🚩 উত্তরভারতে শৈব সিদ্ধান্ত পরম্পরার ইতিহাস

 

☘️ প্রাচীন সিদ্ধান্ত শৈব সম্প্রদায়ভুক্ত অষ্টাদশ শৈব পদ্ধতিকার আচার্য্যবৃন্দ এবং শৈব ধর্মের ইতিহাসে তাঁদের অবদান------

" উগ্রোত্তরজ্যোতিরথো স সদ্যঃ শ্রীরামকণ্ঠোঽপি চ বৈদ্যকণ্ঠঃ |

নারায়ণশ্চাপি বিভূতিকণ্ঠঃ শ্রীনীলকণ্ঠাবপি সোমশংভু || ৩৪২ ||

ঈশানশংভুর্হৃদযাদিনা স্যাৎ বিরিঞ্চিবৈরাগ্যকযুগ্মবাচ্যৌ |

জ্ঞানস্ত্রিণেত্রো বরুণেশ্বরৌ তাবিত্যাদযস্তে স্যুরঘোরশংভুঃ || ৩৪৩ || "

(তথ্যসূত্র - কাঞ্চিপুরনিবাসী শ্রীজ্ঞানশিবাচার্য্য চরণাশ্রিত শ্রীপঞ্চাক্ষর শিবযোগীরচিত 'শৈব ভূষণ')

👉 প্রাচীনকালে সমগ্র উত্তর, মধ্য এবং পূর্বভারত জুড়েই শৈব সিদ্ধান্ত পরম্পরা স্বমহিমায় অত্যন্ত দাপটের সহিত বিরাজমান ছিল। স্থানে স্থানে ছিল একাধিক শৈব মঠ এবং সিদ্ধ শৈব আচার্য্যগণেরা, পরবর্তীতে যাঁরা দাক্ষিণাত্যে বসতি গড়ে তোলেন। শৈব দার্শনিক প্রস্থান গ্রন্থের পাশাপাশি, তাঁরা-ই নিত্য শিব উপাসনা, আত্মার্থ শিব সাধনা, পরার্থ পূজা, নিত্যকর্ম, শৈব দীক্ষা ইত্যাদির 

নিমিত্ত প্রাচীন শৈবতন্ত্র, আগম শাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে একাধিক শৈব অর্চনাপদ্ধতি গ্রন্থ প্রনয়ণ করেন যেগুলির উপর ভিত্তি করে আজও দক্ষিণভারতে শিবের আত্মার্থ ও পরার্থ উপাসনা হয়ে আসছে। এই ১৮ জন শৈব পদ্ধতিকার আচার্য্যেগণের নাম প্রাচীন শাস্ত্রে উল্লেখিত হয়েছে, তাঁরা হলেন - 

১. আচার্য্য উগ্রজ্যোতি, ২. আচার্য্য সদ্যোজ্যোতি,  ৩. রামকণ্ঠাচার্য্য, ৪. বিদ্যাকণ্ঠাচার্য্য, ৫. আচার্য্য নারায়ণকণ্ঠ, ৬. আচার্য্য বিভূতিকন্ঠ, ৭. আচার্য্য শ্রীকণ্ঠ, ৮. আচার্য্য নীলকণ্ঠ, ৯. ভগবান সোমশম্ভু,  ১০. ঈশানশম্ভু, ১১. হৃদয়শম্ভু, ১২. ব্রহ্মশম্ভু,  ১৩. বৈরাগ্যশম্ভু, ১৪. জ্ঞানশিবাচার্য্য,  ১৫. আচার্য্য ত্রিলোচনশিব, ১৬. আচার্য্য বরুণশিব, ১৭. আচার্য্য ঈশ্বরশিব এবং ১৮. অঘোরশিবাচার্য্য ।

👉 পরম্পরা - 

আচার্য্য উগ্রজ্যোতি হতে আচার্য্য ভট্ট নারায়ণকণ্ঠ পর্যন্ত প্রচলিত পরম্পরা প্রাচীন শৈব সিদ্ধান্ত পরম্পরা (Classical Saiva Sidhhanta) বা শৈব কর্মাবরণ পরম্পরা নামে অভিহিত। আচার্য্য সদ্যোজ্যোতির সময়কাল ছিল আনুমানিক ৬ষ্ঠ থেকে ৭ম শতকে। রৌরব তন্ত্রের জ্ঞান সাক্ষাৎ শ্রীকণ্ঠরুদ্রের কাছ থেকে এই পরম্পরার আদি গুরু আচার্য্য রুরু সর্বপ্রথম প্রাপ্ত করেন তারপর সেই জ্ঞান ক্রমশ কালক্রমে পরম্পরা ক্রমে প্রবাহিত হতে থাকে।

সদাশিব ----- অনন্ত ভট্টারক ----- শ্রীকণ্ঠনাথ ---- ব্রহ্মনেশ ------ নন্দী ---- ব্রহ্মা, রুরু ও অন্যান্য ঋষিগণ।

রুরু ----- আত্রেয় ----- উগ্রজ্যোতি ----- সদ্যোজ্যোতি ও বৃহস্পতি (শিবতনু শাস্ত্রের রচয়িতা)।

সদ্যোজ্যোতি ---- (discontinued) ----- ভট্ট রামকণ্ঠ I ----- ভট্ট বিদ্যাকণ্ঠ I এবং ভট্ট শ্রীকণ্ঠ।

ভট্ট বিদ্যাকণ্ঠ I----- ভট্ট নারায়ণকণ্ঠ ---- ভট্ট রামকণ্ঠ II ---- ভট্ট বিদ্যাকণ্ঠ II 

(বিঃদ্রঃ - ভট্ট রামকণ্ঠ এবং ত্রিক আচার্য্য রাজানক রামকণ্ঠ উভয়েই কাশ্মীর নিবাসী হলেও উভয়ে কিন্তু পৃথক । একই ভাবে, 'স্তবচিন্তামণি' কার ত্রিক আচার্য্য ভট্ট নারায়ণ এবং সিদ্ধান্ত শৈব আচার্য্য ভট্ট নারায়ণকণ্ঠ উভয়েই কিন্তু পৃথক ব্যক্তি।)

    ----- এই ক্রমেই এই পরম্পরা চলে এবং পুনরায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শিবমহাপুরাণ বায়বীয় সংহিতা মতে আচার্য্য রুরু ছিলেন একজন মহান পাশুপত আচার্য্য। উগ্রজ্যোতি হতে রামকণ্ঠ দ্বিতীয় পর্যন্ত প্রচলিত ক্রম কাশ্মীর প্রদেশে বিস্তার লাভ করে, আচার্য্যরা প্রাচীন কাশ্মীর প্রদেশেরই অধিবাসী ছিলেন। শৈব তন্ত্রাগম শাস্ত্রের ইতিহাসে আচার্য্য সদ্যোজ্যোতিই সর্বপ্রথম কোনো শৈব তন্ত্রের উপরে টীকা রচনা করেন, নাম - স্বায়ম্ভুবসূত্রটীকা এবং রৌরবসূত্রটীকা অর্থাৎ স্বায়ম্ভুবসূত্রসংগ্রহ (স্বায়ম্ভুবাগম) এর উপর রচিত টীকা এবং রৌরব তন্ত্রের উপর রচিত টীকা। সদ্যোজ্যোতি কৃত আগম ভাষ্যগুলির মধ্যে 'স্বায়ম্ভুবসূত্রটীকা' আজও উপলব্ধ। প্রাচীন ত্রিক শৈব আচার্য্য শ্রীসোমানন্দও তাঁর 'শিবদৃষ্টি' তে এবং অভিনবগুপ্তপাদাচার্য্যও তাঁর 'তন্ত্রালোকে' 'স্বায়ম্ভুবটীকাকার গুরুদেব 'খেটকবাল' নামে আচার্য্য সদ্যোজ্যোতির উল্লেখ করে গেছেন। (খেটপাল = খেটকবাল = খেটকনন্দন = সদ্যোজ্যোতি)। তাছাড়া, ভট্টরামকণ্ঠ II এর উল্লেখ 'শিবদৃষ্টি'তে মতঙ্গ আগম টীকাকার ' ব্যাখ্যানিগুরু ' নামে শ্রীসোমানন্দ করে গিয়েছেন - " তথা মতঙ্গটীকাযাং ব্যাখ্যানিগুরুণোদিতম্ || " (শিবদৃষ্টি/তৃতীয় আহ্নিক/১৪)। তাছাড়া আচার্য্য ক্ষেমরাজ তাঁর স্বচ্ছন্দতন্ত্র ভাষ্যে ভট্ট নারায়ণকণ্ঠ এবং তাঁর মৃগেন্দ্রবৃত্তি টীকার উল্লেখ করে গিয়েছেন। অভিনবগুপ্তের তন্ত্রালোক এবং জয়রথ রচিত তন্ত্রালোক ভাষ্যে 'শিবতনুশাস্ত্রের' রচয়িতা আচার্য্য বৃহস্পতির উল্লেখ মেলে।

যদিও ত্রিক সম্প্রদায় এবং ক্ল্যাসিকাল শৈব সিদ্ধান্ত এই উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই দার্শনিক ভেদ এবং সিদ্ধান্তগত বিবাদ স্পষ্ট ছিল যা শিবদৃষ্টি, তন্ত্রালোক এবং মালিনীবিজয়বার্ত্তিক পড়লেই বোঝা যায়। সদ্যোজ্যোতি, নারায়ণকন্ঠ, রামকণ্ঠ কর্তৃক একাধিক সিদ্ধান্ত শৈব আগমের তথা মালিনীবিজয়োত্তর, স্বচ্ছন্দ ইত্যাদি ত্রিক আগমের দ্বৈত ব্যাখ্যা, দ্বৈত ভাষ্য হতে নিজ সম্প্রদায়কে রক্ষা হেতুই যে অভিনবগুপ্ত এবং ক্ষেমরাজ যে এই আগমগুলির উপর অদ্বৈত ব্যাখ্যা রচনা করেন তা বলা বাহুল্য।

অন্যদিকে, 

ভগবান সোমশম্ভু, ঈশানশম্ভু, হৃদয়শম্ভু এনারা ছিলেন প্রাচীনকালে মহর্ষি দূর্বাসা প্রবর্তিত শৈব সিদ্ধান্ত পরম্পরাভুক্ত, যা আচার্য্য জ্ঞানশম্ভু এবং অনন্তশম্ভু কর্তৃক সমর্থিত। মহাশৈব দূর্বাসা (ক্রোধভট্টারক) ছিলেন একজন মহাপাশুপত আচার্য্য তথা শ্রীকণ্ঠরুদ্রাবতার। মতান্তরে তাঁরই নাম গুহাবাসী সিদ্ধ। কলিযুগে একমাত্র তিনিই মর্ত্যলোকে শৈব শাস্ত্রের ও পরম্পরার প্রণেতা ছিলেন। তাঁর রচিত 'পরশম্ভুমহিম্নস্তব' আজও উপলব্ধ। কলিযুগের একদম প্রাক্কালে তিনি আমর্দক মঠ এর স্থাপনা করেন এবং সনকাদি ঋষি তথা গৌতম, অগস্ত্য, ভরদ্বাজ প্রমুখ আদি শৈব ঋষিকে শৈব সিদ্ধান্ত জ্ঞানে দীক্ষিত করেন। সনকাদি চার ঋষিদের দ্বারা আমর্দক মঠের অধীন চারটি পৃথক মঠও গড়ে ওঠে - গোলকী, রণভদ্র, পুষ্পগিরি ইত্যাদি। 

সনৎকুমার প্রতিষ্ঠা করেন --- আমর্দক মঠ

সনক প্রতিষ্ঠা করেন --- পুষ্পগিরি মঠ

সনাতন প্রতিষ্ঠা করেন --- গোলকী মঠ 

সনন্দন প্রতিষ্ঠাকরেন--- রণভদ্র মঠ

এমনটাই বর্ণিত রয়েছে অনন্তশম্ভুকৃত সিদ্ধান্তসারাবলী টীকায়।

কলির পরবর্তী সময়কালে দূর্বাসা পরম্পরা হতে সদ্ভাব শম্ভু এবং তাঁরও পরবর্তীতে আমর্দক তীর্থনাথ/রুদ্রশম্ভু আসেন এবং আমর্দক মঠের পুনঃস্থাপনা করেন। এই আমর্দক মঠ হতেই সমগ্র উত্তর, পূর্ব ও মধ্যভারতে শৈব সিদ্ধান্ত মত ছড়িয়ে পড়ে। এই আমর্দক মঠ হতে মত্তময়ূর সম্প্রদায়, মধুমেয়ত্ত সম্প্রদায় এবং গোলকী মঠ সম্প্রদায় ছড়িয়ে পড়ে। এই গোলকী মঠ সম্প্রদায়ের নবীন প্রবর্তক প্রভাবশম্ভু/সদ্ভাবশম্ভু। এই গোলকী মঠের শাখা গৌড়বঙ্গের দেবকোটেও স্থাপিত হয়। মধ্যভারত ও গৌড়বঙ্গের এই গোলকী/গোলাগি মঠ ও তার শাখা গুলি হতেই পরবর্তীতে বাকি পদ্ধতিকার আচার্য্যরা আসেন। আচার্য্য ঈশানশিব গুরুদেবের শিষ্য বিমলশিব, তাঁর শিষ্য শর্বশিব এবং তাঁর শিষ্য ছিলেন আচার্য্য সোমশম্ভু, এমনটাই 'কর্মকাণ্ডক্রমাবলি'-তে উক্ত হয়েছে। গৌড়দেশের দেবকোট (বর্তমান বাণগড়) প্রদেশের এই সিদ্ধান্ত শৈব আচার্য্য পরম্পরাকেও মত্তময়ূর সম্প্রদায় বলা হত (আচার্য্য ধর্মশিব, বিদ্যাশিব, মূর্তিশিব, সারশিব প্রমুখ ছিলেন উল্লেখযোগ্য।)

দূর্বাসা - আমর্দক পরম্পরার সাথে সদ্যোজ্যোতি - রামকণ্ঠ এই পরম্পরার যে প্রত্যক্ষ যোগসূত্র ছিল তার সমর্থন শৈব দর্শন কেশরী কান্তিচন্দ্র পাণ্ডে মহাশয় করে গিয়েছেন। তাঁর মতে, ভট্ট রামকণ্ঠ II এর সাক্ষাৎ শিষ্য ছিলেন মত্তময়ূর শৈব অঘোর শিবাচার্য্য। তবে এই মতকে নাকচ করে দেন প্রখ্যাত শৈব সিদ্ধান্তবাদী পণ্ডিত, শৈব আগমবাগীশ ভট্ট নিদ্যোদি রামচন্দ্র। তাঁর মতে, ভট্ট রামকণ্ঠ II এর সময়কাল অঘোর শিবাচার্যের অনেককাল পূর্বে ছিল। মত্তময়ূর অঘোর শিবাচার্য্য রামকণ্ঠ II এর দার্শনিক প্রস্থান গুলির দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং সেগুলোর উপরে নিজে পুনঃ ভাষ্যও রচনা করেন, কিন্তু তিনি রামকণ্ঠের সরাসরি শিষ্য ছিলেন না।

👉শৈব পরম্পরাগত জ্ঞানের সাধারণ প্রসারক্রম নিম্নরূপ -

পরমশিব---- পরাশক্তি (পরাবাক্) ---- অনাশ্রিত ---- অনাথ ---- অনন্ত ----- ব্যাপিশ --- ব্যোমরূপ ---- সাদাখ্য সদাশিব (মন্ত্রমহেশ্বর) ----- মন্ত্রেশ্বর প্রমাতা ---- মন্ত্র/বিদ্যেশ্বর (অনন্ত ভট্টারক বা অনন্তেশ, নিধনেশ, ব্রহ্মনেশ, অনাদিরুদ্র, প্রণবশিব, সুশিব প্রমুখ) ----- শ্রীকণ্ঠনাথ/শ্রীকণ্ঠরুদ্র (বিজ্ঞানকল) ------ সকল প্রমাতা (ঋষি, মুনি, স্কন্দ, দেবতাগণ, নন্দী প্রমুখ)

👉শৈব সমাজে তাঁদের অবদান -

১. আচার্য্য উগ্রজ্যোতি - 

রৌরব আগম পরম্পরার প্রবর্তক মহাপাশুপত আচার্য্য রুরু এঁর প্রশিষ্য ছিলেন উগ্রজ্যোতি। ভোগকারিকা এবং নরেশ্বরপরীক্ষা-য় আচার্য্য সদ্যোজ্যোতি এনাকে নিজ গুরু হিসেবে অভিহিত করেছেন। উগ্রজ্যোতিকৃত কোনো শাস্ত্রই আজ উপলব্ধ নয়।

২. আচার্য্য সদ্যোজ্যোতি - 

ইনি ছিলেন রৌরব আগম পরম্পরার প্রত্যক্ষ আচার্য্য। একমাত্র নায়নার তিরুমুলার রচিত তিরুমন্তিরাম তন্ত্র ব্যতীত জগতে যখন কোনো প্রাচীন তন্ত্রের কোনো লিখিত রূপ তথা ভাষ্য ছিল না, সেসময় সর্বপ্রথম কোনো তন্ত্রের উপরে কোনো আচার্য্য কর্তৃক কোনো ভাষ্য রচিত হয় সমগ্র তন্ত্রের ইতিহাসে (৬ঠ - ৭ম শতক), তিনিই আচার্য্য সদ্যোজ্যোতি। যদিও তাঁর রচিত কোনো পদ্ধতি গ্রন্থের নাম আজ মেলে না তবুও শৈব সমাজে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর কৃতিত্ব -

a. রৌরবসূত্রসংগ্রহের (রৌরবতন্ত্র) উপর টীকা- ইহা লুপ্ত।

b. স্বায়ম্ভুবসূত্রসংগ্রহের (স্বায়ম্ভুব আগম) উপর টীকা - ইহা আজও উপলব্ধ।

c. ভোগকারিকা - ইহা আজও উপলব্ধ।

d. নরেশ্বরপরীক্ষা - ইহা আজও উপলব্ধ।

e. মোক্ষকারিকা - ইহা আজও উপলব্ধ।

f. পরামোক্ষনিরাসকারিকা (বেদান্তমত খণ্ডন)- ইহা আজও উপলব্ধ।

g. তত্ত্বত্রয়নির্ণয় - ইহা আজও উপলব্ধ।

h. তত্ত্বসংগ্রহ - ইহা আজও উপলব্ধ।

i. মন্ত্রবার্ত্তিক - ইহা আজ লুপ্ত।

৩. ভট্ট রামকণ্ঠাচার্য্য I এবং II-

ভট্টরাম কণ্ঠ I ছিলেন ভট্ট নারায়ণকণ্ঠের পরমগুরু। তাঁর লেখা একটিমাত্র শাস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায় যার নাম - 'সদ্-বৃত্তি', যা আজ লুপ্ত। তাঁর রচিত বাকি শাস্ত্র সম্পর্কে জানা যায় না। অন্যদিকে ভট্ট রামকণ্ঠ II এঁর একাধিক শাস্ত্র আজও পাওয়া যায়। কিরণ তন্ত্রের ভাষ্যে তিনি কৌলমত এবং মহাব্রতাদি (কালামুখ, কাপাল) মতকে অশৈব মত হিসেবে আখ্যায়িত করেন, তার পাশাপাশি তিনি বাম, দক্ষিণ, পূর্ব এবং পশ্চিম স্রোতের শৈব তন্ত্রাবলীকে নিকৃষ্ট এবং ঊর্ধ্ব স্রোতের সিদ্ধান্ত তন্ত্র গুলিকে একমাত্র উচ্চ শ্রেণির তন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন। নিম্নবর্ণের ব্যক্তিদের শৈব দীক্ষা প্রদানের ব্যাপারে ঘোর বিরোধী ছিলেন যার প্রমাণ তাঁর রচিত 'সার্ধত্রিশতিকালোত্তর তন্ত্র' টীকায় দেখতে পাওয়া, এই মতকে অভিনবগুপ্ত তাঁর মালিনীবিজয়বার্ত্তিকে কৌশলে খণ্ডন করেন। তাছাড়া, তাঁর মতে বেদ, পুরাণ, স্মৃতি শাস্ত্র সাক্ষাৎ সদাশিব কর্তৃক রচিত নয় বরং অসর্বজ্ঞ ঋষিদের দ্বারা রচিত জন্য তিনি সেইসব শাস্ত্রকে অপ্রমাণ হিসেবে ঘোষণা করে গিয়েছেন কিরণ বৃত্তিতে। তাঁকে 'ব্যাখ্যানি গুরু' নামে শ্রীসোমানন্দ তাঁর শিবদৃষ্টিতে উল্লেখ করে গিয়েছেন।

যদিও তাঁর দ্বারা রচিত কোনো শৈব পদ্ধতি শাস্ত্রের উল্লেখ মেলে না। তাঁর কৃতিত্ব -

a. কিরণতন্ত্র বৃত্তি - যা আজ উপলব্ধ ।

b. মাতঙ্গ পরমেশ্বর আগম টীকা - যা আজও উপলব্ধ। 

c. সার্ধত্রিশতিকালোত্তর তন্ত্র টীকা - যা আজও উপলব্ধ।

d. সদ্যোজ্যোতি রচিত 'রৌরবতন্ত্র বৃত্তির' উপরে 'সুবৃত্তি' টীকা 

e. সদ্যোজ্যোতি রচিত ' মন্ত্রবিবেক ' এর উপর টীকা

f. আগমবিবেক

g. নাদকারিকা 

h. জাতি-নির্ণয়-পূর্বক-আলয়-প্রবেশ-বিধি

i. ব্যোমব্যাপিস্তব 

j. সদ্যোজ্যোতি রচিত মোক্ষকারিকা এর উপরে টীকা।

k. সদ্যোজ্যোতি রচিত পরামোক্ষনিরাসকারিকা এর উপরে টীকা।

l. সদ্যোজ্যোতি রচিত নরেশ্বরপরীক্ষা এর উপরে টীকা।

৪. ভট্ট বিদ্যাকণ্ঠাচার্য্য I - 

ইনি ভট্ট নারায়ণকণ্ঠের গুরু। ইনি রচনা করেন 'ভাবচূড়ামণি' তন্ত্র (তন্ত্র স্মৃতি) যা আজও উপলব্ধ। ( ইহা নব্য শাক্ত তন্ত্র ভাবচূড়ামণি/তন্ত্রচূড়ামণি হতে পৃথক।) তবে এনার দ্বারা রচিত কোনো শৈব পদ্ধতি মূলক শাস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায় না।

৫. আচার্য্য ভট্ট নারায়ণকণ্ঠ -

ইনি ভট্ট রামকণ্ঠ II এর গুরু তথা পিতা এবং ভট্টবিদ্যাকণ্ঠের (I) শিষ্য তথা পুত্র ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব - 

a. সম্পূর্ণ মৃগেন্দ্রতন্ত্রের উপরে ভাষ্য রচনা, যা আজও উপলব্ধ। 

b. সদ্যোজ্যোতি কৃত 'তত্ত্বসংগ্রহের' উপর রচিত বৃহৎ টীকা, যার নাম 'সারান্নিশ', যা আজ লুপ্ত।

 তবে এনার দ্বারা রচিত কোনো শৈব পদ্ধতি মূলক শাস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায় না। ইনি এবং 'স্তবচিন্তামণি'কার ত্রিক আচার্য্য ভট্ট নারায়ণ উভয়েই কাশ্মীর নিবাসী হলেও উভয়ে কিন্তু পৃথক ব্যক্তি।

৬. আচার্য্য বিভূতিকন্ঠ - এনার লেখা শাস্ত্রসমূহ আজ লুপ্ত।

৭. আচার্য্য শ্রীকণ্ঠ - 

ইনি ভট্ট রামকণ্ঠাচার্য্য I এর শিষ্য ছিলেন। ইনি রচনা করেন 'রত্নত্রয়পরীক্ষা' (ইহা অপ্পয় দীক্ষিত রচিত রত্নত্রয়পরীক্ষা হতে ভিন্ন)। তাছাড়া নির্মলমণি আচার্য্য রচিত ক্রিয়াক্রমোদ্যতিকা প্রভা ব্যাখ্যা তে শ্রীকণ্ঠপদ্ধতি নামক গ্রন্থেরও উল্লেখ মেলে, যা সম্ভবত আচার্য্য শ্রীকণ্ঠ রচিত ছিল।

৮. আচার্য্য নীলকণ্ঠ - 

এনার রচিত শাস্ত্রসমূহ আজ বিলুপ্ত। ইনি এবং স্কন্দ শৈবসিদ্ধান্ত পরম্পরার গুরু (আচার্য্য শিবাগ্রযোগীর পরম্পরা) নীলকণ্ঠ আচার্য্য উভয়েই এক কিনা সেই ব্যাপারে further গবেষণা ব্যতীত স্পষ্ট কিছু বলা সম্ভব নয়।

৯. ভগবান সোমশম্ভু - 

এনার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ ' সোমশম্ভুপদ্ধতি'/ ' কর্মকাণ্ডক্রমাবলী' । এর থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে অঘোর শিবাচার্য্য রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'ক্রিয়াকর্মোদ্যোতিকা'।

১০. ঈশানশম্ভু - ইনি রচনা করেন ঈশানশিবগুরুদেবপদ্ধতি/তন্ত্রসারপদ্ধতি/ সিদ্ধান্তসার পদ্ধতি যা আজও উপলব্ধ। ইনি আচার্য্য সোমশম্ভুর পরমেষ্টি গুরু যা ' কর্মকাণ্ডক্রমাবলী' তে সোমশম্ভু নিজেই বলে গিয়েছেন।

১১. হৃদয়শম্ভু/ সর্বাত্মা শম্ভু - ইনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত বই ' সিদ্ধান্তপ্রকাশিকা'। ইনি অঘোর শিবাচার্য্য এর গুরু যা 'তত্ত্বত্রয়নির্ণয়বৃত্তি' তে অঘোরশিবাচার্য্য নিজেই বলে গিয়েছেন।

১২. ব্রহ্মশম্ভু - ইনি রচনা করেন ' ব্রহ্মশম্ভুপদ্ধতি' যা আজ লুপ্ত। ইনি গৌড়দেশ হতে দক্ষিণে গমন করেন। এনারই শিষ্য পরম্পরা ধারার একজন শিষ্য ছিলেন 'নটরাজপদ্ধতি' কার আচার্য্য রামনাথ।

১৩. বৈরাগ্যশম্ভু - এনার রচিত শাস্ত্রসমূহ আজ বিলুপ্ত।

১৪. জ্ঞানশিবাচার্য্য - 

জ্ঞানশম্ভু রচনা করেন 'জ্ঞানরত্নাবলী' এবং 'শিবপূজাস্তব' যা আজও উপলব্ধ। ভট্ট রামকণ্ঠ II তাঁর 'কিরণতন্ত্র_ভাষ্যে' কৌলমতকে যে খণ্ডন করেছিলেন, তাঁর মীমাংসা স্বরূপ এই জ্ঞানরত্নাবলীতে-ই শৈব আচার্য্যদের অন্তঃ কৌল স্বভাব এর যথাযথ ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং মৎস্যেন্দ্রনাথের 'কৌলজ্ঞাননির্ণয়' থেকে শ্লোক উদ্ধৃত করে কুল ও অকুল তত্ত্বের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ' শিবপূজস্তব' শিবের আত্মার্থ উপাসনার উপর রচিত একটি উচ্চকোটির গ্রন্থ। আচার্য্য জ্ঞানশম্ভুর ই শিষ্য পঞ্চাক্ষরযোগী, যিনি রচনা করেন 'শৈবভূষণ' ।

১৫. আচার্য্য ত্রিলোচনশিব - 

এনার বিখ্যাত রচনা 'সিদ্ধান্তসারাবলী' যেটি নিজেই একটি সম্পূর্ণ তন্ত্র (তন্ত্র স্মৃতি), যা আজও উপলব্ধ। ইহার উপর টীকা রচনা করেন আচার্য্য অনন্তশম্ভু।

১৬. আচার্য্য বরুণশিব -

 ইনি রচনা করেন 'বরুণপদ্ধতি', যা আজও উপলব্ধ। ইহার উপরে ভট্ট শিবোত্তম রচিত 'বরুণপদ্ধতিবৃত্তি' এবং নিগমজ্ঞানদেশিক II রচিত 'বিলোচন' ব্যাখ্যা আজও উপলব্ধ।

১৭. আচার্য্য ঈশ্বরশিব - 

এনার সম্পর্কে জানা যায় না। তবে বামকেশ্বরীমত টীকায় আচার্য্য জয়রথ ঈশ্বরশিব নামক একজন আচার্য্যকে এই বামকেশ্বরীমত ঘরানার (শ্রীবিদ্যাসম্প্রদায়) সংস্থাপক হিসেবে মেনে গিয়েছেন। এখন এই উভয় ঈশ্বরশিব একই ব্যক্তি কিনা তা further গবেষণা ব্যতীত সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়।

১৮. অঘোর শিবাচার্য্য -

মধ্যভারত এবং গৌড় দেশে প্রবর্তিত দূর্বাসা- আমর্দক সম্প্রদায় ভুক্ত একজন বিখ্যাত সিদ্ধ আচার্য্য ছিলেন অঘোর শিবাচার্য্য যিনি চিদম্বরনিবাসী ছিলেন। শৈব সমাজের ইতিহাসে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর কৃতিত্ব গুলি হল -

a. ক্রিয়াক্রমোদ্যতিকা (the Magnum Opus), যা 'অঘোর শিবাচার্য্য পদ্ধতি' নামেও পরিচিত, যার অনুকরণে আজও দক্ষিণের মন্দির গুলোতে শিবের উপাসনা হয়ে আসছে। ইহার উপরে গুরুদেব নির্মলমণিকৃত প্রভা ব্যাখ্যা এবং আচার্য্য নটেশশম্ভু কৃত টীকা আজও উপলব্ধ।

b. পঞ্চাবরণস্তব ।

c. শ্রীকণ্ঠের রত্নত্রয়পরীক্ষার উপরে 'উল্লেখিনী' ভাষ্য।

d. সদ্যোজ্যোতি রচিত ভোগকারিকার উপরে টীকা ব্যাখ্যা।

e. সদ্যোজ্যোতি রচিত তত্ত্বসংগ্রহের উপরে লঘুটীকা।

f. মহাশৈব ভোজদেব/ভোজরাজ রচিত তত্ত্বপ্রকাশ এর উপরে টীকা ব্যাখ্যা।

g. সদ্যোজ্যোতি রচিত তত্ত্বত্রয়নির্ণয় এর উপরে টীকা।

h. সর্বজ্ঞানোত্তর তন্ত্রের উপর ভাষ্য।

i. ভট্ট রামকণ্ঠ এই রচিত নাদকারিকার উপরে ব্যাখ্যা।

j. কিরণ মহাতন্ত্রের উপর বৃত্তি ভাষ্য।

k. ভট্ট নারায়ণকণ্ঠের মৃগেন্দ্রবৃত্তি এর উপরে পুনঃ ভাষ্য (মৃগেন্দ্রবৃত্তিদীপিকা)।

l. মৃগেন্দ্রপদ্ধতি (মৃগেন্দ্রতন্ত্র ভিত্তিক)।

m. সর্ববিদ্যেশিনি।

n. আচার্য্যসার।

o. ভক্ত প্রকাশ।

p. নাট্য অভ্যুদয়ম্।

q. পাখণ্ডপযপ।

তাছাড়া আচার্য্য অনন্তশম্ভু রচিত সিদ্ধান্তসারাবলী টীকা, আচার্য্য বিমলশিব রচিত বিমলবতিতন্ত্র, আচার্য্য রামনাথ রচিত নটরাজপদ্ধতি/রামনাথপদ্ধতি, আচার্য্য বামদেব রচিত বামদেবপদ্ধতি, মহর্ষি পতঞ্জলি (নন্দিনাথ পরম্পরা) রচিত চিদম্বরনিত্যপূজাসূত্র, নির্মলমণি আচার্য্য রচিত ক্রিয়াক্রমোদ্যতিকা 'প্রভা ব্যাখ্যা', নিগমজ্ঞানদেশিকাচার্য্য II রচিত 'আত্মার্থপূজাপদ্ধতি', শিবাগ্রযোগীর ক্রিয়াদীপিকা, স্কন্দগুরুদেব পদ্ধতি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য - এগুলো আজও উপলব্ধ।।

👉 গবেষণা ও লিখনে - ©RohitKumarChoudhury(ISSGT)

👉 Source - extracted from the Research Paper - 

Choudhury et al., (2023). "Agamas, their authenticity and their three fold and seven fold revelation from Parasiva: Ancient agamic traditions with a special focus on Trika Saiva agamic cult." Indica. 

👉 Thankful to Pandit Acarya Niddodi Ramachandra Bhatt and Dominic Goodall.

© Copyright is strictly restricted only to author and International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT.