নমঃ শিবায় স্তোত্র (শিবভক্ত শৈব জ্ঞানসম্বন্ধ নায়নার কৃত)
নমঃ শিবায়
শিবভক্ত জ্ঞানসম্বন্ধ (নায়নার) - ৬৩ জন জনপ্রিয় শিব ভক্তদের মধ্যে একজন , যিনি জৈন মতবাদ খণ্ডনের জন্য পৃথিবীতে অবতরণ করেন, যখন ইনি শিশু ছিলেন, তার মুখে কথার বুলিও ঠিক মতো ফোটেনি ঠিক সেই সময়ের একটি ঘটনা অবলম্বনে, একদিন শিবভক্ত জ্ঞানসম্বন্ধের পিতা ভোর বেলায় স্নানের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে পুকুরের দিকে যাচ্ছিলেন, যাবার সময় তার পত্নীকে বলেন পুত্রের দিকে নজর রাখতে। কিন্তু নিদ্রায় আচ্ছন্ন হওয়ায় তার পত্নী ততটা নজর দিতে পারলেন না, এদিকে পিতা বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে শিশু জ্ঞানসম্বন্ধ তার পিতার পিছু নিলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর তার পিতা পেছন ঘুরে দেখলেন যে জ্ঞানসম্বন্ধ পিছু নিয়েছে। তখন তিনি তাকে সাথে করে নিয়ে এলেন এবং পুকুরপাড়ে বসিয়ে রেখে তিনি জলের মধ্যে গিয়ে স্নান করতে লাগলেন, তিনি জলে ডুব দিয়ে পঞ্চব্রহ্ম সহ অন্যান্য শিব মন্ত্র জপ করতে লাগলেন। এদিকে শিশু জ্ঞানসম্বন্ধ তার পিতাকে দেখতে না পেয়ে, অম্বা ! অম্বা ! বলে অস্ফুট স্বরে ডাকতে লাগলে।
শিবভক্তের প্রতি স্নেহবশত পরমেশ্বর শিব ও মাতা পার্বতী সেখানে উপস্থিত হলেন, আর মাতা পার্বতী নিজের স্তন্য একটি সোনার গ্লাসে ভরে নিয়ে জ্ঞানসম্বন্ধকে তা হাতে ধরে পান করিয়ে দিলেন স্নেহভরে। তারপর তার হাতে সোনার গ্লাস ওভাবে ধরিয়ে রেখেই তারা অন্তর্ধান হলেন, এদিকে তার পিতা জল থেকে উঠে এসে দেখলেন পুত্রের হাতে সোনার গ্লাস তাতে কিছুটা দুধ রয়েছে এবং তার মুখের পাশ থেকেও কিছুটা দুধ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
তখন তার পিতা জিজ্ঞাসা করলেন, এই দুধ কোথায় পেলি, আর এই সোনার গ্লাস ই বা কোথা দিয়ে আনলি, চুরি করে আনিস নি তো ? পরক্ষণে তিনি ভাবলেন এ তো শিশু, তাছাড়া আশেপাশেও কেউ নেই তাহলে এটি এলো কোত্থেকে ?
এদিকে শিশু জ্ঞানসম্বন্ধ পিতার প্রশ্ন শুনে শিব মন্দিরের দিকে হাত দেখিয়ে অস্ফুটস্বর করে ঐ দিকেই ইঙ্গিত করতে লাগলেন। কিন্তু পিতা সেসব বুঝতে না পেরে, তার হাত ধরে মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলেন, মন্দিরে বহু গ্রামবাসী উপস্থিত হয়েছিল, সেখানে নিত্যদিনের মতো পৌরহিত্য করবার জন্য জ্ঞানসম্বন্ধের পিতা যখন মন্দিরে প্রবেশ করলেন, তখন সকলকে অতি আশ্চর্যান্বিত করে তিনবছরের শিশু জ্ঞানসম্বন্ধ পরমেশ্বর শিব ও মা পার্বতীর উদ্দেশ্যে স্তোত্র উচ্চারণ করতে করতে পার্বতী পরমেশ্বরের প্রশংসা করতে লাগলেন, ব্রহ্মবিদ্যা পার্বতীদেবীর স্তন্য পান করে সে সকল বেদ আগম পুরাণ ইতিহাস শাস্ত্রের সমস্ত জ্ঞান প্রাপ্ত করে ফেলেছিলেন, ফলে তিনি ঐ শক্তির মাধ্যমেই ওমন বয়েসেই উচ্চতর অর্থের স্তোত্র বলতে সক্ষম হয়েছিলেন, এই কারণে তার নাম জ্ঞানসম্বন্ধ। এখানে সেই পরম পবিত্র নমঃ শিবায় স্তোত্র উপস্থাপন করা হয়েছে, যা শিবভক্ত জ্ঞানসম্বন্ধের মুখ থেকে নির্গত হয়েছিল।
এই স্তোত্র টি - শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী দ্বারা সংগৃহীত ও অনুবাদিত ।
॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥
গৌরীসুতোঽহং দেবেশ স্তন্যপানেন শঙ্কর ।
ক্ষমস্ব বাচা বিহিতমপরাধং বিভো মম ॥ ১
এণীদৃশালংকৃত বিগ্রহায় বাণীশমুখ্যামর সেবিতায় ।
বেণী জটাবদ্ধ সরিদ্বরায় দ্রোণীপুরেশায় নমঃ শিবায় ॥ ২
ব্রহ্মাত্মভেদাময় ভেষজাঙ্ঘ্র ব্রহ্মাণ্ডেসৃষ্টিস্থিতিনাশ সাক্ষিণে ।
ব্রহ্মাস্তুতি প্রীতিমতে বৃহন্মহস্তনো নমো ব্রহ্মপুরীশ্বরায় ॥ ৩
বিদ্যানবদ্যা বিমলা চ কীর্তির্বেদাগমোক্তে চ বিধৌ চিকীর্ষা ।
বিশ্বাসভাগ্যং যদনুগ্রহেণ তস্মৈ নমো বেণুপুরীশ্বরায় ॥ ৪
নালীকনেত্রার্পিতচারুচক্ষুষে নীলীকসম্পূজ্যপদাম্বুজায় ।
কেলী স্মিতপ্লুষ্ট পুরত্রয়ায় কালীপুরেশায় নমঃ শিবায় ॥ ৫
জম্ভারি লোকদ্রুমপুণ্যমালা সম্ভাবনীয়াঙ্ঘ্রী সরোরুহায় ।
অম্বামহাসেনসমন্বিতায় চম্পাপুরীশায় নমঃ শিবায় ॥ ৬
পঞ্চপাতকহন্ত্রে তে পঞ্চব্রহ্মস্বরূপিণে ।
পঞ্চভূতাধিপতয়ে পঞ্চার্ণতনবে নমঃ ॥ ৭
ত্রয়ীনুতায় ত্রিপুরান্তকায় ত্রিবর্গদায় ত্রিগুণাতিগায় ।
ত্রিমূর্তয়েঽস্তু ত্রিপুটীনিয়ন্ত্রে ত্রৈলোক্যনাথায় নমঃ শিবায় ॥৮
ত্বামেব বাগ্বদতু পশ্যতু লোচনং
মে ত্বামেব সন্নমতু মৌলিরপি শ্রুতির্মে ।
নিত্যং শৃণোতু চরিতং তব চন্দ্রমৌলে স্বামিন্
মনঃ স্মরতু তাবকমঙ্ঘ্রিপদ্মম্ ॥ ৯
[তথ্যসূত্র — স্কন্দ উপপুরাণ(শিবভক্তবিলাস)/অধ্যায় ৫১/১-৯ নং শ্লোক]
________________________________________________
🌷 অর্থ —
হে দেবশাসক ! হে কল্যাণকারী ! যেহেতু আমি মাতা পার্বতীর বেদান্তবিদ্যারূপী জ্ঞানস্বরূপ স্তন্য পান করেছি, এ কারণে আমি গৌরীপুত্র তথা সন্তান। হে ব্যাপক ! আমার বাণীর দ্বারা হওয়া অপরাধকে আপনি ক্ষমা করুন ॥ ১
মৃগ নয়না পার্বতী দেবীর দ্বারা অলংকৃত শরীরধারী যিনি, ব্রহ্মা আদি সকল দেবতার দ্বারা যিনি সেবিত হন, বেণী আর জটাতে গঙ্গাকে বেঁধে রাখেন যিনি , সেই দ্রোণীপুরেশ্বর শিবকে নমস্কার করি ॥ ২
যার চরণ জীব-ব্রহ্ম -এর মধ্যে থাকা ভেদরূপ অজ্ঞানের রোগ কে নিবারণ করে দেন, যিনি ব্রহ্মাণ্ডের জন্মস্থিতি ভঙ্গের সাক্ষী, ব্রহ্মা দ্বারা গায়ন করা স্তুতি যিনি পছন্দ করেন, যার বিস্তৃত জ্যোতিস্বরূপ দিব্যশরীর রয়েছে, সেই ব্রহ্মপুরীশ্বর শিবকে নমস্কার করি ॥ ৩
যার অনুগ্রহে নির্দোষ বিদ্যা, নির্মল খ্যাতি, বেদ আগমে নির্দেশিত কর্তব্য করবার ইচ্ছা আর সৌভাগ্য লাভ করা যায় , সেই বেণুপুরীশ্বর শিবকে নমস্কার করি ॥ ৪
কমল নয়ন শ্রী হরি ভক্তিভরে নিজের সুন্দর চক্ষু যাকে অর্পণ করে দিয়েছেন, যার চরণকমল দুটি ভগবতী কালীর দ্বারা পূজিত হয়ে থাকে, খেলার ছলে মৃদুমন্দ হাস্য করতে করতে যিনি ত্রিপুরকে জ্বালিয়ে বিনাশ করে ফেলেছেন, সেই কালীপুরেশ্বর শিবকে নমস্কার করি ॥ ৫
ইন্দ্র লোকস্থ বৃক্ষের ফুলের দ্বারা তৈরি হওয়া ফুলের মালা দ্বারা যার চরম কমল পূজা করা হয়ে থাকে, অম্বা আর কার্তিকেয় দ্বারা সমন্বিত সেই চম্পাপুরীশ্বর শিবকে নমস্কার করি ॥ ৬
যিনি গৃহস্থদের দ্বারা হয়ে থাকা অবশ্যম্ভাবী পাঁচ ধরণের পাপকে সমাপন করেন, সদ্যোজাতাদি পঞ্চব্রহ্ম যার নিজের রূপ, যিনি পঞ্চভূতের অধিপতি, পঞ্চাক্ষরী বিদ্যারূপী মহামন্ত্র যার শরীর স্বরূপ, সেই পরমেশ্বর শিব কে নমস্কার করি ॥ ৭
বেদ যার স্তুতি করে, ত্রিপুরকে যিনি বিনাশ করেছেন, যিনি ত্রিবর্গ প্রদান করেন, তিন গুণের ঊর্ধ্বে থাকা গুণাতীত যিনি, যিনি ব্রহ্মা-বিষ্ণু ও মহেশ এই তিন মূর্তি ধারণ করেন, যিনি ত্রিপুটিসমূহের (তিন-তিন করে পাওয়া যায় যে বস্তু, তাকে ত্রিপুটি বলে, যেমন - জ্ঞাতা-জ্ঞান-জ্ঞেয়, কর্তা-কর্ম-কারণ প্রভৃতি) নিয়ন্ত্রণ করেন, যিনি ত্রিলোকের শাসক, সেই পরমেশ্বর শিবকে নমস্কার করি ॥ ৮
হে চন্দ্রমৌলি ! হে স্বামী ! আমার মুখের বাণী যেন আপনার ঐ কথা বলে, আমার চক্ষু যেন সর্বদা আপনারই দর্শন করে, আমার মস্তক যেন সর্বদাই আপনাকেই নমস্কার করে, আমার কান যেন সর্বদাই আপনার চরিত্র শ্রবণ করে, আমার মন যেন সর্বদা আপনার চরণ কমল স্মরণ করে ॥ ৯
পরমশৈব শিবভক্ত জ্ঞানসম্বন্ধের জয়
পরমেশ্বর শিবের জয়
মাতা পার্বতীর জয়
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
✍️লেখনী ও সংগ্রহে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
©️ কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন