সনাতন ধর্মে ব্রাহ্মণের লক্ষণ, বৈশিষ্ট্য ও তার স্থান কি ? — জেনে নিন
প্রকৃত ব্রাহ্মণ কে ? ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম হলেই কি ব্রাহ্মণ হয়? পৈতা ধারণ করলেই কি পূর্ণ ব্রাহ্মণ হয় ? অতিবর্ণাশ্রমী কী ?
ব্রাহ্মণ্যবাদের খণ্ডন মণ্ডন ও আপত্তি নিরসন—
বর্তমানে এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ এর উদয় হয়েছে, যাদের পরিচয় জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ নাহলে পৈতার জন্য এরা ব্রাহ্মণ। কিন্তু শাস্ত্রে বার বার করে বলা হয়েছে যে, যিনি ব্রহ্মকে জানার ইচ্ছা রাখেন, ব্রহ্মতত্ত্ব সম্পর্কে জানবার চেষ্টা করেন, যিনি বেদাভ্যাস করেন তিনিই প্রকৃত ব্রাহ্মণ বলে কথিত হন।
🔷শাস্ত্র অধ্যয়ন তো দূরের কথা, ভুলভাল কথা বলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ায় এসব নামধারী ব্রাহ্মণেরা। শাস্ত্রের সর্ব্বোচ্চ দৌঁড় পুরোহিত দর্পণ, পঞ্জিকা, আর্যদর্পণ অবধি এর বাইরে অন্য কোনো শাস্ত্র জ্ঞান আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই গেলো।
এসব ব্রাহ্মণরা এখনো "পঞ্চব্রহ্ম" কে এটাই জানেনা।
এখনো স্মার্ত মতানুযায়ী, গণেশ, সূর্য্য, শিব, দূর্গা ও নারায়ণ কেই পঞ্চব্রহ্ম ভেবে পূজো করে।
বর্তমান ব্রাহ্মণদের মধ্যে একটা ব্যাপার পরিলক্ষিত করা যায়, এরা অন্য সনাতনীদের ঘরের জল টুকুও পান করবে না। এবং কথায় কথায় অন্যান্য সনাতনীদের ‘শূদ্র’ বলে ‘নিচু জাত’ বলে ছোট করবে। এগুলিই ব্রাহ্মণ্যবাদ।
কিন্তু তারা এটা জানেনা যে, এটা তাদের মূর্খামি ছাড়া আর কিছুই নই। কারণ প্রকৃত ব্রাহ্মণের ব্যবহার কখনো এমন কটু ও নিম্ন মানসিকতা নয়, বরং প্রকৃত ব্রাহ্মণ ব্যক্তি হলেন সৎ, উদার, পরোপকারী ও দয়াসম্পন্ন।
তাদের এটাও ধারণা দিতে চাই যে, ব্রাহ্মণের চেয়েও শ্রেষ্ঠ হলো "অতিবর্ণাশ্রমী", যারা সব বর্ণের ঊর্ধ্বে। সকল বর্ণাশ্রমী ব্যক্তিবর্গের গুরু হলেন অতিবর্ণাশ্রমী ব্যক্তি। যেখানে কোনো বর্ণ বা আশ্রমের ভেদ থাকে না, জাতপাতের ভেদাভেদের বিষয় থাকে না। যেখানে কেউ কাউকে ছোট জাত, নিচু জাত বলে অপমান করেনা। যেখানে সবাই সমান, সবকিছুই শিবময় তাই অতিবর্ণাশ্রমী।
যার ভুঁড়ি ভুঁড়ি প্রমাণ স্মৃতি-শ্রুতি উভয় শাস্ত্রে রয়েছে।
🔶🔶 তাই আজকে দেখানো হবে একজন প্রকৃত ব্রাহ্মণ কে🔶🔶 —
➡️ শাস্ত্রে বলা হয়েছে —
দ্বিবিধা ব্রাহ্মণা রাজন্ ধর্ম্মশ্চ দ্বিবিধঃ স্মৃতঃ।।৪০
( তথ্যসূত্র — কালীপ্রসন্ন সিংহ অনুবাদিত—মহাভারত, মোক্ষধর্ম পর্ব্বাধ্যায় ২৬)অর্থ — মহারাজ ব্রাহ্মণ দুই প্রকার - কর্ম্ম নিরত ও কর্ম্ম বিরত। ধর্ম ও দুই প্রকার - প্রবৃত্তি ধর্ম ও নিবৃত্তি ধর্ম ॥৪০
ব্রাহ্মণ সাধারনত দুই শ্রেনীতে বিভক্ত। এক শ্রেনীর ব্রাহ্মণ, যারা শ্রুতি ও স্মৃতি শাস্ত্র অধ্যয়ন করে উক্ত ব্রহ্মতত্ত্বজ্ঞান লাভ করবার মার্গে চলতে থাকেন তিনি যথার্থ ব্রাহ্মণ নামের উপযুক্ত হয়। তারা নিজের কর্ম কাণ্ডে আবদ্ধ থাকতেন না, তবে অজ্ঞ লোকেদের হিতের জন্য তাদের সেইরূপ শাস্ত্রীয় বিধানের ব্যবস্থা করে দেন।
আর অন্য আরেক শ্রেনীর ব্রাহ্মণ আছেন, যারা শাস্ত্র জ্ঞানে আগ্রহী থাকে না। কিন্তু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করার জন্য এবং সাত্ত্বিক ভাববিশিষ্ট ও শৌচাচারাদি নিয়ম পালন করে বলে নামমাত্র ব্রাহ্মণ বলে কথিত হয় মাত্র। কিন্তু সে বাস্তবিক অর্থে ব্রহ্মজ্ঞানে নিরত থাকা ব্রাহ্মণ নয়।
👉ব্রহ্মজ্ঞান নিষ্ঠ , যিনি ব্রহ্মজ্ঞান লাভের মার্গ অনুসরণকারী তিনি - ব্রাহ্মণ।
👉ভগবান ব্যাস শুকদেব কে প্রকৃত ব্রাহ্মণ সম্পর্কে বলেছিলেন যে—
ব্রহ্মজ্ঞানপ্রতিষ্ঠং হি তং দেবা ব্রাহ্মণং বিদুঃ।।২২
(কালীপ্রসন্ন সিংহ—মহাভারত, মোক্ষধর্ম পর্ব্বাধ্যায় ৬৩)
[হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ—মহাভারত, শান্তিপর্ব্ব, মোক্ষধর্মপর্ব্বাধ্যায়-২৩৪]
যার ব্রহ্মজ্ঞান বিষয়ে প্রতিষ্ঠা জন্মেছে, দেবতারা তাকেই ব্রাহ্মণ বলে অবগত হন।।২২
👉তিনি আরও বলেছেন—
সর্ব্বান্ বেদানধীয়ীত শুশ্রুষুব্রহ্মচর্যবান্।
ঋচো যজুংষি সামানি ন যো বেদ ন বৈ দ্বিজঃ।।২
ইষ্টীশ্চ বিবিধাঃ প্রাপ্য ক্রতূংশ্চৈবাপ্তদক্ষিণান্।
প্রাপ্নোতি নৈব ব্রাহ্মণ্যমবিধানাৎ কথঞ্চন।।৪
(কালীপ্রসন্ন সিংহ—মহাভারত, মোক্ষধর্ম পর্ব্বাধ্যায়, ৭৭)
[হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ—মহাভারত, শান্তিপর্ব্ব, মোক্ষধর্মপর্ব্বাধ্যায়-২৪৮]
ঋক, যজু ও সামাদি বেদাধ্যয়ন, গুরুশুশ্রুষা, ও ব্রহ্মচর্যেরনুষ্ঠান করিলেই যে ব্রাহ্মণ বলে পরিগণিত হবে তা নয়।। ২
ব্রাহ্মণ্য লাভের প্রকৃত পথ পরিত্যাগ করে কেবল ভুরিদক্ষিণ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করলেও ব্রাহ্মণ্য লাভ হয় না।।৪
👉খেয়াল করে দেখুন শাস্ত্র কি বলছে, এখানে বলেছে “ব্রাহ্মণত্ব লাভের প্রকৃত পথ” অবলম্বন না করেই, ব্রাহ্মণেরা কেবল যাগযজ্ঞাদি, হোম, পূজা ইত্যাদি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। কিন্তু এগুলো কি ব্রাহ্মণত্ব লাভের উপায়?
👉তাছাড়া তন্ত্রে স্পষ্ট ভাবেই বলা হয়েছে—
বেদমাতাজপেনৈব ব্রাহ্মণ নৈ হি শৈলজে।
ব্রহ্মজ্ঞানং যদা দেবী তদা ব্রাহ্মণ উচ্চতে।।
(নীলতন্ত্র, নবম ত্রিংশ পটলোধ্যায়)
অর্থ — হে পার্ব্বতী! কেবল মাত্র সন্ধ্যা বা গায়ত্রী জপের দ্বারা যে প্রকৃত ব্রাহ্মণ হয় তা নয়, যখন মানুষ ব্রহ্মজ্ঞান লাভের মার্গকে চিনতে পেরে সেই মার্গে চলতে থাকেন, তখন তাকে ব্রাহ্মণ বলা হয়।।
বেদশাস্ত্রার্ণবে ঘোরে তাড্যমানা ইতস্ততঃ।
কালোর্মিগ্রাহগ্রস্তাশ্চ তিষ্ঠস্তি হি কুতার্কিকাঃ।।৮৮
[কূলার্ণব তন্ত্র- ১ম উল্লাস—৮৮]
অর্থ — ঘোর বেদশাস্ত্রসাগরে নিমজ্জিত কুতার্কিকেরা কালরূপ তরঙ্গ ও কুমীরের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে এবং এদিক থেকে ওদিক তাড়িত হয়ে অবস্থান করছে।। ৮৮
👉শুধু মাত্র শাস্ত্র পড়লেই যে, ব্রাহ্মণ হওয়া যাবে এমনটাও না। যতক্ষণ না পরমতত্ত্ব সম্বন্ধে না জানছে, জ্ঞান অর্জন না করছে সে কদাপি ব্রাহ্মণ বলে গণ্য হবে না।
👉মনু সংহিতাতে উত্তম ও অধম পর্যায়ে ব্রাহ্মণকে চার ভাগে উল্লেখ করেছেন—
জ্ঞাননিষ্ঠা দ্বিজাঃ কেচিৎ তপোনিষ্ঠাস্তথাপরে।
তপঃস্বাধ্যায়নিষ্ঠাশ্চ কর্ম্মনিষ্ঠাস্তথাপরে।।
(মনুস্মৃতি, ৩/১৩৪)
অর্থ — কিছু ব্রাহ্মণ আত্মজ্ঞাননিষ্ঠ, কিছু ব্রাহ্মণ তপঃ পরায়ণ, কিছু ব্রাহ্মণ তপস্যা ও বেদাধ্যয়ন উভয়নিষ্ঠ এবং অপর কিছু ব্রাহ্মণ যাগযজ্ঞাদি কর্ম্মনিষ্ঠ।।
👉মনু এই চার প্রকার ব্রাহ্মণের মধ্যে জ্ঞাননিষ্ঠ ব্রাহ্মণেরই প্রাধান্য সর্ব্বত্র বর্ণনা করেছে। মনু জ্ঞানকেই ব্রাহ্মণের তপস্যা ও সাধনা বলে নির্দ্দেশ করেছে—.
ব্রাহ্মণস্য তপো জ্ঞানং তপঃ ক্ষত্রস্য রক্ষণং।
বৈশ্যস্য তু তপো বার্ত্তা তপঃ শুদ্রস্য সেবনং।।
(মনুস্মৃতি, ১১/২৩৬)
অর্থ — ব্রাহ্মণের পক্ষে জ্ঞানই উৎকৃষ্ঠ তপস্যা। ক্ষত্রিয়ের পক্ষে প্রজা পালন ও দেশরক্ষাই শ্রেষ্ঠ তপস্যা। বৈশ্যের পক্ষে কৃষিকর্ম্ম ও শুদ্রের পক্ষে সেবা করাই উত্তম তপস্যা।।
👉জন্ম অনুসারে কখনোই বর্ণ নির্ধারণ হয় না। কারণ জন্ম অনুসারেই যদি বর্ণ নির্ধারণ হতো তাহলে ঈশ্বর শাস্ত্রে বলতো না যে, তিনি গুণ এবং কর্মকেই ভিত্তি করে বর্ণ বিভক্ত করেছেন। তাই এটাই স্পষ্ট যে, গুণ এবং কর্মের মাধ্যমে বর্ণের নির্ধারণ হয়।
👉তাছাড়া গীতাতে বলা হয়েছে—
"চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্।।" ১৩।।
(ভগবদ গীতা, চতুর্থ অধ্যায়—১৩)
অর্থ — ভগবান বলছেন, আমি গুণ ও কর্ম অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চারবর্ণ সৃষ্টি করিয়াছি। কিন্তু আমাকে অকর্তা ও অব্যয় বলিয়াই জানিও।।১৩
👉তার এক’ই কথার সমর্থন পাওয়া যায় মহাভারতে—
ব্রাহ্মণাঃ ক্ষত্রিয়া বৈশ্যাঃ শূদ্রাশ্চ কৃতলক্ষণাঃ।।১৯
[হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ- মহাভারত- বনপর্ব্ব- অধ্যায়- ১২৩—১৯]অর্থ — ঈশ্বর গুণ ও কর্ম অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র চারটি বর্ণ বিভক্ত করেন।। ১৯
👉এখন যদি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও গুণ যদি তমোগুণী হয় আর কর্ম যদি শূদ্রের ন্যায় হয় তাহলে সে কদাপি ব্রাহ্মণ বলে গণ্য হবেন না। তাই আপনার গুণ ও কর্ম'ই বিচার্য যে আপনি ব্রাহ্মণ নাকি চন্ডাল।
👉চাণক্য ও বলেছেন—
কিং কুলেন বিশালেন গুণহীনস্তু যো নরাঃ।
অকুলীনোহপি শাস্ত্রজ্ঞো দৈবতৈরপি পূজ্যতে।।৪
[চাণক্য নীতি, ৪]অর্থ — যে ব্যক্তি গুণহীন তার উচ্চবংশে জন্মগ্রহনেও সার্থকতা কোথায়? বিপরীতপক্ষ, যিনি শাস্ত্রজ্ঞ তিনি উচ্চবংশীয় না হলেও দেবতা দ্বারা পূজিত হন।। ৪
👉আবার মহাভারতে বলা হচ্ছে সবাই প্রথমে এক ব্রাহ্মণ'ই ছিলো। পরবর্তী গুণ ও কর্ম অনুসারে বিভিন্ন জাতিতে পরিণত হয়েছে।
ন বিশেষোহন্তি বর্ণানাং সর্ব্বং ব্রাহ্মমিদ জগৎ।
ব্রহ্মণা পূর্ব্বসৃষ্টং হি কর্ম্মভির্ব্বর্ণতা গতং।। ১০
[কালীপ্রসন্ন সিংহ—মহাভারত, মোক্ষধর্মপর্ব্বাধ্যায়, ১৪]
[হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ—মহাভারত, শান্তিপর্ব্ব, মোক্ষধর্মপর্ব্বাধ্যায়-১৮১]
অর্থ — হে তপোধন! ইহলোকে বস্তুতঃ বর্ণের ইতরবিশেষ নাই। জগতের যাবতীয় মনুষ্যই পূর্ব্বেই ব্রহ্মাকতৃক ব্রাহ্মণ জাতি রূপে সৃষ্টি হয়েছিলেন। ক্রমে ক্রমে এক ব্রাহ্মণ জাতিই কর্ম্ম ও ব্যবসায়ভেদে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য প্রভৃতি বিবিধ জাতিরূপে পরিণত হয়েছেন।।১০
কামভোগপ্রিয়াস্তীক্ষ্ণাঃ ক্রোধনাঃ প্রিয়সাহসাঃ।
ত্যক্তস্বধর্মারক্তাঙ্গাস্তেদ্বিজাঃ ক্ষত্রতাং গতাঃ।।১১
গোভ্যো বৃত্তিং সমাস্থায় পীতাঃ কৃষ্যুপজীবিনঃ।
স্বধর্ম নাধিতিষ্ঠন্তি ত্ব দ্বিজাঃ বৈশ্যতাং গতাঃ।।১২
হিংসানৃতপ্রিয়া লুব্ধাঃ সর্ব্বকর্মোপজীবিনঃ।
কৃষ্ণাঃ শৌচপরিভ্রষ্টাস্তে দ্বিজাঃ শুদ্রতাং গতাঃ।।১৩
ইত্যেতৈঃ কর্মভির্ব্যস্তা দ্বিজা বর্ণান্তরং গতাঃ।
ধর্মো যজ্ঞঃ ক্রিয়া তেষাং নিত্যং ন প্রতিষিধ্যতে।।১৪
[কালীপ্রসন্ন সিংহ—মহাভারত, মোক্ষধর্মপর্ব্বাধ্যায়, ১৪]
[হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ—মহাভারত, শান্তিপর্ব্ব, মোক্ষধর্মপর্ব্বাধ্যায়-১৮১]
ব্রহ্মা কত্তৃক সৃষ্ট সেই আদি ব্রাহ্মণ জাতির মধ্যে যারা কামভোগপ্রিয়, ক্রোধপরতন্ত্র, সাহসী ও তীক্ষ্ণ স্বভাব হয়ে স্বধর্ম পরিত্যাগ করেছেন, তারাই ক্ষত্রিয়ত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন।।১১
যারা স্বধর্মে অবস্থিত না থেকে রজঃ ও তমোগুণ প্রভাবে পশুপালন ও কৃষিকার্য্য অবলম্বন করেছে, তারাই বৈশ্যত্ব প্রাপ্ত হয়েছে।।১২
যারা তমোগুণ প্রভাবে হিংসাপরতন্ত্র, লুব্ধ, সর্ব্বকর্মোপজীবী, মিথ্যাবাদী ও শৌচভ্রষ্ট হয়েছে তারাই শুদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়েছে।।১৩
এইরূপে এক আদি ব্রাহ্মণ জাতিই কার্য্য দ্বারা পৃথককৃত হয়ে বিভিন্ন জাতি রূপে পরিগনিত হয়েছে। অতএব সকল বর্ণেরই নিত্যধর্ম ও নিত্যকর্মে অধিকার আছে।।১৪
ইত্যেতে চতুরোবর্ণা যেষাং ব্রাহ্মী সরস্বতী।
বিহিতা ব্রাহ্মণা পূর্ব্বং লোভাত্ত্বজ্ঞানতানতাং গতাঃ।।১৫
[কালীপ্রসন্ন সিংহ—মহাভারত, মোক্ষধর্মপর্ব্বাধ্যায়, ১৪]
[হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ—মহাভারত, শান্তিপর্ব্ব, মোক্ষধর্মপর্ব্বাধ্যায়-১৮১]
অর্থ — এই চতুরময়লোক যাদেরকে ব্রহ্মা পূর্ব্বে বেদময় বাক্যে অধিকার প্রদান করেছিলেন, তারাই লোভবশতঃ শুদ্রাদিরূপ অজ্ঞানতা প্রাপ্ত হয়েছে।।১৫
সমাশ্রমং সমাচারং সমজ্ঞানঞ্চ কেবলম্।
তদা হি সমকর্ম্মাণো বর্ণা ধর্ম্মানবাপ্নুবন।।২০
👉তো এবার ব্রাহ্মণ্যবাদীরা কি বলবেন? যে ব্রাহ্মণ সবার ঊর্ধ্বে সবার থেকে শ্রেষ্ঠ? এটা যদি বলেন তাহলে তো আপনাদের শাস্ত্র বিরুদ্ধ বলা যায়। কারণ যিনি শাস্ত্রের বাক্য মানেন না তার পরাগতি প্রাপ্ত হয় না। একথাও আমি না, ভগবদ্গীতা বলছে—
যঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ততে কামকারতঃ।
ন স সিদ্ধিবাপ্নোতি ন সুখং ন পরাং গতিম্।।২৩
অর্থ — যে ব্যক্তি শাস্ত্রের বিধি ত্যাগ করিয়া স্বেচ্ছাচরণ করে সে সিদ্ধি, সুখ ও পরাগতি লাভ করিতে পারে না।।২৩।।
তস্মাচ্ছাস্ত্রং প্রমাং তে কার্যংকার্যং ব্যবস্থিতৌ।
জ্ঞাত্বা শাস্ত্রবিধানোক্তং কর্ম কর্তুমিহার্হসি।।২৪।।
অর্থ — অতএব তোমর পক্ষে কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই প্রমাণ, এই কথা জেনে তুমি শাস্ত্রবিধিমতে নির্দিষ্ট কর্ম করো।।২৪।।
[ভগবদ গীতা, ১৬ অধ্যায়]
নাকি এবার বলবে ভগবদ্গীতা’ই ভুল?
👉মহাভারতে ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে বলেছে—
আলম্ভযজ্ঞাঃ ক্ষত্রাস্তু হবির্যজ্ঞা স্মৃতাঃ।
পরিচারযজ্ঞাঃ শুদ্রাস্তু তপোযজ্ঞা দ্বিজাতয়ঃ।।৩৩
(কালীপ্রসন্ন সিংহ—মহাভারত, মোক্ষধর্ম পর্ব্বাধ্যায়, ৫৮)
[হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ—মহাভারত, শান্তিপর্ব্ব, মোক্ষধর্মপর্ব্বাধ্যায়-২৩৫]
এই শ্লোকের টীকায় "তপঃ" শব্দের অর্থ টীকাকার লিখেছেন "ব্রহ্মোপাসনং"। অর্থাৎ ব্রহ্মোপাসনাই ব্রাহ্মণের উৎকৃষ্ট যজ্ঞ।
👉এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়েছে যে, ব্রহ্মের উপাসনা করাই ব্রাহ্মণের কর্ম।
তাহলে আমার প্রশ্ন এটাই যে, ব্রাহ্মণরা কি আদৌ ব্রহ্মের উপাসনা করে? নাকি কর্মকাণ্ড নিয়েই ব্যস্ত থাকে?
বর্তমানে ব্রাহ্মণের কাজ হলো পূজা-অর্চ্চনা, যাগযজ্ঞাদি ইত্যাদি করা। কিন্তু এসব কি ব্রহ্মের উপাসনার একমাত্র উপায়? এ ক্ষেত্রে শাস্ত্র কি বলে তা বিচার করার বিষয়। কারণ শাস্ত্রের বচন ছাড়া দ্বন্দ্বের মীমাংসা হয় না।
👉তাই শাস্ত্র কি বলছে তা দেখে নেব —
নামমাত্রেণ সন্তুষ্টাঃ কর্মকাণ্ডরতা নরাঃ।
মন্ত্রোচ্চারণহোমাদৈর্ভ্রামিতাঃ ত্রুতুবিস্তরৈঃ।।৭৪
[কূলার্ণব তন্ত্র- ১ম উল্লাস—৭৪]👉এখানেও বলছে শুধুমাত্র পূজা-অর্চ্চনা, যাগযজ্ঞাদি, হোম ইত্যাদি এসব ক্রিয়াকর্ম করতে থাকলে শুধু এসবের বেড়াজালে আটকে আর বেরোতে পারবে না।
👉কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান বর্তমানের ব্রাহ্মণের কেন'ই বা প্রয়োজন হচ্ছে, তারা তো টাকা রোজগার আর খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলেই হলো। এভাবে জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করছে।
এসব ব্রাহ্মণের জন্য ব্রহ্মজ্ঞান গেছে তেল নিতে, তারা খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকতে পারলেই হয়। আরও মজার বিষয় হচ্ছে এরা নিজেদের ব্রাহ্মণ বলে দাবী করে।
বলি, লজ্জা লাগে না নিজেকে ব্রাহ্মণ বলতে?
👉তাই তো শাস্ত্রে বলছে—
ধনাহারার্জনে যুক্তা দাম্ভিকা নেষধারিণঃ।
ভ্রমন্তি জ্ঞানিবল্লোকে ভ্রাময়ন্তি জনানপি।।৭৭
[কূলার্ণব তন্ত্র- ১ম উল্লাস—৭৭ নং শ্লোক]👉 শাস্ত্রে একটা প্রবাদ আছে যে, গাধাও বনের মধ্যে ঘাসপাতা খেয়ে বেড়ায় দিগম্বর হয়ে চলাফেরা করে, তাতেই কি সে যোগী হয়ে যায়?
এই আধুনিক কালের তথাকথিত নামধারী নকল ব্রাহ্মণদেরও একই অবস্থা , এরা নিজেদের জ্ঞানী বলে বেড়ায়, জ্ঞানীর বেশ ধারণ করে ঘুরে বেড়ায়, এবং অন্যদেরও ঘুরিয়ে মারে।
👉কিছু শাস্ত্র পড়ে নিয়ে ব্যাখ্যা না বুঝে নিজের মতো ভেবে নেওয়া ব্যক্তিগত ধারণাকে সত্য মনে করে নিজেকে অনেক বড় হনু হয়ে বসে থাকে এই নকল ব্রাহ্মণেরা। শাস্ত্রের সঠিক অর্থ কে বিচার করবে? পরমেশ্বর শিব কেন’ই বা শাস্ত্র প্রকট করলেন? শুধু মাত্র শাস্ত্রের মধ্যে থাকা পূজার বিধি অনুসারে পূজা করে চালানোর জন্য?
মোটেও তা নয় শাস্ত্রের মূল বিষয় হচ্ছে শাস্ত্রের সঠিক অর্থকে বিচার করা ও ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে তার দ্বারা সাধারণ মানুষদের সঠিক পথ দেখানো।
👉তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে—
বেদাগমপুরাণজ্ঞঃ পরমার্থং ন বেত্তি যঃ।
বিড়ম্বকস্য তস্যাপি তৎ সর্বং কাকভাসিতম্।।৮৯
[কূলার্ণব তন্ত্র- ১ম উল্লাস—৮৯]যে-ব্যক্তি বেদ, শৈব আগম ও পুরাণে পারদর্শী কিন্তু পরমার্থ জানেনা, সে প্রতারক। তার সব বিদ্যা কাকের মতো কা-কা ছাড়া আর কিছুই নয়।
👉কিন্তু কথা হচ্ছে, এরা কি সাধারণ মানুষকে সঠিক পথ দেখাতে পারছে? পরমতত্ত্ব সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দিতে পারছে?
👉কারণ শাস্ত্র তো বলছে—
অন্যথা পরমং তত্ত্বং জনা ক্লিশ্যন্তি চান্যথা।
অন্যথা শাস্ত্রসদ্ভাবো ব্যাখ্যাং কুর্বন্তি চান্যথা।।৯২
[কূলার্ণব তন্ত্র- ১ম উল্লাস—৯২]👉তাই শাস্ত্রের যথার্থ অর্থ না জেনে নিজের নামের আগে ‘'পঞ্চতীর্থ, শাস্ত্রী’' ইত্যাদি ইত্যাদি নামের ট্যাগ লাগিয়ে নিজেদের কি প্রমাণ করতে চান ?
👉মহাভারতে বলা হয়েছে যে—
অনারম্ভাঃ সুধৃতয়ঃ শুচয়ো ব্রহ্মসংস্থিতাঃ।
ব্রহ্মণৈব স্ম তে দেবাংস্তর্পয়ন্ত্যমৃতৈষিণঃ।।২০
(কালীপ্রসন্ন সিংহ—মহাভারত, মোক্ষধর্ম পর্ব্বাধ্যায়, ৯৪)
[হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ—মহাভারত, শান্তিপর্ব্ব, মোক্ষধর্মপর্ব্বাধ্যায়-২৬৩]
অর্থ — কর্ম্মকাণ্ডত্যাগী(ব্রহ্মজ্ঞান অর্জনের পর), ধৈর্য্যবান পবিত্র ব্রহ্মজ্ঞ মহাত্মারা ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার দ্বারাই অমৃতকাঙ্ক্ষী দেবগণকে তৃপ্ত করতে পারেন।।২০
এবং ঐ অধ্যায়ের ৩৩ নং শ্লোকের টীকায় টীকাকার লিখেছেন— " ঈদৃশং ব্রাহ্মণ্যং অজ্ঞাত্বা মূঢ় কর্ম্মসু সজ্জন্তে যোগঞ্চাবমন্যন্তে ইতি।
👉মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে—
ঋষিযজ্ঞং দেবযজ্ঞং ভুতযজ্ঞঞ্চ সর্ব্বদা।
নৃযজ্ঞং পিতৃযজ্ঞঞ্চ যথাশক্তি ন স্থাপয়েৎ।।
(মনুস্মৃতি, ৪/২১)অর্থ — ঋষিযজ্ঞ অর্থাৎ বেদাধ্যয়ন, দেবযজ্ঞ অর্থাৎ হোমাদি অগ্নিহোত্র কর্ম্ম, ভূতযজ্ঞ অর্থাৎ ইতর জীবদিগের জন্য অন্নদান, মনুষ্যযজ্ঞ অর্থাৎ অতিথিসেবা এবং পিতৃযজ্ঞ অর্থাৎ তর্পণ, এই সমুদায় যজ্ঞ সর্ব্বদা যথাশক্তি পরিত্যাগ করিবে না।।
👉এবং এর পরের শ্লোকে বলা হয়েছে—
এতানেক মহাযজ্ঞান্ যজ্ঞশাস্ত্রবিদো জনাঃ।
অনীহমানাঃ সততমিন্দ্রিয়েষ্বেব জুহ্বতি।।
(মনুস্মৃতি, ৪/২২)অর্থ — কতিপয় যজ্ঞাশাস্ত্রবেত্তা জ্ঞানবান্ গৃহস্থ এইরূপ (পঞ্চবিধ) মহাযজ্ঞ কিছু মাত্র অনুষ্ঠান না করিয়া, কেবল পঞ্চবুদ্ধিন্দ্রিয়ে পঞ্চপ্রকার জ্ঞানের সংযমনরূপ যজ্ঞ নির্বাহ করিয়া থাকেন।।
👉টীকাকার কুল্লুক ভট্ট লিখেছেন—
"ব্রহ্মনিষ্ঠানাং বেদসন্ন্যাসিনাং গৃহস্থনামমী বিধয়ঃ।"
অর্থ — বৈদিক কর্ম্ম কাণ্ড হইতে নিবৃত্ত ব্রহ্মনিষ্ঠ গৃহস্থদিগের পক্ষে এই রূপই বিধি।।
👉তাছাড়া মহাভারতে ব্রাহ্মণের সম্পর্কে বলেছেন—
নৈতাদৃশং ব্রাহ্মণস্যাস্তি বিত্তং যথৈকতা সমতা সত্যতা চ।
শীলং বিধির্দণ্ডবিধানমার্জবং তপস্বিতা চোপরমঃ ত্রিয়াভ্যঃ।।৩৭
(কালীপ্রসন্ন সিংহ—মহাভারত, মোক্ষধর্ম পর্ব্বাধ্যায়, ২)
[হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ—মহাভারত, শান্তিপর্ব্ব, মোক্ষধর্মপর্ব্বাধ্যায়-১৬৯]
অর্থ — ব্রাহ্মণের পক্ষে একাকিত্ব, সমতা, সত্য, সচ্চরিত্রতা, অহিংসা, সরলতা, তপস্বিতা এবং ক্রিয়াকলাপ হইতে নিবৃত্তি অপেক্ষা বিত্ত ধন আর কিছুই নাই।। ৩৭
👉তাছাড়া গীতাতেও পরিষ্কার ভাবে ব্রাহ্মণের নয়টি গুণের কথা উল্লেখ আছে —
শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তরার্জবমেব চ।
জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্।।৪২
(ভগবদগীতা, অধ্যায় ঃ ১৮)অর্থ — অন্তঃকরণের সংযম, ইন্দ্রিয়াদি দমন, ধর্মপালনের জন্য কষ্টস্বীকার, অন্তরে ও বাইরে শুচি রাখা, অপরের অপরাধ ক্ষমা করা, কায়মনোবাক্যে সরল থাকা, বেদ শাস্ত্র ঈশ্বর এবং পরলোকাদিতে শ্রদ্ধা রাখা, বেদাদি গ্রন্থের অধ্যয়ন-অধ্যাপন করা এবং পরমাত্ম তত্ত্ব অনুভব করা — এ সবই ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত কর্ম।। ৪২
👉কিন্তু দুঃখের বিষয় এটাই যে, বর্তমানের নামধারী ব্রাহ্মণদের মধ্যে এসব গুণ বিলুপ্ত। এসব ভেকধারীরা মনে করে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায়। তাহলে ওদের বলি তোমরা বোকার স্বর্গে বসবাস করছো। জন্মগত ভাবেই যদি ব্রাহ্মণ হওয়া যেত তাহলে শাস্ত্রে ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তিকে ব্রাহ্মণ বলতো না। হ্যা জন্মগত ভাবে ব্রাহ্মণ শুধু নামমাত্র বলা হয়েছে শাস্ত্রে, কিন্তু প্রকৃত ব্রাহ্মণ হতে গেলে কর্মেও তাকে ব্রাহ্মণের লক্ষণ সম্পন্ন হতে হবে।
👉ব্রাহ্মণ শব্দে কাকে বোঝায়? জীবাত্মা কী? জীবের দেহ কী? জাতি কী? বর্ণ কী? ধর্ম কী? পাণ্ডিত্য কী? কর্ম্ম কী? জ্ঞান কী?
🔷যদি এই গোঁড়াব্রাহ্মণরা মনে করে যে, শাস্ত্রবিহিত ব্রাহ্মণ পিতা ও ব্রাহ্মণী মাতা থেকে যাদের জন্ম হয় তারাই পূর্ণ ব্রাহ্মণ, তাহলে তাদের বলতে চাই —
জন্ম সূত্রে যদি ব্রাহ্মণ হওয়া যায় তাহলে বেদ এবং স্মৃতিতে প্রসিদ্ধ অনেক মহর্ষিকে অব্রাহ্মণ বলতে হয়।
যেমন— ঋষ্যশৃঙ্গ, কৌশিক, বাল্মীকি, মাতঙ্গ, অগস্ত্য, মাণ্ডুক্য, অচর, ভরদ্বাজ, বেদব্যাস ইত্যাদি।
যদি এটা বলে যে, পিতা মাতা কেউ-ই ব্রাহ্মণ না হয় অন্ততঃ পিতা ব্রাহ্মণ হলেই সন্তান ব্রাহ্মণ হয় তাহলে তো দেখা যায় যে, বিশ্বামিত্র প্রভৃতি ঋষি ক্ষত্রিয়ের ঔরসে (ক্ষত্রিয়ের গর্ভে) জন্ম হয়েও শাস্ত্রে ব্রাহ্মণ বলে উল্লিখিত হয়।
বিশ্বামিত্রস্তদোবাচ ক্ষত্রিযোহহং তদাভবম্।
ব্রাহ্মণোহহং ভবানীতি ময়া চারাধিতো ভবঃ।।
তৎপ্রসাদান্মযা প্রাপ্তং ব্রাহ্মণ্যং দুর্লভং মহৎ।।১৬/১৭
[হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ- মহাভারত- অনুশাসনপর্ব্ব- অধ্যায়- ১৭]অর্থ — বিশ্বামিত্র বলেন, আমি পূর্ব্বে ক্ষত্রিয় ছিলাম। সুতরাং ব্রাহ্মণ হইবো বলে মহাদেবের আরাধনা করি। মহাদেবের অনুগ্রহে অতি দূর্লভ ব্রাহ্মণত্ব লাভ করি।। ১৬/১৭
👉তাছাড়া ব্যাসদেবের জন্ম কীভাবে তা বৃত্তান্ত জানলেই জানা যায় যে, জন্ম সূত্রে ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না।
ভরদ্বাজ ঋষির জন্ম ভূমিতেই হয়, কিন্তু তারপরেও শাস্ত্রে ব্রাহ্মণ বলেই উল্লিখিত হয়।
ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি হরিনীর গর্ভে, মাণ্ডুক্য ভেকের গর্ভে, অগস্ত্য কলসে, বাল্মীকি বল্মীকে ইত্যাদিরূপে জন্মগ্রহণ করেন, কিন্তু কর্ম্ম ও ব্রহ্মজ্ঞানে নিরত হবার জন্যই তারা শাস্ত্রে ব্রাহ্মণ বলেই কথিত হন।
অর্থাৎ যারা ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণ বলে লাফাচ্ছেন জন্মসূত্র বা পৈতার জোড়ে, তাদেরকে বলে রাখি আপনি ব্রহ্মজ্ঞ হবার পথে না চললে আপনি ব্রাহ্মণ কখনো হবেন না। তাই নিজেকে ব্রাহ্মণ দাবী করাটা মূর্খামির পরিচয় দেওয়া।
👉তাই তো শাস্ত্রে বলা হয়েছে—
অত্রি মুনির উক্তিঃ-
ব্রহ্মতত্ত্বং ন জানাতি ব্রহ্মসূত্রেন গর্ব্বিতঃ
তেনৈব স চ পাপেন বিপ্রঃ পশুরুদাহৃতঃ।।
[অত্রি সংহিতা ৩৭২]
অর্থ — ব্রহ্মতত্ত্ব না জেনে পৈতার জোরে যিনি ব্রাহ্মণ বলে গর্ব করেন, ওই পাপে সে পশু বলে খ্যাত হয়।।৩৭২
👉এখন ব্রহ্মতত্ত্বকে জানা যায় কীভাবে একটা দ্বন্দ্ব থেকেই গেলো। কারণ উপরেই বলা হয়েছে কেবল মাত্র যাগযজ্ঞাদি, হোম, পূজা-অর্চ্চনা, ভজন-কীর্তন এসবের মাধ্যমে জীবের পূণ্য অর্জন হলেও তা মোক্ষের পথ নয়।
তাহলে মোক্ষের পথ কি তা জেনে নেব।
👉শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে—
আত্মকর্ম্মসু মোক্ষো ব্যাখ্যাতঃ।।১৬
[বৈশেষিক দর্শন- ৬ষ্ঠ অধ্যায়- ২য় আহ্নিক—১৬]অর্থ — আত্মকর্ম্ম হলে মোক্ষ হয় ইহা কথিত হয়েছে।।১৬
👉এখানে টীকাকার আত্মকর্ম্ম বলছে বুঝিয়েছে "আত্মসাক্ষাৎকার"(আত্মজ্ঞান)। অর্থাৎ নিজের আত্মস্বরূপকে উপলব্ধি করা। জীবের যখন আত্মসাক্ষাৎকার হয় তখন নশ্বর দেহের প্রতি আর অহং বোধ অর্থাৎ, "দেহটাই আমি" এই বোধ থাকে না।
তাই জীবের মোক্ষের জন্য আত্মসাক্ষাৎকার (আত্মজ্ঞান) এই একমাত্র পথ।
👉এবং এক’ই কথার সমর্থন পাওয়া যায় তন্ত্রেও—
মোক্ষস্য কারণং সাক্ষাতত্ত্বজ্ঞানং কুলেশ্বরী।।৮৬
[কূলার্ণব তন্ত্র- ১ম উল্লাস—৮৬]অর্থ — সাক্ষাৎ তত্ত্বজ্ঞানই মোক্ষের কারণ।।৮৬
এখানে টীকাকার তত্ত্বজ্ঞান বলতে বুঝিয়েছে—
তত্ত্বজ্ঞান— আত্মজ্ঞান(প্রত্যভিজ্ঞা) বা ব্রহ্মজ্ঞান।
মোক্ষস্যকারণং— মোক্ষের কারণ।
আত্মসন্বিদের উদয় হলে অর্থাৎ আত্মরূপের যথাযথ জ্ঞান অর্জন হলে যে অবস্থা হয় তাকেই বলে মোক্ষ।
সাক্ষাৎ তত্ত্বজ্ঞান অর্থাৎ আত্মস্বরূপের উপলব্ধি বা আত্মসন্বিদের উদয় (বেদের ভাষায় যাকে বলা হয় "অহং ব্রহ্মাস্মী" অবস্থা অর্থাৎ আমিই ব্রহ্ম। এখানে আমি বলতে আত্মাকেই বোঝানো হয়েছে “অয়মাত্মা ব্রহ্ম”)।
👉আর যেসব ব্রাহ্মণেরা মোক্ষের সঠিক কারণ না জেনে কেবল জন্মগত ভাবে ব্রাহ্মণ হওয়ার অহংকারে পতিত থাকে। তাদের জন্য শাস্ত্রে বলা হয়েছে—
স্বদেহধর্মদারাদিনিরতাঃ সর্বজন্তবঃ।
জায়ন্তে চ ম্রিয়ন্তে চ হা হন্তাজ্ঞানমোহিতাঃ।।৭১
[কূলার্ণব তন্ত্র- ১ম উল্লাস—৭১]অর্থ — অজ্ঞানমোহিত সব প্রাণী স্বীয় দেহধর্মের অনুগত এবং দারাদিনিরত হয়ে থাকে। হায়, হায়! এরা শুধু জন্মায় আর মরে।।৭১
👉অর্থাৎ ব্রাহ্মণের লক্ষ্য যে ব্রহ্মোপাসনা তা ভুলেই তারা কর্মকাণ্ডে নিজেদের এমন ভাবে মোহিত করে রাখে, তারা আর অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে না। এবং জীবন-মৃত্যুর চক্রে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে।
👉ধর্ম, কর্ম্ম, জ্ঞান, পাণ্ডিত্য প্রভৃতির বিষয় সম্বন্ধে এইরূপ আপত্তি উত্থাপন করে শেষে ব্রাহ্মণের লক্ষণ সম্বন্ধে এইরূপ মীমাংসা করা হয়েছে যে—
করতলামলকমিব পরমাত্মহপরোক্ষেণ কৃতার্থতয়া শমদমাদিযত্নশীলো দয়ার্জ্জবক্ষমাসত্যসন্তোষবিভবক নিরুদ্ধমাৎসর্য্যদম্ভসম্মোহো যঃ এক স এব ব্রাহ্মণ ইত্যুচ্যতে।
তথাহি, "জন্মনা জায়তে শুদ্রঃ সংস্কারাদুচ্যতে দ্বিজঃ।
বেদাভ্যাসাদ্ভবেদ্বিপ্রো ব্রহ্ম জানাতি ব্রাহ্মণঃ।। ইতি।
অতএব ব্রহ্মবিদ্বাহ্মণো নান্য ইতি নিশ্চয়ঃ।
তজ জ্ঞানতারতম্যেন ক্ষত্রিয়বৈশ্যৌ তদভাবেন শুদ্র ইতি সিদ্ধান্তঃ।।
যিনি করতলস্থিত আমলকী ফলের ন্যায় অপরোক্ষ রূপে পরমাত্মার সত্তা উপলব্ধি করে কৃতার্থ হয়েছে, যিনি শমদমাদি সাধন বিষয়ে যত্নশীল, যিনি দয়া ক্ষমা সত্য সরলতা ও সন্তোষ প্রভৃতি গুণ সম্পন্ন এবং যিনি মোহ মাৎসর্য্য ও দম্ভাদি দমন বিষয়ে যত্নবান তাকেই কেবল ব্রাহ্মণ বলা যায়।
কারণ শাস্ত্রে কথিত আছে জন্মকালে সবাই শুদ্র থাকে, পরে উপনয়নাদি সংস্কার প্রাপ্ত হলে দ্বিজ, বেদাভ্যাস করলে বিপ্র আর ব্রহ্মকে জানিলে তবেই ব্রাহ্মণ বলে গণ্য হয়।
অতএব এটাই নিশ্চয় হলো যস ব্রহ্মনিষ্ঠ ব্যাক্তিই কেবল ব্রাহ্মণ, অন্য কেউ নয়। সেই জ্ঞানের ন্যুনাধিক্য দ্বারা ক্ষত্রিয় বৈশ্য আর তাহার অভাব দ্বারা শূদ্র হয়।
🔷মহর্ষি ভরদ্বাজ ব্রহ্মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে—
কো ব্রাহ্মণঃ?
ব্রাহ্মণ কে?
পিতামহ ব্রহ্মা উত্তর দিলেন —
ব্রহ্মবিৎ এব ব্রাহ্মণঃ।
অর্থ — যিনি ব্রহ্ম কে লাভ করার মার্গে নিরত হয়ে ব্রহ্মবিদ্যায় নিরত হন, তিনিই ব্রাহ্মণ।
(নিরালম্বোপনিষদ- ৩৯)
তাই গোঁড়াব্রাহ্মণরা প্রথমে ব্রহ্মতত্ত্বকে জেনে তারপর নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে দাবী করুন।
👉যারা ব্রহ্ম তত্ত্বকে জানেন না, অথচ নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে দাবী করেন তার জন্য শাস্ত্রে বলেছেন যে—
ব্রাহ্মণগণের মধ্যে যারা ব্রহ্মজ্ঞানলাভে যত্নবান না হন, এবং যারা সেই জ্ঞানলাভার্থে বেদাদি শাস্ত্র অধ্যয়ন না করে অন্য রূপে জীবন অতিবাহিত করে, ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করলেও শাস্ত্রকারগণ তাদের প্রকৃত ব্রাহ্মণরূপে উল্লেখ করে নাই।
👉পরাশর সংহিতা'য় বলা হয়েছে —
অত ঊর্ধ্বস্তু যে বিপ্রাঃ কেবলং নামধারকাঃ।
পারিষত্বং ন তেষাং বৈ সহস্রগুণসমণিতেষ্বপি।।২২
(পরাশর সংহিতা, অধ্যায়, ৮)যারা কেবল নাম মাত্র ব্রাহ্মণ (অর্থাৎ বেদজ্ঞ নয়) তারা সহস্রগুণ সম্পন্ন হলেও পরিষদ হতে পারে না।।২২
👉 যথা কাষ্ঠময়ো হস্তী যথা চর্ম্মময়ো মৃগঃ।
ব্রাহ্মণাস্ত্বনধীয়ানাস্ত্রয়স্তে নামধারকাঃ।।২৩
(পরাশর সংহিতা, অধ্যায়, ৮)কাট নির্মিত হস্তী যেরূপ, চর্ম্মময় মৃগ যেরূপ, অধ্যয়ন বিহীন ব্রাহ্মণ সেইরূপ, এরা তিন জন নাম ধারণ করে মাত্র।।২৩
👉 গ্রামস্থানং যথা শূন্যং যথা কূপস্তু নির্জ্জলঃ।
যথা হুতমনগ্নৌ চ অমন্ত্রো ব্রাহ্মণস্তথা।।২৪
(পরাশর সংহিতা, অধ্যায়, ৮)শূন্য গ্রাম যেরূপ, জলহীন কূপ যেরূপ, অগ্নিহীন ভস্মে হোম প্রদান করা যেরূপ নিষ্ফল, (বৈদিক) মন্ত্রানভিজ্ঞ ব্রাহ্মণ ও সেইরূপ নিষ্ফল।।২৪
👉 যথা ষণ্ডোহফলঃ স্ত্রীষু যথা গৌরুষরাফলা।
যথা চাজ্ঞেহফলং দানং তথা বিপ্রোহনৃচোহফলঃ।।২৫
(পরাশর সংহিতা, অধ্যায়, ৮)ষণ্ড অর্থাৎ নপুংষকের স্ত্রী সম্ভোগ যেরূপ নিষ্ফল, মূর্খে দান ও মরুভূমি যেরূপ নিষ্ফল, বেদানভিজ্ঞ ব্রাহ্মণ ও সেইরূপ নিষ্ফল।। ২৫
👉ভগবান ব্যাস বলেছেন —
"মূর্খ ব্রাহ্মণ, কাঠের হস্তী, চর্ম্মের মৃগ, মনুষ্যবিহীন গ্রাম এবং জলবিহীন কূপ এই কয়টিই সমান।
(ব্যাস সংহিতা, ৪র্থ অধ্যায়)
👉মনু সংহিতাতেও অবিকল এইরূপ অভিপ্রায় দেখা যায়।। (মনুস্মৃতি, ২/১৫৬)
মনু আরও বলেছেন যে—
বেদাধ্যয়ন ও বেদ শাস্ত্রের অনুশীলন না করে যে সকল ব্রাহ্মণ অন্য বিষয়ে পরিশ্রম করে, তারা জীবিতবস্তাতেই শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হন।
(মনুস্মৃতি, ২/১৬৮)
👉এমনকি ভগবান ব্যাসদেব মূর্খ ব্রাহ্মণদের জন্য এইরূপ বলেছেন যে—
বেদপূর্ণমুখং বিপ্রং সুভুক্তমপি ভোজয়েৎ।
ন চ মুর্খং নিরাহারং ষড়রাত্রমুপাবাসিনং।।
(ব্যাস সংহিতা, অধ্যায় ৪)যে ব্রাহ্মণের মুখে বেদ শাস্ত্রের কথা সর্বদা শুনতে পাওয়া যায়, তিনি যদি উত্তম রূপে ভোজন করে থাকে তাহলে তাকে যত্ন সহকারে ভোজন করানো উচিত, কিন্তু মূর্খ ব্রাহ্মণ যদি আহার না পেয়ে ছয়রাত উপবাস থাকে তাহলে, তারপরেও সেই মূর্খ ব্রাহ্মণ কে আহার প্রদান করবে না।।
➡️এই ছিলো প্রকৃত ব্রাহ্মণ ও মূর্খ ব্রাহ্মণের মধ্যে পার্থক্য।
ব্রাহ্মণের স্বভাব হওয়া দরকার নির্ম্মল, ধৈর্য্যশীল, দয়াবান, ক্ষমাশীল,পরোপকারী, বেদজ্ঞ, ব্রহ্মতত্ত্বনিষ্ঠ। কিন্তু বর্তমানের ব্রাহ্মণেরা কেবল নাম ধারণ করে মাত্র। এদের ব্রহ্মজ্ঞানের মাত্রা ভাঁড়ে মা ভবানি।
তাই বলছি নিজেকে ব্রাহ্মণ পরিচয় দিয়ে অযথা মূর্খের পরিচয় দিবেন না। আপনি শুধু ব্রাহ্মণকে উপস্থাপন করছেন মাত্র। তাই পৈতার জোড়ে বা জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ বলে গর্ববোধ করার কোনোই কারণ নেই। নিজেকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও তুলনা করতে যাবেন না।
কারণ ব্রাহ্মণ শব্দের অর্থ না জেনে ব্রাহ্মণ,ব্রাহ্মণ বলে লাফানো বন্ধ করুন।
কারণ ব্রাহ্মণ শব্দের অর্থ হলো—
ব্রাহ্মণ শব্দটি ব্রহ্ম শব্দ থেকে এসেছে।
সংস্কৃত ব্রোম/বৃনহ্ + মন হতে উৎপত্তি।
যার অর্থ হলো পরমাত্মা, পরমেশ্বর, পরমপুরুষ, বিধাতা, বেদমন্ত্র, তপস্যা ও ওঙ্কার।
যিনি ব্রহ্মকে জানতে সর্বোতভাবে চেষ্টা করেন, তিনিই ব্রাহ্মণ।
➡️ এসবের বাইরেও মানুষ বুঝতেই পারে না ধর্মের মূল বিষয় কি মীমাংসা কি। খুব সাধারণ ভাবেই বলি, যদি শ্রীকৃষ্ণের জীবনী দেখে বা পড়ে থাকে তাহলে এটা নিশ্চিত যে, অন্তত জাতপাতের বেড়াজালের মীমাংসা কতটা সুন্দর ভাবে আমাদের মাঝে উপস্থাপন করে গেছেন—
👉 ভগবান পরমশৈব শ্রীকৃষ্ণের জন্ম অনুসারে ছিলেন ক্ষত্রিয়, বসুদেবের (ঔরসে) দেবকীর গর্ভে।
কৃষ্ণের লালন পালন হয় যাদবকূলে অর্থাৎ এবার বৈশ্য হয়ে গেলেন।
এবার যখন কৃষ্ণ অর্জুনের রথের সারথী তাহলে এবার তিনি হয়ে গেলেন শূদ্র।
আর যখন অর্জুনের অজ্ঞনতাকে দূর করতে যখন ধর্মের জ্ঞান দিচ্ছেন, ধর্ম, কর্তব্য, কর্ম সম্পর্কে বোঝাচ্ছেন তখন হয়ে গেলেন ব্রাহ্মণ।
অর্থাৎ ব্যক্তিত্ব একটাই গুণ এবং কর্ম অনুসারে'ই বর্ণের প্রতিফলন হচ্ছে। এই সাধারণ ব্যাপার টা কেউ বুঝতে পারে না বলেই, জাতপাতের বেড়াজালে আটকে থাকে।
👉যারা জাতপাতের বেড়াজালে আটকে থাকে, তাদের জন্য শাস্ত্র বলছে—
স্বস্ববর্ণাশ্রমাচারনিরতাঃ সর্বমানবাঃ।
ন জানান্তি পরং তত্ত্বং মূঢ়া নশ্যন্তি পার্বতি।।৭২
[কূলার্ণব তন্ত্র- ১ম উল্লাস—৭২]সব মানুষ আপন আপন বর্ণাশ্রমবিহিত আচার পালনেই সন্তুষ্ট। হে পার্বতী ! এই মূঢ়েরা পরমতত্ত্ব জানে না বলেই বিনাশ প্রাপ্ত হয়।। ৭২
👉বর্ণাশ্রম পালন করলেই জীবের উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ হবে এটা ওদের মান্যতা। কিন্তু স্বয়ং পরমেশ্বর শিব বলছেন যে পরতত্ত্বকে জানে না তারা জন্ম-মৃত্যুর চক্রে ঘুরপাক খেতেই থাকে। এরা শুধু জন্মাবে আর মরবে। জীবের মূল উদ্দেশ্য কি তা আর উপলব্ধি করতেই পারবে না।
🔶🔶এবার আসা যাক অতিবর্ণাশ্রমী কী সেই বিষয়ে🔶🔶—
🔷যিনি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে ফেলেছেন, তিনি সকল বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে যান, তিনি — অতিবর্ণাশ্রমী।
শাস্ত্রে অতিবর্ণাশ্রমীকে সকল বর্ণের ঊর্ধ্বে বলেছে। যেখানে তাকে কোনো জাত, বর্ণ দ্বারা আবদ্ধ করা যায় না। যে পর্যায়ে চলে গেলে সব শিবময় হয় তাহাই অতিবর্ণাশ্রমী।
🔷অতীবর্ণাশ্রমী নিয়ে শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে—
তস্মাদ সেব্য নমস্কার্যাঃ সদা ব্রহ্মবিদস্তথা।।৩২
বর্ণাশ্রমীবিনির্মুক্তা বর্ণাশ্রমপরায়ণৈঃ।।৩৩
(লিঙ্গমহাপুরাণ, পূর্ব্বভাগ, অধ্যায় ২৮)বর্ণাশ্রমের নিয়ম থেকে মুক্ত হয়ে বর্ণাশ্রমের ঊর্ধ্বে উঠে যারা 'অতিবর্ণাশ্রমী শৈব' হয়ে গেছেন সেই সমস্ত ব্রহ্মজ্ঞানী/শিবজ্ঞানী শৈবদের সমক্ষে সর্বদা নত হয়ে নমস্কার সহ সেবা করবে বর্ণাশ্রমী (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র) গণ ॥ ৩২-৩৩
👉তাছাড়া যিনি অতিবর্ণাশ্রমী তিনি শিবস্বরূপ হন।
আর যিনি শিব যোগী তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তাকে নির্দিষ্ট কোনো বর্ণে বাঁধা যায় না। ব্রাহ্মণের চেয়েও শ্রেষ্ঠ হলো অতিবর্ণাশ্রমী।
অতিবর্ণাশ্রমী নিত্যং শিবোঽহং ভাবনাৎপরাৎ ।
শিবযোগী চ নিয়তমীশানেনাপি ধারয়েৎ ॥৩৭
[তথ্যসূত্র - শিবমহাপুরাণ/বিদ্যেশ্বর সংহিতা/২৪নং অধ্যায়]
অর্থ — যারা বর্ণাশ্রমের বিধিনিষেধের ঊর্দ্ধে উঠে গেছেন তারা অতিবর্ণাশ্রমী, তারা নিত্য আমিরূপী আত্মাই শিব —এমন ভাবনাতে তৎপর থাকেন, এনাদেরই শিবযোগী বলে, এনারা ঈশানমন্ত্র দ্বারা ভস্ম ধারণ করে থাকেন।।৩৭
👉ব্রাহ্মণদের একটা হাস্যকর দাবী এখানে খণ্ডিত হয়। তারা বলে ব্রাহ্মণ দেবতাস্বরূপ হয়। তাই তাদের পূজা করা দরকার।
কিন্তু শাস্ত্রে তো বলছে যিনি অতিবর্ণাশ্রমী সে সাক্ষাৎ শিবস্বরূপ হয় অর্থাৎ নিজেই ব্রহ্ম হয়ে যায় তাহলে ব্রাহ্মণদের কি দরকার না অতিবর্ণাশ্রমীদের পূজা, সেবা করা?
ব্রহ্মের থেকেই তো সম্পূর্ণ জগৎ সৃষ্টি হচ্ছে, অন্তে লয় ও হচ্ছে। এবং সকল দেবতাই তো ব্রহ্মেরই প্রকাশিত স্বরূপ মাত্র।
তাহলে যে অতিবর্ণাশ্রমীরা সাক্ষাৎ ব্রহ্মের স্বরূপ হয় তাদের বিরুদ্ধে দেবতার দোহাই দেওয়া নিতান্তই বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।
🔷এছাড়াও অতিবর্ণাশ্রমী সম্পর্কে শাস্ত্র আরও বলছে যে—
যস্য বর্ণাশ্রমাচারো গলিতঃ স্বাত্মদর্শনাৎ ।
স বর্ণানাশ্রমান্সর্বানতীত্য স্বাত্মনি স্থিতঃ ॥ ৩১
যোঽতীত্য স্বাশ্রমান্বর্ণানাত্মন্যেব স্থিতঃ পুমান্ ।
সোঽতিবর্ণাশ্রমী প্রোক্তঃ সর্ববেদান্তবেদিভিঃ ॥ ৩২
জলস্য চলনাদেব চঞ্চলত্বং যথা রবেঃ ।
তথাঽহঙ্কারসম্বন্ধাদেব সংসার আত্মনঃ ॥ ৩৫
তস্মাদন্যগতা বর্ণা আশ্রমা অপি কেশব ।
আত্মন্যারোপিতা এব ভ্রান্ত্যা তে নাঽঽত্মবেদিনঃ ॥ ৩৬
ষ বিধির্ন নিষেধশ্চ ন বর্জ্যাবর্জ্যকল্পনা ।
আত্মবিজ্ঞানিনামস্তি তথা নান্যজ্জনার্দন ॥ ৩৭
আত্মবিজ্ঞানিনো নিষ্ঠামীশ্বরীমম্বুজেক্ষণ ।
মায়য়া মোহিতা মর্ত্যা নৈব জানন্তি
সর্বদা ॥ ৩৮
✅ সেই(অতিবর্ণাশ্রমী) ব্যক্তি আশ্রম প্রযুক্ত কোনো আচার পালন করেন না, তিনি বর্ণ তথা বর্ণাশ্রমের নিয়ম আচারের ঊর্ধ্বে উঠে নিজ(আত্ম) স্বরূপস্থিত(আভ্যন্তরীণ আত্মভাবে শিবরূপে স্থিত) হন (অর্থাৎ) যে পুরুষ(তথা মানব) এইভাবে(দেহাভিমানশূণ্য হয়ে) নিজ আশ্রম তথা বর্ণের ঊর্ধে উঠে নিজ স্বরূপস্থিত হন, সেই ব্যক্তিই বেদান্তবেত্তাগণের দ্বারা অতিবর্ণাশ্রমী বলে সম্মোধিত(কথিত) হন ॥ ৩১-৩২
(নন্দীটিকা - ও বিভিন্ন রকম বর্ণাশ্রম প্রথার নিয়ম অথবা বিধি অতিবর্ণাশ্রমীরা পালন করেন না, অতি বর্ণাশ্রমীরা এটি মনে করেন যে তারা অদ্বিতীয় আত্মা এবং আত্মাতে কখনোই বর্ণাশ্রম বিধি আরোপিত হয় না, সুতরাং আত্মজ্ঞানী শৈবগণ বিধিনিষেধের ঊর্ধ্বে )
✅ যেমন জলের চঞ্চলতায় ঢেউ এর দ্বারা তার মধ্যে থাকা সূর্যের প্রতিবিম্বতে চঞ্চলতা অনুভব হয় , তেমনি অহংকার সম্বন্ধ দ্বারা আত্মাতেও সংসরণ(বিচলিত) অনুভব হয় ।
অতএব, অন্যত্র অর্থাৎ শরীরাদির ধর্মভূত বর্ণাশ্রমাদি ভ্রমবশত আত্মার উপর আরোপিত করা হয়ে থাকে। যিনি আত্মস্বরূপ উপলব্ধি করে এই ভ্রমকে ছিন্ন করে ভ্রম থেকে মুক্ত হয়েছেন, তার কাছে এই বর্ণাশ্রমের কোনো সত্ত্বাই নেই ॥ ৩৫-৩৬
(নন্দীটিকা - সূর্যের প্রতিচ্ছবিকে জলের ঢেউতে নড়তে বা বিচলিত হতে দেখা যায় কিন্তু আসলে তা ভ্রম মাত্র, কেননা জলের মধ্যে সূর্য আদৌও নেই, ঠিক তেমনি আত্মাকেও দেহের মধ্যে ভেবে জীবেরা তার উপর মায়ার তৈরি জাগতিক বর্ণাশ্রমকে আরোপিত হয় বলে ভাবে, তারা ভাবে আত্মার সুখ দুঃখ আছে, কিন্তু যে আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি এই ভ্রমকে কাটিয়ে উঠতে পারেন এবং আত্মাকে সমস্ত মায়া থাকে নির্লিপ্ত জানতে সক্ষম হন তিনি অতিবর্ণাশ্রমী)
✅ আত্মজ্ঞানীর জন্য কোনো বিধি, নিষেধ, বর্জ্জ্য, অবর্জ্জ্য আদি কিছুই থাকে না ॥ ৩৭
(নন্দীটিকা - যিনি আত্মজ্ঞানী অতিবর্ণাশ্রমী তার ক্ষেত্রে বর্ণাশ্রমের বাধা নিষেধ কখনোই প্রযোজ্য হয় না তার ওপর কেননা তিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন তাই আত্মার ওপর কখনোই বিধি-নিষেধ আরোপিত হয় না, যারা আত্ম জ্ঞানহীন তাদের জন্য বর্ণাশ্রম -এর বিধি নিষেধ আরোপিত হয় অর্থাৎ শৈবরা বর্ণাশ্রমগত বিধি-নিষেধের ঊর্ধ্বে)
✅ যে মরণধর্মা মনুষ্য মায়া দ্বারা মোহিত হয়, সেই মনুষ্য কখনোই আত্মজ্ঞানীর ঈশ্বর নিষ্ঠা কে কখনোই বুঝতে সক্ষম হয় না ॥ ৩৮
(নন্দীটিকা - যে ব্যক্তি জাগতিক মায়া দ্বারা ভ্রমে রয়েছেন তিনি কখনোই আত্মজ্ঞানীব্যক্তির উচ্চ পর্যায়ের জ্ঞানের উচ্চতা কে বোধগম্য করতে সক্ষম নন, মায়ায় ভ্রমিত ব্যক্তি অতি বর্ণাশ্রমের ব্যক্তির চিন্তা ধারা ও তার উপলব্ধির বিন্দুমাত্র নিজের মায়া দ্বারা ভ্রমিত বিচার-বিবেচনা দ্বারা তা উপলব্ধি করতে সক্ষম নন তাই তারা অতিবর্ণাশ্রমী হওয়ার পর্যায় পৌঁছাতেও পারেন না এমনকি তারা অতিবর্ণাশ্রমী ব্যক্তির চিন্তা-ধারাকেও বুঝতে অক্ষম, আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি যেভাবে পরমেশ্বরকে জগৎময় চিন্তা করেন এবং নিজের আত্মাতে সেই পরমেশ্বর কে একত্ব ভাবে দর্শনরূপী পূজা করে থাকেন সেই চরম পর্যায়ের চিন্তা কখনোই সাধারণ ব্যক্তি করতে পারেনা)
🔷অর্থাৎ এর থেকে স্পষ্ট যে, যে সাধক নিজের আত্মস্বরূপ (শিবজ্ঞান দ্বারা শিবকে) জানতে পারে তিনিই বর্ণাশ্রমের ঊর্ধ্বে, অতিবর্ণাশ্রমী বলে কথিত হন। যার কাছে সমগ্র অখিলবিশ্বব্রহ্মাণ্ড শিবময়।
➡️ যেসব ব্রাহ্মণরা মনে যে, বেদের মধ্যে অতিবর্ণাশ্রমীর কথা উল্লেখ নেই তাদের জন্য কৈবল্য উপনিষদ ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে পরিষ্কারভাবে অতিবর্ণাশ্রমীর শব্দ প্রমাণ দেখানো হলো—
বেদেও অতিবর্ণাশ্রমী নিয়ে বলা হয়েছে যে, সাধারণ বর্ণাশ্রমে যারা রয়েছেন তাদের মুক্তির জন্য, অতিবর্ণাশ্রমীদের অনুসরণ করতে বলা হয়েছে—
দ্বিতীয় খন্ড ॥
যঃ শতরুদ্রিযমধীতে সোঽগ্নিপূতো ভবতি । স বাযুপূতো ভবতি । স আত্মপূতো ভবতি । স সুরাপানাৎপূতো ভবতি ।
স ব্রহ্মহত্যাযাঃ পূতো ভবতি । স সুবর্ণস্তেযাৎ পূতো ভবতি ।
স কৃত্যাকৃত্যাৎ পূতো ভবতি । তস্মাদবিমুক্তমাশ্রিতো ভবতি ।
অত্যাশ্রমী সর্বদা সকৃদ্বা জপেৎ ।
অনেন জ্ঞানমাপ্নোতি সংসারার্ণবনাশনম্ । তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং কৈবল্যং পদমশ্রুতে কৈবল্যং পদমশ্রুত ইতি ॥ ২৫ ॥
[কৈবল্য উপনিষদ, দ্বিতীয় খণ্ড]অর্থ — যে মনুষ্য এই শতরুদ্রিয় পাঠ করে সে অগ্নির সাদৃশ্য পবিত্র হয়ে যায়, বায়ুর মতো সুচিতার বরণ করে, সে আত্মপূজা(পরমাত্মা শিবের সহিত একত্ব) করে সে সুরাপান ও ব্রহ্মহত্যার দোষ থেকেও মুক্ত হয়ে যায়, স্বর্ণ চুরির মতো পাপ থেকে মুক্ত হয়ে যায়, শুভাশুভ কর্মের দ্বারা উদ্ধার হয়ে যায়। ভগবান সদাশিবের প্রতি সমর্পিত ব্যক্তি অবিমুক্তস্বরূপকে প্রাপ্ত করে। যিনি অত্যাশ্রমী(যে ব্যক্তি বর্ণাশ্রম ও চতুরাশ্রমের বিধিনিষেধের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছেন), সেই কৈবল্যপদপ্রাপ্তকারী(শিবপদে স্থিত) ব্যক্তিকে সর্বদা অনুসরণ করা উচিত অথবা অন্তত একবার এই কৈবল্য উপনিষদের পাঠ অবশ্যই করা উচিত ॥ ২৫ ॥
তপঃ প্রভাবাদ্দেবপ্রসাদাশ্চ ব্রহ্ম হ শ্বেতাশ্বতরহথ বিদ্বান।
অত্যাশ্রমিভ্যঃ পরমং পবিত্রং প্রোবাচ সম্যগৃষিসঙ্ঘজুষ্টম্ ।।২১
[শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, অধ্যায় ৬]অর্থ — বিদ্বান শ্বেতাশ্বতর তপঃপ্রভাবে ও দেবপ্রসাদে ঋষিকুল সেবিত ব্রহ্ম-শিবকে সম্যক্ বিদিত হইয়াছিলেন এবং পরে পরমপবিত্র অত্যাশ্রমীদিগকে ঐ ব্রহ্মজ্ঞান সম্পর্কে বলেছিলেন।। ২১
🔶মহর্ষি ব্যাসদেব তার ব্যাস সংহিতা ১.৪ তে বলেছেন—
"শ্রুতি স্মৃতি পুরাণানাং বিরোধো যত্র দৃশ্যতে ।
তত্র শ্রৌতং প্রমাণস্তু তয়োর্দ্বৈধে স্মৃতিব্বরা ॥"
♦️সরলার্থ : যেখানে শ্রুতি, স্মৃতি ও পুরাণের বিরোধ দেখা যায়, সেখানে শ্রুতির কথনই বলবান এবং যেস্থলে স্মৃতি ও পুরাণের বিরোধ দেখা যায়, সেখানে স্মৃতির কথনই বলবান।
🔷তাই এক্ষেত্রে শ্রুতি অর্থাৎ বেদের কথাই মান্যতা পাবে। এবং অতিবর্ণাশ্রমী যে, সবার চেয়েও শ্রেষ্ঠ এটিও মানতে হবে।
🔷 বেদ থেকে ও অতিবর্ণাশ্রমীর প্রমাণ দেখানো হলো।
সুতরাং মূল কথা এটাই যে, অতিবর্ণাশ্রমীরা হলো সকল বর্ণাশ্রমের ঊর্ধ্বে, সকলের থেকে শ্রেষ্ঠ ও সকলের গুরু। তাই যদি জীব মুক্তির অভিলাষ করে তাহলে বর্ণাশ্রম এর ঊর্ধ্বে গিয়ে অতিবর্ণাশ্রমী হয়ে সেই পরমজ্ঞান শিবজ্ঞান সম্পর্কে জানতে হবে। তার জন্য অতিবর্ণাশ্রমীদের অনুসরণ করতে হবে। অতিবর্ণাশ্রমী শৈবরা সকল বিধি নিষেধের থেকে মুক্ত হয়ে স্বতন্ত্র ভাবে থাকেন।
🔴 পরমেশ্বর শিবের ভক্ত শৈব রা সর্বদা সকল বিধি নিষেধের থেকে মুক্ত, দেখুন -
স্বতন্ত্রঃ খলু শংকরঃ ।। ৪৬
মহাদেবস্য ভক্তাশ্চ তদ্ভক্তা অপি দেহিনঃ ।
স্বতন্ত্রতা বেদবিচ্ছ্রেষ্টাঃ কিং পুনঃ স মহেশ্বরঃ ।। ৪৭
[স্কন্দমহাপুরাণ/সূতসংহিতা/যজ্ঞবৈভবখণ্ড/উপরিভাগ/(সূতগীতা) ৩ অধ্যায়/ ৪৬-৪৭ নং শ্লোক]
অর্থ - পরমেশ্বর শিব সকল বিধি নিষেধের থেকে মুক্ত, স্বতন্ত্র। যখন পরমেশ্বর শিবের অদ্বৈতবাদী অতিবর্ণাশ্রমী ভক্তশৈবরাই স্বতন্ত্র, তখন মহেশ্বরের স্বতন্ত্রতার বিষয়ে আর কি বলব ?।
➡️ যারা সত্যিকারেরই ধার্মিক ব্যক্তিবর্গ তারা সবাই অতিবর্ণাশ্রমী মার্গকেই অনুসরণ করেন। এবং পরমেশ্বর শিব কতৃক সৃষ্ট পাশুপত ব্রত পালন করেন। কারণ এই ব্রত সমস্ত আশ্রম ধর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
যার প্রমাণ মহাভারতে পাওয়া যায় —
গতাং তৈরধ্যবসিতমত্যাশ্রমমিদং ব্রতং।
ময়া পাশুপতং দক্ষ শুভমুৎপাদিতং পুরা।।১২৩
অর্থ — ধার্মিকেরা অধ্যাবসায় সহকারে পাশুপত ব্রত আচরণ করেন। পাশুপত ব্রত সমস্ত আশ্রম ধর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।। ১২৩
⚠️আবারও বলছি যারা পৈতার জন্য বা ব্রাহ্মণ ঘরে জন্মগ্রহণ করার জন্য নিজেকে পূর্ণ ব্রাহ্মণ বলে দাবী করছেন আর অন্যদের অব্রাহ্মণ হবার কারণে হেনস্থা করছেন, তা কিন্তু আপনাদের ভুল ধারণা।
এই কাজের জন্যই ব্রাহ্মণদের আজকের সমাজে কোনো মূল্য নেই, কেউ দাম দেয় না। তাদের অহংকার তাদের সর্বনাশ এর কারণ হয়।
যদি জন্মগতভাবেই পূর্ণ ব্রাহ্মণ হয়ে থাকে, তবে বিচার করে দেখুন, সকল মনুষ্য তথা জীবগণ মনুর তথা ব্রহ্মার সন্তান, সেই হিসেবে সকলেই ব্রাহ্মণ।
সনাতন ধর্মে কোনো জাতপাত নেই, সনাতন ধর্মে পরমেশ্বর শিব সকলকে অতিবর্ণাশ্রমী হবার অধিকার দিয়েছেন, আত্মজ্ঞানী হবার অধিকার সবার আছে।
তাই বলছি মিছা ব্রাহ্মণত্বের অহংকার ত্যাগ করে আত্মজ্ঞানী শিবজ্ঞানী অতিবর্ণাশ্রমীদের অনুসরণ করুন। আপনাদের জীবনে অনেক উন্নতি হবে (পারমার্থিক ও লৌকিক) দুই দিকেই।
🔷তাই সিদ্ধান্ত হলো —
পৈতা ধারণ বা জন্মসূত্রে পূর্ণ ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না ✔️
ব্রহ্মজ্ঞানে চেষ্টা রত ব্যক্তিই প্রকৃত ব্রাহ্মণ ✔️
অতিবর্ণাশ্রমী সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ✔️
মুক্তির জন্য জীবের উচিত অতিবর্ণাশ্রমী মার্গ চয়ন করা ✔️
ॐ দক্ষিণামূর্তয়ে নমঃ🙏
ॐ সাম্বসদাশিবায় নমঃ 🙏
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে ✊🚩
✍️ সংগ্রহ ও লেখনীতেঃ- অন্তিক ভট্টাচার্য্য (শম্বরনাথ শৈব)
🔆 বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ- আমার গুরু হলেন “শ্রী নন্দীনাথ শৈবাচার্য” জী। যার থেকে শাস্ত্রশিক্ষা ও জ্ঞান পেয়ে আমি শিবজ্ঞান লাভে সমৃদ্ধ হয়েছি।
🔶ধন্যবাদ — শ্রী রোহিত কুমার চৌধুরী শৈবজী, শ্রী সৌরভ গাঙ্গুলি শৈবজী, শ্রী ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য শৈব জী ।
কপিরাইট ও প্রচারেঃ- International Shiva Shakti Gyan Tirtha (আন্তর্জাতিক শিবশক্তি জ্ঞান তীর্থ)
বিঃ দ্রঃ- লেখাটি কপি করলে সম্পূর্ণরূপে কপি করবেন, কোনো রকম কাটাছেঁড়া ছাড়া।।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন