শৈব অবধূত পরম্পরার “গুরু ব্রহ্মা গুরু শ্যাম গুরু শিব গুরু রাম”— এই গুরুনাম শব্দের রহস্য জানুন
শৈব অবধূত পরম্পরার বিখ্যাত গুরু সম্পর্কিত নামকীর্তনের শব্দসমূহ —
“গুরু ব্রহ্মা গুরু শ্যাম গুরু শিব গুরু রাম”
— এই মহান নামসমূহ প্রকাশ করেছিলেন মাতা পার্বতী দেবী মহাযোগী শৈব সাধক শ্রী দয়ানন্দ অবধূত গুরুদেবের নিকট। তিনি বলেছিলেন এটি তার শিষ্যের কাছে প্রকাশ করতে।
কিন্তু এর পূর্ণ অর্থ সম্পর্কে বেশিরভাগ ভক্তই অজ্ঞাত।
শ্রীগুরু কাশীনাথ শৈবাচার্য গুরুদেব সেই পূর্ণ অর্থ অবগত করিয়েছিলেন।
শ্রীগুরু বলেছেন —
গুরু শব্দে পরমব্রহ্ম শিবকেই বোঝানো হয়, যার থেকে সকল কিছুর উৎপত্তি হয়েছে। নিরাকার পরমসত্ত্বা পরমশিব যখন নিজের অদ্বিতীয় অবস্থা থেকে দ্বিতীয় কোনো কিছু প্রকট করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তখন তিনি তার ইচ্ছাশক্তিকে প্রেরণা দ্বারা প্রেরিত করে সদাশিব রূপে সাকার বিগ্রহ রূপ ধারণ করেন।
সেই সদাশিবের অঙ্গের বামভাগ অর্থাৎ আদ্য(অর্ধেক) ভাগ থেকে নারীরূপ শক্তি দেবী প্রকট হন। তাই দেবীকে আদ্যাশক্তি বলে । এই আদ্যাশক্তি শিবা তার প্রকৃতি ভাগ থেকে ব্রহ্মা-বিষ্ণুকে উৎপন্ন করেন। সদাশিবের নির্দেশে ব্রহ্মা জাগতিক সৃষ্টি রচনা করেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে (Automatically) সৃষ্টি চালনা করবার জন্য সেই ব্রহ্মার সৃষ্ট চর-অচর ব্রহ্মাণ্ডের চারিদিকে শ্রী বিষ্ণু ব্যাপ্ত হয়ে অবস্থান করেন । সেই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে থাকা জগতে বহু জীব উৎপন্ন হয়।
পরমার্থিক দৃষ্টিকোণে জীব, জগত, ব্রহ্মা-বিষ্ণু, আদ্যাশক্তি - এই সকলের রূপে সেই এক পরমব্রহ্ম শিবই ব্যাপ্ত রয়েছেন । এই কারণে গুরুগীতাতে বলা হয়েছে, “অখণ্ড মন্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচর” অর্থাৎ খণ্ডিত করা যায় না এমন সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত চরাচর জগত জুড়ে সব কিছুতে যিনি ব্যাপ্ত হয়ে আছেন , “তৎপদং দর্শিতং যেন, তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ” সেই পরমব্রহ্ম যে সর্বোচ্চ পদস্বরূপে স্থিত, যাকে যোগীরা ধ্যানের মাধ্যমে দর্শন করতে থাকেন, সেই গুরু অর্থাৎ পরমশিবকে আমি নমস্কার করি।
অর্থাৎ গুরু শব্দে পরমশিবই আখ্যায়িত হন ।
এই পরমশিবই সাকার বিগ্রহ “দক্ষিণামূর্তি শিব” রূপ ধারণ করে সকলকে পরমতত্ত্বরূপী গুরুজ্ঞান অর্থাৎ শিবজ্ঞান প্রদান করে সকল জীবকে তাদের আসল পরিচয় জানিয়ে তাদের এই জন্মমৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত করে নিজের স্বরূপে বিলীন করে নেন।
যেহেতু পরমশিব সমস্ত মায়া-মোহের প্রভাবের উর্ধ্বে থাকা পরমতত্ত্ব। তাই শিষ্য জ্ঞানলাভ করে গুরুরূপী পরমশিবের তত্ত্বে স্থিত হয়ে যান, এভাবেই শিষ্য গুরু কৃপায় জাগতিক মায়ার প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে মায়ার ঊর্ধ্বে থাকা পরম শিবকে লাভ করা নেয়।
🟥(১) গুরু অর্থাৎ শিবই নিজের সাকার বিগ্রহ পঞ্চমুখী সদাশিবের সদ্যোজাত মুখ থেকে ব্রহ্মারূপ প্রকট করেন। তাই অবধূত পরম্পরার “গুরু ব্রহ্মা” শব্দ দ্বারা মূলত সেই পরমব্রহ্ম শিবই ব্রহ্মাস্বরূপ ধারণকারী বলে আখ্যায়িত হয়েছেন।
🟥(১) গুরু ব্রহ্মা = শিবই ব্রহ্মা — সৃষ্টিকর্তা ।
🟦(২) গুরু অর্থাৎ শিবই নিজের সাকার বিগ্রহ পঞ্চমুখী সদাশিবের বামদেব মুখ থেকে বিষ্ণুরূপ প্রকট করেন। তাই অবধূত পরম্পরার “গুরু শ্যাম” শব্দ দ্বারা মূলত সেই পরমব্রহ্ম শিবই শ্যামবর্ণযুক্ত বিষ্ণুস্বরূপ ধারণকারী বলে আখ্যায়িত হয়েছেন।
🟦(২) গুরু শ্যাম = শিবই বিষ্ণু — পালনকর্তা ।
🟧(৩) গুরু অর্থাৎ শিবই নিজের সাকার বিগ্রহ পঞ্চমুখী সদাশিবের অঘোর মুখ থেকে রুদ্ররূপ প্রকট করেন। তাই অবধূত পরম্পরার “গুরু শিব” শব্দ দ্বারা মূলত সেই পরমব্রহ্ম শিবই রুদ্রস্বরূপ ধারণকারী বলে আখ্যায়িত হয়েছেন।
[প্রথমে মাতা পার্বতীর আদেশ ছিল “গুরু শঙ্কর” বলবার জন্য, পরবর্তীতে মাতা বলেন কৈলাসপতি শঙ্কর তো মূল সদাশিবের পূর্ণাবতার, তাই ‘গুরু শিব’ ই উচ্চারণ করবে, তখন থেকে ‘গুরু শঙ্কর’ -এর স্থানে ‘গুরু শিব’ বলেই উচ্চারণ হতে আরম্ভ হল, গুরু শিব শব্দে ‘শিব’ বলতে সংহার কর্তা রুদ্র দেবের কথা বোঝানো হয়েছে]
🟧(৩) গুরু শিব = শিবই রুদ্রদেব — প্রলয়কর্তা ।
🟨(৪) গুরু অর্থাৎ শিবই নিজের সাকার বিগ্রহ পঞ্চমুখী সদাশিবের তৎপুরুষ মুখ থেকে মহেশ্বর রূপ প্রকট করেন। তাই অবধূত পরম্পরার “গুরু রাম” শব্দ দ্বারা মূলত সেই পরমব্রহ্ম শিবের মহেশ্বরস্বরূপ কেই বোঝায়। এখানে রাম শব্দের অর্থ হল , যোগীরা ধ্যানের মাধ্যমে যে পরমব্রহ্মে রমন করেন সেই পরমব্রহ্মকেই রাম বলা হয়। এক্ষেত্রে সেই মহেশ্বরকে রাম নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
🟨(৪) গুরু রাম = শিবই মহেশ্বর — তিরোভাব কর্তা ।
🔲(৫) গুরু অর্থাৎ শিবই নিজের সাকার বিগ্রহ পঞ্চমুখী সদাশিবের ঈশান মুখ থেকে অনুগ্রহ কর্তা সদাশিব রূপ প্রকট করেন। তাই অবধূত পরম্পরার “গুরু” শব্দ দ্বারা মূলত সেই পরমব্রহ্ম শিবের “অনুগ্রহ কর্তা ঈশান সদাশিব” কেই বোঝায়।
(৫) গুরু = শিব ঈশান — অনুগ্রহ কর্তা ।
এভাবেই মাতা পার্বতীর আদেশে “গুরু” পদ দ্বারা পরমেশ্বর শিবকে প্রচার করা হয়ে থাকে শৈব অবধূত পরম্পরায়।
গুরু শব্দটি যে একমাত্র পরমেশ্বর শিবেরই বাচক। তার প্রমাণ শাস্ত্র থেকে প্রমাণ সহ দেওয়া হল।
✳️ গুরুগীতাতে বলা হয়েছে 👇
কাশীক্ষেত্রং তন্নিবাসো জাহ্নবী চরণোদকম্ ।
গুরুর্বিশ্বেশ্বরঃ সাক্ষাৎ তারকং ব্রহ্ম নিশ্চিতম্ ॥ ১৬
যো গুরু স শিবঃ প্রোক্তা যঃ শিবঃ স গুরুস্মৃতঃ ।
বিকল্পং যস্তু কুর্বীত স নরো গুরুতল্পগঃ ॥ ১৮
প্রভবে সর্ববিদ্যানাং শম্ভবে গুরবে নমঃ ॥ ৩৩
[স্কন্দপুরাণ/গুরুগীতা]
অর্থ — গুরুর নিবাস কাশীক্ষেত্র তে, তার চরণোদক ই জাহ্নবী(গঙ্গা), আর গুরু স্বয়ং বিশ্বেশ্বর সদাশিব অর্থাৎ কাশীনগরীর অধিপতি স্বয়ং শিব, তিনিই সাক্ষাৎ তারক ব্রহ্ম অর্থাৎ তিনি সকল দুঃখকে তাড়ন করেন, এটি নিশ্চিত ॥ ১৬
যাকে গুরু বলা হয় , সেই গুরু প্রকৃত পক্ষে একমাত্র শিবই, আর যিনি শিব তিনিই একমাত্র গুরু বলে জানা উচিত। যদি এর বিকল্প ভাবনা করা হয় অর্থাৎ যদি কেউ গুরু শব্দ দ্বারা পরমেশ্বর শিবকেই ইঙ্গিত করা হয় বলে না মান্য করে তবে সেই ব্যক্তির গুরুপত্নীগমনের পাপ লাগে ॥ ১৮
সমস্ত প্রকারের বিদ্যা যে প্রভুর থেকে উৎপন্ন হয় সেই শম্ভু অর্থাৎ শিবই সাক্ষাৎ গুরু , তাকে নমস্কার করি ॥ ৩৩
✳️ শিবমহাপুরাণে বলা হয়েছে 👇
জীবের উদ্ধার হেতু 'গুরু' রূপ ধারণ করেন শিব
মহাদেব উবাচ
অহং দুঃখোদধৌ মগ্না উদ্ধরিষ্যামি চ প্রজাঃ ।
সম্যগ্ জ্ঞানপ্রদানেন গুরুমূর্তিপরিগ্রহঃ ॥৬৩
[তথ্যসূত্র : শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/সৃষ্টিখণ্ড/অধ্যায় ১৫]
অর্থ - মহাদেব বললেন, আমি গুরুমূর্তি ধারণ করে শিবজ্ঞান প্রদান করে দুঃখসাগররূপী সংসারে ডুবে থাকা সেই জীবেদের উদ্ধার করবো সর্বদা ॥৬৩
সিদ্ধান্ত - পরমেশ্বর শিব নটরাজরূপ ধারণ করেছেন, শরভেশ্বর রূপ ধারণ করেছেন, তেমনই তিনি সকল অজ্ঞানী জীবেদের এই জন্মমৃত্যুর চক্র থেকে উদ্ধার করার জন্য 'গুরু' নামক একটি রূপ ধারণ করেন, যার অপর নাম দক্ষিণামূর্তি, এই রূপে তিনি তার ভক্তদের পরম শিবজ্ঞান প্রদান করে তাদের উদ্ধার করেন । তাই জগতের সকল শিবজ্ঞানী গুরুকে শিবস্বরূপ বলা হয়, গুরু নামটিই শিবের, যেমন মহাদেব তার একটি নাম।
শ্রী দয়ানন্দ অবধূত গুরুদেব নিজেই পরমেশ্বর শিবকে ‘গুরু’ শব্দে সম্বোধন করতেন। তিনি নিজেই এই ‘গুরু’ নামের অক্ষরের মধ্যে নিজের জ্ঞানীগুরু, শিক্ষাগুরু, দীক্ষাগুরু, যোগীগুরুকে দেখতেন, আর সবার মধ্যে সেই একমাত্র সকলের আদি পরাৎপর গুরু পরমশিবকেই দর্শন করতেন।
প্রত্যেক ভক্তের উচিত তার নিজ দীক্ষাগুরু বা জ্ঞান প্রদানকারী গুরুর মধ্যে পরমেশ্বর শিবের প্রকাশ রয়েছে বলে মান্য করে নিজ গুরু ও পরমেশ্বর শিবের প্রতি অচলা ভক্তি শ্রদ্ধা রাখা। তবেই মোক্ষ লাভ সম্ভব । যদি কোনো ব্যক্তি অহংকার ও জেদবশত পরমেশ্বর শিবের বা নিজ দীক্ষাগুরু বা জ্ঞান প্রদানকারী গুরুর মধ্যে কাউকে ছোট বড় করে দেখতে শুরু করে তবে তার পতন অনিবার্য।
তাই গুরুভক্তি সাথে সাথে শিবভক্তি অবশ্যই করতে হবে।
নচেৎ সব বৃথা ।
এ কারণেই গুরুনামের রহস্য উন্মোচন করা হল, যাতে কেউ পরমেশ্বর শিবের অবহেলা না করে।
বর্তমানে বেশিরভাগ ভক্ত শিষ্যরা এ বিষয়ে অবগত নয়, তাই তারা বিভিন্ন রকম বিভ্রান্তির শিকার হয়ে চলেছেন । সকলের জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য এই তথ্য প্রকাশ করা হল ।
অবশ্যই এই তথ্যকে বেশি পরিমাণে শেয়ার করে সকলকে জানিয়ে দিন ।
গুরু কৃপা বিনে তোর নাই কোনো চর ।
সব চিন্তা ছেড়ে শুধু গুরুর দু চরণ ধর ॥
শিব পাবি গুরুচরণ সেবা করিস যদি ।
তার কৃপা লাভে পাড় হয়ে যাবি ভবনদী ॥
গুরু ব্রহ্মা শ্যাম রাম সব নাম তার ।
দক্ষিণামূর্তি উমাপতি শিব নাম যার ॥
গুরুবাক্যে বিশ্বাস নাহি হয় যে নরের ।
নরকের বাসী হয় অনন্ত কল্পান্তরের ॥
জয় গুরু জয় গুরু ভক্তশৈব বলো ।
গুরুকৃপায় অন্তিমে শিবলোক চলো ॥
ॐ শ্রী গুরু দয়ানন্দ অবধূত সহিতায় নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায় ॥
ॐ নমঃ পার্বতীপতয়ে হর হর মহাদেব
সংগ্রহে ও লেখনীতে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন