পরমেশ্বর শিব কি বিষ্ণুভক্তির জন্য বিষ্ণুর চরণ থেকে উৎপন্ন গঙ্গাকে মস্তকে ধারণ করেছেন ?
॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥
বর্তমানে কলিযুগে বৈষ্ণবদের শিবনিন্দার কার্যক্রম যেন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। পরমেশ্বর শিব ও শিবভক্ত শৈবদের নিন্দা করা তো বৈষ্ণবদের লক্ষণের মধ্যে অন্যতম অবশ্যম্ভাবী লক্ষণ। তার মধ্যে থেকে বৈষ্ণবদের একটি দাবী হল, শিব তার নিজের মস্তকে শ্রীহরির চরণ থেকে উৎপন্ন গঙ্গাদেবীকে ধারণ করেন। শ্রীহরির চরণধৌত জল শিব মস্তকে ধারণ করেন হরিভক্তির কারণে ।
⚜️ শ্রী নন্দীনাথ শৈবাচার্য জীর দ্বারা বৈষ্ণবদের দাবীর সত্যতা যাচাইকরণ —
পাঠকবৃন্দ !! চলুন বৈষ্ণবদের উপরি উক্ত ঐ দাবীর সত্যতা যাচাই করা যাক ।
আগে জানা যাক, গঙ্গার উৎপত্তির বিষয়ে ।
♦️ গঙ্গার জন্ম কার থেকে উৎপন্ন হয়েছেন ?
উত্তর :
শৈলেন্দ্র হিমবান্ নামধাতূ নামাকরো মহান্ ।
তস্য কন্যা দ্বয়ং রাম রূপেণা প্রতিমংভুবি ॥ ১৩
যামেরুদুহিতারামতয়োর্মাতাসুমধ্যমা ।
নাম্ নামেনামমনোজ্ঞাবৈপত্নীহিমবতঃ প্রিয়া ॥ ১৪
তস্যাং গঙ্গেযমভবজ্জেষ্ঠামি বতঃ সুতা ।
উমানামদ্বিতীয়াভূৎকন্যাতস্যৈবরাঘব ॥ ১৫
অথজ্যেষ্ঠাংসুরাঃ সর্বেদেবকার্যচিকীর্ষয়া ।
শৈলংদ্রবরয়ামাসুর্গঙ্গাং ত্রিপথগাং নদীম্ ॥ ১৬
দদৌধর্মেণহিমবান্স্তনয়াং লোকপাবনীম্ ।
স্বচ্ছন্দপথগাং গঙ্গাং ত্রৈলোক্যহিতকাম্যয়া ॥ ১৭
প্রতিগৃহা ত্রিলোকার্থং ত্রিলোকহিতকাঙ্ক্ষিণঃ ।
গঙ্গামাদায় তেঽগচ্ছন্ কৃতার্থেনান্তরাত্মনা ॥ ১৮
যা চান্যা শৈলদুহিতা কন্যাসীদ্রঘুনন্দন ।
উগ্রং সুব্রতমাস্থায়তপস্তেপেতপোধনা ॥ ১৯
উগ্রেণতপসাযুক্তাং দদৌ শৈলবরঃ সুতাম্ ।
রুদ্রায়াপ্রতিরূপায় উমা লোকনমস্কৃতাম্ ॥ ২০
এতেতেশৈল রাজস্য সুতেলোকনমস্কৃতে ।
গঙ্গাচসরিতাং শ্রেষ্ঠা উমাদেবী চ রাঘব ॥ ২১
(তথ্যসূত্র — বাল্মিকী রামায়ণ/বাল কাণ্ড/সর্গ ৩৫)
🌷 অর্থ — হে রাম ! সুবর্ণ আদি ধাতুসমূহ স্থানরূপ হিমালয় পর্বতের দুইকন্যা উৎপন্ন হয়েছে ॥ ১৩
হে রাম ! যিনি সুন্দর কটিযুক্ত সুমেরুর কন্যা, সেই হিমালয়ের প্রিয় পত্নী মেনকা এই দুইজনের মাতা হন ॥ ১৪
হে রাঘব ! মেনকার দুই কন্যার মধ্যে গঙ্গা দেবী জ্যেষ্ঠ, আর সেই মেনকারই কনিষ্ঠ কন্যার নাম উমা ॥ ১৫
এছাড়াও সম্পূর্ণ দেবতাগণেরা নিজেদের কার্য সাধন করবার নিমিত্তে ত্রিপদা নাম সম্পন্ন গঙ্গা নদীকে হিমালয়ের কাছ থেকে যাচনা করেছিলেন ॥ ১৬
হিমালয় ত্রিভুবনের হিতের জন্য নিজের ইচ্ছায় বিচরণকারী লোকপাবনকারীনি কন্যা দেবী গঙ্গা কে ধর্মবিধি পূর্বক তাদের সাথে গমন করবার জন্য দিলেন ॥১৭
তিন লোকের উপকার করবার ইচ্ছা সম্পন্ন দেবতারা ত্রিভুবনের উপকারের জন্যই দেবী গঙ্গাকে নিয়ে মনে মনে নিজেদের কৃতার্থ বলে অনুভব করতে করতে বিদায় নিলেন ॥ ১৮
রঘুনন্দন হিমালয়ের যে উমা নামক দ্বিতীয়তম কন্যা আছে, তিনি কঠিন ব্রত অবলম্বন করে ঘোর তপস্যা করেছিলেন ॥ ॥ ১৯
হিমালয় নিজে সেই ত্রিলোকপূজিত মহাতপকারী যোগশালিনী কন্যাকে যোগেশ্বর শান্তমূর্তিরূপী পরমেশ্বর শিব কে সম্প্রদান করেছেন ॥ ২০
হে রঘুনন্দন এই প্রকারে নদীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ গঙ্গা দেবী তথা ভগবতী উমা এই দুজন গিরি রাজ হিমালয়ের কন্যা বলে বিখ্যাত । সমগ্র জগত সংসার এই উমাদেবীর (সহিত গঙ্গার) চরণে মস্তক নত করে ॥ ২১
— তাহলে উপরিউক্ত বাল্মীকি রামায়ণ থেকে প্রমাণ সহ জানা গেল যে হিমালয় হলেন গঙ্গার উৎপত্তি কর্তা । শ্রীহরির চরণ থেকে গঙ্গা উৎপন্ন হননি ।
এবার দ্বিতীয় শঙ্কা সমাধান করা যাক,
♦️ পরমেশ্বর শিব কি হরিভক্তির কারণে মস্তকে গঙ্গাকে ধারণ করেছেন নাকি অন্য কারণে ধারণ করেছেন ?
উত্তর :
ইয়ং হৈমবতীজ্যেষ্ঠা গঙ্গা হিমবতঃসুতা ।
তাং বৈধারয়িতুংরাজন্হরস্তত্রনিয়ুজ্যতাম্ ॥ ২৩
গঙ্গায়াঃ পতনংরাজন্পৃথিবীনসহিষ্যতে ।
তাংবৈধারয়িতুরাজন্নান্যং পশ্যামিশু লিনঃ ॥ ২৪
তমেবমুক্ত্বারাজানংগাঞ্চা ভাষ্যলোককৃৎ ।
জগাম ত্রিদিবংদেবৈঃ সর্বৈঃ সহমরুদ্গণৈঃ ॥ ২৫
[তথ্যসূত্র : বাল্মিকী রামায়ণ/বালকাণ্ড/সর্গ ৪২]
🌷 অর্থ —
হে মহারথী ভগীরথ! এটি তোমার বড় ইচ্ছা, তাই তোমার ইচ্ছা পূরণ হবে, তোমার মঙ্গল হোক ॥ ২২
হে রাজা, হিমালয়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা গঙ্গা পৃথিবীতে অবতরণ করবে। তার গতিবেগকে ধারণ করবার জন্য, পরমেশ্বর শিবের কাছে প্রার্থনা করো ॥ ২৩
হে রাজন ! গঙ্গা পৃথিবীতে পতিত হলে গঙ্গার গতিবেগ পৃথিবী সহ্য করতে পারবে না, তাই শূলপাণি শঙ্কর ছাড়া আর কেউ গঙ্গার এই গতিবেগকে সহ্য করে ধারণ করতে সক্ষম নয় ॥ ২৪
সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাজী রাজা ভগীরথকে এই কথা বলেছিলেন এবং গঙ্গাজীকে বলেছিলেন যে, হে গঙ্গা তুমি সঠিক সময়ে রাজার উপর কৃপা বর্ষিত করবে। তখন সমস্ত দেবতা ও মরুৎগণ স্বর্গে চলে গেলেন ॥ ২৫
দেবদেব গতেতস্মিন্সরোঙ্গুষ্ঠাগ্রনিপীড়িতাম্ ।
কৃত্বাবসুমতীং রামবৎসর সমুপা সত ॥ ১
অথসম্বৎসরে পূর্ণে সর্বলোকনমস্কৃতঃ ।
উমাপতিঃ পশুপতিরাজানমিদমব্রবীৎ ॥ ২
প্রীতস্তেনরশ্রেষ্ঠকরিষ্যামিতবপ্রিয়ম্ ।
শিরসাধারয়িষ্যামিশৈলরাজসুতামহম্ ॥ ৩
ততো হৈমবতী জ্যেষ্ঠাসর্বলোকনমস্কৃতা ।
তদাসাতিমহদ্রূপং কৃত্বাবেগঞ্চদুঃসহম্ ॥ ৪
আকাশাদপতদ্রামশিবেশিবশিরস্যুত ।
অর্চিতযচসাদেবীগঙ্গাপরমদূর্ধরা ॥ ৫
বিশাম্যহংহিপাতালংস্রোতসাগৃহ্যশংকরম্ ।
তস্যাবলেপনংজ্ঞাত্বা ক্রুদ্ধস্তু ভগবা রন্হঃ ॥ ৬
তিরোভাবয়িতুংবুদ্ধিং চক্রে ত্রিনয়নস্তদা ।
সাত স্মিন্পতিতা পুণ্যাপুণ্যে রুদ্ধস্যমূর্ধনি ॥ ৭
হিমবৎস্রতিমেরামজটামণ্ডলগহ্বরে ।
সাকথঞ্চন্মহীংগতাংনাশক্নো দ্যত্নমা স্থিতা ॥ ৮
নৈবসা নিগমলে ভেজটামণ্ডলমংততঃ ।
তত্রৈবাভ্রমদ্দেবীসম্বৎসরগণান্বহূন্ ॥ ৯
তামপশ্যৎপুনস্তত্রতপঃ পরমমাস্থিতঃ ।
সতেনতোষিতশ্চাসীদত্যং তং রঘুনন্দন ॥ ১০
বিসসর্জততোগং গাং হরো বিন্দুসরঃ প্রতি।
তস্যাবিসৃজ্যমানায়াং সপ্তস্রোতাংসিজজ্ঞিরে ॥ ১১
[তথ্যসূত্র : বাল্মিকী রামায়ণ/বালকাণ্ড/সর্গ ৪৩]
🌷 অর্থ —
দেবদেব প্রজাপতি যখন দেবলোক প্রস্থান করলেন, তখন ভগীরথ নিজের এক পায়ের আঙুলের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে থেকে এক বছর ধরে পরমেশ্বর শিবের জন্য তপস্যা করেন ॥ ১
এক বছর পেরিয়ে গেলে, সমস্ত জগত দ্বারা যিনি পূজিত, যিনি উমার স্বামী, যিনি পশুপতি সেই পরমেশ্বর মহাদেব ভগীরথের সামনে আবির্ভূত হয়ে ভগীরথকে বললেন, ॥ ২
হে শ্রেষ্ঠ পুরুষ! আমি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছি, এখন তোমার যা প্রিয় অভিলাষ আছে তা আমি পূর্ণ করবার জন্যই অর্থাৎ হিমালয় কন্যা গঙ্গাকে আমার মস্তকে ধারণ করবো ॥ ৩
সেই সময় পর্বত কন্যা গঙ্গা অত্যন্ত শোভাসম্পন্ন রূপ ধারণ করে প্রবল বেগে চলতে শুরু করলেন ॥ ৪
হে রাম! তা আকাশ থেকে কল্যাণ স্বরূপ পরমেশ্বর শিবের মস্তকের উপরে নামলেন, আকাশ থেকে পতিত হবার সময় চরম দূর্ভাগা গঙ্গা দেবী চিন্তা করে ভাবতে লাগলেন ॥ ৫
(গঙ্গা ভাবতে লাগলেন) আমি প্রবল প্রবাহের দ্বারা (আঘাতের মাধ্যমে ধাক্কা দিয়ে) শিবকে নিয়ে পাতাললোকে গিয়ে পাতালে বসবাস করবো, ধূর্জটি মহাদেব অন্তর্যামী হবার কারণে গঙ্গার মনে চলতে থাকা এই অভিপ্রায়ের কথা জেনে কুপিত হলেন ॥ ৬
তার এমন অহংকার সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে পরমেশ্বর মহাদেব ঠিক করলেন, আমি আমার জটার মধ্যেই গঙ্গাকে এমন বিস্মৃত করবো যে সে বের হবার পথ পাবে না , এদিকে তখন সেই গঙ্গা রুদ্রদেবের দিব্যদেহের উপরে থাকা জটায় পতিত হলেন ॥ ৭
গঙ্গা (জটায় পতিত হবার পর) জটা থেকে বের হয়ে ভূতলে চলে যাবার খুবই চেষ্টা করলেন, কিন্তু হিমালয়ের সমান অতি গম্ভীর জটাজূটের মধ্যে তিনি কত ঘুরেফিরে বেরালেন কিন্তু কোনো প্রকারে সেখান থেকে বের হতে পারলেন না ॥ ৮
সেই গঙ্গা দেবী এইরকম ভাবেই বহু বছর ধরে জটামণ্ডলের মধ্যে মণ্ডিত হয়ে বের হবার জন্য ঘুরতেই থাকলেন , কিন্তু কোনো ভাবেই বের হবার পথ পেলেন না ॥ ৯
ভগীরথ এমন অবস্থা দেখে পুনরায় পরমেশ্বর শিবের তপস্যা আরম্ভ করলেন, হে রাম ! তপস্যা করে ভগীরথ পরমেশ্বর শিবকে প্রসন্ন করলেন ॥ ১০
তার তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে গঙ্গাধর শিব নিজের জটাজাল থেকে গঙ্গাকে বের করে বিন্দু সরোবরের দিকে ছেড়ে দিলেন , তিনি এভাবে যখন ছাড়লেন তখন সাতটি ধারার উৎপত্তি হলো ॥ ১১
— উপরোক্ত রামায়ণের বচন থেকে প্রমাণিত হল যে, গঙ্গা দেবীকে পরমেশ্বর শিব নিজের মস্তকে ধারণ করেছিলেন শুধুমাত্র ভগীরথের তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে ভগীরথের ইচ্ছা পূরণ করবার জন্য , শ্রীহরি বিষ্ণুর ভক্তিতে গদগদ হয়ে হরির চরণধৌত জল মাথায় নিয়ে বসে থাকার জন্য নয় ।
এবার দেখা যাক ,
♦️ শ্রীহরি তার নিজের মস্তকের উপরে কি ধারণ করে থাকেন ?
✅ উত্তর —
সূত উবাচ -
এবং নিশম্য ভগবান্ বাসুদেবো জগন্ময়ঃ ।
স্বমূর্ধ্নি চরণদ্বন্দ্বং শিবস্য পরমাত্মনঃ ॥ ৪৬
বিন্যস্য ব্রহ্মবিজ্ঞানং বেদান্তোক্তং বিমুক্তিদম্ ।
লব্ধ্যা ভূমৌ মহাভক্ত্যা বিবশো গদ্গদস্বরঃ ॥ ৪৭
প্রণম্য বহুশঃ শ্রীমান্সলিলার্দ্রসুলোচনঃ ।
কৃতার্থোঽভবদীশানপ্রসাদাদেব সুব্রতাঃ ॥ ৪৮
[তথ্যসূত্র - স্কন্দমহাপুরাণ/সূতসংহিতা/মুক্তিখণ্ড/অধ্যায় নং ৫/৪৬-৪৮শ্লোক]
🌷 অর্থ —
সূত মুনি বললেন -
এটি শ্রবণ করার পর শ্রীবিষ্ণু পরমেশ্বর শিবের চরণ দুটি নিজের মাথায় ধারণ করলেন এবং মোক্ষফলক বেদান্ত জ্ঞান পেয়ে হর্ষিত হয়ে পরমেশ্বর শিবকে প্রণাম করলেন। তিনি রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলেন শ্রীবিষ্ণুর কণ্ঠস্বর গদগদ হয়ে গেল। তার দুই চক্ষু হতে আনন্দ অশ্রু বইতে লাগলো। পরমেশ্বরের কৃপায় কৃতার্থ হয়ে গেলেন ॥৪৬-৪৮
কি বুঝলেন ?
বৈষ্ণবেরা তো ‘শিব হরিভক্তি করবার কারণে বিষ্ণুর চরণ থেকে উৎপন্ন চরণধৌত জল নাকি শিব নিজের মাথায় ধারণ করেছে’ বলে অপপ্রচার করে বেড়ায়। এদিকে
স্কন্দমহাপুরাণের সূতসংহিতা বলছে যে, চরণধোয়া জল তো তুচ্ছ বিষয় ; বরং, শ্রী হরি নিজেই পরমেশ্বর শিবের দুই চরণকে সরাসরি নিজের মাথার উপর ধারণ করে নিয়েছেন।
🔵 আরো একটি প্রমাণ দেখুন 👇
বিষ্ণুর্বিশ্বজগৎকর্তা বিশ্বেশাঙ্ঘ্রিসরোরুহম্ ।
স্বমূর্ধ্নি ভক্ত্যা নিক্ষিপ্য তথা পরবশোঽভবৎ ॥ ১৮১
পিতামহোঽপি সর্বাত্মা শিবপাদাম্বুজদ্বয়ম্ ।
স্বমূর্ধ্নি ভক্ত্যা নিক্ষিপ্য তথা পরবশোঽভবৎ ॥ ১৮২
[তথ্যসূত্র : স্কন্দমহাপুরাণ/সূতসংহিতা/ যজ্ঞবৈভবখণ্ড/উপরিভাগ/ব্রহ্মগীতা/৮ অধ্যায়/১৮১-১৮২ শ্লোক]
🌷 অর্থ — ভগবান বিষ্ণু ও পিতামহ ব্রহ্মা উভয়ে জগৎকর্তা বিশ্বপতি বিশ্বেশ্বর সর্বাত্মা শিবের চরণদ্বয় নিজের নিজের মাথার ওপরে স্পর্শ করে ধারণ করলেন এবং ভক্তিভাবে বিভোর হয়ে গেলেন ॥ ১৮১-১৮২
🔵 আরো প্রমাণ দেখুন 👇
মত্তবারণমুখ্যচর্মকৃতোত্তরীয়মনোহরং
পঙ্কজাসনপদ্মলোচনপূজিতাঙ্ ঘ্রিসরোরুহম্ ।
দেবসিদ্ধতরঙ্গিণীকরসিক্তশীতজটাধরং
চন্দ্রশেখরমাশ্রয়ে মম কিং করিষ্যতি বৈ যমঃ ॥ ৩
[তথ্যসূত্র: শ্রীশিবরহস্য মহা ইতিহাস/চতুর্থাংশ/১৪ অধ্যায়/(চন্দ্রশেখরাষ্টকম/মৃত্যুঞ্জয় স্তোত্রম)৩ নং শ্লোক]
🌷 অর্থ — যিনি মত্ত গজরাজের চর্ম ঢেকে পরম মনোহররূপে প্রতিভাত, ব্রহ্মা ও বিষ্ণু যাঁর চরণ মস্তকে ধারণপূর্বক পূজা করেন এবং যিনি দেবতা ও সিদ্ধদের নদী গঙ্গার তরঙ্গে সিক্ত শীতল জটা ধারণ করেন, সেই ভগবান চন্দ্রশেখরের আমি শরণ গ্রহণ করি। যম আমার কী করবেন ? ॥ ৩
শ্রী হরি নিজেই পরমেশ্বর সদাশিবের পরমভক্ত তা সর্বত্র প্রমাণিত। তাই শ্রীহরি বিষ্ণু নিজেই পরমেশ্বর সদাশিবের দিব্য চরণদ্বয় নিজের মস্তকে তুলে রাখেন সর্বদা ও শিবভক্তিতে মগ্ন থেকে পূজা করেন ।
হরিরুবাচ
ত্বৎপাদযুগলে শম্ভো ভক্তিরস্তু সদা মম।
অথ দত্ত্বা বরং শম্ভুরিদমাহ বচো হরিম্ ॥২৪০
(তথ্যসূত্র - পদ্মপুরাণ/পাতালখণ্ড/চতুঃষষ্টিতমোঽধ্যায়)
অর্থ — শ্রীবিষ্ণু বললেন, হে শম্ভো! আপনার পদযুগলে আমার সর্বদা যেন ভক্তি থাকে,আমি এই বর প্রার্থনা করি ॥ ২৪০
পদ্মপুরাণের এই বাক্যকে হুবহু বেদ স্বয়ং উল্লেখ করেছেন।
বেদের বৃহৎ জাবাল উপনিষদে বলা হয়েছে 👇
ত্বৎপাদযুগলে শম্ভো ভক্তিরস্তু সদা মম ।..॥ ১৫
[বৃহৎ জাবাল উপনিষদ/৬ষ্ঠ ব্রাহ্মণ/১৫ মন্ত্র]
🌷 অর্থ — শ্রীবিষ্ণু বললেন, হে শম্ভো! আপনার পদযুগলে আমার সর্বদা যেন ভক্তি থাকে ॥ ১৫
অর্থাৎ, পরমেশ্বর শিবের চরণ ভক্তিসহকারে শ্রীহরি পূজা করেন , তা বেদ ও পুরাণ উভয় শাস্ত্র থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। বেদ ও পুরাণের বচন মিলে গিয়েছে, পুরাণের বচন যখন বেদ সম্মত হয় তখন তা পরমসত্য বলেই গ্রহণ করতে হয়, এর খণ্ডন অসম্ভব । সুতরাং, পরমেশ্বর শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত হলেন শ্রী হরি বিষ্ণু । পরমেশ্বর শিবের নামে করা অপপ্রচার এখানে খণ্ডিত হল ।
এছাড়াও শ্রীবিষ্ণুর একটি প্রসিদ্ধ নাম রয়েছে ভদ্রাবিধ আগমের ৯ নং পটলের ২১ নং মহামন্ত্রে বলা হয়েছে, 👇
শম্ভোঃ চরণদ্বয়ং গোবিন্দং স্বস্য মস্তকোপরি ধারয়তি ।
অতঃ শ্রীনারায়ণ শিবচরণশিরোধরণেন প্রসিদ্ধঃ ॥ ২১
[তথ্যসূত্র : ভদ্রাবিধ আগম/৯ নং পটল]
🌷 অর্থ — শম্ভুর চরণ দুটি গোবিন্দ নিজের মস্তকে ধারণ করে রাখেন, তাই নারায়ণ ‘শিবচরণশিরোধর’ নামে বিখ্যাত ॥ ২১
তাহলে সাক্ষাৎ শৈব আগমে শ্রী নারায়ণ নিজের মস্তকে শিবচরণদ্বয় ধারণ করেছেন বলে , হরির একটি নাম শিবচরণশিরোধর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
আরো দেখুন , শ্রী ভগবন্ত মন্দিরে ভগবান শ্রীহরি বিষ্ণুর মস্তকে শিবলিঙ্গ স্থিত থাকে, 👇
বিষ্ণুর মস্তকে শিবলিঙ্গ
Shri Bhagwant Mandir
श्री भगवंत मंदिर
Full Address : 6MMQ+M7J, Mangalwar Peth, Mangire Mala, Barshi, Maharashtra 413401
https://maps.app.goo.gl/veNJ5vRypkn6UWEB6
________________________________________________
এবার প্রশ্ন হল,
♦️ পরমেশ্বর শিব কি সত্যিই বিষ্ণুর ভক্তি করেন ?
উত্তর —
চলুন এর সত্যতা আমরা বৈষ্ণবদের প্রাণপ্রিয় সাত্ত্বিকপুরাণ পদ্মপুরাণ থেকেই উন্মোচন করে দেখিয়ে দিচ্ছি —
(চৌখাম্বা প্রকাশনীর প্রকাশিত পদ্মপুরাণের পাতালখণ্ড)
শঙ্করউবাচ্-
" ধ্যায়েনকিঞ্চিৎ গোবিন্দননমস্যেহকিঞ্চন ॥২৪৮
নোপাস্যেকিঞ্চনহরেনজপিষ্যেহকিঞ্চন
কিন্তু নাস্তিকজন্তুনাং প্ৰবৃত্ত্যৰ্থমিদংময়া ॥২৪৯"
(তথ্যসূত্র - পদ্মপুরাণ/পাতাল খণ্ড/ ১১৪ নং অধ্যায়)
🌷 অর্থ — হে গোবিন্দ! বস্তুত আমি কারোরই ধ্যান করিনা, কাউকে প্রণাম করিনা, কাউকে উপাসনা করিনা এবং কারও জপ করিনা। নাস্তিকদেরকে এবং জগৎবাসিকে শিক্ষা প্রদানের নিমিত্তে আমি নিজ ইচ্ছায় নিজ বিধি নিয়মে আবদ্ধ হই মাত্র। কেননা আমিই পরমেশ্বর।
পরমেশ্বর শিব শ্রীহরির প্রশ্নের উত্তরে বললেন যে, শিব কাউকে ধ্যান করে না বা প্রণাম করে না কারো উপাসনা করে না তিনি কারণ নাম জপও করে না শুধুমাত্র তিনি নাস্তিক ও অন্যান্য সমগ্র জগত বাসি কে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি নিজের ইচ্ছেমতো নিজের বিধিতে তিনি আবদ্ধ হন অর্থাৎ সকলকে তিনি শুধুমাত্র শিক্ষা দেবার কার্যটুকু করেন,যা শিবেরই লীলামাত্র। তাই পরমেশ্বর শিব কখনোই রাম নাম জপ ও করেন না তিনি রাম কে প্রণাম ও করেন না তিনি রামের ধ্যান করেন না তিনি রামকে পুজো করেন না, তিনি শুধুমাত্র লীলাবশত নিজের ভক্তের উচ্চ প্রশংসা করেন মাত্র। কারণ তিনি তাঁর ভক্তদের প্রতি স্নেহ করেন এবং ভালবাসেন তাই তিনি স্নেহবশত তো তার ভক্তদের স্মরণ করে থাকেন বা তাদের গুণগান গেয়ে থাকেন।
এই একই কথা শিবমহাপুরাণে পরমেশ্বর শিব বলেছেন।
চলুন দেখে নেওয়া যাক -
সর্বে রুদ্রং ভজন্ত্যেব রুদ্রঃ কঞ্চিদ্ভজেন্ন হি ।
স্বাত্মনা ভক্তবাৎসল্যাদ্ভজত্যেব কদাচন ॥ ১৫
[তথ্যসূত্র – শিবমহাপুরাণ/কোটিরুদ্রসংহিতা/অধ্যায় ৪২]
🌷 অর্থ — সবাই ভগবান রুদ্র তথা পরমেশ্বর শিবের ভজনা করেন, কিন্তু পরমেশ্বর শিব কারোর ভজন করেন না, কখনো কখনো ভক্তবৎসলবশত তিনি নিজেই নিজের ভক্তের প্রশংসা রূপে ভজনা করে থাকেন ॥ ১৫
অতএব, পরমেশ্বর শিব বা কৈলাসপতি রুদ্রদেবও কখনোই বৈষ্ণব নন, শিব কখনোই পঞ্চমুখে রামনামও করেন না। তিনি রামের গুণগান করেন শুধুমাত্র রামের শিবভক্তির মহানতার কারণে। কিন্তু কলিরচর বৈষ্ণবেরা সেই পরমসত্যকে ধামাচাপা দিয়ে অসত্য কাল্পনিক গল্পের ভাণ্ডার খুলে পরমেশ্বর শিবকে বিষ্ণুদাস/কৃষ্ণদাস/রামদাস বানানোর অপপ্রচেষ্টা করে চলেছে।
অথচ শাস্ত্র কি বলছে দেখা যাক -
নাস্তিশৈবাগ্রণীর্বিষ্ণো ॥৫৬
(তথ্যসূত্র - স্কন্দমহাপুরাণ/মাহেশ্বরখণ্ড/অরুণাচমাহাত্ম্যম/উত্তরার্ধ্ব/অধ্যায় নং ৪)
🌷 অর্থ — শ্রীবিষ্ণুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ শৈব আর কেউ নেই।
অর্থাৎ প্রমানিত হল যে শ্রীবিষ্ণুই পরমশৈব। তার চেয়ে বড় শৈব আর কেউ নেই। আশা করি কলির চর বৈষ্ণবদের চোখ খুলে গেছে এবার। যদি চোখ না খোলে তবে তাদের জন্য বেদ থেকে হরির চেয়েও পরম হল পরমেশ্বর শিব, এটিই প্রমাণ করে দেয়া হল। চলুন দেখে নিই বেদশাস্ত্র কি বলছে -
পরাৎপরতরো ব্রহ্মা তৎপরাৎপরতো হরিঃ ।
তৎপরাৎ হ্যেষ তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্ত ॥১৮
[তথ্যসূত্র — ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/১৮ এবং ঋগ্বেদোক্ত শিবসংল্পসূক্ত - ঋগ্বেদ সংহিতা/খিলানি/চতুর্থ অধ্যায়/১১ নং খিলা]
🌷 অর্থ — সর্বোপরি হলেন ব্রহ্মা, তাঁরও উপরে হরি এবং এদের চেয়েও যিনি পরমতম ঈশ (ঈশান/মহাদেব) সেই শিবের প্রতি মন সংকল্পবদ্ধ হোক ॥১৮
বেদের উপরোক্ত এই মন্ত্রই আরো কট্টরভাবে বেদের শরভ উপনিষদে উল্লেখ হয়েছে। সেখানে সরাসরি হরিকে শ্রেষ্ঠ বলার নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রভু শিব ছাড়া আর কেউ শ্রেষ্ঠ নয় তাও বলে দেওয়া হয়েছে।
দেখুন 👇
পরাৎপরতরং ব্রহ্মা যৎপরাৎপরতো হরিঃ ।
পরাৎপরতরো হীশস্তস্মাত্তুল্যোঽধিকো ন হি ॥ ২৯
এক এব শিবো নিত্যস্ততোহন্যৎসকলং মৃষা ।
তস্মাৎসর্বাপরিত্যজ্য ধ্যেযান্বিষ্ণবাদিকারান্ ॥ ৩০
(তথ্যসূত্র — শরভ উপনিষদ/২৯ নং মন্ত্র)
🌷 অর্থ — যিনি পরাৎপর ব্রহ্মা, তাঁর থেকেও অধিক পরাৎপর হলেন হরি। কিন্তু হরির থেকেও অধিক যিনি পরাৎপর তিনিই হলেন ঈশ(সদাশিব), সেই প্রভু শিবের সমান তথা তাঁর চেয়ে অধিক কেউ নেই (কারণ শিবই সর্বোচ্চ সত্ত্বা পরমব্রহ্ম) ॥২৯
শিবই একমাত্র নিত্য, অন্য সকল কিছুই মিথ্যা। এই কারণে বিষ্ণু আদি সকল দেবতাকে পরিত্যাগ করে শিবকেই ধ্যেয় বলে জানা উচিত ॥৩০
আশা করি কলিরচর বৈষ্ণবদের চোখ এবার নিশ্চয়ই খুলে গিয়েছে।
আর যারা এখানে একতার জ্ঞান দিতে আসবে, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, আমরা শৈবরা সকল দেবতাকেই এক শিবের রূপ মানি, কোনো দেবতাকে ছোট করা হয় না , কিন্তু শিব রূপই মূল তাই বেদে শিবকেই পরমেশ্বর ঘোষনা করা হয়েছে। হরি হল পরমেশ্বর শিবের একটি গুণপ্রকাশ , হরি সত্ত্বগুণসম্পন্ন। ব্যবহারিক পর্যায়ের বিচারে শিবের আশ্রয়ে সমস্ত দেবতারা থাকেন, যা শাস্ত্রেও উল্লেখ আছে। তাই এখানে কোনো ভেদাভেদ করা হয়নি, পরমার্থিক পর্যায়ের বিচারে সব দেবতাই পরমেশ্বর শিবের বিভিন্ন স্বরূপ বলে বিবেচিত হয় তাই সব দেবতার অস্তিত্ব একমাত্র শিব জেনে শিবকেই পরম ও অদ্বিতীয় সত্ত্বা বলা হয়েছে। আশা করি একতাবাদীরা ভুল করেও আমাদের একতা শেখাতে আসবেন না আর বৈষ্ণবদের উপরোক্ত সমস্ত বিষয়ের উপর আলোচনা সমাপ্ত হল। এবার সিদ্ধান্তের পালা।
________________________________________________
✅ সিদ্ধান্ত —
(১) পরমেশ্বর শিব ছাড়া গঙ্গার গতিবেগ সহ্য করবার ক্ষমতা অন্য কারোর ই নেই, এমনকি শ্রীবিষ্ণুরও নেই ।
(২) পরমেশ্বর শিব শ্রীহরির চরণধৌত জল মাথায় ধারণ করেন না, বরং শ্রীহরি নিজেই পরমেশ্বর সদাশিবের পরমভক্ত বলে প্রমাণিত, সেই শিবভক্তির কারণে পরমেশ্বর শিবের দিব্য চরণকমল দুটি পরমশৈব শ্রীহরি নারায়ণ তার নিজের মস্তকের উপরে ধারণ করেন । যার প্রমাণ বেদ পুরাণ ও আগম শাস্ত্র দিয়ে রেখেছে।
(৩) পরমেশ্বর শিব কখনোই বিষ্ণুর ভক্ত নন, তিনি তার সংহার কর্তা রুদ্রদেবের দ্বারা বিষ্ণুর মাহাত্ম্য জগতে প্রচারের জন্য প্রশংসা মাত্র করে থাকেন। এর দ্বারা প্রভু শিব বিষ্ণুভক্ত বলে প্রমাণিত হন না ।
সুতরাং, বৈষ্ণবদের গালগপ্পো এখানে সম্পূর্ণ ভাবে খণ্ডিত তথা ধ্বংস হল ।
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
🔥 অপপ্রচার দমনে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
©কপিরাইট ও প্রচারে — international Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন