সনাতন শৈবধর্মের মার্গ ও শিবের উপাসনা কেন সর্বশ্রেষ্ঠ ❓
সনাতন শৈবধর্মের মার্গ ও শিবের উপাসনা কেন সর্বশ্রেষ্ঠ❓
🔥 উত্তর —
শাস্ত্রের নিরিখে তার প্রামাণ্যতা বিচার—
ॐ মহাগণাধিপতয়ে নমঃ 🙏
ॐ শ্রী গুরু দক্ষিণামূর্তয়ে নমঃ 🙏
👉 সৃষ্টির শুরু থেকে যে গুরু পরম্পরার ধারা অব্যাহত রয়েছে তা হলো “পাশুপত” পরম্পরা। পরমেশ্বর শিব দ্বারা প্রদর্শিত এই পাশুপত পরম্পরার প্রথম দুই শিষ্য হলো ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু। শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাম ও পাশুপত মতে দীক্ষিত ছিলেন। শিবপুরাণ, কূর্ম্মপুরাণ, মহাভারত, শিবগীতা অধ্যয়ন করলে তার সত্যতা জানা যায়। আমাদের International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT - হল সেই প্রাচীন মহা পাশুপত শৈব অবধূত পরম্পরার অন্তর্গত।
👉আজ আমরা আলোচনা করতে চলেছি সেই পাশুপত পরম্পরার নির্দেশিত আচার নিয়ে। কেন শৈবরা শ্রেষ্ঠ এমন প্রশ্ন সবার মনে একবার হলেও আসে। বা কেনই বা শিবার্চনা শ্রেষ্ঠ!
এর উত্তর হল —
অন্যান্য পরম্পরা অনুযায়ী তাদের প্রদর্শিত মার্গে আচার অনুষ্ঠান, যাগ-যজ্ঞাদি, পূজা-অর্চনা ইত্যাদি করতে সাধারণ মানুষের অনেক পরিশ্রম করতে হয়, অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয় এবং সম্পূর্ণ সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। ভুল করার বিন্দু মাত্র ও অবকাশ রাখা যাবে না।
👉পরম্পরা বিষয়ক কিছু তথ্য —
নাস্তিক্যবাদী মত হলো— বৌদ্ধ, জৈন, চার্বাক, সৌগত(সুগত বুদ্ধ প্রবর্তিত) ও আর্হত। 'শূণ্যবাদ' হলো এদের প্রমুখ সিদ্ধান্ত।
"তারে তুত্তারে তুরে স্বাহা" এই “তারা” মন্ত্রসমূহের জপ করে এরা। এটি হলো অবৈদিক মত।
এরপর বৈদিক মতের শুরু হয়— সব বেদানুযায়ী মতে সকলে ব্রহ্মগায়ত্রী-র জপ করে।
কিন্তু এর থেকে সৌর মতের অধিক মাহাত্ম্য বলা হয়েছে।
সৌর মতের পাঁচটা ভেদ রয়েছে— বৈকর্তন, আদিত্য, মার্ত্ণ্ড, পৌষ্ণ ও সৌর। এই মত গুলোর প্রধান অধিপতি হলো সূর্য। এবং সৌরমতে সূর্যের উপাসনাই মূখ্য।
সৌর মত থেকেও শ্রেষ্ঠ মত হলো বৈষ্ণব মত। এবং বৈষ্ণব মতের ও পাঁচটা ভেদ রয়েছে— গোপাল, নরসিংহ, রাম, কৃষ্ণ ও নারায়ণ। এরা সবাই বৈষ্ণব গায়ত্রী জপ করে। এবং এরা একমাত্র বিষ্ণুর উপাসনায় করে।
আর এইসব মত থেকে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম পন্থা হলো শৈবমার্গ। শৈবমার্গের সাত প্রকার ভেদ রয়েছে—
বীর শৈব (অদ্বৈত জ্ঞানী শৈব), অনাদিশৈব, আদিশৈব, অনুশৈব, মহাশৈব, যোগশৈব ও জ্ঞানশৈব।
এই সাতটা মতের মধ্যে বীর শৈব (আত্মজ্ঞানী শৈব) মার্গই সর্বশ্রেষ্ঠ, বাদবাকী গুলো বীরশৈবমার্গেরই অঙ্গ।
এর অতিরিক্ত অঙ্গ হিসেবে গাণপত্য, বীরভদ্র, ভৈরব, শরভ, নন্দীকেশ, কৌমার ও পৈশাচ মতের উল্লেখ ও রয়েছে।
তার মধ্যে গাণপত্য মত- ৮ প্রকারের, বীরভদ্র মত- ৭ প্রকারের, ভৈরব মত- ৮ প্রকারের, শরভ মত- ৫ প্রকারের, নন্দীকেশ মত- ৩ প্রকারের, কৌমার মত- ৩ প্রকারের এবং পৈশাচ মত ও- ৩ প্রকারের।
সৌগত মত থেকে বৈষ্ণব মত পর্যন্ত বর্ণিত সকল মত একে অপরের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
ষড়দর্শনের ভেদ অনুযায়ী তন্ত্রশাস্ত্রেরও ৬ ভেদ শাস্ত্রে উল্লেখ হয়েছে।
এগুলো হলো—
বীর শৈব(অদ্বৈত শৈব), বৈষ্ণব, শাক্ত, সৌর, গাণপত্য ও কাপাল। দর্শনের দৃষ্টিতে তন্ত্রে এই ছয় প্রকার ভেদ মানা হয়। এবং যে যেই পরম্পরার অধীনে থাকে সে ব্যক্তি সেই মতানুযায়ী ধর্ম পালন করার আদেশ শাস্ত্র দেয়।
কিন্তু এই মতবাদের থেকে একমাত্র শৈবমার্গই সর্বোত্তম।
👉বৈষ্ণবমত হোক বা শাক্তমত দুই পরম্পরার উদ্দেশ্যই মুক্তি লাভ করা। কিন্তু এইসব মতের প্রদর্শিত মার্গ অবলম্বন করা অপেক্ষাকৃত কঠিন।
👉পরমেশ্বর শিবের প্রদর্শিত “অদ্বৈত শৈবমার্গ”-এ নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম, বিধির প্রয়োজন পড়ে না। শুদ্ধ-অশুদ্ধতার কোনো মান্যতা নেই, শৌচাশৌচের কোনো মান্যতা নেই, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এসব জাতিভেদের কোনো মান্যতা নেই। অদ্বৈত শৈবমার্গে কেউ উঁচু কেউ নিচু হয় না, শৈবমার্গে সবাই সমান। অদ্বৈত শৈব মার্গে পূজা-অর্চনাতে নির্দিষ্ট কোনো তিথি-নক্ষত্রের প্রয়োজন পড়ে না। স্ত্রী, বালক, বৃদ্ধ, চাণ্ডাল, বর্ণসংকর সবাই পরমেশ্বর শিবের পূজা করতে পারে। যার যেমন ভক্তি ভাব সে সেভাবেই পরমেশ্বর শিবের পূজা করতে পারবে। শিব অল্পতেই তুষ্ট বলেই শিবকে আশুতোষ বলা হয়। শিব এক ঘটি জলে সন্তুষ্ট, একটা বেলপাতাতে সন্তুষ্ট, একটা ফুলের দ্বারাও শিবের পূজা সম্পূর্ণ হয়। এবং তার মাধ্যমে সাধক অনায়াসেই মোক্ষ প্রাপ্ত হয়।
তাইতো বলা হয় যে, অদ্বৈত শৈবমার্গ সর্বশ্রেষ্ঠ। কারণ এখানে সবকিছু শিবময়।
👉এবার আসা যাক শাস্ত্রের দিকে শাস্ত্র কি বলে তা একবার দেখে নেব—
দেব্যুবাচ—
উক্তান্যেতানি দেবেশ সর্বাণি চ সমানি বা।
তারতম্যেন বা তত্র কিং মতং চন্দ্রশেখর।।৩৬।।
নোক্তং শাক্তমতং দেব উত্তমং বা অধমং সমম্।
তদধ্যা কথয় স্বামিন্ যক্তু সর্বোক্তমোক্তমম্।।৩৭
[মহাশ্রুতি পারমেশ্বরাগম/প্রথম পটল]
অর্থঃ— দেবী পার্বতী বললেন— হে দেবেশ! এখানে আপনি যেসব মত গুলোর কথা বলছেন, সেসব মত গুলো কি সব একি নাকি তারতম্য রয়েছে? যদি তারতম্য থাকে তাহলে এর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মত কোনটা? ।।৩৬।।
আপনি শাক্ত মতের ব্যাপারে কিছুই বললেন না যে এটি উত্তম, অধম নাকি অন্য মত গুলোর সমমান? হে স্বামিন্! এইজন্যই আপনি আমাকে আজ এটি বলুন যে, এর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মত কোনটা? ।। ৩৭।।
💠পরমেশ্বর শিব মাতা পার্বতীকে বিভিন্ন মত সম্পর্কে বলার একটা পর্যায়ে, মাতা পার্বতী পরমেশ্বর শিব থেকে জানতে চাইলেন যে, পরমেশ্বর শিব সব পরম্পরা নিয়ে বলেছেন কিন্তু শাক্ত পরম্পরা নিয়ে কিছুই বললেন না! তাই এবার মাতা পার্বতী পরমেশ্বর শিব থেকে শাক্ত পরম্পরা সম্পর্কে জানতে চাই যে, শাক্ত পরম্পরা উত্তম, অধম নাকি অন্যান্য মতগুলোর সমান।
👉এবার পরমেশ্বর শিব কি বলছেন তা দেখে নেব—
ঈশ্বর উবাচ—
সর্বাণি চ মহাদেবি মতানি তু মহান্ত্যপি ।
প্রাপ্যমেকং ফলং তেষাং বিশেষস্তত্র বক্ষ্যতে ।।৩৮
[মহাশ্রুতি পারমেশ্বরাগম/প্রথম পটল]
অর্থঃ— হে মহাদেবী! এই সব মতগুলো নিজ নিজ স্থানে মহান, কেননা এই সব মত গুলোর ফল একমাত্র মুক্তি। তারপরেও এই মত গুলোর যে বিশেষতা রয়েছে তা আমি তোমাকে বলছি ।।৩৮
💠আমি উপরেই বলেছি যে বৈষ্ণব হোক বা শাক্ত মত সবার উদ্দেশ্য মুক্তি পাওয়া। কিন্তু এর মধ্যেও তার কিছু আলাদা বিশেষতা আছে, তা-ই উল্লেখ করছে পরমেশ্বর শিব।
👉 পরমেশ্বর শিব অন্যান্য মত এবং শৈবমার্গ নিয়ে বলছেন —
বিত্তায়াসমহাযন্তুসাধ্যান্যন্যানি পার্বতী।
মহাফলং শুভকরং শৈবমেব ন সংশয়ঃ।।৩৯।।
তত্র বক্ষ্যে শিবে বীরশৈবং সর্বোত্তমোত্তমম্।
নান্যস্য তদ্ধবেধ্যোগ্যং শাক্তেয়ং সর্বসংমতম্।।৪০
বীরশৈবমতং সধ্যো ভোগমোক্ষৈকসাধনম্।
সর্বোক্তমং মম মতং যতঃ সর্বোক্তমোঽস্ম্যহম্।।৪১।।
ন বীরশৈবসদৃশং মতমস্তি জগতত্রয়ে।
সর্বভোগপ্রদং পুণ্যং শিবসাযুজ্যদায়কম্।।৪২।।
যথা মন্যদৃশো নাস্তি পুরুষাণাং ত্ব্যা সমা।
স্ত্রীণাং তথা বীর শৈবসদৃশং নাস্তি বৈ মতম্।।৪৩।।
অপি পাপশতং কৃত্বা জ্ঞানতোऽজ্ঞানতোঽপিবা।
বীরশৈবমতং প্রাপ্য শিব এব ন সংশয়ঃ।।৪৪।।
ন তস্যাস্তি ভয়ং পাপান্নাধিক্যং পুণ্যকর্মণঃ।
স্বয়ং হি পুণ্যপাপানাং নির্ণেতা চ নিয়ামকঃ।।৪৫।।
[মহাশ্রুতি পারমেশ্বরাগম/প্রথম পটল]
অর্থঃ— হে পার্বতী! অন্যান্য মতে প্রদর্শিত যাগ-যজ্ঞাদি অনুষ্ঠানের আয়োজনে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়, অনেক পরিশ্রম করতে হয় আর সম্পূর্ণ সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। তার বিপরীতে শৈবমার্গে প্রদর্শিত অনুষ্ঠানে মহান শুভকর ফল অনায়াসেই প্রাপ্তি হয়। এই কারণেই নিঃসন্দেহে বীর শৈব(অদ্বৈত শৈব) মার্গ সর্বশ্রেষ্ঠ।।৩৯।।
👉(আমি উপরেই বলেছিলাম যে অন্যান্য মতানুযায়ী পূজার কর্মকাণ্ড পালন করতে অনেক কিছুই মানতে হয়। কিন্তু অন্যান্য মত থেকে শৈব মার্গে এসবের আধিক্য নেই। শৈবমার্গে অনায়াসেই মানুষ সিদ্ধি লাভ করতে পারে)।।
হে শিবে! আমি তোমাকে বলবো যে, কীভাবে বীর শৈব মার্গে অন্য সব মতের থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ। এর যোগ্যতা সবার মধ্যে থাকে না। শাক্ত মত তো যে-কেউ পালন করতে পারে।।৪০।।
বীর শৈব(অদ্বৈত শৈব) মার্গ তৎকালেই ভোগ (অষ্টবিধ ঐশ্বর্য) আর মোক্ষ উভয় প্রাপ্তির একমাত্র সাধন। আমার(শিবের) এই শৈবমার্গ সর্বোত্তম, কারণ আমি অর্থাৎ শিবই স্বয়ং সর্বোত্তম।। ৪১।।
👉(অন্যান্য মত থেকে শৈবমার্গ এই কারণেই সর্বশ্রেষ্ঠ, কারণ পরমেশ্বর শিব সর্বশ্রেষ্ঠ। বেদেও একি কথা বলা হয়েছে—
"পরাৎপরতরো ব্রহ্মা তৎপরাৎপরতো হরিঃ।
তৎপরাৎ হ্যেষ তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্ত”।।১৮।।
[ঋগ্বেদ সংহিতা/আশ্বলায়ণশাখা/১৭১/১০ এবং ঋগ্বেদ সংহিতা/খিলানি/চতুর্থ অধ্যায়/১১ নং খিলা]
✅ অর্থ — সর্বোপরি হলেন ব্রহ্মা, তার উপরে বিষ্ণু এবং এদের সবার চেয়েও যিনি সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ তিনি হলেন পরমেশ্বর শিব।
তার আরও প্রমাণ উপনিষদে পাওয়া যায়—
চিত্তাদিসর্বোহীনোহস্মি পরমোহস্মি পরাৎপরঃ।
সদা বিচাররূপোহস্মি নির্বিচারোহস্মি সোহম্ম্যহম্।।১০
[মৈত্রেয়ী উপনিষদ- অধ্যায়- ৩]
✅ অর্থ — আমি সমস্ত চিত্তাদি রহিত। আমি (শিব) পরাৎপর ব্রহ্ম। আমি সর্বদাই বিচার রূপ আবার বিচারের উর্ধ্বেও আমি।।১০।।
অর্থাৎ বেদ থেকেই প্রমাণিত হয় যে পরমেশ্বর শিবই সর্বোত্তম সর্বোচ্চ সত্ত্বা, তা-ই পরমেশ্বর শিবের দ্বারা প্রদর্শিত মার্গ সর্বশ্রেষ্ঠ)।।
এই ত্রিলোকে বীর শৈব(অদ্বৈত শৈব) মার্গের সমান অন্য কোনো মার্গ নেই। ইহা সর্ব প্রকার ভোগ (ঐশ্বর্য) প্রদানকারী পবিত্র আর শিবসাযুজ্য প্রদানকারী।। ৪২।।
যেমন পুরুষের মধ্যে আমার(শিবের) সমান অন্য কোন পুরুষ নেই, স্ত্রী'র মধ্যে তোমার(পার্বতীর) সমান অন্য কোনো স্ত্রী নেই, সেভাবেই বীর শৈব(অদ্বৈত শৈব) মার্গের সমান অন্য কোনো মার্গ নেই।।৪৩।।
👉(হ্যাঁ এটাই চিরন্তন সত্য যে, শৈবমতের সমান অন্য মত এই ত্রিভুবনে নেই। এবং শিবার্চনা থেকে উত্তম কিছুও এই ত্রিভুবনে নেই।
♦️ শাস্ত্রেও একি কথা বলা আছে—
ন শিবার্চনতুল্যোহস্তি ধর্মোহন্যো ভুবনত্রয়ে ।। ২৩।।
[শিবমহাপুরাণ, বায়বীয় সংহিতা, উত্তরখণ্ড, অধ্যায় ২৬]
✅ অর্থ — পরমেশ্বর শিবের উপাসনার তুল্য অন্য কোনো ধর্ম নেই এই ত্রিভুবনে।
তাই বলা হয় শৈবধর্ম থেকে শ্রেষ্ঠ অন্যকিছুই এই ত্রিভুবনে নেই)।।
জেনে বা না জেনে নানাবিধ পাপ করা ব্যক্তি বীর শৈব(অদ্বৈত শৈব) মার্গের আশ্রয় নিয়ে সাক্ষাৎ শিবস্বরূপ হয়ে যায়।।৪৪।।
শৈব বীরেদের দের না পাপ কার্যের কোনো ভয় থাকে না পূণ্যের, কারণ এর মধ্যেই এর বিশেষতা, কেননা সে তো পূণ্য আর পাপের নির্ণয় করার নিয়ামক হয়ে যায়।।৪৫।।
👉(এই অর্থের মর্মার্থ হলো- যে ব্যক্তি পাপ কার্যে লিপ্ত থাকে, সে যদি বীরশৈব মতের আশ্রয় নেয় অর্থাৎ, সে যদি আত্মজ্ঞানের পথ নির্বাচন করে তাহলে সে সাক্ষাৎ শিব স্বরূপ হয়ে যায়। যেমন টা বেদান্তে বলা হয়েছে—’'অহং ব্রহ্মাস্মী” আমিই ব্রহ্ম, “অয়মাত্মা ব্রহ্ম” আমার আত্মাই ব্রহ্ম(শিব)। বলে রাখা ভালো যে শৈবমার্গ আত্মজ্ঞান মার্গী। অর্থাৎ নিজেকে(আত্মাকে) শিব জানাটাই অদ্বৈত শৈব মার্গের একমাত্র উদ্দেশ্য।
♦️ মহাভারতেও এমন একটা প্রমাণ পাওয়া যায়—
সর্বথা বর্তমানোহপি যো ভক্তঃ পরমেশ্বরে।
সদৃশোহরণ্যবাসীনাং মুনীনাং ভাবিতাত্মনাম্ ॥৬৩৷৷
ব্রহ্মত্বং কেশবত্বং বা শত্রুত্বং বা সুরৈঃ সহ।
ত্রৈলোক্যস্থাধিপত্যং বা তুষ্টো রুদ্রঃ প্রযচ্ছতি ॥৬৪৷৷
[মহাভারত- অনুশাসনপর্ব- অধ্যায়- ১৭]
অর্থঃ— যে মানুষ পুণ্যকর্মে বা পাপকর্মে প্রবৃত্ত থাকিয়া ও মহাদেবের ভক্ত হন, তিনি শোধিতচিত্ত বনবাসী মুনির তুলা হইয়া থাকেন। সুতরাং মহাদেব সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে ব্রহ্মত্ব, বিষ্ণুত্ব, অন্য দেবগণের সহিত ইন্দ্রত্ব, কিংবা ত্রিভুবনের অধিপতিত্ব দান করেন।।
♦️ আত্মজ্ঞানীরা এসব পাপ পুণ্যের ঊর্ধ্বে হয়, তন্ত্রে বলা হয়েছে—
ন বিধিন নিষেধঃ স্যান্ন পুণ্যং ন চ পাতকম্।
ন স্বর্গো নৈব নরকং কৌলিকানাং কুলেশ্বরি।।
[কূলার্ণবতন্ত্র- ৯ম উল্লাস— ৫৮]
অর্থঃ— কুলেশ্বরী, কৌলিকদের বিধিও নেই, নিষেধও নেই, পুণ্যও নেই পাপও নেই, স্বর্গও নেই নরকও নেই।।৫৮
এবার এখানে অনেক শাক্ত বলবে যে, কৌল বলতে কেবল শাক্তদের বোঝানে হয়েছে। কিন্তু এমন টা তাদের ভুল ধারণা, কেননা এখানে কৌল বলতে “শিবশক্তি” অবস্থা বোঝানো হয়েছে। যিনি কৌল তিনিই শৈব এদের মধ্যের কোনো পার্থক্য নেই )।।
👉অন্যান্য পরম্পরায় তাদের আরাধ্যের পূজা-অর্চনা, যাগ-যজ্ঞাদি বিভিন্ন কর্মকাণ্ড করতে গেলে বেশ কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম পালন করতে হয়। তিথি-নক্ষত্র, শুভদিন, শুভ সময়, সম্পূর্ণ শুদ্ধ হয়ে, পবিত্র বস্ত্র ধারণ করে, সম্পূর্ণ বিধি অনুসারে করতে হয়।
যা বৈষ্ণব পরম্পরা ও শাক্ত পরম্পরাতে দৃশ্যমান।
কিন্তু অন্যদিকে , শৈব পরম্পরাতে এসব কোনো কিছুরই প্রয়োজন পড়ে না। যারা আত্মজ্ঞানী শৈব তারা যেকোনো অবস্থাতেই পরমেশ্বর শিবের পূজা করতে পারে। এবং পরমেশ্বর শিব সন্তুষ্ট হয়ে মোক্ষ ও প্রদান করে—
ন কালনিয়মো যত্র ন দেশস্য স্থলস্য চ।
যত্রাস্য রম্যতে চিত্তং তস্য ধ্যানেন কেবলম্।
স্বাত্মত্বেন শিবস্যাসৌ শিবসাযুজ্যমাপ্নুয়াৎ।।৩০
[পদ্ম পুরাণ/পাতাল খণ্ড/শিবগীতা/অধ্যায়- ১]
অর্থঃ— শিবের উপসনায় কাল, দেশ ও স্থাননিয়ম নাই। সাধকের চিত্ত যেখানে প্রসন্ন, সেই স্থানেই সাধক শিবকে আত্মরূপে ধ্যান করে শিব সাযুজ্য প্রাপ্ত হতে পারবে।।৩০।।
👉অর্থাৎ সাধক যদি পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র, নদী, জঙ্গল, মরুভূমি, নিজবাড়ি, মন্দির বা যতই দূর্গম স্থান হোক না কেন, সেই সাধকের নির্দিষ্ট কোনো দিন ক্ষণের দরকার পড়বে না পরমেশ্বর শিবের উপাসনা করার জন্য। সাধকের মন ও শরীর যেখানে স্থির হবে সাধক সেখানেই শিবকে নিজের আত্মস্বরূপে পূজা করতে পারবে।
তন্ত্রে বলা হয়েছে ব্রহ্মের উপাসনার জন্য নির্দিষ্ট কোনো বিধিবিধান নেই। আর শিব হলো পরব্রহ্ম “এক হি রুদ্র ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য “ (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ-৩/২)।
তাই তন্ত্রে বলা হয়েছে—
পরব্রহ্মণি বিজ্ঞাতে সমস্তৈনিয়মৈরলম্।
তালবৃন্তেন কিং কাৰ্যং লধে মলয়মারুতে।।২৮
[কূলার্ণবতন্ত্র- ৯ম উল্লাস— ২৮]
অর্থঃ— পরব্রহ্ম বিজ্ঞাত হলে সমস্ত নিয়ম নিরর্থক হয়ে যায় অর্থাৎ তখন আর কোনো নিয়মের প্রয়োজন হয় না। মলয় বাতাস পাওয়া গেলে তালপাতার পাখার আর কি প্রয়োজন।।২৮
👉অর্থাৎ আত্মজ্ঞানী শৈব ব্যক্তির জন্য এসব ব্যবহারিক বিধি-বিধানের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। কারণ তার দৃষ্টিকোণে তখন সমগ্র জগৎ টাই শিবময়।
👉পরমেশ্বর শিবের উপাসনার মাহাত্ম্য মহাশ্রুতি শৈব আগম শাস্ত্রে খুব ভালো ভাবেই বর্ণিত আছে—
আবযোরর্চনং কার্যং জপহোমাদিকং প্রিয়ে।
যথাশ্রদ্ধং যথাপ্রজ্ঞং যথাকালং যথাস্মৃতি।।৫৯
যথাশক্তি সংপাদ্যং যথাযোগ্যং যথারথি।
যদা কদাঽপি বা ভক্ত্যা যত্র কুত্রাপি বা কৃতা।।৬০।।
যেন কেনাপি বা দেবি পূজা মুক্তি হি নেষ্যতি।
সদা সক্তেন মনসা যত্কৃতং পরমেষ্ঠিনঃ।।৬১।।
যত্প্রিয়ং চ শিবস্যৈব ক্রমেণ ব্যুত্ক্রমেণ বা।
তথাপি শিবভক্ত্যা যে নাত্যন্তবিবশা নরাঃ।।৬২
[মহাশ্রুতি পারমেশ্বরাগম/একাদশ পটল/৫৯-৬২ নং মহামন্ত্র]
✅ অর্থঃ— নিজের ইচ্ছানুযায়ী, বুদ্ধি অনুযায়ী, কালানুরূপ, স্মৃতি অনুযায়ী, শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী, রুচি অনুযায়ী, আমরা দুজনের পূজা যে সাধক যেকোনো সময়ে, যেকোনো স্থানে, যেমন-তেমন ভাবে, যেকোনো বস্তু দিয়ে ভক্তিপূর্বক করে, হে দেবী! সেই পূজাই সেই সাধককে মুক্তিমার্গের দিকে নিয়ে যায়। যে পূজা ভরা মন (ভক্তির দ্বারা) দ্বারা করা হয় তা পরমেশ্বর শিবের অত্যন্ত প্রিয় হয়। তা শাস্ত্রের নিয়মানুসারে হোক বা বিনা শাস্ত্রানুসারেই হোক ।। ৫৯-৬২।।
👉এর থেকেই তো পরিস্কার ভাবে জানা যায় যে, শৈবমার্গই সর্বশ্রেষ্ঠ মার্গ। কারণ, শৈবমার্গে পরমেশ্বর শিবের উপাসনার জন্য আলাদা কোনো কর্মকাণ্ডের উপস্থাপন করতে হয় না, আলাদা করে বিধি নিয়ম, শাস্ত্র নিয়ম ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে না। পরমেশ্বর শিবকে তো ভক্তিতেই পাওয়া যায়।
💠কিন্তু অন্যান্য মতে অনেক সংকীর্ণতা রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে যেমন,
বৈষ্ণবদের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিধি নিষেধ দেখতে পাওয়া যায়। যেমন— মেয়েরা শালিগ্রাম স্পর্শ করতে পারে না, রজস্বলা অবস্থায় শ্রীহরির পূজা করতে পারেনা, শূদ্ররা ও শালিগ্রাম স্পর্শ করতে পারে না এবং ব্রত পালনের সময় সম্পূর্ণ নিখুঁত ভাবে ব্রত সম্পন্ন করতে হয়, কোনো ভুলত্রুটির অবকাশ নেই।
বৈষ্ণব এবং ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য কোনো জাতীর ব্যক্তি যদি শালিগ্রাম স্পর্শ করে তাহলে স্পর্শদোষ হয় এবং সেই ব্যক্তি নরকে গমন করে। অশৌচ হলে পূজা করা যাবেনা আরও অনেক কিছু।
👉কিন্তু অদ্বৈত শৈবদের ক্ষেত্রে এসব কোনো কিছুই প্রযোজ্য হয় না। কারণ শৈবরা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। সমস্ত জাত-পাত, সমস্ত বিধি-বিধান সবকিছুর ঊর্ধ্বে শৈবরা। তার প্রমাণও শাস্ত্রের মধ্যেই রয়েছে—
মহাবেদ বলছে —
তস্য জাতিভেদোऽস্তি ন শুচ্যশুচিকল্পনা।
ন স্পৃষ্টির্নাপি বাঽশুদ্ধিঃ সর্বং শিবময়ং যতঃ।।৫৫।।
ন স্পৃষ্টির্ন রজোদোষো ন স্ত্রীবালাদিকল্পনা।
ন জন্মমরণাশৌচং ন স্থানাদিবিধির্যতঃ।।৫৭।।
[মহাশ্রুতি পারমেশ্বরাগম/প্রথম পটল]
অর্থঃ— এখানে শৈবমার্গে জাতিভেদের কল্পনা করা হয় না, পবিত্রতা আর অপবিত্রতার কল্পনাও সমাপ্ত হয়ে যায়। স্পর্শদোষ আর অশুদ্ধি সবকিছুই সমাপ্ত হয়ে যায়, কারণ এখানে সবকিছুই শিবময় ।।৫৫।।
শৈবমার্গে স্পর্শদোষ, রজোদোষ, স্ত্রী-বালকের কল্পনা, জন্ম আর মরণজনিত অশৌচ তথা স্নানবিধির কোনো মান্যতা থাকে না।।৫৭।।
👉অশৌচ অবস্থায়, হোক তা জন্মাশৌচ বা মরণাশৌচ সে অবস্থাতেও পরমেশ্বর শিবের উপাসনা করা যাবে। কোনো জাতিভেদ নেই যে কোনো জাতির যেকোনো বর্ণের ব্যক্তি পরমেশ্বর শিবের পূজা-অর্চনা করতে পারবে।
এমনকি মেয়েদের ক্ষেত্রে যে বিধি নিষেধ দেখা যায় যে, তারা শালিগ্রাম স্পর্শ করতে পারবে না এবং রজস্বলা অবস্থায় পূজা-অর্চনা করতে পারবে না।
কিন্তু শৈবমার্গে তার কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, মেয়েরা শিবলিঙ্গ স্পর্শ করতে পারবে এবং রজস্বলা অবস্থায় পরমেশ্বর শিবের উপাসনা করতে পারবে, এতে আলাদা করে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
তার একি প্রমাণ পাওয়া যায় শিবমহাপুরাণে —
ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়ৈ বৈশ্যঃ শূদ্রো বা প্রতিলোমজঃ।
পূজয়েৎ সততং লিঙ্গং তত্তন্মন্ত্রেণ সাদরম্।।
কিং বহুক্তেন মুনয়ঃ স্ত্রীণামপি তথান্যতঃ।
অধিকারোহস্তি সর্ব্যোং শিবলিঙ্গার্চনে দ্বিজাঃ।।
[শিবমহাপুরাণ/বিদ্যেশ্বরসংহিতা- অধ্যায়- ২১— ৩৯-৪০]
অর্থঃ— ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র অথবা বিলোম সংকর- যে কেউই হোক না কেন, সে নিজ অধিকারে বৈদিক অথবা তান্ত্রিক মন্ত্র দ্বারা সর্বদা শ্রদ্ধা সহকারে শিবলিঙ্গের পূজা করবে। ব্রাহ্মণগণ! মহর্ষিগণ! অধিক কথায় লাভ কী? শিবলিঙ্গের পূজা করার অধিকার নারী এবং অন্য সকলেরই আছে।।
👉এবং নারীদের সম্মান শৈবমার্গে কতটুকু তা এই প্রমাণ থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়—
‘ন বালকৃদ্ধভেদোঽস্তি নমস্কারাদিপুজনে।
সর্বেঽপি বন্দনীয়া হি বিধবাপুষ্পিণীমুখাঃ।।৬১।।
[মহাশ্রুতি পারমেশ্বরাগম/প্রথম পটল]
অর্থঃ— নমস্কার করতে, পূজা করতে এখানে বালক অথবা বৃদ্ধের ভেদ করা হয় না। বিধবা, রজস্বলা ইত্যাদি সবাই শৈবমার্গ অনুসারে বন্দনীয় ।।৬১।।
👉বর্তমান সমাজে বলা হয় যে, নারীদের রজস্বলা হলে পূজা-অর্চনা করতে পারে না, উপাসনা আদি কিছুতেই অধিকারী হয় না। কিন্তু শৈবমার্গ অনুসারে বলা হচ্ছে রজস্বলা অবস্থাতেও নারীরা সদা বন্দনীয় অর্থাৎ পূজনীয়। কারণ নারীর সাক্ষাৎ মাতা পার্বতীর স্বরূপ —
স্ত্রীরূপমখিলং দেবি তব রূপং ন সংশয়ঃ।।৫৩।।
[মহাশ্রুতি পারমেশ্বরাগম/দ্বিতীয় পটল]
অর্থঃ— সকল নারী মাতা পার্বতীর স্বরূপ।।৫৩
👉বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার কুসংস্কার — এর খণ্ডনে শাস্ত্রে বলছে যে—
ন পুষ্পিণী ত্যজেৎ পুজাং ন ভুক্ত্বা নাশুচিস্ত্বপি।
যদৈব পুজয়েল্লিঙ্গং তদাঽনুগ্রাহকো হ্যয়ম্।।১০০।।
[মহাশ্রুতি পারমেশ্বরাগম/প্রথম পটল]
অর্থঃ— নারীগণেরা রজস্বলা হোক না কেন, তার শিবলিঙ্গ পূজা কখনো ত্যাগ করা উচিত নয়। এইভাবে ভোজনের পর বা অশুদ্ধি অবস্থাতে ও ইষ্টলিঙ্গ পূজা ত্যাগ করা উচিত নয়। ভক্ত যেকোনো অবস্থাতে যখনই শিবলিঙ্গের পূজা করে, আমি তার উপর অনুগ্রহ করি।।১০০।।
👉এর থেকে তো এটা পরিস্কার যে, নারীগণ রজস্বলা(ঋতু)কালীন সময়েও পরমেশ্বর শিবের উপাসনা করতে পারবে। আর সেই আদেশ সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিবেরই। তিনিই মহাশ্রুতি মহাবেদ -এ অনুমোদন করেছেন ।
👉অন্যান্য ক্ষেত্রে দেখা যায় যেমন, মাতা কালীকা বা দূর্গার প্রতিমাতে এবং শালিগ্রামে স্ত্রী এবং শূদ্রের স্পর্শতে স্পর্শদোষ হয় কিন্তু পরমেশ্বর শিবের প্রতিমা বা শিবলিঙ্গে কোনো প্রকারের স্পর্শ দোষ নেই তা শাস্ত্রই প্রমাণ করে—
মহাপীঠহনাদিতিলিঙ্গে সর্ব্বদোষ বিবর্জ্জিত।
সর্ব্বদা পূজয়েত্তত্র স্বং স্বমিষ্টং সুতাপ্তয়ে।।১০২।।
[মহানির্বাণতন্ত্র, ১৪ উল্লাস]
✅ অর্থ — মহাপীঠ এবং অনাদিলিঙ্গ সর্বদোষ বিবর্জ্জিত, সুতরাং সুখ প্রাপ্তির নিমিত্তে তাহাতে অর্চ্চনা করিবে।।১০২।।
মহাপীঠে তবার্চ্চায়ামস্পৃশ্যস্পর্শদূশনম্।
বিদ্যতে সুব্রতে নৈতল্লিঙ্গরূপধরে হরে।। ২০।।
[মহানির্বাণতন্ত্র, ১৪ উল্লাস]
✅ অর্থ — হে সুব্রত! মহাপীঠস্থানে ও তোমার প্রতিমাতেও অস্পৃশ্যস্পর্শ দোষ হয়,কিন্তু লিঙ্গরূপী মহেশ্বরের তাহা হয় না।।২০।।
শিবক্ষেত্রে মহাতীর্থে তথা জানাহী কালিকে।।২১।।
[মহানির্বাণতন্ত্র, ১৪ উল্লাস]
✅ অর্থ — মহাতীর্থস্বরূপ শিবক্ষেত্রে স্পর্শদোষ নাই জানিবে।।২১।।
👉তাই পরমেশ্বর শিব বলেছেন যে, শৈবমার্গের শৈবধর্মই সর্বশ্রেষ্ঠ। কারণ এর থেকে উত্তম পদ্ধতি আর কোনো মতে দেখা যায় না। এখানে সকলের স্বাধীনতা আছে, এখানে কাউকে বর্ণাশ্রমের গোঁড়ামীতে আটকে রাখা হয় না । একারণেই পরমেশ্বর শিবের প্রকাশিত সনাতন ধর্ম অর্থাৎ শৈবধর্ম সত্য ও সুন্দর তথা শাশ্বত ।
যদি আজকে সকল সনাতনীরা শৈব আদর্শ মান্য করে চলতে শুরু করে তবে কোনো অসনাতনীদের ক্ষমতা হবে না আমাদের সনাতন ধর্মের উপর প্রশ্ন তোলবার। কারণ, একমাত্র শৈবমার্গেই সকল প্রশ্নের উত্তর রয়েছে।
এবার এখানে আমার কিছু প্রশ্ন বৈষ্ণবদের উদ্দেশ্যে যে—
বিষ্ণু পরমেশ্বর হলে তার উপাসনার ক্ষেত্রে বিধি নিয়ম কেন মানতে হবে❓
বিষ্ণু পরমেশ্বর হলে শালিগ্রামের উপর স্পর্শ দোষ আসবে কেন❓
কেন মেয়েরা ও শূদ্রেরা শালিগ্রাম স্পর্শ করার অধিকারী হবে না❓
রজস্বলা অবস্থাতেও কেন মেয়েরা শ্রীহরির উপাসনা করতে পারবে না❓
👉এবার এখানে বৈষ্ণবেরা ভগবদ্গীতার ১৬ অধ্যায়ের ২৩ এবং ২৪ নং শ্লোক টেনে এনে যদি এটা দাবী করে যে শাস্ত্রের বিধি মানা ছাড়া পরাগতি প্রাপ্ত হওয়া যায় না, এবং কি করনীয়-অকরনীয় তা শাস্ত্রই নির্দেশ দেয়। তাহলে তাদের বলতে চাই যে, ভগবদ্গীতার ৪র্থ অধ্যায়ের ১১ নং শ্লোকে এটাও বলা আছে যে, যে ভক্তরা যেভাবে ঈশ্বরের উপাসনা করে ঈশ্বর তাদের সেরূপ ফল প্রদান করে।
তাহলে এক্ষেত্রে কি বলবেন❓
আসল কথা হল, শৈবরাই একমাত্র আত্মজ্ঞানের দ্বারা সকল বিধিনিষেধ কে এড়িয়ে যেতে সক্ষম, কিন্তু বৈষ্ণবেরা আত্মজ্ঞানী হতে সক্ষম নন। তাই তাদের জন্য সংকীর্ণ বর্ণাশ্রমের নিয়মই প্রযোজ্য।
শৈবদের জন্য শাস্ত্রের বিধি নিষেধ ঠিক ততটুকুই মান্য যতটুকু প্রয়োজন, কিন্তু যে বিধি নিষেধ জীবের শিব জ্ঞান লাভের পথে বাঁধা প্রদান করে সে স্থানে আত্মজ্ঞানের সহায়তায় সেই শিবজ্ঞানের দৃষ্টিতে সংকীর্ণ বিধিনিষেধ অমান্য করে চলে শৈব রা ।
তাই জ্ঞানীভক্তদের দৃষ্টিতে পরমেশ্বর শিবের পূজার বিধি শিবগীতায় আরও সুন্দর ভাবে বর্ণনা করে দিয়েছে—
ঋদ্ধং কিঞ্চিৎ সমাদায় ক্ষুল্লকং জলমেব বা।
যো দত্তে নিয়মেনাসৌ তস্মৈ দত্তে জগত্রয়ম্।। ২৩।।
তত্রাপ্যশক্তো নিয়মান্নমস্কারং প্রদক্ষিণাম্।
যঃ করোতি মহেশস্য তস্মৈ তুষ্টো ভবেচ্ছিঃ।।২৪।।
প্রদক্ষিণাস্বশক্তোহপি যঃ স্বান্তে চিন্তয়েচ্ছিবম্।
গচ্ছন্ সমুপবিষ্টো বা তস্যাভীষ্টং প্রযচ্ছতি।। ২৫।।
[পদ্মপুরাণ/পাতালখণ্ড/শিবগীতা- অধ্যায়- ১]
অর্থঃ— তাঁহাকে নিয়মপূর্বক নানাবিধ উপচারপূর্ণ জল অথবা কেবলমাত্র জল সমর্পণ করিলেও তিনি তৎপ্রদানকারীকে জগত্রয় দান করিয়া থাকেন।। ২৩।।
👉(যার ইচ্ছা আছে যে পরমেশ্বর শিবকে সকল উপাচার দিয়ে পূজা করার, তাহলে সে ব্যক্তি তাই করুক। যদি সেই সামর্থ্য না থাকে তাহলে কেবল মাত্র এক ঘটি জল দ্বারা পরমেশ্বর শিবের পূজা করলে, পরমেশ্বর শিব সেই ব্যক্তিকে প্রসন্ন হয়ে ত্রিলোক দান করেন)।।
উপচারাদি দান করিতে অশক্ত হইয়া যদি নিয়ম অনুসারে তাঁহাকে প্রদক্ষিণপূর্বক নমস্কার করে, তাহাতেও তিনি সন্তুষ্ট হয়েন।। ২৪।।
👉(যদি উপাচার দ্বারা পূজা করতে সামর্থ্যহীন হয় তাহলে পরমেশ্বর শিবকে বা শিবলিঙ্গের প্রদক্ষিণ করলেও পরমেশ্বর শিবেরপূজা সম্পন্ন হয়)।।
যিনি প্রদক্ষিণ করিতে অশক্ত, তিনি গমন-উপবেশনাদি ক্রিয়াকালেই মনে মনে শিবকে চিন্তা করিবেন। এই প্রকার চিন্তক ব্যক্তিকে তিনি সর্ব অভীষ্ট প্রদান করেন।। ২৫।।
👉(আর যদি প্রদক্ষিণ করার সামর্থ্যও না থাকে তাহলে কেবল পরমেশ্বর শিবকে মনে মনে চিন্তা দ্বারা নমস্কার করলেও শিবের পূজা সম্পন্ন হয় এবং পরমেশ্বর শিব তাতে সন্তুষ্ট হয়ে সকল অভীষ্ট বস্তু দান করেন)।।
👉শৈব পরম্পরা যেখানে কোনো জাতিভেদ নেই, যেখানে সবার সমান অধিকার। আর তার প্রয়াণ দিচ্ছে স্বয়ং মহাশ্রুতি শৈব আগম শাস্ত্র।
যেখানে মেয়েরা নিজের স্বতন্ত্রতা অনুযায়ী যেকোনো ভাবে রজস্বলা চলাকালীন ও পরমেশ্বর শিবের উপাসনা করতে পারে, যেখানে মেয়েদের মাতা পার্বতীর স্বরূপ বলা হয়, তাদের সর্বোচ্চ সম্মান প্রদান করা হয়।
নেই কোনো বিধি বিধানের ভয়, নেই কোনো পাপ-পূণ্যের ভয়, নেই কোনো স্বর্গ নরকের ভয়, কারণ শৈবমার্গে সবই শিবময়।
জন্ম-মরণ অশৌচেও পরমেশ্বর শিবের উপাসনাতে কোনো বাধা নেই। কোনো জোড় নেই যে শাস্ত্রানুসারেই পূজা-অর্চনা করতে হবে। এখানে ভক্তের ভক্তিই সর্বোপরি।
যে ভক্ত যেভাবেই, যেকোনো অবস্থাতেই পরমেশ্বর শিবের উপাসনা করতে পারে। পরমেশ্বর শিবও তো আশুতোষ অল্পতেই সন্তুষ্ট হয়ে ত্রিলোকের অধিপতিত্ত্ব দান করেন। উপাচার দিয়ে না পারলে কেবল জল দিয়ে, তা ও না পারলে কেবল প্রদক্ষিণ করে, তাও না পারলে মনে মনে স্মরণ করে নমস্কার করলেও পরমপ্রভু পরমেশ্বর শিবের উপাসনা সম্পন্ন হয়। তাই তো সবাই বলে শিব একটা বেলপাতাতে তুষ্ট।
তাই সর্বক্ষেত্রে এটাই প্রমাণ হয় যে — শৈবপন্থাই সর্বশ্রেষ্ঠ মার্গ । শিব উপাসনা ই সর্বোত্তম সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বোপরি।
ॐ সাম্বসদাশিবায় নমঃ 🙏🕉️
ॐ দক্ষিণামূর্তয়ে নমঃ 🕉️🙏
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে ✊🚩
হর হর মহাদেব ✊🚩
✍️লেখনীতেঃ— অন্তিক ভট্টাচার্য্য (শম্বরনাথ শৈব) Antik Bhattacharya
🙏বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ—আমার গুরু শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী ও Rohit Kr Choudhury শৈবজী।।
কপিরাইট ও প্রচারেঃ— © International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT 🔥 আন্তর্জাতিক শিবশক্তি জ্ঞান তীর্থ (ISSGT)
বিঃদ্রঃ— লেখাটি কপি করলে সম্পূর্ণ রূপে কপি করবেন কোনো রকম কাটাছেঁড়া করা যাবে না।।
(This post is only for public Awareness)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন