেছেন-  

" স এব বিশ্বমেষিতুং জ্ঞাতুং কর্তৃং চোন্মুখো ভবন্ | শক্তিস্বভাবঃ কথিতো হৃদয়ত্রিকোণমধুমাংসলোল্লাসঃ ||

 (শ্রীমহেশ্বরানন্দ রচিত মহার্থমঞ্জরী / ১৪ নং শ্লোক )

অর্থ- তিনি ( পরমশিব ) যখন নিজের হৃদয়ের ইচ্ছা - জ্ঞান - ক্রিয়া রূপি ত্রিকোণের মাধুর্যমণ্ডিত উল্লাস দ্বারা নিজ হৃদয়ে স্থিত সূক্ষ্মরূপি জগতকে ঈক্ষণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তখন তিনিই শক্তিস্বভাব সম্পন্ন হন অর্থাৎ স্বয়ং শক্তি ( বিমর্শ ) হয়ে যান ।


কাশ্মীর কালী ক্রম ঘরানার একটি অন্যতম তন্ত্র জয়দ্রথ যামলে স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে যে --


 " সর্বজ্ঞং ব্যাপকং শান্তং শুদ্ধমব্যযমীশ্বরম্ || ২ || সম্পূর্ণমমলং তৃপ্তমমনস্কং নিরামযম্ | সূক্ষ্মং সর্বগতং স্বচ্চমবৰ্ণানমনাদিমম্ || ৩ প্রমাণাতীতসদ্ভাবং শক্তিমদ্ বিশ্বভৈরবম্ | ৪|"


কাশ্মীর ভৈরবান্নায় (অনুত্তরান্নায়-যোগিনী/সপ্তমান্নায়)/ বিদ্যাপীঠ/ শিরচ্ছেদ তন্ত্র/ 'জয়দ্রথ যামল' (তন্ত্ররাজ ভট্টারক) / ১ম ষটক/ কালসংকর্ষণী কল্প/ ১ম পটল


👉 ভাবার্থ - অনুত্তর ভট্টারক পরশিব (পরমব্রহ্ম) সর্বজ্ঞ ("সত্যং জ্ঞানং অনন্তং ব্রহ্ম") এবং সর্বব্যাপী ("সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম")। তিনি পূর্ণ, মলরহিত, সর্বদাই তৃপ্ত (জগদানন্দময়) এবং নিরাময়। তিনি শান্ত ("শান্তং শিবং অদ্বৈতং”), শুদ্ধ, অব্যয় ঈশ্বর। তিনি পরম সূক্ষ্ম, আবার তিনি সর্বগত ("সহস্রশীর্ষাঃ পুরুষঃ", "সর্বগত শিবঃ)। তিনি সৎ, আবার তাঁকে বর্ণ, শব্দ দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না (সৎ, অসৎ এরও অতীত), তিনি অনাদি। তিনি প্রমাণাতীত, তিনিই সর্বশক্তিমান (শক্তিসদ্ভাব)। তিনিই ব্যবহারিক পর্যাযে, বিশ্বময় অবস্থায় বিশ্বভৈরব-স্বরূপ অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বের ভরণপোষণকারী।


🔘 ব্রহ্মসূত্র শ্রীকর ভাষ্যে আচার্য শ্রীপতি পণ্ডিতারাধ্য স্পষ্টভাবেই বলছেন -


'সৃষ্টেঃ পূর্বং মহাদেবশক্তিসংকোচহেতুনা | " নির্গুণত্বেন শাস্ত্রেষু গীযতে তত্ত্ববেদিভিঃ || সৃষ্ট্যাদৌ পরমেশস্য শক্তেঃ প্রাচুর্যবৈভবাৎ | সর্বজ্ঞত্বাদিকল্যাণগুণবানিতি কীৰ্ততে || "

ব্রহ্মসূত্র/ শৈবাচাৰ্য্য শ্রীপতি পণ্ডিতারাধ্য রচিত শ্রীকরভাষ্য /১/৩/৭


👉 ব্যাখ্যা- সৃষ্টির পূর্বে মহাদেব সদাশিব তাঁর বিশ্বময় শক্তিকে নিজের অভ্যন্তরেই সংকুচিত করে নেন। সেই পরাশক্তি সূক্ষ্ম বিমর্শ চিৎ স্বরূপে শিবের হৃদয়েই সুপ্ত অবস্থায় বিদ্যমান থাকেন। এই অবস্থাকেই বিশ্বোত্তীর্ণ অবস্থা বলে, পরমশিব অবস্থা বলে। এই সূক্ষ্ম চিৎ শক্তি বিশিষ্ট পরমশিবই নির্গুণ, নিষ্ক্রিয়, নিষ্কল, নিরাকার ব্রহ্ম হিসেবে শাস্ত্রে তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের দ্বারা উল্লেখিত হয়েছে। সৃষ্টির আদিতে (প্রাক মুহূর্তে) সেই ব্রহ্ম পরমশিবের সৃষ্টি-ইচ্ছার দরুন পরমশিবে সুপ্ত সেই শক্তির স্ফূরণ ঘটে এবং তা পরা, পরাপরা এবং অপরা স্বরূপ ধারণ পূর্বক জগদাকারে প্রকাশ পায় এবং ব্রহ্ম পরমশিব কল্যাণ স্বরূপসগুণ ঈশ্বর পদ বাচ্য হন। এই ভাবেই পরমেশ্বর শিব বিশ্বোত্তীর্ণ অবস্থা থেকে বিশ্বময় অবস্থায় ভাসিত হন।


🔘 কালী কুলের অতিপ্রিয় শাক্ত তন্ত্র শক্তিসঙ্গম তন্ত্রও বলছে যে -


" স এব আদিনাথস্তু পরব্রহ্মেতি গীয়তে | সচ্চিদাত্মস্বরূপৈবং ব্রহ্মরূপা অথ নির্গুণা || ১১৪ || "


[ শক্তিসঙ্গম তন্ত্র (শাক্ত তন্ত্র)/ ছিন্নমস্তাখণ্ড/ পঞ্চমপটল ]


👉সেই আদিনাথ-ই (সদাশিব) পরমব্রহ্ম হিসেবে আখ্যায়িত হন


🔘 আচার্য ভাস্কররায় তাঁর বরিবস্যারহস্য এর 'প্রকাশ' ভাষ্যে স্পষ্টভাবেই বলছেন -


'পরমশিবঃ কামকলাস্বরুপনির্ণযাবসরে নিষ্কৃষ্য কথিতং ব্রহ্ম | " (বরি. র./২/৮২)


👉অর্থ - কামকলাস্বরূপ নির্ণয় প্রসঙ্গে সেই তৎ ব্রহ্ম-ই সাক্ষাৎ পরমশিব।


🔘 বাংলার কালী কুলের অতিপ্রিয় তন্ত্র মহানির্বাণ তন্ত্রেও একই কথার উল্লেখ মেলে --


'কারনং সর্বভূতানাংস এক পরমেশ্বরঃ ... || 80 || 

স এক এব সদ্রুপঃ সত্যোহদ্বৈতঃ পরাৎপরঃ | 

স্বপ্রকাশঃ সদাপূর্ণঃ সচ্চিদানন্দলক্ষণঃ || ৩৪ ||

ন করোতি ন চাশ্নাতি ন গচ্ছতি ন তিষ্ঠতি |

সত্যং জ্ঞানমনাদ্যন্ত - মবাত্মনসগোচরম্ || ২৮ || তস্যেচ্ছামাত্রমালম্ব্য ত্বং মহাযোগিনী পরা || 

করোসি পাসি হংস্যন্তে জগদেতচ্চরাচরম্ || ২৯ || এ্যক্ষারাত্মকতারেণ পরেশঃ প্রতিপাদ্যত || ২১৭ || বেদান্তরদ্যো ভগবান্ যত্তোচ্ছন্দপলক্ষিতং || ৪৫ || ”


(দ্বিতীয়োল্লাসঃ, চতুর্থোল্লাসঃ নবমোল্লাসঃ, মহানির্ব্বাণ তন্ত্রম্)


👉 সদাশিব বললেন- সর্বভূতের একমাত্র কারন সেই এক পরমেশ্বর। তিনি এক, অদ্বিতীয়, সত্য, সদরুপ, পরাৎপর, স্বপ্রকাশ, সর্বদাপূর্ণ ও সচ্চিদানন্দস্বরুপ । তিনি নিরাকার, নির্বিকল্প তিনি গুণাতীত, সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী, বিভু। তিনি সর্বব্যপী ভগবান। তিনি সনাতন, তিনি সর্বেন্দ্রিয় বর্জিত তিনিই বেদান্তবেদ্য ভগবান এবং যিনি যৎ তৎ শব্দ দ্বারা বোধিত হন। এ্যক্ষরাত্মক প্রণব দ্বারা সেই পরমেশ্বরই প্রতিপাদিত হন, তিনি কোনো কার্য করেন না, ভক্ষণ করেন না, গমন করেন না, তিনি সত্যস্বরুপ ও আদি - অন্তরহিত, বাক্য ও মনের অগোচর । তাঁর ইচ্ছা মাত্রই তুমি (অর্থাৎ পরাপ্রকৃতি আদ্যাশক্তি) এই জগৎ চরাচরকে সৃষ্টি করছ, পালন করছ ও অন্তে সংহার করছ ।


🔘 বেদান্তবেদ্য সেই পরমব্রহ্ম কে, সেই ব্যাপারে শাস্ত্র সরাসরি বলছে -


" সকলং নিষ্কলং চেতি স্বরুপদ্বযমস্তি মে | নান্যস্য কস্যচিত্তস্মাদন্যঃ সর্বোহপ্যনীশ্বরঃ || ৩০ || "


(শিবমহাপুরাণ/ বিদ্যেশ্বর সংহিতা/ নবম অধ্যায়)


👉 অর্থ - পরমেশ্বর শিব বললেন, সকল (সাকার) এবং নিষ্কল (নিরাকার) এই উভয় মূর্তি আমারই রয়েছে, অন্য কারো নেই। (তাই আমার অতিরিক্ত) অপর কেউই সাক্ষাৎ ঈশ্বর নন (অনীশ্বর)।


" অব্ৰহ্মত্বাত্তদন্যেষাং নিষ্কলত্বং ন হি ক্বচিৎ || ১৩ || তস্মাত্তে নিষ্কলে লিঙ্গে নারাধ্যন্তে সুরেশ্বরাঃ | অব্রহ্মত্বাচ্য জীবত্বাত্তথান্যে দেবতাগণাঃ || 14 || "


(শিবমহাপুরাণ/ বিদ্যেশ্বর সংহিতা/ পঞ্চম অধ্যায়)


👉অর্থ - শিব ব্যতীত ভিন্ন যারা দেবতা রয়েছেন, তাঁরা সাক্ষাৎ ব্ৰহ্ম নন, এই কারণেই তাঁদের কারোরই নিষ্কল লিঙ্গ স্বরূপে পূজা হয় না। অন্যান্য দেবগণ, সুরেশ্বরগণ সাক্ষাৎ ব্রহ্ম না হওয়ায়, বরং জীবতত্ত্ব হওয়ায়, তাঁদের শুধুমাত্র মূর্তিতে পূজা হয়, নিষ্কল লিঙ্গ স্বরূপে পূজা হয় না ।


সুতরাং ত্রিক শাস্ত্র‌ আর তন্ত্র‌ থেকে থেকে সম্পূর্ণরূপে‌ প্রমাণ করা হল যে - সাক্ষাৎ পরমশিবই‌ শক্তির স্বরূপ ধারণ করেন।‌ কোনো শক্তিই কখন‌ও পরমশিবের ঊর্ধ্বে‌ থাকতে পারে না, তা সে যে শক্তিই হউক না কেন। এখানে আমরা প্রকৃতপক্ষে শিব আর শক্তির মধ্যে ভেদাভেদ করছিনা, কিন্তু শাক্তবাদীদের বাড়বাড়ন্ত দেখে পোস্টটি আনতে বাধ্য হয়েছি। পরিশেষে একটি মাত্র কথা বলে আমার বক্তব্য শেষ করবো -


" আধারমাসনং প্রোক্তং আধেয়ঃ পরমশিবঃ |

নাদ লিঙ্গমিতি প্রোক্তং বিন্দুঃ পীঠমিতি স্মৃতম্‌ || ২১৭ 

ন শিবেন বিনা শক্তির্ন‌ শক্তয়া রহিত‌‌ শিবঃ | ২১৮

শিবশক্ত্যোশ্চ সংযোগাদন্যরূপং সমুদ্ভবম্ || ২১৯‌||"

(যোগজ আগম/ ক্রিয়াপাদ/ তৃতীয় পটল)


" শিবাদিক্ষিতিপর্যন্ত বিশ্বংবযুরুদঞ্চযন‌ |

পঞ্চকৃত্যমহানাট্যরসিকঃ ক্রীড়তি প্রভুঃ || ২ ||"

(কাশ্মীর শৈব শাস্ত্র অনুত্তর পঞ্চাশিকা)


অর্থ - ৩৬ তত্ত্বের প্রথম তত্ত্ব শিব তত্ত্ব থেকে অন্তিমতম তত্ত্ব ভূমি তত্ত্ব, এই ৩৬ তত্ত্বময় বিশ্বচরাচর সেই পঞ্চকৃত্যকারী পরমেশ্বর এর ক্রীড়ার দরুন সৃষ্টি হয়ে থাকে। এই জগৎ চরাচর নাটকের ন্যায় সেই পরমেশ্বর পরম প্রভু (শিব) এর মধ্যে চিত্রিত হয় মাত্র।


👉 লেখনীতে এবং তথ্য প্রদানে - শ্রী অভিনব নাথ‌ মহাশয় 

👉 সম্পাদনায় - RohitKumarChoudhury (ISSGT)

👉 প্রচারে - International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত