🚩শৈব অদ্বৈত দর্শন মতে ব্রহ্ম (পরমশিব) সূক্ষ্ম বিমর্শ পরাচিৎ শক্তি বিশিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও নির্গুণ -- কিভাবে?

অদ্বৈত বেদান্ত মতে শক্তি যুক্ত ব্রহ্ম মানে সে সগুণ (ঈশ্বর পদ বাচ্য) হবেই। কারণ ব্রহ্মশক্তিকে অদ্বৈত বেদান্ত মতে বলা হয় মায়া বা প্রকৃতি। এই অব্যক্ত জড় প্রকৃতি থেকে গুণ ক্ষোভের দরুণ সত্ত্ব, তম, রজ এই তিন গুণ প্রকাশিত হয়। তারপর সেই অব্যক্ত প্রকৃতি হতে সাংখ্যের বাকি তত্ত্ব গুলি অর্থাৎ মহৎ আদি তত্ত্ব, অন্তঃকরণ, পঞ্চতন্মাত্র, পঞ্চভূত এর উৎপত্তি হয় এবং সগুণ নিরাকার জীব সগুণ সাকার (কারণ শরীর----সূক্ষ্ম শরীর----স্থূল শরীর এই ক্রমে) দেহধারী স্বরূপ লাভ করে। তাই মায়া শক্তি যুক্ত ব্রহ্ম মানেই সে নির্গুণ নয়, সে গুণযুক্ত হবেই এবং ব্রহ্মের এই ঈশ্বর পদ বাচ্যতা স্বাভাবিক নয়, বরং ঔপাধিক। মূল সত্য সেই, নির্বিশেষ, শক্তিরহিত নির্গুণ, নির্বিশেষ ব্রহ্ম। তাই শিব বা রুদ্র বা সদাশিব হল সেই নিরাকার ব্রহ্মের একটি ঔপাধিক মিথ্যা রূপ মাত্র।

কিন্তু অদ্বৈত শৈব দর্শন মতে (৩৬ তত্ত্ব ভিত্তিক) প্রকৃতি তত্ত্বের উর্ধ্বে মায়া, আর মায়া তত্ত্বের অনেক উর্ধ্বে শক্তিতত্ত্ব আর এই সূক্ষ্ম চিৎশক্তি সম্পন্ন ব্রহ্ম পরমশিব তাই ত্রিগুণ এর অতীত, নির্গুণ এবং নিরাকারও। তাই অদ্বৈত শৈব দর্শনেও ব্রহ্ম নির্গুণ, নিরাকার কিন্তু বিমর্শময়ও বটে। কারণ গুণ তত্ত্বের সৃজন ঘটে অব্যক্ত প্রকৃতি স্তর থেকে। 

এ প্রসঙ্গে মহামান্য শৈব আচার্য শ্রীপতি পণ্ডিত আরাধ্য তাঁর ব্রহ্মসূত্র শ্রীকর ভাষ্যে বলছেন -

" সৃষ্টেঃ পূর্বং মহাদেবশক্তিসংকোচহেতুনা |
নির্গুণত্বেন শাস্ত্রেষু গীযতে তত্ত্ববেদিভিঃ ||
সৃষ্ট্যাদৌ পরমেশস্য শক্তেঃ প্রাচুর্যবৈভবাৎ | সর্বজ্ঞত্বাদিকল্যাণগুণবানিতি কীৰ্ততে || "

(ব্রহ্মসূত্র/ শৈবাচাৰ্য্য শ্রীপতি পণ্ডিতারাধ্য রচিত শ্রীকরভাষ্য /১/৩/৭)

👉 ভাষ্যানুবাদ ও মর্মার্থ বিশ্লেষণ -  

সৃষ্টির পূর্বে মহাদেব সদাশিব তাঁর বিশ্বময় শক্তিকে নিজের অভ্যন্তরেই সংকুচিত করে নেন। সেই পরাশক্তি সূক্ষ্ম বিমর্শ চিৎ স্বরূপে শিবের হৃদয়েই সুপ্ত অবস্থায় বিদ্যমান থাকেন। (এই অবস্থাকেই বিশ্বোত্তীর্ণ অবস্থা বলে, পরমশিব অবস্থা বলে।) এই সূক্ষ্ম চিৎ শক্তি বিশিষ্ট পরমশিবই নির্গুণ, নিষ্ক্রিয়, নিষ্কল, নিরাকার ব্রহ্ম হিসেবে শাস্ত্রে তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের দ্বারা উল্লেখিত হয়েছে। সৃষ্টির আদিতে (প্রাক মুহূর্তে) সেই ব্রহ্ম পরমশিবের সৃষ্টি-ইচ্ছার দরুন পরমশিবে সুপ্ত সেই শক্তির স্ফূরণ ঘটে এবং তা পরা, পরাপরা এবং অপরা স্বরূপ ধারণ পূর্বক জগদাকারে প্রকাশ পায় এবং ব্রহ্ম পরমশিব কল্যাণ স্বরূপসগুণ ঈশ্বর পদ বাচ্য হন। এই ভাবেই পরমেশ্বর শিব বিশ্বোত্তীর্ণ অবস্থা থেকে বিশ্বময় অবস্থায় ভাসিত হন।

এ প্রসঙ্গে জগৎগুরু  শ্রীকণ্ঠ (নীলকণ্ঠ) শিবাচার্য তাঁর ব্রহ্মসূত্র  ভাষ্যে  বলছেন -

" শক্তিঃ প্রথমসংভূতা শান্ত্যতীতপদোত্তরা |
ততো মায়া ততো অব্যক্তং শিবাৎ শক্তিমতঃ প্রভোঃ ||
ইত্যাদিনা মায়াদি প্রপঞ্চে শক্তিমতঃ শিবস্যৈবোপাদানত্বমবগম্যতে |
শক্ত্যাদি চ পৃথিব্যন্তং শিবতত্ত্বসমুদ্ভবম্ |
তেনৈকেন তু তদ্‌ ব্যাপ্তং মৃদা মৃদাকুম্ভাদিকং যথা
শিবস্যৈবোপাদানত্বমবগম্যতে |
ইত্যাদিনা তত্রৈব শিবেনোপাদানভূতেন জগদ্ব্যাপ্তম্ মৃদ্ধটাদিন্যায়েনা অবগম্যতে | "

(ব্রহ্মসূত্র / নীলকণ্ঠভাষ্য /২/২ /৩৮)

👉 ভাষ্যানুবাদ ও মর্মার্থ বিশ্লেষণ -

জগৎগুরু নীলকণ্ঠ শিবাচার্য বলছেন --  অব্যক্ত পরমশিব এর সিসৃক্ষা হেতু সর্বপ্রথম প্রকটিত (হৃদয় থেকে) হন শক্তি (অর্থাৎ পরাশক্তি)(ইহাই আগমে মহাবিন্দু বা পরাবিন্দু বা পরকুণ্ডলিনী পদ বাচ্য)। (প্রাচীন শৈবাচার্য শ্রীমায়িদেবের 'অনুভবসূত্র' মতে ইহাই আবার শান্ত্যতীত্তোরা পদ বাচ্য।)  এরপর এই  শক্তি/পরাশক্তি থেকে শান্ত্যতীত কলা  প্রকটিত হয়। এরপর ধীরে ধীরে সেখান হতে মায়া, (সাথে মায়ার পঞ্চ আবরণ/ কঞ্চুক),  অব্যক্ত প্রকৃতি ইত্যাদি বাকি তত্ত্ব গুলি সহ পুরো জগৎ প্রপঞ্চ প্রকটিত হয়।  সুতরাং পরশক্তি  থেকে পৃথিবী তত্ত্ব পর্যন্ত সব কিছু প্রকৃত পক্ষে সেই পরমশিবই (পরমশিবের বিশ্বময় অবস্থা)।  মাটির কোনো পাত্রে যেমন মাটি ব্যাপ্ত থাকে , তেমনি জগৎ চরাচরে উপাদান রূপে, শক্তিরূপে (মহাবিন্দু বা পরবিন্দুরূপে) সেই ব্রহ্ম পরশিবই ব্যাপ্ত রয়েছেন।

ব্রহ্ম শিব এইভাবেই জগতের উপাদান ও নিমিত্ত কারণ হচ্ছেন যা শ্রুতি ও মীমাংসা সম্মত মত। 

এই সম্পর্কে আচার্য অপ্পয় দীক্ষিত এবং শৈব আচার্য্য মুডিগোণ্ডা নাগালিঙ্গা শিবারাধ্য তাঁদের ব্রহ্মসূত্র নীলকণ্ঠভাষ্য টীকায় বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন । তাঁরা  লিখছেন  --

" সূক্ষ্মচিদ্রুপাপন্নচিচ্ছক্তিবিশিষ্ট সকলতত্ত্বাতীত শিব এক এব ... সিসৃক্ষো স্তস্মাৎপ্রথমং শিবতত্ত্ব-পরবিন্দু-পরমায়া-শুদ্ধমায়া-মহামায়া-কুটিলা-কুণ্ডলিন্যা শব্দালম্বনত্বন প্রসিদ্ধাশুদ্ধাধ্বগত সকলভুবনভোগস্যানভোগোপকরণানাং উপাদানভূতা পরাশক্তিরুৎপত্তে। তত শক্তি সদাশিবো মহেশ্বর শুদ্ধবিদ্যেতি ... তদনন্তর অপরামায়া মিশ্রাধ্বগত সকলতনুভুবনাদ্দুপাদানভূতা জায়তে। ততঃ কালো, নিয়তিঃ, কলা, বিদ্যা, রাগঃ পুরুষ ইতি‌ ষট্-তত্ত্বানি‌জায়ন্তে। তদনন্তরং অশুদ্ধাধ্বগত তনুভুবনাদ্দুপাদানভূতং অব্যক্তং আবির্ভবতি।...এবমেতানি পরশক্ত্যয়াদীনি পৃথিব্যন্তানি জড়ানি ষট্-ত্রিংশতত্ত্বানি শিবশাস্ত্রেষু প্রসিদ্ধানি।.... নিবৃত্তিঃ--- প্রতিষ্ঠা--- বিদ্যা--- শান্তি---- শান্ত্যতীতেতি সংজ্ঞাভিঃ প্রসিদ্ধাঃ ... পঞ্চকলা পরশক্তিপ্রভবাঃ। তত্র শতকোটিযোজনমিতব্রহ্মাণ্ডরূপং পৃথিবীতত্ত্বং নিবৃত্তিকলায়ামবতিষ্ঠতে। জলাদ্য-অব্যক্তানি ত্রয়োবিংশতিস্তত্ত্বানি প্রতিষ্ঠায়াং। পুরুষাদীনি মায়ান্তানি সপ্ততত্ত্বানি বিদ্যায়াম্। শুদ্ধবিদ্যামহেশ্বরশ্চ শান্তিকলায়াম্। পরশক্তিস্তু তত্ত্বান্তরাণান্ত... পঞ্চপিকলা ... তত উপর্যুপরিস্থিতা শান্ত্যতীত পদোত্তরা ভবতি....শক্তিশব্দেন শিবতত্ত্বরূপা পরাশক্তিরুচ্যতে। "

(ব্রহ্মসূত্র/ শ্রীকণ্ঠভাষ্য/ শিবাকর্মণিদীপিকা/অপ্পয় দীক্ষিত/২/২/৩৮ এবং  ব্রহ্মসূত্র/ শ্রীকণ্ঠভাষ্য/ শিবচিন্তামণিপ্রভা/ মুডিগোণ্ডা নাগালিঙ্গা শিবারাধ্য/২/২/৩৮)

👉  ভাষ্যানুবাদ ও মর্মার্থ বিশ্লেষণ - 

উপরিউক্ত বিষয়ের আরো বিস্তৃত ব্যাখ্যা পরম শৈব পণ্ডিত অপ্পয় দীক্ষিত এবং বিদগ্ধ শৈব বৈদান্তিক পণ্ডিত শিবযোগী মুডিগোণ্ডা নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী তাঁদের ব্রহ্মসূত্র শ্রীকণ্ঠভাষ্য টীকায় করেছেন। তাঁরা লিখছেন   ---

ব্রহ্ম পরশিব হলেন তত্ত্বাতীত এবং সূক্ষ্ম পরাচিৎশক্তি বিশিষ্ট। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর মধ্যে যখন সৃষ্টির ইচ্ছা জন্মায় তখন তাঁর থেকে প্রথমে শিবতত্ত্ব (অনাশ্রিত শিব) প্রকটিত হয়।

(অপ্পয়‌ দীক্ষিত এবং নাগালিঙ্গা শাস্ত্রী এই শিবতত্ত্বকেই পরবিন্দু বা পরামায়া বা শুদ্ধ মায়া বা কুণ্ডলিনী বা মহামায়া বা পরাশক্তি হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই পরাশক্তিই পরমশিবের প্রথম স্পন্দন স্বরূপিণী, তাই নাগলিঙ্গা শাস্ত্রী ও অপ্পয় দীক্ষিত উভয়ই এই পরাশক্তি-কে প্রথমতত্ত্ব শিবতত্ত্বের সাথে অভেদ হিসেবে মেনেছেন তাঁদের টীকায়। এই পরাশক্তি প্রকৃতপক্ষে অনাশ্রিত শিবতত্ত্বই।)

এই পরাশক্তি বা শিবতত্ত্ব থেকে এরপর দ্বিতীয় তত্ত্ব শক্তিতত্ত্ব আসে।  এর পর ধীরে ধীরে সেই শক্তি তত্ত্ব থেকে বাকি তত্ত্ব গুলি নিম্নোক্ত ক্রমে প্রকটিত হয় ---- যথা  সদাশিব তত্ত্ব (সাদাখ্য তত্ত্ব)--- মহেশ্বর------ শুদ্ধ বিদ্যা----- অপরা মায়া/মায়া ----- কাল, নিয়তি, কলা, বিদ্যা, রাগ (মায়ার পঞ্চ আবরণ বা কঞ্চুক) ----- অব্যক্ত প্রকৃতি এবং পুরুষ ---- তিনটি অন্তঃকর্ণ (মন, বুদ্ধি, অহংকার) ---- পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রীয় ----- পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় --- পঞ্চ তন্মমাত্র ---- পঞ্চ ভূত (পৃথিবী তত্ত্ব পর্যন্ত) = ৩৬ তত্ত্ব।

অপ্পয় দীক্ষিত এবং নাগালিঙ্গা শিবারাধ্যের মান্যতা অনুযায়ী -

নিবৃত্তি কলা - পৃথিবী তত্ত্ব
প্রতিষ্ঠা কলা - জল থেকে অব্যক্ত প্রকৃতি তত্ত্ব
বিদ্যা কলা - পুরুষ থেকে মায়া তত্ত্ব
শান্তি কলা- শুদ্ধ বিদ্যা থেকে মহেশ্বর
শান্ত্যতীত কলা - সদাশিব তত্ত্ব (সাদাখ্য), শক্তিতত্ত্ব
শান্ত্যতীত্তোরা কলা - শিবতত্ত্ব অথবা পরাশক্তি তত্ত্ব (সিসৃক্ষা)  আর পরমশিব হল সাক্ষাৎ কলাতীত।

💥♦️ সুতরাং ব্রহ্মের শক্তি ও মায়ার মধ্যে ব্যবহারিক ভেদ,  ব্রহ্মের মধ্যে সূক্ষ্ম শক্তির উপস্থিতি এবং সেই  শক্তির সাথে ব্রহ্মের অভেদত্ব প্রাচীন শৈব আচার্যগণের মান্যতার নিরিখে প্রমাণিত হল।

শুধু আচার্যদের সিদ্ধান্তে নয় এই প্রমাণের মান্যতা সাক্ষাৎ শ্রুতিসার শিবমহাপুরাণ হতেও সিদ্ধ করা যায় -

" শক্তিঃ প্রথমসংভূতা শান্ত্যতীতপদোত্তরা |
ততো মায়া ততো অব্যক্তং শিবাৎ শক্তিমতঃ প্রভোঃ || ৩ ||
শান্ত্যতীতপদং শক্তেস্ততঃ শান্তিপদং ক্রমাৎ |
ততো বিদ্যাপদং তস্মাৎপ্রতিষ্ঠাপদসম্ভবঃ || ৪ ||
নিবৃত্তিপদমুৎপন্নং প্রতিষ্ঠাপদতঃ ক্রমাৎ |
এবমুক্তা সমাসেন সৃষ্টিরীশ্বরচোদিতা || ৫ || "

(শিবমহাপুরাণ/ বাযবীয় সংহিতা/ পূর্বখণ্ড/ ৯ নং অধ্যায়)

শ্রীমৎভগবদ্গীতা-তেও পরমেশ্বর বলছেন -  

"অপরেযমিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বৃদ্ধি মে পরাম্ | 

জীবভূতাং মহাবাহো যযেদং ধাৰ্য্যতে জগৎ || ৫ ||"

(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা/সপ্তম অধ্যায়)

👉 অর্থ-    আমার (পরমেশ্বরের) অষ্টধাজড়প্রকৃতির (পঞ্চভূত + তিনটি অন্তঃকর্ণ) চেয়েও উর্ধ্বে আরও একটি সূক্ষ্মপ্রকৃতি আছে তাঁর নাম পরাপ্রকৃতি। এই পরাপ্রকৃতিই হল 'জীবভূতাং' অর্থাৎ সাক্ষাৎ জীবের আত্মস্বরূপ (Individual Self)। এই পরাপ্রকৃতিই জীব সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ। এই পরাপ্রকৃতিই জগতকে ধারণ করে আছেন।

👉 মহামহেশ্বরাচার্য   শ্রীঅভিনবগুপ্ত ভাষ্য -

" सा चैकैव सती प्रकाराष्टकेन भिद्यते इति एकप्रकृत्यारब्धत्वादेकमेव विश्वमिति प्रकृतिवादेऽप्यद्वैतं प्रदर्शितम्। सैव जीवत्वं - पुरुषत्वं प्राप्ता परा ममैव नान्यस्य च। सोभयरूपा वेद्यवेदकात्मकप्रपञ्चोपरचनविचित्रा ॥ ५ ॥

(গীতাৰ্থ সংগ্রহ/সপ্তম অধ্যায় )

👉 আচার্যা গুরুমা শ্রীপ্রভাদেবী কৃত অনুবাদ ও ব্যাখ্যা - 

সেই এক সূক্ষ্ম পরাপ্রকৃতিই অষ্টধাজড় প্রকৃতি স্বরূপে ব্যবহারিক পর্যায়ে ভাসিত হন (পরাশক্তিরই একটি ব্যবহারিক স্বরূপ অপরা শক্তি)। সুতরাং বলা যায় পরমেশ্বরের সাথে অভিন্না ব্রহ্মবিদ্যা স্বরূপা সেই এক পরাপ্রকৃতি থেকেই বিশ্বপ্রপঞ্চের সৃষ্টি হয়েছে, তাই এই বিশ্বও সাক্ষাৎ শিব। এভাবেই প্রকৃতিবাদ বা সাংখ্যমতও সেই অদ্বৈত (শিবাদ্বয়) এরই প্রতিপাদক। পরমেশ্বরের সাথে অভিন্না এই পরাপ্রকৃতিই জীবভাব (জীবাত্মা) অর্থাৎ পুরুষ তত্ত্ব প্রাপ্ত হন আবার তিনিই অপরা প্রকৃতি (জড়) স্বরূপ  ধারণ করেন। এই পরাপ্রকৃতি উভয়াত্মিকা (অর্থাৎ প্রকৃতি-পুরুষাত্মিকা) [এই কারণেই দেবী অথর্বশীর্ষ শ্রুতিতে দেবী বলছেন - “ মত্তঃ প্রকৃতিপুরুষাত্মকং জগত্ |” - অথর্ব্ববেদীয় দেব্যাথৰ্বশীৰ্ষম্/২] এবং বেদ্য (জ্ঞেয়) বেদকাত্মক (জ্ঞাতা) এই জগৎ প্রপঞ্চ সৃ্ষ্টির মূল কারণ। 

অদ্বৈত বেদান্ত মতে ব্রহ্ম শুধু মাত্র সৎ-চিৎ-আনন্দ লক্ষণযুক্ত। ইচ্ছা, জ্ঞান এবং ক্রিয়া জীবের লক্ষণ, ব্রহ্ম এর নয়। কিন্তু অদ্বৈত শৈব দর্শন মতে ব্রহ্ম - সৎ-চিৎ-আনন্দ-ইচ্ছা-জ্ঞান-ক্রিয়া ময়। ইচ্ছা অর্থাৎ সিসৃক্ষা, জগৎ আকারে প্রকাশিত হওয়ার ইচ্ছা, যা " একো অহং বহু স্যাং " প্রভৃতি শ্রুতি দ্বারা সিদ্ধ। পরমশিব জ্ঞান স্বরূপ - " সত্যং জ্ঞানং অনন্তং ব্রহ্ম "। জগদাকারে প্রকাশ হওয়ার সক্ষমতা কেই ক্রিয়া বলা হয়। অদ্বৈত শৈব দর্শন মতে পরমেশ্বর স্বতন্ত্র, জগৎ সৃষ্টির জন্য অদ্বৈত বেদান্তের ন্যায় তাঁকে কারো অপেক্ষা করতে হয়না।  তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে -

" জগচ্চিত্রং সমালিখ্য স্বেচ্ছাতুলিকযাত্মনি |

স্বযমেব সমালোক্য  প্রীণাতি ভগবান শিবঃ || "

(যোগিনী হৃদয় দীপিকা)

👉 অর্থ - পরমেশ্বর ভগবান শিবের স্বাতন্ত্র্য শক্তিই (ইচ্ছা শক্তিরুমা কুমারী- শিবসূত্র) তুলিকা স্বরূপা। এই তুলিকা স্বরূপিণী ইচ্ছাশক্তির দ্বারা পরমেশ্বর শিব নিজের মধ্যেই (বিমর্শ হৃদয় দর্পণে) জগৎ সংসারকে চিত্রিত করেন এবং নিজেই সেই চিত্র দেখে প্রসন্ন হন। তিনি সর্বদাই আত্ম স্বরূপে প্রসন্ন চিত্তে বিচরণ করেন। তাই এই  জগৎ আনন্দময় (অহং - রূপি)।

পরমেশ্বরের এই স্বাতন্ত্র্যতা-কেই অর্থাৎ ইচ্ছাকেই শক্তি বলা হয়, যা "ইচ্ছা শক্তিরুমা কুমারী" ইত্যাদি শিববাক্য (শিবসূত্র অর্থাৎ সাক্ষাৎ শ্রুতি) দ্বারা প্রতিপাদিত হয়েছে  অথবা  "ইমাংল্লোকান্ ঈশত ঈশনীভিঃ " (শ্বেতাঃ .৩.২)
--- (পরমেশ্বর) রুদ্রই  নিজ (ঈশানী) শক্তির দ্বারা নিখিল বিশ্বজগৎ নিয়ন্ত্রিত করেন , অথবা " পরাঽস্য শক্তিবিবিধৈব শুয়তে স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্ৰিয়া চ || ৮ || " - (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/ ৬নং অধ্যায়) --- (সেই পরমেশ্বরের) পরাশক্তিই জ্ঞান, বল, ক্রিয়া ইত্যাদি বিবিধ প্রকারে বর্ণিত হয়েছে শাস্ত্রে। -- প্রভৃতি শ্রুতি দ্বারা যা সিদ্ধ। সুতরাং অদ্বৈত শৈব দর্শনে পরমেশ্বরের স্বাতন্ত্র্যবাদ স্বীকৃত,  যা অদ্বৈত বেদান্তে স্বীকার্য নয়।

প্রকাশ-বিমর্শময় নির্গুণ পরমব্রহ্মের ইচ্ছা শক্তি স্বরূপা এই বিমর্শময়ী স্বাতন্ত্র্য শক্তিই পরাচিৎ অথবা প্রত্যবমর্শাত্মা  হিসেবে অদ্বৈত শৈব দর্শনে উক্ত হয়েছে -

" চিতিঃ প্রত্যবমর্শাত্মা পরাবাস্বরসোদিতা | স্বাতন্ত্র্যমেতমুখ্যং তদৈশ্চর্যং পরমাত্মনঃ || ১৩ || "

(মহামান্য ত্রিকাচার্য শ্রী উৎপলদেব রচিত ঈশ্বর-প্রত্যভিজ্ঞা-কারিকা / প্রথম খণ্ড / জ্ঞানাধিকার/৫ম অধ্যায়)

👉 অর্থ - চিতি বা আত্ম-চেতনাশক্তি সর্বদাই পরমানন্দ স্বরূপ। সেই সর্বোচ্চ চৈতন্যরূপি পরমাত্মার স্বাতন্ত্র্যই 'পরাবাক' নামে অভিহিত হন, যা সর্বদা স্বতন্ত্র ও ঐশ্বর্যশালী।  এই সচ্চিদানন্দ পরমশিব সর্বদাই নিজের শক্তির সম্পর্কে জ্ঞাত থাকেন যারা দ্বারা তিনি সৃষ্টি, স্থিতি, লয়ের অসীম খেলায় মত্ত।

এই পরাচিতিই  ব্রহ্মের সিসৃক্ষার দরুন তাঁর হৃদয় থেকে অনুলোম ক্রমে স্ফুরিত (বিন্দু- পরা- পরাপরা- অপরা এই ক্রমে )হয় এবং সেই চিতিই পারমার্থিক অবস্থায় সেই ব্রহ্মেই সূক্ষ্ম বিমর্শ হৃদয় স্বরূপে নিহিত থাকে, যা একাধিক প্রাচীন অদ্বৈত শৈব আচার্যদের দ্বারা মান্যতাপ্রাপ্ত ---

" সা স্ফুরত্তা মহাসত্তা দেশকালবিশেষিণী |
সৈষা সারতযা প্রোক্তা হৃদযং পরমেষ্ঠিন " || ১৪ ||

(ভগবান অভিনবগুপ্ত রচিত ঈশ্বর প্রত্যভিজ্ঞা বিমর্শিনি/১/৫/১৪)

" বিশ্বাত্মিকাং তদুত্তীর্ণাং হৃদয়ং পরমেশিতুঃ |
পরাদি শক্তি রূপেন স্ফুরন্তীং সম্বিদং নুমঃ || ১ || "

(মহামহেশ্বরাচার্য শ্রীক্ষেমরাজ রচিত পরাপ্রবেশিকা)

শক্তিসূত্রেও একই বিষয় ব্যক্ত রয়েছে --

" চিতিরেব চেতনপদাৎ অবরুঢ়া চৈত্যসঙ্কোচিনী চিত্তম্ " -- (শক্তিসূত্র) 

👉 অর্থাৎ  চেতনপদ (অর্থাৎ ব্রহ্ম বা পরশিব পদ) থেকে অবতীর্ণ সঙ্কুচিত (ষট্-কঞ্চুক দ্বারা) পরাচিতি বা পরাশক্তিই চিত্ত পদ বাচ্য।

ব্রহ্ম পরমশিব যে কদাপি শক্তিরহিত হননা এই একই সিদ্ধান্তের সমর্থন প্রত্যভিজ্ঞাচার্য ভগবান শ্রীসোমানন্দপাদ (8th C.E) তাঁর শিবদৃষ্টি-তে (ত্রিক সম্প্রদায়ের ন্যায়প্রস্থান তূল্য) করে গিয়েছেন --

" ন শিবঃ শক্তিরহিতো ন শক্তির্ব্যতিরেকিণী || ২ ||"  (শিবদৃষ্টি/তৃতীয়মাহ্নিক)

আদি জগৎগুরু রেণুকাভগবৎপাদাচার্য তাই স্পষ্টভাবেই তাঁর সিদ্ধান্তশিখামণি-তে বলছেন -

" যথা চন্দ্রে স্থিরা জ্যোৎস্না নিত্যবস্তুপ্রকাশিনী |
তথা শক্তির্বিমর্শাখ্যা প্রকাশে ব্রহ্মণি স্থিরা " ||

(সিদ্ধান্তশিখামণি/২০/৩৮)

👉 অর্থ - যে রূপ জগতকে আলো প্রদায়িনি চন্দ্রিমা চন্দ্রে স্থিত থাকে, ঠিক সেই রূপ সমস্ত বস্তুর প্রকাশিকা সেই বিমর্শ পরাচিৎ শক্তি ব্রহ্ম পরশিবেই (সূক্ষ্মভাবে) স্থিতা।

ব্রহ্মসূত্র শ্রীকর ভাষ্যের ১.১.৩ নং সূত্রের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শ্রীপতিপণ্ডিত আরাধ্য আরো বলছেন -

" বিমর্শরূপিণী শক্তিঃ শিবস্য পরমাত্মনঃ "

মহামান্য শৈব আচার্য উমচিগিশঙ্কর শাস্ত্রী তাঁর ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যের ১.১.১৯ নং সূত্রের ভাষ্য প্রসঙ্গে তাই বলছেন -

" ইচ্ছা ত্বেকা বিভোঃ শক্তিঃ প্রাগ্ভিধাজ্ঞক্রিযাবিধা..... ইচ্ছাত্বং সিসৃক্ষোঃ প্রতিপাদ্যতে " ||

👉 অর্থাৎ বিভু অর্থাৎ পরমশিবের সিসৃক্ষা ইচ্ছাই শক্তিপদ বাচ্য।

এ প্রসঙ্গে শ্রুতিসার শিবমহাপুরাণ স্পষ্টভাবেই বলছে -

" শক্তিরাজ্ঞা পরা শৈবী চিদ্রুপা পরমেশ্বরী | শিবোহধিতিষ্ঠত্যখিলং যয়া কারণভূতয়া || ২৮ ||
স তয়ৈব গৃহী সাপি তেনৈব গৃহিণী সদা |...৩ ||
প্রভেব ভানোশ্চিদ্রুপা ভিন্নেবেতি ব্যবস্থিতিঃ |
তস্মাচ্ছিবঃ পরো হেতুস্তস্যাজ্ঞা পরমেশ্বরী || ৩৪ ||
তয়ৈব প্রেরিতা শৈবী মূলপ্রকৃতিরব্যয়া |
মহামায়া চ মায়া চ প্রকৃতিন্ত্রিগুণোতি চ || ৩৫ || "

(শিবমহাপুরাণ/ বায়বীয়সংহিতা/পূর্বখণ্ড/ ২৯ নং অধ্যায়)

👉 অর্থ - পরমেশ্বর শিবের(সৎ) চিৎরূপিণী যিনি পরাশক্তি আছেন তিনিই পরমেশ্বরী এবং আজ্ঞা নামে অভিহিতা হন। সেই কারণরূপা পরাশক্তির সাথে সংযোগে শিব সমগ্র অখিল জগতের অধিষ্ঠাতা হন (অর্থাৎ সাকার ঈশ্বর পদ বাচ্য হন)। সেই শক্তির সাথেই শিব সদা গৃহস্থ জীবনযাপন করছেন এবং সেই শক্তিই শিবের গৃহিণী (অর্থাৎ মা পার্বতী, সাকারে)। যেমনটা প্রভা সূর্যের থেকে অভিন্না ঠিক সেরকমই সেই পরমেশ্বরী পরাশক্তিও শিবের থেকে অভিন্না। শিবের এই মূলাপ্রকৃতিরূপিণী শক্তিই শিব কর্তৃক প্রেরিতা হয়ে - মহামায়া, মায়া এবং ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিরূপে স্থিতা হন।

মহামহেশ্বরাচার্য ভগবান অভিনবগুপ্ত এর শিষ্য  আচার্য ক্ষেমরাজ তাই বলছেন -

" যথা ন্যগ্রোধ বীজস্থঃ শক্তি রূপো মহাদ্রুমঃ |
তথা হৃদয বীজস্থং বিশ্বমেতচ্চরাচরম্ || ২|| "

(পরাপ্রবেশিকা/কাশ্মীর শৈবাচার্য শ্রীক্ষেমরাজ)

👉অর্থ - যেরূপ একটি বৃহৎ বৃক্ষ একটি ক্ষুদ্রবীজের মধ্যে নিহিত থাকে ঠিক সেরূপ এই বিশ্ব চরাচরও পরমেশ্বর পরমশিবের চিদাকাশরূপি হৃদয়বীজ মধ্যে শক্তিরূপে বিদ্যমান থাকে। পরমেশ্বরের বিমর্শরূপিণী সেই হৃদয় থেকেই শক্তির স্ফুরণ ঘটে এবং সেই চৈতন্যশক্তিই জগদাকারে প্রকাশ পায়।

👉সিদ্ধান্ত - 

এই বিমর্শ শক্তি না থাকলে, ব্রহ্মে সিসৃক্ষাই জন্মাতো না, তাহলে জগৎ সৃষ্টিই হত না কদাপি, কালীও শিবের বুকে আর নৃত্য করতেন না।  আর পারমার্থিক অবস্থায় শক্তি যদি ব্রহ্ম এর থেকে ভিন্না হন তাহলে " সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম ", " ঈশবাস্যমিদং সর্বং ", " একো হি রুদ্রঃ ", " সর্ব বৈ রুদ্র " , " পরংব্রহ্মপুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলম্ ", "  উমাসহাযং ", " অম্বিকা পতয়ে ", " উমাপতযে" প্রভৃতি শ্রুতি বাক্যগুলি দোষযুক্ত হয়ে পড়বে।

এই সূক্ষ্ম পরা চিৎশক্তির থেকেই মায়া তত্ত্ব আসে। সেই মায়ার দ্বারাই ব্রহ্ম সগুণ হন । ব্রহ্মকে শক্তি বা মায়ার সাথে নতুন করে যুক্ত হতে হচ্ছে জগৎ সৃষ্টির নিমিত্তে, এমনটা নয়, কারণ ব্রহ্ম নির্গুণ হওয়া সত্ত্বেও সূক্ষ্ম পরাচিৎ শক্তি বিশিষ্ট, যা মায়া তত্ত্বের উর্ধ্বে অবস্থিতা। 

সুতরাং ব্রহ্ম পরমশিব সূক্ষ্ম শক্তিবিশিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে নির্গুণ, নিরঞ্জন, নিষ্কল, নিরাকার সেটা আশাকরি সকলের নিকট স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।

তাই অদ্বৈত বেদান্তের সাথে অদ্বৈত শৈব দর্শনের  ব্যাখ্যাগত পার্থক্য রয়েছে, তত্ত্বগত পার্থক্য রয়েছে এবং স্বীকার্যগত পার্থক্য রয়েছে ।  তাই শৈবরা আগে নিজেরা নিজেদের দর্শন সম্পর্কে অবগত হোন।

শ্রী দক্ষিণামূর্তযে নমঃ |

👉লেখনীতে -  RohitKumarChoudhury (ISSGT)

👉 প্রচারে - International Shiva Shakti Gyan Tirtha