নন্দী মহারাজ দ্বারা রাবণকে অভিশাপ ও পরমেশ্বর শিবের দ্বারা রাবণের দম্ভ নাশ

নন্দী মহারাজ দ্বারা রাবণকে অভিশাপ ও পরমেশ্বর শিবের দ্বারা রাবণের দম্ভ নাশ


অভিমানী দাম্ভিক রাবণ আকাশে যাত্রাপথে কৈলাস পর্বতের কারণে বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে নিচে নেমে এলে নন্দী মহারাজের সতর্ক বাক্য শুনে নন্দী মহারাজ কে অপমানিত করেন, নন্দী মহারাজ তাকে অভিশাপ দেন। জড়িয়ে পড়েন, এরপর রাক্ষসরাজ রাবণ অহংকারবশত নিজেকে সর্বশক্তিমান ভেবে পরমেশ্বর শিব কে তুচ্ছ মনে করে কৈলাস পর্বত তুলতে ফেলে দেবার দুঃসাহস দেখাতে গিয়ে চরম শাস্তি ভোগ করেন, সেই প্রসঙ্গে ‘বাল্মিকী রামায়ণ’ থেকে সম্পূর্ণ তথ্যসূত্র উল্লেখ করে শ্লোকসহ অনুবাদ উপস্থাপন করা হয়েছে নিম্নোক্ত প্রতিবেদনে ।

_______________________________________________


স জিত্বা ধনদং রাম ভ্রাতরং রাক্ষসাধিপঃ ।

মহাসেনপ্রসূতি তদ্ যযৌ শরবণ মহৎ ॥ ১

অথাপশ্যদ্ দশগ্রীবো রৌক্মং শরবণং মহৎ ।

গভস্তিজালসম্বীতং দ্বিতীয়মিব ভাস্করম্ ॥ ২

স পর্বতং সমারুহ্য কঞ্চিদ্ রম্যবনান্তরম্ ।

প্রেক্ষতে পুষ্পকং তত্র রাম বিষ্টম্ভিতং তদা ॥ ৩

বিষ্টব্ধং কিমিদং কস্মান্নাগমৎ কামগং কৃতম্ ।

অচিন্তয়দ্ রাক্ষসেন্দ্রঃ সচিবস্তঃ সমাবৃতঃ ॥ ৪

কিনিমিত্তামিচ্ছা সে নেদং গচ্ছতি পুষ্পকম্ ।

পর্বতস্যোপরিষ্ঠস্য কর্মেদং কস্যচিদ্ ভবেৎ ॥ ৫

ততোঽব্রবীৎ তদা রাম মারীচো বুদ্ধিকোবিদঃ ।

নেদং নিষ্কারণং রাজন পুষ্পকং যন্ন গচ্ছতি ॥ ৬

অথবা পুষ্পক মিদং ধনদান্ত্রান্য বাহনম্ ।

অতো নিস্পন্দমভবদ্ ধনাধ্যক্ষ বিনা কৃতম্ ॥ ৭

ইতি বাক্যান্তরে তস্য করালঃ কৃষ্ণপিঙ্গলঃ ।

বামনো বিকটো মুণ্ডী নন্দী হ্রস্বভুজো বলী ॥ ৮

ততঃ পার্শ্বমুপাগম্য ভবস্যানুচরোঽব্রবীৎ ।

নন্দীশ্বরো বচশ্চেদং রাক্ষসেন্দ্রমশঙ্কিতঃ ॥ ৯

নিবর্তস্ব দশগ্রীব শৈলে ক্রীড়তি শঙ্করঃ ।

সুপর্ণ নাগ যক্ষাণাং দেবগন্ধর্বরক্ষসাম্ ॥ ১০

সর্বেষামেব ভূতানামগম্যঃ পর্বতঃ কৃতঃ ।

ইতি নন্দিবচঃ শ্রুত্বা ক্রোধাৎ কস্মিতকুণ্ডলঃ ॥ ১১

শেষাৎ তু তাম্রনয়নঃ পুষ্পকাদবরুহ্য সঃ ।

কোঽয়ং শঙ্কর ইত্যুক্ত্বা শৈলমূলমোপাগতঃ ॥ ১২

সোঽপশ্যন্ নন্দিনং তত্র দেবাস্যাদূরতঃ স্থিতম্ ।

দীপ্তং শূলমবষ্টভ্য দ্বিতীউয়মিব শঙ্করম্ ॥ ১৩

তং দৃষ্টবা বানরমুখমবজ্ঞায় স রাক্ষসঃ ।

প্রহাসং মুমুচে তত্র সতোয় ইব তোয়দঃ ॥ ১৪

তং ক্রুদ্ধো ভগবান্ নন্লী শঙ্করস্যাপরা তনুঃ ।

অব্রবীৎ তত্র তদ্ রক্ষো দশাননমুপস্থিতম্ ॥ ১৫

যস্মাদ্ বানররূপং মামবজায় দশানন ।

অশনীপাতসঙ্কাশমপহাসং প্রমুক্তবান্ ॥ ১৬

তস্মান্মদ্বীর্যসংযুক্তা মদ্ রূপসমতেজসঃ ।

উৎপৎস্যন্তি বধার্থং হি কুলস্য তব বানরাঃ ॥ ১৭

নখদংষ্ট্রাযুধা ক্রুর মনঃ সম্পাতরংহসঃ ।

যুদ্ধোন্মত্তা বলোদ্রিক্তা শৈলাঃ ইব বিসর্পিণঃ ॥ ১৮

তে তব প্রবলং দর্পমুৎসেধং চ পৃথগ্বিধম্ ।

ব্যপনেষ্যন্তি সম্ভূয় সহামাত্যসুতস্য চ ॥ ১৯

কিং ত্বিদানীং ময়া শক্যং হন্তুং ত্বাং হে নিশাচর ।

ন হন্তব্যো হতস্ত্বং হি পূর্বমেব স্বকর্মভিঃ ॥ ২০

ইত্যুদীরিতবাক্যে তু দেবে তস্মিন্ মহাত্মনি ।

দেবদুন্দুভয়ো নেদুঃ পুষ্পবৃষ্টিশ্চ খাচ্চ্যুতা ॥ ২১

অচিন্তয়িত্বা স তদা নন্দিবাক্যং মহাবলঃ ।

পর্বতং তু সমাসাদ্য বাক্যমাহ দশাননঃ ॥ ২২

পুষ্পকস্য গতিরিছন্না যৎকৃতে মম গচ্ছতঃ ।

তমিমং শৈলমুন্মূলং করোমি তব গোপতে ॥ ২৩

কেন প্রভাবেণ ভবো নিত্যং ক্রীড়তি রাজবৎ ।

বিজ্ঞাতব্যং ন জানীতে ভয়স্থানমুপস্থিতম্ ॥ ২৪

এবমুক্ত্বা ততো রাম ভুজান্ বিক্ষিপ্য পর্বতে ।

তোলয়ামাস তং শীঘ্রং স শৈলঃ সমকম্পত ॥ ২৫

চালনাৎ পর্বস্যৈব গণা দেবস্য কম্পিতাঃ ।

চচাল পার্বতী চাপি তদাশ্লিষ্টা মহেশ্বরম্ ॥ ২৬

ততো রাম মহাদেবো দেবানাং প্রবরো হরঃ ।

পাদাঙ্গুষ্ঠেন তং শৈলং পীড়য়ামাস লীলয়া ॥ ২৭

পীড়িতাস্তু ততস্তস্য শৈলস্তম্ভোপমা ভুজাঃ ।

বিস্মিতাশ্চাভবংস্তত্র সচিবাস্তস্য রক্ষসঃ ॥ ২৮

রক্ষসা তেন রোষাচ্চ ভুজানাং পীড়ানাৎ তথা ।

মুক্তো বিরাবঃ সহসা ত্রৈলোক্যং যেন কম্পিতম্ ॥ ২৯

মেনিরে বজ্রনিষ্পেষ তস্যামাত্যা যুগক্ষয়ে ।

তদা বৎর্মসু চলিতা দেবা ইন্দ্রপুরোগমাঃ ॥ ৩০

সমুদ্রাচাপি সন্ধাক্ষতাচাপি পর্বতাঃ ।

যক্ষা বিদ্যাধরাঃ সিদ্ধাঃ কিমেতদিতি চাব্রুবন্ ॥ ৩১

তোষযস্য মহাদেবং নীলকন্ঠং উমাপতিম্ ।

তমৃতে শরণং নান্যং পশ্চামোঽন্ন দশানন ॥ ৩২

স্তুতিভিঃ প্রণতো ভূত্বা তমেব শরণং ব্রজ ।

কৃপালু শঙ্করস্তুষ্টঃ প্রসাদং তে বিধাস্যতি ॥ ৩৩

এব মুক্তস্তদামাত্যৈস্তুষ্টাব বৃষভধ্বজম্ 

সামভির্বিবিধৈঃ স্তোত্রৈঃ প্রণম্য স দশাননঃ ।

সংবৎসর সহস্রং তু রুদতো রক্ষসো গতম্ ॥ ৩৪

ততঃ প্রতো মহাদেবঃ শৈলা বিষ্টিতঃ প্রভুঃ ।

মুক্ত্বা চাস্য ভুজান্ রাম প্রাহ বাক্যং দশাননম্ ॥ ৩৫

 প্রীতোঽস্মি তব বীরস্য শৌটীর্যাচ্চ দশানন ।

শৈলাক্রান্তেন যো মুক্তস্ত্বয়া রাবঃ সুদারুণঃ ॥ ৩৬

যস্মাল্লোকত্রয়ং চৈতদ্ রাবিতং ভয়মাগতম্ ।

তস্মাৎ ত্বং রাবণো নাম নাম্না রাজন্ ভবিষ্যসি ॥ ৩৭

দেবতা মানুষা যক্ষা যে চান্যে জগতীতলে ।

এবং ত্বামভিধাস্যন্তি রাবণং লোকরাবণম্ ॥ ৩৮

গচ্ছ পৌলস্ত্য বিস্রব্ধং পথা যেন ত্বমিচ্ছসি ।

ময়া চৈবাভ্যনুজ্ঞাতো রাক্ষসাধিপ গম্যতাম্ ॥ ৩৯

এবমুক্তস্তু লঙ্কেশঃ শম্ভুনা স্বয়মব্রবীৎ ।

প্রীতো যদি মহাদেব বরং মে দেহি যাচতঃ ॥ ৪০

অবধ্যত্বং ময়া প্রাপ্তং দেবগন্ধর্বদানবৈঃ ।

রাক্ষসৈর্গুহ্যকৈর্নাগয়ে চান্যে বলবত্তরাঃ ॥ ৪১

মানুষন্ ন গণে দেব স্বল্পাস্তে মম সম্মতাঃ ।

দীর্ঘমায়ুশ্চ মে প্রাপ্ত ব্রহ্মণস্ত্রিপুরান্তক ॥ ৪২

বাঞ্ছিতং চায়ুষঃ শেষং শস্ত্রং ত্বং চ প্রয়চ্ছ মে ।

এব মুক্তস্ততস্তেন রাবণেন স শঙ্করঃ ॥ ৪৩

দদৌ খড়গং মহাদীপ্তং চন্দ্রহাসমিতি শ্রুতম্ ।

আয়ুষশ্চাবশেষং চ দদৌ ভূতপতিস্তদা ॥ ৪৪

দত্ত্বোবাচ ততঃ শম্ভুর্নাবিজ্ঞেয়মিলং ত্বয়া ।

অবজ্ঞাতং যদি হি তে মামেব বৈষ্যত্যসংশয়ঃ ॥ ৪৫

এবং মহেশ্বরেণৈব কৃতনামা স রাবণঃ ।

অভিবাদ্য মহাদেবমারুরহাথ পুষ্পকম্ ॥ ৪৬

[তথ্যসূত্র — গোরক্ষপুর গীতাপ্রেস প্রকাশনীর প্রকাশিত ‘বাল্মিকী রামায়ণ/উত্তরকাণ্ড/১৬ তম সর্গ’]

✅ অর্থ — অগস্ত্য মুনি জী বললেন, 

হে রঘুকুলন্দন শ্রীরাম ! রাক্ষসরাজ দশগ্রীব নিজের ভাই কুবের কে জয় করে  ‘শরবন’ নামে প্রসিদ্ধ বিশাল বনে এসে উপস্থিত হলেন, যেখানে মহাসেন কার্তিকেয়্ -এর উৎপত্তি হয়েছিল ॥ ১

সেখানে পৌঁছে দশগ্রীব দেখলেন সুবর্ণময় ক্লান্তি যুক্ত বিশাল শরবণের জঙ্গল । যা কিরণসমূহের দ্বারা ব্যাপ্ত হবার কারণে দ্বিতীয় সূর্যদেবের মত প্রকাশিত হচ্ছিল ॥ ২

তার পাশেই কোন একটি পর্বত ছিল, যেখানকার বনস্থলী বড়ই রমণীয় ছিল। হে রাম ! যখন রাবণ তার ওপর থেকে যাবার উপক্রম করলেন তখন তিনি দেখলেন যে পুষ্পক বিমানের গতি দাঁড়িয়ে গেল ॥ ৩

তখন সে রাক্ষসরা আজ নিজের সেই মন্ত্রীদের সাথে মিলে বিচার করতে লাগলেন যে, এটি হবার কারণ কি ? পুষ্পক বিমান কেন দাঁড়িয়ে গেল ?

এটি তো এই বিমানের কর্তার ইচ্ছা অনুসারে চলবার কথা ছিল, তাহলে সামনের দিকে না এগিয়ে কোন কারণে এই পুষ্প বিমানটি আমার কথা অনুসারে সামনে এগোচ্ছে না ?

হয়তো হতে পারে, এই পর্বতের উপরে কেউ এমন একজন আছে, তার কর্মের দ্বারাই এটিই হচ্ছে হয়তো ॥ ৪-৫

হে রাম ! তখন বুদ্ধিকুশল মারীচ বললেন, হে রাজন ! এই পুষ্পক বিমান যদি সামনে এগিয়ে যেতে পারছে না, এতে কিছু না কিছু কারণ অবশ্যই আছে। অকারণে এই ঘটনা ঘটিত হবে এমন কথা কিন্তু নয় ॥ ৬

অথবা এই পুষ্পক বিমান কুবেরকে ছাড়া অন্য কারোর বাহন হতে পারে না, এইজন্য কুবের ছাড়া এটি নিস্পন্দ হয়ে অসাড় হয়ে গেছে॥ ৭

তাদের এই কথাবার্তার মধ্যে পরমেশ্বর শিবের পার্ষদ নন্দীশ্বর দশাননের কাছে এসে পৌঁছলেন, তিনি দেখতে অত্যন্ত বিকরাল ছিলেন । তার অঙ্গ কান্তি কৃষ্ণপিঙ্গল, তিনি কম উচ্চতার বিকট মুণ্ডী ও দেহের তুলনায় ছোট ছোট হস্ত বিশিষ্ট ও ভীষণ বলবান ছিলেন। তিনি উপস্থিত হয়ে রাক্ষসেন্দ্র দশানন কে নিঃসংকোচে বললেন ॥ ৮-৯

'দশগ্রীব ! ফিরে যাও, এই পর্বতের উপর ভগবান শঙ্কর ক্রীড়া করেন। এখানে সুপর্ন নাগ যক্ষ দেবতা গন্ধর্ব বা রাক্ষস তথা যে কোনো প্রাণীর আসা-যাওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়নি ॥ ১০

নন্দীর এই কথা শুনে দশগ্রীব কুপিত হয়ে গেলেন, ক্রোধে তার কানের কুণ্ডল নড়তে লাগলো । নেত্রদুটি রোষে লাল বর্ণের হয়ে উঠলো, আর তিনি পুষ্পক বিমান থেকে নেমে এসে বললেন, কে এই শঙ্কর ?!

এইভাবে বলে তিনি পর্বতের মূল ভাগে উপস্থিত হলেন ॥ ১১-১২

সেখানে পৌঁছে তিনি দেখলেন, ভগবান শঙ্করের থেকে কিছুটা দূরে চকমক করতে থাকা শূল হাতে ধারণ করে সেই নন্দী দ্বিতীয় শিবের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে ॥ ১৩

তার মুখ কিছুটা বানরের ন্যায়, তাকে দেখে সেই নিশাচর দশগ্রীব নন্দীকে গম্ভীর স্বরে ঠাট্টা করে হেসে হেসে তিরস্কার করতে লাগলেন ॥ ১৪

এই অবস্থা দেখে শিবের দ্বিতীয় স্বরূপ ভগবান নন্দী কুপিত হয়ে সেখানে উপস্থিত হ‌ওয়া নিশাচর দশাননকে এই ভাবে বললেন ॥ ১৫

হে দশানন ! তুমি আমার বানরের ন্যায় রূপ কে দেখে আমার অবহেলা করেছ তথা বজ্রপাতের সমান ভয়ানক অট্টহাস করেছো, অতএব তোমার কুলের বিনাশ করবার জন্য আমার সমান পরাক্রম ও এই রূপ ও তেজ সম্পন্ন বানর উৎপন্ন হবে ॥ ১৬-১৭

হে ক্রুর নিশাচর !  নখ আর দাঁতই সেই বানরের অস্ত্র হবে তথা মনের সমান তার তীব্র গতি হবে । তিনি যুদ্ধের জন্য উন্মত্ত থাকবেন আর অতিশয় বলশালী হবেন তথা চলতে ফিরতে পর্বতের সমান প্রতীয়মান হবেন ॥১৮

তিনি একত্রিত হয়ে মন্ত্রী আর পুত্র সহিত তোমার প্রবল অভিমানকে আর বিশালাকার হবার গর্ব কে টুকরো টুকরো করে দেবেন ॥ ১৯

ও নিশাচর ! আমি তোমাকে এখনই বধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখি , তথাপি তোমাকে আমি মারিনি এই ভেবে যে তুমি নিজের কুৎসিত কর্মের দ্বারা পূর্বেই বধ হয়ে রয়েছো (অর্থাৎ পূর্বে অধার্মিক কর্মের দ্বারা নিজেই বধ হবার পথ তৈরি করে রেখেছো, তাহলে মৃত্যু হয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে পুনরায় বধ করে কি লাভ?) ॥ ২০

মহামনা ভগবান নন্দী এ কথা বললে দেবতারা দুন্দুভি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে উঠলেন, আকাশ থেকে পুষ্পের বর্ষা হতে শুরু করলো ॥ ২১

কিন্তু মহাবলী দশানন সেই সময় নন্দীর সেইসব বচনের কোন পরোয়া করলেন না, বরং পর্বতের কাছে গিয়ে বললেন ॥ ২২

ওহে গোপতি ! আমার সামনে দাড়িয়ে থাকা এই পর্বতের কারণে যেহেতু আমার এই পুষ্পক বিমানের গতি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সেহেতু আমি এই পর্বত তুলে ফেলে দেবো  ॥ ২৩

কিসের প্রভাবে ভব(শিব) এখানে প্রতিদিন রাজার মত ক্রীড়া করে থাকেন ? তার তো হয়তো এটাও জানা নেই যে তার সামনে কত বড় ভয় উপস্থিত হয়েছে  ॥ ২৪

হে শ্রীরাম! এভাবে বলে দশানন পর্বতের নিচের অংশের দিকে দুই হাত প্রবেশ করিয়ে দিলেন আর সেই পর্বতকে শীঘ্রই উঠিয়ে নেবার চেষ্টা করলেন। তখন সেই পর্বত নড়তে থাকলো ॥ ২৫

সেই পর্বত এইভাবে নড়তে থাকলে ভগবান শংকরের সমস্ত গণেরা কম্পিত হতে থাকলেন । জগত জননী পার্বতী দেবীও বিচলিত হয়ে মহাদেবকে জড়িয়ে ধরলেন ॥ ২৬

হে শ্রীরাম ! তখন দেবতাদের মধ্যে অগ্রগণ্য প্রবর পাপহরণকারী পরমেশ্বর মহাদেব সেই পর্বত কে নিজের পায়ের অঙ্গুষ্ঠ আঙ্গুল দিয়ে খেলার ছলের ন্যায় নীচের দিকে চাপ দিলেন ॥ ২৭

এরপর তো দশগ্রীবের সেই হাত দুটি যা পর্বতের স্তম্ভের সমান বলে বিখ্যাত ছিল, সেই দুটি হাত পর্বতের নিচে চাপা পড়ে আটকে গেল । এটি দেখে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা এই দশানন রাক্ষসের মন্ত্রী বড় আশ্চর্য তে হয়ে গেলেন ॥ ২৮

সেই রাক্ষস দশানন রোষ তথা নিজের চাপা পড়া হাতের বিভৎস বেদনায় পীড়িত হয়ে সহসা অত্যন্ত বিরাট বিরাট উচ্চৈঃস্বরে বিরাব রোদন করে আর্তনাদ করতে লাগলেন, তার ঐ রব অর্থাৎ শব্দের অতিরিক্ততার ফলে তিনলোকের সকল প্রাণী কেঁপে উঠল ॥ ২৯

তখন তার মন্ত্রী এটি ভাবলেন যেন এখন প্রলয় পাল চলে এসেছে আর বিনাশকারী বজ্রপাত হতে শুরু করেছে। সে সময় ইন্দ্র আদি দেবতারা সকলে তাদের স্থানে বসেই বিচলিত হয়ে উঠলেন ॥ ৩০

সমুদ্রের জোয়ার চলে এসেছিল, অনান্য পর্বত নড়তে শুরু করেছিল আর যক্ষ, বিদ্যাধর তথা সিদ্ধগণেরা পরস্পর পরস্পরের কাছে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন এটি কি হলো ? ॥ ৩১

তদনন্তর দশগ্রীবের মন্ত্রীগণেরা বললেন, 

মহারাজ দশানন ! এখন আপনি নীলকন্ঠ উমাপতি মহাদেবকে সন্তুষ্ট করুন । তিনি ছাড়া আপনাকে শরণ দেবার মতো আর অন্য কাউকে দেখতে পাচ্ছি না আমরা ॥ ৩২

আপনি শ্রুতি দ্বারা তাকে প্রণাম করে তার শরণাপন্ন হোন, ভগবান শঙ্কর বড়ই দয়ালু, তিনি সন্তুষ্ট হয়ে আপনার উপর কৃপা করবেন ॥ ৩৩

মন্ত্রীদের এমন কথা শুনে, দশমুখধারী রাবণ ভগবান বৃষভধ্বজ-শিবকে প্রণাম জানিয়ে নানা প্রকারের স্তোত্র তথা সামবেদোক্ত মন্ত্র দ্বারা মহাদেবের স্তব করলেন । এইভাবে দুই হাতের পীড়ায় পীড়িত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে স্তুতি করতে থাকা রাবণের প্রায় এক হাজার বছর পেরিয়ে যায় ॥ ৩৪

হে শ্রী রাম ! তখন সেই পর্বতের শিখরে স্থিত থাকা পরমেশ্বর ভগবান মহাদেব প্রসন্ন হলেন । তিনি দশগ্রীবকে তার হাতের সংকট থেকে মুক্ত করে দিয়ে তাকে বললেন ॥ ৩৫

ওহে দশানন ! তুমি তো বীর ! তোমার এই স্তুতির পরাক্রম দ্বারা আমি প্রসন্ন হয়েছি । তোমার হাতদুটি পর্বতের তলায় চাপা পড়ে যাবার কারণে তুমি যে অত্যন্ত ভয়ানক রব তুলে আর্তনাদ করেছিলে, সেই আর্তনাদ শুনে তিন লোকের প্রাণী ভয়ে ভীত হয়ে উঠেছিল , এই কারণে ওহে রাক্ষসরাজ ! এখন থেকে তুমি রাবণ নামে পরিচিতি লাভ করবে ॥ ৩৬-৩৭

দেবতা মনুষ্য যক্ষ তথা অন্য যে সমস্ত প্রাণী ভূতলে নিবাস করে, তারা সব এই প্রকার সমস্তলোককে রোদন করানোর মূল কারণ তুমি দশগ্রীব , এরা সকলেই তোমাকে রাবণ বলবে ॥ ৩৮

হে পুলস্ত্যনন্দন ! এখন তুমি যে মার্গ থেকে যেতে চাও সেই দিক থেকে তুমি যেতে পারো। 

ওহে রাক্ষসপতি ! আমি তোমাকে আমার পক্ষ থেকে যাবার আজ্ঞা দিচ্ছি, যাও ॥ ৩৯

পরমেশ্বর ভগবান শংকর এভাবে বলবার পর, লঙ্কেশ্বর রাবণ বললেন , হে মহাদেব যদি আপনি প্রসন্ন হয়ে থাকেন তাহলে আমাকে বর প্রদান করুন । আমি আপনার কাছ থেকে বর যাচনা করছি ॥ ৪০

আমি ঐ সমস্ত দেবতা, গন্ধর্ব, দানব, রাক্ষস, গুহ্যক, নাগ তথা অন্য মহাবলশালী প্রাণীদের কাছে অবধ্য হবার বর প্রদান করুন ॥ ৪১

হে দেব ! মনুষ্যদের তো আমি হিসাবের মধ্যেও ধরিনা । আমার মান্যতা অনুসারে তাদের শক্তি খুব ই অল্প । 

হে ত্রিপুরান্তক ! ব্রহ্মা জীর দ্বারা দেওয়া বর দান অনুসারে আমি দীর্ঘ আয়ু প্রাপ্ত হয়েছি । ব্রহ্মা জীর দেওয়া আয়ুর যতটা অংশ বেঁচে গেছে, সেটির‌ পুরোপুরি প্রাপ্ত হয়ে যাক। এটাই আমার ইচ্ছা, আপনি এটি পূর্ণ করে দিন তার সাথে আপনি আমাকে আপনার পক্ষ থেকে একটি শস্ত্র প্রদান করুন । এভাবে রাবণ বলবার পর ভূতনাথ ভগবান শংকর তাকে একটি অত্যন্ত দীপ্তিমান চন্দ্রহাস নামক খড়্গ দিলেন আর তার আয়ুর যতটা অংশ অতীত হয়েছিল তাও পূর্ণ করে দিলেন ॥ ৪২-৪৪

সেই খড়্গ প্রদান করে পরমেশ্বর শিব বললেন, তোমার কখনোই এটির তিরস্কার করা উচিত হবে না। যদি তুমি কখনো এটির তিরস্কার করো তাহলে এটি নিঃসন্দেহে আমার কাছেই ফিরে আসবে ॥৪৫

এইভাবে ভগবান শঙ্করের কাছ থেকে নূতন নাম পেয়ে রাবণ প্রভু শিব কে প্রণাম করলেন । তারপর তিনি পুষ্পক বিমানে চড়লেন ॥ ৪৬

_______________________________________________


বিশেষ লক্ষ্যণীয় বিষয় —

 বর্তমানে সনাতন ধর্মের সনাতন সমাজের মানুষদের মধ্যে দশানন রাবণকে সবচেয়ে বড় মহান শিবভক্ত ভেবে নেবার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু দশানন রাবণের যে চরিত্র ছিল তা একজন সাধারণ ব্যক্তির মতো ছিল না, তাহলে শিবভক্ত হ‌ওয়াই তো সম্ভব নয়, আর সেখানে সবচেয়ে বড় মহান শিবভক্ত হ‌ওয়া তো অসম্ভব বিষয়।


(১) রাবণ তার জীবনের প্রথমকাল থেকে শিবের উপাসনা করেনি, বরং ব্রহ্মার তপস্যা করে ব্রহ্মার কাছ থেকে বরদান পেয়ে রাবণ দুরাচারী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি নিজের যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াতেন, বহু নারীকে জোরপূর্বক সম্ভোগ করতেন। এসব করতে করতে তিনি নিজের ভাই কুবের -এর কাছ থেকে পুষ্পক বিমান ছিনিয়ে নিয়ে নিজের অজান্তেই কৈলাস পর্বতের উপর থেকে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনি সফল হননি। তখন নন্দীমহারাজ উপস্থিত হয়ে রাবণকে ঐ কৈলাস পর্বতের উপর থেকে চলাচল করতে নিষেধ করে সাবধান করেন, নন্দী মহারাজ বলেন যে, এই কৈলাস পর্বতে পরমেশ্বর শঙ্করের বাস, তাই এখান থেকে ফিরে যাও।

কিন্তু রাবণ ছিলেন অহংকারী, তিনি নন্দী মহারাজ কে বানর মুখী বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন আর বলেন কে এই শঙ্কর?।

[অর্থাৎ, দশানন রাবণের এই ‘কে শঙ্কর’ - বচনেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে রাবণ পরমেশ্বর শিবের সম্পর্কে অবগত ছিলেন না, তার মাহাত্ম্য‌ও জানতেন না। আর পরমেশ্বর শিবের‌ অত্যন্ত প্রিয় পার্ষদ নন্দী মহারাজকেও ঐ দশানন রাবণ অপমানিত করে শিবভক্তকে অপমানিত করেছিলেন। সুতরাং একজন প্রকৃত মহান শিবভক্ত কখনোই অপর শিবভক্ত কে অপমান করতে পারে না, এমনকি একজন প্রকৃত শিবভক্ত অন্য কারোর চেহারা নিয়ে তো কখনো কোনো কটুক্তি বা নিন্দা করবেই না। কিন্তু রাবণ সেই নিন্দামূলক কাজ করেছে।]


(২) এরপর দশানন রাবণ নন্দী মহারাজ কে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলেন যে, শিব কিভাবে এই কৈলাস পর্বতে বাস করছে? আর কিভাবে নিজেকে রাজা মনে করছে? শিব জানেনা যে তার সামনে কত বড় মহা ভয় উপস্থিত হয়েছে। যেহেতু এই পর্বত আমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাই আমি এই পর্বত তুলে ফেলে দেবো। 

 [অর্থাৎ, রাবণের প্রচণ্ড অহংকার আর দম্ভ ছিল , তিনি মহাদেব সম্পর্কে জানতেনই না, মহাদেবসহ কৈলাশকে উপরে ফেলে দেওয়ার মত বুদ্ধিহীনতার মত কাজ করতে উদ্যত হয়েছিলেন] 


(৩) এরপর রাবণ যখন পর্বতের কিছুটা তুলে ধরেছিলেন তখন ঐ পরমেশ্বর শিব নিজের পায়ের অঙ্গুষ্ঠ আঙুল দ্বারা পর্বত কে টিপে ধরেন, এতে রাবনের হাত আটকে যাওয়ার পর অসহ্যকর যন্ত্রণায় রাবণ চিৎকার করে ওঠে, বহু প্রচেষ্টার পরেও রাবণ সেখান থেকে হাত বের করে আনতে সক্ষম হননি, তখন রাবণ তার মন্ত্রীদের পরামর্শে সামবেদের স্তোত্র সূক্ত পাঠ করেছিলেন, তবুও তা হাজার বছর ধরে করেছিলেন। এরপর পরমেশ্বর শিব তার হাতকে মুক্ত করেছিলেন ক্ষমা হিসেবে। 

[অর্থাৎ, বাল্মীকি রামায়ণের কৈলাস পর্বত তুলে ফেলে দেবার প্রসঙ্গে রাবণ যে স্তোত্র পাঠ করেছিলেন তা ছিল সামবেদের বিভিন্ন সূক্ত স্তোত্র, এখানে কোথাও রাবণ দ্বারা শিবতাণ্ডব স্তোত্র পাঠের উল্লেখ নেই। উক্ত ৩৪নং শ্লোকে স্পষ্টভাবে শব্দ প্রমাণ সহ বলা হয়েছে যে, 

এব মুক্তস্তদামাত্যৈস্তুষ্টাব বৃষভধ্বজম্ 

সামভির্বিবিধৈঃ স্তোত্রৈঃ প্রণম্য স দশাননঃ ।

সংবৎসর সহস্রং তু রুদতো রক্ষসো গতম্ ॥”  — এখানে কোথাও রাবণের মুখ থেকে ‘শিবতাণ্ডব স্তোত্র’ উচ্চারণ হবার উল্লেখ নেই। সুতরাং টিভি সিরিয়ালে দেখানো রাবণ চরিত্রকে যেভাবে নতুন নতুন কল্পকাহিনী দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করা হয় তা গ্রহণযোগ্য নয়। হ্যা ! শিব তাণ্ডব স্তোত্র অবশ্য‌ই খুব‌ই সুন্দর ও চমৎকার স্তোত্র, এটি পাঠ করতে কোনো বাঁধা নেই, কিন্তু এটি যে রাবণ পাঠ করেছেন এই কথা সত্য নয়, কারণ বাল্মীকি রামায়ণে এমন কিছু উল্লেখ করা নেই। সুতরাং শাস্ত্র অনুযায়ী যে যে ঘটনা ঘটেছে সেগুলিকেই মেনে চলুন, যাতে কোনো অসত্য কথা সমাজে বহুল প্রচলিত হয়ে সত্যের আকার ধারণ না করে, যা শাস্ত্রের বচন, সেই সত্য‌ই প্রচার করুন।]


(৪) 

রাবণ শুধুমাত্র নিজেকে অসহ্য যন্ত্রনার বিপদ থেকে মুক্ত করবার জন্য বাধ্য হয়ে মহাদেব কে তুষ্ট করেছিলেন মাত্র, কোন ভক্তি ছিল না তার মধ্যে। একথা বলার কারণ হল, রাবণ এত বড় নির্লজ্জ , সে যে মহাদেবকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে উপড়ে ফেলে দেবার কথা বলেছিল, সেই মহাদেবের কাছেই হাতমুক্ত হবার সাথে সাথে অকৃতজ্ঞের মতো দিব্য অস্ত্র চেয়ে বসেন। এরপর মহাদেব দশাননের রব তুলে চিৎকার করবার কারণে রাবণ নাম দিলেন, এরপর রাবণ আরো নির্লজ্জের মতোই পরমেশ্বর শিবের আরো বরদান চেয়েছিলেন, রাবণ মানুষদের দুর্বল ভেবে মানুষ ছেড়ে অন্য সকল দেবতা, গন্ধর্ব, দানব, রাক্ষস, গুহ্যক, নাগ তথা অন্য মহাবলশালী প্রাণীদের কাছে অবধ্য হবার বরদান চেয়ে বসলেন, পরমেশ্বর শিব সেই বরদান‌ই দিলেন। 

কিন্তু এখানে পরমেশ্বর শিব ঐ দশানন রাবণ কে সবচেয়ে মহান শিবভক্ত বলে ঘোষণা করেননি।

[অর্থাৎ, রাবণ ছিলৈন শুধুই স্বার্থপর, নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য সে ক্ষণে ক্ষণে নিজের রূপ বদলে ফেলতো।

রাবণকে যারা সবচেয়ে মহান শিবভক্ত বলে দাবী করেন তাদের সকলের উদ্দেশ্যে বলি-

ভক্তির প্রকারভেদ আছে । সকাম ভক্তি, নিষ্কাম ভক্তি ইত্যাদি। আবার তার মধ্যেও সূক্ষ্ম ভেদ বিদ্যমান। যারা আসলেই বাল্মীকি রামায়ণ আদি ইতিহাস শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন কেবলমাত্র তারাই এর সঠিক অর্থ জানতে পারবে রাবণ কেমন শিব ভক্ত ছিলেন।

প্রথমত, রাবণ পরমেশ্বর শিবের সামনে টিকতে পারেননি। তাই নিজেকে বাঁচানোর জন্য বাধ্য হয়ে পরমেশ্বর শিবের কাছে নত হয়েছেন মাত্র। অর্থাৎ রাবণ বিপদে পড়ে আর কোনো উপায় না দেখে পরমেশ্বর শিবের শরণাপন্ন হয়েছিলেন মাত্র। আর প্রভু শিব এতটাই করুণাময় যে,  রাবণের ন্যায় একজন পাষণ্ড ব্যক্তি কে উজার করে সব দিয়েছেন। 

এই রকম একই ঘটনা রাবণ ঘটিয়েছিল বালী ও সহস্রবাহু কার্তবীর্যার্জুনের সাথে। রাবণ এনাদেরও যুদ্ধে হারাতে পারেননি তাই বালীর সাথে বন্ধুত্ব করলেও কার্তবীর্যাজুনকে এড়িয়ে চলতেন সবসময়। 

কারণ, রাবণ যার সামনে দূর্বল বলে বুঝতেন নিজেকে, তিনি তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে নিতেন আর তা নাহলে তাদের এড়িয়ে চলতেন।

প্রভু পরমেশ্বর শিব তো সর্বশক্তিমান। তাই, রাবণ যখন দেখলেন যে পরমেশ্বর শিবের রোষ থেকে আর কেউ অন্য কেউ রক্ষা করতে সক্ষম নয় তখন মন্ত্রীদের পরামর্শে বাধ্য হয়ে পরমেশ্বর শিবের‌ই শরণাপন্ন হওয়ার অভিনয় করেছিলেন মাত্র । 


রাবণ দূর্বলের উপর অত্যাচার করে নিজেকে স্থাপিত করেছে। ঈশ্বরের দেওয়া বরদানের অপপ্রয়োগ করেছে। অসংখ্য নারীকে ধর্ষণের ন্যায় অপরাধ করেছে। যা বর্তমানের শাস্ত্র জ্ঞানহীন এই আবেগী মানুষেরা জানেন না।

তারা লোকমুখে বা টিভি সিরিয়ালে দেখানো রাবণ চরিত্রের মুখ থেকে সমাজে প্রচলিত হ‌ওয়া ‘শিব তাণ্ডব স্তোত্র’ পাঠ হতে দেখে এই ধারণা করতে শুরু করেছে যে, শিব তাণ্ডব স্তোত্র রাবণের রচিত।

কিন্তু সমগ্র বাল্মীকি রামায়ণের বা পুরাণ শাস্ত্রের কোথাও এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না।


শিবতাণ্ডব স্তোত্র কিভাবে সমাজে প্রচলিত হয়েছে ? 


এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। কারণ এটি শাস্ত্রের মধ্যে কোথাও উল্লেখ নেই, সেই হিসেবে এটি শাস্ত্রগত কোনো স্তোত্র নয় - এটি নিশ্চিত। কিন্তু এটি ঠিক কখন কিভাবে কার দ্বারা রচিত হয়েছে তা জানা যায় না।

তবে বিভিন্ন ওয়েবসাইট খুঁজে আমি একটি লোকমুখে প্রচলিত কথা জানতে পেরেছি, তা উল্লেখ করছি, কিন্তু এর সত্যতা কতটা তার নিশ্চয়তা নেই।

শোনা যায়, বহুবছর পূর্বে রামায়ণের যাত্রাপালায় রাবণের চরিত্রে অভিনয় করবার সময়ে ঐ যাত্রাপালার সময় অনুষ্ঠানের জন্য এই স্তোত্র রচিত হয়েছিল। যেমন আজকালকার রামায়ণ চলচ্চিত্র তে নতুন নতুন গান রচনা করে ব্যবহার করা হয়েছে, এই বিষয়টিও ঠিক তেমন। যাত্রাপালায় যিনি রাবণ চরিত্রে অভিনয় করছিলেন, তিনি যখন কৈলাস পর্বতের নিচে হাত আটকে যাবার মুহূর্তের অভিনয় করেছিলেন তখন তার মুখ থেকে এই স্তোত্র পাঠ হচ্ছে এমনটাই দেখানো হয়েছিল। তারপর থেকে এটি জনপ্রিয় হয়ে যায়। তখন থেকে এটি রাবণ রচিত শিব তাণ্ডব স্তোত্র বলে প্রচলিত হয়েছে। স্তোত্র টি খুব‌ই সুন্দর !খুব‌ই চমকপ্রদ এতে সন্দেহ নেই। এটি পাঠ করতে কোনো দ্বিধা বোধ হবার কারণ নেই। কিন্তু এটি যে, রাবণ রচনা করেছেন, তা সত্য নয়। আর এই ‘শিব তাণ্ডব স্তোত্র’ রাবণ রচনা করেছে বলে অপপ্রচারের উপর ভিত্তি করেই বহু মানুষের এই ধারণা হয়েছে যে রাবণ সবথেকে মহান শিবভক্ত বা তিনিই শ্রেষ্ঠ শিবভক্ত, যা কখনোই সত্য নয়। কারণ বাল্মীকি রামায়ণের এই প্রসঙ্গে পরমেশ্বর শিব রাবণের উদ্দেশ্যে এমন কোনো বচন বলেননি। তাই শাস্ত্রের বহির্ভূত কোনো বচন গ্রহণযোগ্য নয়।

তাই যাযা রাবণকে আদর্শ ভেবে নিজেকে রাবণের মতো শিবভক্ত বানাতে চাইছে তারা অজ্ঞানতার সমুদ্রে ভেসে গেছেন মাত্র।

আর এই ধরণের ব্যক্তিদের কারণে রাবণের মতো চরিত্রহীন লম্পট অধার্মিক ব্যক্তিকে শ্রেষ্ঠ শিবভক্ত ভাবা হচ্ছে সমাজে। 

আর শিবনিন্দা করতে থাকা কিছু বৈষ্ণব ভেকধারী ব্যক্তিগণ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বলে বেড়াচ্ছে যে, শিবভক্তরা রাবণের মতো হয়, পাষণ্ড দুরাচারী হয়, রাবণের মতো অত্যাচারী অসুর রাক্ষস দৈত্য হয়।


আমরা যারা পরমেশ্বর শিবের সন্তান আছি, তারা এই ধরণের মন্তব্যে ব্যথিত হয়ে যাই, কেননা আজকের এই সমাজে অনেকেই শিবের ভক্ত হলেও আবেগে ভেসে গিয়ে লাবণকে আদর্শ মানতে শুরু করেছে, আর এই কারণেই বৈষ্ণবেরা আমাদের শিবভক্তদের শৈবদের কটুক্তি করতে সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। 


কিন্তু, আসলেই সবচেয়ে বড় ও মহান শিবভক্ত হলেন শ্রীহরি বিষ্ণু। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, শ্রী বিষ্ণুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ শৈব আর কেউ নেই, ভগবান শ্রী হরি হলেন শৈবদের মধ্যে অগ্রণী, অর্থাৎ শ্রী বিষ্ণু হলেন শিবভক্ত শৈবদের মধ্যে প্রথম তথা শ্রেষ্ঠ। প্রমাণ দেখুন 👇 

নাস্তিশৈবাগ্রণীর্বিষ্ণো ॥৫৬

(তথ্যসূত্র - স্কন্দমহাপুরাণ/মাহেশ্বরখণ্ড/অরুণাচমাহাত্ম্যম/উত্তরার্ধ্ব/অধ্যায় নং ৪)

☘️ অর্থ : শ্রীবিষ্ণুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ শৈব আর কেউ নেই


এই কারণে, শ্রীহরি বিষ্ণুর অবতার শ্রীরামচন্দ্র ই হলেন প্রকৃত শিবভক্ত । তিনি প্রকৃত শিবভক্ত শৈব বলেই রাবণকে বধ করে ধর্মপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।


✅ দেখুন প্রমাণ 👇

রাঘবঃ শৈবসত্তমঃ ।..॥ ১৪

কৃতবান্ রাঘবঃ পূজাং শিবধর্মপরায়ণঃ ॥ ৩৪

স্তুতিং চ বিবিধাং কৃত্বা প্রণিপত্য শিবং মুদা ।

জয়ং চ প্রার্থয়ামাস রাবণাজৌ তদাত্মনঃ ॥ ৩৫

(তথ্যসূত্র : শিবমহাপুরাণ/কোটিরুদ্র সংহিতা/৩১ অধ্যায়)

অর্থ — শ্রী রাঘব রামচন্দ্র হলেন শৈব ব্যক্তি ॥ ১৪

 পরমেশ্বর শিবের পরমভক্ত শিবধর্মপরায়ণ ছিলেন শ্রীরাম, তিনি পরমেশ্বর শিবের পূজা করলেন। শ্রী রামচন্দ্র বিভিন্ন প্রকারে পরমেশ্বর শিবের স্থপতি করে প্রসন্নতা পূর্বক পরমেশ্বর শিব কে প্রণাম করে রাবণের সাথে যুদ্ধ হতে নিজের বিজয় প্রাপ্ত করবার বর প্রার্থনা করলেন ॥ ৩৪-৩৫

প্রমাণিত হল যে, রাবণ নয় বরং শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন প্রকৃত শিবভক্ত শৈব ব্যক্তি। 

 যদি রাবণ শিবভক্ত‌ই হতেন তবে কখনোই দুরাচারী হতেন না, আর শ্রীরামচন্দ্র‌ও ঐ রাবণ কে বধ করতে পারতেন না। কিন্তু সত্য সর্বদা জয়ী হয়, তাই সত্যের পথে ধার্মিক পথে শ্রীরামচন্দ্র এগিয়েছিলেন, এই কারণে শ্রীরামচন্দ্র জয়ী হয়েছিলেন, রাবণ বধ হয়েছিলেন শ্রীরামচন্দ্রের কাছে, তাই শ্রীরামচন্দ্র‌ই আমাদের শিবভক্ত শৈবদের আদর্শ, রাবণ আদর্শ নন। ঠিক এক‌ই ভাবে সাক্ষাৎ নন্দীমহারাজ হলেন আমাদের শিবভক্তদের জন্য পরম আদর্শের, রাবণ আদর্শ নয়, আর না তিনি কোনো সবচেয়ে বড় মহান শিবভক্ত। তাই যদি কোনো বৈষ্ণব ব্যক্তি দাবী করে যে শিবভক্তরা রাবণ হয়ে থাকে, তাহলে সেই দাবীও এই সকল তথ্য যুক্তি তথা শাস্ত্রীয় প্রমাণের দ্বারা খণ্ডিত হল, অর্থাৎ এই দাবী সত্য নয়।]

________________________________________________

সত্যের জয় হোক, ধর্মের জয় হোক।

অসত্যের নাশ হোক, অধর্মের নাশ হোক।


শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩 

হর হর মহাদেব 🚩 


✍️ লেখনীতে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী

©️ কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT 


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ