শাস্ত্র অমান্যকারী ব্যক্তির শাস্তি ও ধার্মিক ব্যক্তির করণীয় কর্তব্য

Punishment for those who disobey the scriptures


॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥

আমরা এমন একটি কালে এসে পৌঁছে গিয়েছি, যেখানে বহু ব্যক্তির দ্বারা শাস্ত্রের বচনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে অমান্য করতে দেখছি ।

সনাতন ধর্ম কে সঠিকভাবে বোঝবার জন্য পরমেশ্বর শিব নিজেই আগম, বেদ, পুরাণ ইত্যাদি সকল প্রকার শাস্ত্র প্রণিত করেছেন । আমাদের মতো সাধারণ জীবেদের জন্য কোন কার্য উচিত আর কোনটি অনুচিত, সে বিষয়ে স্থান কাল পাত্র বিশেষে প্রত্যেক ক্ষেত্রে নির্দেশনা রয়েছে সেই শাস্ত্রে। পরমেশ্বরের বিভিন্ন লীলার প্রমাণ, পরমতত্ত্ব প্রকৃত পক্ষে কেমন তা সমগ্র শাস্ত্রে বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করেছেন পরমেশ্বর নিজেই । 

যিনি প্রকৃতপক্ষে আস্তিক সনাতনী ব্যক্তি, তিনি কখনোই পরমেশ্বরের প্রকাশিত সনাতন ধর্মের এই দলিলরূপী শাস্ত্রসমূহকে অবজ্ঞা করবেন না । কারণ, পরমেশ্বর কোন লীলা করেছেন, কোন দেবতার কি মাহাত্ম্য, ধার্মিক আচার-বিচার, রীতি-নীতি, ধর্মীয় ব্রত-পূজার্চনার বিধি তথা সনাতন ধর্মের আদি পুরাতন সৃষ্টির কাহিনী ইত্যাদি সকল কিছুই শাস্ত্রে মধ্যে বর্ণিত হয়েছে। 

শাস্ত্রের নির্দেশিত বানী কে অস্বীকার করলে বা শাস্ত্রের বচনকে মানুষের লেখা কথা বলে প্রচার করা কোনো প্রকৃত আস্তিক সনাতনী ব্যক্তির কর্ম নয়।

শাস্ত্র যদি কোনো মনুষ্যের রচনা হয়ে থাকে তবে সনাতন ধর্ম তথা সকল দেবদেবী কাল্পনিক হিসেবে পরিচিত হবে। তাই যে সব অজ্ঞ কিছু সনাতনীরা শাস্ত্রসমূহকে মানুষ রচনা করেছে বলে মনে করছেন, আবার অন্যদিকে নিজেকে অমুক দেবতার ভক্ত বলে দাবী করেন তিনি স্ববিরোধী ব্যক্তি । কারণ, যদি শাস্ত্র মানুষের রচনা হয়ে থাকে, তবে শাস্ত্রের মধ্যে বর্ণিত দেবদেবী‌ও কাল্পনিক বলে জানতে হবে। আর সেই যুক্তি অনুযায়ী ঐ শাস্ত্রে বর্ণিত কাল্পনিক দেবতার উপাসক বলে যদি ঐ ব্যক্তি নিজেকে দাবী করে তাহলে সেই ব্যক্তি নিজেই নিজেকে মূর্খ প্রমাণ করে থাকে।  তাই শাস্ত্রকে কাল্পনিক বলা কখনোই উচিত নয়।

কিন্তু সমাজে এইরকম বহু ব্যক্তি আছেন, যারা শাস্ত্রের বচনকে পাত্তা না দিয়ে নিজের ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে অন্যদের মধ্যে প্রচার করে নিজের বিশ্বাসকে সমাজে স্থাপন করতে চায়। তার এই ব্যক্তিগত বিশ্বাস যখন প্রকৃত সত্য সনাতন ধর্মের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে সমাজে অসত্যের প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে সমাজকে বিপথে নিয়ে যায়, তখন আমরা শাস্ত্র নির্দেশিত বচন দ্বারা সঠিক সত্য সিদ্ধান্তের মার্গ তুলে ধরলেও ঐ সংকীর্ণতা মনোভাবে পরিপুষ্ট ব্যক্তিগত বিশ্বাসের প্রচারক ব্যক্তি কখনোই তা স্বীকার করতে চান না, বরং নিজের ব্যক্তিগত মতবাদকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন আর শাস্ত্রের বচন দেখেও শাস্ত্রের বচনকে অমান্য করেন, শাস্ত্রকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন অথবা কোনো অজুহাত দেখিয়ে শাস্ত্রবচনকে অস্বীকার করেন । 

সেই সকল শাস্ত্রের নির্দেশিত ধর্মের শাস্ত্রীয় বানীকে উপেক্ষাকারী ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে শাস্ত্রে যা বলা হয়েছে তা উল্লেখ করা হয়েছে নীচে, যাতে সনাতনী রা কখনোই নিজেদের সনাতন ধর্মের শাস্ত্রের বচনকে উপেক্ষা না করে, যদি শাস্ত্রের বচন কে উপেক্ষা করে তবে তার পরিণাম ভয়ংকর , দেখুন —


(১) শাস্ত্রবচন উপেক্ষা করে নিজের ইচ্ছামতো যা খুশি তাই করে যে ব্যক্তি তার উদ্দেশ্যে মহাভারতের অংশ শ্রীমদ্ ভগবদ্গীতা বলছে —


যঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ততে কাযকারতঃ।

ন স সিদ্ধিবাপ্নোতি ন সুখং ন পরাং গতিম্ ৷৷ ২৩

তস্মাচ্ছাস্ত্রং প্রযাং তে কার্যংকার্যং ব্যবস্থিতৌ।

জ্ঞাত্বা শাস্ত্রবিধানোক্তং কর্ম কর্তুমিহার্হসি ৷৷ ২৪

[ভগবদ্গীতা/১৬ অধ্যায় ]

অর্থ – যে ব্যক্তি শাস্ত্রের বিধি ত্যাগ করিয়া স্বেচ্ছাচরণ করে সে সিদ্ধি, সুখ ও পরাগতি লাভ করিতে পারে না ৷৷ ২৩

অতএব তোমর পক্ষে কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই প্রমাণ, এই কথা জেনে তুমি শাস্ত্রবিধিমতে নির্দিষ্ট কর্ম করো ৷৷ ২৪

_______________________________________________

(২) যারা শাস্ত্র অমান্য করে নিজের মনের কথাকেই শ্রেষ্ঠ ভাবতে থাকে তাদের জন্য শাস্তির বিধান দিয়েছে পদ্মপুরাণ —

ন শৃণ্বন্তি হিতং বাক্যং শাস্ত্রবার্তা কদাপি ন ।

আত্মসম্ভাবিতাঃ স্তব্ধা মূঢ়াঃ পণ্ডিত মানিনঃ ॥ ১১

এতে চান্যে চ বহবঃ পাপিষ্ঠা ধর্মবর্জিতাঃ ।

গচ্ছন্তি যমমার্গে হি রোদমানা দিবানিশম্ ॥ ১২

[পদ্মপুরাণ/উত্তর পর্ব/৪ অধ্যায়/১১-১২ নং শ্লোক]

অর্থ — যে ব্যক্তি হিতকর বচন ও শাস্ত্রের কথাকে অমান্য করেন, নিজের মনের ভেতরে নিজেকেই একমাত্র শ্রেষ্ঠ ভেবে নেন, যিনি জেদী,মূর্খ, কিছু না জেনেও নিজেকে পণ্ডিত বলে মানতে থাকেন, এমন ব্যক্তি তথা অন্যান্য বিভিন্ন প্রকার ধর্মহীন পাপী ব্যক্তিগণ যমমার্গে(নরকে) অগ্রসর হতে থেকে রোদন করতে থাকে ॥ ১১-১২

_______________________________________________

(৩) যে ব্যক্তি শাস্ত্রের নির্দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে ধর্মবিরোধী আচরণ করেন তার শাস্তির বিধান বিষয়ে স্কন্দমহাপুরাণ বলছে —


বিধ্যুক্তকর্মনিষ্ঠাটানামনিষ্টকরণং তু যৎ ।

তন্মাপাতকং প্রোক্তং সংসারস্য প্রবর্তকম ॥ ১৯

[স্কন্দ মহাপুরাণ/সূতসংহিতা/যজ্ঞবৈভবখণ্ড/অধ্যায় ৩]

অর্থ — যে ব্যক্তি শাস্ত্র বিরুদ্ধ আচরণ করেন, সে ব্যক্তি মহাপাপী, আর সে সংসারের দুঃখ যাতনার প্রবাহে বয়ে গিয়ে দুঃখ ভোগ করতেই থাকে।
_______________________________________________


(৪) ধর্মের প্রচারক গুরুতুল্য ব্যক্তির শাস্ত্রীয় বচন ও সনাতন ধর্মের শাস্ত্র কে যারা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়ানক শাস্তি, বলছে পরমপবিত্র শিবমহাপুরাণ —

যে নিন্দতি মহাত্মানং বাচকং ধর্মদেশিকম্ ।
দেবাগ্নিগুরুভক্তাংশ্চ ধর্মশাস্ত্রং চ শাশ্বতম্ ॥ ২১
তেষামুরসি কণ্ঠে চ জিহ্বায়াং দন্তসন্ধিষু।
তালুন্যোষ্ঠে নাসিকায়াং মূর্ছিন সর্বাঙ্গসন্ধিষু ॥ ২২
অগ্নিবর্ণাস্তু তপ্তাশ্চ ত্রিশাখা লোহশংকবঃ ।
আখিদ্যন্তে চ বহুশঃ স্থানেষ্বেতেষু মুদ্গরৈঃ ॥ ২৩
ততঃ ক্ষারেণ দীপ্তেন পূর্যতে হি সমন্ততঃ ।
যাতনাশ্চ মহত্যো বৈ শরীরস্যাতি সর্বতঃ ॥ ২৪
অশেষনরকেষ্বেব ক্রমন্তি ক্রমশঃ পুনঃ ।..॥ ২৫

[ তথ্যসূত্রঃ- শিব মহাপুরাণ/উমাসংহিতা/ অধ্যায় - ১০/ শ্লোক ২১-২৫]

অর্থ — যারা ধর্মের উপদেশকারী মহাত্মা কথাবাচক ব্যক্তির নিন্দা করে, দেবতা, অগ্নি ও গুরুর ভক্তদের এবং সনাতন ধর্মশাস্ত্রকে উপহাস করে, তাদের বুক, কণ্ঠ, জিহ্বা, দন্তসন্ধি, তালু, ওষ্ঠ, নাসিকা, মস্তক এবং সম্পূর্ণ অঙ্গের সন্ধিস্থলে অগ্নিতে তপ্ত করা লোহার রড মুদার দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এরপর, সমস্ত অংশ গরম ক্ষার দিয়ে লেপা হয়, এবং এইভাবে, বিভিন্ন ধরণের তীব্র শারীরিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে, তারা একে একে নরকের মধ্য সমস্ত স্থানে ঘুরে বেড়াতে থাকে।
_______________________________________________


(৫) শাস্ত্রের নির্দেশিত পথে আচার-বিচার অবশ্য‌ই পালন করা উচিত, নচেৎ সেই ব্যক্তি নিন্দার যোগ্য তথা  তিনি কখনোই সুখ প্রাপ্ত করতে পারেন না, বলছে পরমপবিত্র শিবমহাপুরাণ — 

আচারঃ পরমো ধর্ম আচারঃ পরমং ধনম্।
আচারঃ পরমা বিদ্যা আচারঃ পরমা গতিঃ ৷৷ ৫৫
 আচারহীনঃ পুরুষো লোকে ভবতি নিন্দিতঃ।
পরত্র চ সুখী ন স্যাত্তস্মাদাচারবান ভবেৎ ৷৷ ৫৬
 
[ তথ্যসূত্রঃ- শিব মহাপুরাণ / বায়বীয়সংহিতা / উত্তরখণ্ড / অধ্যায় - ১৪ / শ্লোক ৫৫-৫৬ ]

অর্থ - আচার পরম ধর্ম, আচার উত্তম ধন, আচার শ্রেষ্ঠ বিদ্যা, আচারই পরম গতি। আচারহীন (নাস্তিক) পুরুষ সংসারে নিন্দিত হয়, পরলোকে সুখ পায় না। তাই সকলের আচারবান হওয়া উচিত। 
_______________________________________________


এবার দেখুন,
 সাক্ষাৎ শ্রুতি(বেদ) শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, শাস্ত্র অধ্যয়ন করা আবশ্য‌ক, কখনোই শাস্ত্র অধ্যয়নে অবহেলা করা উচিত নয় —

ঋতং চ স্বাধ্যায় প্রবচনে চ। সত্যং চ স্বাধ্যায় প্রবচনে চ। তপশ্চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। দমশ্চ স্বাধ্যায় প্রবচনে চ। শমশ্চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। অগ্নয়শ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। অগ্নিহোত্রং চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। অতিথয়শ্চ স্বাধ্যায় প্রবচনে চ। মানুষং চ স্বাধ্যায় প্রবচনে চ। প্রজা চ স্বাধ্যায় প্রবচনে চ। প্রজনশ্চ স্বাধ্যায় প্রবচনে চ। প্রজাতিশ্চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। সত্যমিতি সত্যবচা রাথীতরঃ। তপ ইতি তপোনিত্যঃ পৌরুশিষ্টিঃ। স্বাধ্যায় প্রবচনে এবেতি নাকো মৌদগল্যঃ। তদ্ধি তপস্তদ্ধি তপঃ ॥ ৯
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় উপনিষদ/৯ম অনুবাক]

অর্থ — শাস্ত্রের নির্দেশমতো নিজ কর্তব্য পালন কর এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় রত হও। কায়মনোবাক্যে সৎ হও এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় রত হও। কৃচ্ছসাধনায় জীবন অতিবাহিত করো এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় রত হও। বহিরিন্দ্রিয়কে দমন করো এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় রত হও। অন্তরিন্দ্রিয়কে সংযত করো এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় রত হও। যজ্ঞাগ্নি (অগ্নিহোত্র যজ্ঞে ব্যবহৃত তিনটি অগ্নি-গার্হপত্য, আহবনীয় এবং দক্ষিণাগ্নি) জ্বালিয়ে রাখো এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় ব্রতী হও। অগ্নিহোত্র যজ্ঞ প্রতিদিন করো এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় ব্রতী হও। শ্রদ্ধার সাথে অতিথি আপ্যায়ন করো এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় ব্রতী হও। স্বাভাবিক জীবন যাপন করো এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় রত হও। সন্তান উৎপাদন করো এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় রত হও। বংশধারা অব্যাহত রাখো এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় রত হও। পৌত্রাদি লাভের জন্য সন্তানের বিবাহ দাও এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় রত হও। রথীতর বংশের সত্যবচার মতে সত্যই সব। পুরুশিষ্টির পুত্র পৌরুশিষ্টি যিনি তপোনিত্য বলেও পরিচিত তিনি বলেন, তপস্যায় মনঃসংযোগ করা উচিত। মুদ্গল পুত্র নাকের মতে শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনাই একমাত্র উপায়। এটিই যথার্থ তপস্যা। এটিই একমাত্র তপস্যা।

বেদমনূচ্যাচার্যোঽন্তে বাসিনমনুশাস্তি। সত্যং বদ। ধমং চর। স্বাধ্যায়ান্মা প্রমদঃ। আচার্যায় প্রিয়ং ধনমাহৃত্য প্রজাতন্তুং মা ব্যবচ্ছেৎসীঃ। সত্যান্ন প্রমদিতব্যম্। ধর্মান্ন প্রমদিতব্যম্। কুশলান্ন প্রমদিতব্যম্। ভূত্যৈ ন প্রমদিতব্যম্। স্বাধ্যায় প্রবচনাভ্যাং ন প্রমদিতব্যম্ ॥ ১১
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় উপনিষদ/১১শ অনুবাক]

অর্থ — আচার্য প্রথমে শিষ্যকে বেদ শিক্ষা দেন এবং পরে নিম্নলিখিত উপদেশ দেন:
নিজের বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী সর্বদা সত্য কথা বল। শাস্ত্রের নির্দেশ মেনে ধর্মের আচরণ কর। বেদ অধ্যয়নে কখনও অবহেলা করো না। আচার্যকে তাঁর পছন্দ ও প্রয়োজন মতো জিনিস দক্ষিণাস্বরূপ দিও। (আচার্যের নির্দেশ মতো বিয়ে করে স্ত্রী-পুত্রাদি নিয়ে সংসার করো)। বংশধারা যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে সেদিকে লক্ষ্য রেখো। সত্য থেকে কখনও বিচ্যুত হয়ো না। শাস্ত্রে যে কর্তব্য কর্মের কথা বলা হয়েছে তা সম্পাদনে অবহেলা করো না। আত্মরক্ষার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করো এবং নিজের উন্নতি সাধনে যত্নবান হয়ো। আবার বলি, শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা বিষয়ে অমনোযোগী হয়ো না। (এইসব নির্দেশ যথাসম্ভব মেনে চলো)।

_______________________________________________


(প্রশ্ন - ১) শাস্ত্র দিয়ে ঈশ্বর লাভ হয় কি ?

উত্তর ঃ শাস্ত্র নিজেই বলেছে বেদ,পুরাণ অন্যান্য শাস্ত্রও পর্যন্ত শিব কে সম্পূর্ণরূপে জানতে সক্ষম নন। কিন্তু ঈশ্বর লাভের পথে শাস্ত্র হল সহায়ক, যার দ্বারা আমরা ঈশ্বরের বিভিন্ন লীলা মাহাত্ম্য জানতে পারি, ঈশ্বর লাভ করবার জন্য কি কি করা উচিত তা জানতে পারি, বিভিন্ন ভক্তদের, বিভিন্ন মুনি ঋষিগণ কিভাবে ঈশ্বরকে লাভ করেছেন সেই বিষয়ে আমরা বেশ কিছু ধারনা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারি। সৃষ্টি তত্ত্ব, প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে‌ জানতে পারি।
 ধ্যান কি, যোগ কি, ব্রহ্মচর্য কি, ভক্তি কি, জ্ঞান কি, কিভাবে সৎ কর্ম করতে হয়, উচিত অনুচিত কি, জীবনে কীভাবে চলতে হয়, ঈশ্বরের সামান্য কিছু ধারনা লাভ তথা আরও অনেক কিছু সম্পর্কে‌ জানতে পারি। তাই বেদ,পুরাণ অন্যান্য শাস্ত্রও পরমেশ্বর শিব কে সম্পূর্ণরূপে জানতে সক্ষম নন ঠিক কথা কিন্তু শাস্ত্র আমাদের ঈশ্বর লাভের পথ অবশ্যই দেখায়। 
যদি শাস্ত্রের কোনো প্রয়োজন না হতো তাহলে পরমেশ্বর শিব কখনোই শাস্ত্র প্রকট করে জীবেদের তা মান্য করে চলতে বলতেন না । পরমেশ্বর শিব এই কারনেই শাস্ত্র প্রকট করেছেন, যাতে শাস্ত্র আমাদের মতো মায়ায় আবদ্ধ থাকা জীবেদের সঠিক মার্গে চলতে সহযোগিতা করে ।

(প্রশ্ন - ২) ভক্তি করলেই ঈশ্বর কে লাভ করা যায়, তার জন্য শাস্ত্রের কি প্রয়োজন ?

উত্তর ঃ অবশই, ভক্তি শ্রেষ্ঠ , ভক্তি করলে অবশই মুক্তি লাভ তথা ঈশ্বর লাভ সম্ভব। কিন্তু আপনাকে প্রকৃত ভক্তি করতে হবে, তবেই ঈশ্বর প্রাপ্তি করে মুক্তি লাভ করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু আপনি একবার ভালো করে বিচার করে ভেবে দেখুন, আপনি যে ভক্তি করছেন সেটি আদৌও প্রকৃত ভক্তি কিনা তা আপনি কি করে জানবেন ?
সবাই তো নিজের যা ইচ্ছে সেই মতো কার্যকলাপ করবে আর সেটি ভালো হোক বা মন্দ হোক, সেই ব্যক্তি তো তা বুঝতেই পারবে না যে সে ভক্তি করছে নাকি ভুল করছে । 
সব কিছুর যাচাই এর দরকার। নচেৎ, মানুষ যা ইচ্ছে তাই করবে ভক্তির অছিলা দিয়ে। আর তার ভুল ভাবনা কে ভক্তি ভেবে প্রচার করতে গিয়ে তার দ্বারা কুসংস্কার জন্ম নিতে পারে সমাজে, ফলে ক্ষতি হবে সনাতন সমাজের । তাই ভক্তি কি, ভক্তি কীভাবে করতে হয়, ভক্তি করলে একজন প্রকৃত ভক্তের মধ্যে কোন কোন বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণ দেখা যায়, সে বিষয়ে আমাদের সঠিক তথ্য দেয় একমাত্র আমাদের সনাতন ধর্মের শাস্ত্র। 
শাস্ত্রের মধ্যে প্রকৃত ভক্তি ও প্রকৃত ভক্ত সম্পর্কে‌ বলা আছে। সে সম্পর্কে জেনে সঠিক পথে ভক্তি করা উচিত। তাই একজন প্রকৃত ভক্ত কখনোই শাস্ত্র বানী অমান্য করেন না।
আমাদের শ্বেতাশ্বতর, লকুলিশ, ব্যাসদেব, শ্রীকণ্ঠ, শ্রীপতিপণ্ডিতারাধ্য, পঞ্চআচার্য, মৎসেন্দ্রনাথ, গোরক্ষনাথ সহ সকল শৈব আচার্যগণ, (অশৈব দের মধ্যে) স্মার্ত আদি শঙ্করাচার্য‌, বৈষ্ণবদের রামাণুজ, মধ্ব, চৈতন্যদেব সহ সকল আচার্য তথা সনাতন ধর্মের  মুনি ঋষিগণ, শাস্ত্র মান্য করে তার উপর বিভিন্ন ভাষ্য বা টীকা রচনা করেছেন। এমনকি বর্তমানের স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত শাস্ত্র (বেদান্ত) মান্য করে চলতেন ।
 শাস্ত্রের যদি কোনো প্রয়োজন না থাকতো তবে সনাতন ধর্মের পুরাতন আচার্যগণ কেন শাস্ত্র কে এত গুরুত্ব দিয়েছেন ?
তারা কি বোকা ছিলেন ? না.. তারা বোকা ছিলেন না । তারা বর্তমানের তথাকথিত ভক্তদের চেয়ে অনেক উচ্চস্তরের জ্ঞানী মহাত্মা ছিলেন।
তারা শাস্ত্র কে এই কারণেই গুরুত্ব দিয়েছেন, কারণ শাস্ত্র আমাদের সনাতন ধর্মের দলিল, তথা পরমেশ্বরের বানী । তাই অবশ্যই ভক্তি করুন, কিন্তু শাস্ত্রকে উপেক্ষা করে অন্ধ ভক্তি নয়, বরং শাস্ত্রের আলোকে জ্ঞানসম্পন্ন ভক্তি করুন, এটিই একজন প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তির করণীয় কর্তব্য ও লক্ষণ। তাতে কুসংস্কারও জন্ম নেবে না, অসত্যও প্রচার হবে না, সনাতন ধর্মের প্রকৃত সিদ্ধান্ত বজায় থাকবে, শাস্ত্রের বচনেরও মান থাকবে, ঈশ্বরও লাভ হবে, মুক্তিও পাবেন ।

_______________________________________________


সিদ্ধান্ত


অতএব - যে ব্যক্তি একজন প্রকৃত আস্তিক সনাতনী ব্যক্তি, তিনি কখনোই সনাতন ধর্মের শাস্ত্রের বানীকে অমান্য করবেন না। যিনি প্রকৃত পক্ষে পরমেশ্বর শিবের ভক্ত, তিনি কখনোই পরমেশ্বর শিবের বানীরূপী শাস্ত্রকে অমান্য করবেন না। ভক্ত তাকেই বলা যায় যিনি ভগবানের বলা বচনকে মান্য করেন। যিনি নিজেকে ভক্ত বলে ভাবেন কিন্তু ঈশ্বরের বচনকে অস্বীকার করেন, সেই ব্যক্তি কখনোই প্রকৃত ভক্ত নন, তিনি আসলেই ভণ্ড । 
পরমেশ্বর শিবের দ্বারা প্রণীত শাস্ত্র মান্য করা আমাদের সকলের পরম কর্তব্য। 


শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে। 🚩
ॐ পরমেশ্বরায় সদাশিবায় নমঃ। 🌷

© লেখনীতে : শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য 
CopyRight ও প্রচারে : International Shiva Shakti Gyan Tirtha (ISSGT)

#ISSGT 
নন্দীনাথ শৈব আচার্য  

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ