শ্রী কালভৈরভের বৈকুণ্ঠ আগমন

         ॥ শ্রী কালভৈরভের বৈকুণ্ঠ আগমন ॥


 [তথ্যসূত্র - স্কন্দপুরাণ/কাশিখণ্ড/অধ্যায় নং-৩১]

কাপালিক ব্রত ধারণ করে শ্রীকালভৈরব ব্রহ্মার পঞ্চম কপাল নিয়ে ত্রিলোকে বিচরণ করিতে করিতে বৈকুণ্ঠলোকে গমন করিলেন। 


মহাদেবাংশ সম্ভুত, ত্রিনয়ন, সর্পকুণ্ডলী, ভীষনাকার সেই মহাকাল ভৈরবের বৈকুণ্ঠে সমাগত দেখিয়া ভগবান গরুড়ধ্বজ, তাঁহাকে (কালভৈরবজীকে) দণ্ডবৎ প্রনাম করিলেন। দেবতা, মুনি ও দেবাঙ্গনা সকল‌ও সেই কালভৈরবজীকে প্রনাম করিলেন, কমলাপতি শ্রীহরি প্রনামানস্তর মস্তকে অঞ্জলিবদ্ধ করিয়া বহুবিধ স্তব করত ক্ষীরোদমথন-সম্ভবা পদ্মালয়াকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, হে প্রিয়ে! হে দেবী! জগৎপতিকে দর্শন করিয়া তুমি ধন্য হ‌ইলে, আমিও ধন্য হ‌ইলাম। ইনি ধাতা, বিধাতা, ত্রিলোকের ঈশ্বর ও প্রভু, ইনি‌ই অনাদি, শরণ্য, শান্ত, পরমাত্মস্বরূপ, সর্ব্বজ্ঞ, সর্ব্বযোগীশ্বর, সব্বভুতের একমাত্র নায়ক, অন্তরাত্মা, সকলের সর্ব্বাভীষ্টপ্রদ। শান্ত ও ধ্যানাবলম্বী যোগীগণ নিদ্রা ও নিঃশ্বাস রহিত হ‌ইয়া জ্ঞান দ্বারা যাঁহাকে সতত হৃদয়ে দর্শন করিতেছেন, সেই ভগবান্ কালভৈরব অদ্য আমাদিগের আলয়ে উপস্থিত অত‌এব দর্শন করো। 

বেদতত্ত্বজ্ঞ এবং যোগীজন যাকে জানতে পারেন, তিনি সর্বব্যাপক শিব অরূপ হয়েও শিব স্বরূপ ধারণ করে আসিছেন। যার চরিত্র বর্ণন করিলে মাত্র মনুষ্য শরীর ধারণকারী হয়েও বিদেহ হয়ে যান, তার দর্শন মাত্রে মনুষ্যদের পুনঃ পৃথিবীতে জন্মগ্ৰহণ করিতে হয় না, তিনি ত্রয়ম্বক শশীভূষণ ভগবান শিব আসিছেন। হে প্রিয়ে! আজ আমার শ্বেতপদ্ম দলের সমান নয়ন আজ ধন্য মহেশ্বরের দর্শনে। দেবতাদের দেবত্বপদকে ধিক্কার দেই, কারণ তারা সেই মহাদেবের দর্শন করেও সর্ব্বদু্খান্তকর নির্বান পদলাভে সমর্থ নহেন। যিনি সমস্ত দূঃখ হরণ করে মোক্ষদান করেন। যদি আমরা দেবলোকে থেকে মহাদেবের দর্শন করে মুক্তি প্রাপ্ত করতে না পারি তাহলে দেবলোকের দেবতা হ‌বার থেকে বড়ো অশুভ আর কিছুই হ‌ইতে পারে না।


পুলকিতাঙ্গ হৃষীকেশ এই সকল কথা বলিয়া বৃষবাহন মহাদেবকে প্রনাম পূর্ব্বক কহিলেন। হে বিভো! হে সর্ব্বপাপহর! আপনি দেবদেব, সর্বজ্ঞ ও জগৎপিতা হ‌ইয়া এ কি করিতেছেন? হে ত্রিলোচন! হে বিরূপাক্ষ! আপনার এ কি চেষ্টা কি কারণেইবা এরূপ ভাব অবলম্বন করিলেন? হে জগন্নাথ! আপনি ষড়ৈশ্বর্য্যশালী, মায়ার নিয়ন্তা, আপনি ভক্তদিগকে ত্রিলোকের আধিপত্য প্রদান করেন তবে কি নিমিত্ত কুৎসিত ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিলেন ইহাতে আমার অতীব সংশয় হ‌ইয়াছে। 


অনন্তর মহাদেব বিষ্ণুর এই কথা শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে কহিলেন, হে বিষ্ণো! আমি অঙ্গুল্যগ্ৰবর্ত্তী নখ দ্বারা ব্রহ্মার মস্তক ছেদন করিয়াছি। সেই পাপ বিমোচনার্থ এখন আমি এই পবিত্র ব্রত আচরণ করিতেছি।


পুণ্ডরীকলোচন হরি, মহাদেবের এই কথা শুনিয়া অধোবদনে ঈষৎ হাস্য করত পুনর্ব্বার কহিলেন। হে সকল ভুবন স্বামিন্! মহাদেব! আপনার যাহা ইচ্ছা তাহাই করুন, কিন্তু আমাকে মায়াদ্বারা ভুলাইতে পারিবেন না। হে ঈশ! আপনার আজ্ঞানুসারে আমি কল্পে কল্পে এইরূপ কোটি কোটি ব্রহ্মা নিজ নাভিকমল হ‌ইতে সৃষ্টি করিয়া থাকি। সকলেই আপনার অচিন্তনীয় মহামায়ায় বিমোহিত, অত‌এব অকৃতাত্মাজনের এই মায়া পরিহার করুন। হে শিবাপতে! আপনার যেরূপ চেষ্টিত তাহা আমি বিশেষরূপে অবগত আছি। হে হর! সংহারকাল উপস্থিত হ‌ইলে, যখন আপনি দেবতা, মুনি ও বর্ণাশ্রমী লোকদিগকে হরণ করিয়া থাকেন, তখন আপনার ব্রহ্মবধাদি পাপ সকল কোথায় থাকে? অত‌এব আপনি স্বৈর বিহারী সুতরাং কোন কালেই আপনার পরাধীনতা নাই। হে মহাদেব এক্ষণে অতীত ব্রহ্মের অস্থিমালা আপনার কণ্ঠে শোভা পাইতেছে কিন্তু সংহার কাল উপস্থিত হ‌ইলে এই অস্থিমালা ও ব্রহ্মহত্যা কোথায় থাকিবে? যে ব্যক্তি অতি মহাপাতকী, সে যদি ভক্তি পূর্ব্বক জগদীশ্বর জগতের আধার আপনাকে স্মরণ করে, তাহা হ‌ইলে তাহার সমস্ত পাপরাশি দুরীভুত হয়। যে মহাত্মা আপনার পাদ-পদ্ম যুগল সতত চিন্তা করেন, তাঁহার ব্রহ্মহত্যাদি পাশ সকল‌ও বিনষ্ট হ‌ইয়া যায়। যে মানুষের বাক্য আপনার নামে অবিরত অনুরক্ত থাকে, সেই মনুষ্যকে পর্বত শৃঙ্গ প্রমাণ পাপরাশিও আক্রমন করিতে পারে না। হে শিব! রজ ও তমোগুণে বিবর্দ্ধিত পরিতাপ-দায়ক পাপ‌ইবা কোথায়? আর জগতের পাপ-রোগনাশক পরম মঙ্গল জীবনৌষধস্বরূপ তোমার নাম‌ইবা কোথায়? ফলিতার্থ তোমার নামোচ্চরণ করিলে জীবের কোন পাপ‌ই থাকে না। হে অন্ধকরিপো ! শিব, শঙ্কর, চন্দ্রশেখর ইত্যাদি ত্বদীয় নাম যদি কখন‌ও জীবের

ওষ্ঠপুট হ‌ইতে বারম্বার নিঃসৃত হয়, তাহা হ‌ইলে তাহার আর পুনর্বার সংসারে আসিতে হয় না। হে পরমাত্মন্ পরম জ্যোতির্ম্ময় ঈশ্বর! আপনি স্বীয় ইচ্ছায় শরীর ধারণ করেন। আপনার পরাধীনতা কখনোই নাই, তবে যে পরাধীন হ‌ইয়াছেন এ বড় কৌতুকের বিষয়। যাঁহাকে যোগীগণ দর্শন করিতে সমর্থ নহেন, সেই জগৎ-কারণ, অক্ষয়, মহেশ্বর আপনাকে দেখিয়া আমি আজ ধন্য হ‌ইলাম। আপনার দর্শনরূপ অমৃতে পরিতৃপ্ত ব্যক্তির স্বর্গ এবং অপবর্গ‌ও তৃণের ন্যায় তুচ্ছ বোধ হয়, সুতরাং আজ আপনাকে দর্শন করিয়া আমার পরমলাভ ও পরম মঙ্গল হ‌ইল। 


ভগবান্ গোবিন্দ এইপ্রকারে কহিতেছেন, ইতি মধ্যে তদীয় প্রেয়সী লক্ষ্মী মহাদেবের ভিক্ষা পাত্রে অমৃত তুল্য পবিত্র ভিক্ষা প্রদান করিলেন, মহাদেব‌ও ভিক্ষা পাইয়া আনন্দে অন্য স্থানে গমন করিলেন। ভগবান্ জনার্দন, তখন মহাদেবের অনুগামিনী ব্রহ্মহত্যাকে আহ্বান করিয়া, তাঁহার নিকট প্রার্থনা করিলেন, 

হে ব্রহ্মহত্যে! তুমি এক্ষণে শূলপাণিকে পরিত্যাগ কর।


 ব্রহ্মহত্যা কহিলেন, আমি এই স্থানে বৃষবাহন মহাদেবকে সেবা করিয়া আত্মাকে পবিত্র করিব। এরূপ ঘটনা না ‌হ‌ইলে আর মহাদেবের দর্শন কোথায় পাইব। ভগবান্ মুরারী ব্রহ্মহত্যাকে এই কথা কহিলেও মহাদেবের পার্শ্ব পরিত্যাগ করিল না। 


অনন্তর মহাদেব ঈষৎ হাস্য করিয়া হরিকে কহিলেন, হে গোবিন্দ! তুমি আমাকে অনেক সম্মান করিলে, তোমার বাক্যামৃত পান করিয়া আমি পরিতৃপ্ত হ‌ইয়াছি। এক্ষণে তুমি অভিলষিত বর্ প্রার্থনা কর, আমি তোমাকে বর্ প্রদান করিব। ভিক্ষুক ব্যক্তিসকল যেমন মানরূপ সুধাপানে ভিক্ষাটন ক্লেশ দূর করিয়া অত্যন্ত পরিতৃপ্ত হয়, সেইরূপ সম্মান শূন্য প্রচুর পবিত্র ভিক্ষালাভেও তৃপ্ত হয় না। 


মহাবিষ্ণু কহিলেন, হে দেবদেব! আমায় এই বর প্রদান করুন যেন আমি মনোরথ পথের অতীত,

নিখিল দেবতাধিপতি আপনাকে নিয়ত দর্শন করিতে পাই। আমি আর অন্য বর্ প্রার্থনা করিতে চাহি না কেবল এই বর্ প্রার্থনা করি, যেন ভবদীয় চরণযুগলে কখন‌ও বঞ্চিত না হ‌ই।


মহাদেব কহিলেন, হে মহামতে! তুমি যাহা কহিতেছ তাহাই হ‌ইবে এবং তুমি সমস্ত দেবগণের ফলদাতা হ‌ইবে। কালভৈরব এইরূপে দৈত্যারিকে অনুগ্ৰহ করিয়া ক্রমে ব্রহ্মেন্দ্রাদিলোকে বিচরণ করিতে করিতে অবশেষে কৈবল্যধাম বারাণসীতে গমন করিলেন। কাশিস্থিত জীবগণের ষোড়শাংশের একাংশ তুল্য‌ও ব্রহ্মাদী দেবগণের পদ নহে। কারণ ঐ সকল পদ বিপদের আশ্রয় অর্থাৎ উহা হ‌ইতে পতন হ‌ইতে পারে। 


অনন্তর ভীষণকায় কালভৈরব কাশি প্রবেশ মাত্র‌ই তাঁহার অনুগামিনী ব্রহ্মহত্যা হাহা করিয়া পাতালে প্রবেশ করিল। সর্বজন সমক্ষে ব্রহ্মার কপাল হস্ত হ‌ইতে পতিত হ‌ইলো দেখিয়া কালভৈরব পরমানন্দে নৃত্য করিতে লাগিলেন। কালভৈরবের যে ব্রহ্মহত্যা কোন স্থানেই অপগত হয় নাই। সেই ব্রহ্মহত্যা কাশিতে ক্ষণকাল মধ্যে বিনষ্ট হ‌ইল, অত‌এব এই কাশি কিজন্য দুর্লভ নহে? সকলের‌ই এই পুরীর পূজা ও প্রদক্ষিণ করা বিধেয়।

সংগ্ৰহে ও লেখনীতে - নমিতা রায় দেবীজী 


🚩কপিরাইট ও প্রচারে - International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত