শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের শ্রুতিমন্ত্রে বর্ণিত একমাত্র পরমেশ্বর — শিব । বিষ্ণু বা অন্য কেউ নয় ।

Svetashvatara Upanishad


॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥

॥ শ্রীগুরবে নমঃ ॥

ভূমিকা —

বর্তমানে এই কলিযুগে জগতকে পাপের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য জগতে নানা ধরনের কুকর্ম তো চলছেন, এমনকি ধর্মের সঠিক মার্গগুলিকেও মুছে একটি ভ্রান্ত মার্গ বানিয়ে তার দিকে মানুষকে ঠেলে দেওয়ার মতো ভয়ংকর ভ্রষ্টাচার চলছে চারিদিকে। বেদ, পুরাণ, ইতিহাস,তন্ত্র তথা অনান্য শাস্ত্রের নামে বিকৃত মস্তিষ্কের ভাবনায় প্রেরিত বুদ্ধি দ্বারা শাস্ত্রের মূল লক্ষ্যের এবং প্রকৃত অর্থের অনর্থ ঘটিয়ে অবশেষে লক্ষ্যচ্যুত করে এমন অর্থ লিখে প্রচার করা হচ্ছে যা অধ্যয়ন করে সাধারণ মানুষ প্রকৃত অর্থ জানবার পরিবর্তে নকল অর্থ জানছে, ফলে ধীরে ধীরে সনাতন ধর্মের প্রকৃত রূপ টি জন সাধারণের কাছে বদলে গিয়ে একটি ভ্রান্ত ধারণা সত্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। 

এভাবেই বিকৃতিকরণ করে, সত্যকে অর্ধসত্য তথা মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে প্রচার করে কলিযুগের সহায়ক করে তুলছে বহু নরকের কীটেরা। আজ তার মধ্যে থেকে বেদের অন্তর্গত ‘শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ’ -এর বিষয়ে আলোচনা করবো। কারণ, বর্তমানে বহু অপসংস্কৃতির গোষ্ঠীদলের নিজের নিজের ইচ্ছা অনুসারে এই উপনিষদের ত্রুটিপূর্ণ ব্যাখ্যা ও ভাষ্য করে কেউ দাবী করছে যে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে নিরাকার ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে, আবার কোনো কোনো বৈষ্ণবীয় পরম্পরা দাবী করছে যে, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে ভগবান শ্রীহরি বিষ্ণুকেই নির্দেশ করে শ্রীহরিকেই পরমেশ্বর বলা হয়েছে । শ্রুতি(বেদ) মন্ত্রের সঠিক অর্থ বোঝবার জন্য পুরাণ, ইতিহাস শাস্ত্রের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, শ্রুতির ব্যাখ্যা করতে গেলে সে বিষয়ে ইতিহাস পুরাণে যেমন ভাবে বর্ণিত আছে সেই প্রমাণের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় । 

তাই আমি ‘শ্রী নন্দীনাথ শৈব’ এখানে পুরাণ ইত্যাদি শাস্ত্রের থেকে প্রমাণ উল্লেখ করে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ মূলত কাদের পরম্পরাগত শাস্ত্র, কে এই শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ  প্রকট করেছিলেন, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে পরমব্রহ্ম হিসেবে কাকে নির্বাচন করা হয়েছে, তা উল্লেখ করে দেখাবো, যাতে কোনো অপসংস্কৃতির ক্ষমতা না হয় শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ কে অপব্যাখ্যা করে তার অপপ্রয়োগ করবার ।


________________________________________________


(প্রশ্ন - ১) শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ অনুসারে পরম আরাধ্য দেবতা কে হ‌ওয়া উচিত ?

✅ উত্তর :

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ অর্থাৎ শ্রুতি অনুসারে, প্রকৃত আরাধ্য দেবতা হলেন, পরমেশ্বর শিব । প্রমাণ 👇

তমীশ্বরাণাং পরমং মহেশ্বরং

তং দেবতানাং পরমং চ দৈবতম্।

পতিং পতীনাং পরমং পরস্তাদ্ 

বিদাম দেবং ভুবনেশমীড্যম্ ॥ ৭

[তথ্যসূত্র : শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/অধ্যায় ৬/৭নং মন্ত্র]

অর্থ — তিনিই পরম ঈশ্বর মহেশ্বর, তিনিই সকল দেবতার মধ্যে পরম দেবতা অর্থাৎ পরমব্রহ্ম। তিনি ব্রহ্মাদি সকল শাসকের‌ও পরমতম শাসক - পশুপতি, তিনি সকল কিছুর ঊর্ধ্বে থাকা অদ্বিতীয় পরমসত্ত্বা, সেই পরম আরাধ্য দেবতা ‘ভুবনেশ শিব’ -কে আমরা নিজের অন্তরের আত্মারূপে জানি ॥ ৭


পরমেশ্বর শিব‌ই যে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে পরমারাধ্য পরমেশ্বর হিসেবে বর্ণিত, তা দিনের আলোর ন্যায় স্পষ্ট। 

এই পরমেশ্বর শিবের‌ই শক্তি পরা-অপরা ইত্যাদি বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত হয়ে আছে । প্রমাণ 👇 

ন তস্য কার্যং করণং চ বিদ্যতে

ন তৎসমশ্চাভ্যধিকশ্চ দৃশ্যতে।

পরাস্য শক্তিবিবিধৈব ক্রয়তে

স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চ।।৮

[তথ্যসূত্র : শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/অধ্যায় ৬/৭নং মন্ত্র]

অর্থ — মহেশ্বরের না কোনো কার্য করবার প্রয়োজন আছে, আর না তার করণীয় কিছু আছে, তার সমতুল্য কোথাও কাউকে দেখা যায়না, শিবের পরা শক্তি বিভিন্ন স্বরূপে প্রকাশিত হয়ে আছে, শিবের এই শক্তি স্বাভাবিক ভাবেই জ্ঞানময়, বল তথা ক্রিয়াশক্তি প্রভৃতি রূপে পরিচিত ॥ ৮


পরমেশ্বর শিবের থেকেই শক্তির উন্মেষ, তা স্বয়ং শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের শ্রুতি বলছে । 

 

♦️এবার এই শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের  এই ‘শিবের পরাশক্তি’ বিষয়ে ‘শ্রী শিবমহাপুরাণ’ বলেছে —

ইত্যাদিশিবসূত্রাণাং বার্তিকৈ কথিতং ময়া ।

জ্ঞানং বন্ধ ইতীদং তু দ্বিতীয়ং সূত্রমীশিতুঃ ॥ ৪৬

জ্ঞানমিত্যাত্মনস্তস্য কিঞ্চিজ্জ্ঞানক্রিয়াত্মকম্ ।

ইত্যাহাদ্যপদেনেশঃ পশুবর্গস্য লক্ষণম্ ॥ ৪৭

এতদ্দ্বয়ং পরাশক্তেঃ প্রথমং স্পন্দতাং গতম্ ।

এতামেব পরাং শক্তিং শ্বেতাশ্বতরশাখিনঃ ॥ ৪৮

স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চেত্যস্তুবন্মুদা ।

জ্ঞানক্রিয়েচ্ছারূপং হি শম্ভোর্দৃষ্টিত্রয়ং বিদুঃ ॥ ৪৯

(তথ্যসূত্র : শিবমহাপুরাণ/কৈলাস সংহিতা/১৬ অধ্যায়/৪৬-৪৯ শ্লোক)

অর্থ — এই প্রকারে শিবসূত্রের ব্যাখ্যা করলাম । এবার ‘জ্ঞান বন্ধঃ’ এই হল শিবসূত্রের দ্বিতীয় সূত্র ॥ ৪৬

এই সূত্রে পশু(জীব) বর্গদের লক্ষণ বলা হয়েছে । এই সূত্রের আদি পদ ‘জ্ঞান’ শব্দের দ্বারা কিঞ্চিৎ মাত্র জ্ঞান আর ক্রিয়া হ‌ওয়াই জীবের লক্ষণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে । এই জ্ঞান আর ক্রিয়া পরাশক্তির প্রথম স্পন্দন, কৃষ্ণ-যজুর্বেদের শ্বেতাশ্বতর শাখার অধ্যয়নকারী বিদ্বানেরাস্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চ’ - এই শ্রুতি দ্বারা এই পরাশক্তির‌ই স্তব করেছেন । পরমেশ্বর শম্ভুর শক্তিকে তিন ধরনের দৃষ্টিতে ‘জ্ঞান, ক্রিয়া ও ইচ্ছারূপ’ হিসেবে এখানে দেখা হয়েছে ॥ ৪৭-৪৯


🔲◼️◾▪️বিশ্লেষণ : শিব মহাপুরাণ এর বচন থেকে স্বাভাবিকভাবেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে স্পষ্টভাবে পরমেশ্বর শিবের‌ই মহিমা গায়ন করা হয়েছে। শিব মহাপুরাণে শ্বেতাশ্বতর শাখা বলে উল্লেখ তো করা হয়েছেই, তারই সাথে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ‘পরাস্য শক্তি’ ও ‘স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চ’ পদের শ্রুতিমন্ত্র পর্যন্ত উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, ঐ পরাশক্তি শিবের‌ই, যা তিন প্রকারের ।

🔥 সিদ্ধান্তশ্বেতাশ্বতর উপনিষদকে শিবমহাপুরাণের বচন দ্বারা পরমেশ্বর শিবের‌ই মহিমায় পরিপূর্ণ বলে প্রমাণ করা হল ।

সুতরাং, শক্তিসমন্বিত পরমেশ্বর শিব‌ই শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বর্ণিত একমাত্র পরম আরাধ্য পরমব্রহ্ম পরমেশ্বর ।

________________________________________________

(প্রশ্ন - ২) শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের বেদবাক্য অনুসারে জগত উৎপত্তির কারণ কি ?


✅ উত্তর : শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ অর্থাৎ শ্রুতি অনুসারে, জগতের কারণ হল পরমেশ্বর শিবের যে পরাশক্তি রয়েছেন, সেই দেবী পরাশক্তিই সমগ্র জগত উৎপত্তির একমাত্র কারণ। প্রমাণ 👇

তে ধ্যানযোগানুগতা অপশ্যন্ 

দেবাত্মশক্তিং স্বগুণৈর্নিগূঢ়াম্

যঃ কারণানি নিখিলানি তানি

কালাত্মযুক্তান্যধিতিষ্ঠত্যেকঃ ॥ ৩

[তথ্যসূত্র : শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/অধ্যায় ১/৩নং মন্ত্র]

অর্থ — ঋষিরা গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে দেখলেন, পরমাত্মা পরমশিবের পরাশক্তিই এই জগত উন্মেষের একমাত্র কারণ। দেবীশক্তিই তার তিন গুণের সাহায্যে সেই পরমাত্মা শিবকে যেন এই বিশ্বের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছে (তাই মায়ায় আবদ্ধ জীব নিজের আত্মরূপ পরমাত্মা শিব সম্পর্কে জানতে পারে না)। কিন্তু সেই এক এবং অদ্বিতীয় পরমাত্মা শিবই - 'পুরুষ' বা জীবাত্মা এবং জগতের নিখিল কারণরূপী ঐ শক্তি তথা জগত ইত্যাদি সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করছেন, যা শিবেই স্থিত।

পরমেশ্বর শিবের এই শক্তি থেকেই জগৎ উৎপত্তি লাভ করেছে, তা স্বয়ং শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের শ্রুতি বলছে । 

♦️এবার শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের এই ‘শিবের পরাশক্তিই জগতের কারণ’ শ্রুতি মন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে 

 ‘দেবীভাগবত মহাপুরাণ’ বলেছে —

তদা শিবামবিজ্ঞায় দুঃখস্যান্তো ভবিষ্যতি ।

অত এব শ্রুতৌ প্রাহুঃ শ্বেতাশ্বতরশাখিনঃ ॥ ১০

তে ধ্যানযোগানুগতা অপশ্যন্ ।

দেবাত্মশক্তিং স্বগুণৈর্নিগূঢ়াম ॥ ১১

(তথ্যসূত্র : দেবী ভাগবত মহাপুরাণ/৭ম স্কন্ধ/২৯ অধ্যায়/১০-১১ শ্লোক)

অর্থ — পরমেশ্বর শিবের যে শক্তি (দেবী শিবা) রয়েছে সেই শিবাতত্ত্বের জ্ঞান ছাড়া সংসারের দুঃখভোগের নাশ হয় না । অতএব, এই কারণেই শ্বেতাশ্বতর শাখার অধ্যয়নকারী বিদ্বানব্যক্তিগণ শ্রুতিতে(বেদের শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের অন্তর্গত ১ম অধ্যায়ে) বলেছেন, ধ্যানযোগের অনুগত হয়ে দেখেছিলেন যে, পরমাত্মা পরমশিবের পরাশক্তিই এই জগত উন্মেষের একমাত্র কারণ। দেবীশক্তিই তার তিন গুণের সাহায্যে সেই পরমাত্মা শিবকে যেন এই বিশ্বের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছে ( তাই মায়ায় আবদ্ধ জীব নিজের আত্মরূপ পরমাত্মা শিব সম্পর্কে জানতে পারে না) ॥ ১১


🔲◼️◾▪️বিশ্লেষণ : শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে পরমেশ্বর শিবের‌ যে পরাশক্তি রয়েছে , সেই পরাশক্তিই জগতের একমাত্র কারণ। দেবী ভাগবত মহাপুরাণ - এর বচনেও সেই এক‌ই সমর্থন বাক্য উল্লেখিত হয়েছে।

 দেবীভাগবত মহাপুরাণে শ্বেতাশ্বতর শাখা বলে উল্লেখ তো করা হয়েছেই, তারই সাথে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ‘দেবাত্মশক্তিং স্বগুণৈর্নিগূঢ়াম’ পদের শ্রুতিমন্ত্র পর্যন্ত উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, ঐ  শিবের‌ই পরাশক্তি, জগতের একমাত্র কারণ ।

🔥 সিদ্ধান্ত — শ্বেতাশ্বতর উপনিষদকে দেবী ভাগবত মহাপুরাণের বচন দ্বারা শিবের পরাশক্তি তথা সর্বোপরি পরমেশ্বর শিবের মহিমায় পরিপূর্ণ বলে প্রমাণ করা হল । সুতরাং, শক্তিসমন্বিত পরমেশ্বর শিব‌ই শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বর্ণিত একমাত্র জগতের কারণ বলে প্রমাণিত । 

________________________________________________


(প্রশ্ন - ৩) শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের যিনি বক্তা তথা শ্বেতাশ্বতর শাখার যিনি প্রতিষ্ঠাতা সেই মহর্ষি শ্বেতাশ্বতর কি শৈব আচার্য ছিলেন ?


✅ উত্তর :

অবশ্য‌ই ! মহর্ষি শ্বেতাশ্বতর জী  নিঃসন্দেহে শৈব আচার্য ছিলেন, তিনি বেদ ও শৈবাগম সমন্বিত মহাপাশুপত শৈব গুরুপরম্পরার প্রথম শৈব আচার্য ছিলেন । প্রমাণ দেখুন,

🔘♦️🔘 সৌরপুরাণ থেকে — 

সূত উবাচ ।

যোঽসৌ শিখণ্ডিনঃ পুত্রো ব্রহ্মচর্যাশ্রমে রতঃ ।

অধীত্য বিধিবদ্বেদান্ পরং বৈরাগ্যমাস্থিতঃ ॥ ১৪

বিচারঃ শ্রেয়সে তস্য কদাচিৎ সমভূদ্দ্বিজাঃ ।

প্রবৃত্তঞ্চ নিবৃত্তঞ্চ কৰ্ম যদ্দ্বিবিধং মতম্ ।

তয়োরাত্যন্তিকী মুক্তিৰ্ম্মম কেন ভবিষ্যতি ॥ ১৫

ইতি সঞ্চিন্ত্য মনসা জগাম হিমবদ্গিরিম্ ॥ ১৬

তত্র ধর্মবনং নাম মুনিসিদ্ধৈর্নিষেবিতম । 

অপশ্যদ্‌যোগিভিজুর্ষ্টং মহাদেবকৃতালয়ম্ ॥ ১৭

যত্র সিদ্ধা মহাত্মানো মরীচ্যাদ্যা মহর্ষয়ঃ।

নারায়ণশ্চ ভগবাংস্তথা চান্যে সুরাসুরাঃ ॥ ১৮

সমারাধ্য মহাদেবং সিদ্ধিং প্রাপ্তা হ্যনেকশঃ ॥ ১৯

যত্র মন্দাকিনী গঙ্গা রাজতে হ্যঘহারিণী ।

অপশ্যদাশ্রমং তস্যাস্তীরে যোগীন্দ্রসেবিতম্ ॥ ২০ 

মন্দাকিনীজলে তত্র স্নাত্বাভ্যর্চ্চ্য মহেশ্বরম্ । 

মহাদেবকথাযুক্তৈঃ স্তুত্বা স বিবিধৈঃ স্তবৈঃ।

ধ্যায়মানঃ ক্ষণং তত্র স্থিতো বিশ্বেশ্বরং শিবম্ ॥ ২১

শ্বেতাশ্বতরনামানমথাপশ্যন্মহামুনিম্

মহাপাশুপতং শান্তং জীর্ণকৌপীনবাসসমৃ ।

ভস্মোদ্ধূলিতসৰ্বাঙ্গং ত্রিপুণ্ড্ৰতিলকান্বিতম্ ॥ ২২ 

অভিবন্দ্য মুনেঃ পাদৌ শিরসা প্রাঞ্জলির্নৃপঃ ।

অব্রবীৎ তং মুনিশ্রেষ্ঠং সৰ্বভূতানুকম্পিনম্ ॥ ২৩

অদ্য ধন্যঃ কৃতার্থোঽস্মি সফলং জীবিতং মম ৷

তপাংসি সফলান্যেব জাতানি তব দর্শনাৎ ॥ ২৪

ভবামি তব শিষ্যোঽহং রক্ষ সংসারজাদ্ভয়াৎ ।

যোগ্যতা মম চেদন্তি শিষ্যোঽহং ভবিতুং তব ॥ ২৫

সোঽনুগৃহ্যাথ পুত্রত্বে রাজানং মুনিপুঙ্গবাঃ ।

কায়য়িত্বা স সন্ন্যাসং দদৌ যোগমনুত্তমম্ ॥ ২৬

যত্তৎ পাশুপতং যোগমন্ত্যাশ্রমমিতি শ্রুতম্।

গুহ্যং তৎ সর্ববেদেষু বেদবিদ্ভিরনুষ্ঠিতম্ ॥ ২৭ 

অনুগ্রহান্মুনেস্তস্য সোঽপি পাশুপতোঽভবৎ । 

বেদাভ্যাসরতঃ শান্তো ভস্মনিষ্ঠো জিতেন্দ্রিয়ঃ ।

সন্ন্যাসবিধিমাশ্রিত্য সুশীলো মুক্তিমান্ ভবেৎ ॥ ২৮

(তথ্যসূত্র : সৌরপুরাণ/২৭ অধ্যায়/১০-১১ শ্লোক)

অর্থ — সূত বলিলেন, ঐ যে শিখণ্ডীর পুত্র, উনি ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বনপূর্বক যথাবিধি বেদ অধ্যয়ন করে এরপরে বৈরাগ্যে আস্থাবান হলেন। হে দ্বিজগণ ! কোন সময়ে তার শ্রেয়বিচার মনে উপস্থিত হয়। “প্রবৃত্ত-নিবৃত্ত” নামক যে দুইপ্রকারের কৰ্ম আছে, সেসবের থেকে ঊর্ধ্বে যে মুক্তি আছে, সেই মুক্তি আমার হবে কিভাবে  ? — মনে মনে এই চিন্তা করে রাজা হিমালয়পর্বতে মুনিসিদ্ধ-সেবিত ধৰ্মবনে গেলেন। ধর্মবনে ঋষি- সেবিত শিবালয় দেখতে পেলেন ; সেখানে মরীচি প্রভৃতি মহর্ষিগণ, সিদ্ধগণ, ভগবান নারায়ণ হরি এবং অন্য দেবদানবেরা অনেকেই শিবারাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছেন। ৭-১৯।

সেখানে পাপহারিণী মন্দাকিনী গঙ্গা বিরাজমানা ; গঙ্গাতীরে যোগীন্দ্র-সেবিত এক আশ্রম দর্শন করলেন। রাজা সেখানে মন্দাকিনী-জলে স্নান, শিবপূজা এবং শিবকথাযুক্ত বিবিধ স্তোত্র দ্বারা শিবস্তব করে বিশ্বেশ্বর শিবকে ধ্যান করতে থেকে ক্ষণকাল সেখানে থাকলেন। অনন্তর তিনি মহাপাশুপত, শান্ত, জীর্ণ- কৌপীন-পরিধান, তার অঙ্গের সর্বত্র ভস্মে আবৃত , ত্রিপুণ্ড্রধারী, শ্বেতাশ্বতর নামক মহামুনিকে দেখতে পেলেন ।

রাজা, মুনির চরণযুগল বন্দন করে, সর্ব্বভূতে দয়ালু সেই মুনিকে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন, আজ আমি ধন্য ও কৃতার্থ হলাম, আমার জীবন সার্থক হল; আপনার দর্শনহেতু তপস্যাও সফল হল। আপনার শিষ্য হবার যদি আমার যোগ্যতা থাকে তাহলে আমাকে আপনার শিষ্য করুন, আমাকে সংসারভীতি হতে বিমুক্ত করুন। হে মুনি- বরগণ!  শ্বেতাশ্বতর, রাজাকে পুত্রের মতো দৃষ্টিতে দেখে অনুগ্রহ প্রদর্শন করে সন্ন্যাস আশ্রম অবলম্বন করিয়ে সেই অত্যুত্তম যোগ প্রদান করিলেন,  যা অন্ত্যাশ্রম(অতিবর্ণাশ্রম/শিবাশ্রম) লভ্য এবং পাশুপত নামে অভিহিত। সেই যোগ সর্ব্ববেদের গুহ্য বিষয়, কিন্তু বেদজ্ঞগণের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়। মুনি শ্বেতাশ্বতরের অনুগ্রহে রাজা সুশীলও পাশুপত হইলেন। তিনি বেদাভ্যাসনিরত, ভস্মনিষ্ঠ ও জিতেন্দ্রিয় হয়ে সন্ন্যাস-বিধি আশ্রয় করবার কারণে মুক্তিলাভ করলেন। ২০-২৯


🔘♦️🔘 আরো দেখুন, এই এক‌ই ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, 

কূর্ম পুরাণ থেকে — 

মন্দাকিনীজলে স্নাত্বা সন্তর্প্য পিতৃ-দেবতাঃ ।

অর্চ্চয়িত্বা মহাদেবং পুষ্পৈঃ পদ্মোৎপলাদিভিঃ ॥ ২৮ 

ধ্যাত্বার্কসংস্থং ঈশানং শিরস্যাধায় চ অঞ্জলিম্ । 

সম্প্রেক্ষমাণো ভাস্বন্তং তুষ্টাব পরমেশ্বরম্ ॥ ২৯ 

রুদ্রাধ্যায়েন গিরিশং রুদ্রস্য চরিতেন চ ।

অন্যৈশ্চ বিবিধৈঃ স্তোত্রৈঃ শাম্ভবৈর্বেদসম্ভবৈঃ ॥ ৩০ 

অথাস্মিন্নন্তরেহপশ্যৎ সমায়ান্তং মহামুনিম্ ।

শ্বেতাশ্বতরনামানং মহাপাশুপত উত্তমম্ ॥৩১ 

ভস্মসন্দিগ্ধসর্বাঙ্গং কৌপীনাচ্ছাদনান্বিতম্।

তপসা কর্শিতাত্মানং শুক্লযজ্ঞোপবীতিনম্॥৩২

সমাপ্য সংস্তবং শন্ডোরানন্দাস্রাবিলেক্ষণঃ।

ববন্দে শিরসা পাদৌ প্রাঞ্জলির্বাক্যমব্রবীৎ ॥ ৩৩

ধন্যোহস্ম্যনুগৃহীতোহস্মি যন্মে সাক্ষান্মুনীশ্বরঃ । 

যোগীশ্বরোহদ্য ভগবান্ দৃষ্টো যোগবিদাংবরঃ ॥ ৩৪

অহো মে সুমহদ্ভাগ্যং তপাংসি সফলানি মে ।

কিং করিষ্যামি শিষ্যোহহং তব মাং পালয়ানঘ ॥ ৩৫ সোহনুগৃহ্যাথ রাজানং সুশীলং শীলসংযুতম্ ।

শিষ্যত্বে প্রতিজগ্রাহ তপসা ক্ষীণকল্মষম্ ॥ ৩৬

সান্ন্যাসিকং বিধিং কৃৎস্নং কারয়িত্বা বিচক্ষণঃ।

দদৌ তদৈশ্বরং জ্ঞানং স্বশাখাবিহিতব্রতম্ ॥ ৩৭

অশেষং বেদসারং তৎ পশুপাশবিমোচনম্ ।

অন্ত্যাশ্রমমিতি খ্যাতং ব্রহ্মাদিভিরনুষ্ঠিতম্ ॥৩৮

উবাচ শিষ্যান্ সম্প্রেক্ষ্য যে তদাশ্রমবাসিনঃ ।

ব্রাহ্মণাঃ ক্ষত্রিয়া বৈশ্যা ব্রহ্মচর্য্যপরায়ণাঃ।৩৯

ময়া প্রবর্ত্তিতাং শাখামধীত্যৈবেহ যোগিনঃ।

সমাসতে মহাদেবং ধ্যায়ন্তো নিষ্কলং শিবম্ ॥ ৪০

ইহ দেবো মহাদেবো রমমাণঃ সহোময়া।

অধ্যাস্তে ভগবানী শো ভক্তানামনুকম্পয়া ॥৪১ 

ইহাশেষজগদ্ধাতা পুরা নারায়ণঃ স্বয়ম্।

আরাধয়ন্ মহাদেবং লোকানং হিতকাম্যয়া ॥৪২

ইহ তং দেবং ঈশানং দেবানামপি দৈবতম্।

আরাধ্য মহতীং সিদ্ধিং লেভিরে দেব দানবাঃ ॥ ৪৩

ইহৈব মুনয়ঃ সর্বে মরীচ্যাদ্যা মহেশ্বরম্।

দৃষ্টা তপোবলাজ জ্ঞানং লেভিরে সার্বকালিকম্ ॥ ৪৪

তস্মাৎ ত্বমপি রাজেন্দ্র তপোযোগসমন্বিতঃ।

তিষ্ঠ নিত্যং ময়া সার্দ্ধং ততঃ সিদ্ধিমবাপ্স্যসি॥ ৪৫

এবমাভাষ্য বিপ্রেন্দ্রো দেবং ধ্যাত্বা পিনাকিনম্

আচচক্ষে মহামন্ত্রং যথাবৎ সর্বসিদ্ধয়ে ॥ ৪৬

সর্বপাপোপশমনং বেদসারং বিশুদ্ধিদম্!

অগ্নিরিত্যাদিকং পুণ্যমৃষিভিঃ সম্প্রবর্তিতম্ ॥‌ ৪৭

সোহপি তদ্বচনাদ্রাজা সুশীলঃ শ্রদ্ধয়াবিতঃ।

সাক্ষাৎ পাশুপতো ভূত্বা বেদাভ্যাসরতোহভবৎ ॥ ৪৮ 

ভস্মোদ্ধুলিতসর্বাঙ্গঃ কন্দ-মূলফলাশনঃ।

শান্তো দন্তো জিতক্রোধঃ সন্ন্যাসবিধিমাশ্রিতঃ ॥ ৪৯

[তথ্যসূত্র : নবভারত প্রকাশিত ‘কূর্মমহাপুরাণ/পূর্বভাগ/১৪ অধ্যায়/২৮-৪৯ শ্লোক’] ( গীতাপ্রেসের হিন্দি ভাষায় প্রকাশিত ‘কূর্মপুরাণ/পূর্বভাগ/১৩ তম অধ্যায়/২৮-৪৯ নং শ্লোক’)

🌷 অর্থ — মন্দাকিনীজলে স্নান, পিতৃ ও দেবতাদের উদ্দেশ্যে তর্পণ এবং পদ্মোৎপলাদি পুষ্পদ্বারা মহাদেবের অর্চ্চনা করলেন এবং মস্তকে অঞ্জলি বন্ধনপূর্ব্বক অর্কসংস্থ ঈশানকে ধ্যান করে অতি তেজোময় পরমেশ্বরকে দর্শন করে স্তব করতে লাগলেন। তিনি রুদ্রাধ্যায়(বেদের শতরুদ্রিয়), রুদ্রচরিত ও অন্যান্য বিভিন্ন বেদ- সম্ভব শাম্ভব স্তোত্রদ্বারা গিরিশের স্তব করলেন । এই সময়ে তিনি দেখলেন যে, মহাপাশুপত, ভস্ম দ্বারা আচ্ছাদিত দেহধারী, কৌপীনধারী, তপস্যা দ্বারা কৃশতনু, শুক্ল যজ্ঞোপবীতধারী শ্বেতাশ্বতর নামের মহামুনি আসছেন। সুশীল শম্ভুর স্তব সমাপন করে আনন্দের অশ্রুপরিপূরিত চোখে নিজের মস্তক দ্বারা মহামুনির চরণযুগল বন্দনা করিলেন এবং হাতজোড় করে বললেন, – এখন আমি ধন্য ও অনুগৃহীত হলাম। যেহেতু যোগবিদ গণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ভগবান্ যোগীশ্বরকে সাক্ষাৎ দর্শন করলাম। অহো আমার কি পরম সৌভাগ্য। আমার তপস্যা সফল হয়ে গেল। আমি আপনার শিষ্য, কি করবো আমি ? অনুমতি করুন। হে অনঘ! আমাকে রক্ষা করুন। 

অনন্তর শ্বেতাশ্বতর মুনি তপস্যা দ্বারা নিষ্পাপ ও সচ্চরিত্র রাজার প্রতি অনুগ্রহ করে তাকে নিজের শিষ্য বলে স্বীকার করলেন। বিচক্ষণ মুনি সমস্ত সান্ন্যাসিক বিধির অনুষ্ঠান করিয়ে ঐশ্বর জ্ঞান ও স্বশাখাবিহিত (নিজের শ্বেতাশ্বতর শাখার) ব্রত প্রদান করলেন। ঐ জ্ঞান অসীম, বেদের সারভূত ও পশুপাশবিমোচক এবং ঐ ব্রত ব্রহ্মবাদিগণের দ্বারা অনুষ্ঠিত অন্ত্যাশ্রম(অত্যাশ্রম/অতিবর্ণাশ্রম) নামে বিখ্যাত। পরে তিনি তদাশ্রমবাসী ব্রহ্মচর্য্য পরায়ণ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য আদি শিষ্যদের প্রতি তাকিয়ে মহর্ষি শ্বেতাশ্বতর বললেন,— এই যোগীগণ আমার প্রবর্তিত শ্বেতাশ্বতর শাখা অধ্যায়ন করে নিষ্কল মহাদেব শিবের ধ্যান করবার জন্য এই স্থানে স্থিত আছেন। 

 ভগবান দেবাদিদেব মহাদেব ভক্তগণের কামনা অনুকম্পা হেতু উমার সহিত ক্রীড়া করবার জন্য এই স্থানে অবস্থান করে থাকেন। সমস্ত লোকের বিধাতা স্বয়ং নারায়ণ লোকসমূহের হিতকামনায় পূর্বকালে এই স্থানে পরমেশ্বর মহাদেবের আরাধনা করেছিলেন। দেবতাদের‌ও দেবতা দেব ঈশানকে এই স্থানেই আরাধনা করে দেব-দানবগণ মহতী সিদ্ধিলাভ করেছেন। এই স্থানে মরীচ্যাদি মুনিগণ তপোবলপ্রভাবে মহেশ্বরকে দর্শন করে সার্বকালিক জ্ঞান লাভ করেছেন। হে রাজেন্দ্র! সেইজন্য তুমি তপোযোগে-সমন্বিত হয়ে আমার সহিত এই স্থানে এখন সর্বদা অবস্থান করো ; তবেই সিদ্ধিলাভ করতে পারবে। বিপ্রশ্রেষ্ঠ মুনি এভাবে বলে পিনাকী মহাদেবের ধ্যান করে সর্বসিদ্ধির জন্য যথাবিধি সর্বপাপনাশক, বেদসার, বিমুক্তিপ্রদ, ঋষিগণের দ্বারা সংপ্রবর্তিত, পুণ্যজনক, “অগ্নিরিতি” ইত্যাদি মহামন্ত্র উপদেশ করলেন। রাজা সুশীলও এগুলি মুনিবচন হবার কারণে সেই বচনের প্রতি শ্রদ্ধাযুক্ত ও সাক্ষাৎ পাশুপত হয়ে বেদ অভ্যাসে রত হলেন। তিনি সন্ন্যাসবিধি অবলম্বনপূর্বক সর্ব অঙ্গে ভস্মে ভূষিত করে কন্দ-মূল ফলাশী, শান্ত, দান্ত ও জিতক্রোধ হয়েছিলেন ॥ ২৮-৪৯


🔴 এবার দেখুন  🔴

শ্রী শিবমহাপুরাণ থেকে — 

শ্বেতাদ্যা নকুলীশান্তাঃ সশিষ্যাশ্চাপি দেশিকাঃ ।

তৎ সন্ততীয়া গুরবো বিশেষাদ্ গুরবো মম ॥ ১৬৮

শৈবা মাহেশ্বরাশ্চৈব জ্ঞানকর্মপরায়ণাঃ ।

কর্মেদমনুমন্যন্তাং সফলং সাধ্বনুষ্ঠিতম্ ॥ ১৬৯

(তথ্যসূত্র : শিবমহাপুরাণ/বায়বীয় সংহিতা/উত্তর খণ্ড/অধ্যায় ৩১/১৬৮-১৬৯ নং শ্লোক)

অর্থ — শ্বেত থেকে নকুলীশ পর্যন্ত, শিষ্য-সহ আচার্যগণ, তাঁদের সন্তান পরম্পরায় উৎপন্ন গুরুজন, বিশেষতঃ আমার গুরু, যারা শৈব মাহেশ্বর মার্গী, যাঁরা জ্ঞান ও কর্মে তৎপর থাকেন, তাঁরা যেন আমার এই কর্মকে সফল ও সুসম্পন্ন বলে মানেন ॥ ১৬৮-১৬৯


🔲◼️◾▪️বিশ্লেষণ : শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ তথা শ্বেতাশ্বতর শাখার যিনি স্থাপক সেই মহর্ষি শ্বেতাশ্বতর নিজের দেহের সর্বত্র ভস্ম ও ত্রিপুণ্ড্র ধারণ করেন, তিনি শৈব মহাপাশুপত পরম্পরাভুক্ত ছিলেন, তার নিজের বৈদিক শাখার নাম শ্বেতাশ্বতর শাখা, তার অন্তর্গত ই হল এই শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ , এই পরম্পরার ব্রত হল - পাশুপতব্রত । তার পরম্পরায় ‘অগ্নিরিতি ভস্ম বায়ুরিতি ভস্ম’ নামক অথর্ব-শির উপনিষদের বেদোক্ত মন্ত্রটি পাঠ করে ভস্ম ধারণ করা হয় । যারা এই পাশুপত পরম্পরাভুক্ত হন তিনি অন্ত্যাশ্রমী/অত্যাশ্রমী/ শিবাশ্রমী/অতিবর্ণাশ্রমী বলে কথিত । তারা সকলেই পরমেশ্বর শিবের ধ্যান করেন। তারা যে স্থানে থেকে শিব আরাধনা করেন সেখানেই মানুষ, দৈত্য-দানব, দেবতারা এমনকি শ্রীহরি নারায়ণ‌ও শিব আরাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছেন।

একথা সৌরপুরাণ ও কূর্মপুরাণ উভয় শাস্ত্র ই তা  স্পষ্টভাবে জানিয়েছে ।

এছাড়া শিবমহাপুরাণ সরাসরি শৈবপরম্পরার আচার্য হিসেবে শ্বেতাশ্বতরাচার্য থেকে শুরু করে নকুলীশাচার্য পর্যন্ত উল্লেখ করে দিয়েছে । 


🔥 সিদ্ধান্ত — মহর্ষি শ্বেতাশ্বতর যে শৈব আচার্য ছিলেন, আর শ্বেতাশ্বতর শাখাতে যে পরমেশ্বর শিবের‌ই মহিমা গায়ন করা হয় তা শাস্ত্র দ্বারা প্রমাণিত ।

________________________________________________


(প্রশ্ন - ৪) মহর্ষি শ্বেতাশ্বতরের প্রকৃত পরিচয় কি ? তিনি কে ? 

উত্তর :

পরমেশ্বর শিব নিজেই শ্বেতাশ্বতর রূপ ধারণ করে বেদোক্ত জ্ঞান ব্রহ্মা কে প্রদান করেছেন । প্রমাণ দেখুন 👇

শ্রী শিবমহাপুরাণ থেকে — 

তপসা তেন তীব্রেণ তুষ্টস্তস্য পিতা স্বয়ম্ ।

দিব্যং কৌমারমাস্থায় রূপং রূপবতাং বরঃ ॥ ৪

শ্বেতো নাম মুনির্ভূত্বা দিব্যাং বাচমুদীরয়ন্ ।

দর্শনং প্রদদৌ তস্মৈ দেবদেবো মহেশ্বরঃ ॥ ৫

তং দৃষ্ট্বা পিতরং ব্রহ্মা ব্রহ্মণোঽধিপতিং পতিম্ ।

প্রণম্য পরমজ্ঞানং গায়ত্র্যা সড় লব্ধবান্ ॥ ৬

(তথ্যসূত্র : শিবমহাপুরাণ/বায়বীয় সংহিতা/পূর্ব খণ্ড/অধ্যায় ৫/৪-৬নং শ্লোক)

🌷 অর্থ — তার(ব্রহ্মার) সেই তীব্র তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তার পিতা স্বয়ং দেবদেব মহেশ্বর তাঁকে দর্শন দেন। তিনি দিব্য কুমারের রূপ ধারণ করে রূপবানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শ্বেত নামক মুনি হয়ে দিব্য বাণী উচ্চারণ করতে করতে তাঁর সামনে উপস্থিত হন। বেদাধিপতি এবং সকলের পালকপিতা মহেশ্বরকে দর্শন করে গায়ত্রীসহ ব্রহ্মা তাঁকে প্রণাম করেন এবং তাঁর থেকেই উত্তম জ্ঞান লাভ করেন ॥ ৪-৬


🔲◼️◾▪️বিশ্লেষণ : মহর্ষি শ্বেতাশ্বতর মূলত স্বয়ং পরমেশ্বর শিবের‌ই প্রকাশিত অবতার স্বরূপ বলেই পরমপবিত্র শিবমহাপুরাণ নির্দেশ দিয়েছেন । পরমেশ্বর শিব কুমার বয়সী রূপ ধারণ করে ব্রহ্মাকে পরমজ্ঞান প্রদান করেছেন, তার সেই দিব্য মুনিরূপের নাম - শ্বেত ।


🔥 সিদ্ধান্ত — মহর্ষি শ্বেতাশ্বতরের প্রকৃত পরিচয় হল তিনি মূলত পরমেশ্বর শিব স্বয়ং ।  সেই পরমেশ্বর শিব নিজেই শ্বেতাশ্বতর রূপ ধারণ করে শ্বেতাশ্বতর শাখা স্থাপন করে তার দ্বারা সকল সৎপুরুষদের শৈবমার্গে পরিচালনা করে মোক্ষলাভ সম্ভব করে তোলেন । তাই শ্বেতাশ্বতর শাখার অন্তর্গত শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে যে পরমেশ্বর হিসেবে একমাত্র প্রভু শিবের‌ই বিভিন্ন মহিমার গায়ন করা হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহই নেই। 

________________________________________________

(প্রশ্ন - ৫) সেটা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের মন্ত্রের দ্বারা যে একমাত্র শিবকেই স্তুতি করা হয় এমন কি কোনো সরাসরি প্রমাণ উপলব্ধ আছে ?

উত্তর :

হ্যা ! অবশ্যই প্রমাণ উপলব্ধ রয়েছে। পদ্মপুরাণের পাতালখণ্ডের অন্তর্গত 

শ্রী শিবগীতা -র মধ্যে বলা হয়েছে —

শ্বেতাশ্বতরমন্ত্রেণ স্তুবন্তং গিরিজাপতিম্। অনন্তাদিমহানাগান কৈলাসগিরিসন্নিভান্ ॥ ৪২

(তথ্যসূত্র : পদ্মপুরাণ/পাতালখণ্ড/শিবগীতা/৪র্থ অধ্যায়/৪২ শ্লোক)

🌷 অর্থ — শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের বেদোক্ত মন্ত্রে তারা সকলে অনাদি অনন্ত দেবাদিদেব গিরিজাপতির স্তব করে চলেছেন। অনন্তাদি মহানাগগণও সেখানে পরমেশ্বর শিবের স্তব করে চলেছেন, তাদের দেহ কৈলাস পর্বতের ন্যায় বিপুলাকার ॥ ৪২


শ্রী শিবগীতাতে আরো বলা হয়েছে —

ভস্মাচ্ছন্নো ভস্মশায়ী সর্ব্বদা বিজিতেন্দ্রিয়ঃ।

যন্ত্র রুদ্রং জপেন্নিত্যং চিন্তয়েন্মামনন্যধীঃ।। ৬৷৷

স তেনৈব চ দেহেন শিবঃ সংজায়তে স্বয়ম্।। ৭।।

জপেদ যো রুদ্রসূক্তানি তথাথর্ব্বশিরঃ পরম্। কৈবল্যোপনিষৎসূক্তং শ্বেতাশ্বতরমেব চ।

ততঃ পরতরো ভক্তো মম লোকে ন বিদ্যতে।। ৮।।

(তথ্যসূত্র : পদ্মপুরাণ/পাতালখণ্ড/শিবগীতা/১৫ অধ্যায়/৬-৮ নং শ্লোক)

🌷 অর্থ — পরমেশ্বর শিব বললেন, যে ভক্ত সদা জিতেন্দ্রিয় হয়ে অর্থাৎ তার ইন্দ্রিয় সমূহ বশীভূত করে বা ইন্দ্রিয়গুলি সংযম করে সারা দেহে পবিত্র ভস্ম মেখে ভস্মাচ্ছন্ন হয়ে ভস্মে শয়ন পূর্বক একমনে রুদ্রমন্ত্র জপ করে এবং আমার চিন্তা পূর্বক ধ্যান করে ॥ ৬

ভস্মাচ্ছন্ন ও ভস্মশায়ী হয়ে যে ভক্ত একাগ্রচিত্তে সদা রুদ্রমন্ত্রজপ ও আমার ধ্যান করে, নিজের আত্মা থেকে অভিন্নভাবে আমাকে জ্ঞান করে। সেই ভক্ত দেহধারী হলেও মৎস্বরূপে বিরাজ করে থাকে অর্থাৎ সে ভক্ত সশরীরে শিবত্ব লাভ করে ॥ ৭

যে উপাসক বেদের রুদ্রসূক্ত নিয়মিত জপ করে এবং অথর্বশির, কৈবল্য ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের বেদমন্ত্র পাঠ করে আমার(শিবের) ধ্যান করে সে আমার পরম ভক্ত। এই উপাসকের মতো প্রিয় ভক্ত যেন আমার রুদ্রলোকেও পাওয়া যায় না ॥ ৮


[এছাড়াও — শ্রী শিবমহাপুরাণের বায়বীয় সংহিতার পূর্বখণ্ডের ৬ং অধ্যায়ে (মহেশ্বরের মহত্ত্বের প্রতিপাদন নামক অধ্যায়) - এ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের অবিকল মন্ত্র উপস্থাপন করে তা পরমেশ্বর শিবের বলে সরাসরি উল্লেখিত হয়েছে।]


🔲◼️◾▪️বিশ্লেষণ : শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের মন্ত্র পরমেশ্বর শিবের‌ বিষয়েই প্রতিপাদন করে, তাই দেবতারাও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের বৈদিক মন্ত্র পাঠ করেন। স্বয়ং পরমেশ্বর শিব নিজেই শ্রীরামচন্দ্র কে বলেছেন, যে ব্যক্তি শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের মন্ত্র পাঠ করে শিব উপাসনা করেন তিনি পরমেশ্বর শিবের পরম প্রিয় ভক্ত।

🔥 সিদ্ধান্ত — শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের বৈদিক মন্ত্র দ্বারা একমাত্র পরমেশ্বর শিবের‌ই স্তুতি করা হয়ে থাকে , প্রভু শিবকে ছাড়া অন্য কারোর স্তুতি করা হয় না ।

________________________________________________

(প্রশ্ন - ৬) আজকাল দেখা যায় যে বৈষ্ণবেরা তাদের শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ভাষ্য রচনা করে বিষ্ণুকে একমাত্র পরমেশ্বর বলে দাবী করছে, তাহলে বৈষ্ণবদের সেই সমস্ত ভাষ্য রচনাগুলি কি সঠিক নয় ?

স্মার্ত আদি শঙ্করাচার্য্য যে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ভাষ্য রচনা করেছেন, সেখানে তিনি শিবকেই শুধু পরমেশ্বর বলেননি, তিনি বলেছেন ব্রহ্মের বাচক সকল উপনিষদ, তাহলে শুধুমাত্র শিব কি করে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের একমাত্র পরমেশ্বর হবেন ? নাকি আদিশঙ্করাচার্যের ভাষ্য গ্রহণযোগ্য নয় ?

আবার অনেক নিরাকারবাদীরা (যেমন-আর্যসমাজ) বলেন শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে শিব বলতে পার্বতীদেবীর পতি মহাদেবকে বোঝানো হয়নি বরং শিব বা রুদ্র বলতে নিরাকার ব্রহ্মের দুঃখনাশক গুণকে রুদ্র এবং নিরাকার ব্রহ্মের কল্যানকারী গুণকে শিব বলে বোঝানো হয়েছে, তাহলে এগুলো কি সত্য নয় ?


উত্তর :

এই প্রশ্নগুলির উত্তর অবশ্যই রয়েছে, 

বর্তমানের অপপ্রচারগুলি হল —

🚫 আধুনিক কালে তথাকথিত বৈষ্ণবদের আচার্যগণ ‘শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ’-এর প্রত্যেক মন্ত্র কে নিজেদের বৈষ্ণবীয় মতবাদ অনুসারে, পরমেশ্বর শিবের স্থানে ভগবান শ্রীহরি বিষ্ণু কে স্থাপন করবার অপপ্রয়াস করে বসে আছেন । কেননা, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের বৈদিক মন্ত্রে পরমেশ্বর শিবের মাহাত্ম্য উল্লেখ রয়েছে, যদি ভগবান শ্রীহরি বিষ্ণুকে সর্বোচ্চ তথা একমাত্র পরমেশ্বর হিসেবে সমাজের কাছে তুলে ধরতে হয় তবে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের মধ্যে থাকা শিব মাহাত্ম্য তাদের কাছে বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাড়াবে, এই কারণে বৈষ্ণবদের আচার্যগণ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের মন্ত্রের প্রত্যেক অর্থকে ঘুরিয়ে ঐ মন্ত্রতে একমাত্র শ্রীহরিকেই শ্রেষ্ঠ বোঝানো হয়েছে বলে এমনটা দেখানোর চেষ্টা করে ভাষ্য রচনা করে গিয়েছেন। যা পুরাণ শাস্ত্রে উল্লেখিত শ্বেতাশ্বতর বিষয়ক নির্দেশ ও ইতিহাসের বিরুদ্ধে গিয়ে করা বৈষ্ণবদের অপকর্ম বলেই গণ্য হতে দেখা যাচ্ছে ।

🚫 স্মার্ত-আদিশঙ্করাচার্য পরমেশ্বর শিবের মাহাত্ম্যকে গৌণ করে শিব শব্দকে কিছুটা বিশেষণের পরিপ্রেক্ষিতে ঘুরিয়ে ব্যক্তিবাচক বিশেষ্য পদ ‘পার্বতীপতি’ থেকে সরিয়ে ব্রহ্মের গুণবাচক বিশেষন ‘মঙ্গলময়/কল্যানময়’ গুণ হিসেবে ব্যবহার করে ব্রহ্ম হিসেবে তুলে ধরে ভাষ্য করেছেন, এটি সমাজে শাঙ্করভাষ্য বলে পরিচিত। এই কর্ম‌ও সনাতন ধর্মের শাস্ত্র তথা শৈব পরম্পরার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে করা ষড়যন্ত্র মাত্র ।

🚫 কট্টর নিরাকার ব্রহ্মবাদী (যেমন - আর্যসমাজ) তথা অশৈব মতবাদের পরিপন্থী যারা তারা ‘শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ’ কে নিজেদের মতবাদ অনুসারে নিরাকার ব্রহ্মের কথা আছে বলে কুযুক্তি দিয়ে অম্বিকাপতি পরমেশ্বর শিবের মাহাত্ম্য কে নাকচ করে দেন।


এবার এই দিচ্ছি অপপ্রচারগুলির জবাব —

পুরাণ শাস্ত্রে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের বক্তা শ্বেতাশ্বতর শাখার স্থাপক মহর্ষি শ্বেতাশ্বতর স্বয়ং, যিনি স্বয়ং শৈব আচার্য ছিলেন, ঐ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের বৈদিক মন্ত্রে উমাপতি পরমেশ্বর শিবের‌ই মাহাত্ম্য রয়েছে বলে পুরাণ শাস্ত্র স্বীকৃতি দিয়েছে। সুতরাং যেখানে শৈবদের আচার্য পরম্পরার অন্তর্ভুক্ত শৈব আচার্যের মুখ নিঃসৃত বৈদিক মন্ত্র এই শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, সেখানে পুরাণের এই সকল প্রমাণকে অমান্য করে নিজের মনমতো যা ইচ্ছে তাই ভাষ্য করে দিয়ে পরমেশ্বর শিবের মাহাত্ম্যকে নাকচ করবার চেষ্টা করে শ্রীবিষ্ণুর মাহাত্ম্য স্থাপন করে দেওয়া শাস্ত্র বিরুদ্ধ কার্য, এক‌ইভাবে ব্রহ্মবাদে বা নিরাকার ব্রহ্মের অছিলায় পরমেশ্বর শিবের মাহাত্ম্যকে মুছে ফেলবার অপপ্রয়াস‌ও অধর্মের কাজ ।

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের বৈদিক মন্ত্রে উমাপতি পরমেশ্বর শিবের মাহাত্ম্য রয়েছে, তা পুরাণ শাস্ত্র স্বীকার করে নিয়েছে। তাই পুরাণের নির্দেশ বাক্য কে অশ্রদ্ধা করে অমান্য করে বেদের মনগড়া কাল্পনিক ব্যাখ্যা করলে  তার মতো অধার্মিককে দেখে বেদ‌ও ভয় পান, 

মহাভারত থেকে প্রমাণ দেখুন 👇 

ইতিহাসপুরাণাভ্যাং বেদং সমুপবৃংহয়েৎ।

বিভেত্যল্পশ্রুতাদ্বেদো মাময়ং প্রহরিষ্যতি ॥২২৯

[তথ্যসূত্র : মহাভারত/আদিপর্ব/অধ্যায় ১/২২৯ নং শ্লোক]

🌷 অর্থ — ইতিহাস ও পুরাণশাস্ত্র দ্বারা বেদকে বর্ধিতপূর্বক ব্যাখ্যা করবে; নইলে 'এ আমাকে প্রহার করবে' এটি ভেবে বেদ অজ্ঞ লোক হতে ভয় পেয়ে থাকেন ॥২২৯


ব্যাখ্যা - ইতিহাস ও পুরাণশাস্ত্র পাঠ করলে তা থেকে বিভিন্ন পুরাতন কাহিনী জানা যাবে, যেমন - প্রাচীন ঋষি-মুনি সহ বিভিন্ন মহাপুরুষদের জীবন যাপন, তাদের বেদ পাঠের মাধ্যম, বেদবাণীর সঠিক প্রয়োগ, দেবতা তথা পরমেশ্বরের বিভিন্ন লীলা ও রীতিনীতি সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। এই পুরাণ সম্পর্কে অবগত না হয়ে যে ব্যক্তি বেদ পাঠ করে, সে বেদবাণীর ভুল অর্থ বের করে, ভুল ব্যাখ্যা বের করে প্রচার করে এবং সেই নিজস্ব ধারণায় পুষ্ট ভ্রমটিকেই সত্য বলে ভাবে। ফলে বেদ বানীর অর্থ বিকৃত হয়ে সমাজে ঐ বিকৃত অর্থ ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকেও ভুল পথে পরিচালিত করে, ধর্মের প্রকৃত অর্থ প্রচারের স্থানে ত্রুটিপূর্ণ অর্থ প্রচার হলেৎএতে ধর্মের অবনতি হয়। তাই উপমা হিসেবে বলা হয়েছে যে এধরণের ব্যক্তিদের কে বেদ ভয় করেন। কারণ এতে বেদের বাণী বিকৃত করার অর্থ বেদের উপর আঘাত করা বোঝানো হয়েছে।

তাই যারা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের বৈদিক মন্ত্রের অর্থ কে পুরাণশাস্ত্রের প্রাচীন বৃত্তান্ত অনুসারে ব্যাখ্যা না করে নিজেদের মনের মতো করে ব্যাখ্যা করে চলেছে সেইসব অধার্মিক বৈষ্ণব, স্মার্ত আদি শঙ্করাচার্য্যবাদী, নিরাকারবাদীদের স্বয়ং বেদ‌ই সহ্য করতে পারেন না।

♦️ বেদকে সর্বদা পুরাণ শাস্ত্র অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা উচিত, গৌতমধর্ম সূত্র বলছে —

তস্য চ ব্যবহারো বেদোধর্মশাস্ত্রাণ্যঙ্গান্যুপবেদাঃ পুরাণম।

[তথ্যসূত্র : গৌতম ধর্মসূত্র(বেদাঙ্গশাস্ত্র)/১১/১৯]

🌷অর্থ  — বেদ, ধর্মশাস্ত্র (স্মৃতি), অঙ্গ (কল্প বেদাঙ্গ) ও পুরাণশাস্ত্রের ভিত্তিতে ন্যায়বিচার হওয়া উচিত।

তাই যে ব্যক্তি শাস্ত্রের দেওয়া বিধানকে শ্রদ্ধাসহিত মান্য না করে নিজের ইচ্ছামত শাস্ত্রের বিধানের সাথে অপব্যবহার করে তাদের মতো অপব্যাখ্যাকারীদের উদ্দেশ্যে 

শ্রীমদ্ ভগবদ্গীতা বলছে —

যঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ততে কামকারতঃ।

ন স সিদ্ধিমবাপ্নোতি ন সুখং ন পরাং গতিম্ ॥ ২৩

[তথ্যসূত্র – ভগবদ্ গীতা/অধ্যায় ১৬/২৩ নং শ্লোক]

🌷 অর্থ — যে ব্যক্তি শাস্ত্রের দেওয়া আদেশ মান্য না করে নিজের যা ইচ্ছা তাই করে, সেই ব্যক্তি না কোনো সুখ পান আর না তার পরমগতি(মুক্তিলাভ) হয় ॥ ২৩


🔲◼️◾▪️বিশ্লেষণ : বেদসহ পুরাণশাস্ত্রের ভিত্তিতেই সর্বদা সিদ্ধান্ত নিতে হবে, নচেৎ পুরাণের ঘটনার বিবরণ ও ইতিহাসকে অমান্যকারী কল্পিত বৈদিক ভাষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। তাই পুরাণে বর্ণিত শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের বৈদিক মন্ত্রের অর্থ পরমেশ্বর শিবের‌ই বাচক বলে যেহেতু স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছে, তথা পুরাণ শাস্ত্র শ্বেতাশ্বতর কে শৈবপরম্পরার অন্তর্ভুক্ত বলেছেন, সেই কারণে পুরাণের এই বচনকে গ্রহণ করতে হবে। 

এই কারণে, বৈষ্ণব,নব্যশাক্ত,স্মার্ত শঙ্করাচার্যপন্থী বা কট্টর নিরাকার ব্রহ্মবাদী তথা অশৈব মতবাদের পরিপন্থী ব্যক্তিবর্গ তাদের রচিত তথাকথিত অশৈবভাষ্য দ্বারা কখনোই শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের কোনো মন্ত্রকে ব্যবহার করে নিজেদের মতবাদকে শ্রেষ্ঠ বলে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না। বৈষ্ণবদের রচিত শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের নকল ভাষ্য পরিত্যাজ্য, স্মার্ত বা কট্টর নিরাকারবাদীদের‌ও রচিত শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ভাষ্য সর্বদা পরিত্যাজ্য। এই সকল ভাষ্যের উপর নির্ভর করে পরমেশ্বর শিবের মাহাত্ম্য কে খণ্ডানো অসম্ভব। 


🔥 সিদ্ধান্ত — শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের বৈদিক মন্ত্রের অপব্যাখ্যা করা অশৈবভাষ্য গুলি অগ্রহণযোগ্য, একমাত্র পরমেশ্বর শিবের মাহাত্ম্য হিসেবে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের বৈদিক মন্ত্র সর্বদা গ্রহণযোগ্য, অন্য কোনো তথাকথিত ব্রহ্ম বা শ্রীবিষ্ণু নয় ।


________________________________________________


🔲◼️◾▪️▪️▪️ অন্তিম নির্ণয় ▪️▪️▪️▪️◾◼️🔲

(১) শ্বেতাশ্বতর স্বয়ং পরমেশ্বর শিবের অবতার,

(২) তিনি মহাপাশুপত শৈব পরম্পরার প্রথম আচার্য,

(৩) তিনি শিরমন্ত্রে ভস্ম-ত্রিপুণ্ড্র, রুদ্রাক্ষ ধারণ করতেন,

(৪) তার অনুসারী সকলে ঐ নিয়ম অনুযায়ী চলেন,

(৫) তিনি ও তার শিষ্যরা পাশুপতী অতিবর্ণাশ্রমী ছিলেন,

(৬) তারা শিবপূজার মাধ্যমেই মোক্ষলাভের পথ দেখান,

(৭) তার দ্বারা নির্মিত বেদোক্ত শাখার নাম শ্বেতাশ্বতরশাখা,

(৮) শ্বেতাশ্বতর শাখার অন্তর্গত শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ,

(৯) শ্বেতাশ্বতর শৈবাচার্যের বানী হল শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ,

(১০) শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ প্রভু শিবকেই একমাত্র পরমেশ্বর বলে স্বীকার করেছেন ।

(১১) শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ তথা বেদের কোনো কিছুর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সেই ব্যাখ্যা যদি ইতিহাস-পুরাণ শাস্ত্রে থাকা নির্দেশনার সমর্থনপ্রাপ্ত হয় তবেই তা গ্রহণযোগ্য, নচেৎ অবার্চীন কাল্পনিক ভাষ্য গ্রহণযোগ্য নয়, তা বৈষ্ণবদের বানানো ভাষ্য হোক, আদি শঙ্করাচার্যের রচিত ভাষ্য হোক অথবা কট্টর নিরাকারবাদী তথা আর্যসমাজী হোক, ইতিহাস-পুরাণের বিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয় ।


শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩 

হর হর মহাদেব 🚩 


✍️ সত্য উন্মোচনে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী 

©️ কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ