পরমেশ্বর শিব যে রামের উপাসনার কথা বলেছেন সেই “ রাম ” আসলে কে ?



পরমেশ্বর শিব যে রামের উপাসনার কথা বলেছেন সেই " রাম " আসলে কে ?

॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥

ভূমিকা :

বর্তমান কালে বৈষ্ণব দের মুখে প্রচলিত একটি জনপ্রিয় বচন শোনা যায়, তারা বলেন -

"পঞ্চমুখে রাম নাম গায়েন ত্রিপুরারী" - শিব তো নিজের পাঁচ মুখে সর্বদা রাম নাম জপ করতে থাকেন।

শিব সর্বদা রামের ধ্যান করেন, শিব হল রামের ভক্ত।


বর্তমান কালে বৈষ্ণবেরা এই ধরনের কথা বার্তা সবার কাছে বলে বেড়ায়, যাতে সবার কাছে পরোক্ষভাবে হরি/ কৃষ্ণ/রাম একমাত্র পরমেশ্বর বলে বিশ্বাস জন্মে যায়। আর শিব কে যেন সবাই রামভক্ত/বিষ্ণুভক্ত/কৃষ্ণভক্ত ভাবতে শুরু করে। এর ফলে শিবভক্তরাও শিব ভক্তির পথ ছেড়ে ভগবান বিষ্ণুকেই একমাত্র পরমেশ্বর মানতে শুরু করবে, এতে বৈষ্ণব দের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, তাহলেই বৈষ্ণব দের আরাধ্য ভগবান হরি সনাতন ধর্মের একমাত্র পরমেশ্বর বলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, তখন সর্ব‌ত্র বৈষ্ণব দের শাসন চলবে । এই উদ্দেশেই  বৈষ্ণবেরা এই ধরনের কথা বার্তা বলে বেড়ায় ।

কিন্তু সত্যিই কি প্রভু শিব রামের ধ্যান করেন ? সত্যিই কি প্রভু শিব সীতাপতি রামের ভক্ত ?

এই প্রশ্ন অনেক শিব ভক্তদের মনে উদয় হয়। এই প্রবন্ধে আমি সেই সংশয়ের অবসান ঘটাবো ।


--------------------------------------------------------------------------------------


মূল প্রসঙ্গ


 পরমেশ্বর শিবের মাহাত্ম্য সম্পর্কে আগ্রহ যাতে সনাতন ধর্মের মানুষের মধ্যে থেকে লুপ্ত হয়ে যায় তার জন্যে বৈষ্ণবেরা সর্বদা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে নানারকমের কুমন্তব্য করে সমাজের মানুষজন কে নকল কাহিনি শুনিয়ে পরমেশ্বর শিবের প্রতি কাল্পনিক ভাবনা করতে বাধ্য করে । যার ফলে আজকাল বৈষ্ণব দের কথায় সাধারন মানুষেরাও এই কাল্পনিক গল্প অন্যান্য মানুষ দের মধ্যে ছড়িয়ে বেড়ায়। এই ভাবে সনাতন সমাজ শাস্ত্রের বচন না মেনে কাল্পনিক গল্পের উপর বিশ্বাস করে ভাবছেন তারা ধার্মিক হয়ে গিয়েছেন । ঠিক এই ভাবেই প্রভু শিব নাকি অযোধ্যার সীতাপতি শ্রীরামচন্দ্রের ধ্যান করেন, প্রভু শিব নিজের পাঁচ মুখে নাকি অযোধ্যার সীতাপতি শ্রীরামচন্দ্রের রামনাম করেন, প্রভু শিব নাকি অযোধ্যার সীতাপতি শ্রীরামচন্দ্রের আরাধনা করেন।

 বৈষ্ণবেরা পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে প্রভু শিবের অবতার সংহারকর্তা রুদ্রদেব -এর মুখ থেকে বলা রামের প্রশংসা হতে দেখে বৈষ্ণবেরা ভেবে নিয়েছে যে, শিব সারাদিন রামনাম করে, রামের ধ্যান করে, শিব হল রামের ভক্ত ।

 এখন সংহারকর্তা রুদ্রদেব -এর মুখ থেকে বলা রামের প্রশংসা হতে দেখে বৈষ্ণবেরা যদি এটা ভাবে যে শিব রামের ভক্ত, তাহলে  বৈষ্ণব দের ভাবনা যে তাদের কল্পনা মাত্র, তা বৈষ্ণবদের মান্য পদ্মপুরাণ থেকেই প্রমাণ হয়ে যায়। 

বৈষ্ণবরা বলেন শিব সারাদিন রামনাম/হরিনাম করেন, চলুন এর সত্যতা আমরা বৈষ্ণবদের‌ প্রাণপ্রিয় সাত্ত্বিকপুরাণ পদ্মপুরাণ থেকেই উন্মোচন করা হল, দেখুন  —

(চৌখাম্বা প্রকাশনীর প্রকাশিত পদ্মপুরাণের পাতালখণ্ড)


শঙ্কর উবাচ্- 

 ধ্যায়েনকিঞ্চিৎ গোবিন্দননমস্যেহকিঞ্চন ॥২৪৮

নোপাস্যেকিঞ্চনহরেনজপিষ্যেহকিঞ্চন 

কিন্তু নাস্তিকজন্তুনাং প্ৰবৃত্ত্যৰ্থমিদংময়া ॥২৪৯

[(তথ্যসূত্র - চৌখাম্বা প্রকাশনীর প্রকাশিত - পদ্মপুরাণ/পাতাল খন্ড/ ১১৪ নং অধ্যায়)/(নবভারত প্রকাশনীর প্রকাশিত - পদ্মপুরাণ/পাতালখণ্ড/৬৯ অধ্যায়/২৯৮-৩১০ শ্লোক)]

✅ অর্থ : হে গোবিন্দ! বস্তুত আমি কারোর‌ই ধ্যান করিনা, কাউকে প্রণাম করিনা, কাউকে উপাসনা করিনা এবং কারও জপ করিনা। নাস্তিকদেরকে এবং জগৎবাসিকে শিক্ষা প্রদানের নিমিত্তে আমি নিজ ইচ্ছায় নিজ বিধি নিয়মে আবদ্ধ হই মাত্র। কেননা আমিই পরমেশ্বর।


বিশ্লেষণ  — পরমেশ্বর শিব শ্রীহরির প্রশ্নের উত্তরে বললেন যে, শিব কাউকে ধ্যান করে না বা প্রণাম করে না কারো উপাসনা করে না তিনি কারণ নাম জপ‌ও করে না শুধুমাত্র তিনি নাস্তিক ও অন্যান্য সমগ্র জগত বাসি কে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি নিজের ইচ্ছেমতো নিজের বিধিতে তিনি আবদ্ধ হন অর্থাৎ সকলকে তিনি শুধুমাত্র শিক্ষা দেবার কার্যটুকু করেন,যা শিবের‌ই লীলামাত্র। তাই পরমেশ্বর শিব কখনোই রাম নাম জপ ও করেন না তিনি রাম কে প্রণাম ও করেন না তিনি রামের ধ্যান করেন না তিনি রামকে পুজো করেন না, তিনি শুধুমাত্র লীলাবশত নিজের ভক্তের উচ্চ প্রশংসা করেন মাত্র। কারণ তিনি তাঁর ভক্তদের প্রতি স্নেহ করেন এবং ভালবাসেন তাই তিনি স্নেহবশত তো তার ভক্তদের স্মরণ করে থাকেন বা তাদের গুণগান গেয়ে থাকেন।

 এই একই কথা শিবমহাপুরাণে পরমেশ্বর শিব বলেছেন -

চলুন দেখে নেওয়া যাক -

সর্বে রুদ্রং ভজন্ত্যেব রুদ্রঃ কঞ্চিদ্ভজেন্ন হি ।

স্বাত্মনা ভক্তবাৎসল্যাদ্ভজত্যেব কদাচন ॥ ১৫

[তথ্যসূত্র – শিবমহাপুরাণ/কোটিরুদ্রসংহিতা/অধ্যায় ৪২]

☘️অর্থ – সবাই ভগবান রুদ্র তথা পরমেশ্বর শিবের ভজনা করেন, কিন্তু পরমেশ্বর শিব কারোর ভজন করেন না, কখনো কখনো ভক্তবৎসলবশত তিনি নিজেই নিজের ভক্তের প্রশংসা রূপে ভজনা করে থাকেন ॥ ১৫

অত‌এব, পরমেশ্বর শিব বা কৈলাসপতি রুদ্রদেব‌ও কখনোই বৈষ্ণব নন, শিব কখনোই পঞ্চমুখে রামনাম‌ও করেন না। তিনি রামের গুণগান করেন শুধুমাত্র রামের শিবভক্তির মহানতার কারণে। কিন্তু কলিরচর বৈষ্ণবেরা সেই পরমসত্যকে ধামাচাপা দিয়ে অসত্য কাল্পনিক গল্পের ভাণ্ডার খুলে পরমেশ্বর শিবকে বিষ্ণুদাস/কৃষ্ণদাস/রামদাস বানানোর অপপ্রচেষ্টা করে চলেছে।

_______________________________________________

এখন বৈষ্ণবেরা প্রশ্ন করবেন তাহলে কৈলাসে যে শিব বসে ধ্যান করেন, সেটি কিসের জন্য করেন  ? 

ভাগবতপুরাণেও বলা হয়েছে, পরমেশ্বর শিব জগতের হিতের জন্য জপ ধ্যান করবার লোকাচার পালন করেন মাত্র —

বিদ্যাতপোযোগপথমাস্থিতং তমধীশ্বরম্ ।

চরন্তং বিশ্বসুহৃদং বাৎসল্যাল্লোকমঙ্গলম্ ॥ ৩৫

(ভাগবত পুরাণ/৪র্থ স্কন্ধ/৬ অধ্যায়/৩৫ নং শ্লোক)

✅ অর্থ : ঈশ্বর মহাদেব হলেন সমগ্র বিশ্বসংসারের সুহৃদ, স্নেহবশত তিনি সবার কল্যাণকারী, তিনি একমাত্র লোকহিতের জন্যই বিদ্যার চর্চা, উপাসনা, চিত্রের একাগ্রতা আর ধ্যানযোগের দ্বারা সমাধি আদি তপ-সাধনার আচরণ করতে থাকেন ।


🟦 আরো দেখুন 👇 


ধ্যায়ে ন কিঞ্চিদ্গোবিন্দ নমস্যে হু ন কিঞ্চন ।

কিন্তু নাস্তিকজন্তুনাং প্ৰবৃত্ত্যৰ্থমিদং ময়া ॥২০০

দর্শনীয়ং হরে চৈতদন্যথা পাপকারিণঃ ।

তস্মাল্লোকোপকারার্থমিদং সর্বং কৃতং ময়া ॥২০১

ওমিত্যুৎক্ত্বা হরিরথ তং নত্বা সমতিষ্ঠত ।

অথ তে গৌতমগৃহং প্রাপ্তা দেবর্ষয়স্তদা ॥ ২০২

[বৃহন্নারদীয় পুরাণ/পূর্বার্ধ/৭৯ অধ্যায়/ ২০০-২০২ শ্লোক]

অর্থ — পরমেশ্বর শিব বললেন, হে গোবিন্দ ! না আমি কারোর ধ্যান করি, না আমি কাউকে নমস্কার করি‌ । তবুও শুধুমাত্র মনুষ্যগণ যাতে নাস্তিক প্রবৃত্তির শিকার না হয়ে যায় সেই কারণে আমি এই উপাসনা ইত্যাদি কার্য নিজে করে অন্যদের কাছে উদাহরণ উপস্থাপন করে থাকে ॥ ২০০

হে হরি ! এই প্রকারে স্বয়ং আমি এই কার্য করে অন্যদের জন্য কাছে এইভাবে উপাসনা করবার পথ দর্শন করিয়ে দিই, যদি আমি এভাবে পথ না দেখাই তবে সমস্ত লোক পাপকর্মে লিপ্ত হয়ে যেতে থাকবে । সমস্ত লোকের উপকারের উদ্দেশ্যেই আমি এই উপাসনার অভিনয় মাত্র করি । এ কথা শুনে শ্রী হরি ওম উচ্চারণ করতে করতে ‘আপনি উচিত বচন বলেছেন’ — এভাবে বলে শ্রী হরি মহেশ্বর কে নতমস্তকে প্রণাম করলেন। এরপর তখন সমস্ত দেবতা এবং ঋষিগণ গৌতমের আশ্রমে পৌঁছে গেলেন। 


♦️ আরো দেখুন 👇 

ব্রহ্মা বিষ্ণুশ্চ রুদ্রস্য স্বাসাধারণরূপতঃ ।

স্ববিভূত্যাত্মনা চাপি  কুর্বাতে এব সেবনম্ ॥ ৫৫

রুদ্রঃ স্বেনৈব রূপেণ বিষ্ণোশ্চ ব্রহ্মণস্তথা ।

সেবনং নৈব কুরুতে বিভূতের্বা দ্বয়োরপি ॥ ৫৬

কেবলং কৃপয়া রুদ্রো লোকানাং হিতকাম্যয়া ।

স্ববিভূত্যাত্মনা বিষ্ণোর্ব্রহ্মণশ্চাপরস্য চ ॥ ৫৭

করোতি সেবাং হে বিপ্রাঃ কদাচিৎসত্যমীরিতম্ ।

ন তথা ব্রহ্মণা বিষ্ণুর্ণ ব্রহ্মা ন পুরন্দরঃ ॥ ৫৮

[স্কন্দমহাপুরাণ/সূতসংহিতা/যজ্ঞবৈভবখণ্ড/উত্তরার্দ্ধ/ (সূতগীতা) অধ্যায় ২]

অর্থ — ব্রহ্মা তথা বিষ্ণু নিজের রূপ তথা অবতার নিয়ে সেই অবতার আদি বিভূতিরূপ ধরেও সর্বদা ভগবান রুদ্রের ভজনা করেন। রুদ্র কোনোভাবেও‌ এদের সেবা করেন না ।

কখনো কখনো শুধুমাত্র কৃপাবশত মানুষ কে হিত শেখাবার জন্য ব্রহ্মাদি কে পূজ্য বলেন বা নিজের অবতারাদি বিভূতিরূপ দ্বারা বিষ্ণু, ব্রহ্মাদির সেবা করে দেন মাত্র । 

কিন্তু বিষ্ণু-ব্রহ্মা কৃপাবশত শিবের পূজা করে দেন এমনটা নয় ॥ ৫৫-৫৮


সুতরাং, পরমেশ্বর শিব যে রামের ধ্যান করেন না তা প্রমাণিত হয়ে গেল । বরং জগতবাসী কে সাধন মার্গের দিকে আগ্রহ করবার জন্য ভগবান রুদ্রদেব ধ্যান করবার লোকাচার(অভিনয় কার্য‌) পালন করেন মাত্র।

_______________________________________________


এখন এসব শুনে বৈষ্ণবেরা প্রশ্ন করবেন যে, পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে শিব নিজে কেন বলেছেন তিনি রামের ভক্ত এবং তিনি রামের ধ্যান করেন ?

এই প্রশ্নেরও উত্তর আছে, 

প্রথমেই শাস্ত্র প্রমাণ সহ বলেছি, পরমেশ্বর শিব বা তার অবতার রুদ্রদেব কারোর ভজনা করেন না।  সুতরাং পরমেশ্বর শিব বা তার অবতার রুদ্রদেব যে কারোর ভক্ত নন তা আগে থেকেই প্রমাণিত। 

তাই এই বিষয়ে, কোনো সন্দেহর অবকাশ ।

কিন্তু যেহেতু কৈলাসপতি রুদ্রদেব পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বলেছেন যে, তিনি রাম ভক্ত  ও সেই রামের ধ্যান করেন তাই এই রাম বলতে আসলে কাকে বোঝানো হয়েছে তা বিশ্লেষণ করা হবে,

দেখুন, বেদে রাম বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে 👇


রামং ত্রিনেত্রং সোমার্ধধারিণং শূলিনং পরম্ ।

ভস্মোদ্ধূলিতসর্বাঙ্গং কপর্দিনমুপাস্মহে ।। ৩২

রামাভিরামাং সৌন্দর্যসীমাং সোমাবতংসিকাম্ ।

পাশাঙ্কুশধনুর্বাণধরাং ধ্যাযেৎ ত্রিলোচনাম্ ।। ৩৩

ধ্যাযন্নেবং বর্ণলক্ষং জপতর্পণত পরঃ ।

বিল্বপত্রৈঃ ফলৈঃ পুষ্পৈস্তিলাজ্যৈঃ পঙ্কজৈর্হুনেৎ ।। ৩৪

(অথর্ববেদ/রামরহস্য উপনিষদ/২য় অধ্যায়)

✅ অর্থ : আমি সেই রামের ধ্যান করি যিনি মস্তকে অর্ধচন্দ্র ধারণ করেন, যিনি ত্রিশূল ধারণ করেন, যিনি পরমতত্ত্ব বলে পরিচিত, যে প্রভুর দিব্য দেহের সর্বাঙ্গে ভস্ম লেগে রয়েছে, যিনি জটাজূট ধারণ করবার কারণে কপর্দিন নামে পরিচিত পরমেশ্বর শিব, আমি সেই প্রভুর উপাসনা করি ॥ ৩২

তার‌ই সাথে উপস্থিত যে ভগবতীর রমনীয় অভিরাম হল সৌন্দর্য শেষ সীমা, যিনি চন্দ্রধারিণী, পাশ-অঙ্কুশ-ধনুক-বাণ ধারিণী, সেই ত্রিনয়না দেবী শিবার ধ্যান করি ॥ ৩৩

এই প্রকারে ধ্যান করতে থেকে মন্ত্রের বর্গের সংখ্যার লক্ষগুণ জপ করে,(দশাংশ) তর্পণ করে, বেলপত্র, ফল, পদ্ম ইত্যাদি অনান্য পুষ্প, তিল, ঘী দ্বারা (সংখ্যানুসারে) হোম করা উচিত ॥ ৩৪

________________________________________________

💥রাম শব্দের অর্থ কি ? 

রামো রমন্তে যত্র যোগীনঃ ।। ৩

(অথর্ববেদ/রামরহস্য উপনিষদ/৫ম অধ্যায়)

✅ অর্থ : যোগীগণ নিজ হৃদয়ে যে পরমব্রহ্মে রমন(নিমগ্ন) করেন, তাকে রাম বলে ।


এখন দেখা যাক,

 যোগী ব্যক্তি নিজের হৃদয়ের মধ্যে কার ধ্যান করে থাকেন ?


হৃৎপুণ্ডরীকং বিরজং বিশুদ্ধং বিচিন্ত্য মধ্যে বিশদং বিশোকম্।

অচিন্ত্যমব্যক্তমনন্তরূপং শিবং প্রশান্তমমৃতং ব্রহ্মযোনিম্  ॥৬॥

তমাদিমধ্যান্তবিহীনমেকং বিভুং চিদানন্দমরূপমদভুতম্।

তথাদিউমাসহাযং পরমেশ্বরং প্রভুং ত্রিলোচনং নীলকণ্ঠং প্রশান্তম্।

ধ্যাত্বা মুনির্গচ্ছতি ভূতযোনিং সমস্তসাক্ষিং তমসঃ পরস্তাত্  ॥৭॥

[কৈবল্য উপনিষদ/প্রথম খণ্ড]

✅ অর্থ : এইভাবে যিনি অচিন্ত্য, অব্যক্ত তথা অনন্তরূপে যুক্ত, কল্যাণকারী, শান্ত-চিত্ত, অমৃত, যিনি নিখিল ব্রহ্মান্ডের মূল কারণ, যার আদি, মধ্য এবং অন্ত নেই, যিনি অনুপম, বিভু(বিরাট্) এবং চিদানন্দ স্বরূপ, অরূপ এবং অদ্ভুত, এভাবে সেই উমা(ব্রহ্মবিদ্যা) এর সাথে পরমেশ্বরকে , সম্পূর্ণ চর-অচরের পালনকর্তাকে, শান্তস্বরূপ, ত্রিনেত্র স্বরূপ, নীলকণ্ঠকে যিনি সমস্ত ভূত সমূহ তথা প্রাণীদের মূল কারণ, সবকিছুর সাক্ষী এবং অবিদ্যা রহিত প্রকাশিত হচ্ছে, এভাবে সেই(প্রকাশপুঞ্জ পরমাত্মা) কে যোগী ব্যক্তি ধ্যানের মাধ্যমে গ্ৰহণ করেন    ॥৬-৭॥


তাহলে প্রমাণিত হয়ে গেল যে, 

রাম বলতে নিঃসন্দেহে পরমেশ্বর শিব কেই বোঝায় ।

এখন তাহলে কৈলাসপতি সংহারকর্ত‌া রুদ্রদেব যেখানে বলেছিলেন যে তিনি রামের ভক্ত, এই রাম বলতে তিনি আসলে  কার ভক্ত হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেছিলে বলে বুঝতে পারছেন ?

হ্যা ! একদম নিঃসন্দেহে  কৈলাসপতি সংহারকর্ত‌া রুদ্রদেব নিজের আত্মরূপ পরমেশ্বর শিবেরই ধ্যান করেন , অন্য আর কারোর নয়

প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখতে চান ?  দেখুন 👇  


পরম পবিত্র শিবমহাপুরাণের রুদ্র সংহিতার সতীখণ্ডের ১৬ অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে যে, ভগবান রুদ্রদেবকে সতীদেবীর সাথে বিবাহ সম্পাদন করবার জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু সহ সকল দেবতা কৈলাসে উপস্থিত হন। তারা ভগবান রুদ্রদেব কে সতী দেবীর সহিত বিবাহের জন্য রুদ্রদেবের কাছে প্রার্থনা করেন, তখন সংহারকর্তা ভগবান রুদ্রদেব বললেন,

যমক্ষরং বেদবিদো নিগদন্তি মনীষিণঃ ।

জ্যোতীরূপং শিবং তে চ চিন্তয়িষ্যে সনাতনম্ ॥ ৪০

তচ্চিন্তায়াং যদাসক্তো ব্রহ্মণ্ গচ্ছামি ভাবিনীম্ ।

তত্র যা বিঘ্নজননী ন ভবিত্রী হস্তাস্তু মে ॥ ৪১

ত্বং বা বিষ্ণুরহং বাপি শিবস্য ব্রহ্মরূপিণঃ ।

অংশভূতা মহাভাগা যোগ্যং তদনুচিন্তনম্ ॥ ৪২

[তথ্যসূত্র : শিবমহাপুরাণ/রুদ্র সংহিতা/সতীখণ্ড/১৬ অধ্যায়]

✅ অর্থ : বেদবেত্তা বিদ্বান যাকে অবিনাশী বলে জানেন, সেই অবিনাশী জ্যোতিঃস্বরূপ সনাতন শিবের আমি সর্বদা চিন্তন(ধ্যান) করি ॥ ৪০

হে ব্রহ্মণ ! সেই শিবের চিন্তনে যখন আমি মগ্ন থাকবো না, একমাত্র তখন‌ই আমি আমার সেই পত্নীর সহিত অবস্থান করবো। কিন্তু আমার শিবের চিন্তায় বিঘ্ন সৃষ্টি করবে এমন নারী আমার পত্নী না হোক ॥ ৪১

তুমি ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং আমি রুদ্রদেব - এই তিনজন মহাভাগ্যশালী আমরা হলাম সেই পরমব্রহ্ম শিবের অংশভূত স্বরূপ । অতএব, আমাদের সর্বদা সেই শিবের চিন্তন(ধ্যান) করা উচিত ॥ ৪২


ব্যাখ্যা — দেখুন কৈলাসপতি রুদ্রদেব নিজের মুখে বলছেন যে, তিনি যার চিন্তা করেন তিনি হলেন সাক্ষাৎ পরম শিব , তাছাড়া রুদ্রদেব পরিস্কার করে বললেন যে, সেই শিবেরই তিনটি রূপ হলেন এই ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্র অর্থাৎ ত্রিদেব।  আর এই তিন দেবতার সেই পরমেশ্বর শিব কেই ধ্যান করা উচিত।


সুতরাং, এটা পরিস্কার হয়ে গেল যে,

 প্রথমত, পরমেশ্বর শিব কারোর ধ্যান, জপ, পূজা করেন না।

দ্বিতীয়ত, পরমেশ্বর শিবের অবতার সংহার কর্তা রুদ্রদেবও নিজেরই প্রধান শিবস্বরূপ ছাড়া অন্য আর কারোর ধ্যান জপ পূজা ইত্যাদি কোন কিছুই করেন না ।  

_______________________________________________

_______________________________________________

 রাম বলতে শুধু অযোধ্যা পতি দশরথপুত্র শ্রীরামচন্দ্র কে বোঝায় না, বরং পরমেশ্বর শিব কেও বোঝায়, এটি বেদ থেকে প্রমান করেছি , এবার দেখুন আমাদের শৈব শাস্ত্র  ও শৈব আচার্যগণ এই বিষয়ে কি বলেছেন ? 

প্রথমেই শৈব তন্ত্র থেকে প্রমাণ দেখুন 👇 

♦️ এই 'রামস্থ অবস্থা' আসলেই কার প্রতি সমর্পিত ?

" গচ্ছংস্তিষ্ঠন্স্বপঞ্জাগ্রদুন্মিষন্নিমিষংস্তথা ।

ধাবনং প্লবনং চৈব আযাসঃ শক্তিবেদনম্ ॥

বুদ্ধিভেদাস্তথা ভাবাঃ সংজ্ঞাঃ কর্মাণ্যনেকশঃ । এতচ্চতুর্দশবিধং রামং তু পরিকীর্তিতম্ ॥

ব্যাপিতং দেবদেবেন শিবেন পরমাত্মনা । "

(প্রাচীন শৈবাগম 'ত্রিশিরোভৈরব' তন্ত্র)

অর্থ - গতি, স্থান, স্বপ্ন, জাগ্রত, উন্মেষ, নিমেষ, ধাবন, প্লবন, আয়াস, শক্তিবেদন, অষ্টবিধা বুদ্ধি, ভাব, সমস্ত জাগতিক বস্তুর নাম তথা সংজ্ঞা এবং সমগ্র জাগতিক কর্ম - রামের এই চোদ্দটি স্বরূপ, এই চোদ্দটি স্বরূপ দ্বারা পরমশিবই ব্যাপ্ত রয়েছেন। 


♦️ সাক্ষাৎ মহামাহেশ্বরাচার্য অভিনবগুপ্ত শৈবাচার্য জী তাঁর তন্ত্রালোকের ১.৮৮-৮৯ নং শ্লোকে বলছেন - 

এষ রামো ব্যাপকোঽত্র শিবঃ পরংকারণম্ ॥

ধ্যাযতে পরমং ধেযং গমাগমপদে স্থিতম্ ॥  

পরং শিবং তু ব্রজতি ভৈরবাখ্যং জপাদপি ।

অর্থ — রাম স্বরূপ সেই শিবই সর্বব্যাপী, তিনিই সবকিছুর পরম কারণ, তিনি পরমধ্যেয়, তিনিই গম্য এবং তিনিই অগম্য। ধ্যান (অপরা ধ্যান) এবং জপ (আত্মরোমন্থন/ পরা ধ্যান) এর দ্বারা সেই পরমশিব অবস্থায় উপনীত হওয়াই 'রামস্থ' হওয়া। 


♦️ শৈব নাথ যোগী পরম্পরার শিবের জ্যোতিবালক রূপ অবতার মহাযোগী গোরক্ষনাথ জী তার গোরক্ষবাণী তে বলেছেন —

" सक्ति रूपी रज आछै सिव रूपी व्यंद ।

बारह कला रव आछै सोलह कला चन्द ।

चारि कला रवि की जे ससि घरि श्रावै ।

तौ सिव सक्ती संमि होवै, अन्त कोई न पावै ॥ ৫

एही राजा राम आछै सबै अंगे बासा | "

(গোরক্ষ-বাণী/পদ/১২)

অর্থ — রজ/রক্ত শক্তি স্বরূপ এবং বিন্দু/শুক্র শিব স্বরূপ। সূর্য দ্বাদশকলা যুক্ত (মূলাধারে অবস্থিত কুলামৃত শােষক কলা) এবং চন্দ্র ষোড়শকলা যুক্ত (সহস্রারে অবস্থিত অমৃত নিঃসারক কলা)। হঠ পূর্বক সূর্যের চারকলা যখন চন্দ্রের ষোড়শকলায় মিলিত হয়ে যায়, তখন শিব ও শক্তি অভেদ হয়ে যায় এবং শিবযোগী শিব - শক্তির যামলাত্মক পরমশিব অবস্থায় এসে উপনীত হয়ে জগদানন্দের অনুভূতি লাভ করে যার কোনো অন্ত নেই। এই পরমানুভূতি তত্ত্বই হল 'রাজারাম' অর্থাৎ আত্ম স্বরূপে রমণ।


সারকথা : শৈব আচার্য দের বানীর মাধ্যমে বেদের বচন‌ই বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যার সহ এটি প্রমাণিত হল যে, পরমশিব কেই ‘রাম’ বলা হয়, শুধুমাত্র অযোধ্যারাজ সীতাপতি রামচন্দ্রকেই ‘রাম’ বলা হয় না।


_______________________________________________

_______________________________________________

অযোধ্যা পতি দশরথপুত্র শ্রীরামচন্দ্র ‘রাম’ নামে কেন সম্বোধিত হতেন ? 


পুরাণ শাস্ত্রের মীমাংসা করবার নিমিত্তে সাবর্ণীমুনিকৃত স্বতন্ত্র শৈবশাস্ত্র পৌরাণিক সংহিতা(উপ-আগম)-তে বলা হয়েছে যে পরমেশ্বর শিবের‌ই নাম মূলত ‘রাম’ কারণ তিনিই আত্মা হিসেবে সকল জীবের অন্তরে আছেন, যোগীরা সর্বদা নিজেদের হৃদয়ে সেই পরমেশ্বর পরমশিবের ভাবনায় রমণ করে আনন্দ লাভ করেন, তাই প্রভু শিবকে আত্মারাম বলা হয়, আর যেহেতু দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্র পরমেশ্বর শিবের মতোই সকলকে আনন্দ প্রদান করে সকলের হৃদয়ে রমন করতে শুরু করেছেন জন্ম হবার সাথে সাথে, তাই তার নাম ‘রাম’ রাখা হয়েছে। এছাড়াও প্রভু শিবের কৃপা যাতে রাজ্যের উপর বর্ষিত হয় তার জন্য‌ও রাম নামকে আশ্রয় করেছেন বশিষ্ঠ জী।  প্রমাণ দেখুন —

बशिष्ठ उवाच -

यस्य हृदि सदा साक्षात् शिवः परमकारणम्। 

तस्य हृदयं सदा नित्यं आनन्देन च रम्यते॥ १ ॥

आत्मरामेति यं शास्त्रे महादेवं विभाव्यते।

तेनैव हेतुनाऽस्माकं रमणं सततं भवेत्॥ २ ॥

राजन् दृष्ट्वा तव सुतं ज्येष्ठं सद्गुणभूषणम्। 

सुन्दरं स्मितवक्त्रं च रमणं कुरुते जनः॥ ३ ॥

न केवलं मया दृष्ट्वा ब्रह्माद्याः सुरसत्तमाः। 

त्रैलोक्येऽपि समस्तानि रमन्तेऽद्यैव सर्वतः॥ ४ ॥

भविष्यति महान् शिवधर्मी कर्तव्ये निश्चलो दृढः। 

संसारे प्रेरणास्रोतः श्रेष्ठानां दृष्टिसंस्थितः॥ ५ ॥

राम इत्येव नामास्य कृत्वाऽहं परमं सुखम्। 

सर्वेषां हृदि नित्यं च रमणं कुरुते सदा॥ ६ ॥

एतन्नाम्ना शुभं राज्ये रमते शंकरः स्वयम्। 

आशिषा परमेनैव सदा रम्यं भवन्तु वः॥ ७ ॥

श्रेष्ठः शिवभक्तेषु वेदादिवाक्यपरायणः। 

गुरूऋषीणां पूजकः पुत्रोऽयं ते महामते॥ ८ ॥

साक्षाद्रुद्राय दास्यति हर्षं परममद्भुतम्। 

भविष्ये देवदेवेशः भक्तवत्सलशङ्करः॥ ९ ॥

कैलासपतिरीशानो मार्गदर्शी भविष्यति।

अनेकेषु च कल्याणे पुत्रस्यास्य करिष्यति॥ १० ॥

[তথ্যসূত্র : পৌরাণিক সংহিতা/৯ম পটলঃ(অধ্যায়)]


অর্থ — সমস্ত কারণের মূল কারণ, সেই সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিব যার হৃদয়ে স্থিত। সেই ব্যক্তির হৃদয় নিত্যই আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে রমন করে ॥ ৫

যার কারণে মহাদেবকে শাস্ত্রে ‘আত্মারাম’ নামে বর্ণনা করা হয়েছে আর তার কারণে সবার হৃদয়‌ও সতত রমণীয়(আনন্দিত) হয়ে থাকে ॥ ৬

হে রাজা ! আপনার পুত্রকে দেখে, যিনি সদ্ গুণের দ্বারা অলংকৃত, যার মুখমণ্ডল অতি সুন্দর ও মৃদুমন্দ হাঁসি তে যুক্ত, তা দেখে সমস্ত জন আনন্দে তেমন‌ই রমন করছেন ॥ ৭

শুধুমাত্র আমি ন‌ই, বরং ব্রহ্মা আদি সমস্ত দেবতা তথা ত্রিলোকের সমস্ত প্রাণী‌ও আজ এই পুত্রকে দেখে আনন্দে রমণ করে চলেছে ॥ ৮

এই পুত্র ভবিষ্যতে মহান শিবধর্মপরায়ণ শৈব হবেন, নিজ কর্তব্যে দৃঢ় হয়ে তাতেই নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখবেন, এই নবজাতক সংসারে প্রেরণার স্রোতধারা প্রবাহকারী হবেন আর শ্রেষ্ঠ পুরুষদের দৃষ্টিতে এক উত্তম উদাহরণ হিসেবে বিখ্যাত হয়ে থাকবেন ॥ ৯

এই কারণে আমি এই নবজাতকের নাম ‘রাম’ রাখলাম আর এর দ্বারা আমি নিরন্তর পরম আনন্দ প্রাপ্ত করবো। এই নাম সবার হৃদয়ে রমন করবে আর আর সর্বদা আনন্দপ্রাপ্ত করবে ॥ ১০

এই শুভ নামের দ্বারা তোমার রাজ্যে স্বয়ং ভগবান শংকর রমণ করবেন আর তিনি তার কৃপার দ্বারা এই রাজ্যে সর্বদা সুখ সমৃদ্ধি সম্পন্ন বানিয়ে রাখবেন ॥ ১১

আপনার এই পুত্র রাম শিবভক্তদের মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ শৈব হবেন, বেদ আদি শাস্ত্রের বাক্য পালনকারী হবেন, গুরু এবং ঋষিগণেদের আদর সৎকার শ্রদ্ধাকারী হবেন আর তাদের পূজা ও সম্মান করবেন ॥ ১২

এই কারণে রাম ! স্বয়ং ভগবান রুদ্রদেবকেও পরম অদ্ভুত হর্ষিত(আনন্দ প্রদান) করবেন এবং ভবিষ্যতে সেই দেবতাদের‌ও আরাধ্য দেব ভক্তবৎসল ভগবান শঙ্কর এই শ্রীরাম কে রক্ষা করবেন ॥ ১৩

কৈলাস পতি, সর্বেশ্বর ভগবান শঙ্কর এই রামচন্দ্রের মার্গদর্শনকারী হবেন আর তোমার এই পুত্র অনেক প্রকারের কল্যাণ কার্যতে সংলগ্ন থাকবেন ॥ ১৪


_______________________________________________

_______________________________________________


♦️পৌরাণিক সংহিতাতে বলা হুবহু এক‌ই কথা বৈষ্ণবদের প্রাণপ্রিয় পদ্মপুরাণের পাতালখণ্ডে বলা আছে।

পদ্মপুরাণের পাতালখণ্ডের ৭১ অধ্যায়ে বলা হয়েছে শ্রীরামচন্দ্র বনবাসে যাওয়ার সময় দশরথ বশিষ্ঠ কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন রামচন্দ্র বনবাসে গিয়ে কি কি করবেন ? তখন ভবিষ্যত বলতে গিয়ে বশিষ্ঠ জী বললেন —

গত্বা বনং নিখিলদানববীরহন্তা

শম্ভোরনেকবিধপূজনমাতনোতি ।..॥ ১৪৬

শর্বেণ দেবেন চিরং ন্যবাৎসীৎ ।..॥ ১৪৮

[পদ্মপুরাণ/পাতালখণ্ড/৭১ অধ্যায়]

অর্থ — হে দশরথরাজা ! আপনার রাম বনে গিয়ে বহু দৈত্য রাক্ষস বধ করবেন এবং বিভিন্ন প্রকারে পরমেশ্বর শম্ভুর পূজা করতে থাকবেন ॥ ১৪৬

পরমেশ্বর শর্ব সর্বদা পরম সৌভাগ্যবান রামের সহিত থাকবেন ॥ ১৪৮


♦️ এরপর রামচন্দ্র বনবাসে গিয়ে শৈব বেশভূষা ধারণ করলেন —

অথোপবনে দিনমেকং স্থিত্বা জটাঃ কারয়িত্বা বল্কলং বাসসং ধৃত্বৈকোপবীতী কৃতদন্তশুদ্ধিরে কেনোপবীতেন জটা বদ্ধা ভস্মোদ্ধূলিতসর্ব্বাঙ্গো ভসিতনিষ্ঠুরকায়ো মুক্তাফলদামা মণিব্যত্যস্ত রুদ্রাক্ষমালামুরসি দধানোঽল্লভূষণাধিভূষিতসীতাসহায়ো লক্ষ্মণানুচরো বিবেশ বনান্তরম্ ॥১৫১

[পদ্মপুরাণ/পাতালখণ্ড/৭১ অধ্যায়]

অর্থ — প্রথমে একদিন উদ্যানে থেকে জটানির্মাণ  করলেন, বক্কল পরিধান করলেন, দন্ত ধৌত করলেন, সর্ব্বা নিজে অঙ্গের সর্বত্র ভস্ম মাখলেন, ভস্ম মেখে এমন কোমল সুন্দর দেহ কর্কশ করে ফেললেন, এক উপবীত দ্বারা জটা বাঁধলেন এবং এক উপবীত গলায় পরিধান করলেন; আর মণি-খচিত রুদ্রাক্ষ মালা গলায় ধারণ করলেন । সীতা দেবী সামান্য পরিচ্ছেদ ও অলঙ্কার পরিধান করে তাঁর অনুগামিনী হলেন, লক্ষ্মণ অনুচরের মতো পশ্চাৎ পশ্চাৎ চললেন ॥ ১৫১


♦️এবার পরমেশ্বরের শিবের আরাধনা করে শ্রীরামচন্দ্র কিভাবে রামেশ্বরম জ্যোতির্লিঙ্গে পরমেশ্বর শিবের দর্শন লাভ করে শিবকৃপা প্রাপ্ত করেছিলেন, তা দেখুন 👇 

অথ রামঃ শঙ্করমারাধ্য সর্বং নিবেদ্য তদুক্তং করোমীতি বচনমুক্ত্বা শিবমভ্যর্চ্চ্য প্রণতো ভূত্বা ব্যজিজ্ঞপৎ ॥ ২১৬

দেব মহাদেব মহাভূতগ্রাস মহাপ্রলয়-কারণ মহাহিভূষণ মহারুদ্র শঙ্কর পরমেশ্বর বিরূপাক্ষ নাগযজ্ঞোপবীত করিকৃত্তিবসন ব্রহ্মশিরঃকপালমালাভরণ নরকাস্থিভূষণ ভসিতপর নারায়ণপ্রিয় শুভচরিত পঞ্চব্রহ্মা-দিদেব পঞ্চানন চতুর্ব্বদন বেদবেদ্য ভক্ত-স্থলভাভক্তদুর্লভ পরমানন্দবিজ্ঞানপর পূষ-দন্তপাতন দক্ষশিরশ্ছেদন ব্রহ্মপঞ্চমশিরো-হরণ পার্ব্বতীবল্লভ নারদোপগীয়মান-শুভ-চরিত শর্ব্ব ত্রিনেত্র ত্রিশূলধর পিসকপাণে কপর্দিন্ননেকরূপরম্বাহন শুদ্ধস্ফটিকসঙ্কাশ চতুর্ভুজ নানায়ুধদক্ষিণামূর্ত ঈশ্বর দেবপতে গঙ্গাধর ত্রিপুরহর শ্রীশৈলনিবাস কাশীনাথ কেদারেশ্বর ভূষণসিদ্ধেশ্বর পটহকর্ণেন্বয় কন-খলেশ্বর পর্বতেশ্বর চক্রপ্রদ বাণচিন্তাপাদক মুরহরপূজিতচরণকমল সোম সোমভূষণ সর্ব্বজ্ঞ জ্যোতিৰ্ম্ময় জগন্ময় নমস্তে নমস্তে।২১৭

এবং ভবতো রামন্য পুরতো লিঙ্গমধ্য-কোপেতস্তেজোময়মূর্তিরাবির্ব্বভূব। ২১৮

অভয়বানথ পুনঃ পদ্মাসনাসীনমুমাধি-ষ্ঠিতাঙ্ক-মীশমামুক্ত-সর্বাভরণং সুকান্তি-কিরীটিনংহৈমবতীকটীস্পর্শং করদ্বয়েনাভয়বর-প্রদং তরঙ্গিতানেকদিশাভিঃ পূর্ণং তেজস্বিনং হাসমুখং প্রসন্নবদনৎ দদর্শ রামঃ পরমেশিতারং ননাম বদ্ধাঞ্জলিঃ পুনশ্চ দণ্ডবৎ পপাত।২১৯

[পদ্মপুরাণ/পাতালখণ্ড/৭১ অধ্যায়]

অর্থ — অনন্তর রাম 'শঙ্করের আরাধনা করিয়া তাঁহার নিকট সমস্ত নিবেদন করি, তাহায় পর তিনি যাহা বলেন, তাহাই করিব” এই বলিয়া শঙ্করকে পূজাপূর্ব্বক প্রণাম করিয়া স্তব করিতে লাগিলেন। ২১১-২১৬। দেব! আপনি মহাদেব। আপনি মহাভূত-সমূহকে গ্রাস করিয়া থাকেন। আপনি মহাপ্রলয়ের কারণ। বাসুকি আপনার ভূষণ। আপনি শঙ্কর। আপনি মহারুদ্র পরমেশ্বর। আপনি বিরূপাক্ষ। সর্প দ্বারা আপনি যজ্ঞোপবীত করিয়াছেন। গজচৰ্ম্ম আপনার বসন। ব্রহ্মমস্তক ও নয়-কপাল-মালা আপনার অলঙ্কার। নয়কাসুরের অস্থি দ্বারা আপনি অলঙ্কার করিয়াছেন। আপনি সর্ব্বাঙ্গে ভস্ম মাখিয়া থাকেন। নারায়ণকে আপনি ভালবাসেন। আপনি পবিত্রচরিত্র, পঞ্চব্রহ্মাদিদেব। আপনি পঞ্চানন। আপ-নিই চতুর্মুখ। আপনি বেদপ্রতিপাদ্য ঈশ্বর। আপনি ভক্তের পক্ষে সুলভ, অভক্তের পক্ষে দুর্লভ, আপনি পরমানন্দ-জ্ঞানে বিভোর। আপনি পৃষার দন্ত উৎপাটন করিয়াছেন। দক্ষের মস্তক ছেদন করিয়াছেন, ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তক হরণ করিয়াছেন। হে পার্ব্বতীবল্লভ! নারদ সর্ব্বদা আপনার পবিত্র চরিত গান করিয়া থাকেন, হে শর্ব! হে ত্রিশূলধারিন্! হে পিনাকপাণি কপর্দিন! আপনি বহুবিধ রূপ ধারণ করিয়া থাকেন। বৃষভ আপনার বাহন। শুদ্ধস্ফটিকের ন্যায় আপনার শরীরকান্তি। হে ঈশ্বর দেবপতে আপনি নানা অস্ত্রধারী চতুর্ভুজ। দক্ষিণামূর্তিধারী; আপনি আপনি গঙ্গাধর আপনি ত্রিপুরাসুরকে বধ করিয়াছেন আপনি শ্রীপর্ব্বতে বাস করেন, আপনি কাশীনাথ, কেদারেশ্বর, ভূষণ, সিদ্ধেশ্বর আপনি পটহকর্ণেশ্বর, পর্ব্বতেশ্বর। আপনি কনখলেশ্বর। আপনি চক্রপ্রদ! আপনি - বাণাসুরের চিন্তাপ্রদাতা; মুরারি আপনা পাদপদ্ম পূজা করিয়া থাকেন। আপনি চন্দ্রমূর্তিতে বিরাজ করিতেছেন, চন্দ্র আপ নার ভূষণ। হে জ্যোতিৰ্ম্ময়! আপনি জগন্ম ও সর্ব্বজ্ঞ। আপনাকে পুনঃপুনঃ প্রণাম করি। রাম এইরূপে স্তব করিতে থাকিলে তাঁহার সম্মুখস্থাপিত লিঙ্গমূর্তি হইতে তেজে ময় মূর্ত্তি আবির্ভূত হইলেন। তাঁহার সর্বাঙ্গে বিবিধ অলঙ্কার। মস্তকে উজ্জ্বল কিরী তাঁহার অঙ্গনিঃসৃত জ্যোতি দ্বারা চতুদ্দি আলোকিত হইয়া গেল। তিনি পদ্মাসে আসীন। তাঁহার অঙ্কোপরি পার্বতী দেবী অবস্থিতি করিতেছেন। পার্ব্ব তাঁর কটি স্পর্শ করিয়া তিনি সহাস্যবদনে বরাভয় প্রদান করিতেছেন । পরমেশ্বরকে দর্শন করিয়া রাম অভয় প্রাপ্ত হইলেন, এবং কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাকে 'প্রণাম করিয়া পুনরপি তাঁহার পদপ্রান্তে দণ্ডবৎ পতিত হইলেন ॥ ২১৬-২১৯ 

♦️ পদ্মপুরাণে বর্ণিত শ্রীরামের দ্বারা শিবভক্তির ঘটনার অনুরূপ ঘটনা শিবমহাপুরাণেও বর্ণিত হয়েছে।

অযোধ্যাপতি শ্রীরামচন্দ্র শৈবধর্ম পালন করতেন, তিনি ছিলেন শিবভক্ত পরমশৈব, সীতা হরণ হবার পর সাগরের পাড়ে এসে তৃষ্ণার্ত হয়ে, পানীয় জল নিয়ে আসতে বলেন বানরগণকে, সেই জল পান করতে উদ্যত হয়ে শ্রী রামচন্দ্র ভাবতে থাকেন যে, আজ তো পরমেশ্বর শিবের দর্শন তথা পূজা কিছুই তিনি করতে পারেননি, তাহলে সে অর্চনা না করে কিভাবে তিনি জল পান করবেন ? এই ভেবে শ্রীরামচন্দ্র শিব আরাধনা করেন। সেই প্রসঙ্গতেই, শ্রী রামচন্দ্র একজন পরমশিবভক্ত শৈব বলে প্রমাণিত হন, কারণ, শিব মহাপুরাণে বলা আছে, শৈবরা শিব আরাধনা না করে জল বা আহার গ্রহণ করেন না। শ্রী রামচন্দ্র সইবো না হলে এমন নীতি আদর্শ পালন করতেন না। তিনি একজন পরম শৈব । তাই শৈব হবার আদর্শ ও নীতিকে পালন করেছেন । শ্রীরামচন্দ্র যে শৈব ছিলেন, সেই বিষয়ে দেখুন প্রমাণ 👇

রাঘবঃ শৈবসত্তমঃ ।..॥ ১৪

কৃতবান্ রাঘবঃ পূজাং শিবধর্মপরায়ণঃ ॥ ৩৪

স্তুতিং চ বিবিধাং কৃত্বা প্রণিপত্য শিবং মুদা ।

জয়ং চ প্রার্থয়ামাস রাবণাজৌ তদাত্মনঃ ॥ ৩৫

(তথ্যসূত্র : শিবমহাপুরাণ/কোটিরুদ্র সংহিতা/৩১ অধ্যায়)

অর্থ — শ্রী রাঘব রামচন্দ্র হলেন শৈব ব্যক্তি ॥ ১৪

 পরমেশ্বর শিবের পরমভক্ত শিবধর্মপরায়ণ ছিলেন শ্রীরাম, তিনি পরমেশ্বর শিবের পূজা করলেন। শ্রী রামচন্দ্র বিভিন্ন প্রকারে পরমেশ্বর শিবের স্থপতি করে প্রসন্নতা পূর্বক পরমেশ্বর শিব কে প্রণাম করে রাবণের সাথে যুদ্ধ হতে নিজের বিজয় প্রাপ্ত করবার বর প্রার্থনা করলেন ॥ ৩৪-৩৫


♦️ বশিষ্ঠ নিজেই শৈব আচার্য ছিলেন, শ্রীরামকে একবার ব্রহ্মরাক্ষস ধরেছিলেন, তখন পরমেশ্বর শিবের ভস্ম দিয়ে বশিষ্ঠ জী শ্রীরামকে রক্ষা করেছিলেন, প্রমাণ দেখুন 👇 

অথ কদাচিৎ ক্রীড়মানে রামে বাত্যা রামমপাতয়দ্রামশ্চ রুদন্নপতৎ। ৫০

এতস্মিন্নন্তরে ব্রহ্মরাক্ষসো রামমগৃহা-দ্রামশ্চ মূর্ছামাপ হ। ৫১

অথ সহচরো বাল ইতস্ততো রোক্রয়মাণো রামং তথাবিধং রাজে ব্যজ্ঞাপয়ৎ। ৫২

অথ রাজা রামমাদায় বসিষ্ঠমাহ কিমিদং রামসেস্থতি পপ্রচ্ছ। ৫৩

অথ বসিষ্ঠো ভস্মাদায়াভিমন্ত্র্য।

ব্রহ্ম-রাক্ষসং মোচয়ামাস পপ্রচ্ছ কো ভবানিতি ।৫৪

[পদ্মপুরাণ/পাতালখণ্ড/৭১ অধ্যায়]

অর্থ — একদিন রাম খেলা করিতেছেন, এমন সময়ে একরূপ বাতাস আসিয়া তাহাকে ফেলিয়া দিল; রাম পড়িয়া গিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। ইত্যব-সরে এক ব্রহ্মরাক্ষস আসিয়া রামকে গ্রহণ করিল, রাম মুচ্ছিত হইলেন। তাঁহার সহচর অন্যান্য বালকেরা তাঁহার এইরূপ অবস্থা দেখিয়া চিৎকার করিতে করিতে রাজার কাছে গিয়া রামের এইরূপ অবস্থার কথা বলিল। অনন্তর রাজা তাড়াতাড়ি আসিয়া মুচ্ছি অবস্থায় রামকে লইয়া বসিষ্ঠদেবের নিকটে গমন করিলেন এবং "রামের এ কি হল" বলিয়া তাঁহাকে প্রশ্ন করিলেন। ৪৭-৫৩। বশিষ্ঠদেব রামের গাত্রে মন্ত্রপূত ভস্ম নিক্ষেপ করিয়া ব্রহ্মরাক্ষস থেকে মুক্ত করলেন ।


অর্থাৎ শ্রীরামচন্দ্র শিশুকাল থেকেই পরমেশ্বর শিবের কৃপাপ্রাপ্ত ছিলেন, ভস্ম‌ই তাকে রক্ষা করতো, বশিষ্ঠ জী নিজেই শৈবাচার্য হবার কারণে পরমপবিত্র ভস্ম দ্বারাই রক্ষা করেছেন । এটিই শৈবদের আচার ব্যবহার।

[সেই ব্রহ্মরাক্ষস‌ও শিবপূজার্চনা করেই পাপ থেকে মুক্তি লাভ করেছিল]

_______________________________________________

_______________________________________________



দশরথপুত্র শ্রীরামচন্দ্র যে পরমেশ্বর শিবের পরমভক্ত ছিলেন তা বৈষ্ণবদের‌ই শাস্ত্র পদ্মপুরাণের আরো একটি প্রসঙ্গের থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়। পদ্মপুরাণের পাতালখণ্ডের অধ্যায়ে বলা হয়েছে, দশরথপুত্র শ্রীরামচন্দ্র শিবমাহাত্ম্য বর্ণনা শোনামাত্র শিবের ভক্তিভাবে ভাবিত হয়ে শিবপূজা বিষয়ে শম্ভু মুনিকে প্রশ্ন করতে করতে বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন, প্রমাণ দেখুন 👇 


শ্রীরাম উবাচ।

ক্ব পুজা দেবদেবস্য শঙ্করস্যামিতৌজসঃ।

স্মরণাৎ পাপনাশস্য স্মরণান্মোক্ষদস্য চ ।১০৭

শিবস্য শিবরূপস্য শিবতত্ত্বার্থবেদিনঃ।

সোমস্য সোমভূষস্য সোমনেত্রস্য রাজিসু ॥ ১০৮

বেদমূর্ত্তের মূর্ত্তেশ্চ বেদসারস্য বেদিনঃ।

বেদবেদাঙ্গবিজ্ঞস্য বেদ্যাবেদ্যস্য যোগিনঃ ॥ ১০৯

গোক্ষীরসমদেহস্য গোক্ষীরস্নানমোদিনঃ। 

গোপত্রিণস্থিনেত্রস্য ত্রয়ীনেত্রস্য মায়িনঃ ॥ ১১০

প্রশ্নমধ্যে তথা রামং শিবজ্ঞানমথাবিশৎ।

স্থাণুভূত ইবাসীনো নাসাগ্রন্যস্তলোচনঃ ॥ ১১১

আনন্দনিব্যন্দবিলোচনাশ্রু-প্রবাহসংস্পৃষ্টকপোলদেশঃ।

দধার দেবং গিরিশং হৃদম্বুজে

গোক্ষীর সুস্নিগ্ধসুচারুগাত্রম্ ॥ ১১২

প্রতিবিম্বযথো গাত্রে রামস্য সমদৃশ্যত ॥ ১১৩

দৃষ্ট্বৈব বিম্বিতং শম্ভুং চতুর্বাহুং ত্রিলোচনম্ 

বিস্ময়ং পরমং যাতাঃ সর্বে মুনিহরীশ্বরাঃ ॥ ১১৪

[পদ্মপুরাণ/পাতালখণ্ড/৬৪ অধ্যায়]

অর্থ —

শিবভক্ত রাম ভাববিহ্বল হইয়া প্রশ্ন করিতে লাগলেন, যাঁর স্মরণে পাপনাশ হয়, অধিক কি বলবো যাঁর স্মরণেই মুক্তি লাভ হয়ে থাকে ; সেই অমিততেজা দেব শঙ্করের পূজা কোথায় ? তাঁর পূজা করতে সমর্থ কে ? তিনি শিবতত্ত্বার্থবিদ শিবরূপী (মঙ্গলময়) শিব ; তিনি চন্দ্রভূষণ ও সোমরূপী, চন্দ্র তাঁর নেত্র ; তিনি মূর্তি(রূপ)হীন হয়েও বেদ তাঁর মূর্তি; তিনি বেদের সারভাগ, তিনি বেদবেদাঙ্গবিজ্ঞ সর্বজ্ঞ ও দুর্জ্ঞেয় যোগী।

গোদুদ্ধের ন্যায় তাহার গাত্রকান্তি ; গোদুদ্ধে স্নান করালে তিনি অতি প্রীত হন ; তিনি ত্রিলোচন ; বেদত্রয় তাঁর তিনটি লোচন; তিনি মায়া প্রকাশকারী, তাই মায়া দ্বারা লীলামাত্র করে বৃষবাহন হয়েছেন। এইরূপ প্রশ্ন করতে করতে রাম শিবজ্ঞানে বিভোর হইয়া বাহ্যজ্ঞান-শূন্য হলেন। তিনি নাসাগ্রে নয়ন বিন্যস্ত করে স্থাণুর ন্যায় নিশ্চল হয়ে গেলেন। তাঁর নয়নযুগল হতে দরদর করে আনন্দে অশ্রু প্রবাহিত হয়ে গণ্ডদেশ পরিপ্লুত করতে লাগল। তিনি ধ্যানবলে হৃৎপদ্মে গোদুগ্ধের ন্যায় স্নিগ্ধ, শ্বেতবর্ণ, সুচারুদেহ দেব গিরিশ শিবকে ধারণ করলেন। সেই সময়ে রামের হৃদয়ের মধ্যে মহেশ্বরের প্রতিমূর্তি দৃষ্ট হতে লাগল। সেই সভায় উপস্থিত মুনিগণ ও বানরপতিগণ শ্রীরামের গাত্রমধ্যে চতুর্বাহু (পরশু,মৃগ,বর ও অভয় মুদ্রা ধারী) ত্রিলোচন শিবের প্রতিবিম্ব দর্শন করে সাতিশয় বিস্মিত হলেন ॥ ১০৫-১১৪


_______________________________________________

_______________________________________________

রামায়ণে বলা হয়েছে,

রামচন্দ্র সীতাকে নিয়ে হনুমান প্রভৃতির সহিত আকাশ পথে বিমানে বসে লঙ্কা থেকে অযোধ্যায় ফিরে যাবার সময় মাতা সীতাকে বলেছেন


অত্র পূর্বং মহাদেবঃ প্রসাদমকরোদ্বিভূঃ ।..॥ ২০

(বাল্মিকী রামায়ণ/যুদ্ধ কাণ্ড/সর্গ ১২৫/শ্লোক সংখ্যা ২০)

অর্থ — যিনি সর্বত্র বিভু (ব্যাপ্ত হয়ে আছেন) সেই দেবাদিদেব মহাদেব পরমাত্মা, তারই প্রসাদে (কৃপায়) এই সমস্ত জয় প্রাপ্ত হয়েছি। 


_______________________________________________

_______________________________________________

অন্তিম বিশ্লেষণ 

শিবমহাপুরাণের রুদ্রসংহিতার সতীখণ্ডের ২৪-২৫নং অধ্যায়ে যা বর্ণিত হয়েছে তা সংক্ষেপে হল এমন —

 পরমেশ্বর রুদ্রদেব সতীদেবীকে নিয়ে আকাশপথে ভ্রমণ করছিলেন। সেখানে তিনি একটি গভীর বন দেখতে পান, তার মধ্যে সীতা বিরহে দুঃখিত রাম ও লক্ষ্মণ সীতা দেবীকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। ভগবান রুদ্রদেব এখানে করলেন এক লীলা। তিনি সমগ্র জগতকে এই সত্য অবগত করিয়ে দেবার জন্য, তিনি লীলাবশত রামচন্দ্র কে আড়ালে থেকে প্রণাম করলেন, তা দেখে সতিদেবী খুবই আশ্চর্য হলেন। সতীদেবী বললেন আপনি এই সামান্য মনুষ্যকে কেন প্রণাম করলেন ? আপনি তো সাক্ষাৎ পরমব্রহ্ম শিব, যিনি সবার স্বামী তিনি কি তার সেবককে প্রণাম করেন ? এটি তো উচিত কার্য বলে মনে হয় না। 

তখন পরমেশ্বর রুদ্রদেব বললেন, হে দেবী আমি প্রকৃত কথা বলছি যাতে কোন ছলনা নেই, আমি যেহেতু বর প্রদান করেছি সেই বরের সম্মান রক্ষার্থে আমি রামচন্দ্র কে সম্মানসহ প্রণাম করেছি। কারণ ইনি হলেন সাক্ষাৎ বিষ্ণু। 

কিন্তু সত্যি দেবী তা বিশ্বাস না করে শ্রীরামচন্দ্র কে পরীক্ষা করবার জন্য দেবী সীতার রূপ ধরে উপস্থিত হলেন, কিন্তু শ্রীরামচন্দ্র সতীদেবী কে চিনতে পেরে তাকে প্রণাম করলেন। এতে সতীদেবী বুঝতে পারলেন যে শ্রী রামচন্দ্র প্রকৃতপক্ষে ভগবান বিষ্ণু।

এরপর সতী দেবী  শ্রীরামচন্দ্র কে বললেন, হে রামচন্দ্র তুমি সত্য করে বলো, তুমি কিভাবে শিবের বন্ধনীয় হতে পেরেছো ?

এর উত্তরে শ্রীরামচন্দ্র বললেন, প্রাচীনকালে কৈলাসপতি পরমেশ্বর রুদ্র শ্রীবিষ্ণুর শিব ভক্তির কারণে অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে শিবলোকে বিশ্বকর্মা কে দিয়ে একটি সিংহাসন বানিয়ে সেখানে সকলকে ডেকে এনে সকলের সামনে শ্রীবিষ্ণুকে অভিষেক করিয়ে ঐ সিংহাসনে বসিয়ে তাকে গোপেশপদ প্রদান করেছিলেন, শ্রী বিষ্ণুর সেই লোকের নাম গোলোক। সেখানে সমস্ত দেবতার সামনে পরমেশ্বর শম্ভু নিজের ভক্ত শ্রীবিষ্ণুর কাছে পরাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। পরমেশ্বর শম্ভু বলেছিলেন - আজ থেকে আমার নির্দেশ অনুসারে এই শ্রীবিষ্ণু হরি আমার বন্ধনীয় হলেন। আমার নির্দেশে বেদ আমার মতই শ্রী হরির বর্ণনা করবে। 

এরপর পরমেশ্বর শম্ভু শ্রীবিষ্ণুকে বিভিন্ন রকম বর প্রদান করলেন।

সেই বিষ্ণুই অবতার নিয়েছেন চার ভাই রূপে, যার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আমি রাম, দ্বিতীয় ভরত, তৃতীয় লক্ষণ এবং চতুর্থ শত্রুঘ্ন।  ভগবান শম্ভু নিজের বরদান অনুসারেই আমাকে প্রণাম করেছেন, কারণ তিনি ভক্তবৎসল।


 🔶 এর দ্বারা দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গেল যে, পরমেশ্বর শিব রুদ্র অবতার রূপে শ্রী রামচন্দ্ররূপী ভগবান বিষ্ণুকে নিজের জন্য বন্দনার যোগ্য হবার বরদান দিয়েছিলেন। এটি মূলত শ্রীবিষ্ণুর শিবভক্তির কারণে প্রভু শিব প্রসন্ন হয়ে নিজের ভক্তের অধীন হয়েছেন এই দৃষ্টিতে তিনি শ্রীবিষ্ণু তথা তার অবতারদের প্রণাম করেন মাত্র। পরমেশ্বর শিব নিজের ভক্তদের ভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে নিজের ভক্তকে প্রভু বলে ডাকেন, নিজের ভক্তের দাস হয়ে লীলা মাত্র করেন। তিনি নিজূর দেওয়া বরদান অনুসারেই নিজূর ভক্ত রাম বা কৃষ্ণ বা বিষ্ণুকে প্রণাম করেন, যা পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, ভাগবত পুরাণ ইত্যাদিতে উল্লেখিত হয়েছে বলে দেখা যায়। 

কিন্তু প্রকৃত সত্য তো এটিই যে, 

পরমেশ্বর শিব কারোর ধ্যান জপ পূজা করেননা, নিজের ভক্তের ভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে ভক্তের ভক্তি করেন লীলাবশত। কিন্তু মূর্খ বৈষ্ণবেরা সেই প্রভু শিবের এই মহান মহিমার বিন্দুমাত্র ধারণাও করতে পারে না, তাই তারা সর্বদা পরমেশ্বর শিবকে রামের ভক্ত বলে বেড়ান । যা সম্পূর্ণ অসত্য ।

_______________________________________________

_______________________________________________


সিদ্ধান্ত 


(১) ব্রহ্মা-বিষ্ণু-রুদ্রের উৎপত্তিকর্তা ত্রিদেব জনক পরমেশ্বর শিব কারোর ধ্যান, জপ, পূজা করেন না। তিনি কারোর ভক্ত‌ও নয় ।

(২) পরমেশ্বর শিবের অবতার সংহারকর্তা রুদ্রদেব লোকাচারবশত শ্রীহরি/কৃষ্ণ/রামকে ধ্যান করবার বা তার নাম জপ করবার অভিনয় করেন মাত্র।

(৩) সীতাপতি রামচন্দ্র একজন পরমশিবভক্ত শৈব। এই কারণে ভগবান রুদ্রদেব শিবভক্ত দশরথপুত্র রামের উচ্চ প্রশংসা করতে গিয়ে রামকে উৎকৃষ্ট বলে ঘোষণা করেন, শিবভক্তকে নিজের হৃদয়ে চিন্তা করেন কখনো কখনো, এতে রুদ্রদেবের শ্রেষ্ঠত্ব খণ্ডিত হয় না ।

(৪) রাম বলতে পরমেশ্বর শিবকেও বোঝায়, কৈলাসে বসবাসকারী সংহার কর্তা ভগবান রুদ্রদেব নিজের অন্তরে থাকা আত্মাস্বরূপ পরমাত্মা পরমশিবকেই ধ্যান করতে থাকেন, যাকে আত্মারাম বলা হয়। তিনি সীতাপতি রামকে নিজের আরাধ্য ঈশ্বর হিসেবে কখনোই আরাধনা করেন না।


         — উপরোক্ত শাস্ত্র থেকে দেওয়া প্রমাণ ও যুক্তির  মাধ্যমে ভণ্ড বৈষ্ণবদের অপদাবীর সম্পূর্ণ চরম খণ্ডন  উপস্থাপন করা হয়েছে । 

পরমেশ্বর শিবের অদ্বিতীয়তা ও পরমত্ব সসম্মানে দৃঢ় ও অক্ষুন্ন র‌ইল ।

শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩 

হর হর মহাদেব 🚩


🔥 সত্য উন্মোচন করে অপপ্রচার দমনে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী 

কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT 



মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ