ভগবদ্গীতায় ‘পত্র, পুষ্প, জল, ফল’— মূলত কার উদ্দেশ্যে অর্পন করার নির্দেশ রয়েছে ? জেনে নিন
নমঃ শিবায়
বর্তমান সময়ে যোগ সম্পর্কে প্রায় সকল সনাতনী রা বিন্দুমাত্র অবগত নন, ফলে “ভগবদ্গীতা”-র নামে ভণ্ড বৈষ্ণবেরা চালিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব ব্যক্তিগত মতামত, যার দরুন সমগ্র সনাতন ধর্মের মূল রূপের চেহারা বদলে গিয়ে নকল তথ্যের উপর মানুষের বিশ্বাস জন্মে যাচ্ছে। এতে ক্ষতি হচ্ছে সকল সনাতনীর। কারণ, সনাতন ধর্মের সমস্ত শাস্ত্রের অন্তিম সিদ্ধান্ত হল — প্রভু শিব ই অদ্বিতীয় পরমেশ্বর পরমসত্ত্বা।
কিন্তু কলিযুগের প্রভাবে সকলেই এই সত্য থেকে বঞ্চিত, তারা প্রভু শিবকে ছেড়ে অন্য দেবতা বা শ্রীকৃষ্ণ কেই সর্বোচ্চ পরমসত্ত্বা হিসেবে ভেবে নিতে শুরু করেছে যা সনাতন ধর্মের মূল সিদ্ধান্তের বিপরীত ।
ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ ‘আমি’ বলতে তার দেহের মধ্যে থাকা অন্তরস্থ ‘আত্মা’ কে সম্বোধন করে বুঝিয়েছেন।
সেই আত্মা সকল জীব দেহের মধ্যে স্থিত। এই আত্মা রূপে পরমেশ্বর শিবই স্থিত। একথা স্বয়ং বেদই বলেছে।
তাই শ্রীকৃষ্ণ যেহেতু যোগযুক্ত অবস্থায় নিজের চেতনাকে শিবত্বে উন্নীত করে অর্জুন কে উপদেশ দিয়ে ছিলেন। তাই শ্রীকৃষ্ণের উক্ত অবস্থায় যা কিছু বানী নির্গত হয়েছিল তা পরমেশ্বর শিবেরই বাচক বলে গণ্য করতে হয়। আর এই কারণেই ভগবদ্গীতার বহু শ্লোক স্বয়ং পরমেশ্বর শিবের শ্রীমুখে বলা - শিবগীতা, ঈশ্বরগীতা ও বেদের অথর্বশির উপনিষদের সাথে হুবহু মিলে যায়।
বৈষ্ণবেরা ‘যোগ’ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ হবার কারণে, শিবগীতা, ঈশ্বরগীতাতে এই একই শ্লোক প্রভু শিবের মুখ থেকে নির্গত হতে দেখে সেটিকে এড়িয়ে যাবার জন্য অজুহাত দেখিয়ে বলতে থাকে যে, “এইসব শিবগীতা ঈশ্বরগীতা শৈবরা নিজেরা লিখে তৈরি করেছে, এগুলি নকল।”
এছাড়া অন্য কোনো যুক্তি উপস্থাপন করতে সক্ষম নয় বৈষ্ণবেরা । যদিও আমরা শৈব সনাতনী রা আমাদের শৈব পক্ষ থেকে শিবগীতা ও ঈশ্বরগীতার প্রামাণিকতা প্রমাণ করেছি বৈষ্ণবদেরই নারদপুরাণ ও কূর্মপুরাণ থেকে, এছাড়া প্রাচীন শৈব আচার্যগণ ও স্মার্তাচার্য আদি শঙ্করও এগুলির উল্লেখ করে গিয়েছেন ।
সুতরাং বৈষ্ণবদের এসব অযৌক্তিক দাবি কখনোই গ্রহণযোগ্য হয় না।
এবার আপনাদের আমি দেখাবো ভগবদ্গীতায় বলা একটি শ্লোক, যা প্রভু শিব বিভিন্ন পুরাণে অনেক আগেই বর্ণনা করে রেখেছিলেন । এমনকি বেদেও তার উল্লেখ রয়েছে ।
ভগবান শ্রীবিষ্ণুর অবতার দেবকীনন্দন শ্রীকৃষ্ণ মহাভারতের মধ্যে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রে চলা যুদ্ধে অর্জুকে তার কর্তব্য স্মরণ করাতে গিয়েই ধর্মের নীতি আদর্শ জানিয়েছেন, যা সনাতন ধর্মের সমস্ত শাস্ত্রের মধ্যে বলা বিভিন্ন নীতি আদর্শের সংকলন করা সার কথা, যতটুকু অর্জুনের প্রয়োজন ছিল, ততটুকুই তিনি বলেছেন।
ঈশ্বরের শরণাপন্ন কিভাবে হতে হয় তার বিভিন্ন মার্গ দেখিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ। এই সময়ে তিনি - ‘ভক্তি সহকারে যা দেওয়া হয় ঈশ্বরকে, তা ই ঈশ্বর গ্রহণ করেন, তাকে পত্র পুষ্প ফল জল দিলেও তিনি তুষ্ট হয়ে কৃপা করেন’ — এই কথা বলেছিলেন।
দেখুন 👇
✅ ভগবদ্গীতা —
পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রযচ্ছতি ৷
তদহং ভক্ত্যুপহৃতমশ্নামি প্রযতাত্মনঃ ॥ ২৬
[তথ্যসূত্র - মহাভারত/ভীষ্মপর্ব/ভগবদ্গীতা/অধ্যায় ৯/শ্লোক ২৬]
🔶 অর্থ — যে বিশুদ্ধ চিত্ত নিষ্কাম ভক্ত আমাকে ভক্তিপূর্বক পত্র, পুষ্প, ফল ও জল অর্পণ করেন, আমি তার সেই ভক্তিসম্পন্ন উপহার প্রসন্ন হয়ে গ্রহণ করি।
☢️ বিশ্লেষণ — শ্রীকৃষ্ণ এখানে যা কিছু বলেছেন , সেই যুগটি দ্বাপর যুগ ছিল । কিন্তু শিবমহাপুরাণের বায়বীয়সংহিতার উত্তরখণ্ডে দেখা যায় মহর্ষি উপমন্যু জী তার শিষ্য শ্রীকৃষ্ণকে শিব মাহাত্ম্য বর্ণনা করে শ্রবণ করাতে গিয়ে বলেছেন যে, পূর্বকালে পরমেশ্বর শিব এই কথা মাতা পার্বতীকে বলেছিলেন।
প্রমাণ দেখুন 👇
_______________________________________________
✅ শিবমহাপুরাণ —
পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রয়চ্ছতি ।
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি সচ মেন প্রণশ্যতি ॥৭২
[তথ্যসূত্র - শিবমহাপুরাণ/বায়বীয়সংহিতা/উত্তরখণ্ড/অধ্যায় ১০/শ্লোক ৭২]
🔶 অর্থ — পরমেশ্বর শিব বললেন, যে ব্যক্তি ভক্তিভাবে আমাকে পত্র, পুষ্প, ফল অথবা জল সমর্পণ করে, তার কাছে আমি অদৃশ্য হই না এবং সে-ও কখনও আমার দৃষ্টির অন্তরালে থাকে না।
☢️ বিশ্লেষণ — পরমেশ্বর শিব শ্রীকৃষ্ণের বহু পূর্বেই পত্র পুষ্প ফল জল দিয়ে শিবকে পূজা করবার কথা বলে রেখেছিলেন। মহাভারতের অনুশাসন পর্বের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে -
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হবার পর শ্রীকৃষ্ণ সহ সকলে শরসজ্জায় শায়িত ভীষ্মের কাছে উপস্থিত হন। তখন সেখানে শ্রীকৃষ্ণ অন্যদের কাছে কৃষ্ণের দ্বারা শিব সাধনা করবার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে, পূর্ব কালে শ্রীকৃষ্ণ পুত্রলাভের আশায় শিবের তপস্যা করবার জন্য পরমশৈব শিরোমণি মহর্ষি উপমন্যু জীর আশ্রমে গিয়েছিলেন, সেখানে তিনি মহর্ষি উপমন্যু জীর শিব আরাধনা ও শিব কৃপা লাভের ঘটনা শোনেন, শিব মাহাত্ম্য শ্রবণ করতে করতে আট দিন আট রাত কাটিয়ে দেন। তারপর মহর্ষি উপমন্যু জীর কাছে শ্রীকৃষ্ণ শিবমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে পাশুপত শৈব পরম্পরাভুক্ত হয়ে প্রভু শিবের তপস্যা করে পরমেশ্বর শিব কে লাভ করেন। সুতরাং এখান থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময়েরও বহু আগে মহর্ষি উপমন্যু জীর কাছে শিব জ্ঞান লাভ করে শৈব হয়ে শিবসাধনা করে শিবদর্শন করে ব্রহ্মজ্ঞ হয়েছিলেন। সুতরাং, শ্রীকৃষ্ণের মুখে ভগবত গীতা প্রকাশিত হবার বহু পূর্বেই শ্রীকৃষ্ণ মহর্ষি উপমন্যু জীর কাছেই স্বয়ং পরমেশ্বর শিবের বলা ঐ “পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রয়চ্ছতি” — বচন শ্রবণ করেছিলেন।
প্রত্যেক জীব যখন সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করে তখন তার ব্রহ্মদর্শন হয়, এই ব্রহ্মদর্শনের ফলে তার জীবাত্মা র সাথে পরমাত্মা অভিন্নতা অবস্থা প্রাপ্ত হয় — একেই “অদ্বৈত” বলে ।
পরমেশ্বর শিব কে নিজের দেহের মধ্যে থাকা ‘আত্মা’ বলে জানতে পারার বিষয়ে শ্রীকৃষ্ণ নিজে শিব স্তুতি করতে গিয়ে বলেছেন,
হৃদয়ং সৰ্বভূতানাং ক্ষেত্রজ্ঞস্ত্বমৃষিস্তুতঃ।
সর্বতঃ পাণিপাদস্ত্বং সর্ব্বতোঽক্ষিশিরোমুখঃ ॥৪১৫
সর্বতঃ শ্রুতিমাল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠসি।
ফলং ত্বমসি তির্গ্মাশোনিমেষাদিষু কৰ্ম্মসু ॥ ৪১৬
যস্ত্বাং ধ্রুবং বেদয়তে গুহাশয়ং প্রভুং পুরাণং পুরুষঞ্চ বিগ্রহম্ ।
হিরণ্ময়ং বুদ্ধিমতাং পরাং গতিং স বুদ্ধিমান্ বুদ্ধিমতীত্য তিষ্ঠতি ॥ ৪১৯
(তথ্যসূত্র -মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩)
অর্থাৎ, হে মহাদেব ! যে ব্যক্তি আপনাকে(শিবকে) (ঐ ব্যক্তির) হৃদয়ে মধ্যে স্থিত জীবাত্মা, প্রভু, পুরাণপুরুষ, মূৰ্ত্তিমান হিরণ্যরূপ পরব্রহ্ম(সদাশিব) ও জ্ঞানিগণের পরম গতি বলে নিশ্চিতভাবে জানেন ; সেই জ্ঞানীব্যক্তি লৌকিক বুদ্ধি(সাধারণ পর্যায়ের ভাবনাকে) অতিক্রম করে পরমগতি লাভ করে থাকেন ॥ ৪১৯
শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন, জীব তার হৃদয়ে স্থিত আত্মাকে হিরণ্যবর্ণরূপ সদাশিব বলে জেনে পরমগতি লাভ করতে পারেন, যা বেদেই বলা আছে, আর যারা এটি জানতে পারেন না তারা সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন। কিন্তু যারা এই পরমজ্ঞান উপলব্ধি করেন তারা সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে যান, তারাই পরমগতি লাভ করেন, সাধরণেরা নয় ।
অদ্বৈত উপলব্ধি করলে সাধকের "আত্মা" ও "পরমাত্মা"য়(ব্রহ্মে) কোনো ভেদ থাকে না, বেদের মুণ্ডক উপনিষদের ৩/২/৯ মন্ত্রে বলা হয়েছে “ব্রহ্মবেদ ব্রহ্মৈব ভবতি” অর্থাৎ যিনি ব্রহ্মকে দর্শন করে জেনে(উপলব্ধি করে) ফেলেন তিনিও(এক পরমাত্মা শিবের সাথে একীভূত হবার কারণে) ব্রহ্ম বলে অভিহিত হন — একেই বলে জীব “ব্রহ্মত্ব” লাভ করেছেন ।
একারণেই শাস্ত্রের কোনো কোনো স্থানে শ্রীকৃষ্ণকে ‘ব্রহ্ম’ বলে উল্লেখ করা থাকলেও, অথবা শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে ‘আমি ব্রহ্ম’ বলে দাবি করলেও, তা মূলত বেদের “ব্রহ্মবেদ ব্রহ্মৈব ভবতি” শ্রুতির দ্বারা বিবেচ্য অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর শিবের সাধনা করে শিবদর্শন অর্থাৎ ব্রহ্মদর্শন করেছেন। একারণে শ্রীকৃষ্ণের অস্তিত্ব তার আত্মা শিবই পরমব্রহ্ম, দেহরূপী শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্ম নন।
বেদ অনুসারে যিনি ব্রহ্মকে দর্শন করেন তিনিও "পরমার্থিক দৃষ্টিকোণে" ব্রহ্ম বলেই অভিহিত হন।
এখানে কোথাও অদ্বৈত ভাবের হানি হচ্ছে না বরং একমাত্র পরব্রহ্ম শিবই সকলের মূল, এটিই সিদ্ধ হয় । এই কারণে শ্রীকৃষ্ণ যা কিছু ভগবদ্গীতাতে বলেছেন তা মূলত শ্রীকৃষ্ণ “শিবচেতনা” -র স্তরে উঠে ‘শিবভাব’ - এ ভাবিত হয়ে বলেছেন। একারণেই শিবমহাপুরাণে প্রভু শিবের বলে দেওয়া বানীকেই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে হুবহু একই শ্লোক উচ্চারণ করে বলেছেন, যা ভগবদ্গীতা রূপে পরিচিতি পেয়েছে সমাজে।
আরো প্রমাণ দেখুন 👇
_______________________________________________
✅ কূর্মপুরাণ -এর অন্তর্গত ঈশ্বরগীতা —
পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং মদারাধনকারণাৎ ।
যো মে দদাতি নিয়তং সমে ভক্তঃ প্রিয়ো মম ॥ ১৪
[তথ্যসূত্র - কূর্মপুরাণ/উত্তরভাগ/ঈশ্বরগীতা/অধ্যায় ৪]
🔶 অর্থ — পরমেশ্বর শিব বললেন, যে ব্যক্তি আমার আরাধনার নিমিত্ত পত্র, পুষ্প, ফল ও জল আহরণ করে আমাকে অর্পণ করে, সেই ব্যক্তিই আমার প্রিয়ভক্ত।
☢️ বিশ্লেষণ — ঈশ্বরগীতার এই শ্লোকটি থেকে আরো একটি বড় প্রমাণ পাওয়া যায় যে, পরমেশ্বর শিব শ্রীকৃষ্ণের বহু পূর্বেই পত্র পুষ্প ফল জল দিয়ে শিবকে পূজা করবার কথা বলে রেখেছিলেন । কূর্মপুরাণের উত্তরভাগ অংশের ১ম অধ্যায় থেকে শুরু করে ১১তম অধ্যায় পর্যন্ত ঈশ্বরগীতা বর্ণিত হয়েছে। এই ঈশ্বরগীতার প্রথম অধ্যায়ে পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, প্রকৃতপক্ষে পরমতত্ত্ব কে ? — ঋষিগণেদের মনে এই প্রশ্ন জেগেছিল, ঠিক তখনই সেখানে নর ও নারায়ণ ঋষি উপস্থিত হন, যারা ছিলেন শ্রীবিষ্ণুর অবতার। সমস্ত ঋষিগণ সেই নারায়ণ ঋষির কাছে “পরমতত্ত্ব কে ?” এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন। তখন নারায়ণ ঋষি নিজের তপস্বীরূপ ত্যাগ করে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী বিষ্ণুরূপে প্রকট হলেন , তিনি বললেন যিনি স্বয়ং পরমতত্ত্ব তার মুখেই আপনারা এই বিষয়ে জানতে পারবেন, সেই সময় পরমেশ্বর মহাদেব সেখানে উপস্থিত হলেন ও সকলকে নিজের সেই শিব মাহাত্ম্য বর্ণনা করে শোনালেন, যা ঈশ্বরগীতা নামে পরিচিত। পরমেশ্বর মহাদেব নৃত্য করে সমগ্র জগতকে তার শরীরের মধ্যেই দেখালেন, বিশ্বের সকল রূপ ই তার। এভাবে পরমেশ্বর শিব সকল কিছু বর্ণনা করলেন, আর সেই বর্ণনা করতে করতে শিব কিভাবে প্রসন্ন হবেন তার উপায় বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং মদারাধনকারণাৎ — অর্থাৎ পত্র,পুষ্প,ফল, জল দিয়ে পূজা করলে শিব প্রসন্ন হন ।
এভাবে বর্ণনা করবার পর বর্ণনার অন্তিমে সময় বললেন যে, এই বিষ্ণু হল তার অপরমতনু অর্থাৎ মায়ার দ্বারা তৈরি দেহ, যা শিবের থেকে ভিন্ন নয়। এভাবে বর্ণনা করতে করতে ব্যাসদেব বললেন, শিবের এই ঈশ্বরগীতার জ্ঞান পরবর্তীতে ঐ শ্রীনারায়ণ শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ময়দানে শ্রবণ করিয়েছিলেন। এবার দেখুন মহাভারতের দ্রোণ পর্বে ব্যাসদেবই বলেছেন, অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণ পূর্বজন্মে নর ও নারায়ণ ঋষি ছিলেন। ওই জন্মে তারা দুজন কেদারনাথে কেদারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গের স্থানে বসে শিবলিঙ্গ পূজা পূর্বক শিব আরাধনা করতেন । এখান থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে, প্রভু শিব ঐ পত্র পুষ্প ফল জল দিয়ে পূজা করবার কথা ভগবদ্গীতাতে উল্লেখ করা শ্রীকৃষ্ণেরও জন্মের বহুপূর্বে বলেছিলেন। ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ একজন মহাযোগী হিসেবে স্থিত হয়েই শিবজ্ঞান প্রদান করছিলেন। যা সাধারণ মানুষেরা সহজে বুঝতে সক্ষম হননা ।
আরো প্রমাণ দেখুন 👇
_______________________________________________
✅ পদ্মপুরাণের পাতালখণ্ডের অন্তর্গত শিবগীতা
পুষ্পং ফলং সমূলং বা পত্রং সলিলমেব বা ।
যো দদ্যাৎ প্রণবে মহ্যং তৎকোটিগুণিতং ভবেৎ ॥২৮
[তথ্যসূত্র — পদ্মপুরাণ/পাতালখণ্ড/শিবগীতা/অধ্যায় ৫]
🔶 অর্থ — পরমেশ্বর শিব বললেন, ॐ মন্ত্র উচ্চারণ করে ভক্তিপূর্বক ফুল, ফল, মূল, পত্র এবং জল যাই আমাকে দান করা হয় বা অর্পণ করা হয়, তা মন্ত্রবিহীন দেওয়ার চেয়ে কোটিগুণ বেশী ফলদায়ক হয়ে থাকে।
☢️ বিশ্লেষণ — পদ্মপুরাণের পাতালখণ্ডের অন্তর্গত শিবগীতার এই শ্লোকটি থেকে আবারো আরো একটি বড় প্রমাণ পাওয়া যায় যে, পরমেশ্বর শিব শ্রীকৃষ্ণের বহু পূর্বেই ত্রেতা যুগেও শ্রীরামচন্দ্র কে ‘পত্র পুষ্প ফল জল’ দিয়ে শিবকে পূজা করবার কথা বলে রেখেছিলেন ।
আরো একটি প্রমাণ দেখুন 👇
_______________________________________________
✅ শিবধর্মপুরাণ —
পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রয়চ্ছতি ।
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি ॥ ৩১
[তথ্যসূত্র - শিবধর্ম পুরাণ/অধ্যায় ১]
🔶 অর্থ — পরমেশ্বর শিব বললেন, যিনি ভক্তিপূর্বক পত্র, ফুল, ফল এবং জল আমাকে অর্পণ করে , আমি তাকে কখনো ত্যাগ করি না সেই ভক্তিমান ব্যক্তিও কখনো আমাকে ত্যাগ করতে পারে না অর্থাৎ বিনষ্ট হয় না ।
☢️ বিশ্লেষণ — শিবধর্ম পুরাণে স্বয়ং পরমেশ্বর শিব বলেছেন যে, শিবকে ভক্তিযুক্ত হয়ে ‘পত্র পুষ্প ফল জল’ দিয়ে পূজা করলে তিনি শিব তাকে গতি প্রদান করেন ।
ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণের বলা উক্ত শ্লোকের সহিত পুরাণ শাস্ত্রের শিববচন হুবহু মিলে গিয়েছে। কি কারণে তা মিলেছে সেটি পূর্বেই বিশ্লেষণ করে দিয়েছি ।
_______________________________________________
এবার অন্তিম প্রমাণ দেখবো বেদ অর্থাৎ শ্রুতি শাস্ত্র কি বলছে, সেটি দেখুন 👇
বৃষভারূঢ়ং হিরণ্যবাহুং হিরণ্যবর্ণং হিরণ্যরূপং পশুপাশবিমোচকং পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলং ঊর্ধ্বরেতং বিরূপাক্ষং বিশ্বরূপং সহস্রাক্ষং সহস্রশীর্ষং সহস্রচরণং বিশ্বতোবাহুং বিশ্বাত্মানং একং অদ্বৈতং নিষ্কলং নিষ্ক্রিয়ং শান্তং শিবং অক্ষরং অব্যয়ং হরি-হর-হিরণ্যগর্ভ-স্রষ্টারং অপ্রমেয়ং অনাদ্যন্তং রুদ্রসূক্তৈরভিষিচ্য সিতেন ভস্মনা শ্রীফল দলৈশ্চ ত্রিশাখৈরার্দ্রৈর-নার্দ্রৈর্বা ॥
[তথ্যসূত্র : বৈদিক ভস্মজাবাল উপনিষদ/২/৭]
অর্থ — যিনি বৃষভ নন্দীকে বাহন বানিয়ে তার উপর আরূঢ় হন, যার বাহু হিরণ্য অর্থাৎ স্বর্ণালী বর্ণের ন্যায় উজ্জ্বল, দিব্যদেহ স্বর্ণালী বর্ণের ন্যায় উজ্জ্বল, যার রূপ মাধুর্য স্বর্ণালী বর্ণের ন্যায়, যিনি জীবরূপী সকল পশুর পাশরূপী বন্ধন কে মোচন করেন, যিনি স্বয়ং ব্রহ্মপুরুষ, কৃষ্ণপিঙ্গলরূপী অর্ধনারীশ্বর হিসেবে একই দেহে শক্তিদেবী উমা কে ধারণ করেন, যিনি ঊর্ধ্বরেতরূপে দেহের অভ্যন্তরের ঊর্ধ্বে সহস্রারচক্রে সকল শক্তির উৎস স্থিত, যার অসাধারণ বিরূপ ত্রিনেত্র রয়েছে, বিশ্বের সকল রূপ যার, চারিদিকে যার হাজার হাজার নেত্র রয়েছে, হাজার হাজার মস্তক রয়েছে, হাজার হাজার চরণ রয়েছে, যার বিশ্বের সকল দিকে হস্ত রয়েছে, যিনি বিশ্বের সকলের আত্মা, যিনি এক ও অদ্বিতীয় সত্ত্বা, যিনি সমস্ত কলার অতীত হিসেবে নিরাকার সত্ত্বা, যিনি সকল কিছুর স্রষ্টা ও পরিচালনাকারী হয়েও হয়েও নিজে নিষ্ক্রিয়ভাবে স্থিত তথা শান্ত রূপে সমস্তদিকে সমানভাবে শান্ত তথা স্থির, সেই প্রভু হলেন স্বয়ং শিব, এই প্রভুই অক্ষরব্রহ্ম ॐ-কার, এই প্রভুই অব্যয় অর্থাৎ বিনাশহীন, এই প্রভু শিব(সদাশিব)ই ত্রিদেবরূপী হরি(বিষ্ণু), হর(কৈলাসপতি রুদ্র) ও হিরণ্যগর্ভ(ব্রহ্মা)-র সৃজন কর্তা, তিনি অপ্রমেয়রূপে অসীম, তিনি অনাদি, তার অন্ত নেই, রুদ্রসূক্ত (শতরুদ্রিয়) পাঠপূর্বক তার (দুধ তথা জল দ্বারা) স্নান-অভিষেক করা হয়, ভস্ম প্রদান করা হয়, শ্রীফল রূপী বেলগাছের বেলফল ও ত্রিশাখাযুক্ত ভেজা বা শুকনো বেলপাতা প্রভৃতি সহ (ধুতরা প্রভৃতি বন্য)ফুল তাকে অর্পন করা হয় (আমি সেই প্রভু শিবের ধ্যানে মগ্ন) ।
☢️ বিশ্লেষণ — পুরাণশাস্ত্র গুলিতে পরমেশ্বর কে পত্র, পুষ্প, জল ও ফল দিতে বলা হয়েছে । জল দিয়ে যে মহাদেবের অভিষেক(স্নান) করানো হয় সে সম্পর্কে সমগ্র বিশ্ব চরাচর অবগত। এবার দেখুন বেদেও বলা হয়েছে যে,
শিবকে রুদ্রসূক্ত অর্থাৎ ‘শতরুদ্রিয়’ পাঠ করে
‘সিতেন’ অর্থাৎ পবিত্র ‘জল’ দিয়ে অভিষেক করানো হয়।
‘ফল’ অর্থাৎ বিল্ব বৃক্ষের ফল ‘বেল ফল’ প্রদান করা হয়।
‘পত্র’ অর্থাৎ বিল্প বৃক্ষের ‘বেলপাতা’ প্রদান করা হয়।
‘ফুল’ অর্থাৎ সুবর্ণ বর্ণযুক্ত ‘ধুতরা’ ফুল অর্পন করা হয়ে থাকে।
_______________________________________________
পুষ্পের মধ্যে শিব আরাধনার জন্য ধুতুরা ফুলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর নেই, এটিই স্কন্দ পুরাণ বলেছে , দেখুন 👇
নন্দীশ্বর উবাচঃ
নাস্তি শ্রোণাদ্রিতঃ ক্ষেত্রং নাস্তি পঞ্চাক্ষরান্মনুঃ ॥৫৪
নাস্তি মহেশ্বরাদ্ধম্মো নাস্তি দেবো মহেশ্বরা ।
নাস্তি জ্ঞানং শিব - জ্ঞানান্নাস্তি শ্রীরুদ্রতঃ শ্রুতিঃ ॥৫৫
নাস্তি শৈবাগ্ৰণীবিষ্ণোর্নাস্তি রক্ষা বিভূতিতঃ ।
নাস্তি ভক্তেঃ সদাচারো নাস্তি রক্ষাকরাদ্ গুরুঃ ॥৫৬
নাস্তি রুদ্রাক্ষতো ভূষা নাস্তি শাস্ত্রং শিবাগমাৎ ।
নাস্তি বিল্বদলাৎপত্রং নাস্তি পুষ্পং সুবর্ণকাৎ ॥৫৭
নাস্তি বৈরাগ্যতঃ সৌখ্যং নাস্তি মুক্তেঃ পরং পদম্ ॥৫৮ (তথ্যসূত্র — স্কন্দমহাপুরাণ/মাহেশ্বরখণ্ডে/অরুণাচলমাহাত্ম্য/উত্তরার্দ্ধ/অধ্যায় নং ৪)
🌷 অর্থ — নন্দীশ্বর বললেন,
শ্রোণাদ্রি থেকে উত্তম ক্ষেত্র, পঞ্চাক্ষর মন্ত্রের থেকে উত্তম মন্ত্ৰ, মাহেশ্বরধর্ম অর্থাৎ শৈবধর্ম থেকে উত্তম ধর্ম, শিবজ্ঞান থেকে উত্তম জ্ঞান, শ্রীরুদ্র সূক্ত থেকে উত্তম শ্রুতি(বেদমন্ত্র), বিষ্ণুর থেকে শ্রেষ্ঠ শৈব অগ্রণী, বিভূতি(ভস্ম) থেকে উত্তম রক্ষা, ভক্তি থেকে উত্তম সদাচার, রক্ষক থেকে উত্তম গুরু, রুদ্রাক্ষ থেকে উত্তম ভূষা, শৈবাগম থেকে উত্তম শাস্ত্র, বিল্বপত্র থেকে উত্তম পত্র, সুবর্ণক(ধুতুরা) থেকে উত্তম পুষ্প, বৈরাগ্য থেকে উত্তম সৌখ্য এবং মুক্তি থেকে উত্তম পরম পদ আর নেই ৷
_______________________________________________
🟦 সিদ্ধান্ত 🟦
উপরোক্ত পুরাণ ও বেদের শব্দপ্রমাণ থেকে প্রমাণিত হল — শ্রী কৃষ্ণের বলা ভগবদ্গীতার শ্লোক - পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রযচ্ছতি ৷ — শ্লোকটিতে মূলত পরমেশ্বর শিবকে ‘পত্র(বেলপত্র), পুষ্প(ধুতুরা), ফল(বেল) ও জল(অভিষেকের গঙ্গাজল বা শুদ্ধ জল) — দেওয়াকে নির্দেশ করা হয়েছে ।
সুতরাং, ভগবদ্গীতা যে শিবজ্ঞানে পরিপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ভগবান বিষ্ণুর অবতার শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর শিবের শৈবজ্ঞান অত্যন্ত সহজ করে প্রদান করেছেন। কিন্তু ‘যোগ’ সম্পর্কে বর্তমান সনাতনীদের অভ্রান্ত জ্ঞান না থাকার ফলে তাদের জ্ঞানহীনতার সুযোগ নিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী গোঁড়া বৈষ্ণব তথা নকল অদ্বৈতবাদী স্মার্তরা শ্রীকৃষ্ণকেই পরমেশ্বর দাবী করে বসছে ও সাধারণ মানুষের মধ্যে অপপ্রচার করে পরমশিব তত্ত্বকে চাপা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছে। কিন্তু যতদিন আমরা আদি সনাতনী শৈব রা এই পৃথিবীতে স্থিত আছি ততদিন পর্যন্ত সমগ্র সনাতনী শাস্ত্র থেকে প্রমাণ সহ সনাতন ধর্মের প্রকৃত অদ্বিতীয় সিদ্ধান্ত অর্থাৎ পরমেশ্বর শিবের পরমত্বকে অক্ষুন্ন রাখার দায়িত্ব পালন করে যাবো।
কারণ, শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
✍️ সত্য উন্মোচনে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
© কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন