পদ্মপুরাণে শিবকে বৈষ্ণব বলা হয়েছে — বলে দাবী করা রামানুজ আচার্যের নব্য অনুসারী বৈষ্ণবের আস্ফালন নিবারণ
বর্তমানে শৈব দের প্রচারকে আটকাতে রামানুজ আচার্যের নব্য অনুসারী এক বৈষ্ণব ব্যক্তি “বিপ্লব চন্দ্র রায়” তার ‘বৈষ্ণব দর্শন’ নামক এক ফেসবুক পেজে পোষ্ট করে দাবী করছে যে, পদ্ম পুরানে নাকি প্রভু শিব কে বৈষ্ণব বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তাই শিব নাকি বৈষ্ণব।
দাবীটির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, দেখুন 👇
শ্রীমান বিপ্লব চন্দ্র রায় নামক নব্য রামানুজীর দাবী হল এরকম,
পদ্মপুরাণের উত্তর খণ্ডের ৭১ অধ্যায়ের ৪৩ ও ৫১ নং শ্লোকে বলা হয়েছে যে, বৈষ্ণব শ্রেষ্ট হচ্ছেন মহাদেব। তিনি পঞ্চবক্র (সদাশিব),
উমাকান্ত এবং এই সদাশিবই হচ্ছেন বৈষ্ণব শ্রেষ্ঠ ।
আকাট বোধহীন কলিকালের এই বৈষ্ণবেরা এখনো পর্যন্ত কৈলাসপতি রুদ্রদেব এবং শিবলোকবাসী সদাশিবের মধ্যে গুণগত পার্থক্য বুঝতেই সক্ষম হয়নি। এই মাথামোটা আকাটগুলোকে আমি বারংবার শাস্ত্র থেকে প্রমাণ সহ দেখিয়েছি যে, ত্রিদেব অর্থাৎ ব্রহ্মা-বিষ্ণু এবং কৈলাসপতি রুদ্রদেব -এর উৎপত্তি হয়েছে শিবলোকবাসী সদাশিব থেকে। কিন্তু এই মাথামোটা বৈষ্ণবগুলো এই সামান্য বিষয়টুকু বুঝতে অক্ষম।
এই মস্তিষ্কহীন বৈষ্ণবেরা সদাশিব ও কৈলাসপতি রুদ্রদেবের মধ্যে যে গুণগত তফাৎ আছে তা এরা বুঝতেই পারে না।
শাস্ত্র প্রমাণ দেখুন 👇
পরমেশ্বর সদাশিব ব্রহ্মাকে বলছেন -
মদ্রুপং পরমং ব্রহ্মন্নীদৃশং ভবদঙ্গতঃ।
প্রকটীভবিতা লোকে নাম্না রুদ্রঃ প্রকীর্তিতঃ ॥
[তথ্যসূত্র : শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/সৃষ্টিখণ্ড/৯.৩০]
☘️ সরলার্থ — পরমেশ্বর সদাশিব বললেন, হে ব্ৰহ্মা! আমার এমন পরম অংশস্বরূপ তোমার শরীর থেকে ইহলোকে প্রদর্শিত হবে, যাকে 'রুদ্র' বলা হবে।
সুতরাং এখানে প্রমাণিত হচ্ছে যে পরমেশ্বর শিব ব্রহ্মাজী কে বলছেন তাঁর একটি অংশস্বরূপ পিতামহ ব্রহ্মার শরীর থেকে সম্ভূত হবে, যার নাম 'রুদ্র' হবে ।
এই একই কথা বৈষ্ণবদের মান্য ভাগবতপুরাণও স্বীকার করেছে -
ধিয়া নিগৃহ্যমাণোহপি ভ্ৰুবোৰ্মধ্যাৎ প্রজাপতেঃ।
সদ্যোহজায়ত তন্মন্যুঃ কুমারো নীললোহিতঃ ॥৭
স বৈ রুরোদ দেবানাং পূর্বজো ভগবানভবঃ।
নামানি কুরু মে ধাতঃ স্থানানি চ জগদগুরো ॥৮
[তথ্যসূত্র : ভাগবতপুরাণ/৩.১২.]
☘️ সরলার্থ — নিজের বিচারবুদ্ধিদ্বারা সেই ক্রোধ দমন করার সত্ত্বেও ব্রহ্মার ভ্রূযুগলের মধ্যস্থান থেকে সেই ক্রোধ এক নীললোহিত বর্ণ বালকরূপে তৎক্ষণাৎ উৎপন্ন হল ॥৭
দেবগণের অগ্রজ ষড়ৈশ্বর্যশালী ভগবান রুদ্র রোদন করে করে বলতে লাগলেন 'হে জগৎ গুরু ব্রহ্মা! আমার নাম এবং থাকবার স্থান নির্দেশ করুন' ॥ ৮
সুতরাং, দেখুন... উভয় শৈব ও বৈষ্ণব পুরাণ একই কথা বলছে যে পরমেশ্বর শিব হল পরমেশ্বর, কিন্তু কৈলাসপতি ভগবান রুদ্র বা হর হল সেই পূর্ণব্রহ্ম শিবের একটি অংশস্বরূপ গুণাত্মক সত্ত্বা। তাই পরমেশ্বর শিব ও ভগবান রুদ্র গুণভেদের কারণে এক নয়।
🟥 মায়াযুক্ত গুণসত্ত্বা 'হর/রুদ্র/মহেশ' স্বরূপে শিব বিভিন্ন লীলা করেন যা তার গুণসত্ত্বা কে ধারণ করার কারণেই সম্ভব। এই হর বা রুদ্রদেব অনেক সময় এমন কিছু লীলা করেন যা দেখে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় যে, যিনি পরমেশ্বর পরমব্রহ্ম তার পক্ষে এমন কার্য করা কখনোই শোভনীয় নয়।
কিন্তু মজার বিষয় এই, পরমেশ্বর শিবের গুণাতীত সদাশিব সত্ত্বাকে সাকার ব্রহ্ম বলা হয় । শৈবরা শিবের এই গুণাতীত সদাশিব সত্ত্বাকেই আরাধ্য বলে মানেন। তারা রুদ্রদেবের গুণাত্মক সত্ত্বাকে নয় বরং তার অন্তরের সদাশিব সত্ত্বাকেই আরাধ্য মানেন।
অতএব, আপনারা পরমেশ্বর শিবের গুণাত্মক সত্ত্বা তমঃগুণ ধারণ করা হর স্বরূপকেই সম্পূর্ণ শিব বলে ধারণা করেন, অথচ শাস্ত্র বলছে অন্য কথা।
শিবমহাপুরাণে বলা হয়েছে সাক্ষাৎ সদাশিব হল গুণাতীত, তিনি মায়াগুণ যুক্ত হয়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও হর এই ত্রিদেবরূপে প্রকটিত হন।
গীতাপ্রেসের সংক্ষিপ্ত শিবপুরাণের রুদ্রসংহিতার দ্বিতীয় খণ্ডের ১৬নং অধ্যায় থেকে একটি ছবি তুলে ধরা হল, পৃষ্ঠা নং সহ👇
এবার প্রমাণ দেখুন 👇
(১) বৈষ্ণব দের প্রাণপ্রিয় পদ্মপুরাণ থেকে।
👇
য একঃ শাশ্বতোদেবোব্রহ্মবন্দ্যঃ সদাশিবঃ । ত্রিলোচনোগুণাধারো গুণাতীতোহক্ষরোব্যয়ঃ ॥৩ পৃথকৃত্বাত্মনস্তাততত্র স্থানং বিভজ্য চ ।
দক্ষিণাঙ্গে সৃজাৎপুত্রং ব্রহ্মাণাং বামতো হরিম্ ॥৫
পৃষ্ঠদেশে মহেশানংত্রিপুত্রান্ সৃজিদ্বিভুঃ । জাতমাত্রাস্ত্রয়োদেবা ব্রহ্মাবিষ্ণুমহেশ্বরাঃ ॥৬”
(তথ্যসূত্র - পদ্মপুরাণ/ পাতালখণ্ড/১০৮ নং অধ্যায়)
☘️ সরলার্থ — সেই এক সদাশিবই শাশ্বত, ব্রহ্মা দ্বারা অৰ্চিত, ত্রিলোচন, ত্রিগুণধারী, ত্রিগুণাতীত, অক্ষর (অক্ষর ব্রহ্মস্বরূপ) এবং অব্যয়। তিনি নিজ ইচ্ছায় নিজেকে তিনভাগে বিভক্ত করেন। তিনি তাঁর দক্ষিণ(ডান)ভাগ থেকে পুত্রস্বরূপ ব্রহ্মাকে, বামভাগ থেকে শ্রীহরিকে এবং পৃষ্ঠদেশ(হৃদয়) থেকে মহেশ্বরকে (অর্থাৎ রুদ্র) সৃষ্টি করেন। এই ভাবে সদাশিবের তিনপুত্র ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর - ত্রিদেব হিসেবে পরিচিতি পায়। [ তাই সদাশিবকে ত্রিদেবজনক বলা হয়]
পদ্মপুরাণও বলছে যে সদাশিব তিনগুণের অতীত। কিন্তু তার থেকে উৎপন্ন হওয়া ত্রিদেব, অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ও মহেশ/রুদ্র হলে গুণযুক্ত(মায়ায় প্রভাবিত হওয়া) সত্ত্বা । ত্রিদেবের মধ্যে থাকা কৈলাসপতি “হর বা রুদ্র/মহেশ” গুণযুক্ত সত্ত্বা আর তিনগুণের ঊর্ধ্বে যিনি আছেন তিনি হলেন পরমেশ্বর সদাশিব।
(২) সাক্ষাৎ বেদ শাস্ত্র থেকে প্রমাণ দেখুন 👇
একং অদ্বৈতং নিষ্কলং নিষ্ক্রিয়ং শান্তং শিবং অক্ষরং অব্যয়ং হরি-হর-হিরণ্যগর্ভ-স্রষ্টারং ।..॥
[বেদ/ভস্মজাবাল উপনিষদ/২/৭]
☘️ সরলার্থ — যিনি এক ও অদ্বিতীয় সত্ত্বা, যিনি সমস্ত কলার অতীত হিসেবে নিরাকার সত্ত্বা, যিনি সকল কিছুর স্রষ্টা ও পরিচালনাকারী হয়েও নিজে নিষ্ক্রিয়ভাবে স্থিত তথা শান্ত রূপে সমস্তদিকে সমানভাবে শান্ত তথা স্থির, সেই প্রভু হলেন স্বয়ং শিব, এই প্রভুই অক্ষরব্রহ্ম ॐ-কার, এই প্রভুই অব্যয় অর্থাৎ বিনাশহীন, এই প্রভু শিব(সদাশিব)ই ত্রিদেবরূপী হরি(বিষ্ণু), হর(কৈলাসপতি রুদ্র) ও হিরণ্যগর্ভ(ব্রহ্মা)-র সৃজন কর্তা ।
এই ত্রিদেবে চেয়েও যিনি পরম তিনি পরমেশ্বর সদশিব, এই সদাশিবই মূলত সাকার ব্রহ্ম — শিব ।তাই সৌরপুরাণ বলেছে ত্রিদেবের চেয়েও শ্রেষ্ঠ হলেন পরমেশ্বর শিব। প্রমাণ দেখুন 👇
তস্মৈব শক্তয়স্তিস্রো ব্রহ্মবিষ্ণুমহেশ্বরঃ । সর্ব্বস্মাদধিকস্তাভ্যঃ শূলপাণিরিতি শ্রুতিঃ ॥ ৩৯
🟪 তাই উপরোক্ত সমস্ত শাস্ত্র প্রমাণ থেকে এটিই স্পষ্ট হয়ে গেল যে, শৈবদের আরাধ্য মূলত শিবলোকবাসী পরমেশ্বর সদাশিব।
শিবের অংশস্বরূপ অবতার রুদ্রই কৈলাসপর্বতে থাকেন — একথা শিবমহাপুরাণেই পরমেশ্বর সদাশিব বলেছেন। প্রসঙ্গ টি হল এমন,
কুবেরকে সখা হিসেবে তার বাসস্থানের পাশেই তিনি বাস করে থাকার জন্য বরদান দিয়েছিলেন পরমেশ্বর সদাশিব, এই বরদান দেবার পর তিনি ভাবলেন যে, তিনি তো মায়ার জগতের সমস্ত মায়ার প্রভাবের অতীত অর্থাৎ গুণাতীত সদাশিব। তাহলে মায়ার জগতে থাকা কুবেরের বাসস্থানের পাশে সদাশিব কিভাবে বসবাস করবেন ?
তখন পরমেশ্বর সদাশিব একটি উপায় বের করে ভাবলেন যে, যেহেতু আমার হৃদয় থেকে প্রকটিত হওয়া রুদ্রদেবই আমার পূর্ণাবতার, সেহেতু সেই রূপেই আমি রুদ্রকে ওখানে থাকার ব্যবস্থা করবো, এতে রুদ্রের দ্বারাই আমার বরদান অনুযায়ী কুবেরের পাশে থাকাও হয়ে যাবে আবার গুণাতীত সদাশিব রূপেই মায়ার জগতে প্রবেশও করতে হবে না।
তাই পরমেশ্বর সদাশিব অংশস্বরপে গুণযুক্ত রুদ্রদেবরূপে কৈলাসে বসবাস করে কৈলাসপতিরূপে থাকেন সর্বদা।
প্রমাণ — পরমেশ্বর সদাশিব ভাবলেন,
বিধ্যঙ্গজস্স্বরূপো মে পূর্ণঃ প্রলয়কার্যকৃৎ।
তদ্রুপেণ গমিষ্যামি কৈলাসং গুহ্যকালয়ম্ ॥ ৩
রুদ্রো হৃদয়জো মে হি পূর্ণাংশো ব্রহ্ম নিষ্কলঃ ।
হরিব্রহ্মাদিভি সেব্য মদভিন্নো নিরঞ্জনঃ ॥ ৪
তৎস্বরূপেণ তত্রৈব সুহৃদ্ভূত্বা বিলাস্যহম্ ।
কুবেরস্য চ বৎস্যামি করিষ্যামি তপো মহৎ ॥ ৫
সঞ্চিন্ত্য রুদ্রোঽসৌ শিবেচ্ছাং গন্তুমুৎসুকঃ ।
ননাদ তত্র ঢক্কাং স্বাং সুগতিং নাদরূপিণীম্ ॥ ৬
[তথ্যসূত্র - শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/সৃষ্টিখণ্ড/অধ্যায় ২০]
অর্থ — ব্রহ্মার ললাট থেকে যিনি প্রাদুর্ভূত হয়েছেন তথা প্রলয় কার্যের দায়িত্ব পালন করছেন, সেই রুদ্রদেব আমার পূর্ণ স্বরূপ । অতঃ সেই রুদ্রদেবের রূপেই আমি সদাশিব গুহ্যগণের অন্তিমকালের আশ্রয়রূপী নিবাসস্থান কৈলাস পর্বতে যাবো । রুদ্র আমার(সদাশিবের) হৃদয় থেকেই প্রকট হয়ে প্রলয় কার্য সামলান, সেই রুদ্রই প্রকৃত পক্ষে আমার পূর্ণ অবতার, নিষ্কল, নিরঞ্জন ব্রহ্ম আমার অন্তর থেকে সে আমার(সদাশিবের) থেকে অভিন্ন। হরি, ব্রহ্মা আদি দেবতারা সেই রুদ্রের সেবা করে থাকে নিরন্তর। সেই রুদ্রদেবের রূপেই কুবেরের মিত্র হয়ে সেই কৈলাস পর্বতেই বিলাসপূর্বক থাকবো আর মহান তপস্যা করবো। শিবের অন্তরের এই ইচ্ছা কে চিন্তন করেই সেই রুদ্রদেব কৈলাস যাবার জন্য উৎসুক হয়ে উত্তম গতি প্রদানকারী নাদস্বরূপ নিজের ডমরু বাজালেন।
সুতরাং রুদ্রদেবই কৈলাসে কৈলাসপতি হিসেবে ঐ পর্বতে থেকে লীলা করছেন মাত্র ।
🟪 এই অংশস্বরূপ কৈলাসবাসী রুদ্রদেবই পরমেশ্বর
সদাশিবের আজ্ঞা অনুসারে বিষ্ণুকে আরাধ্য হিসেবে প্রশংসা করে থাকেন জগৎবাসীর সামনে।
প্রমাণ – শিবলোকবাসী পরমেশ্বর সদাশিব শ্রীবিষ্ণু ও
কৈলাসপতি রুদ্রদেবকে আদেশ দিয়ে বলেছেন,
যে —
গুণরূপো হ্যহং রুদ্রো হ্যনেন বপুষা সদা ।
কার্যং করিষ্যে লোকানাং তবাশক্যং ন সংশয় ॥ ৫
রুদ্রধ্যেয়ো ভবাংশ্চৈব ভবদ্ধ্যেয়ো হরস্তথা ।
যুবয়োরন্তরং নৈব তব রুদ্রস্য কিঞ্চন ॥ ৬
-
[তথ্যসূত্র – শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/সৃষ্টিখণ্ড/১০ অধ্যায়]
☘️ অর্থ — হে হরি ! যে কার্যগুলি করতে তুমি সমর্থ হবে না, গুণযুক্ত রুদ্ররূপ ধারণ করে আমি নিশ্চিতভাবে আমার এই গুণযুক্ত রুদ্রদেবরূপী শরীর দ্বারা সমস্ত সংসারের প্রাণীদের উদ্ধার করবার জন্য তোমার সেই কার্য করবো। হে হরি ! তুমি রুদ্রের ধ্যেয় হবে এবং রুদ্র তোমার ধ্যেয় হবে । তোমারা দুজনেই গুণযুক্ত হবার কারণে গুণাত্মক রুদ্রের সাথে তোমার কোনো ভেদ নেই ৷
দেখুন! পরমেশ্বর সদাশিব আদেশ দিয়েছেন যে তার গুণযুক্ত পূর্ণাবতার কৈলাসপতি ভগবান রুদ্রদেব লোকাচার বশত শ্রীবিষ্ণুকে আরাধ্য হিসেবে প্রশংসা করে নিজেকে বিষ্ণুভক্ত হিসেবে জগতের কাছে বিষ্ণুর ভক্তির মাহাত্ম্য প্রচার করবেন, আবার বিষ্ণুও রুদ্রকে আরাধ্য বলেই মানবেন।
কিন্তু এখানে কোথাও শৈবদের আরাধ্য সাক্ষাৎ সদাশিবকে বিষ্ণু উপাসক বলা হয়নি, বিষ্ণু উপাসক হবার লোকাচার(অভিনয় হিসেবে) দায়িত্ব পালন করবেন গুণাতীত সদাশিবের অবতার গুণযুক্ত কৈলাসপতি ভগবান শ্রী রুদ্রদেব ।
বৈষ্ণবরা বলেন শিব সারাদিন রামনাম/হরিনাম করেন, চলুন এর সত্যতা আমরা বৈষ্ণবদের ঐ প্রাণপ্রিয় সাত্ত্বিকপুরাণ পদ্মপুরাণ থেকেই উন্মোচন করে দেখিয়ে দিচ্ছি —
(চৌখাম্বা প্রকাশনীর প্রকাশিত পদ্মপুরাণের পাতালখণ্ড)
শঙ্করউবাচ্-
" ধ্যায়েনকিঞ্চিৎ গোবিন্দননমস্যেহকিঞ্চন ॥২৪৮
নোপাস্যেকিঞ্চনহরেনজপিষ্যেহকিঞ্চন
কিন্তু নাস্তিকজন্তুনাং প্ৰবৃত্ত্যৰ্থমিদংময়া ॥২৪৯"
(তথ্যসূত্র — পদ্মপুরাণ/পাতাল খন্ড/ ১১৪ নং অধ্যায়)
☘️ সরলার্থ — হে গোবিন্দ! বস্তুত আমি কারোরই ধ্যান করিনা, কাউকে প্রণাম করিনা, কাউকে উপাসনা করিনা এবং কারও জপ করিনা। নাস্তিকদেরকে এবং জগৎবাসিকে শিক্ষা প্রদানের নিমিত্তে আমি নিজ ইচ্ছায় নিজ বিধি নিয়মে আবদ্ধ হই মাত্র। কেননা আমিই পরমেশ্বর।
পরমেশ্বর শিব শ্রীহরির প্রশ্নের উত্তরে বললেন যে, শিব কাউকে ধ্যান করে না বা প্রণাম করে না কারো উপাসনা করে না তিনি কারোর নাম জপও করে না শুধুমাত্র তিনি নাস্তিক ও অন্যান্য সমগ্র জগত বাসি কে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি নিজের ইচ্ছেমতো নিজের বিধিতে তিনি আবদ্ধ হন অর্থাৎ সকলকে তিনি শুধুমাত্র শিক্ষা দেবার কার্যটুকু করেন,যা শিবেরই লীলামাত্র। তাই পরমেশ্বর শিব কখনোই রাম নাম জপ ও করেন না তিনি রাম কে প্রণাম ও করেন না তিনি রামের ধ্যান করেন না তিনি রামকে পুজো করেন না, তিনি শুধুমাত্র লীলাবশত নিজের ভক্তের উচ্চ প্রশংসা করেন মাত্র। কারণ তিনি তাঁর ভক্তদের প্রতি স্নেহ করেন এবং ভালবাসেন তাই তিনি স্নেহবশত তো তার ভক্তদের স্মরণ করে থাকেন বা তাদের গুণগান গেয়ে থাকেন।
এখন বৈষ্ণবরা বলুক, পদ্মপুরাণের এই বচনকে তারা খণ্ডন করবে কিভাবে ??
এই একই কথা শিবমহাপুরাণে পরমেশ্বর শিব বলেছেন।
চলুন দেখে নেওয়া যাক -
সর্বে রুদ্রং ভজন্ত্যেব রুদ্রঃ কঞ্চিদ্ভজেন্ন হি ।
স্বাত্মনা ভক্তবাৎসল্যাদ্ভজত্যেব কদাচন ॥ ১৫
[তথ্যসূত্র – শিবমহাপুরাণ/কোটিরুদ্রসংহিতা/অধ্যায় ৪২]
☘️ সরলার্থ — সবাই ভগবান রুদ্র তথা পরমেশ্বর শিবের ভজনা করেন, কিন্তু পরমেশ্বর শিব কারোর ভজন করেন না, কখনো কখনো ভক্তবৎসলবশত তিনি নিজেই নিজের ভক্তের প্রশংসা রূপে ভজনা করে থাকেন ॥ ১৫
অতএব, পরমেশ্বর শিব বা কৈলাসপতি রুদ্রদেবও কখনোই বৈষ্ণব নন, শিব কখনোই পঞ্চমুখে রামনামও করেন না। তিনি রামের গুণগান করেন শুধুমাত্র রামের শিবভক্তির মহানতার কারণে। কিন্তু কলিরচর বৈষ্ণবেরা সেই পরমসত্যকে ধামাচাপা দিয়ে অসত্য কাল্পনিক গল্পের ভাণ্ডার খুলে পরমেশ্বর শিবকে বিষ্ণুদাস/কৃষ্ণদাস/রামদাস বানানোর অপপ্রচেষ্টা করে চলেছে।
অথচ শাস্ত্র কি বলছে দেখা যাক -
নাস্তিশৈবাগ্রণীর্বিষ্ণো ॥৫৬
(তথ্যসূত্র - স্কন্দমহাপুরাণ/মাহেশ্বরখণ্ড/অরুণাচমাহাত্ম্যম/উত্তরার্ধ্ব/অধ্যায় নং ৪)
☘️ সরলার্থ — শ্রীবিষ্ণুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ শৈব আর কেউ নেই।
অর্থাৎ প্রমানিত হল যে শ্রীবিষ্ণুই পরমশৈব। তার চেয়ে বড় শৈব আর কেউ নেই। আশা করি কলির চর বৈষ্ণবদের চোখ খুলে গেছে এবার। যদি চোখ না খোলে তবে তাদের জন্য বেদ থেকে হরির চেয়েও পরম হল পরমেশ্বর শিব, এটিই প্রমাণ করে দেয়া হল। চলুন দেখে নিই বেদশাস্ত্র কি বলছে -
পরাৎপরতরো ব্রহ্মা তৎপরাৎপরতো হরিঃ ।
তৎপরাৎ হ্যেষ তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্ত ॥১৮
[তথ্যসূত্র — ঋগ্বেদ সংহিতা/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১(শিবসংল্পসূক্ত) এবং ঋগ্বেদ সংহিতা/খিলানি/চতুর্থ অধ্যায়/১১ নং খিলা]
☘️ সরলার্থ — সর্বোপরি হলেন ব্রহ্মা, তাঁরও উপরে হরি এবং এনাদের চেয়েও যিনি পরমতম ঈশ (ঈশান/সদাশিব) সেই শিবের প্রতি মন সংকল্পবদ্ধ হোক ॥১৮
বেদের উপরোক্ত এই মন্ত্রই আরো কট্টরভাবে বেদের শরভ উপনিষদে উল্লেখ হয়েছে। সেখানে সরাসরি হরিকে শ্রেষ্ঠ বলার নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রভু শিব ছাড়া আর কেউ শ্রেষ্ঠ নয় তাও বলে দেওয়া হয়েছে।
দেখুন 👇
পরাৎপরতরং ব্রহ্মা যৎপরাৎপরতো হরিঃ ।
পরাৎপরতরো হীশস্তস্মাত্তুল্যোঽধিকো ন হি ॥ ২৯
এক এব শিবো নিত্যস্ততোহন্যৎসকলং মৃষা ।
তস্মাৎসর্বাপরিত্যজ্য ধ্যেযান্বিষ্ণবাদিকারান্ ॥ ৩০
(শরভ উপনিষদ/২৯ নং মন্ত্র)
সরলার্থ – যিনি পরাৎপর ব্রহ্মা, তাঁর থেকেও অধিক পরাৎপর হলেন হরি। কিন্তু হরির থেকেও অধিক যিনি পরাৎপর তিনিই হলেন ঈশ(সদাশিব), সেই প্রভু শিবের সমান তথা তাঁর চেয়ে অধিক কেউ নেই (কারণ শিবই সর্বোচ্চ সত্ত্বা পরমব্রহ্ম) ॥২৯
শিবই একমাত্র নিত্য, অন্য সকল কিছুই মিথ্যা। এই কারণে বিষ্ণু আদি সকল দেবতাকে পরিত্যাগ করে শিবকেই ধ্যেয় বলে জানা উচিত ॥৩০
আশা করি কলিরচর বৈষ্ণবদের চোখ এবার নিশ্চয়ই খুলে গিয়েছে।
আর একটি মজার বিষয় হল, এই বিপ্লব রায় নামক নব্য রামানুজী , দাবী করেছে যে, পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ডের ৭১ তম অধ্যায়ের ৪৩ ও ৫১ নং শ্লোকে নাকি সদাশিব কে বৈষ্ণব বলা হয়েছে।
যা অতিমাত্রায় একটি হাস্যকর ও অসত্য দাবি। কারণ মূল শ্লোকে ‘সদাশিব’ শব্দটিই উল্লেখ করা নেই, আর না অনুবাদে কোথাও সদাশিব বলে উল্লেখ করেছেন অনুবাদক।
অথচ, তিল থেকে তাল বানিয়ে দিতে সবার আগে এগিয়ে থাকে এই কল্পনাপ্রবণ কলিরচর বৈষ্ণবেরা ।
যেখানে সদাশিব শব্দটি পর্যন্ত কোথাও উল্লেখ নেই, সেখানে এই বৈষ্ণবেরা সদাশিবকে বৈষ্ণব বলবার মতো যুক্তি কি করে খুঁজে পায় তা এদের ঐ বিষ্ঠাপূর্ণ মস্তিষ্ক ই জানবে হয়তো।
এরা পঞ্চবক্র শব্দটা দেখে ভেবেছে, সদাশিবেরই একমাত্র পাঁচটি মুখ হয়, রুদ্রদেবের পাঁচ মুখ নেই 😆😂🤣
কিন্তু এই আকাট বোধহীন বৈষ্ণবেরা এটা জানে না যে, কৈলাসপতি ভগবান রুদ্রদেবেরও পাঁচটি মুখ রয়েছে, আবার শিবলোকবাসী পরমেশ্বর সদাশিবেরও পাঁচ মুখ রয়েছে। তাই পঞ্চবক্র শব্দটা দেখে রুদ্রদেবকে স্বয়ং গুণাতীত সদাশিব বলে উল্লেখ করা হল বৈষ্ণবদের চরম মূর্খামি ।
ক্ষেত্রবিশেষে, কৈলাসপতি রুদ্রদেব কেও সদাশিব বলে সম্বোধন করা হয়েছে শাস্ত্রের মধ্যে অল্প কিছু জায়গায়, তার তাৎপর্য মূলত রুদ্রদেব যেহেতু সদাশিবের পূর্ণলীলা অবতার তাই রুদ্রদেবের আভ্যন্তরীণ সদাশিব সত্ত্বাকে ইঙ্গিত করে সম্বোধন করা হয় মাত্র। তার অর্থ এই নয় যে, গুণাত্মক রুদ্রদেবই সাক্ষাৎ সদাশিব হয়ে গিয়েছেন।
যে সমস্ত আকাট বোধহীন বৈষ্ণবদের কোনো জ্ঞানই নেই পুরাণ শাস্ত্র সম্পর্কে, তারাই পরমেশ্বর শিবের এই সদাশিব ও কৈলাসপতি রুদ্রদেবের মধ্যের গভীর তত্ত্বগত বিষয় গুলি বুঝতে অক্ষম। এগুলো বোঝবার জন্য উচ্চ স্তরের আধ্যাত্মিক চেতনা বোধ প্রয়োজন, যা কলির বৈষ্ণবদের মধ্যে নেই।
কলির বৈষ্ণবদের মধ্যে রয়েছে শুধু ক্রোধ হিংসা আর অহংকার।
তাই শাস্ত্রে কলিযুগের বৈষ্ণবদের উদ্দেশ্য করে ভবিষ্যতবানী করে বলা হয়েছে —
পুরুষোত্তমমাশ্রিত্য শিবা নিন্দারতা দ্বিজাঃ ।
কলৌ যুগে ভবিষ্যন্তি তেষাং ত্রাতা না মাধবঃ ॥ ২১
(তথ্যসূত্র- সৌরপুরাণ/৪ অধ্যায়)
☘️ সরলার্থ — কলিযুগে দ্বিজরা পুরুষোত্তম কে আশ্রয় করে শিব-নিন্দাপরায়ন হবে, মাধব কিন্তু তাদের ত্রাতা(রক্ষক) নন।
🔥সিদ্ধান্ত- যারা শ্রী হরির আশ্রিত বৈষ্ণব তারা কলিযুগে শিবনিন্দা করবে ইহাই শাস্ত্রের ভবিষ্যৎবাণী, তাদের স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও রক্ষা করবেন না। বর্তমানে বৈষ্ণবদের শিবকে তামসিক,হরির দাস বৈষ্ণব, শ্মশানবাসী, উলঙ্গ বলে তাচ্ছিল্য করতে দেখা যায়।
তাই পরমেশ্বর শিব যে বৈষ্ণব নন, বরং এসব অশাস্ত্রিয় গুজব বৈষ্ণবরা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে , তা শাস্ত্রের নিরিখে প্রমাণ করলাম।
সুতরাং, পদ্মপুরাণ অনুসারেও পরমেশ্বর শিব যে বৈষ্ণব নয় তা প্রমাণিত হল ।
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
▪️ এবিষয়ে সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি এখানে ক্লিক করে দেখতে পারেন 👉 পরমেশ্বর শিব বৈষ্ণব নন
🔥 অপপ্রচার দমনে লেখক – শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
কপিরাইট ও প্রচারে – International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
© Koushik Roy. All Rights Reserved https://issgt100.blogspot.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন