বিষ্ণুর অভিশাপ মুক্তি প্রসঙ্গে শিবের সোমাস্কন্দ মূর্তির উৎপত্তির সংক্ষিপ্ত কাহিনী

 


॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥

আজ আমরা জানবো পরমেশ্বর শিবের ৬৪ টি লীলা মূর্তির মধ্যে একটি সোমাস্কন্দ মূর্তির উৎপত্তির কথা। সোমাস্কন্দ পরমেশ্বর শিবের একটি অন্যতম কল্যাণকারী স্বরূপ। বাংলায় হয়তো আগে কখনো এই ঘটনা কেউ উপস্থাপন করেনি, আজ ISSGT থেকে উন্মোচন করা হলো সেই দিব্য সোমাস্কন্দ মূর্তির উৎপত্তির ইতিহাস। এই ঘটনার উল্লেখ আমরা স্কন্দ উপপুরাণ (শিবভক্তবিলাস) — এ পেয়ে থাকি, এর‌ই নাম তামিল ভাষায় পেরিয়া পুরাণ। এই পুরাণে ৬৩ জন শ্রেষ্ঠ দ্রাবিড় শিবভক্তের কথা বর্ণনা করা আছে যারা নিজের ভক্তির দ্বারা শিবলাভ করেছেন। সেখানেই এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। তিরুভারুরের অর্থাৎ ত্যাগরাজ শিবের মাহাত্ম্য নিয়ে আগেই সংক্ষেপে একটি পোস্ট করা হয়েছিল,তাই আর ত্যাগরাজ (তিরুভারু) মাহাত্ম্য না লিখে সরাসরি মূল ঘটনায় প্রবেশ করছি। ঘটনাক্রমে আমরা কমলালয় বা তিরুভারুর ক্ষেত্রের মাহাত্ম্য বুঝতে পারবো। সোমাস্কন্দ মূর্তির সম্পূর্ণ বর্ণনাও আগে রয়েছে।

_______________________________________________

 স্কন্দ উপপুরাণ (শিবভক্তিবিলাস) -এর ১০ম অধ্যায়ে ‘বিষ্ণুর ভ্রুণ হত্যা নিবৃত্তি’ , ১১শ অধ্যায়ে ইন্দ্রের সোমাস্কন্দ মূর্তি প্রাপ্তি, ১২শ অধ্যায়ে ‘মুচুকুন্দ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ত্যাগরাজের প্রতিষ্ঠা’ বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে।

নিচে এই তিন অধ্যায়কে সংক্ষিপ্ত করে পাঠের উপযোগী করে উপস্থাপন করা হল —


 পরমশৈব আচার্য মহর্ষি অগস্ত্য বলতে শুরু করলেন, 

কোনো এক কল্পের কথা, একবার শক্তিশালী অসুরদের দ্বারা পরাজিত হয়ে ইন্দ্র সহ সকল দেবতাগণ ভগবান বিষ্ণুর স্বরণ নিয়েছিলেন। পালনকর্তা শ্রীবিষ্ণু দেবতাদের উদ্ধারের জন্য সেই শক্তিশালী অসুরদের সাথে যুদ্ধ শুরু করেন। শ্রীহরি সেই অসুরদের পরাজিত করেন। ভগবান বিষ্ণুর হাতে বহু অসুর সেখানেই মৃত্যুকে প্রাপ্ত করে কিন্তু কিছু অসুর এমন ছিল যারা যুদ্ধে পরাজিত হবার পর সেখান থেকে পালিয়ে যায়। তারা ভৃগু ঋষির আশ্রমে গিয়ে পৌঁছায়। মহর্ষি ভৃগু সেইসময় তার আশ্রমে ছিলেন না। কিন্তু ভৃগুঋষির পত্নী তার আশ্রমে মৃত্যুভয়ে পালিয়ে আসা অসুরদের আশ্রয় দেয়। ঋষিপত্নী সেইসময় গর্ভবতী ছিলেন। এরপর ভগবান বিষ্ণুও সেই অসুরদের অনুসরণ করে ভৃগুর আশ্রমে উপস্থিত হয়। স্বয়ং জগৎকর্তা বিষ্ণুকে নিজের আশ্রমে উপস্থিত দেখে ভৃগুপত্নী তৎক্ষণাৎ তার পূজা করেন। ভৃগুপত্নীর পূজা স্বীকার করে ভগবান বিষ্ণু বললেন: হে পতিব্রতেতিব্রতে! আমার ভয়ে ভিত হয়ে দুষ্ট অসুরেরা তোমার আশ্রমে স্বরণ নিয়েছে, তুমি সেই দেবশত্রু অসুরদের আমার হাতে তুলে দাও, আমি এখনি তাদের চক্র দ্বারা বধ করবো। বিষ্ণুর কথা শুনে ভৃগুপত্নী আশ্রমের কুটিরের দুয়ার বন্ধ করে তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থেকে বিষ্ণুকে বললেন:

  হে প্রভু আপনি তো জগতের রক্ষক, আপনি এই পক্ষপাতিত্ব কেন করছেন? যেভাবে দেবতারা আপনার স্বরণ নিয়েছিল বলে আপনি স্বয়ং তাদের রক্ষার নিমিত্তে অসুরদের সাথে যুদ্ধ করেছেন, ঠিক সেরকমই এখন এই অসুরেরা আমার স্বরণ গ্ৰহণ করেছে,তাই এদের রক্ষা করা আমার ধর্ম। হে হরি!এই দৈত্যরা কোথায় লুকিয়ে আছে তা আমি আপনাকে বলতে পারবো না, আপনি যেখান থেকে এসেছেন সেখানে ফিরে যান,আর তা। যদি না হয় তাহলে আপনি আমাকে নিজের চক্র দিয়ে কেটে ফেলুন। 


 তখন ভগবান নারায়ণ দেবতাদের দ্বারা প্রেরিত হয়ে ভৃগুপত্নী কে চক্র দ্বারা বধ করলেন। তারপর সেখানে লুকিয়ে থাকা সমস্ত অসুরদেরও সংহার করলেন। এরপর অসুরদের থেকে দেবতারা তো উদ্ধার পেয়ে গেলেন, কিন্তু ভৃগুপত্নীকে গর্ভবতী থাকা অবস্থায় বধ করার ফলে ভগবান বিষ্ণুর লাগলো ভ্রুণহত্যার দোষ। শাস্ত্রে ভ্রুণহত্যা কে মহাপাপ বলা হয়েছে। এরপর ঋষি ভৃগু যখন সমস্ত ঘটনা জানতে পারে তখন ক্রোধিত হয়ে তিনি ভগবান বিষ্ণু কে অভিশাপ দেন- যেরকম বিষ্ণু তার পত্নীকে হত্যা করে তাকে স্ত্রীবিয়োগের কষ্ট দিয়েছে সেরকমই বিষ্ণুরও স্ত্রীবিয়োগ হবে। এরপর অবশ্য ভৃগুমুনি তার তপোবলের দ্বারা নিজের স্ত্রীকে আবার পুনর্জীবিত  করেছিলেন। ভৃগুঋষির অভিশাপের ফলে শ্রীলক্ষ্মী দেবী বিষ্ণুকে ছেড়ে বৈকুণ্ঠ লোক ত্যাগ কমলালয়ে চলে আসেন এবং সেখানে এসে তিনি পতিকে শাপমুক্ত করার জন্য পরমেশ্বর শিবের আরাধনা করতে লাগলেন।

এদিকে সকল দেবতাগণ সহ শ্রীবিষ্ণু মহর্ষি ভৃগুর স্বরণে গেলেন দোষ নিবৃত্তির জন্য। ভৃগুঋষির ক্রোধ শান্ত হবার পর তিনি শ্রীবিষ্ণুকে বললেন : তুমি যে মহাপাপ করেছো তার তা থেকে উদ্ধার পাবার মাত্র একটিই উপায় আছে তা শোনো! রুদ্রাধ্যায় মহামন্ত্রের ১২ কোটি জপ দ্বারা শিবলিঙ্গের উপর দুধ অভিষেক করলে তুমি শিবের কৃপায় উদ্ধার পাবে। এই সময় তোমাকে সর্বদা শরীরে ভস্ম ও রুদ্রাক্ষ ধারণ করে থাকতে হবে এবং ভস্মের উপরেই শয়ন করতে হবে। এই প্রকার নিষ্ঠার সাথে উমা ও স্কন্দ সহিত পরবমেশ্বর শিবের উপাসনা করলে তুমি ভ্রুণহত্যা দোষ থেকে মুক্তি পাবে এবং লক্ষ্মী দেবী পুণরায় আপনার কাছে ফিরে আসবে।

 ভৃগুঋষির বচন অনুযায়ী, ভগবান বিষ্ণু একটি মরকত মণির শিবলিঙ্গ স্থাপন করে উমাস্কন্দ সহিত পরমেশ্বর শিবের মূর্তি মনে কল্পনা করে, শৈবচিহ্ন(ভস্ম ত্রিপুণ্ড্র তিলক) ধারণ করে শতরুদ্রীয় মন্ত্র পাঠপূর্বক কামধেনু গাভীর দুধ দিয়ে শিবলিঙ্গের অভিষেক করতে লাগলেন। ভগবান বিষ্ণু এই সময় তার হৃদয়ে যে শিব মূর্তির কল্পনা করেছিলেন সেটিই সোমস্কন্দ মূর্তি।

এইভাবে অনন্তকাল ধরে শিব আরাধনা করার পর একসময় পরমেশ্বর শিব আকাশবাণীর মাধ্যমে বললেন : হে বিষ্ণু ভ্রুণহত্যা দোষ থেকে তুমি মুক্ত হয়ে গেছো। দেবী লক্ষ্মীও এবার তোমার কাছে পুণরায় ফিরে আসবে। তোমার আরাধনায় আমি প্রসন্ন হয়েছি,বলো আর কি বর চাও তুমি, তোমাকে সবকিছু দিতে আমি সক্ষম। তখন শ্রীবিষ্ণু বললেন : হে চন্দ্রমৌলে! আপনার কৃপায় আমি যদি পাপমুক্ত হয়ে থাকি তাহলে আপনি আমাকে দর্শন দিন,আমি আপনার রূপ দেখতে চাই। এরপর পরমেশ্বর শিব উত্তর দিলেন : বিষ্ণো! যদি তুমি আমাকে দেখতে চাও তাহলে লক্ষ্মী সমেত বৈরাগ্য ধারণ করে ২ কোটি বছর পর্যন্ত পাশুপত ব্রত পালন করো। সময় শেষ হলে আমি তোমাকে আমার সেই দিব্য রূপ দেখিয়ে দেবো যা যোগীদের পক্ষেও দূর্লভ। 

এরপর ভগবান বিষ্ণু পাশুপত দীক্ষা গ্ৰহণ করলেন। এইসময় তিনি তার সারা শরীরে সর্বদা ভস্ম লেপন করে থাকতেন,তিনি ভস্মের মধ্যেই শয়ন করতেন। মুনিদের ন্যায় বল্কল বস্ত্র ধারণ করে তিনি লক্ষ্মী সহিত গভীর শিব আরাধনায় রত হলেন। এইসময় তিনি জটা ধারণ করেছিলেন। ভগবান বিষ্ণু জটা ধারণ করে সাক্ষাৎ শিবগণেদের ন্যায় দৃষ্টিমান হচ্ছিলেন। সেই সময় সে সর্বদা নমঃ শিবায় মহামন্ত্র জপ করতেন। জলের মধ্যে গলা পর্যন্ত ডুবে থেকে হাতজোড় করে তিনি শিবের তপস্যা করতেন। দেবী লক্ষ্মীও পতিব্রতা নারীর ন্যায় ভগবান বিষ্ণুর সেবা করতে লাগলেন। এইসময় লক্ষ্মীদেবী শিবকে খুশি করার জন্য নানা ধরনের পুষ্প সংগ্ৰহ করে আনতেন এবং ভগবান নারায়ণ শিবসহস্র নাম পাঠপূর্বক সেই পুষ্পদ্বারা শিব আরাধনা করতেন।

এইভাবে ২ কোটি বছর পর্যন্ত শ্রীহরি ও দেবী লক্ষ্মী শিব আরাধনা করলেন। ২ কোটি বছর শেষ হবার পর অবশেষে পরমেশ্বর শিব নারায়ণের উপর অনুগ্ৰহ করলেন। তারা যে শিবলিঙ্গের পূজা করতেন সেই শিবলিঙ্গ থেকেই পরমেশ্বর শিব ষণ্মুখ (কার্তিক) ও মাতা উমা সহিত প্রকট হলেন। পরমেশ্বর শিবের এই রূপই সোমস্কন্দ মূর্তি।

'সোমা' কথার অর্থ উমা সহিত শিব (শিব + উমা = সোমা)

'স্কন্দ' ভগবান কার্তিকের নাম।

পরমেশ্বর শিবের দর্শন লাভ করে মাতা লক্ষ্মী ও নারায়ণ পরম আনন্দে তাকে প্রণাম করলেন।

অসংখ্য সূর্যরশ্মির তেজের ন্যায় পরমেশ্বর শিবের অঙ্গরাগে চারিদিক সুশোভিত হয়ে উঠেছিল। তার তিন নেত্রে পরম করুণার দৃষ্টি ছিল। প্রভুর মস্তকে ছোটো চন্দ্রমা চমকিত হচ্ছিল। গঙ্গা,সর্পরাজ ও ব্রহ্মার মুণ্ডমালা তিনি ধারণ করেছিলেন। তপ্ত সোনার কান্তির ন্যায় জটা ছিল। তার ললাটে সুন্দর কস্তুরির তিলক ছিল। তার মোতির ন্যায় দাঁত,গলায় সুন্দর নাগ এবং কণ্ঠে কর্পুরের লেপ ছিল। তার আঙ্গুলে রত্নের অঙ্গটি ছিল,তার মুখমণ্ডল এতোটাই উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ ছিল যে তা দর্পণের ন্যায় শোভা পাচ্ছিল। মহাদেবের দুই গালে মাতা পার্বতীর মুখের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠছিল। তার মুখমণ্ডল প্রসন্নতায় পরিপূর্ণ ছিল। তার একহাতে পরশু ও একহাতে মৃগ ছিল,বাকি দুই হাত বর ও অভয় মুদ্রায় ছিল। তার সারা শরীরে অসংখ্য দূর্লভ রত্নের আভূষণ ছিল। তার কোটিদেশও রত্নে বিভূষিত ছিল। যজ্ঞউপোবিত রূপে যে নাগকে তিনি ধারণ করেছিলেন, তার নিঃশ্বাস ত্যাগ করার কারণে প্রভুর শরীরে থাকা ভস্ম কোথাও কোথাও কমে গিয়েছিল। শার্দূলের চর্ম তিনি ধারণ করেছিলেন। মণিজটিত নুপূরে তার চরণ শোভিত ছিল। মহাদেব রত্নজটিত সিংহাসনে বিরাজমান ছিলেন। মহেশ্বরের বামপাশে কমলের পাপড়ির মতো নেত্র বিশিষ্ট সর্ব আবরণে সুসজ্জিত হৈমবতীর পার্বতী উপস্থিত ছিলেন। তাদের দুজনের মাঝখানে শিশু কার্তিক খেলা করছিলেন। তার গলায় সিংহের নখ বাঁধা ছিল। সেই শিশু কার্তিকের মাত্র তিনটিই দাঁত ছিল এব্ং তিনি ছয় মুখে সুশোভিত ছিলেন। কুমার অসম্পূর্ণ কথা বলতেন এবং হাসতেন (যেরকম ছোটো বাচ্চারা করে থাক)। মায়ের দুগ্ধের কয়েকফোটা অংশ তার ঠোঁটে লেগে ছিল,যা মোতির ন্যায় শোভা পাচ্ছিল।

পরমেশ্বর শিব মা পার্বতী ও ছোটো কার্তিকের এই দিব্য রূপ দর্শন করে ভগবান বিষ্ণু তাদের উপর ছত্র ধরলেন এবং দেবী লক্ষ্মী চামড় দুলিয়ে তাদের সেবা করলেন। তখন শ্রীহরি শঙ্খ বাজালেন। এরপর উমা ও স্কন্দ সমেত পরমেশ্বর শিব নারায়ণের উপর প্রসন্ন হয়ে তাকে বললেন : তোমার পাপের নিবৃত্তি হয়ে গিয়েছে,লক্ষ্মীর সহিত পূনঃমিলন ও হয়ে গিয়েছে, এখন আমার দর্শন লাভ করে তুমি আমারই সমান হয়ে গিয়েছো। আমার এই রূপ যোগীরাও দেখতে পায়না যা তুমি দর্শন করেছো। বলো তুমি আর কি চাও?

প্রভু শিবের কথা শুনে বিষ্ণু বললেন : ভগবান! আমার উপর কৃপা করে আপনি সর্বদা এই রূপ ধারণ করে থাকুন, যাতে দেবতা ও মুনিগণেরা সদা আপনার কৃপায় ধন্য হবার সৌভাগ্য লাভ করতে থাক। এবার আপনি আমায় যোগনিদ্রায় যাবার অনুমতি দিন।

ভগবান বিষ্ণুর অনুরোধে পরমেশ্বর শিব সেই রূপেই স্থিত হলেন এবং দেবতা ও মুনিগণেরা তা দর্শন করে চিত্ত শুদ্ধ করলেন।

প্রভু মহেশ্বরের এই রূপ ‘সোমাস্কন্দ’ নামে জগতে বিখ্যাত হলো।

এই ‘সোমস্কন্দ বিগ্ৰহ’ টি ভগবান বিষ্ণু নিজের শরীরে (বুকে) স্থাপন করলেন এবং ক্ষীরসাগরে পুনঃ যোগনিদ্রায় চলে গেলেন। অনন্তকাল ধরে বুকের মধ্যে শিবমূর্তি জড়িয়ে রেখে শ্রীবিষ্ণু পরম আনন্দে শায়িত ছিলেন। তারপর একসময় দৈত্যদের ভয়ে ভিত দেবরাজ ইন্দ্রের অনুরোধে শ্রীবিষ্ণু সেই সোমাস্কন্দ মূর্তিটিকে ইন্দ্রকে দিয়ে দেন। তিনি ইন্দ্রকে সেই মূর্তির নিত্য আরাধনা করতে বলেন,এর ফলে ইন্দ্রের দৈত্যভয় নাশ হলো এবং সোমাস্কন্দ মূর্তির পূজা করার ফলে তার শক্তি শুক্লপক্ষের চন্দ্রের ন্যায় বাড়তে থাকলো।

এইভাবে অনেক সময় অতিবাহিত হবার পর রাজা মুচুকুন্দ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করলেন। চলুন এবার জানা যাক রাজা মুচুকুন্দের জন্মের ইতিহাস :

একবার পরমেশ্বর শিব মা পার্বতীর সাথে কৈলাসের এক দিব্য বাগানে বিহার করছিলেন। সেই বাগানের এক সুন্দর বেল গাছের নীচে নানারকম ফুলের সজ্জার উপর মাতা পার্বতী বসেছিলেন এবং তার কোলে মাথা রেখে সুন্দরেশ্বর শিব শুয়ে ছিলেন। সূর্যাস্ত হবার আর কিছু সময় বাকি ছিল। সেই বেল গাছের উপরে একটি হনুমান লাফালাফি করছিল। যার ফলে সেই বেলগাছ থেকে বেলপাতা নীচে থাকা পরমেশ্বর শিব ও মাতা পার্বতীর উপর পড়তে থাকে। এভাবে অজান্তেই সেই হনুমানের গাছের উপর নড়াচড়া করার ফলে বেলপাতা পরমেশ্বরের চরণে পড়ছিল। এভাবে ১০৮ টি বেলপাতা‌ পূর্ণ হয়ে যাবার পর ভক্তবৎসল শিব উঠে পড়েন এবং সেই হনুমান টিকে তার কাছে ডাকেন। সেই হনুমানটি যখন শিব পার্বতী কে একসাথে দেখলো তখন সে তৎক্ষণাৎ তাদের পরিক্রমা করে তাদের চরণে প্রণাম করলো। বিল্বার্পণে খুশি হয়ে প্রভু শঙ্কর তাকে বরদান দিলেন। শিব বললেন‌ : তুমি ১ লাখ ৮ বছর পর্যন্ত পৃথিবীতে রাজা হয়ে রাজত্ব করো, তোমার জন্ম মনুবংশে হবে।

শিবের এই বাক্য শুনে সেই হনুমান কাঁদতে লাগলো এবং সে বললো : হে প্রভু আমার কোনো রাজ্যের দরকার নেই। সকলে আপনার বন্দনা করে জন্মমৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হবার জন্য,কিন্তু সেই আপনি যদি আমাকে পৃথিবীতে জন্মাবার আদেশ দেন তাহলে আমার থেকে দূর্ভাগ্যবান জগতে আর কে আছে? রাজ্য তো আপনার ভক্তিতে বাধা, আমি আপনার চরণের দাস হয়েই থাকতে চাই। হে করুণার সাগর প্রভু আমার উপর দয়া করুন। আমার রাজ্য চাই না আমার শুধু আপনার ভক্তি চাই। আমাকে দয়া করুন।

তার কথা শুনে পরমেশ্বর শিব বললেন : আমি যে আদেশ দিয়েছি তুমি সেটাই পালন করো। কারণ তুমি অজান্তে আমার আরাধনা করেছো। অজান্তে আমার আরাধনা করলে ভোগ প্রাপ্তি হয়,তাই তুমি পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে অত্যন্ত সুখ ভোগ করো,অন্তিমে তুমি আমাকে লাভ করবে। মানুষরূপে তুমি আমার দর্শনও লাভ করবে,তাই শোকত্যাগ করো এবং পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করো। ভগবান এই বলে চলে গেলেন।

শিবের আদেশে সেই হনুমান মনুকুলে জন্মগ্ৰহণ করে মহারাজা মুচুকুন্দ নামে বিখ্যাত হয়। রাজা মুচুকুন্দ ধর্মপরায়ণ রাজা ছিলেন এবং দেবরাজ ইন্দ্রের সাথে তার মিত্রতা ছিল। একবার অসুরদের সাথে যুদ্ধে রাজা মুচুকুন্দ ইন্দ্রদেব কে সাহায্য করেছিলেন,যার ফলে ইন্দ্র অসুরদের মারতে সক্ষম হয়েছিল। তাই দেবরাজ ইন্দ্র তাকে স্বর্গলোকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসে। এরপর রাজা মুচুকুন্দ ইন্দ্রের মহলের শিবালয়ে প্রবেশ করে এবং সেই অলৌকিক সোমস্কন্দ মূর্তিটি দেখে। সেটি দেখার পর মুচুকুন্দ মনেমনে পরমেশ্বর মহাদেবের স্তুতি করতে থাকে। ঠিক সেই সময় পরমেশ্বর শিব সূক্ষ্মরূপে অদৃশ্যভাবে এসে মুচুকুন্দের কানে বলে : তুমি আমার এই মূর্তি পৃথিবীতে নিয়ে গিয়ে স্থাপন করো। এই কথা মুচুকুন্দ ছাড়া আর কেউ শুনতে পাইনি। শিবের আদেশ পেয়ে রাজা মুচুকুন্দ ইন্দ্রের থেকে সেই মূর্তিটি চাইলেন। দেবরাজ ইন্দ্র তখন তাকে বলে : যেহেতু এই মূর্তিটি ভগবান বিষ্ণু আমাকে দিয়েছিলেন তাই তুমি তার কাছে গিয়েই মূর্তিটির জন্য প্রার্থনা করো। তার কথামতো রাজা মুচুকুন্দ ভগবান বিষ্ণুর কাছে গিয়ে সেই সোমস্কন্দ বিগ্ৰহটি চাইলেন। ভগবান বিষ্ণু আজ্ঞা দিয়ে দিলেন। তখন মহারাজ মুচুকুন্দ পুণরায় ইন্দ্রদেবের কাছে গেলেন এবং তাকে বললেন : ভগবান নারায়ণ আমাকে আজ্ঞা দিয়েছেন এবার এই মূর্তিটি তুমি আমাকে প্রদান করো। কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্র এই শিবপ্রতিমাকে হাতছাড়া করতে চাইছিলেন না‌,তাই তিনি ভগবান বিশ্বকর্মা কে দিয়ে এই মূর্তির মতোনই হুবহু আর একটি নকল মূর্তি বানায় এবং সেটি রাজা মুচুকুন্দ কে প্রদান করে। এরপর রাজা মুচুকুন্দ সেই মূর্তিটিকে পৃথিবীতে এসে স্থাপন করেন। এরপর পরমেশ্বর শিব আকাশবাণীর মাধ্যমে তাকে জানালেন যে এই মূর্তিটি নকল মূর্তি। আকাশবাণী শুনে মহারাজ মুচুকুন্দ পুণরায় ইন্দ্রলোক যায় এবং আসল মূর্তি দেবার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্র তাকে আবার একটি নকল মূর্তি দেয় এবং বলে যে এটাই আসল মূর্তি। রাজা মুচুকুন্দ সেই মূর্তিটিকেও পৃথিবীতে এসে স্থাপন করেন। এরপর আবার আকাশবাণী হয় এবং পরমেশ্বর শিব তাকে জানায় যে এটাও নকল মূর্তি। এইভাবে রাজা মুচুকুন্দ ছয়বার ইন্দ্রের কাছ থেকে নকল মূর্তি এনে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেন। সপ্তমবারে পরমেশ্বর শিব মুচুকুন্দ কে বলেন যে : যে মূর্তিটির গলার ফুলের মালার মধ্য মৌমাছি এসে বসবে,জানবে সেটাই আসল মূর্তি। কারণ নকল মূর্তির মালাও নকল হবে তাই তাতে মৌমাছি এসে বসবে না। আকাশবাণী শুনে রাজা মুচুকুন্দ পুণরায় ইন্দ্রলোকে গিয়ে ইন্দ্রদেবের থেকে আসল মূর্তির জন্য প্রার্থনা করেন। এবারেও ইন্দ্র তাকে নকল মূর্তি দিতে যাচ্ছিল কিন্তু তখনই রাজা মুচুকুন্দ আসল মূর্তিটির উপর মৌমাছি উড়তে দেখে বুঝে যায় এবং সেই মূর্তিটিই নেবার জন্য ইন্দ্রকে বলে। ইন্দ্র অবাক হয় কিন্তু অবশেষে সে আসল মূর্তিটি দেবার জন্য রাজি হয়ে যায়। এরপর রাজা মুচুকুন্দ সেই দিব্য সোমাস্কন্দ মূর্তিটিকে প্রদক্ষিণ করে পৃথিবীতে নিয়ে আসে। তখন পরমেশ্বর শিব তাকে আদেশ দেয় এই মূর্তিটিকে কমলালয়ে স্থাপিত করার। পরমেশ্বর শিবের কথামত মহারাজ মুচুকুন্দ সেই অলৌকিক সোমাস্কন্দ বিগ্ৰহটিকে কমলালয় বা তিরুভারুরে স্থাপন করেন। এভাবেই স্বয়ং প্রকট হওয়া সোমাস্কন্দ মূর্তি ভগবান বিষ্ণুর থেকে ইন্দ্র, তার থেকে রাজা মুচুকুন্দের হাত ধরে ত্যাগরাজ (তিরুভারুরে) প্রতিষ্ঠা হয়।


আজও এই মূর্তি তামিলনাড়ুর তিরুভারুরে বিরাজমান আছে, যাকে স্কন্দ উপপুরাণ ‘ত্যাগরাজ’ নামে অভিহিত করেছেন। বাকি যে ছয়টি মূর্তি ভগবান বিশ্বকর্মা দ্বারা বানানো হয়েছিল সেগুলিও এক একটি মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত আছে। সেই ছয়টি স্থানের নাম নীচে উল্লেখ করা হলো 👇

১- তিরুনাল্লার

২- বেদারণ্যম

৩- তিরুবাইমুর

৪- তিরুকারভাসাল

৫- তিরুক্কুভালাই

৬- নাগাপট্টিনম

এইসব স্থান তিরুভারুরের কাছাকাছির মধ্যেই আছে।

বর্তমান ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের সাত জায়গায় থাকা এই সাত স্থানকে একত্রে সপ্ত বিড়ঙ্গা বলা হয়।

বিড়ঙ্গা কথার অর্থ অলৌকিক। যেহেতু এখানে থাকা এই সাতটি মূর্তি ভুতলের নয় এবং পৃথিবীর কোনো মানুষ দ্বারা বানানো নয় তাই এই সাত স্থানকে একত্রে সপ্ত বিড়ঙ্গা বলা হয়।

সোমাস্কন্দ মূর্তির পূজা করলে মোক্ষলাভ হয়। এই রূপে পরমেশ্বর শিব অধিক তাড়াতাড়ি প্রসন্ন হন। দক্ষিণ ভারতের সবথেকে বেশি প্রচলিত শিব স্বরূপের মধ্যে এই সোমস্কন্দ স্বরূপ অন্যতম।

সোমস্কন্দ গায়ত্রী মন্ত্র নীচে দেওয়া হলো 👇

ॐ স্বপ্রকাশায় বিদ্মহে সর্বরূপায় ধীমহি ।

তন্নো সোমাস্কন্দ প্রচোদয়াৎ ॥

আপনি এই গায়ত্রী মন্ত্র পাঠপূর্বক সোমাস্কন্দ মূর্তির আরাধনা করতে পারেন।


এই অতি সুন্দর শিবকথা পাঠ করে আপনার  কেমন লাগলো অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন এবং অবশ্যই আমাদের #ISSGT পেজটি ফলো করে দেবেন। আর তার‌ই সাথে এই পোষ্ট টি বেশি বেশি শেয়ার করে সকলকে শিবভক্তির মহিমার কাহিনী জানবার সুযোগ করে দিন।


শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩 

হর হর মহাদেব 🚩 


লেখনীতে ---✍️---অভিষেক বাগ (শৈলনাথ শৈব)

সম্পাদনায় : শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী 

কপিরাইট ও প্রচারে ---©️---- INTERNATIONAL SHIVA SHAKTI GYAN TIRTHA - ISSGT

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ