সনাতন ধর্মের একমাত্র প্রাচীন গুরু পরম্পরা পাশুপত শৈবাপরম্পরার আচার্য ও তাদের শিষ্যদের নাম সমূহ
সনাতন ধর্মের শাস্ত্র অনুসারেই, সনাতন ধর্মের সবথেকে প্রাচীন একমাত্র গুরুপরম্পরার নাম হল – পাশুপত শৈব গুরু পরম্পরা।
সনাতন ধর্মের শাস্ত্রে পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রাচীন কালে সমস্ত মুনিঋষিগণেরা পাশুপত শৈবপরম্পরার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, এমন কোনো মুনিঋষি নেই যারা শৈব পরম্পরার অন্তর্গত নন, সকলেই শৈব পরম্পরার অন্তর্গত ছিলেন, সকলেই শৈব পাশুপত পরম্পরার আচার্য ছিলেন।
অন্য কোনো পরম্পরার অস্তিত্ব তখন ছিল না, অর্থাৎ বৈষ্ণব, শাক্ত, সৌর, গাণপত্য বলে কোনো স্বতন্ত্র পরম্পরা ছিল না, সনাতন ধর্মের শাস্ত্রে একমাত্র শৈব পাশুপত পরম্পরারই প্রাচীনত্বের উল্লেখ রয়েছে স্পষ্ট ভাবে। আর সমস্ত মুনিঋষিগণেরা সত্যযুগ থেকেই পাশুপত শৈবপরম্পরার আচার্য ছিলেন। অন্য কোনো পরম্পরার আচার্য ছিলেন না।
একারণেই সনাতন ধর্মের মূল ও মুখ্য হল — একমাত্র শৈব পরম্পরা, আদি সনাতনী হলেন শৈব রা।
পরবর্তীতে এই শৈব সনাতন পরম্পরার অন্তর্ভুক্ত ঋষিমুনিগণেরাই পরমেশ্বর শিবের আদেশে শাক্ত বৈষ্ণব প্রভৃতি গৌণ পরম্পরা গুলিকে প্রচার করেছিলেন। সেখান থেকেই শক্তি প্রাধান্যতা দিয়ে শাক্তকূলের পরম্পরা সৃষ্টি হয়েছিল, বৈষ্ণবধারার শুরু হয়েছিল। কিন্তু সমস্ত পরম্পরার চেয়েও আদি হল পাশুপত শৈবপরম্পরা।
🔷 পাশুপত পরম্পরার দুটি ধারা রয়েছে,
(১) — শ্রৌত অর্থাৎ বৈদিক আগমিক পাশুপত পরম্পরা,
(২) — অশ্রৌত অর্থাৎ অবৈদিক পাশুপত পরম্পরা ।
🔶 বৈদিক আগমিক পাশুপতকে — মহাপাশুপত পরম্পরা বলে। এই মহাপাশুপত শৈবপরম্পরাই প্রকৃত পাশুপত পরম্পরা হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে শাস্ত্রে। এই মহাপাশুপতেরই আচার্য ছিলেন প্রাচীন কালের সমস্ত ঋষিমুনিগণেরা ।
এই পরম্পরার জ্ঞান ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে স্বয়ং অমরত্ব প্রাপ্তকারী শিবভক্ত পরমশৈব মহর্ষি উপমন্যু তার শিষ্য পরমশৈবশিরোমণি বিষ্ণুঅবতার শ্রীকৃষ্ণজী মহারাজকে প্রদান করেছিলেন। এই কথন টি বেদবেদান্ত সার মহামূল্যবান পবিত্র শ্রীশিবমহাপুরাণের বায়বীয়সংহিতার উত্তরখণ্ডের ৯নং অধ্যায়ের অন্তর্গত।
🖋️সংগ্রহকারী/লেখনীতে – শ্রীনন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
এই ৯নং অধ্যায়ের সূচনাপর্বেই শৈবশিরোমণি শ্রীকৃষ্ণ জী মহারাজ তার দীক্ষাগুরু মহর্ষি উপমন্যুজী কে বলেন,
শ্রীকৃষ্ণ বললেন—ভগবন্ ! সমস্ত যুগাবর্তে যোগাচার্যের রূপে পরমেশ্বর শিবের যাঁরা অবতার হন এবং সেই অবতারদের শিষ্যদের সকলের বর্ণনা করুন।
মহর্ষি উপমন্যু বললেন — বারো কল্পের সপ্তম মন্বন্তরে যুগক্রমে আঠাশজন যোগাচার্য প্রকটিত হন। এঁদের প্রত্যেকের শান্তচিত্তযুক্ত চারজন করে শিষ্য ছিলেন,যা শ্বেত থেকে রুষ্য পর্যন্ত বলা হয়েছে। আমি তাঁদের ক্রমশঃ বর্ণনা করছি, শোনো।এরা ২৮জন যোগাচার্যরূপী মহেশ্বরের শিষ্য।
এই ২৮জন যোগাচার্যগণের মোট শিষ্য সংখ্যা ১১২জন
এরা সকলেই সিদ্ধ পাশুপত অর্থাৎ পাশুপত শৈবধারার সিদ্ধযোগী।
২৮জন পাশুপত শৈবধারার শৈবযোগী আচার্যগণের প্রত্যেকের চারজন করে মোট ১১২জন শিষ্যের নামসমূহ নীচে দেয়া হল –
১)শ্বেত → শ্বেত, শ্বেতশিখ, শ্বেতাশ্ব, শ্বেতলোহিত,
২)সুতার → দুন্দুভি, শতরূপ, ঋচীক, কেতুমান,
৩)মদন → বিকোশ, বিকেশ, বিপাশ, পাশনাশন,
৪)সুহোত্র → সুমুখ, দুর্মুখ, দুর্গম, দুরতিক্রম,
৫)কঙ্ক → সনৎকুমার, সনক, সনন্দন, সনাতন,
৬)লৌগাক্ষি → সুধামা, বিরজা, শঙ্খ, অণ্ডজ,
৭)জৈগীষব্য → সারস্বত, মেঘ, মেঘবাহ, সুবাহক,
৮)দধিবাহ → কপিল, আসুরী, পঞ্চশিখ, বাঙ্কল,
৯)ঋষভ → পরাশর, গর্গ, ভার্গব, অঙ্গিরা,
১০)উগ্র → বলবন্ধু, নিরামিত্র, কেতুশৃঙ্গ, তপোধন,
১১)অত্রি → লম্বোদর, লম্ব, লম্বাত্মা, লম্বকেশক,
১২)সুপালক → সর্বজ্ঞ, সমবুদ্ধি, সাধ্য, সিদ্ধি,
১৩)গৌতম → সুধামা, কশ্যপ, বশিষ্ঠ, বিরজা,
১৪)বেদশিরা মুনি → অত্রি, উগ্র, গুরুশ্রেষ্ঠ, শ্রবণ,
১৫)গোকর্ণ → শ্রবিষ্ঠক, কুণি, কুণবাহু, কুশরীর,
১৬)গুহাবাসী → কুনেত্রক, কাশ্যপ, উশনা, চ্যবন,
১৭)শিখণ্ডী → বৃহস্পতি, উতথ্য, বামদেব, মহাকাল,
১৮)জটামালী → মহানিল, বাচঃশ্রবা, সুবীর, শ্যারক,
১৯)অট্টহাস → যতীশ্বর, হিরণ্যনাভ, কৌশল্য, লোকাক্ষি,
২০)দারুক → কুথুমি, সুমন্ত, জৈমিনী, কুবন্ধ,
২১)লাঙ্গুলী → কুশকন্ধর, প্লক্ষ, দার্ভায়ণি, কেতুমান,
২২)মহাকাল → গৌতম, ভল্লবী, মধুপিঙ্গ, শ্বেতকেতু,
২৩)শূলী → উশিজ, বৃহদশ্ব, দেবল, কবি,
২৪)দণ্ডী → শালিহোত্র, সুবেষ, যুবনাশ্ব, শরদ্বসু,
২৫)মুণ্ডীশ → ছগল, কুম্ভকর্ণ, কুম্ভ, প্রবাহুক,
২৬)সহিষ্ণু → উলূক, বিদ্যুৎ, শম্বুক, আশ্বলায়ন,
২৭)সোমশর্মা → অক্ষপাদ, কণাদ, উলূক, বৎস,
২৮)নকুলীশ্বর(লকুলীশ) → কুশিক, গর্গ, মিত্রক এবং রুষ্য
উপরোক্ত সমস্ত যোগাচার্য ও তাদের শিষ্যদের মধ্যে প্রত্যেকের শরীর ভস্মে বিভূষিত থাকে। এঁরা সম্পূর্ণ শাস্ত্রে তত্ত্বজ্ঞ, বেদ ও বেদাঙ্গের পারঙ্গম বিদ্বান। শিবাশ্রমে অর্থাৎ শৈবপরম্পরাতে অনুরক্ত, শিবজ্ঞান পরায়ণ, সর্বপ্রকার আসক্তিমুক্ত, একমাত্র ভগবান শিবেই মন ন্যস্ত রাখেন, সমস্ত দ্বন্দ্ব সহ্যকারী, ধীর, সর্বভূত হিতকারী, সরল, কোমল, স্বস্থ, ক্রোধশূন্য ও জিতেন্দ্রিয়। তাঁদের অলংকার হল রুদ্রাক্ষের মালা। তাঁদের মস্তক ত্রিপুণ্ড্র অঙ্কিত। তাঁদের মধ্যে কেউ শিখারূপে জটাধারণ করেন, কারো সব কেশই জটারূপ। কেউ কেউ জটা রাখেন না, অনেকে সর্বদা মাথা ন্যাড়া করেন। তাঁরা প্রায়শঃ ফল-মূল খান, প্রাণায়াম সাধনে তৎপর হন। ‘আমি শিবের’ এই অভিমানযুক্ত হন। সর্বদা শিবের চিন্তায় ব্যাপৃত থাকেন। তাঁরা সংসাররূপ বিষ-বৃক্ষের অঙ্কুরকে মন্থন করেছেন এবং সর্বদা পরমধামে যাবার জন্য উৎসুক থাকেন। যাঁরা যোগাচার্যগণের সঙ্গে এই শিষ্যদের জেনেও মান্য করে সর্বদা শিবের আরাধনা করেন, তাঁরা শিবের সাযুজ্য প্রাপ্ত হন, এর অন্যথা ভাবা উচিত নয়।
(তথ্যসূত্র – শিবমহাপুরাণ/বায়বীয়সংহিতা/উত্তরখণ্ড/৯নং অধ্যায়)
______________________________________________
এইভাবে পরমশৈব শ্রীকৃষ্ণ জী মহারাজকে মহর্ষি উপমন্যু শৈবপাশুপত পরম্পরার আচার্যগণের সম্পর্কে মহান জ্ঞান প্রদান করলেন।
সুতরাং, যেসব শাস্ত্রজ্ঞানহীন অবিবেচক ব্যক্তিবর্গেরা দাবী করেন যে, শৈব পরম্পরা হল সনাতন ধর্মের একটি শাখা মাত্র, তাদের সেই দাবী সনাতন ধর্মের শাস্ত্র থেকেই খণ্ডিত হল। কেননা, প্রাচীন কালের সমস্ত ঋষিমুনিগণেরা নিজেরাই শৈবপাশুপত পরম্পরায় দীক্ষিত ছিলেন ও আচার্যপদে আসীন ছিলেন, তারা তাদের পুত্র ও অনান্য শিষ্যদের পাশুপত পরম্পরার জ্ঞান প্রদান করে তাদেরকেও শৈব ই বানিয়েছিলেন। তারা সকলেই ভস্ম-ত্রিপুণ্ড্র রুদ্রাক্ষ ধারণ করতেন। একারণেই সনাতন ধর্মের প্রকৃত নাম শিবধর্ম বা শৈবধর্ম, যাকে আমরা ISSGT থেকে বলি শৈব-সনাতন ধর্ম।
শৈব পরম্পরাই সনাতন ধর্মের আদি পরম্পরা, শৈব পরম্পরা সনাতন ধর্মের মুখ্য, কোনো শাখা নয়।
আদি শঙ্করাচার্য্যের দ্বারা প্রবর্তিত আধুনিক কালের তথাকথিত স্মার্ত পরম্পরার অনুসারীরা,
পঞ্চমত — এর দোহাই দিয়ে দাবী করেন যে,
“শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, সৌর ও শাক্ত - এই পাঁচটি সম্প্রদায় হল সনাতন ধর্মের পাঁচটি শাখা।”
— এখানে তথাকথিত স্মার্তরা শৈবপরম্পরাকে সনাতন ধর্মের মূখ্য পরম্পরার স্থান থেকে নামিয়ে গৌণপরম্পরার তালিকায় বসিয়ে দিয়েছেন। যা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয় ।
সনাতন ধর্মের শাস্ত্র অনুযায়ী, শৈবপরম্পরাই সবথেকে প্রাচীন ও সকল মুনিঋষিগণেরা সেই শৈব পরম্পরারই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। মুখ্য শৈব পরম্পরার থেকে শৈব আচার্য মুনিঋষিদের দ্বারাই পরবর্তীতে অনান্য শাক্ত, সৌর, গাণপত্য, বৈষ্ণব প্রভৃতি পরম্পরার উদ্ভব হয়েছে।
তাই এই শাস্ত্র বচনকে অগ্রাহ্য করে যে সমস্ত তথাকথিত স্মার্তরা মিথ্যা প্ররোচনা ছড়াচ্ছেন তাদের বাক্য গ্রহণযোগ্য নয়, বরং তাদের দাবী শাস্ত্রের বিপক্ষে যাবার কারণে খণ্ডিত হল।
সনাতন ধর্মের মধ্যে শৈব গুরুপরম্পরার প্রাচীনত্ব, মুখ্যতা ও অদ্বিতীয়তা সনাতন ধর্মের শাস্ত্রের নিরিখেই প্রমাণিত হল।
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🪷
🔴 লেখনীতে : শ্রী নন্দীনাথ শৈবাচার্য
🧡 কপিরাইট ও প্রচারে : International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন