শ্রীকৃষ্ণের যোগ অবস্থা ও বিষ্ণু তত্ত্বের রহস্য
শ্রীকৃষ্ণ গীতার জ্ঞান কীভাবে দিয়েছিলেন ?
কে সেই পুরুষ, যার সাথে যোগযুক্ত অবস্থায় অর্জুনকে ভগবদ জ্ঞান দিয়েছিলেন?
শ্রীহরি যোগনয়ন দ্বারা কার দর্শন করেন ?
বিষ্ণু ও কৃষ্ণ তত্ত্বের রহস্য কি ?
বর্তমান সমাজে একটি কথা খুব বেশি প্রচলিত আছে যে, ভগবদ্ গীতার জ্ঞান শ্রীকৃষ্ণই দিয়েছে।
কারণ, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছে পরমেশ্বর। কিছু লোক শ্রীকৃষ্ণকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে করতে এতটাই অব্জেক্টিফাই করে যে, বাদ বাকী দেব/দেবীদের মানতে তো চায় না, বরং অপমান সূচক কথা বলে।
তাদের মতে শ্রীকৃষ্ণ একমাত্র পরমেশ্বর এবং বাদবাকীরা সবাই শ্রীকৃষ্ণের দাসদাসী। ধরতে গেলে কট্টর দ্বৈতবাদী চিন্তা-ভাবনা।
আচ্ছা শ্রীকৃষ্ণ কি নিজে কাউকে বলেছিলো নাকি যে, অন্যান্য দেব/দেবীরা শ্রীকৃষ্ণের দাসদাসী? আপনারা যদি এভাবে অব্জেক্টিফাই করেন তাহলে, সনাতনের অদ্বৈতভাব টাই প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং অদ্বৈতবাদের হানি ঘটে। যা সম্পূর্ণ ধর্ম বিরুদ্ধ।
👉এবার আসা যাক মূল বিষয়ে —
কিছু তথাকথিত সংগঠন ও কিছু মানুষের এটাই দাবী যে, গীতাতে যে জ্ঞান আছে তা শ্রীকৃষ্ণ নিজেই দিয়েছে, শ্রীকৃষ্ণের নিজের বলা বাণী, শ্রীকৃষ্ণ নিজেকেই পরমেশ্বর বলেছেন ।
তাহলে আমার প্রশ্ন এটাই যে,মহাভারতে কেন বলা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণ যোগযুক্ত থাকার কারণে অর্জুনকে সেসব জ্ঞান দিয়েছেন ?
এবং এটাও কেন বলেছেন মহাভারতের আশ্বমেধিকপর্বের অন্তর্গত অধ্যায় ১৭ -এর শ্লোক ১২ তে যে, শ্রীকৃষ্ণ পুণরায় এই জ্ঞান দিতে সক্ষম নন ? কেন সক্ষম নন ?
👉দেখে নেওয়া যাক শাস্ত্র কি বলে —
বাসুদেব উবাচ —
শ্রাবিতত্ত্বং ময়া গুহ্যং জ্ঞাপিতশ্চ সনাতনম্।
ধর্মং স্বরূপিণং পার্থ! সর্ব্বলোকাংশ্চ শাশ্বতান্ ॥৯৷৷
অবুদ্ধ্যা নাগ্রহীর্যত্বং তন্মে সুমহদপ্রিয়ম্।
ন চ সাদ্য পুনর্ভূয়ঃ স্মৃতির্মে সংভবিষ্যতি ॥১০॥
নূনমশ্রদ্দধানোহসি দুৰ্ম্মেধা হ্যসি পাণ্ডব!
ন চ শক্যং পুনর্বক্তুমশেষেণ ধনঞ্জয়! ॥১১॥
স হি ধৰ্ম্মঃ সুপর্য্যাপ্তো ব্রহ্মণঃ পদবেদনে।
ন শক্যং তন্ময়া ভূয়স্তথা বক্তুমশেষতঃ ॥১২৷৷
পরং হি ব্রহ্ম কথিতং যোগযুক্তেন তন্ময়া।
ইতিহাসন্তু বক্ষ্যামি তস্মিন্নর্থে পুরাতনম্ ॥১৩৷৷
[মহাভারত/আশ্বমেধিকপর্ব/অধ্যায় ১৭/শ্লোক ৯-১৩]
✅ অর্থ — শ্রীকৃষ্ণ বললেন- 'পৃথানন্দন! আমি তোমাকে গুপ্ত বিষয় শুনাইয়াছি এবং লক্ষণসংযুক্ত সনাতন ধর্ম ও শাশ্বত সমস্ত লোকের বিষয় জানাইয়াছি ॥৯৷৷
তুমি যে বৈমত্যবশতঃ সে সকল মনে রাখিতে পার নাই, তাহা আমার গুরুতর অপ্রিয় হইয়াছে।
এখন সেই স্মৃতি পুনরায় আমার পূর্ণভাবে হইবে না ।।১০।।
পাণ্ডুনন্দন! নিশ্চয়ই তুমি আমার সেই সকল বাক্যে বিশ্বাস কর নাই, অথবা তুমি নিশ্চয়ই দুৰ্ম্মেধা।
ধনঞ্জয়! তাহা আবার সমস্ত বলা আমার শক্তিসাধ্য নহে ॥১১।।
সেই ধর্মটি পরমাত্মার স্বরূপ জানিবার পক্ষে বিশেষ পর্যাপ্ত ছিল। আমি বর্তমান সময়ে সেই সমস্ত পুনবায় বলিতে সমর্থ নহি ॥১২৷৷
তৎকালে আমি যোগযুক্ত হইয়া পরব্রহ্মের বিষয় বলিয়াছিলাম, এখন সেই বিষয়ে প্রাচীন বৃত্তান্ত বলিতেছি ॥১৩॥
👉খুব ভালো করে ‘'১২/১৩’’ নং শ্লোকে ভাবার্থ টা বোঝার চেষ্টা করবেন সকলে।
এখানে বলা হয়েছে— শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এটাই বলছেন, যে জ্ঞান অর্জুনকে দিয়েছিলেন তা পরমাত্মার স্বরূপ জানার জন্য পর্যাপ্ত ছিলো। অর্থাৎ পরমাত্মার সান্নিধ্য কীভাবে পাওয়া যাবে তার পূঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বলেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো কীভাবে বলেছিলেন?
তার উত্তর ১৩ নং শ্লোকে রয়েছে— শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছে, তখন তিনি যে জ্ঞান দিয়েছিলেন পরব্রহ্মের বিষয়ে তা তিনি পরব্রহ্মের সাথে যোগযুক্ত থাকার কারণেই দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু পুণরায় এই জ্ঞান আবার দিয়ে সক্ষম নন শ্রীকৃষ্ণ।
👉এবার এখানে আমার একটা প্রশ্ন— যদি শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণব্রহ্ম হন তাহলে আবার আলাদা কোন পরব্রহ্মের বিষয়ে অর্জুনকে জ্ঞান দিয়েছিলেন? সনাতন ধর্ম তো একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী এবং ব্রহ্ম যদি দুইজন হয় তাহলে তো অদ্বৈতবাদ(অদ্বিতীয় ব্রহ্ম) মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলে, শ্রীকৃষ্ণ কার জ্ঞান অর্জুনকে দিয়েছিলেন? এবং যোগ দ্বারাও বা কার সাথে যুক্ত থাকেন?
এ ব্যাপারে জানার আগে আমাদের জানতে হবে যে , শ্রীকৃষ্ণ কে ?
👉 শাস্ত্রে বলছে যে—
তত্রৈব নবমো বিষ্ণুরদিতেঃ কশ্যপত্মজঃ।।৭৭।।
দেবক্যাং বসুদেবাত্তু ব্রহ্মাগর্গপুরঃ সরঃ।
একবিংশমস্যাস্য দ্বাপরস্যাংশসঙ্ক্ষয়ে।
নষ্টে ধর্মে তদা জজ্ঞে বিষ্ণুর্বৃষ্ণিকুলে স্বয়ম্।।৭৮।।
[স্কন্দপুরাণ- প্রভাসখণ্ড- অধ্যায়- ১৯]
✅ অর্থ — দ্বাপর যুগেই বিষ্ণুর কৃষ্ণরূপ নবম অবতার হয়। তখন তিনি দেবকীরূপিনী অদিতির গর্ভে বসুদেবরূপী কশ্যপের পুত্ররূপে প্রাদুর্ভূত হন। গর্গরূপী ব্রহ্মাকে তখন তিনি সহায় করিয়াছিলেন।
উক্ত দ্বাপর যুগে ধর্ম নষ্ট প্রায় হইয়াছিলো সেজন্যই বিষ্ণু স্বয়ং বৃষ্ণিকুলে জন্মগ্রহণ করেন।।৭৭-৭৮।।
👉অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ হলেন ভগবান বিষ্ণুর অবতার। দ্বাপরে ধর্মের যখন গ্লানি হয়, অধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি হয় তখন ধর্মকে পুনঃস্থাপন করার জন্য ভগবান বিষ্ণু, কৃষ্ণরূপে দেবকীর পুত্র হয়ে জন্ম নেন।
♦️ একই প্রমাণ পাওয়া যায় মহাভারতেও —
তুরীয়ার্দ্ধেন তস্যেমং বিদ্ধি কেশবমচ্যুতম্।
তুরীয়ার্দ্ধেন লোকাং স্ত্রীন্ ভাবয়ত্যেব বুদ্ধিমান্ ॥৬১৷৷
[মহাভারত- শান্তিপর্ব্ব- অধ্যায়- ২৭৩—৬১]
✅ অর্থ — যুধিষ্ঠির! তুমি ইহা অবগত হও যে, সেই ভগবান্ নায়ায়ণের অষ্টমাংশ স্বরূপই ' এই কৃষ্ণ; এই বুদ্ধিমান কৃষ্ণ সেই অষ্টমাংশ দ্বারাই ত্রিভুবন সৃষ্টি করেন ॥৬১।।
♦️ শ্রীকৃষ্ণ যে বিষ্ণুর একটা মূর্তি তার প্রমাণ ও মহাভারতে পাওয়া যায়—
মমৈতাস্তনবঃ শ্রেষ্ঠা জাতা ধর্মগৃহে দ্বিজ!।
তাস্ত্বং ভজস্ব সততং সাধয়স্ব যথাগতম্ ॥১৪॥
[মহাভারত- শান্তিপর্ব্ব- অধ্যায়- ৩২৫—১৪]
✅ অর্থ — ব্রাহ্মণ! নর-নারায়ণ, হরি ও কৃষ্ণ এই চারিটি আমার (বিষ্ণুর) শ্রেষ্ঠমূর্তি ধর্মরূপী গৃহে জন্মগ্রহণ করিয়াছে; তুমি যাইয়া সর্ব্বদা তাঁহাদের সেবা করো। অতএব যেমন আসিয়াছ তেমন চলিয়া যাও।।১৪
♦️ ধর্ম রক্ষার জন্যই বিষ্ণু, কৃষ্ণ রূপ ধারণ করেন—
অসতাং নিগ্রহার্থায় ধর্মসংরক্ষণায় চ।
অবতীর্ণো মনুষ্যাণামজায়ত যদুক্ষয়ে।
স এষ ভগবান্ বিষ্ণুঃ কৃষ্ণেতি পরিকীর্ত্যতে ॥৬৮॥
[মহাভারত- বনপর্ব্ব- অধ্যায়- ২২৬—৬৮]
✅ অর্থ — সেই ভগবান্ নারায়ণই দুর্জনের নিগ্রহ এবং ধর্মরক্ষার জন্য মনুষ্যমধ্যে অবতীর্ণ হইয়া যদুকুলে জন্মিয়াছিলেন; তাঁহাকেই 'কৃষ্ণ' বলা হয় ॥৬৮৷৷
যস্ত নারাযণো নাম দেবদেবঃ সনাতনঃ।
তস্যাংশো মানুষেষ্বাসীদ্বাসুদেবঃ প্রতাপবান্ ॥১৫২॥
[মহাভারত- আদিপর্ব্ব- অধ্যায়— ৬২]
অর্থঃ— নারায়ণ নামে যিনি সনাতন এবং দেবগণেরও দেবতা ছিলেন, তিনিই মর্ত্যলোকে আসিয়া প্রতাপশালী কৃষ্ণরূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন ॥১৫২৷।
👉ধর্ম রক্ষার জন্যই শ্রীবিষ্ণু অবতার রূপে অবতীর্ণ হন—
তত্র ন্যায্যমিদং কর্তং ভারাবতরণং ময়া।
অথ নানাসমুদ্ভূতৈর্বসুধায়াং যথাক্রমম্ ॥৩৩||
নিগ্রহেণ চ পাপানাং সাধুনাং প্রগ্রহেণ চ।
ইয়ং তপস্বিনী সত্যা ধারয়িষ্যতি মেদিনী ॥৩৪।।
[মহাভারত- শান্তিপর্ব্ব- অধ্যায়— ৩৩৩]
অর্থ — অতএব তখন পৃথিবীর এই ভারাবতরণ আমার করা কর্তব্য হইবে। সুতরাং আমি যথাক্রমে বহুবিধ অবতার অবলম্বন করিয়া, পাপাত্মাদের দমন ও সাধুদের পালন করায় সত্যই এই দীনা পৃথিবী সকলকে ধারণ করিতে পারিবে ॥৩৩-৩৪।।
এবং স চিন্তয়িত্বা তু ভগবান্ মধুসূদনঃ। রূপাণ্যনেকান্যসৃজৎ প্রাদুর্ভাবে ভবায় সঃ।।৩৬।।
বারাহং নারসিংহঞ্চ বামনং মানুষং তথা।
এভিৰ্ম্ময়া নিহন্তব্যা দুর্বিনীতাঃ সুরারয়ঃ ॥৩৭।।
[মহাভারত- শান্তিপর্ব্ব- অধ্যায়— ৩৩৩]
অর্থ — ভগবান্ নারায়ণ এইরূপ চিন্তা করিয়া ভবিষ্যতে অসুরগণের উৎপত্তি হইলে, জগতের মঙ্গলের জন্য বরাহ, নরসিংহ, বামন ও মানুষপ্রভৃতি অনেকরূপ ধারণ করিবার ইচ্ছা করিলেন এবং তিনি এইরূপও চিন্তা করিলেন যে, আমি এই সকল রূপছায়া দুর্বিনীত অসুরগণকে সংহার করিব ॥৩৬-৩৭॥
👉আরও বেশ কিছু প্রমাণ শাস্ত্র থেকে দেখে নেবো, যেখানে বলা হয়েছে শ্রীকৃষ্ণ হলো শ্রীবিষ্ণুর অবতার —
👉[গীতাপ্রেস/পদ্মপুরাণ/উত্তরখণ্ড/অধ্যায় ২৪৫/২৩]
👉[গীতাপ্রেস/বরাহপুরাণ/অধ্যায় ৪/২-৩] [গীতাপ্রেস/বরাহপুরাণ/অধ্যায় ৪৮/১৭-২২] [গীতাপ্রেস/বরাহপুরাণ/অধ্যায় ২১১/৬৯]
👉[গীতাপ্রেস/ভাগবতপুরাণ/১ম স্কন্দ/অধ্যায় ৩/২৩] [গীতাপ্রেস/ভাগবতপুরাণ/২য় স্কন্দ/অধ্যায় ৭]
👉[গীতাপ্রেস/গরুড়পুরাণ/আচারকাণ্ড/অধ্যায় ১] [গীতাপ্রেস/গরুড়পুরাণ/আচারকাণ্ড/অধ্যায় ৮৬/১০-১১] [গীতাপ্রেস/গরুড়পুরাণ/ব্রহ্মকাণ্ড/অধ্যায় ৩০/৩৭]
👉[গীতাপ্রেস/অগ্নিপুরাণ/অধ্যায় ৪৯/১০-১১] [গীতাপ্রেস/অগ্নিপুরাণ/অধ্যায়/১২/৫-৬]
👉[গীতাপ্রেস/নারদপুরাণ/৪র্থ পাদ/অধ্যায় ১১৯/১৪-১৯]
👉[গীতাপ্রেস/মৎস্যপুরাণ/অধ্যায় ৪৭/২]
👉[ব্রহ্মপুরাণ/৪র্থ খণ্ড/অধ্যায় ৫২/৬৮-৭২] [গীতাপ্রেস/ব্রহ্মপুরাণ/চিত্রসূচী/অধ্যায় ২১৩/২৫৭-২৫৮]
👉[গীতাপ্রেস/শিবমহাপুরাণ/বায়বীয় সংহিতা/অধ্যায় ৩০/৫৬-৫৮] [গীতাপ্রেস/শিবমহাপুরাণ/বায়বীয় সংহিতা/অধ্যায় ৩১/১৩৪-১৩৬]
👉এখানে হয়তো অনেকে মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে যে, পুরাণে কৃষ্ণকে নবম অবতার বলা হয়েছে কিন্তু, মহাভারতে অষ্টম অবতার বলা হয়েছে এটা কীভাবে সম্ভব? এমন হলে তো তা শাস্ত্র বিরুদ্ধ হয়।
আসলে এখানে একটা সময়ের মীমাংসার বিষয় আছে। অর্থাৎ কল্পান্তরে এমন ঘটনার পরিবর্তন হয়।
কোনো কল্পে দেখা গেলো দুর্গা সাক্ষাৎ মহিষাসুরকে বধ করছে, তো কোনো কল্পে দেখা যাচ্ছে দুর্গা থেকে চণ্ডীর আবির্ভাব হচ্ছে এবং চণ্ডী’ই মহিষাসুরকে বধ করছে। আবার অন্য কল্পে দেখা যায় কাত্যায়ন ঋষির পুত্রী কাত্যায়নী হয়ে মাতা দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করছে। অর্থাৎ উদ্দেশ্য একটাই যে, দেবীর দ্বারা অসুরবধ হবে কিন্তু, কল্প অনুযায়ী ঘটনা পরিবর্তন হয়।
ঠিক একই ভাবে, ধর্মের রক্ষার জন্য ভগবান বিষ্ণু কখনো অষ্টম অবতার হয়ে জন্ম নেয় তো কখনো নবম কিন্তু, উদ্দেশ্য একটা বিষ্ণুই কৃষ্ণরূপে অবতারিত হয়ে তিনি ধর্মের রক্ষা করবেন।
👉শাস্ত্র থেকে প্রমাণ দেখানো হলো যে, কৃষ্ণ হলো সাক্ষাৎ বিষ্ণুর একটা রূপ। অর্থাৎ তত্ত্বগত ভাবে বিষ্ণু আর কৃষ্ণের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ যিনি কৃষ্ণ তিনিই বিষ্ণু।
________________________________________________
🔵 তাহলে এবার দেখে নেব কৃষ্ণরূপী বিষ্ণু যোগনয়ন দ্বারা কার সাথে যুক্ত থাকেন —
এষ বিদ্বান্ গুণশ্রেষ্ঠো বিষ্ণুঃ পরমদুর্জয়ঃ।
দিব্যচক্ষুর্মহাতেজা বীক্ষতে যোগচক্ষুষা ॥৯৷
[মহাভারত- অনুশাসনপর্ব্ব- অধ্যায়- ১৩—৯]
✅ অর্থ — বিদ্বান, গুণশ্রেষ্ঠ, অত্যন্ত দুর্জয়, দিব্যচক্ষু ও মহাতেজা এই বিষ্ণুই যোগনয়ন দ্বারা সেই পরমেশ্বরকে (সদাশিবকে) নিরন্তর দর্শন করতে থাকেন ॥৯
♦️এবং পুরাণ শাস্ত্রেও একই কথা বলা আছে—
ক্ষীরার্ণবামৃতমিব সদা ক্ষীরার্ণবে হরিঃ।
শেতে শিবজ্ঞানধিয়া সাক্ষাদ্বৈ যোগনিদ্রয়া।।৬
[লিঙ্গ পুরাণ/পূর্বভাগ/অধ্যায় ৪৬/ শ্লোক-৬]
✅ অর্থ — ক্ষীরসাগর অমৃতের সমান। ভগবান বিষ্ণু সেই ক্ষীরসাগরে শিবজ্ঞানের চিন্তন করতে করতে সদা যোগনিদ্রায় শয়ন করেন।।৬
👉এবার শাস্ত্র থেকে পরিষ্কার ভাবেই জানা গেলো যে, কৃষ্ণরূপী ভগবান বিষ্ণু যোগ দ্বারা পরমেশ্বর শিবের সাথে যুক্ত থাকেন।
এবং কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর শিবের সাথে যোগযুক্ত অবস্থায় গীতার জ্ঞান দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
♦️ ভগবদগীতার প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে পুরাণ শাস্ত্রে কি বলা আছে তা একবার দেখে নেব — মাতা লক্ষ্মী শ্রীনারায়ণকে জিজ্ঞাসা করে বলছেন 👇
স্বয়ঞ্চেৎপরমানন্দমবাঙমনসগোচরম্।
কথং গীতা বোধয়তি ইতি মে চ্ছিন্ধি সংশয়ম্।।২০
[পদ্মপুরাণ- উত্তরখণ্ড- অধ্যায়- ১৭৫—২০]
✅ অর্থ — আপনি বিষ্ণু ! স্বয়ং, যদি অবাঙ্মনগোচর পরমানন্দ, তবে গীতা আপনাকে কিরূপে বোধিত করে?
👉মাতা লক্ষ্মী ভগবান বিষ্ণুর থেকে জানতে চাইছেন যে, ভগবান বিষ্ণুই মনের ও অগোচর, পরম আনন্দ স্বরূপ । তাহলে, ভগবান বিষ্ণুকে গীতাতে কি রূপে বোধিত করা হয়েছে ? অর্থাৎ মূল স্বরূপটা কি?
তার উত্তরে ভগবান বিষ্ণু বলছেন—
প্রিয়ঃ শ্রুত্বা বচো যুক্তমিতিহাসপুরঃসরম্।
আত্মানুগামিনীং দৃষ্টিং গীতাং বোধিতবান প্রভুঃ।।২১
অহমাত্মা পরেশানি পরাপরবিভেদতঃ।
দ্বিধা ততঃ পরঃ সাক্ষী নির্গুণো নিষ্কলঃ শিবঃ।।২২
অপরঃ পঞ্চবক্ত্রোহহং দ্বিধা তস্যাপি সংস্থিতিঃ।
শব্দার্থভেদতো বাচ্যো যথাত্মাহং মহেশ্বরঃ।।২৩
[পদ্মপুরাণ- উত্তরখণ্ড- অধ্যায়- ১৭৫]
✅ অর্থ — প্রভু মুরারি লক্ষ্মীর এই যুক্ত বাক্য শ্রবণ করিয়া আত্মানুগামিনী দৃষ্টিস্বরূপা গীতা ইতিহাসপুরঃসর বুঝাইতে লাগিলেন; বিষ্ণু বলিলেন, হে পরেশানি! আমি আত্মা পর-অপর ভেদে দ্বিবিধ।
পর — সাক্ষী নির্গুণ, নিষ্কল, শিব স্বরূপ, আর
অপর — স্থুল-সুক্ষ্মরূপ ভেদে দ্বিবিধ, অহস্পদবাচ্য পঞ্চবক্ত্র এবং অহংপদবাচ্য পরমাখ্যরূপ মহেশ্বর।।২১-২৩।।
মায়াময়মিদং দেবি বপুর্মে ন তু তাত্ত্বিকম্ । সৃষ্টিস্থিত্যুপসংহারক্রিয়াজালোপবৃংহিতম্ ॥১৬
[পদ্মপুরাণ- উত্তর খণ্ড- অধ্যায়-১৭৫—১৬]
✅ অর্থ — ভগবান কহিলেন— হে দেবি! এই যে বিষ্ণুদেহ দেখিতেছ ইহা তাত্ত্বিক নহে, ইহা মায়াময়; এই দেহ সৃষ্টি স্থিতি ও ধ্বংস ক্রিয়াসমূহে উপবৃংহিত।।১৬
অতোহন্যদাত্মনো রূপং দ্বৈতাদ্বৈতবিবর্জিতম্।
ভাবাভাববিনিম্নক্তমাদ্যন্তরহিতং প্রিয়ে।। ১৭
[পদ্মপুরাণ- উত্তর খণ্ড- অধ্যায়-১৭৫—১৭]
✅ অর্থ — হে প্রিয়! ইহা ভিন্ন আমার অন্য যে আত্মরূপ, তাহা দ্বৈতাদ্বৈতবর্জিত, ভাবাভাববিরহিত ও আদ্যন্তহীন - এরূপ শুদ্ধ সংবিৎপ্রভাদ্বারাই জ্ঞেয়।।১৭
👉অর্থাৎ পর(শুদ্ধবিদ্যা), অপর(অশুদ্ধবিদ্যা) ভেদে বিষ্ণুর দুইটি স্বরূপ রয়েছে।
অর্থাৎ বিষ্ণুর যে বাহ্যিক চতুর্ভূজ শরীরটা রয়েছে তা অপরাশক্তি অর্থাৎ মায়া দ্বারা গঠিত। অর্থাৎ বিষ্ণুর শরীর ও একটা সময়ের পরে বিনাশ প্রাপ্ত হয়।
কিন্তু বিষ্ণুর আত্মা হলো সাক্ষাৎ মহাদেব। গীতার পারমার্থিক যে স্বরূপ তা সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিবের।
♦️ ভগবদ্গীতার ১৮ টা অধ্যায়কে পরমেশ্বর শিবের স্বরূপ বলা হয়েছে—
শ্রীভগবানুবাচ—
শুধু সুশ্রোণি বক্ষ্যামি গীতাসু স্থিতিমাত্মনঃ।।২৭
বক্ত্রাণি পঞ্চ জানীহি পঞ্চাধ্যায়াননুক্রমাৎ।
দশাধ্যায়া ভুজাশ্চৈক উদরং দ্বৌ পদাম্বুজে।।২৮
এবমষ্টাদশাধ্যায়া বাঙ্ময়ী মূর্তিরৈশ্বরী।
বিজ্ঞেয়া জ্ঞানমাত্রেণ মহাপাতকনাশিনী ॥২৯
অতোহধ্যায়ং তদর্দ্ধং বা শ্লোকমরেদ্ধং তদর্দ্ধকম্।
অভ্যস্যতি সুমেধা যঃ সুশর্ম্মেব স মুচ্যতে ॥৩০
[পদ্মপুরাণ- উত্তরখণ্ড- অধ্যায়- ১৭৫]
✅ অর্থ — শ্রীভগবান কহিলেন, হে সুশ্রোণি! আমি গীতার আত্মসংস্থান(গুহ্য আত্মাস্বরূপ তত্ত্ব) কথা কহিতেছি, শ্রবণ করো। গীতার পঞ্চাধ্যায় পঞ্চবক্ত্র(৫মুখ) বলিয়া জানিবে। উহার দশাধ্যায় দশভুজ, একাধ্যায় উদয় এবং দুই অধ্যায় পদাম্বুজ; এইরূপে অষ্টাদশাধ্যায়। গীতাকে বাঙ্ময়ী ঐশ্বরী মূর্তি জানিবে। ইহা জানিবামাত্র মহাপাতক- নাশ হয়। যে সুস্থো ব্যক্তি ইহার অধ্যায়, অধ্যায়ার্দ্ধ, শ্লোক, শ্লোকার্দ্ধ বা তদর্দ্ধ অভ্যাস করেন, তিনি সুশর্মার ন্যায় মুক্ত হইয়া থাকেন।।২৭-৩০।।
______________________________________________
♨️ এবার অনেকে এই প্রশ্ন করবে যে বিষ্ণুর আত্মা পরমেশ্বর শিব হয় কীভাবে? বিষ্ণু থেকে তো ব্রহ্মার সৃষ্টি এবং ব্রহ্মার কপাল থেকে রুদ্রের সৃষ্টি, তাহকে শিব কীভাবে বিষ্ণুর আত্মা হয় ?
☘️ তাহলে এখানে মূল যে বিষয় টা জানতে হবে তা হলো বিষ্ণুর জন্মের ঘটনা। আর বিষ্ণুর জন্ম কীভাবে হয় ? তা শাস্ত্রে খুব ভালো ভাবেই বর্ণিত আছে —
যোহসৃজদ্দক্ষিণাদঙ্গাদ ব্রাহ্মণং লোকসম্ভবম্।
বামপার্শ্বাত্তথা বিষ্ণুং লোকরক্ষার্থমীশ্বরঃ ॥৩৪৫৷৷
[মহাভারত- অনুশাসনপর্ব্ব- অধ্যায়- ১৩—৩৪৫]
✅ অর্থ — যে ঈশ্বর (মহাদেব) দক্ষিণপার্শ্ব হতে জগতের সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করেছেন এবং লোকরক্ষার জন্য বামপার্শ্ব হতে বিষ্ণুকে উৎপাদন করেছেন ॥৩৪৫৷৷
🔵 আরও বলা আছে যে, ত্রিদেবরূপ সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিব ধারণ করেন—
ব্রহ্মশিরোপহর্তাষ মহিষঘ্নায় বৈ নমঃ।
নমস্ত্রিরূপধরায় সর্ব্বরূপধরায় চ ॥৩১১।।
[মহাভারত- অনুশাসনপর্ব্ব- অধ্যায়- ১৩—৩১১]
✅ অর্থ — আপনি ব্রহ্মার শিরশ্ছেদ ও মহিষাসুরকে বধ করিয়াছিলেন, আপনি ত্রিদেব - ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্রের রূপ ধারণ করেন এবং সকলের রূপই ধারণ করিয়া থাকেন আপনাকে নমস্কার ॥৩১১৷।
♦️ বিষ্ণুর জন্ম যে পরমেশ্বর শিব থেকে হয় তার কিছু প্রমাণ বৈষ্ণবদের প্রাণপ্রিয় পদ্মপুরাণ শাস্ত্র থেকে দেখে নেব—
'য একঃ শাশ্বতোদেবোব্রহ্মবন্দ্যঃ সদাশিবঃ ।
ত্রিলোচনোগুণাধারো গুণাতীতোহক্ষরোব্যয়ঃ ॥৩
পৃথকৃত্বাত্মনস্তাততত্র স্থানং বিভজ্য চ ।
দক্ষিণাঙ্গে সৃজাৎপুত্রং ব্রহ্মাণাং বামতো হরিম্ ॥৫
পৃষ্ঠদেশে মহেশানংত্রীপুত্রান্ সৃজিদ্বিভুঃ ।
জাতমাত্রাস্ত্রয়োদেবা ব্রহ্মাবিষ্ণুমহেশ্বরাঃ ॥৬”
[তথ্যসূত্র - পদ্মপুরাণ/ পাতালখণ্ড/১০৮ নং অধ্যায়]
✅ অর্থ — সেই এক সদাশিবই শাশ্বত, ব্রহ্মা দ্বারা অৰ্চিত, ত্রিলোচন, ত্রিগুণধারী, ত্রিগুণাতীত, অক্ষর (অক্ষর ব্রহ্মস্বরূপ) এবং অব্যয়। তিনি নিজ ইচ্ছায় নিজেকে তিনভাগে বিভক্ত করেন। তিনি তাঁর দক্ষিণ(ডান)ভাগ থেকে পুত্রস্বরূপ ব্রহ্মাকে, বামভাগ থেকে শ্রীহরিকে এবং পৃষ্ঠদেশ থেকে মহেশ্বরকে (অর্থাৎ রুদ্র) সৃষ্টি করেন। এই ভাবে সদাশিবের তিনপুত্র ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বর ত্রিদেব হিসেবে পরিচিতি পায়। [ তাই সদাশিবকে ত্রিদেবজনক বলা হয়]
মম বামে স্থিত বিষ্ণুর্দক্ষিণে চ পিতামহঃ।
জঠয়ে চতুরো বেদাঃ হৃদয়ে ব্রহ্মা শাশ্বতম্।।১২
[স্কন্দপুরাণ- প্রভাসখণ্ড- অধ্যায়- ৯]
✅ অর্থ — আমার বামভাগে বিষ্ণু, দক্ষিণভাগে ব্রহ্মা, জঠরে বেদ চতুষ্টয়, হৃদয়ে শাশ্বত ব্রহ্ম এবং লোচনে অগ্নি, সোম ও সূর্য্য প্রতিষ্ঠিত।।১২।।
স ত্বং মমাগ্রজঃপুত্রঃ সৃষ্টিহেতোর্বিনির্ম্মিতঃ।
মমৈব দক্ষিণাদঙ্গাদ্বামাঙ্গাৎ পুরষোত্তমমঃ।।৭৬
[কূর্মপুরাণ- পূর্বভাগ- অধ্যায়- ১০]
✅ অর্থ — তুমিই (ব্রহ্মা) আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র, সৃষ্টির নিমিত্তে আমার দক্ষিণাঙ্গ হতে বিনির্মিত হয়েছো, বামাঙ্গ হতে বিষ্ণু বিনির্মিত হয়েছেন।
♦️ শিবমহাপুরাণের রুদ্রসংহিতার দ্বিতীয় খণ্ডের ১৬ নং অধ্যায়ে বলা হয়েছে—
এক পরমাত্মা মহেশ্বরই তিন স্বরূপে অভিব্যক্ত। এই রূপভেদে তাঁর নিজের মায়াই কারণ। প্রকৃতপক্ষে প্রভু স্বাধীন। তিনি লীলার উদ্দেশ্যেই এই সৃষ্টি ইত্যাদি কার্য করে থাকেন। ভগবান শ্রীহরি তাঁর বাম অঙ্গ থেকে প্রকটিত হয়েছেন, আমি ব্রহ্মা তাঁর দক্ষিণ অঙ্গ থেকে প্রকটিত হয়েছি এবং আপনি রুদ্রদেব সেই সদাশিবের হৃদয় থেকে আবির্ভূত হয়েছেন; সুতরাং আপনিই শিবের পূর্ণরূপ। প্রভো! এইভাবে অভিন্ন রূপ হয়েও আমরা তিন রূপে প্রকটিত। সনাতনদেব! আমরা তিনজনই সেই ভগবান সদাশিব এবং শিবার পুত্র।।
✅⇒ ব্রহ্মা ও বিষ্ণু সদাশিবের ডান ও বাম পাশ থেকে উৎপন্ন হয়—
[লিঙ্গমহাপুরাণ- পূর্বভাগ- অধ্যায়- ১০২—৪৪]
[শিবমহাপুরাণ- রুদ্রসংহিতা- সৃষ্টিখণ্ড- অধ্যায়- ১৬—৩২]
[কূর্মপুরাণ- পূর্বভাগ- অধ্যায়- ২৫—৯২]
[ভাগবতপুরাণ- ৮ম স্কন্দ- অধ্যায়- ৭—২৩]
[ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ- অনুসঙ্গ পাডা- অধ্যায়- ২৬—৫৮]
👉এর থেকে নিশ্চিত হওয়া গেলো, বিষ্ণুর উৎপত্তি পরমেশ্বর শিব থেকে।
________________________________________________
ন্যায়শাস্ত্র মতে,
বিষ্ণুকে সরাসরি ব্রহ্ম বলেনি কোথাও। কোথাও কোথাও বিষ্ণুকে পরমেশ্বর বলে স্তুতি করা হয়েছে কিন্তু, পরমেশ্বর বলতে মূলত চতুর্ভুজ বিষ্ণুকে বোঝানো হয়নি, বিষ্ণুর মধ্যে অবস্থিত পরমাত্মাকেই বোঝানো হয়েছে।
ন্যায় শাস্ত্রে বলা হয়েছে, "কাশ্চিন্নিপাতভাজঃ" কোনো কোনো দেবতা অন্য দেবতার সহিত প্রধান বা অপ্রধান ভাবে স্তুত হয় [যাস্ক নিরুক্তম্/৭/৩/১০/৪],
নীতি শাস্ত্র অনুযায়ী,
"স্তুতি প্রিয়া হি বৈ দেবা বিষ্ণুমুখ্যা ইতি শ্রুতি" বেদে উক্ত বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতা স্তুতি বাক্যে সন্তুষ্ঠ হয় [শুক্রনীতি/১ম অধ্যায়/১৩৭] অর্থাৎ নীতিশাস্ত্র অনুযায়ীও বিষ্ণু একজন দেবতা, যাকে বিভিন্ন স্তুতি দ্বারা সন্তুষ্ঠ করা হয়, কারণ দেবতা মধ্যে বিষ্ণু শ্রেষ্ঠ "যথা নারায়ণদেবেশ্য মহাদেবাদিবেশ্বরঃ" দেবতাদের মধ্যে বিষ্ণু শ্রেষ্ঠ, ঈশ্বর শ্রেষ্ঠ মহাদেব [কূর্মমহাপুরাণ/৩০/৬৪]
একই কথা রয়েছে পদ্মপুরাণেও "যত্র নারায়ণ দেবো মহাদেবো দেবেশ্বরঃ" দেবতাদের মধ্যে বিষ্ণু শ্রেষ্ঠ, ঈশ্বর শ্রেষ্ঠ মহাদেব [পদ্মপুরাণ/স্বর্গখণ্ড/অধ্যায় ৩৩/৫০ শ্লোক]
কোথাও বিষ্ণু শব্দে ইন্দ্রাদি দেবতার ন্যায় একজন যজ্ঞভাগ গ্রহণকারী দেবতাকে বুঝিয়েছে । অন্যক্ষেত্রে ৩৩কোটি (শ্রেষ্ঠ) দেবতাদের একজনকে বুঝিয়েছে [নিঘন্টু/৭/১০/৪] অনুযায়ী বিষ্ণু অর্থে ইন্দ্রাদি দেবতার ন্যায় একজন দেবতাকে বোঝানো হয়েছে।
কোথাও পরমেশ্বরের সর্বব্যাপকতাকে বুঝিয়েছে "তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ দিবীব চক্ষুরাততম্" [শুক্ল-যজুর্বেদ/বৃহজ্জাবাল উপনিষদ/ অষ্টম ব্রাহ্মণ/৬ মন্ত্র] "হে সৰ্বব্যাপী পরমেশ্বর ! আমাকে এমন দিব্য জ্ঞানচক্ষু প্রদান করুন যাতে আমি আপনার সেই পরম ধাম, পরম পদকে সর্বদা নিজের আত্মস্বরূপের মধ্যেই প্ৰত্যক্ষ করতে পারি"।
শ্রুতিতেও বিষ্ণুকে ব্রহ্ম বলেনি, বিশেষণ হিসেবেই বলা হয়েছে, অর্থাৎ ঈশ্বরের সর্বব্যাপকত্ব, [নিঘন্টু/৫/৮/১] ও [নিঘন্টু/৫/৮/২] অনুযায়ী বিষ্ণু অর্থে বেষ্টন রহিত অর্থাৎ পরিধি ছাড়া বোঝানো হয়েছে। যার অর্থ দাঁড়ায় " সর্বব্যাপী"। [নিঘন্টু/১২/১৮/৫] মতে ঈশ্বর যখন আদিত্য রশ্মি সমূহে পরিব্যাপ্ত হন, তখন তার নাম হয় বিষ্ণু। [নিঘন্টু/১/২/৩/২৩] ও [নিঘন্টু/১/২/৩/২৪] অনুযায়ী যার থেকে প্রেরিত হয় “রশ্মি সমূহ” তাহাই আদিত্য, তাই সূর্যকে আদিত্য বিষ্ণু বলা হয়। বিষ্ণু(ব্যাপ্তপরমেশ্বর) তার রশ্মিদ্বারা সমগ্র জগৎ ব্যাপ্ত হয়ে আছেন বলেই ঈশ্বর সর্বব্যাপী। আর শ্রুতি শাস্ত্রে সর্বব্যাপী বলতে কাকে বুঝিয়েছে তা দেখে নেব- "সর্বব্যাপী স ভগবান্ তস্মাৎ সর্বগতঃ শিবঃ" [কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/শ্বেতাঃ উঃ/৩/১১] অর্থাৎ সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিবই সর্বব্যাপী। তাই তত্ত্বগত ভাবে বিষ্ণুর মধ্যে অবস্থিত পরমেশ্বর শিবকেই ব্রহ্ম বলা হচ্ছে। কিছু কিছু স্থানে বিষ্ণুকে ব্রহ্ম বলাও হয়, কিন্তু ঔপাধিক অর্থে নয় তত্ত্বগত অর্থে। অর্থাৎ সকল দেবতার মধ্যে অবস্থিত আত্মাকেই ব্রহ্ম হয় "আত্মা সর্ব্বং দেবস্য দেবস্য" আত্মাই সর্ব দেবগণের সর্ব্ববস্তু হয় [নিঘন্টু/৭/৪/১৮] তার অর্থ এই নয় যে চতুর্ভুজ পৌরাণিক বিষ্ণুকে বোঝাচ্ছে।
"অগ্নীষোমাব্ ইন্দ্রাগ্নী বিষ্ণুর্ ইইতি বৈকপ্লিকানি" অগ্নি-সোম, ইন্দ্র-অগ্নি,বিষ্ণু বৈকল্পিক (প্রধান দেবতা) তিন দেবতার মধ্যে যে কেউ-ই যজ্ঞে প্রধান হতে পারে [আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্র/২/১/৩২]।
তাই অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিষ্ণুকে যজ্ঞের প্রধান দেবতা হিসেবে শ্রুতিতে বলা হয়েছে "যজ্ঞ বৈ বিষ্ণু" [তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ] । কিন্তু মূলত উপরোক্ত তিন দেবতার মধ্যে যে কেউ-ই প্রধান দেবতা হতে পারে। যেমন অগ্নিকে মুখ্য দেবতা বলা হয়েছে "অগ্নির্বৈ সর্বাঃ দেবতাঃ" [ঐতঃ ব্রাঃ/১/৩], অর্থাৎ অগ্নি সকল দেবতার মধ্যে প্রধান। সকল দেবতা অর্থাৎ ইন্দ্রাদি দেবতার সাথে তুলনা করা হয়েছে মাত্র। কিন্তু মূলত অগ্নি ব্রহ্ম নন। কারণ ব্রহ্মের কোনো তুলনা হয় না "ন তস্য প্রতিমা অস্তি" [কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/শ্বেতাঃ উঃ/৪/১৯ এবং শুক্ল-যজুর্বেদ/৩২/৩]।
➠ শ্রুতিতে বলা আছে যে —
মহতঃ পরমব্যক্তং অবক্তাৎ পুরুষঃ পরঃ।
পুরুষাৎ ন পরং কিঞ্চিৎ সা কাষ্ঠা সা পরাগতিঃ ॥১১
[কঠ উপনিষদ/১ম অধ্যায়/৩য় বল্লী]
✅ অর্থ —হিরণ্যগর্ভ অপেক্ষা প্রকৃতি শ্রেষ্ঠ, প্রকৃতি অপেক্ষা পরমাত্মা শ্রেষ্ঠ, পরমাত্মা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নাই, উহাই গতির চরম সীমা, উহাই শ্রেষ্ঠ গতি ।।১১।।
শ্রুতিতে প্রকৃতিকে মায়া বলা হয়েছে, আর যিনি মায়ার থেকে শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ মায়ার অধীশ্বর তিনিই পরমেশ্বর। আর শ্রুতিতে মায়ার অধীশ্বর কাকে বলা হয়েছে তা দেখে নেব —
মায়ান্তু প্রকৃতং বিদ্যাষ্মায়িনন্তু মহেশ্বরম্।
তস্যাবয়ভূতৈস্তু ব্যাপ্তং সর্ব্বমিদং জগৎ॥ ১০
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/শ্বেতাঃ উঃ/৪/১০]
✅ অর্থ —মায়াকেই প্রকৃতি ও মায়াধিষ্ঠাতাকে মহেশ্বর জানিবে।মহেশ্বরের অবয়ব দ্বারাই এই সমস্ত জগৎ ব্যাপ্ত ।।১০
অর্থাৎ যিনি প্রকৃতির ঊর্ধ্বে তিনিই মহেশ্বর অর্থাৎ পরমেশ্বর শিব। বলে রাখা ভালো প্রকৃতি অর্থাৎ মায়াকে ত্রিগুণাত্মিকা বলা হচ্ছে, আর পরমেশ্বর শিব ত্রিগুণাতীত, অর্থাৎ ত্রিগুণের (সত্ত্ব,রজ,তম) ঊর্ধ্বে। ইতিহাস শাস্ত্র মহাভারতে বলেছে,
মহেশ্বরশ্চ লোকানাং মহতামীশ্বরশ্চ সঃ ।।
[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩৯/২৮]
✅ অর্থ —তিনি (পরমেশ্বর শিব) প্রধান লোকদিগের ঈশ্বর বলেই শিব মহেশ্বর।।২৮।।
এবার শ্রুতিতে বলা হচ্ছে পরমাত্মা থেকে শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নেই, পরমাত্মা এক ও অদ্বিতীয় "একমেবাদ্বিতীয়ম" ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয় [ছাঃ উঃ/৬/২/১]।
তাহলে বেদানুযায়ী সিদ্ধান্ত দেখলে এটাই মান্যতা পাই পরমেশ্বর এক, দুজন পরমেশ্বর হতে পারে না। কেননা পরমেশ্বর যদি দুজন হয়, তাহলে তা শ্রুতি বিরুদ্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং, এখন দেখার বিষয় হলো বেদ অনুযায়ী সেই অদ্বিতীয় পরমেশ্বর কে। আর শ্রুতিতে অদ্বিতীয় পরমেশ্বর বলতে বলেছে, "এক হি রুদ্র ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য" রুদ্রই (পরমশিব) অদ্বিতীয় পরমেশ্বর দ্বিতীয় কোনো সত্ত্বা নেই [কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/শ্বেতাঃ উঃ/৩/২] "শিব এব কেবলঃ" একমাত্র শিব আছেন [কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/শ্বেতাঃ উঃ/৪/১৮]
একই কথার সমর্থন পাওয়া যায় ন্যায় শাস্ত্রের মধ্যেও যেখানে রুদ্রকে (পরশিবকে) অদ্বিতীয় পরমেশ্বর বলা হচ্ছে "এক এব রুদ্র অবস্ততে ন দ্বিতীয় " অর্থাৎ রুদ্র ভিন্ন দ্বিতীয় কোনো সত্ত্বা নেই [নিঘন্টু/১/২/৪/৯]।
______________________________________________
ভগবান বিষ্ণুর যোগনয়ন দ্বারা পরমেশ্বর শিবকে দেখার কারণ হলো বিষ্ণু পারমার্থিক দৃষ্টিকোণে শিবতত্ত্ব। কারণ বিষ্ণুরূপ টা পরমেশ্বর শিবই ধারণ করেন, যার বহু প্রমাণ শাস্ত্রে পাওয়া যায় —
যোবৈ রুদ্রঃ স ভগবান যশ্চ বিষ্ণু তস্মৈ বৈ নমো নমঃ।।২।।
[অথর্ব-শির উপনিষদ- ২]
✅ অর্থ — যিনি সেই পরমেশ্বর রুদ্র বিষ্ণুরূপ ধারণ করে অখিলব্রহ্মাণ্ড পালন করছে, সেই পরমেশ্বর রুদ্রকে পুনঃ পুনঃ প্রমাণ করি।।২
নমো গিরিশয়ায় চ শিপিবিষ্টায় চ।।২৯
[শুক্লযজুর্বেদ- অধ্যায়- ১৬—২৯]
✅ অর্থ — গিরিতে (কৈলাস) বাস করা পরমেশ্বর রুদ্রকে নমস্কার, বিষ্ণুরূপ ধারণকারী পরমেশ্বর রুদ্রকে নমস্কার।।
যঃ শেতে শেষশয়নে বিশ্বমাবৃত্য মায়য়া।
স্বাত্মাস্বানুভূতিযোগেন তস্মৈ বিশ্বাত্মনে নমঃ।।৬৩
[কূর্মপুরাণ/পূর্বভাগ/অধ্যায়- ১০—৬৩]
✅ অর্থ — যিনি(মহাদেব) স্বীয় আত্মার অনুভূতিযোগে মায়া দ্বারা বিশ্বকে আবৃত করিয়া শেষশয্যায় শয়ন করিয়া রহিয়াছেন, সেই বিষ্ণুমূর্তি পুরুষকে নমস্কার ।।৬৩
👉একই প্রমাণ মহাভারতেও পাওয়া যায় —
সংভক্ষ্য সর্বভূতানি যুগান্তে পৰ্য্যুপস্থিতে।
যঃ শেতে জলমধ্যস্থস্তং প্রপদ্যেহম্বুশায়িনম্ ॥১০১
[মহাভারত/শান্তিপর্ব/অধ্যায় ২৭৭/১০১ শ্লোক]
✅ অর্থ — প্রলয়কাল উপস্থিত হইলে, যিনি সমস্ত ভূতকে উদরস্থ করিয়া জলমধ্যে শয়ন করেন, সেই জলশায়ী নারায়ণরূপী মহাদেবের শরাণাপন্ন হইতেছি ॥১০১
(এখান থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে, মহাভারতে নারায়ণ বলতে যার এত প্রশংসা ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে তা মূলত নারায়ণরূপধারী পরমেশ্বর শিবের ই পরমত্বকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে)
👉এর একই প্রমাণ শ্রুতি শাস্ত্রেও পাওয়া যায়—
👉তাই এক্ষেত্রে যদি কোথাও নারায়ণকে পরমেশ্বর ও মাতা লক্ষ্মীকে পরমেশ্বরী বলে সম্বোধন করা হয় তাতে পমেশ্বর শিবের ও মাতা উমার পরমত্বের বিন্দু পরিমাণ ও হানি হয় না। কেননা নারায়ণ রূপে সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিবই বিদ্যমান আর লক্ষ্মীরূপে মাতা উমাই প্রকাশিত হচ্ছে, শ্রুতিই এই প্রমাণ দিচ্ছে। আর ব্যাস সংহিতার ১/৪ নং প্রমাণ অনুযায়ী শ্রুতির বচনই সর্বোচ্চ, তাই শ্রুতির বাক্যকে পুরাণ, স্মৃতি, ইতিহাস ইত্যাদি শাস্ত্র দ্বারা খণ্ডিত করা যায় না। তাই এক্ষেত্রে শ্রুতির প্রমাণই সর্বোচ্চ মান্যতা পাবে, ইহাই দৃষ্টান্ত।
👉চতুর্ভুজ নারয়ায়ণ রূপে পরমেশ্বর শিবই সর্বব্যাপ্ত আছেন—
ॐকারং চতুর্ভুজং লোকনাথং নারায়ণম্।
সর্বস্থিতং সর্বগতং সর্বপব্যাপ্তং তন্মে মনঃ শিবসঙ্কল্প মস্তু।।২২।।
[ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০ মণ্ডল/১৭১ সূক্ত/২২নং মন্ত্র এবং ঋগ্বেদ/শাকলশাখা/খিলভাগ/৪ অধ্যায়/২২]
✅ অর্থ — যিনি ॐ-কার, যিনি চতুর্ভুজ (চারহাত বিশিষ্ট), অখিলব্রহ্মাণ্ডের স্বামী, সর্বত্রবিরাজমান, সর্বজ্ঞাতা সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী সেই নারায়ণরূপী পরমেশ্বর শিবের প্রতি মন সংকল্পিত হোক।।২২।।
ব্রহ্মবিষ্ণুসুরেন্দ্রাণাং রুদ্রাদিত্যাশ্বিনামপি।
বিশ্বেষামপি দেবানাং বপুর্ধারযতে ভবঃ ।।১৩৯৷৷
নরাণাং দেবনারীণাং তথা প্রেতপিশাচযোঃ।
কিরাতশবরাণাঞ্চ জলজানামনেকশঃ ।।১৪০৷৷
[মহাভারত- অনুশাসনপর্ব- অধ্যায়- ১৩—১৩৯/১৪০]
✅ অর্থ — 'ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র, রুদ্র, আদিত্য, অশ্বিনীকুমার, বিশ্বদেবগণ, মনুষ্যগণ, দেবীগণ, প্রেতগণ, পিশাচগণ, ব্যাধগণ, শবরগণ এবং অনেক প্রকার জলজন্তগণের রূপই মহাদেব ধারণ করিয়া থাকেন ॥১৩৯-১৪০৷৷
ব্রহ্মা ভবশ বিষ্ণুশ্চ স্কন্দেদ্ৰৌ সবিতা যমঃ।
বরুণেন্দুমনুর্দ্ধাতা বিধাতা ত্বং ধনেশ্বরঃ ॥২২॥
[মহাভারত- অনুশাসনপর্ব- অধ্যায়- ১৫—২২]
✅ অর্থ — দেবদেব! ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, কার্ত্তিক, ইন্দ্র, সূর্য্য, যম, বরুণ, চন্দ্র, মনু, ধাতা, বিধাতা ও কুবের এই সকলই আপনি ॥২২॥
আদিত্যানাং ভবান্ বিষ্ণুর্বসূনাঞ্চৈব পাবকঃ।
পক্ষিণাং বৈনতেয়স্তমনন্তো ভুজগেষু চ ॥৩২০৷৷
[মহাভারত- অনুশাসনপর্ব- অধ্যায়- ১৩—৩২০]
✅ অর্থ — আপনি (মহাদেব) আদিত্য তথা দেবগণের মধ্যে বিষ্ণু, বসুগণের মধ্যে অগ্নি, পক্ষিগণের মধ্যে গরুড় এবং নাগগণের মধ্যে অনন্ত ॥৩২০॥
👉শাস্ত্রে এটাও বলা আছে যে, শিবই বিষ্ণু রূপে দুরাচারী অসুর, দৈত্যদের সংহার করেন —
বৈষ্ণবং রূপমাস্থায় দূর্বৃত্তান হন্মি তানহম্।।১১৯
[স্কন্দপুরাণ- প্রভাসখণ্ড- অধ্যায়- ২৪—১১৯]
✅ অর্থ — আমিই (মহাদেব) বিষ্ণুরূপে সেই দুর্ব্বৃত্ত দৈত্যগণকে নিহত করিব।।১১৯
👉এবং নারায়ণ যোগ দ্বারা নিজেকে মহাদেব বলে জানছেন—
বেত্থ নারায়ণানন্তমাত্মানং পরমেশ্বরম্।
মহাদেবং মহাযোগং স্বেন যোগেন কেশব ॥৮৩
[কূর্মপুরাণ - পূর্ব্বভাগ- অধ্যায়- ২৫—৮৩]
✅ অর্থ — হে নারায়ণ কেশব! আপনি স্বীয় যোগের দ্বারা আপনাকেই(নিজের আত্মাকেই) অনন্ত পরমেশ্বর মহাযোগী মহাদেব বলিয়া জানিতেছেন।৮৩
👉বৈদিক শব্দকোশ নিঘন্টু তে' বিষ্ণু' শব্দের ব্যাখ্যায় কি আছে সেটা এবার দেখে নেবো— “শিপিবিষ্টো বিষ্ণুরিতি বিষ্ণোদ্বৈ নামনি ভবতঃ”| (নিঘন্টু/৫/৭) ✅ অর্থ — যিনি শিপিবিষ্ট, তিনিই বিষ্ণু। আর শ্রুতিতে কাকে শিপিবিষ্ট নামে সম্বোধন করা হয়েছে তাঁর শব্দ প্রমাণ নিম্নে দেওয়া হল - " নমঃ কপর্দিনে চ ব্যুপ্তকেশায় চ | নমঃ সহস্রাক্ষায় চ শতধন্বনে চ নমো গিরিশযায চ শিপিবিষ্টায চ নমো মীঢুষ্টমায চেষুমতে চ || ২৯ || " (যজুর্বেদ/তৈঃ সং/৪/৫- শতরুদ্রিয়) - বেদ ভাষ্যকার সায়ণাচার্য সহ আচার্য মহীধর, উবট প্রত্যেকেই সংশ্লিষ্ট উদ্ধৃতি সমূহকে 'শতরুদ্রীয়' হিসেবে মান্যতা দিয়ে গেছেন। বেদের শতরুদ্রীয় যে সাক্ষাৎ শিবের প্রতি সমর্পিত সেটা সর্ব শাস্ত্র মান্য। তাই ন্যায়শাস্ত্র মতে ইহা হল' দৃষ্টান্তের ' লক্ষণ। আর দৃষ্টান্তের কোনো খণ্ডন হয় না। আর' শিপিবিষ্ট' নাম শিব মহাপুরাণের কোটিরুদ্র সংহিতায় শিব সহস্রনামের মধ্যেও পাওয়া যায়। শ্রুতি মান্যতা সহ প্রমাণ করা হল যে শিপিবিষ্ট বা বিষ্ণু এই শব্দটি পরমশ্বর শিবের উদ্দেশেই সমর্পিত।
👉তাছাড়া জগতের সব নাম পরমেশ্বর শিবেরই —
সর্বাণি হ বা অস্য নামধেয়ানি ।। ২৭।।
[আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র— ৪-৯- ২৭]
✅ অর্থ — সকলই রুদ্রেরই নাম।।
বিবৃতি— জগতের যত নাম তা বস্তুত রুদ্রেরই নাম, রুদ্র নিজেই হন সর্বব্যাপী।
👉তাই জগতের সব নাম পরমেশ্বর শিবের এ কথা শাস্ত্র বলছে। তাই এখান থেকেই প্রমাণ হয় বিষ্ণু নাম টা ও পরমেশ্বর শিবেরই।
👉শাস্ত্র থেকে দেখানো হলো শিবই বিষ্ণুর রূপ ধারণ করছে। এবং বিষ্ণু যোগের মাধ্যমে জানতে পারছেন যে, বিষ্ণুর অন্তসত্ত্বা মূলত পরমেশ্বর শিব।
গুণভেদে পরমেশ্বর শিব আর বিষ্ণুর মধ্যে ব্যবহারিক পার্থক্য আছে। পরমেশ্বর সব গুণের অতীত কিন্তু, বিষ্ণু অন্তরে তমগুণ এবং বাইরে সত্ত্বগুণ ধারণ করেন। এটাও পরমেশ্বর শিবের ইচ্ছা।
অদ্বৈত ত্রিক শৈব দর্শনের ভিত্তিতে — পরমেশ্বর শিব মায়ার ষট্কঞ্চুক দ্বারা নিজেকে আবদ্ধ করে বিষ্ণুতত্ত্বে নিজেকে সংকুচিত করে নিজ বিমর্শ হৃদয়ে অনুভব করছেন (level of experience) যাকে বলা হয় ‘আভাসবাদ’। এক কথায় বলতে গেলে পরমেশ্বর শিব বিষ্ণুরূপে নিজেকে প্রকাশ করছেন।
তাই ভগবান বিষ্ণু যোগনয়ন দ্বারা একমাত্র পরমেশ্বর শিবকেই দেখে থাকেন।
এর থেকে পরিষ্কার ভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর শিবের সাথে যোগযুক্ত হয়ে ভগবদ্ জ্ঞান দিয়েছিলেন, যা পরমেশ্বর শিবের প্রতি সমর্পিত।
এবার অনেক বৈষ্ণব ব্যক্তি দাবি করতে পারেন যে, আপনাদের অদ্বৈত দর্শনের ভিত্তিতে করা বিশ্লেষণ আমরা বৈষ্ণবেরা মানবো না, কোনো রামানুজ পন্থী বৈষ্ণবও এমন দাবি করতে পারেন যে, সায়ণাচার্য প্রমুখ বেদভাষ্যাকারেরা শৈব শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন তাই তাদের অদ্বৈত বেদভাষ্য মানবো না। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি,
নিরুক্ত থেকে প্রমাণ করে দেওয়া হয়ে গেছে যে শিপিবিষ্ট কথার অর্থ বিষ্ণু, যা শিবেরই স্বরূপ প্রকাশ মাত্র।
আর অদ্বৈতবাদ যে সর্বোপরি তা বৈষ্ণবদেরই শাস্ত্র নির্দেশনা দিচ্ছে 👇
🔔অদ্বৈত সম্বন্ধে গরুড়পুরাণ বলছে 👇
অদ্বৈতযোগসম্পন্নাস্তে মুচ্যন্তেতি বন্ধনাৎ ॥৩
[গরুড়পুরাণ/অষ্টাবিংশাধিকারদ্বিশততম অধ্যায় (আত্মজ্ঞানকথন)]
✅ অর্থ — যাহারা অদ্বৈত জ্ঞান সম্পন্ন তাহারা ভববন্ধন থেকে মুক্ত হইতে পারে । ৩
🔔দ্বৈত সম্বন্ধে গরুড়পুরাণ 👇
[গরুড়পুরাণ/অষ্টাবিংশাধিকারদ্বিশততম অধ্যায় (আত্মজ্ঞানকথন)]
একেন জন্মনা জ্ঞানাৎ মুক্তিম দ্বৈততাবিনাং ।
যোগভ্রষ্টা কুযোগাশ্চ বিপ্ৰা যোগীকুলোদ্ভবা ॥১১
✅ অর্থ — দ্বৈতজ্ঞানীদের এক জন্মে মুক্তি হইতে পারে না। তাহারা যোগভ্রষ্টা হইয়া যোগীরূপে ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করে।
আপনাদের ই তথাকথিত সাত্ত্বিক গরুড় পুরাণ থেকে প্রমাণিত হলো যে, আপনাদের বৈষ্ণবদের সকল আচার্য যেহেতু অদ্বৈতজ্ঞানহীন, তথা এই অদ্বৈত দর্শনকে স্বীকার করেন না, সুতরাং তাদের কোন ভাষ্য বা সেইসব আচার্যদের লেখা কোন পুস্তকের কোন যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয় - গরুড় পুরানের এই বচন অনুসারে। কারণ অদ্বৈত দর্শনই একমাত্র পরম মুক্তির সর্বোচ্চ মার্গ। এ কারণে রামানুজ বা অন্যান্য কোন বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী, দ্বৈতবাদী, অচিন্ত্যভেদাভেদবাদী প্রভৃতি বৈষ্ণব আচার্যের দেওয়া নির্দেশনা বা ব্যাখ্যা করা শাস্ত্র বা যুক্তি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় ।
________________________________________________
এবার যদি প্রশ্ন করেন যে, গীতায় তো বলা হয়েছে শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর।
তাহলে আপনাদের বলি— গীতায় ‘আমি’ বলতে বুঝিয়েছে নিজের আত্মাকে, অর্থাৎ আত্মাই ব্রহ্ম।
শরীর তো নশ্বর, একটা সময়ের পর শরীর ও নষ্ট হয় কিন্তু, আত্মা তো অবিনশ্বর। আত্মার কোনো জন্ম মৃত্যু নেই। আর শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন জীবন্মুক্ত। অর্থাৎ মানব রূপে লীলা করছেন কিন্তু, শ্রীকৃষ্ণ নিজের আত্মার অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেন।
তাই শ্রীকৃষ্ণ আমি ব্রহ্ম বলতে একমাত্র আত্মাকেই বুঝিয়েছে।
👉তাহলে এখানে আবার অনেকে প্রশ্ন করবে যে, শ্রীকৃষ্ণ যদি পরমেশ্বর না হন তাহলে, অর্জুনকে বিশ্বরূপ কীভাবে দেখিয়েছিলেন?
হ্যা, এটা ঠিক যে, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন কিন্তু, তার মানে এই নয় যে শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণব্রহ্ম।
শাস্ত্রে বলছে যে—
মহর্ষি দধীচি ও নারায়ণের যুদ্ধের একটা সময়ে যখন, নারায়ণ তার ভীষণ বিষ্ণুমূর্তি প্রকট করেন তখন, মহর্ষি দধীচিও বিষ্ণুকে নিজের মধ্যে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড দর্শন করান। মহর্ষি দধীচিও বিশ্বরূপ প্রকট করেন।
[শিবমহাপুরাণ- রুদ্রসংহিতা-সতীখণ্ড- অধ্যায়- ৩৯]
👉তাহলে এবার আমার প্রশ্ন হলো, বিশ্বরূপ প্রকট করলেই যদি পরমেশ্বর হয় তাহলে তো মহর্ষি দধীচিও পরমেশ্বর, কারণ মহর্ষি দধীচিও তো বিশ্বরূপ প্রকট করেছেন । তাই না ?
কিন্তু আসলে তা নয়,
এখানে লুকিয়ে থাকা মীমাংসা টা জানতে হবে। বিশ্বরূপ প্রকট করা যেকোনো আত্মজ্ঞানী জীবের পক্ষে সম্ভব।
তাছাড়া মহর্ষি দধীচি ও শ্রীকৃষ্ণ উভয়েই ছিলেন জীবন্মুক্ত। অর্থাৎ এনারা জীবিত অবস্থাতে নশ্বর দেহ থেকে মুক্ত ছিলো। কেন মুক্ত ছিলেন ?
কারণ— তাদের আত্মজ্ঞান ছিলো, তারা জানতেন - আত্মাই ব্রহ্ম। আর যাদের ব্রহ্ম উপলব্ধি হয় তাদের পক্ষে কোনো কিছুই কঠিন নয়। তাই মহর্ষি দধীচি ও শ্রীকৃষ্ণ বিশ্বরূপ প্রকট করতে সক্ষম ছিলেন।
এবার অনেকেই বলবেন যে, শ্রীকৃষ্ণ ভগবত গীতায় বলেছেন আমি অমৃত স্বরূপ আমি সবকিছু কেন বলেছেন ?
এর উত্তর হল — আত্মজ্ঞান উপলব্ধি করে ব্রহ্ম সপ্তাহে নিজের আমিত্বকে উন্নীত করে ত্রিশঙ্কু ঋষিও একই কথা বলেছিলেন, প্রমাণ 👇
ত্রিশঙ্ক মুনি ব্রহ্ম লাভের পর বললেন —
অহং বৃক্ষস্য রেরিবা। কীর্তিঃ পৃষ্ঠং গিরেরিব। ঊর্ধ্বপবিত্রো বাজিনীব স্বমৃতমস্মি। দ্রবিণং সবর্চসম্। সুমেধা অমৃতোক্ষিতঃ। ইতি ত্রিশঙ্কোর্বেদানুবচনম্ ॥ ১
(তৈত্তিরীয় উপনিষদ/শিক্ষা বল্লী-১০ অধ্যায়/অনুবাক-১)
✅ অর্থ — ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করার পর ত্রিশঙ্ক মুনি বলেছেন — আমি সংসাররূপী বৃক্ষের প্রেরয়িতা। ব্রহ্মে পরিনত হয়ে আমি সমস্ত বিশ্বের সাথে একাত্ম হতে পেরেছি।
গিরিপৃষ্ঠের ন্যায় আমার(ব্রহ্মের) কীর্তি উচ্চ। ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হবার দরুন আমার কীর্তি ব্রহ্মের মতো মহান ও অনন্ত। (আমি ব্রহ্মের সাথে একাত্ম হতে পেরেছি তাই) আমি (অর্থাৎ আত্মারূপী আমি) পবিত্র। সূর্যে যেমন উত্তম অমৃত আছে আমিও সেরূপ উত্তম অমৃত। আমিই সেই ধনরূপ আত্মতত্ব শ্রেষ্ট মেধাযুক্ত। আমি অমৃত ও অক্ষয়।
শ্রীকৃষ্ণ যদি, আমিই সব বলতে শ্রীকৃষ্ণ কেই বোঝাতেন, আর এর জন্যই যদি একমাত্র শ্রীকৃষ্ণ ই ঈশ্বর হয়ে থাকেন। তাহলে ভেবে দেখুন ত্রিশঙ্কু ঋষিও একই কথা বলেছেন যে, তিনিই সব । তাহলে আপনাদের যুক্তি অনুযায়ী সনাতন ধর্মে দুইটি ভিন্ন ভিন্ন ঈশ্বর হতো। কিন্তু সনাতন ধর্মে ঈশ্বর একজনই। তবে এর মীমাংসা কি ?
এর মীমাংসা হল - আত্মজ্ঞান।
👉এবার তাহলে আত্মজ্ঞান কি জানা যাক। শাস্ত্রে বলেছে —
আত্মকর্ম্মসু মোক্ষো ব্যাখ্যাতঃ।।১৬
[বৈশেষিক দর্শন- ৬ষ্ঠ অধ্যায়- ২য় আহ্নিক—১৬]
✅ অর্থ — আত্মকর্ম হলে মোক্ষ হয় ইহা কথিত হয়েছে।।১৬
👉এখানে টীকাকার আত্মকর্ম্ম বলছে বুঝিয়েছে আত্মসাক্ষাৎকার(আত্মজ্ঞান)। অর্থাৎ নিজের আত্মস্বরূপকে উপলব্ধি করা। জীবের যখন আত্মসাক্ষাৎকার হয় তখন নশ্বর দেহের প্রতি আর অহং বোধ অর্থাৎ, "দেহটাই আমি" এই বোধ থাকে না।
তাই জীবের মোক্ষের জন্য আত্মসাক্ষাৎকার (আত্মজ্ঞান) এই একমাত্র পথ।
সয়ো হ বৈ তৎপরমং ব্রহ্ম যো বেদ বৈ মুনিঃ ।
ব্রহ্মৈব ভবতি স্বস্থঃ সচ্চিদানন্দমাতৃকঃ ॥
ইত্যুপনিষৎ ॥ ৫২ ॥
(রুদ্র হৃদয় উপনিষদ/৫২ নং মন্ত্র)
অর্থ — যে ব্যক্তি নিশ্চিতভাবে পরমব্রহ্মকে নিজ আত্মস্বরূপে অবস্থিত বলে জেনে নেন, তিনিই মুনি । সেই মুনি ব্যক্তি নিজেরা আত্মাকে ব্রহ্ম বলে ভেবে নিজেকে সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম বলেই দাবি করেন ( অর্থাৎ আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি নিজের আত্মাই প্রকৃত আমি এবং ঐ আমিরূপী আত্মাই ব্রহ্ম এমনটা ভেবে আমিই ব্রহ্ম বলতে নিজ আত্মাকে ব্রহ্ম-শিব বলে বুঝিয়ে থাকেন) । এমন কথা বলেই এই রুদ্রহৃদয় উপনিষদ সম্পূর্ণ হল ॥ ৫২ ॥
👉এবং একই কথার সমর্থন পাওয়া যায় তন্ত্রেও—
মোক্ষস্য কারণং সাক্ষাতত্ত্বজ্ঞানং কুলেশ্বরী।।৮৬
[কূলার্ণব তন্ত্র- ১ম উল্লাস—৮৬]
✅ অর্থ — সাক্ষাৎ তত্ত্বজ্ঞানই মোক্ষের কারণ ।।৮৬
এখানে টীকাকার তত্ত্বজ্ঞান বলতে বুঝিয়েছে—
তত্ত্বজ্ঞান— আত্মজ্ঞান(প্রত্যভিজ্ঞা) বা ব্রহ্মজ্ঞান।
মোক্ষস্যকারণং— মোক্ষের কারণ।
আত্মসন্বিদের উদয় হলে অর্থাৎ আত্মরূপের যথাযথ জ্ঞান অর্জন হলে যে অবস্থা হয় তাকেই বলে মোক্ষ।
সাক্ষাৎ তত্ত্বজ্ঞান অর্থাৎ আত্মস্বরূপের উপলব্ধি বা আত্মসন্বিদের উদয় (বেদের ভাষায় যাকে বলা হয় "অহং ব্রহ্মাস্মী" অবস্থা অর্থাৎ আমিই ব্রহ্ম। এখানে আমি বলতে আত্মাকেই বোঝানো হয়েছে “অয়মাত্মা ব্রহ্ম”)।
👉যার আত্মজ্ঞান রয়েছে তিনি ব্রহ্মের স্বরূপ হয় ও মোক্ষ লাভ করে। শ্রীকৃষ্ণের আত্মজ্ঞান ছিলো বলেই, শ্রীকৃষ্ণকে জীবন্মুক্ত বলা হতো।
পরমেশ্বরের তত্ত্ব সম্পর্কে জানা ও পরমেশ্বর ঘোষিত করা দুটির মধ্যে আপাত পার্থক্য আছে।
👉তাছাড়া শ্রীকৃষ্ণ এমন কিছু লীলা করেছেন, যার জন্য শ্রীকৃষ্ণের উপর দোষ আরোপিত হয়।
পরমেশ্বরের উপর যদি দোষ আরোপিত হয় তাহলে, পরমেশ্বরের পরমত্ব খণ্ডিত হয়ে যায়। তাই শ্রীকৃষ্ণ নিজের আত্মাকে ব্রহ্ম জানলেও, শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণব্রহ্ম নন।
👉কারণ ব্রহ্মের জন্ম বা মৃত্যু নেই কিন্তু শাস্ত্রে বলছে
শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছে, মৃত্যু ও হয়েছে —
“কৃষ্ণায় 'দেবকীপুত্রায়োক্ত”
[ছান্দোগ্য উপনিষদ- সপ্তদশখণ্ড- অধ্যায়-৩—৬]
✅ অর্থ — দেবকীনন্দন কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে।।৬
👉শ্রীকৃষ্ণ যে দেবকীর পুত্র তা স্পষ্ট। অর্থাৎ দেবকীর গর্ভে কৃষ্ণের জন্ম।
👉আরও কিছু দেখা যাক —
ততঃ শরীরে বাসস্য বাসুদেবস্য চোভযোঃ।
অন্বিষ্য দাহয়ামাস পুরুষেরাপ্তকারিভিঃ ॥৩১
স তেষাং বিধিবৎ কৃত্বা প্রেতকার্য্যাণি পাণ্ডবঃ।
সপ্তমে দিবসে প্রায়াদ্বথমারুহ্য সত্বরঃ ॥৩২॥
[মহাভারত- মৌষলপর্ব্ব- অধ্যায়- ৭—৩১/৩২]
✅ অর্থ — তাহার পর অর্জুন, রাম ও কৃষ্ণের শরীর দুইটি অন্বেষণ করিয়া বিশ্বস্ত ঔর্দ্ধদেহিক ক্রিয়াধিকারী পুরুষগণদ্বারা সেই শরীর দুইটি দাহ করাইলেন॥৩১
অর্জুন যথাবিধানে তাঁহাদের প্রেতকার্য্য করাইয়া সপ্তম দিবসে রথে আরোহণ করিয়া সত্বর দ্বারকা হইতে প্রস্থান করিলেন॥৩২
👉নারায়ণই কৃষ্ণ রূপে ধর্ম স্থাপনের জন্য জন্ম গ্রহণ করেন এবং মৃত্যুবরণ ও করেন—
ভুজৈশ্চতুর্ভিঃ সমুপেতং মমেদং রূপং বিশিষ্টং জীবিতং সংস্থিতঞ্চ।।৩৩
[মহাভারত- মৌষলপর্ব্ব- অধ্যায়- ৪—৩৩]
✅ অর্থ — দেবগণ! আমার এই রূপ চতুর্ভুজযুক্ত ; এতদভিন্ন দ্বিভুজযুক্ত কৃষ্ণরূপে আমি মর্ত্যলোকে জীবিত ছিলাম; পরে মৃত্যু বরণ করিয়াছি।।৩৩
👉এর থেকে জানা গেলো শ্রীকৃষ্ণের জন্ম ও মৃত্যুর রহস্য। তাই শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর নয়৷
এখানে মূল খেলাটা হলো পারমার্থিক তত্ত্বের, ব্যাপার টা বুঝিয়ে বলি —
পরমেশ্বর শিব নিজেকে মায়া দ্বারা সংকুচিত করে বিষ্ণু তত্ত্বে প্রকাশিত হচ্ছেন। এবং বিষ্ণুরূপ ধারণ কারী পরমেশ্বর শিবই কৃষ্ণ রূপে নিজেকে সংকুচিত করছেন। এখন পারমার্থিক দৃষ্টিকোণে তো কৃষ্ণ শিবতত্ত্ব কিন্তু, ব্যবহারিক পর্যায়ে এক নন। অর্থাৎ কৃষ্ণের মধ্যে অবস্থিত আত্মাটাই পরমেশ্বর শিব।
তাই তো শ্রীকৃষ্ণ, পরমেশ্বর শিবের সাথে যোগযুক্ত হয়ে জ্ঞান দিয়েছিলেন।
তাই বলা হয়েছে যে,
পরম হি ব্রহ্ম কথিতং যোগ যুক্তেন তন্ময়,
ইতিহাসং তু বক্ষামি তস্নবন্নথৈ পুরাতনম"।।
(মহাভারত/আশ্বমেধিকপর্ব/অধ্যায় ১৬/ শ্লোক১৩)
✅ অর্থ — সে সময় আমি যোগযুক্ত হয়ে পরমাত্মাতত্ত্বের বর্ননা বিবর্তন করেছিলাম। এখন সেই বিষয় এর জ্ঞান করানোর জন্য আমি এক প্রাচিন ইতিহাস বর্ণনা করছি।♦️ শুধু কৃষ্ণের নয়, সর্বভূতের ও সকল জীবের আত্মা হলেনপরমেশ্বর শিব —
দেহো দৈবালয় প্রোক্তঃ স জীবঃ কেবলঃ শিবঃ।।১
[বেদ/মৈত্রেয়ী উপনিষদ/অধ্যায় ২/ মন্ত্র নং ১]
✅ অর্থ — শরীর হচ্ছে দেবালয় এবং উক্ত শরীরে যে জীবের আত্মা আছেন তিনিই পরমেশ্বর শিব।।১
ত্বং নো গতিশ্চ শ্রেষ্ঠশ্চ ত্বমেব হৃদয়ং তথা।
ত্বং ব্রহ্মা সর্ব্বদেবানাং রুদ্রাণাং নীললোহিতঃ।৩১৫
আত্মা চ সর্বভূতানাং সাংখ্যে পুরুষ উচ্যসে।
ঋষভত্ত্বং পবিত্রাণাং যোগিনাং নিষ্কলঃ শিবঃ॥৩১৬
[মহাভারত-অনুশাসনপর্ব্ব- অধ্যায়- ১৩—৩১৫/৩১৬]
✅ অর্থ — আপনি (মহাদেব) আমার গতি, আপনিই হৃদয়স্থিত জীবাত্মা ও সর্ব্বশ্রেষ্ঠ এবং আপনি সমস্ত দেবতার মধ্যে ব্রহ্মা ও রুদ্রগণের মধ্যে নীললোহিত ॥ ৩১৫
আপনি সমস্ত প্রাণীর জীবাত্মা, সাংখ্যে পুরুষ বলিয়া উক্ত হইয়াছেন। পবিত্রগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং যোগিগণের মধ্যে পূর্ণ নিষ্কল নিরাকার শিব ॥ ৩১৬
সর্বভূতকরো যস্মাৎ সর্বভূতপতিহরঃ।
সর্বভূতান্তরাত্মা চ তেন ত্বং ন নিমন্ত্রিতঃ॥১১১
[মহাভারত- শান্তিপর্ব্ব- অধ্যায়-২৭৭—১১১]
✅ অর্থ — হে মহাদেব যেহেতু আপনি সর্বভূতের সৃষ্টিকর্তা, সর্বভূতের অধিপতি এবং সর্বভূতের অন্তরাত্মা; সেই হেতুই আপনাকে যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করি নাই ॥১১১
যো যোনিং যোনিমধিতিষ্ঠত্যেকো যেনেদং সর্ব্ব বিচরতি সর্ব্বম্।
[অথর্বশির উপনিষদ- ৫]
✅ অর্থ — সেই অদ্বিতীয় সচ্চিদানন্দস্বরূপ পরমব্রহ্ম শিবই প্রতিযোনিতে অধিষ্ঠান করিয়া এই অখণ্ড ব্রহ্মাণ্ডে বিচরণ করিতেছেন। এই সচরাচর জগৎ তাঁহারই প্রতিবিম্ব মাত্র, তিনিই অনন্তজীবরূপে ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া রহিয়াছেন।।৫
👉এর থেকেই তো প্রমাণিত হয়, সকলের মধ্যে অবস্থিত আত্মাটা মূলত পরমেশ্বর শিব ।
শাস্ত্রে বলা হয়েছে, জগৎ সৃসিক্ষার জন্য পরশিব এক থেকে বহু হন। পরশিব নিজেকে মায়ারষট্কঞ্চুক দ্বারা আবৃত করে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, ইন্দ্রাদি দেবতা ইত্যাদি তত্ত্বে নিজেকে সংকুচিত করে, নিজ বিমর্শ হৃদয়ে অনুভব করেন কিন্তু, পরশিব অবিকৃতই থাকে—
এক এব হি ভূতাত্মা ভূতে ভূতে ব্যবস্থিতঃ।
একধা বহুধা চৈব দৃশ্যতে জলচন্দ্রবত।।১২
[অমৃতবিন্দু উপনিষদ- ১২]
✅ অর্থ — এক আত্মাই সর্বভূতে বিরাজ করে। চন্দ্রের প্রতিবিম্ব যেমন বহু জলাশয়ে দেখা যায় কিন্তু চন্দ্র একটাই হয় তেমন এক অখণ্ড আত্মাই বহুরূপে দর্শিত হয়।। ১২
👉ব্রহ্মসূত্রে ১।৪।২৬ নং সূত্রে বলা হয়েছে—
“আত্মকৃতেঃ” ।।১৷৷৪৷৷২৬৷৷
[পদচ্ছেদঃ-আত্মকৃতেঃ (আপনাকেই নানাকারে পরিণত করা)।]
[ সরলার্থঃ- "সোহ কাময়ত, বহু স্যাং প্রজায়েয়", "তৎ আত্মানং স্বয়মকুরুত”, ইতি সিসৃক্ষোঃ ব্রহ্মণ এব কৰ্ম্মত্বং কর্তৃত্বং চ অবগম্যতে; অতশ্চ তস্য নিমিত্তত্বমুপাদান ত্বম্-উভয়মপি সিধ্যতীতি ভাবঃ।
'তিনি কামনা করিলেন-আমি বহু হইব, জন্মিব', এখানে ব্রহ্ম নিজেই নিজেকে বিচিত্রা- কারে পরিণত করার কথা থাকায় বুঝা যাইতেছে যে, এক ব্রহ্মই নিমিত্তও বটে, উপাদানও বটে ॥ ১॥৪॥ ২৬॥]
👉এবার এখানে অনেক প্রশ্ন থাকতেই পারে যে, এখানে তো ব্রহ্ম এক থেকে বহু হচ্ছে তাহলে এখানে পরশিবের কথা কেন আসছে?
এক্ষেত্রে আমাদের শাস্ত্র কি বলছে তা জানতে হবে—
একধা চ দ্বিধা চৈব বহুধা চ স এব হি।
শতধা সহস্রধা চৈব তথা শতসহস্রধা ॥৪২॥
ঈদৃশঃ স মহাদেবো ভূযশ্চ ভগবানতঃ।
নহি শক্যা গুণা বক্তুমপি বর্ষশতৈবপি ॥৪৩৷৷
[মহাভারত- অনুশাসনপর্ব্ব- অধ্যায়-১৩৮—৪২/৪৩]
✅ অর্থ — মহাদেব একরূপ, দুইরূপ, বহুরূপ, শতরূপ, সহস্ররূপ ও লক্ষরূপ হইয়া থাকেন ॥৪২॥
সেই মহাদেব এইরূপ কিংবা ভগবান্ মহাদেব ইহা অপেক্ষাও বহু রূপ হইয়া থাকেন; সুতরাং বহু শত বৎসরেও তাঁহার সকল গুণ বলা যায় না' ॥ ৪৩ ॥
স ব্রহ্মা স শিবঃ সেন্দ্রঃ সোহক্ষরঃ পরমঃ স্বরাট্।
স এব বিষ্ণুঃ স প্রাণঃ স কালোহগ্নিঃ স চন্দ্রমাঃ ।।৮
[কৈবল্য উপনিষদ/প্রথম খণ্ড/৮ মন্ত্র]
✅ অর্থ — তিনি (সদাশিব) ব্রহ্মা, তিনি সেই শিব (পরমশিব), তিনি ইন্দ্র তিনি অক্ষর রূপে শাশ্বত ব্রহ্ম সনাতন, তিনি (সদাশিব) বিষ্ণু, তিনিই প্রাণ, কালাগ্নি ও চন্দ্রমার রুপও সেই প্রভুর(মহাদেব) ।।
যো দেবানাং প্রভবশ্চোদ্ভবশ্চ বিশ্বাধিপা রুদ্র মহর্ষিঃ।
হিরণ্যগর্ভং পশ্যত জায়মানং পূর্ব্বং স নো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনক্তু ।।১২
[শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ- অধ্যায়- ৪]
✅ অর্থ — যাহা হইতে সমস্ত দেবতার উৎপত্তি,যিনি ঐ সকল দেবতাতে যে সকল শক্তি আছে তাহার ও হেতু,যিনি সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মার ও জনয়িতা, পরমেশ্বর সর্ব্বজ্ঞ রুদ্র, যিনি রুদ্র রূপে সংহার করেন,সেই পরমেশ্বর শিব তাদের শুভ বুদ্ধি প্রদান করুক ।।১২
🔥 সোম রূপী পরমেশ্বর শিব থেকেই দেবতাদের উৎপত্তি —
সোমঃ পবতে জনিতা মতীনাং জনিতা দিবো জনিতা পৃথিব্যাঃ।
জনিতাগ্নের্জনিতা সূর্যস্য জনিতেন্দ্রস্য জনিতোত বিষ্ণোঃ ॥ ৫॥
[ঋগ্বেদ- নবম মণ্ডল- সুক্ত নং- ৯৬ মন্ত্র নং- ৫]
✅ অর্থ — সোম ক্ষরিত হচ্ছেন। এই হতেই স্তুতিবাক্য সমূহের উৎপত্তি, এই হতেই দ্যুলোক, ভূলোক, অগ্নি, সূর্য, ইন্দ্র ও বিষ্ণুর উৎপত্তি ॥৫
যঃ শুক্র ইব সূর্যো হিরণ্যমিব রোচতে।
শ্রেষ্ঠো দেবানাং বসুঃ ॥ ৫ ॥
[ঋগবেদ- ১ম মণ্ডল- ৪৩নং সুক্ত]
✅ অর্থ — প্রভু রুদ্র সূর্যসম দীপ্তিমান এবং স্বর্ণসম উজ্জ্বল প্রভাযুক্ত, তিনি সকল দেবতার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রভু, তিনিই সকলের একমাত্র মাত্র আশ্রয়, তাই তার মধ্যে সকলে নিবাস করেন ॥৫॥
এবং "অথর্বশির উপনিষদ-২ অধ্যায়" অনুযায়ী ত্রিদেব, দেবতা তথা ব্রহ্মাণ্ড ও সমস্ত কিছুর রূপ পরমেশ্বর শিবই ধারণ করেন।
স্থিরেভিরঙ্গৈঃ পুরুরূপ উগ্রো বজ্রঃ শুক্রভিঃ পিপিশে হিরণ্যৈঃ।
ঈশানাদস্য ভুবনস্য ভুরে র্ন বা উ যোষদ্রুদ্রাদসূর্যম্ ।। ৯॥
অৰ্হন্ বিভর্ষি সায়কানি ধন্বার্হয়িস্কং যজতং বিশ্বরূপম্।
অহর্ন্নিদং দয়সে বিশ্বমভুং ন বা ওজীয়ো রুদ্রত্বদস্তি। ১০॥
[ঋগবেদ ২য় মণ্ডল— ৩৩ নং সুক্ত]
✅ অর্থ — দৃঢ়্যঙ্গ, বহুরূপ, উগ্র ও বভ্রবর্ণ রুদ্র দীপ্ত হিরণ্ময়ের অলঙ্কারে শোভিত হচ্ছেন। পরমেশ্বর রুদ্র সমস্ত ভুবনের অধিপতি এবং ভর্তা; তাঁর বল পৃথকৃত হয় না ॥৯।। হে অর্চনাই। আপনি ধনুর্বাণধারী; হে অর্চনার্হ ! আপনি নানা রূপবিশিষ্ট ও পূজনীয় নিদ্ধ (অর্থং বক্ষ-ভূষণ) ধারণ করেছেন; হে অর্চনাই। আপনি সমস্ত বিস্তীর্ণ জগৎকে রক্ষা করছেন; আপনার অপেক্ষা অধিক বলবান্ আর কেউ নেই ॥ ১০৷।
👉অর্থাৎ শাস্ত্র থেকে পরিস্কারভাবে জানা গেলো পরমেশ্বর শিব এক থেকে বহু হন।
এখানে ব্রহ্ম বলতে পরমেশ্বর শিবকেই বোঝানো হয়েছে কারণ —
“এক হি রুদ্র ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য” “ শিবই অদ্বিতীয় পরমেশ্বর দ্বিতীয় কোনো সত্ত্বা নেই”(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ- ৩/২),
"বিশ্বাধিপা রুদ্র মহর্ষিঃ" (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ-৪/১২)
“শান্তং শিবম অদ্বৈতং চতুর্থং মন্যন্তে স আত্মা স বিজ্ঞেয়ঃ” “অদ্বৈত পরমেশ্বর শিবকে জ্ঞানিগণ চতুর্থ অবস্থা (অর্থাৎ তুরীয় অবস্থা) বলিয়া জানেন। তিনি আত্মা তিনি বিশেষরূপে জ্ঞাতব্য”(মাণ্ডুক্যোপনিষৎ /৭),
“যদাত মস্তন্ন দিবা ন রাত্রি ন সৎ ন চ অসৎ শিব এব কেবলঃ” “যখন না দিন ছিলো, না রাত ছিলো, না আলো ছিলো, না অন্ধকার ছিলো, না সৎ ছিলো, না অসৎ ছিলো, শুধুমাত্র পরমেশ্বর শিব ছিলো”(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ-৪/১৮),
“অজাত ইত্যেবং” “শিব জন্মাদি রহিত” (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ-৪/২১),
“সর্বো বৈ রুদ্রস্তস্মৈ রুদ্রায় নমো অস্তু পুরুষো বৈ রুদ্রঃ সন্মহো নমো নমঃ,(কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/ তৈত্তিরীয় আরণ্যক/ ১০ ম প্রপাঠক- পরিশিষ্ট/২৪ নং অনুবাক),
“ঋতং সত্যং পরং ব্রহ্ম পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলম্ ।
ঊর্ব্বরেতং বিরূপাক্ষ বিশ্বরূপায় বৈ নমঃ "(কৃষ্ণ যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরণ্যক / দশম প্রপাঠক/২৩ নং অনুবাক),
"ঈশানঃ সর্ববিদ্যানাং ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং" (কৃষ্ণযজুর্বেদ/ তৈত্তিরীয় আরণ্যক/দশমপ্রপাঠক/২১ নং অনুবাক) "একো রুদ্রো ন দ্বিতীয়ায় তস্মৈ য ইমাল্লোকানীশত ঈশানীভিঃ" (অথর্বশির উপনিষদ- ৫) ইত্যাদি শ্রুতি বাক্য দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় শিবই একমাত্র পরমেশ্বর।
তাছাড়া “শুক্ল যজুর্বেদ- অধ্যায়- ৩, মন্ত্র নং- ৩২” অনুযায়ী পরমেশ্বরের মুখ্য নাম হলো শিব। তাই সব দিক থেকেই প্রমাণিত হয় - শিবই অদ্বিতীয় পরমেশ্বর।
👉অনেকের মনে হয়তো এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে যে, এক এক শাস্ত্রে তো এক এক দেবতাকে ব্রহ্ম বলা হয়েছে। তাহলে এখানে কীভাবে বলা হচ্ছে যে শুধু মাত্র শিবই ব্রহ্ম ?
তাহলে বলে রাখি, শিব কেন অদ্বিতীয় ব্রহ্ম তা উপরে আমি বিশ্লেষণ করেই দিয়েছি। তারপরেও শাস্ত্রে যে আলাদা আলাদা দেবতাকে ব্রহ্ম বলে তার কারণ হলো, সবার মধ্যে এক শিবই আত্মা রূপে বিরাজিত। তাই দেবতাদের আত্মরূপে অবস্থিত শিবকেই ব্রহ্ম বলা হয়।
👉শাস্ত্রের মধ্যে ভিন্নতা থাকলেও জ্ঞান কিন্তু একই থাকে —
গবামনেকবর্ণানাং ক্ষীরস্যাপ্যেকবর্ণতা।
ক্ষীরবতপশ্যতে জ্ঞানং লিঙ্গিনস্তু গবাং যথা।।৷ ১৯
[অমৃতবিন্দু উপনিষদ- ১৯]
✅ অর্থ — যেমন ভিন্ন ভিন্ন গাভী ভিন্ন ভিন্ন রঙ্গের হলেও তার দুধ এর রঙ একই থাকে। তেমনি বিভিন্ন শাস্ত্র সমূহ হলো ভিন্ন ভিন্ন গাভীর ন্যায় আর জ্ঞান হলো তার দুধ ।।১৯
👉অর্থাৎ বিভিন্ন শাস্ত্রে বিভিন্ন দেবতাকে ব্রহ্ম বলা হলেও তারা ব্রহ্ম নন। কেননা ব্রহ্ম হলো শুধু মাত্র পরমেশ্বর শিব।
🌸 আমাদের পুরাণ শাস্ত্রেই এর সুন্দর মীমাংসা দেওয়া আছে —
এনমেকে বদন্ত্যগ্নিং নারায়ণপথাপরে।
ইন্দ্রমেকে পরে প্রাণং ব্রহ্মানমপরে জগুঃ।।
ব্রহ্মবিষ্ণুগ্নিবরুণাঃ সর্ব্বে দেবান্তথর্যয়ঃ।
একস্যেবাথ রুদ্রস্য ভেদান্তে পরিকীর্ত্তিতাঃ।।
যং যং ভেদং সমাশ্রিত্য যজন্তি পরমেশ্বরম্।
তত্ত্বদ্রুপং সমাস্থায় প্রদদাতি ফলং শিবঃ।।
[কূর্ম পুরাণ- উপরিভাগ- অধ্যায়- ৪৪/ শ্লোক ৩৬-৩৮]
✅ অর্থ — কেহ কেহ অগ্নিকে পরমাত্মা বলিয়া থাকেন, কেহ নারায়ণকে, কেহ ইন্দ্রকে, কেহ প্রাণকে, কেহ বা ব্রহ্মাকে পরমাত্মা বলিয়া থাকেন। কিন্তু ব্রহ্মা, বিষ্ণু, অগ্নি, বরুণ প্রভৃতি সর্বদেবতা এবং সমস্ত ঋষিগণ এক রুদ্রেরই ভেদমাত্র বলিয়া পরিকীর্ত্তিত। সাধক যে যে ভেদ আশ্রয় করিয়া পরমেশ্বরের পূজা করেন, পরমেশ্বর শিব সেই দেবতার রূপ আশ্রয় করিয়া ফল প্রদান করিয়া থাকেন।।
আরো দেখুন 👇
পরতত্ত্বৈকতাবুদ্ধ্যা ব্রহ্মাণং বিষ্ণুমীশ্বরম্ ।
পরতত্ত্বতয়া বেদা বদন্তি স্মৃতয়োঽপি চ ॥ ২০
[স্কন্দমহাপুরাণ/সূতসংহিতা যজ্ঞবৈভবখণ্ড/উপরিভাগ/সূতগীতা/অধ্যায় ২/ শ্লোক ২০]
✅ অর্থ — বেদ তথা শাস্ত্রের কোথাও কোথাও ব্রহ্মা বা বিষ্ণু কে পরমেশ্বর বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু তা ঔপাধিক রূপের দৃষ্টিকোণে নয় বরং তাদের অন্তরস্থ পরমতত্ত্ব শিব রূপেই বস্তুতঃ - এই দৃষ্টিতে বলা হয়েছে ।
👉বিভিন্ন শাস্ত্রে অন্যান্য দেবতাদের ব্রহ্ম বললেও মূলত তাদের অন্তরস্থ ব্রহ্ম হলেন একমাত্র — পরমেশ্বর শিব।
👉এখানে বলে রাখি ত্রিদেব ও অন্যান্য দেবতাদের ও জন্মমৃত্যু আছে, সময়ের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। একথা শাস্ত্রে রয়েছে —
ব্রহ্মবিষ্ণুমহেশাদিদেবতা ভূতজাতয়ঃ।
নাশমেবানুধাবত্তি তস্মাচ্ছেয়ঃ সমাচরেৎ ॥ ৪৬ ॥
[কূলার্ণবতন্ত্র- ১ম উল্লাস- ৪৬]
✅ অর্থ — ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশাদি দেবতা, প্রাণীসমূহ সবাই বিনাশপ্রাপ্ত হয়। অতএব, শ্রেয়ের আচরণ করবে।।৪৬
মমৈব নিমিষার্দ্ধেন সহস্রাণি চতুর্দ্দশ।
বিনশ্যন্তি ততো বিষ্ণোরসংখ্যাতাঃ পিতামহাঃ।।১৬
[স্কন্দপুরাণ- প্রভাসখণ্ড- অধ্যায়- ১৬]
✅ অর্থ — মদীয় (সদাশিব কত্তৃক) নিমিষার্দ্ধ কালে উক্ত চতুর্দ্দশ সহস্রযুগ অতীত হয়। এই সময় মধ্যে ব্রহ্মা ও বিষ্ণু বিনষ্ট হইয়া থাকে।। ১৬।।
কোটিকোট্যযুতান্যত্র ব্রহ্মণ্ডানি মম প্রিয়ে।
জলবুদ্বুদবদ্দেবি সঞ্জাতানি তু লীলয়া।।৪৫
তত্রতত্র চতুর্ব্বক্ত্রা ব্রহ্মাণো হরয়ো ভবাঃ।
সৃষ্টাঃ প্রধানেন তদা লব্ধা শম্ভোন্তঃ সন্নিধিঃ।।৪৬
লয়ং চৈব তথান্যোন্যমাদ্যস্তং প্রকোরতি চ।
সর্গসংহার-সংস্থানাং কর্ত্তা দেবো মহেশ্বরঃ।।৪৭
সর্গে চ রজসো পৃক্তঃ সত্ত্বস্থঃ পরিপালনে।
প্রতিসর্গে তমোযুক্তোঃ সোহহং দেবি ত্রিধা স্থিতঃ।।৪৮
[স্কন্দপুরাণ- প্রভাসখন্ড- অধ্যায়- ১৯]
✅ অর্থ — প্রিয়ে! মদীয় (সদাশিব কত্তৃক) লীলাক্রমে প্রকৃতি হইতে বারিবুদবুদবৎ কোটি কোটি অযুত অযুত ব্রহ্মাণ্ড জন্মিয়াছে; সেই সকল ব্রহ্মাণ্ডে চতুরানন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্র সৃষ্ট হইয়াছেন।
ইঁহারা পরস্পর আদ্যন্তক্রমে লয় প্রাপ্ত হইয়া শম্ভু সান্নিধ্য লাভ করেন। মহেশ্বরই সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের কর্ত্তা।
হে দেবি! আমিই সেই মহেশ্বর আমি সৃষ্টি কাজে রজগুণযুক্ত, পালণ কার্য্যে সত্ত্বগুণযুক্ত ও সংহার কার্য্যে তমোগুণযুক্ত — এই ত্রিবিধ মূর্তি পরিগ্রহণ করিয়া বিরাজ করি।।
শম্ভুরুবাচ্ -
"ব্রহ্মাধিকবলোবিষ্ণুরায়ুষি ব্রহ্মণোহধিক।।৬৯।।ব্রহ্মাংডমালাভরণে মহেশস্যমমৈবতু।
চতুর্নিঃশ্বাসমাত্রেন বিষ্ণোরায়ুরুদাহৃতম্।।"
[তথ্যসূত্র - পদ্মপুরাণ/ পাতাল খণ্ড/ ১০৮ নং অধ্যায়]
✅ অর্থ — ব্রহ্মার চেয়ে বিষ্ণুদেবের আয়ু ও ক্ষমতা উভয়ই বেশি। তবে মহেশ্বরের এবং আমার (শম্ভু) চারটি নিঃশ্বাসের সমান বিষ্ণুদেবের পুরো আয়ুষ্কাল।।
👉মহেশ্বর, রুদ্র, শম্ভু, শ্রী বিষ্ণু ও ব্রহ্মা সকল সাকার দেবগণই কালের অধীনে আবদ্ধ। প্রত্যেকেরই একটি নির্দিষ্ট আয়ু আছে। কিন্তু সদাশিব কালাতীত। তাঁর কোনো সময়ের মাপকাঠি নেই। জগৎ চরাচরের সকল কিছুই তাঁর মধ্যে বিলীন হয়। তিনি কোথাও বিলীন হন না।
এর জন্য শাস্ত্র বলেছে—
অসঙখ্যাতাশ্চ কল্পাখ্যা অসঙখ্যাতাঃ পিতামহাঃ।
হরয়শ্চাপ্যসঙখ্যাতা এক এব মহেশ্বরঃ।। ৪৪।।
[স্কন্দপুরাণ- প্রভাসখণ্ড- অধ্যায়- ১৯]
✅ অর্থ — কল্পও অসংখ্য, ব্রহ্মা ও অসংখ্য এবং হরিও অসংখ্য ; কিন্তু মহেশ্বরই একমাত্র অদ্বিতীয়।।৪৪।।
এক এব শিবো নিত্যস্ততোহন্যৎসকলং মৃষা।
তস্মাৎসর্বাপরিত্যজ্য ধ্যেযান্বিষ্ণবাদিকান্সুরান্॥ ৩০
[তথ্যসূত্র - শ্রুতিশাস্ত্র (বেদ)/শরভ উপনিষদ]
✅ অর্থ — শিবই একমাত্র নিত্য, অন্য সকল কিছুই মিথ্যা। এই কারণে বিষ্ণু আদি সকল দেবতাকে পরিত্যাগ করে শিবকেই ধ্যেয় বলে জানা উচিত ॥৩০
[বরাহ উপনিষদ- তৃতীয় অধ্যায়]
✅ অর্থ — শিব গুরু, শিব বেদ, শিব দেব, শিব প্রভু, আমি (নারায়ণ নিজেও) শিবস্বরূপ, সমস্তই শিবস্বরূপ, শিব ব্যতীত আর কোথাও অন্য কিছুই নেই।।৩২।।
👉যিনি গুরু রূপে সকলের অজ্ঞানতা নাশ করছেন তিনিই শিব, যিনি বেদ স্বরূপ ও বেদের সার তিনিই শিব, শিবই সকল দেবতা রূপে নিজেকে প্রকাশ করছেন, শিবই সকলের স্বামী, নারায়ণের মধ্যে অবস্থিত আত্মা শিব, তাই নারায়ণ শিব স্বরূপ, যা কিছু দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সকল কিছুই শিব, এই অখিল সম্পূর্ণ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড শিবময় তাই নারায়ণ বলছে শিব ব্যতীত আর কিছুই নেই, একমাত্র শিবই সত্য, বাকী সব মিথ্যা।
শ্রীব্রহ্মা উবাচ
"সোহধ্বনঃ পারমাপ্নোতি তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম্।।২২
পদং যৎপরমং বিষ্ণোস্তদেবাখিলদেহিনাম্।
পদং পরমমদ্বৈতং স শিবঃ সাম্ববিগ্রহঃ।।২৩
রুদ্রবিষ্ণুপ্রজেশানামন্যেষামপি দেহিনাম্।
ঋতে সাম্বং মহাদেবং কিং ভবেৎপরমং পদম্।।২৪
[স্কন্দপুরাণ/সূতসংহিতা/ যজ্ঞবৈভবখণ্ড/ উত্তরভাগ/ব্রহ্মগীতা/ অধ্যায় নং ১১]
✅ অর্থ — সবকিছুর ঊর্ধ্বে সেই বিষ্ণু অর্থাৎ ব্যাপক ব্রহ্মই পরম প্রকৃষ্ট পদ। সেই পরম অদ্বৈত পদই সাক্ষাৎ শিব, তিনিই সাম্ববিগ্রহ (অম্বিকা সহিত শিবলোকবাসী পরমেশ্বর সদাশিব)। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্র প্রমুখ দেহধারীদের জন্যও সেই অম্বিকাপতি মহাদেবের(সদাশিবের) পদই পরম পদ।
[আকাট বোধহীন বৈষ্ণবেরা একটু চোখ খুলে দেখুন, এখানে ত্রিদেবের মধ্যে থাকা রুদ্রদেব,বিষ্ণু ও ব্রহ্মাকে সদাশিবের থেকে গুণভেদে পার্থক্য দেখানো হয়েছে। তাই কালরুদ্রের কর্মকে দেখিয়ে সদাশিবের তত্ত্বকে খণ্ডানোর যে অপপ্রয়াস বৈষ্ণবেরা করে থাকে তা সর্বদাই বৃথা]
সেই 'ঋতং সত্যং পরমব্রহ্ম পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলং' অর্ধনারীশ্বর রূপী মহাদেব ছাড়া পরমপদ আর কেইই বা হতে পারে?
শ্রীমৎমাধবাচার্যের ভাষ্য-- তাৎপর্যদীপিকা---
"এতদেব সচ্চিদানন্দৈকরসং পরশিবস্বরূপং রুদ্রবিষ্ণবাদীনাং গুণমূর্তিনামন্যেষামিন্দ্র- দীনাং চ পরমং পদং ভবতীত্যর্থঃ ॥ "
সেই একরস সচ্চিদানন্দস্বরূপ পরমশিব যিনি রুদ্র, বিষ্ণু, ব্রহ্মা, ইন্দ্র আদি গুণমূর্তি ধারণ করেন, তিনিই পরমপদ।
এই একই কথা সাক্ষাৎ বেদ শাস্ত্র নিজে স্বীকার করেছেন, দেখুন 👇
যত্র ন সূর্যস্তপতি যত্র ন বায়ুর্বাতি যত্র ন চন্দ্রমা ভাতি যত্র ন নক্ষত্রাণি ভান্তি যত্র নাগ্নির্দহতি যত্র ত মৃত্যুঃ প্রবিশতি যত্র ন দুঃখানি প্রবিশ্যন্তি সদানন্দং পরমানন্দং শান্তং শাশ্বতং সদাশিবং ব্রহ্মাদিবন্দিতং যোগিধ্যেয়ং পরং পদং যত্র গত্বা ন নিবর্তন্তে যোগিনস্তদেতদৃচাত্যুক্তম্।
তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ দিবীব চক্ষুরাততম্ ॥ ৬
[বেদ/বৃহজ্জাবাল উপনিষদ(শৈবউপনিষদ)/ অষ্টম ব্রাহ্মণ/৬ মন্ত্র]
✅ অর্থ — যেখানে সূর্য তাপ দেয় না, যেখানে বায়ু বয়না, যে স্থানে চন্দ্রও আলোক প্রদান করে না, যেখানে নক্ষত্রদেরও উপস্থিতি থাকে না, যে স্থানে অগ্নি দ্বারা কোনো কিছুরই দহন সম্ভবপর হয়না, যেখানে মৃত্যু নেই, দুঃখ নেই সেই সদানন্দময়,পরমানন্দময় পরম ধামই হল সাক্ষাৎ শান্ত, শাশ্বত, চিরন্তন, সচ্চিদানন্দ সদাশিব পদ, যে পদ ব্রহ্মাদি দেবগণ (অর্থাৎ ব্ৰহ্মা,
বিষ্ণু, রুদ্র) দ্বারা বন্দিত। সেই পদই সমস্ত যোগীগণের দ্বারা ধেয় (অর্থাৎ সহস্রার চক্রের স্থান)। পরমেশ্বর সদাশিবের সেই পরমপদে পৌছানোর পর যোগীগণকে আর ইহলোকে ফিরে আসতে হয় না। হে সৰ্বব্যাপী পরমেশ্বর ! আমাকে এমন দিব্য জ্ঞানচক্ষু প্রদান করুন যাতে আমি আপনার সেই পরম ধাম, পরম পদকে সর্বদা নিজের আত্মস্বরূপের মধ্যেই প্ৰত্যক্ষ করতে পারি। (অর্থাৎ পশুপাশ বিমোক্ষণ করার কথা বলা হয়েছে।
আশা করি, তদ্ বিষ্ণু পরমং পদং - মন্ত্রের সম্পূর্ণ বেদপুরাণ ভিত্তিক অর্থ আপনাদের বোধগম্য হয়েছে।
👉এক শিবই সত্য, যিনি একাধারে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডকে সৃষ্টি করছেন, আবার নিজেরই ইচ্ছা গুণের দ্বারা আবদ্ধ হয়ে লয় ও করছেন। মূলত শিবই শাশ্বত সনাতন, শিবই সৎ-চিৎ-আনন্দ স্বরূপ।
এক শিবই এই বিশ্ব নাট্যমঞ্চে নাট্য করছেন, তাই তিনি নটরাজ। এক শিবই নিজেকে পাশ দ্বারা আবদ্ধ করে জীব রূপে অনুভব করছেন। শিবই নিজেকে অনুগ্রহ করছেন।
পরমেশ্বর শিব গুণ দ্বারা আবদ্ধ হয়ে জাগতিক লীলা করছে, কালের অধীন হচ্ছে, দোষগুণ যুক্ত হচ্ছে।
কিন্তু গুণ দ্বারা আবদ্ধ হলেও পরমেশ্বর শিব নির্গুণ, কালের অধীনে থাকলেও পরমেশ্বর শিব কালাতীত। জগৎ পরিচালনা করতে মায়া দ্বারা আবদ্ধ হচ্ছে কিন্তু, পরমেশ্বর শিব মায়াতীত। পরমেশ্বর শিব সুখ-দূঃখ, আনন্দ-বেদনা, দোষ-গুণ, বিকার, শোক, সময় সবকিছুর ঊর্ধ্বে। শিবই অলখ-নিরঞ্জন, শিবই সৎ-চিৎ-আনন্দ।
ঈশানস্য জগতঃ স্বদর্শমীশানমিন্দ্রতস্থুর্য ইতি তস্মাদুচ্যতে ঈশানঃ।
[অথর্বশির উপনিষদ- ৪]
✅ অর্থ — স্থাবর জঙ্গমাত্মক জগতের অদ্বিতীয় অধীশ্বর রুদ্ররূপী ভগবান'ই সাক্ষাৎ ঈশান।।
অহমস্মি পরশ্চাস্মি ব্রহ্মাস্মি প্রভবোহম্ম্যহম্। সর্বলোকগুরুশ্চাস্মি সর্বলোকেহস্মি সোহম্ম্যহম্।।১
[মৈত্রেয়ী উপনিষদ- অধ্যায়- ৩]
✅ অর্থ — অন্তঃস্থিত ব্রহ্ম আমি এবং বাহ্যিক ব্রহ্মও আমি। আমিই পরব্রহ্ম। আমিই ব্রহ্ম, আমিই উৎপত্তি, সমস্ত লোকের গুরু এবং সমস্ত লোকে যা কিছু আছে সমস্তই আমি।।১
অহমেবাস্মি সিদ্ধোহস্মি শুদ্ধোহস্মি পরমোহস্ম্যহম্। অহমস্মি সদাসোহস্মি নিত্যোহস্মি বিমলোহ স্ম্যহম্।।২
[মৈত্রেয়ী উপনিষদ- অধ্যায়- ৩]
✅ অর্থ — আমিই সিদ্ধ, আমিই শুদ্ধ তথা পরম তত্ত্ব আমিই। আমি সর্বদা বিদ্যমান থাকি, আমি নিত্য এবং মলরহিতও আমিই।।২
বিজ্ঞানোহস্মি বিশেষোহস্মি সোমোহস্মি সকলোহম্ম্যহম্। শুভোহস্মি শোকহীনোহস্মি চৈতন্যোহস্মি সমোহস্ম্যহম্।।৩
[মৈত্রেয়ী উপনিষদ- অধ্যায়- ৩]
✅ অর্থ — আমি বিশিষ্ট জ্ঞান সম্পন্ন, আমি বিশেষ, আমি সোম, সমস্ত কিছুই আমি। আমি শুভ, আমি শোকরহিত, সমতাও আমি তথা চৈতন্যও আমিই।।৩
মানাবমানহীনোহস্মি নির্গুণোহস্মি শিবোহ স্ম্যহম্। দ্বৈতাদ্বৈতবিহীনোহস্মি দ্বন্দ্বহীনোহস্মি সোহম্ম্যহম্।।৪
[মৈত্রেয়ী উপনিষদ- অধ্যায়- ৩]
✅ অর্থ — আমি মান অপমান রহিত, আমি নির্গুণ (গুণরহিত), আমিই শিব, আমি দ্বৈত ও অদ্বৈত ভাবনারহিত, সুখ তথা দূঃখাদি দ্বন্দ থেকে মুক্ত তথা সেই ব্রহ্ম আমিই।।৪
ভাবাভাববিহীনোহস্মি ভাসাহীনোহস্মি ভাস্ম্যহম্। শূণ্যাশূণ্যপ্রভাবোহস্মি শোভনাশোভনোহ স্ম্যহম্।।৫
[মৈত্রেয়ী উপনিষদ- অধ্যায়- ৩]
✅ অর্থ — ভাব-অভাব অর্থাৎ উৎপত্তি ও বিনাশ হতেও উর্ধ্বে আমি, ভাসা তথা প্রকাশ হতে ভিন্ন আমি কিন্তু প্রকাশও আমিই। আমি শূণ্য ও অশূণ্য রূপ তথা আমিই সুন্দর আবার অসুন্দরও আমি।।৫
তুল্যাতুল্যবিহীনোহস্মি নিত্যঃ শুদ্ধঃ সদাশিবঃ। সর্বাসর্ববিহীনোহস্মি সাত্ত্বিকোহস্মি সদাস্ম্যহম্।।৬
[মৈত্রেয়ী উপনিষদ- অধ্যায়- ৩]
✅ অর্থ — তুল্য-অতুল্য অর্থাৎ সমতা ও বিষমতা রহিত আমি, নিত্য, শুদ্ধ আমিই সদাশিব। আমি সর্ব-অসর্ব কল্পনা রহিত, সাত্ত্বিক আমি এবং আমি সর্বদাই বিদ্যমান থাকি।।৬
চিত্তাদিসর্বোহীনোহস্মি পরমোহস্মি পরাৎপরঃ।
সদা বিচাররূপোহস্মি নির্বিচারোহস্মি সোহম্ম্যহম্।।১০
[মৈত্রেয়ী উপনিষদ- অধ্যায়- ৩]
✅ অর্থ — আমি সমস্ত চিত্তাদি রহিত। আমি (শিব) পরাৎপর ব্রহ্ম। আমি সর্বদাই বিচার রূপ আবার বিচারের উর্ধ্বেও আমি।।১০
সর্বত্রপূর্ণরূপোহস্মি সচ্চিদানন্দলক্ষণঃ।
সর্বতীর্থস্বরূপোহস্মি পরমাত্মাস্ম্যহং শিবং।।১২
[মৈত্রেয়ী উপনিষদ, অধ্যায়-৩]
✅ অর্থ — আমি সর্বত্র পূর্ণরূপে বিরাজিত সচ্চিদানন্দ লক্ষণযুক্ত। তীর্থের স্বরূপও আমি এবং আমি পরমাত্মা স্বরূপ কল্যাণকারী শিব।।১২
👉পরমেশ্বর শিব কখনো সরাসরি এই জগৎ সংসারে প্রবেশ করেন না। পরমেশ্বর শিব জগৎ পরিচালনার যে পাঁচ টা কাজ রয়েছে, সেই পঞ্চকৃত্য প্রতিপাদন করার জন্য, নিজেরই পাঁচটা মুখের মধ্যে তিনটা মুখ থেকে “সৃষ্টিকর্তা- ব্রহ্মা, পালনকর্তা- বিষ্ণু, প্রলয়কর্তা- রুদ্র,” এই ত্রিদেব কে উৎপন্ন করে এবং জগৎ পরিচালনার মূল তিনটা কাজ বুঝিয়ে দেয়। বাকী দুটো কৃত্য তা পরমেশ্বর শিব নিজেই করেন “তিরোভাবকর্তা- মহেশ্বর ও অনুগ্রহকর্তা সদাশিব”।
পরমেশ্বর শিব মায়াতীত, গুণাতীত, কালাতীত তিনি কখনো এই মায়ার জগতে প্রবেশ করেন না। পরমেশ্বর শিব তার অংশভূত অন্যান্য সকল দেব/দেবীদের দ্বারা কার্য করান। এতে করে জগৎ ও পরিচালনা হয় এবং পরমেশ্বর শিব মূলত অবিকৃতই থাকে।
সবই শিব, সবকিছুই শিব, বিষ্ণুও শিব, কৃষ্ণও শিব। সবই পরমেশ্বর শিব থেকে জাত হয়। এক শিবই নিজেকে বিভিন্ন তত্ত্বে ভাসিত করছে।
👉 বেদ, পুরাণ, ইতিহাস, তন্ত্র, দর্শন, ন্যায় শাস্ত্র থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, শিবই একমাত্র পরমেশ্বর। পরমেশ্বর শিব থেকে ত্রিদেব তথা সমস্ত দেবতা, ব্রহ্মাণ্ড, চরাচর জগতের স্থাবর-জঙ্গম, সকল জীবের উৎপত্তি। পরমেশ্বর শিবই সর্বভূত ও সর্বজীবের আত্মা। একমাত্র পরমেশ্বর শিবই নিত্য, শাশ্বত অন্যান্য সব লয় প্রাপ্ত হয়। জগত পালনের জন্য পরমেশ্বর শিবই বিষ্ণুরূপ ধারণ করছেন। শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর শিবের সাথে যোগযুক্ত থেকে গীতার জ্ঞান দিয়েছেন।
👉সর্বশেষ একটা শাস্ত্র বাক্যের মীমাংসা দিয়ে এই পর্ব শেষ করছি—
স এস রুদ্রভক্তশ্চ কেশবো রুদ্রসম্ভবঃ।
সর্ব্বরূপং ভবং জ্ঞাতা লিঙ্গে যোঽর্চ্চয়ত প্রভুম্।।৬২
[মহাভারত/দ্রোণপর্ব্ব/অধ্যায়-১৬৯]
✅ অর্থ — যিনি জগদীশ্বর শিবকে সর্বভূতে ব্যাপ্ত জেনে তার লিঙ্গ স্বরূপে তার পুজা করতেন সেই নারায়ণ এই কৃষ্ণ,তিনি শিবাংশজাত ও শিবভক্ত।।৬২
হর হর মহাদেব ✊🚩
ॐ নমঃ শিবায় 🙏🚩
ॐ সাম্বসদাশিবায় নমঃ 🚩🙏
ॐ দক্ষিণামূর্তয়ে নমঃ 🙏🚩
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে ✊🚩
✍️লেখানীতে — অন্তিক ভট্টাচার্য্য (শম্বরনাথ শৈব)
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ— আমার গুরু শ্রী নন্দীনাথ শৈবাচার্য জী ও শ্রী রোহিত কুমার চৌধুরী শৈবজীকে 🙏
কপিরাইট ও প্রচারেঃ— International Shiva Shakti Gyan Tirtha (আন্তর্জাতিক শিব শক্তি জ্ঞান তীর্থ)
বিঃ দ্রঃ— লেখাটি কপি করলে সম্পূর্ণ কপি করবেন, কোনো রকম কাটাছেঁড়া করা যাবে না।
অসাধারণ লিখেছো। এই ভাবেই এগিয়ে চলো।
উত্তরমুছুন