“শক্তি” সর্বদা পরমশিবেই (ব্রহ্ম) লীন হন, শিব কদাপি শক্তিতে লীন হননা - শৈবাচার্য ও শৈবশাস্ত্র অনুসারে



কাশ্মীর ত্রিক ভৈরবাগম সম্প্রদায়ের বংশানুক্রমিক প্রত্যক্ষ শৈবাচার্য্য, মহামাহেশ্বরাচার্য্য অভিনবগুপ্তপাদের পরমেষ্ঠি গুরু বিদগ্ধ পণ্ডিত তথা সাধক ভগবান শ্রীসোমানন্দপাদ তাঁর 'শাক্তবিজ্ঞান' শাস্ত্রে স্পষ্টভাবেই বলছেন - 


"অন্তাবস্থা সমাখ্যাতা বিশ্রামস্ত্বধুনোচ্যতে | ১৫ |  

যদা সা পরমা শক্তিঃ সুলীনা পরমে পদে || ১৬ || 

তদা ন বিন্দতে কিঞ্চিদ্বিষযী বিষযান্তরম্ | 

শিবে বিশ্রাম্যতে শক্তিস্তদা বিশ্রাম উচ্যতে || ১৭ || 

যত্র বিশ্রমণং শক্তের্মনস্তত্র লযং ব্রজেৎ |  

তদাত্মা পরমাত্মত্বে জ্ঞাতব্যো নিশ্চিতাত্মভিঃ || ১৮ ||

 শিবীভূতো ভবত্যাত্মা পরিণামঃ স এবহি | ১৯ |" 

(তথ্যসূত্র- 'শাক্তবিজ্ঞান'/শ্রীসোমানন্দপাদ বিরচিত)

ভাবার্থ - স্থান, প্রবেশ, রূপ, লক্ষ্য, লক্ষ্যণ, উত্থাপন, বোধন, চক্রবিশ্রাম, ভূমিকাগমন, অন্তাবস্থা, বিশ্রাম, পরিণাম এবং আগমন - শাক্তবিজ্ঞানের এই ১৩ টি স্বরূপ সাক্ষাৎ শিব কর্তৃক শাস্ত্রে কথিত হয়েছে। শিবযোগীর নাভিকন্দ-চক্রস্থিত গ্রন্থি বিদীর্ণ হলে তৎ বিন্দু হতে পরাশক্তির যে স্ফূরণ ঘটে তাহাই 'অন্তাবস্থা' । সেই পরাশক্তি পরমপদ শিব পদে যখন অন্তর্লীন হন, সেই সময় বিষয়-বিষয়ী মূলক কোনো ভেদ থাকে না। শিবে এভাবেই শক্তি বিশ্রান্তি লাভ করেন, ইহাই 'বিশ্রাম'। শিবেই শক্তির বিশ্রাম তথা শিবেই মন (সূক্ষ্ম মন) তত্ত্বের লয় ঘটে। এইভাবেই সেই শক্তিও পরমাত্মক-ই বটে, এটা নিশ্চিত কেননা শিবীভূত হওয়া অর্থাৎ সাক্ষাৎ শিব হয়ে যাওয়া - এটাই শক্তির পরিণাম।

এ প্রসঙ্গে দূর্বাসা-আমর্দক ক্রমের শৈবাচার্য্য শ্রীজ্ঞানশম্ভু-ও তাঁর 'জ্ঞানরত্নাবলী'-তে বলছেন -

" যদুক্তং মহাকৌলজ্ঞাননির্ণযে মৎস্যনাথাবতারিতে চন্দ্রী দীপ বিনির্গতে | জ্ঞানমধ্যে ক্রিযালীনা জ্ঞানীচ্ছা চ লযং গতঃ | ইচ্ছাশক্তি লযোধাত্র স দেবঃ পরমঃ শিবঃ | তস্মান্নিরঞ্জনঃ শান্তঃ শিবঃ শক্তেশ্চ কারণম্ | সর্বসামেব শক্তীনাং হেতুঃ সর্বগতঃ শিবঃ | ন শক্তেঃ পরতন্ত্রত্বাৎ বিশ্বোপাদানমাস্থিতে || ইত্যাদি বাক্যানি শক্তানি শিবত্ব প্রতিপাদকানি বহূনিসন্তি | "

অর্থ - অবতার মৎস্যেন্দ্রনাথ কর্তৃক মহাকৌলজ্ঞাননির্ণয়ে ইহা উক্ত হয়েছে যে - ক্রিয়াশক্তি জ্ঞানে, জ্ঞান শক্তি ইচ্ছা শক্তিতে লয় পায় এবং এই অন্তিম ইচ্ছাশক্তিও সাক্ষাৎ পরমশিবে অন্তর্লীন হয়ে থাকে। সেই নিরঞ্জন শান্ত, সর্বগত শিব-ই শক্তির কারণ, হেতু। শক্তি পরতন্ত্র নয় , শক্তি বিশ্বের উপাদান কারণ - ইত্যাদি আগম বাক্যের দ্বারা প্রকৃতপক্ষে শক্তির শিবত্ব-ই প্রতিপাদিত হয়ে থাকে অর্থাৎ 'শক্তি' শব্দের দ্বারা সেক্ষেত্রে শিব-ই বাচিত হন।


কৌলজ্ঞাননির্ণয় থেকে এবার এই উক্তিটি দেখে নেবো -

ভৈরব উবাচ্ -

" শিব মধ্যে গতা শক্তিঃ ক্রিযামধ্যস্থিত শিবঃ | 

জ্ঞানমধ্যে ক্রিয়া লীনা ক্রিয়া লীযতি ইচ্ছযা || ৬ ||

 ইচ্ছাশক্তিলযং যাতি যত্র তেজঃ পরঃ শিবঃ || ৭ || "

(শৈব নাথযোগী মহাকৌল মৎস্যেন্দ্রনাথ রচিত কৌলজ্ঞাননির্ণয়/ ২য় পটল)

অর্থ - শিবের মধ্যে শক্তিতত্ত্ব লীন পায়, সেই শিবতত্ত্ব তারপর লীন পায় ক্রিয়াশক্তিতে, ত্রিয়াশক্তির লয় ঘটে জ্ঞানশক্তিতে, জ্ঞান শক্তির লয় ঘটে ইচ্ছা শক্তিতে এবং সেই ইচ্ছাশক্তি লয় পায় সাক্ষাৎ পরমশিবের তেজে। 


শিবসংহিতায় সাক্ষাৎ শিব বলছেন -

 শ্রীঈশ্বর উবাচ্-

"কৈলাসৌ নাম তস্মৈব মহেশো যত্র তিষ্ঠতি |

অকুলাখ্য বিলাসী চ ক্ষয়বৃদ্ধিবিবর্জ্জিতঃ ||১৫২||

অত্র কুণ্ডলীনি শক্তির্লয়ং যাতি কুলাভিধা |

তদা চতুর্বিধা সৃষ্টিলীয়তে পরমাত্মনি || ১৫৭ || "

(তথ্যসূত্র- শিবসংহিতা/পঞ্চম পটল )

অর্থ- সেই সহস্রদল পদ্মের নামই কৈলাস (জ্ঞানকৈলাস), পরমধাম , যেখানে অকুল (পরমশিব স্বরূপ) মহেশ্বরের নিত্য অধিষ্ঠান। তিনি নিত্যবিলাসী, তার ক্ষয়, উদয় নাই। কুণ্ডলিনী শক্তি যখন পরমশিবের সাথে মিলিত হওয়ার পর পরমশিবেই বিলীন হয়ে যায় তখন সেই পরমাত্মাতেই তদুনবর্ত্তিনী চতুর্বিধাসৃষ্টি লয় প্রাপ্ত হয়ে থাকে।


ঈশ্বর উবাচ্ - 

" কুণ্ডল্যপি মহামায়া কৈলাসে সা বিলীয়তে ||২৬|| "      

  (তথ্যসূত্র- শিবসংহিতা/চতুর্থ পটল )

অর্থ - কুণ্ডলীনিরূপা মহামায়াও সেই কৈলাসে। অর্থাৎ পরমধাম সহস্রারে পরমশিবে বিলীন হন।

উপরিউক্ত প্রামাণিক শাস্ত্রাবলী- তে এই মতের স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে সহস্রার পদ্মে স্থিত পরমশিবে সাক্ষাৎ কুণ্ডলিনী শক্তির লয় ঘটে অর্থাৎ শক্তি সাক্ষাৎ শিবস্বরূপ প্রাপ্ত করে (কারণ প্রকাশ-বিমর্শমযতা ব্রহ্ম পরশিবের স্বরূপ লক্ষণ) , কিন্তু এই মতের উল্লেখ কোনো প্রমাণিত শাস্ত্রে পাওয়া যায় না যে সহস্রার এর পরমশিবকে শক্তি ক্রীড়ার পর গ্রাস করে নেয়।সুতরাং নব্য শাক্তদের এই দাবী (মনগড়া) প্রামাণিক শাস্ত্রের বিরুদ্ধে চলে যাওয়ায় মান্যতা পায় না।


সহস্রারপদ্মের এই পরমশিব যে সাক্ষাৎ নিরঞ্জন ব্রহ্ম পরমাত্মা তারও উল্লেখ শাস্ত্র হতেই পাওয়া হয় - 

" পরমাত্মা শিবশ্চৈব ব্রহ্মপদ্মস্থিতঃ প্রভুঃ | 

কুণ্ডলী শক্তিরুপা চ পরমাত্মা শিবঃ স্বয়ম্ || " 

(তথ্যসূত্র -যোনিমুদ্রা লক্ষণম্/যোনি তন্ত্র ) 

অর্থ - সাক্ষাৎ পরমাত্মা শিবই ব্রহ্মপদ বাচ্য, পরমপ্রভু। কুণ্ডলিনী সাক্ষাৎ পরাশক্তি এবং শিব সাক্ষাৎ পরমাত্মা।


তাছাড়া যোগশিখা উপনিষদ বলছে -

" তত্ত্বাতীতং মহাদেব প্রসাদাত্কথযেশ্বর |

সর্বভাবপদাতীতং জ্ঞানরূপং নিরঞ্জনম্ || ৭ || " 

(যোগশিখা ঊপনিষদ)

অর্থ- সহস্রারের সেই পরমশিবরূপি মহাদেব তত্ত্বাতীত, ভাবাতীত, পদাতীত, জ্ঞানসাগরস্বরূপ এবং নিরঞ্জন ।


মহাশৈব সিদ্ধ যোগী তাঁর কৌলজ্ঞাননির্ণয়ে আরো বলছেন -

ভৈরব উবাচ্ -

" সঃ পরং নিষ্কলং নিত্যং নিরাময়নিরঞ্জনম্ || ৪ || পরমানুমুচ্যতে নাথো স শিবো ব্যাপকঃ পরঃ | ৫

(শ্রীমৎস্যেন্দ্রনাথ বিরচিত কৌলজ্ঞাননির্ণয়/৬ নং পটলঃ)

অর্থ - ভৈরব বললেন- সেই শিবই পরম নিষ্কল, তিনি নিত্য, নিরাময় ও নিরঞ্জন। তিনি অনু পরমাণুর ন্যায় সূক্ষ্ম, তিনিই সর্বব্যাপক।

সুতরাং সহস্রারপদ্ম স্থিত শিবই যে সাক্ষাৎ পরমব্রহ্ম একথাও একাধিক শব্দ প্রমাণের নিরিখে সিদ্ধ হল। আর পরমব্রহ্ম সর্বদা সৃষ্টি, লয় আদি রহিত, ব্রহ্মের কোনো জন্ম বা ব্রহ্মকে কেউ কলন করতে পারে না, নইলে ইহা শ্রুতি অর্থাৎ আগম ও নিগম এর বিরোধী হয়ে পড়বে, ফলত তা খ ণ্ডিত হয়ে যাবে 


আর সেই পরমপদ যে সাক্ষাৎ সেই পরমশিব পদ তার উল্লেখও শাস্ত্রে মেলে - 

ঈশ্বর উবাচ্ -

" ত্রিপুরে ত্রিপুরন্তেকং শিবং পরমকারণং |

অক্ষয়ং তৎপদং শান্তমপ্রমেয় মনাময়ং |

লভতেসৌ ন সন্দেহো ধীমান্ সর্ব্বমভিপসিতং ||২০৫|| "

(তথ্যসূত্র- শিবসংহিতা/পঞ্চম পটল )

অর্থ - হে ত্রিপুরে! ত্রিপুরসঙ্গক শিবই পরমকারণ। , তৎ শিবপদই অক্ষয়, অপ্রমেয়, অনামেয়, শান্ত, যোগীদিগের বাঞ্ছিত । বুদ্ধিমান ত্রিপুরা সাধকগণ সেই শিবপদই লাভ করে এতে সন্দেহ নেই।

প্রামাণিক ত্রিক ভৈরবাগম স্বচ্ছন্দ তন্ত্রে স্পষ্টভাবে উক্ত হয়েছে যে,

ভৈরব উবাচ্ - 

" সুনির্বাণং পরং তত্ত্বং রুদ্রবক্ত্রং তদুচ্যতে || 

শিবশক্তিরিতি খ্যাতং নির্বিকল্পং নিরঞ্জনম্ | 

অনিষ্কলং চ সকলং নীরূপং নির্বিকল্পম্ | 

নির্দ্বন্দ্বং পরমংতত্ত্বং শিবাখ্যং পরমং পদম্ ||"

(স্বচ্ছন্দ সংগ্রহ / কাশ্মীর ভৈরবাগম) 

অর্থ - নির্বাণস্বরূপ সেই পরমতত্ত্বই রুদ্রবক্ত্র (অদ্বৈত ভৈরব বক্ত্র অর্থে) নামে অভিহিত। সেই নির্বিকল্প, নিরঞ্জন পরমেশ্বরই শিব-শক্তৈক্যরূপি। তিনি একাধারে সকল, নিষ্কল আবার নিষ্কলেরও অতীত, দ্বন্দ্ব রহিত, তিনিই সাক্ষাৎ শিব, সাক্ষাৎ পরমপদ।

সুতরাং একাধিক আগম বচনানুসার, শব্দ প্রমাণ এর নিরিখে শাক্তমতালম্বীদের দাবী করা উক্ত মতবাদ শৈবপক্ষ থেকে খণ্ডিত হল।


👉 লিখনে - RohitKumarChoudhury(ISSGT)

👉 প্রচার - International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত