পরমেশ্বর শিব ও পরমেশ্বরী পার্বতী মাতার দশাবতারের নাম ও মাহাত্ম্য

 


পরমেশ্বর ভগবান শিব এবং ভগবতী পার্বতী দেবী হলেন সর্বোপরি। পরমেশ্বর শিব তার বিভিন্ন স্বরূপের প্রকাশ ঘটিয়ে তাদের দ্বারা সমগ্র ভুবনের কার্য সম্পাদন করান। ঠিক তেমন ভাবেই জগদম্বা পরমেশ্বরী পার্বতী দেবীও নিজ শক্তিসমূহকে প্রকট করে সেই সমস্ত শক্তিগণ কে পরমেশ্বর শিবের প্রকটিত প্রত্যেকটি স্বরূপের সাথে নির্দিষ্ট কার্যের নিমিত্ত একটি একটি করে নির্দিষ্ট শক্তিদেবী কে যুক্ত করেন।
  দশমহাবিদ্যা স্বরূপ টি হল পরমেশ্বরী পার্বতী দেবীর বিশেষ শক্তিগণের স্বরূপ। মূলত দেবী পার্বতী নিজের ইচ্ছেতেই নিজ স্বরূপ এই মহাবিদ্যাগণ কে প্রকট করেন।
পরমেশ্বর শিব সেই সমস্ত দশমহাবিদ্যার দেবীগণকে ধারণ ও তার কার্যে সহায়তা করার নিমিত্তে নিজের দশটি স্বরূপ প্রকট করেন। এই বিষয়ে পরমশৈব ভক্তশিরোমণি নন্দীকেশ্বর পরমশিবভক্ত সনৎকুমারকে বিস্তারিত বলেছেন, যা পরমপূজ্য পবিত্র শিবমহাপুরাণের অন্তর্গত শতরুদ্র সংহিতার ১৭নং অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। নীচে সেই অধ্যায়ের শ্লোকসহ অনুবাদ তুলে ধরা হল —

 

☀️ দেবী পার্বতীর দশমহাবিদ্যার সাথে পতিস্বরূপে পরমেশ্বর শিবের দশমহাবিদ্যাপতি অবতারের নাম ও তাদের মাহাত্ম্য :


🔴(১)

তত্রাদ্যো হি মহাকালো ভুক্তিমুক্তিপ্রদঃ সতাম্ ।
শক্তিস্তত্র মহাকালী ভক্তেপ্সিতফলপ্রদা ॥২

👉 পরমেশ্বর শিবের প্রকটিত প্রথম বিদ্যাপতি  মহাকাল নামে প্রসিদ্ধ। এনার বিদ্যাশক্তির নাম মহাকালী।
দেবী মহাকালী দশমহাবিদ্যার প্রথম মহাবিদ্যা।
যা পার্বতী দেবীর প্রকটিত একজন শক্তিস্বরূপা।
🔷মহাকাল ও মহাকালী তাদের ভক্তদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে ভোগ ও মোক্ষ প্রদান করেন।


🔴(২)

তারনামা দ্বিতীয়শ্চ তারাশক্তিস্তথৈব সা ।
ভুক্তিমুক্তিপ্রদৌ চোভৌ স্বসেবকসুখপ্রদৌ॥৩

👉 পরমেশ্বর শিবের প্রকটিত দ্বিতীয় বিদ্যাপতি তার নামে প্রসিদ্ধ।
এনার বিদ্যাশক্তির নাম তারাদেবী।
দেবী তারা দশমহাবিদ্যার দ্বিতীয়তম মহাবিদ্যা।
ইনি পার্বতী দেবীর প্রকটিত একজন শক্তিস্বরূপা।
🔷 তার ও তারাদেবী এই দুজন ভুক্তি-মুক্তি প্রদাতা এবং সেবকদের জন্য সুখদায়ক।


🔴(৩)

ভুবনেশো হি বালাহ্বস্মৃতীয়ঃ পরিকীর্তিতঃ ।
ভুবনেশী শিবা তত্র বালাহ্বা সুখদা সতাম্ ॥৪

👉 পরমেশ্বর শিবের প্রকটিত তৃতীয় বিদ্যাপতি বাল ভুবনেশ নামে বিখ্যাত।
এনার বিদ্যাশক্তির নাম বালা ভুবনেশী শিবা।এনাকে ভুবনেশ্বরী বলা হয়।
দেবী ভুবনেশ্বরী দশমহাবিদ্যার তৃতীয়তম মহাবিদ্যা।
ইনিও পার্বতী দেবীর প্রকটিত একজন শক্তিস্বরূপা।
🔷ভুবনেশ ও ভুবনেশ্বরী সর্বদা তাদের সজ্জনদের সুখপ্রদানকারী হন।


🔴(৪)

শ্রীবিদ্যেশঃ ষোড়শাহ্বঃ শ্রীর্বিদ্যা ষোড়শী শিবা ।
চতুর্থো ভক্তসুখদো ভুক্তিমুক্তিফলপ্রদঃ ॥৫
 

👉পরমেশ্বর শিবের প্রকটিত চতুর্থ বিদ্যাপতি ষোড়শ শ্রীবিদ্যেশ নামে পরিচিত।

এনার বিদ্যাশক্তির নাম ষোড়শী শ্রীবিদ্যা শিবা।
দেবী ষোড়শী হলেন দশমহাবিদ্যার চতুর্থতম মহাবিদ্যা।
এই শক্তিদেবীও পার্বতী দেবীর প্রকটিত একজন শক্তিস্বরূপা। ইনি ত্রিপুরাসুন্দরী নামে বিখ্যাত। ললিতাও এনারই নাম। ইনিই তান্ত্রিক পার্বতী নামে পরিচিত।
🔷ষোড়শ এবং ষোড়শী দেবী তাদের ভক্তদের জন্য সুখদ ও ভোগ-মোক্ষদায়ক।


🔴(৫)

পঞ্চমো ভৈরবঃ খ্যাতঃ সর্বদা ভক্তকামদঃ ।
ভৈরবী গিরিজা তত্র সদুপাসককামদা ॥৬

👉 পরমেশ্বর শিবের প্রকটিত পঞ্চম বিদ্যাপতির নাম ভৈরব।
এই বিদ্যাপতি ভৈরবের বিদ্যাশক্তির নাম ভৈরবী।
দেবী ভৈরবী দশমহাবিদ্যার পঞ্চম মহাবিদ্যা।
ইনি পার্বতী দেবীর প্রকটিত একজন ভয়ঙ্করী শক্তিস্বরূপা।
🔷ভৈরব ও ভৈরবী দেবী সর্বদা ভক্তদের কামনা পূরণ করেন এবং উপাসকদের অভীষ্টপ্রদায়িনী।


🔴(৬)

ছিন্নমস্তকনামাসৌ শিবঃ ষষ্ঠঃ প্রকীর্তিতঃ ।
ভক্তকামপ্রদা চৈব গিরিজা ছিন্নমস্তকা ॥৭

👉 পরমেশ্বর শিবের প্রকটিত ষষ্ঠতম বিদ্যাপতি ছিন্নমস্তক নামে পরিচিত।
এনার বিদ্যাশক্তির নাম ছিন্নমস্তকা/ছিন্নমস্তা।
দেবী ছিন্নমস্তা দশমহাবিদ্যার ষষ্ঠতম মহাবিদ্যা।
ইনি পার্বতী দেবীর প্রকটিত একজন উগ্র শক্তিস্বরূপা।
🔷 ছিন্নমস্তক ও ছিন্নমস্তা দেবী ভক্তের সমস্ত কাম্যবস্তু প্রদান করেন।


🔴(৭)

ধূমবান্ সপ্তমঃ শম্ভুঃ সর্বকামফলপ্রদঃ ।
ধূমাবতী শিবা তত্র সদুপাসককামদা ॥৮

👉পরমেশ্বর শিবের প্রকটিত সপ্তমতম বিদ্যাপতি ধূমবান নামে বিখ্যাত।
এনার বিদ্যাশক্তির নাম ধূমাবতী।
দেবী ধূমাবতী দশমহাবিদ্যার সপ্তমতম মহাবিদ্যা।
ইনি পার্বতী দেবীর প্রকটিত একজন ভয়ঙ্কররূপী শক্তিস্বরূপা।
🔷 ধূমবান ও ধূমাবতী উভয়েই ভক্তের কামনা পূরণ করে দেন।


🔴(৮)

শিবাবতারঃ সুখদো হ্যষ্টমো বগলামুখঃ ।
শক্তিস্তত্র মহানন্দা বিখ্যাতা বগলামুখী ॥৯

👉 পরমেশ্বর শিবের প্রকটিত অষ্টমতম সুখদায়করূপ বিদ্যাপতি বগলামুখ নামে প্রসিদ্ধ।
এনার বিদ্যাশক্তির নাম বগলামুখী।
দেবী বগলামুখী দশমহাবিদ্যার অষ্টমতম মহাবিদ্যা।
ইনি পার্বতী দেবীর প্রকটিত একজন ঐশ্বর্যপূর্ণ শক্তিস্বরূপা।
🔷বগলামুখ ও বগলামুখী দেবী ভক্তকে সর্বদা সুখ ও আনন্দ প্রদান করেন।


🔴(৯) 

শিবাবতারো মাতঙ্গো নবমঃ পরিকীর্তিতঃ ।
মাতঙ্গী তত্র শর্বাণী সর্বকামফলপ্রদা ॥১০

👉পরমেশ্বর শিবের প্রকটিত নবমতম বিদ্যাপতি মাতঙ্গ নামে পরিচিত।
এনার বিদ্যাশক্তির নাম মাতঙ্গী।
দেবী মাতঙ্গী দশমহাবিদ্যার নবমতম মহাবিদ্যা।
ইনি পার্বতী দেবীর প্রকটিত একজন অমায়িক সৌন্দর্য্যসম্পন্না শক্তিস্বরূপা। এনাকে তান্ত্রিক সরস্বতী বলা হয়ে থাকে।
🔷মাতঙ্গ ও মাতঙ্গী দেবী ভক্তের অভিলাষ পূর্ণ করেন।


🔴(১০) 

দশমঃ কমলঃ শম্ভুর্ভুক্তিমুক্তিফলপ্রদঃ ।
কমলা গিরিজা তত্র স্বভক্তপরিপালিনী ॥১১

👉পরমেশ্বর শিবের প্রকটিত দশমতম বিদ্যাপতি কমল নামে বিখ্যাত।
এনার বিদ্যাশক্তির নাম কমলা।
দেবী কমলা দশমহাবিদ্যার দশমতম মহাবিদ্যা।
ইনি পার্বতী দেবীর প্রকটিত একজন শান্ত শক্তিস্বরূপা। এই দেবী তান্ত্রিক লক্ষী নামে পরিচিত।
🔷কমল ও কমলা দেবী ভক্তগণকে ভুক্তি-মুক্তিরূপ ফলপ্রদানকারী এবং সর্বতোভাবে পালন করেন।


🌺 মাহাত্ম্য  : পরমেশ্বর শিবের এই হল দশ অবতার । এরা সকলেই ভক্ত এবং সৎপুরুষদের জন্য সুখদায়ক এবং ভোগ ও মোক্ষের প্রদাতা। যাঁরা মহাত্মা শংকরের এই দশ অবতারের নির্বিকারভাবে সেবা করেন, তিনি তাদের নিত্য নানা প্রকারের সুখ প্রদান করেন। নন্দীকেশ্বর এইভাবে পরমেশ্বর শিবের দশাবতারের মাহাত্ম্য বর্ণনা করলেন। তন্ত্রশাস্ত্রে একে সর্বকামপ্রদ বলা হয়েছে। এই শক্তিসমূহেরও অদ্ভূত মহিমা রয়েছে। তন্ত্র ইত্যাদি শাস্ত্রে এই মহিমাকে সর্বকামপ্রদরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এটি দুষ্টদের নিত্য দণ্ড প্রদানকারী এবং বিশেষভাবে ব্রহ্মতেজ বৃদ্ধিকারী। যে ব্যক্তি সমস্ত শিবপর্বের সময়ে এই পরম পবিত্র কথা ভক্তিসহকারে পাঠ করেন,তিনি পরমেশ্বর শিবের পরমপ্রিয় হন, শিবভক্তগণের শিবভক্তি বৃদ্ধি পায় এবং পরমানন্দ লাভ হয়।


[বিঃদ্রঃ — বর্তমানে শাক্তমতাবলম্বী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে অনেকে শিবমহাপুরাণোক্ত এই দশমহাবিদ্যাপতির নামগুলি প্রথমবার শুনে থাকবেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলি, শিবমহাপুরাণ শাস্ত্র অনুযায়ী দশমহাবিদ্যার ভৈরবদের নাম ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু সত্ত্বাটি এক‌ই, তাই এটি নিয়ে মজার কিছু নেই। শাক্তমত অনুযায়ী দশমহাবিদ্যার ভৈরবদের নাম ভিন্ন রয়েছে। সুতরাং শাস্ত্র যেখানে যে বিধান দিয়েছে, সেটি নিয়ে মজা করা বুদ্ধিমানের মতো কাজ নয়, বরং শাস্ত্র যেহেতু সকলের অনুশাসনের মাধ্যম, তাই শাস্ত্র অবশ্যই সর্বাগ্রে মান্য, শিবমহাপুরাণের শতরুদ্র সংহিতার ১৭তম অধ্যায়ের ২নং থেকে ১১নং শ্লোক পর্যন্ত দশমহাবিদ্যাপতি ও দশমহাবিদ্যার নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি আমরা তুলে ধরেছি, যদি কারোর সংশয় থাকে তবে তারা তথ্যসূত্র টি শিবমহাপুরাণ থেকে মিলিয়ে দেখে নেবেন, শৈবমত অনুযায়ী দেবী ধূমাবতীর ভৈরব ধূমবানের সাথে লীলা করেছেন দেবী, তাই দেবী ধূমাবতীর ভৈরব আছে নাকি নেই তা নিয়ে নিজস্ব মতামত দেয়া থেকে বিরত থাকুন, যেখানে শিবমহাপুরাণ দেবী ধূমাবতীর ভৈরব ধূমবান বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে , সেখানে সামান্য মনুষ্য হয়ে শাস্ত্র বাক্যের উপর কথা বলা অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। শিবমহাপুরাণ অনুযায়ী, ছিন্নমস্তার ভৈরবের নাম ছিন্নমস্তক, শাক্তমতে কবন্ধ ভৈরব হতে পারে। কমলার ভৈরব কমল - এটিও শিবমহাপুরাণের নির্দেশ, শাক্ত মত অনুসারে অন্যকিছু হতে পারে।  সুতরাং, আপনার জানার অভাব থাকতেই পারে, কিন্তু আপনি যেটা জানেননা সেটা এই জগতে নেই এমন ভাবনাটা সম্পূর্ণ অজ্ঞতা , তাই স্থান,কাল,পাত্র ভেদে শাস্ত্রের মান্যতাকে সম্মান প্রদর্শন করুন এটিই নিবেদন আপনাদের কাছে]


⬛ সংগ্রহে ও লেখনীতে — শ্রীনন্দীনাথ শৈব

কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT 


[আমাদের ওয়েবসাইটের মূল পোষ্টের লিঙ্ক 👇
]

[আমাদের প্রত্যেকেটি পোষ্ট সবার আগে দেখতে আমাদের পেজ লাইক করে ফলো করুন এবং পুনরায় ফলো বাটনে ক্লিক করে """See First""" অথবা """FAVOURITE"""" করে দিন, আমাদের পোষ্ট ভালো লাগলে অবশ্যই শেয়ার করবেন, লাইক করবেন এবং কমেন্ট করে মতামত জানাবেন।আমাদের এই লেখা গুলি এডিট করবেননা, SAME TO SAME লেখা সম্পূর্ণ কপি করে পোষ্ট করবেন।]

🙏🙏🙏🙏হর হর মহাদেব🙏🙏🙏🙏
🙏🙏🙏🙏জয় পার্বতী মাতা🙏🙏🙏🙏

#পরমেশ্বরশিব #মহাকাল #মহাকালী #দশমহাবিদ্যা #পার্বতী #ষোড়শী #কমলা  #দশাবতার #তারা #ভৈরবী #মহাদেব #ISSGT
#INTERNATIONALSHIVASHAKTIGYANTIRTHA
#আন্তর্জাতিকশিবশক্তিজ্ঞানতীর্থ

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত