ত্রিপুণ্ড্র ধারণের নিয়ম (শৈবতিলক)
🔥ত্রিপুণ্ড্রের পরিচয় –
পরমশ্বর শিব নিজ কপালে এই তিলক স্বয়ং ধারণ করেন। তাই পরমেশ্বরের উপাসকবৃন্দও এই মহাপবিত্র শৈবতিলক ধারণ করেন।
যজ্ঞের শুকনো ভস্ম অথবা গোবর ভস্ম বা সাদা বর্ণের খড়িমাটি দ্বারা তৈরি তিনটি লম্বা আড়াআড়ি অঙ্কিত সরল রেখার তিলক কে ত্রিপুণ্ড্র বলে।
শিবমহাপুরাণের বিদ্যেশ্বর সংহিতার ১২নং অধ্যায়ে, ২১নং অধ্যায়ে এবং ২৪নং অধ্যায়ে এই ত্রিপুণ্ড্র সম্পর্কিত বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করা আছে।
খেয়াল রাখবেন, ত্রিপুণ্ড্র ভুরুর নীচের দিকে যেন না যায়। সমস্ত কপাল জুড়ে সমানভাবে তিনটি সরলরেখা আঁকবেন হাতের তিনটা আঙুল দিয়ে।
ত্রিপুণ্ড্র যে কোনো ব্যক্তি ধারণ করতে পারে, এতে কোনো বিধি নিষেধ নেই। প্রত্যেক শিবভক্ত শৈব প্রতিদিন স্নান কার্য সেরে প্রথমেই ত্রিপুণ্ড্র ধারণ করবেন(সাথে রুদ্রাক্ষও ধারণ করবেন), তারপর পূজা শুরু করবেন। ভক্তিসহকারে ত্রিপুণ্ড্র ধারণ করবেন, সন্দেহজনক অথবা অশ্রদ্ধার সহিত ধারণ করা মহাপাপ বলে গণ্য।
🔥আপনি নিজেও এই ভস্ম তৈরী করতে পারেন। এখানে দুটি পদ্ধতি দেয়া হল। নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী যে কোন একটি পদ্ধতি অনুসরণ করে ভস্ম তৈরী করতে পারেন👇
🟥১) যাদের কাছে সময় কম রয়েছে তারা সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিটি অনুসরণ করতে পারেন, নিম্নোক্ত এই লিঙ্কে ক্লিক করে দেখে নিন 👉 ভস্ম তৈরীর সংক্ষিপ্ত পদ্ধতি (শৈব আগমোক্ত)
🟥২) এছাড়া যারা বৃহৎ পদ্ধতিটি অনুসরণ করতে চান, তারা নিম্নোক্ত এই লিঙ্কে ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন 👉 ভস্ম তৈরীর বৃহৎ পদ্ধতি (শৈব আগমোক্ত)
শুকনো ভস্মকে হাত দিয়ে ধরে অথবা ভস্মের উপর হাত দিয়ে ধরে নিম্নোক্ত মন্ত্র উচ্চারণ করে অভিমন্ত্রিত করবেন(খড়িমাটি ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতি অনুসরণ করবেন)
(জাবালি উপনিষদ এবং কালাগ্নিরুদ্র উপনিষদ মতে , প্রথমে পঞ্চব্রহ্ম মন্ত্রোচ্চারণ পূর্বক ভস্মকে সংগ্রহ করে একটি পাত্রে রাখতে হবে। গৃহস্থদের জন্য এমনটাই শিবমহাপুরাণোক্ত নির্দেশ)
(ভস্ম না পেলে খড়িমাটির ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে)
☘️এরপর সেই ভস্মে নিজ হস্ত স্পর্শ করে অভিমন্ত্রিত করতে হবে নিম্নোক্ত মন্ত্র দ্বারা -
🔴অভিমন্ত্রিত করার মন্ত্র 👇
" ॐ অগ্নিরিতি ভস্ম বায়ুরিতি ভস্ম জলমিতি ভস্ম স্থলমিতি ভস্ম ব্যোমেতি ভস্ম সর্বংহ বা ইদং ভস্ম মন এতানি চক্ষূংষি ভস্মানি যস্ মাদ্ ব্রতমিদং পাশুপতং যদ্ ভস্ম নাঙ্গানি সংস্পৃশেত্ তসমাদ্ ব্রহ্ম তদেতত্ পাশুপতং পশুপাশ বিমোক্ষণায় "
[এই মন্ত্রটি বৈদিক অথর্ব-শির উপনিষদোক্ত]
☘️এরপর নিম্নোক্ত মন্ত্রটি পাঠ করে ভস্মটিকে হাতের তিনটি আঙুলে নিতে হবে 👇
" মা নস্তোকে তনয়ে মা নঽ আয়ুষি মা নাে গােষু মা নােঽ অশ্বেষু রীরিষঃ ।
মা নো বীরান্ রুদ্র ভামিনাে বধীর্হবিষ্মন্তঃ সদমিৎ ত্বা হবামহে ॥ "
(জাবালি উপনিষদোক্ত নির্দেশ)
☘️এরপর সেই ভস্মে সামান্য জল মেশাতে হবে নিম্নোক্ত মন্ত্র উচ্চারণ পূর্বক (হাতের মধ্যেই)
👇
" মা নাে মহান্তমুত মা নােঽ অর্ভকং মা নঽ উক্ষন্তমুত মা নঽ উক্ষিতম্ ।
মা নাে বধীঃ পিতরং মােত মাতরং মা নঃ প্রিয়াস্তন্বো রুদ্র রীরিষঃ ॥ "
(কালাগ্নিরুদ্র উপনিষদোক্ত নির্দেশ)
এখন সেই ভস্মটি পুরোপুরিভাবে তৈরী ত্রিপুণ্ড্র হিসেবে ধারণ করার জন্য।
[যদি আপনি শুকনো ভস্ম ধারণ করতে চান তবে উপরোক্ত মন্ত্রে অভিমন্ত্রিত করার পর ভস্ম অথবা খড়িমাটিকে হাতের তিনটে আঙুলে লাগিয়ে সরাসরি নিজের কপালে লাগাতে পারেন নিম্নোক্ত মন্ত্র উচ্চারণ করে]
⭕ধারণ করার পদ্ধতি – ত্রিপুণ্ড্র সর্বদা হাতের তর্জনী, মধ্যমা ও অনামিকা -এই তিনটি আঙুলের দ্বারা আঁকবেন। নীচের ছবিতে দেখুন👇
শিবমহাপুরাণ ও অনান্য শিবশাস্ত্র অনুসারে দেহের যেকোনো ৫টি/৮টি/১৬টি এবং ৩২টি স্থানে ত্রিপুণ্ড্র ধারণ করার বিধান আছে। নীচে ৫টি স্থানে ত্রিপুণ্ড্র ধারণের মন্ত্র উল্লেখ করা হল।
জলের সাথে মেশানোর পর সেই কাদার মতো ভস্ম/খড়িমাটি অথবা জলবিহীন শুকনো ভস্ম নিম্নোক্ত মন্ত্রে দেহের নূন্যতম পাঁচটি স্থানে লাগাবেন । নীচে জাবালি উপনিষদ ও শিবমহাপুরাণের থেকে তিন ধরণের ত্রিপুণ্ড্র ধারণের মন্ত্র ও পদ্ধতি দেয়া হল। যে কোনো একটি অনুসরণ করবেন।
🟥 (১) ধারণের প্রথম প্রকার মন্ত্র ও পদ্ধতি 🟥
জাবালি শৈবউপনিষদোক্ত বিধি অনুযায়ী দেহের পাঁচস্থানে ত্রিপুণ্ড্র ধারণ ( শিবপুরাণোক্ত নির্দেশ মেনে ) -
1. নিম্নলিখিত ত্ৰায়ুষম্ মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে মস্তক , ললাট , বুক এবং দুই কাঁধে সেই ভস্মকে সামান্য পরিমান লাগান প্রথমে ৷ (এখনই তিনটি দাগ কাটবেন না )
" ত্রায়ুুষং জমদগ্নেঃ কশ্যপস্য ত্রায়ুষম্ ।
যদ্দেবেষু ত্রায়ুষং তন্নোঽস্তু ত্ৰায়ুষম্ ॥ "
( জাবালি উপনিষদোক্ত নির্দেশ )
2. এরপর সেই ত্রায়ুষম্ মন্ত্র এবং তারই সাথে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র এক এক বার করে পাঠ পূর্বক উপরিউক্ত দেহের পাঁচটি স্থানে তিনটি রেখা / ত্রিপুণ্ড্র আঁকবেন (অর্থাৎ মোট তিনবার সেই মন্ত্র দুটিকে একসাথে উচ্চারণ করতে হবে) এই বিধিকেই শৈবউপনিষদে শাম্ভবব্রত বলা হয়েছে ।
🔴 ত্রিপুণ্ড্র ধারণ মন্ত্র (ত্রায়ুষম্ ও মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র)
👇
ত্রায়ুুষং জমদগ্নেঃ কশ্যপস্য ত্রায়ুষম্ ।
যদ্দেবেষু ত্রায়ুষং তন্নোঽস্তু ত্ৰায়ুষম্ ॥
ॐ ত্র্যম্বকম্ যজামহে সুগন্ধিম পুষ্টিবর্ধনম্ ।
উর্বারুকমিব বন্ধনান্ মৃত্যোর্মুক্ষীয় মামৃতাত্ ॥
ॐ নমঃ শিবায় ॥
ॐ নমঃ শিবায় ॥
ॐ নমঃ শিবায় ॥
🟥 (২) ধারণের দ্বিতীয় প্রকার মন্ত্র ও পদ্ধতি 🟥
☘️শিব মহাপুরাণের বিধি অনুযায়ী দেহের পাঁচস্থানে ত্রিপুণ্ড্র ধারণ 👇
🔴কপালে ত্রিপুণ্ড্র আঁকার সময় “ নমঃ শিবায় ” মহামন্ত্র উচ্চারণ করে ধারণ করুন ।
🔴দুই ঊর্ধ্ববাহুতে(ডান ও বাম উভয় হাতের উপরের দিকে) ত্রিপুণ্ড্র আঁকার সময় “ ঈশাভ্যাং নমঃ ” মহামন্ত্র উচ্চারণ করে ধারণ করুন ।
🔴নাভীর উপরের দিকে(পেটের শেষের দিকে) ত্রিপুণ্ড্র আঁকার সময় “ পিতৃভ্যাং নমঃ ” মহামন্ত্র উচ্চারণ করে ধারণ করুন ।
🔴হৃদয়দেশে(বুকে) ত্রিপুণ্ড্র আঁকার সময় “ উমেশাভ্যাং নমঃ ” মহামন্ত্র উচ্চারণ করে ধারণ করুন ।
(উপরোক্ত চিত্রে শক্তিবিন্দু বিহীন ভস্মের ত্রিপুণ্ড্র দেখা যাচ্ছে)
এছাড়াও যদি ত্রিপুণ্ড্রের সাথে লাল বর্ণের শক্তিবিন্দু ধারণ করতে চান তবে একটু সিঁদুর অথবা কুমকুম এর এক বিন্দু মধ্যমা আঙ্গুলে তুলে নিন। “ নমঃ পরাশক্তি ” মন্ত্র উচ্চারণ করে কপালে ত্রিপুণ্ড্রের মাঝখানের যে রেখা আছে সেই রেখাটির একদম মাঝখানে একটি ছোট করে গোল বিন্দু করে ধারণ করুন। শুধুমাত্র কপালেই শক্তিবিন্দু ধারণ করবেন, দেহের অন্য স্থানে নয়।
(উপরোক্ত চিত্রে শক্তিবিন্দু সহ সাদা বর্ণের খড়িমাটির ত্রিপুণ্ড্র দেখা যাচ্ছে)
🟥 (৩) ধারণের তৃতীয় প্রকার মন্ত্র ও পদ্ধতি 🟥
কামিকাগম , চন্দ্ৰজ্ঞানাগম , কারণাগম সহ অন্যান্য শৈবআগমে এমনকি শিবপুরাণেও সর্বোচ্চ ৩২ টি স্থানে ত্রিপুণ্ড্র ধারণের বিধান আছে ।
তাছাড়া শৈবআগম ও শিবপুরাণ অনুযায়ী দেহের ১৬ টি এবং ৮ টি স্থানেও ত্রিপুণ্ড্র ধারণের বিধান আছে ৷ চন্দ্ৰজ্ঞানাগমোক্ত নির্দেশানুযায়ী গৃহস্থরা যদি এতগুলি স্থানে ত্রিপুণ্ড্র অঙ্কন করতে চান তবে শুধুমাত্র মূল পঞ্চাক্ষর মন্ত্র " নমঃ শিবায় " উচ্চারণ পূর্বকও তাঁরা ধারণ করতে পারেন ।
☘️পূর্বকামিকাগমোক্ত ত্রিপুণ্ড্র ধারণের ১৬ টি স্থানের নাম -
কপাল দুই কান , দুই কাঁধ , দুই বাহু , দুই হাতের মুষ্ঠিতে , দুই কনুই আর কব্জির মাঝের অংশে , বুক , পেট , নাভির দুই পার্শ্বে ও পিঠে ।
☘️পূর্বকামিকাগমোক্ত ত্রিপুণ্ড্র ধারণের ৩২ টি স্থানের নাম-
মাথার ব্রহ্মতালু , ললাটদেশ , দুই কান , দুই চোখের পাতায় , নাকের দুই পার্শ্বে , গলায় , মুখের উপরে , দুই কাঁধে , দুই ঊর্ধ্ববাহুতে , দুই কব্জিতে , দুই কব্জি আর কনুইয়ের মাঝের অংশে , বক্ষে , নাভিদেশে , লিঙ্গে , পায়ুতে দুই উরুতে , দুই জঙ্ঘাতে , দুই হাঁটুতে , পশ্চাৎদেশের দুইপার্শ্বে এবং দুই পায়ের পাতায় ।
🔴নীচে ছবির মাধ্যমে জাবালি উপনিষদ ও শিবমহাপুরাণোক্ত ত্রিপুণ্ড্র ধারণ মন্ত্র ও দেহের স্থানের নাম উল্লেখ করে দেয়া হল🔴
[ত্রিপুণ্ড্র ধারণ পদ্ধতি এখানে সমাপ্ত]
🔶🔸🔶🔸🔶🔸🔶🔸🔶🔸🔶🔸🔶🔸🔶🔸
🔵 ত্রিপুণ্ড্র ধারনের ফল –
১. ত্রিপুণ্ড্র ধারণ করলে পরমেশ্বর শিব অতি প্রসন্ন হন।
২. ত্রিপুণ্ড্র ভোগ ও মোক্ষ প্রদানকারী ।
৩. ত্রিপুণ্ড্র ধারণকারী ব্যক্তি স্বয়ং রুদ্ররূপী ও পবিত্র হন ।
৪. ত্রিপুণ্ড্র সকল রকম অপদেবতার দৃষ্টি থেকে শিবভক্তকে রক্ষা করে থাকেন।
৫. ত্রিপুণ্ড্রে প্রায় সমস্ত দেবতা অবস্থান করেন, তাই ধারণকারী ব্যক্তি সমস্ত দেবতার কৃপাদৃষ্টিভাগী হন।
🔥ত্রিপুণ্ড্রের প্রত্যেক রেখায় নয় জন দেবতা অবস্থান করেন।
🔶ত্রিপুণ্ড্রের প্রথম রেখার নয়জন দেবতা –
১) প্রণবের (ॐ – অ, উ, ম) প্রথম অক্ষর ‘ অ ‘ কার,
২) গার্হপত্য অগ্নি,
৩) পৃথিবী,
৪) ধর্ম,
৫) রজোগুণ,
৬) ঋগ্বেদ,
৭) ক্রিয়াশক্তি,
৮) প্রাতঃসকল,
৯) মহাদেব ।
🔶ত্রিপুণ্ড্রের দ্বিতীয় রেখার নয়জন দেবতা –
১) প্রণবের (ॐ – অ, উ, ম) দ্বিতীয় অক্ষর ‘ উ ‘ কার,
২) দক্ষিণাগ্নি,
৩) আকাশ,
৪) সত্ত্বগুণ,
৫) যজুর্বেদ,
৬) মধ্যংদিনসবন,
৭) ইচ্ছাশক্তি,
৮) অন্তরাত্মা,
৯) মহেশ্বর ।
🔶ত্রিপুণ্ড্রের তৃতীয় রেখার নয়জন দেবতা –
১) প্রণবের (ॐ – অ, উ, ম) দ্বিতীয় অক্ষর ‘ ম ‘ কার,
২) আহ্বনীয় অগ্নি,
৩) পরমাত্মা,
৪) তমোগুণ,
৫) দ্যুলোক,
৬) জ্ঞানশক্তি,
৭) সামবেদ,
৮) তৃতীয় সবন,
৯) শিব ।
অতএব, প্রত্যেক শিবভক্ত শৈবদের উচিত এই ত্রিপুণ্ড্র শ্রদ্ধার সহিত নিজ দেহে ধারণ করা এবং অপরকেও ত্রিপুণ্ড্র ধারণ করার জন্য উৎসাহিত করা। ত্রিপুণ্ড্র ধারণকারী ব্যক্তিকে কখনো নিন্দা অথবা তাচ্ছিল্য করা উচিত নয়, এতে সমস্ত দেবতার রোষে পড়তে হয় নিন্দাকারী ব্যক্তিকে। তাই শৈবদের কখনোই নিন্দাকারী ব্যক্তিদের কথায় বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে সর্বদাই পরমেশ্বরের আনন্দদায়ক এই ত্রিপুণ্ড ধারণ করে শিবকৃপার ভাগীদার হওয়া উচিত।
✨॥ ॐ নমঃ পার্বতীনাথায় ॥✨
🌷॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥🌷
🖋️লেখনি ও সংগ্রহে – শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
©️কপিরাইট ও প্রচারে – International Shiva Shakti Gyan Tirtha
© Koushik Roy. All Rights Reserved https://issgt100.blogspot.com
খরিমাটি কি,,,??? এটা কি চকের গুরা,,,????
উত্তরমুছুনHmm
মুছুন