শ্রীকৃষ্ণ কেন নিজের আত্মস্বরূপ রুদ্রের পূজা করেন ? - এবিষয়ে অপযুক্তি উপস্থাপনকারী বৈষ্ণবদের খণ্ডন
সমগ্র জগৎ ও জীবাত্মা হচ্ছে পরমাত্মার শরীর। পরমাত্মা হচ্ছেন জগৎ ও জীবাত্মার আত্মা। জীবাত্মা পরমাত্মার শরীর আর পরমাত্মা হচ্ছে জীবাত্মার অন্তঃস্থিত আত্মা অর্থাৎ পরম আত্মা
শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হচ্ছে,
য আত্মনি তিষ্ঠন্ আত্মনোঽন্তরো যমাত্মা ন বেদ যস্যাত্মা শরীরং য আত্মানমন্তরো যময়তি স ত আত্মাঽন্তর্যাম্যমৃতঃ।। (শতপথ ব্রাহ্মণ ১৪/৬/৭/৩০)
সরলার্থঃ- যিনি আত্মাতে(জীবাত্মা) অবস্থান করতঃ আত্মার(জীবাত্মা) মধ্যে থাকেন, আত্মা(জীবাত্মা) যাহাকে জানে না, আত্মা(জীবাত্মা) যাহার শরীর, যিনি আত্মার(জীবাত্মা) অভ্যন্তরে থাকিয়া তাকে শাসন করেন, তিনিই তোমার আত্মা(পরমাত্মা) অন্তর্যামী মৃত্যুহীন।
শ্রুতি, ইতিহাস, পুরাণ মতে এই পরমাত্মাই হচ্ছেন নারায়ণ,
শ্রুতি,
নারায়ণং মহাজ্ঞেয়ং বিশ্বাত্মানং পরায়ণম্ ॥(তৈত্তিরীয়ারণ্যক, প্রপাঠকঃ - ১০ , অনুবাকঃ - ১৩, মন্ত্র:-১)
অর্থ:- নারায়ণই হচ্ছে জ্ঞানের যোগ্য সর্বোচ্চ পরম বস্তু বা লক্ষ্য। তিনিই বিশ্বের আত্মা। তিনিই হচ্ছেন সমস্ত কিছু পরম গতি।
আত্মা নারায়ণঃ পরঃ।।
(তৈত্তিরীয়ারণ্যক, প্রপাঠকঃ - ১০ অনুবাকঃ - ১৩, মন্ত্র:- ১)
অর্থ:- নারায়ণই পরমাত্মা।
✅ শৈব পক্ষ থেকে বৈষ্ণবদের দাবীর খণ্ডন—
প্রথমেই বৈষ্ণবগণ পরমাত্মা ও জীবাত্মার যে উদাহরণ টা দিলো তার মধ্যে উল্লেখ করলো যে- “পরমাত্মা হলো জীবাত্মার আত্মা”। আচ্ছা এটা কীভাবে সম্ভব? জীবের অন্তঃস্থিত আত্মা বলা যেতে পারে, তাই বলে জীবাত্মার আত্মা এটা কীভাবে যৌক্তিক হয়? আত্মার মধ্যে আরেক আত্মার অবস্থান কীভাবে হতে পারে? আত্মার মধ্যে যদি আত্মার অবস্থান হয় তাহলে- “অয়ম্ আত্মা ব্রহ্ম” [বৃহদারণ্যক উপনিষদ/৪/৪/৫], এই শ্রুতি বাক্যের বিরোধ ঘটে। কেননা, পরমাত্মাই জীবাত্মা স্বরূপে ভাসিত হচ্ছে- “[ছান্দোগ্য উপনিষদ/৩/১৪/৩ ও ছান্দোগ্য উপনিষদ/৩/১৪/৪]” অনুযায়ী- এই আত্মা এই আত্মসত্ত্বাই হলো সেই ব্রহ্ম। তাই এখানে বৈষ্ণবদের মূর্খতাপূর্ণ দাবীর কোনো যৌক্তিকতা পাওয়া যায় না। কেননা পরমাত্মাই জীবদেহে প্রবেশ করবার কারণে জীবাত্মা নামেতে সম্বোধিত হন মাত্র। তাই আত্মার মধ্যে কখনো আরেকটি ভিন্ন আত্মার অবস্থান হয় না। পরমাত্মাই জীবাত্মা রূপে ভাসিত হন, ইহাই শ্রুতি ও ন্যায় সঙ্গত।
যঃ শুক্র ইব সূর্যো হিরণ্যমিব রোচতে।
শ্রেষ্ঠো দেবানাং বসুঃ ॥ ৫ ॥
[ঋগবেদগ/১ম মণ্ডল/৪৩নং সুক্ত]
প্রভু রুদ্র সূর্যসম দীপ্তিমান এবং স্বর্ণসম উজ্জ্বল প্রভাযুক্ত, তিনি সকল দেবতার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রভু, তিনিই সকলের একমাত্র মাত্র আশ্রয়, তাই তার মধ্যে সকলে নিবাস করেন ॥৫॥
অর্থাৎ প্রথমে যা বললো যে, জগৎ পরমাত্মারই শরীর তার একি সমর্থন শ্রুতিও দিচ্ছে যে, সেই পরমাত্মা মহেশ্বর মহাদেবই, যার অবয়ব দ্বারা সমগ্র জগৎ ব্যাপ্ত। তাই শ্রুতিতে পরমেশ্বর শিবকে "জগতাম পতয়ে নমঃ" [শুক্ল-যজুর্বেদ/১৬/১৮] ইত্যাদি বলে সম্বোধন করে। যার অর্থ হয় শিব নিজেই জগত স্বরূপ বা জগতের অধিপতি। এবং পরমেশ্বর শিবই একমাত্র আশ্রয় তাই সকলে পরমেশ্বর শিবের মধ্যেই নিবাস করেন। তাই এক্ষেত্রে দেখা যায় যে, পরমাত্মা রূপী শিবই জীবের মধ্যে আত্মারূপে অবস্থিত আছেন। এবং সকলে পরমেশ্বর শিবের মধ্যে অবস্থিত।
বৈষ্ণবরা তৈত্তিরীয় আরণ্যক টেনে এনে পরমাত্মা বাচক বিশেষণকে, চতুর্ভুজ পৌরাণিক বিষ্ণু দাবী করলে এই দাবী কদাপি গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা নারায়ণ শব্দটা শিববাচক। কেননা শ্রুতিতে স্পষ্ট বলায় আছে যে—
ॐকারং চতুর্ভুজং লোকনাথং নারায়ণম্।
সর্বস্থিতং সর্বগতং সর্বপব্যাপ্তং তন্মে মনঃ শিবসঙ্কল্প মস্তু।।২২।।
[ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/২২ এবং ঋগ্বেদ খিলভাগ/৪/১১/২২]
অর্থ— যিনি চতুর্ভুজ (চারহাত বিশিষ্ট), অখিলব্রহ্মাণ্ডের স্বামী, সর্বত্রবিরাজমান, সর্বজ্ঞাতা সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী সেই নারায়ণরূপী পরমেশ্বর শিবের প্রতি মন সংকল্পিত হোক।।২২।।
অর্থাৎ শ্রুতি থেকেই এই বিষয়টা পরিস্কার হয়, উক্ত তৈত্তিরীয় আরণ্যকে যে নারায়ণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা পরমেশ্বর শিবকেই প্রতিপাদিত করে। কেননা শ্রুতি কখনো পরস্পর বিরোধী বক্তব্য স্থাপন করে না। তাই বৈষ্ণবদের মীমাংসা জানা উচিত যে- “একমেবাদ্বিতীয়ম” [ছান্দোগ্য উপনিষদ/৬/২/১] ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। তাই শ্রুতি সিদ্ধান্ত অনুসারে সেই এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মটা সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিব। কেননা শ্রুতিতে পরমেশ্বর শিব সম্পর্কে এটাই বলা হয়েছে যে- “এক এব রুদ্রো ন দ্বিতীয়” [তৈত্তিরীয় সংহিতা/১/৮/৬] অর্থাৎ রুদ্রই (পরশিব অর্থে) অদ্বিতীয় পরমেশ্বর, দ্বিতীয় কোনো সত্ত্বা নেই।
তাই এই অর্থে এই মীমাংসায় উপনীত হওয়া যায় যে, যেহেতু সনাতন একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী, সেহেতু সেই এক ঈশ্বরটিই হলো একমাত্র পরমেশ্বর শিব। আর ইহা হলো শ্রুতির মান্যতা। তাই এখানে বিশেষণকে ঔপাধিক অর্থে ধরে পরমাত্মা বাচক নামকে চতুর্ভুজ পৌরাণিক নারায়ণ বলে দাবী করাটা মোটেও শ্রুতি ও ন্যায় সঙ্গত নয়।
এসব ছাড়াও বৈষ্ণব দর্শন অনুসারে ঈশ্বর সগুণ, সবয়ব। এখানে নিরাকার নির্গুণের কোনো কনসেপ্ট নেই বললেই চলে। তাই যদিও বৈষ্ণব দর্শন মানা হয়, তাহলেও তা শ্রুতি বিরুদ্ধ হয়। কেননা শ্রুতি মতে ঈশ্বর সগুন এবং নির্গুণ দুই অবস্থাতেই বিদ্যমান আছেন। যা, [বৃহদারণ্যক উপনিষদ/২/৩/১] অনুযায়ী প্রমাণিত হয়।
এবং একি প্রসঙ্গে শ্রুতিতে সেই সগুণ, নির্গুণ ঈশ্বর বলতে পরমেশ্বর শিবকেই বোধিত করে। [ঋগবেদের আশ্বলায়ণ শাখা/১০/১৭১ ও ঋগবেদ/খিলভাগ/অধ্যায় ৪/খিলা ১১] অনুযায়ী, পরমেশ্বর শিবকে নিরাকারে “অকায়ো নির্গুণ” ও সাকারে “নীলকণ্ঠ ত্রিনেত্র” বলা হয়েছে। যার থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, উক্ত বৃহদারণ্যক শ্রুতিতে বলা সেই, সগুণ, নির্গুণ ব্রহ্মটা কেবল শিবই, দ্বিতীয় কেউই নয়। আর ইহাই হলো সম্পূর্ণ শ্রুতি সঙ্গত।
——————————————————————————————————————————
(সুবল উপনিষদ- ৭)
অর্থ:- তিনি সর্বজীবের অন্তরাত্মা দিব্য দেব অদ্বিতীয় নারায়ণ।
মহাভারতে,
অহমাত্মা গুড়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ৷
অহমাদিশ্চ মধ্যং চ ভূতানামন্ত এব চ৷৷
(গীতা-১০/২০)
অর্থ: হে গুড়াকেশ, আমিই সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থিত পরমাত্মা, আমি সর্বভূতের আদি, মধ্য ও অন্ত।
শিবের হৃদয়স্থিত পরমাত্মা হলেন ভগবান নারায়ণ,
"বিষ্ণুরাত্মা ভগবতো ভবস্যাঅমিততেজস:। তস্যাদ্ধনুর্গ্যাসংস্পর্শং স বিষেহে মহেশ্বর:।।" (মহাভারত, কর্ণপর্ব,৩৫/৫০)
অনুবাদ: অমিততেজা মহেশ্বর শিবের মধ্যে আত্মারূপে বিষ্ণু অবস্থিত সেই জন্য তিনি ধনুকের জ্যা সংস্পর্শ সহ্য করতে পেরে ছিলেন।
মহাভারতে মোক্ষধর্মপর্বে ১৭৯/৪ এ ব্রহ্মা রুদ্র সংবাদে রুদ্রের প্রতি ব্রহ্মার বাক্য-
"ভবান্তরাত্মা মম চ যে চান্যে দেহি সংজ্ঞিতা:।
অণ্যেষাং চ দেহিণাং পরমেশ্বরো নারায়ণ: অন্তরাত্মত্যাবস্থিত।।"
অনুবাদ: তোমার আমার এবং অপরাঅপর যে সব দেহধারী আছেন তাদের অন্তরাত্মা রূপে পরমে নারায়ণ অবস্থিত আছেন।
সুতরাং, সমগ্র দেব জীব মনুষ্যের অন্তঃস্থিত পরমাত্মা রূপে নারায়ণই অবস্থিত আছেন।
✅শৈব পক্ষ থেকে বৈষ্ণবদের দাবীর খণ্ডন—
বৈষ্ণবগণ সুবল উপনিষদের প্রমাণ টেনে যে দাবীটা করেছে যে, জীবের অন্তঃস্থিত আত্মাটা হলো নারায়ণ। আবার ওখানে এটাও বলা আছে যে- “একো নারায়ণঃ” অর্থাৎ একমাত্র নারায়ণ। তাহলে এমন যদি হয়, শ্রুতিতে যেখানে বলা আছে যে জীবের মধ্যে আত্মারূপে বিরাজমান হলো পরমেশ্বর শিব। এই প্রসঙ্গে শ্রুতিতে বলা আছে—
“দেহো দৈবালয় প্রোক্তঃ স জীবঃ কেবলঃ শিবঃ”।।
[মৈত্রেয়ী উপনিষদ/অধ্যায় ২/১]
শরীর হচ্ছে দেবালয় এবং উক্ত শরীরে যে জীবাত্মা আছেন তিনিই পরমেশ্বর শিব।।
তাহলে ভেবে দেখুন, এখানে কি শ্রুতির পরস্পর বিরোধ হচ্ছে না ? সুবল উপনিষদ অনুযায়ী নারায়ণ জীবের আত্মা। আবার মৈত্রেয়ী উপনিষদ অনুযায়ী পরমেশ্বর শিবই জীবের আত্মা। তাহলে এর মীমাংসা কি?
মীমাংসা— সকল জীবের অন্তঃস্থিত আত্মা হলো নারায়ণ রূপধারী পরমেশ্বর শিব। এই জগৎ উৎপত্তির কারণ হলো পরমেশ্বর শিব। তাই শ্রুতিতে পরমেশ্বর শিবকে জগতের পতি বলা হয়েছে- “জগতাম পতয়ে নমঃ” [শুক্ল-যজুর্বেদ/অধ্যায় ১৬/১৮] অর্থাৎ পরমেশ্বর শিবই জগতের অধিপতি। আর এই জগতকে পরিচালিত করে শ্রীহরি নারায়ণ। এই প্রসঙ্গে শ্রুতিতে বলা আছে যে— “রুদ্রাৎপ্রবর্ততে বীজং বীজযোনির্জনার্দনঃ” [রুদ্রহৃদয় উপনিষদ/৭] পরমেশ্বর 'পরারুদ্র শিব'ই সকল কিছুর উৎপত্তির কারণরূপী বীজ, আর সেই কারণরূপী বীজ বপন করবার জন্য যোনীস্বরূপ হলেন জনার্দন নারায়ণ।
এবং আরও বলা হয়েছে যে—
অন্তরাত্মা ভবেদ্ ব্রহ্মা পরমাত্মা মহেশ্বরঃ
সর্বেষামেব ভূতানাং বিষ্ণুরাত্মা সনাতনঃ ॥ ১২
[রুদ্রহৃদয় উপনিষদ/১২]
অর্থ - জীবের অন্তরের আত্মা হলেন ব্রহ্মা, পরমাত্মা হলেন মহেশ্বর, তিনিই সর্বভূতে ব্যাপ্ত হয়ে বিষ্ণু নামে বিখ্যাত সনাতন আত্মা ॥১২।।
তাহলে এবার সবার কাছে এটা পরিস্কার হলো যে সেই নারায়ণটাই হলো পরমেশ্বর শিব, যিনি সমস্ত জীবের হৃদপুণ্ডরীকে অবস্থান করেন। এই প্রসঙ্গে শ্রুতিতে আরও বলা আছে—
যে নমস্যন্তি গোবিন্দং তে নমস্যন্তি শঙ্করম্।
যেহচয়ন্তি হরিং ভক্ত্যা তেহচয়ন্তি বৃষধ্বজম্ ॥ ৫ ॥
[রুদ্রহৃদয় উপনিষদ/৫]
অর্থ - (পরমেশ্বর শিবের বামপাশে স্থিত থাকা) শ্রীগোবিন্দের প্রতি নমস্কার করলে সেই নমস্কার মূলত পরমেশ্বর শঙ্করকেই করা হয়ে থাকে, যিনি ভক্তি সহকারে হরিকে অর্চনা করে থাকেন তার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে বৃষধ্বজ শিবেরই অর্চনা হয় বলে জানবে ॥ ৫ ॥
অর্থাৎ শ্রুতি নিজেই বলছে যে সেই নারায়ণকে অর্চ্চনা করলে তা শিবেরই অর্চ্চনা করা হয়। তাই কেই যদি মোক্ষ অভিলাষে নারায়ণের অর্চ্চনা করেন তবে, পরমেশ্বর শিবই সেই জীবের মোক্ষ নিশ্চিত করে। তাই এখানে উক্ত বিষয় টা পরিস্কার যে জীবের হৃদয়ে অবস্থিত আত্মাটা হলো নারায়ণরূপী শিব।
এবার হয়তো বৈষ্ণবেরা এটাও মানতে চাইবে না, কারণ বৈষ্ণবরা বরাবরেই পরমেশ্বর শিবের নিন্দুক ও অপপ্রচারকারী। তারা স্বতন্ত্র ভাবে নারায়ণকে মানলেও পরমেশ্বর শিবকে মানে না। আর যে পরমেশ্বর শিবকে মানে না সে ভগবান বিষ্ণুরও দ্বেষকারী। তাই শ্রুতিতে বলছে—
যে দ্বিষন্তি বিরূপাক্ষং তে দ্বিষন্তি জনার্দনম্।
যে রুদ্রং নাভিজানন্তি তে ন জানন্তি কেশবম্ ॥ ৬
[রুদ্রহৃদয় উপনিষদ/৬]
অর্থ - যে ব্যক্তি 'বিরূপাক্ষ শিব'কে দ্বেষ করে, এর মাধ্যমে জনার্দন শ্রীহরিকেও দ্বেষ করা হয়ে থাকে। যিনি পরমেশ্বর রুদ্রের প্রকৃত তত্ত্ব সম্পর্কে অবগত নন, তিনি কেশবের সম্পর্কেও কিছুই অবগত নন ॥৬॥
দেখুন একটা বিষয় খুব পরিস্কার ভাবে বলা উচিত যে পরমেশ্বর শিব আর নারায়ণের মধ্যে ব্যবহারিক কিছু পার্থক্য ছাড়া পারমার্থিক দিকে কোনো ভেদ নেই। কেননা পরমেশ্বর শিবই নারায়ণ রূপে ভাসিত হচ্ছেন যা শ্রুতির সিদ্ধান্ত। তাই কেবল বাহ্যিকভাবে নারায়ণকে স্বতন্ত্র পরমেশ্বর দাবী করাটা মোটেও যৌক্তিক নয়। কেননা নারায়ণের মধ্যেও আত্মরূপে শিবই অবস্থিত। আর যদি বাহ্যিক ভাবে শ্রীহরি বিষ্ণুকে বিচার করতে যান তাহলে শ্রুতিতে এমনও বলা আছে যে, শ্রীহরি বিষ্ণু পরমেশ্বর শিবের বন্দনা করেন- “শাশ্বতং সদাশিবং ব্রহ্মাদিবন্দিতং” [বৃহজ্জাবাল উপনিষদ/৮/৬] ব্রহ্মাদিদেবতা অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র সেই শাশ্বত সদাশিবের বন্দনা করেন। তাই বাহ্যিক ভাবে মানতে গেলে শ্রীহরি বিষ্ণু পরমেশ্বর শিবের ভক্ত প্রমাণিত হয় শ্রুতি অনুযায়ী।
শংকা— এবার হয়তো বৈষ্ণবরা এখানে এটাই দাবী করবে যে, নারায়ণ আর বিষ্ণুর মধ্যেও পার্থক্য আছে। তাই নারায়ণ আর বিষ্ণুকে এক মেনে নিলে হবে না। তাই এখানে বিষ্ণু শব্দপ্রমাণ দেখিয়ে তার দ্বারা নারায়ণকে খণ্ডন করা যাবে না। কারণ ব্যবহারিক আর পারমার্থিক দিকে বিষ্ণু আর নারায়ণের মধ্যে পার্থক্য আছে। তাই এখানে শৈবপক্ষের দাবী মান্য নয়।
সমাধান— বৈষ্ণবদের কাজই হলো অর্থের অনর্থ করা, তা আজকে নতুন নয়। যেখানে এই বৈষ্ণবেরা অনুমান করে যে তাদের অপযুক্তিতে পূর্ণ হাড়ি ভেঙ্গে যাবে, সেখানে তারা আর্যসমাজীর মতো বিভিন্ন অপযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের পিঠ বাঁচাতে মরিয়া হয় , এটা আজকে নতুন বিষয় না।
স সম্যগ্জ্ঞানং চ লব্ধ্বা বিষ্ণুসাযুজ্যমবাপ্নোতি।।”
[বাসুদেব উপনিষদ]
তাই মীমাংসা এই যে উক্ত নারায়ণ এবং বিষ্ণু অর্থে এক পরমেশ্বর শিবকেই প্রতিপাদিত করে।
যেহেতু পরমেশ্বর শিব নারায়ণ রূপে বিদ্যমান তাই জীবগণ সেই নারায়ণরূপী শিবেরই শরণাপন্ন হন। তাই শ্রুতিতে এমনটা বলা হয়েছে, জীবের অন্তঃস্থিত আত্মা হলো নারায়ণ। পরমেশ্বর শিবই সকলকে চেনতা প্রদানকারী পরাচৈতন্য স্বরূপ সর্বোচ্চ সত্ত্বা। এবং পরমেশ্বর শিবই সকল জীবের অন্তঃস্থিত আত্মা।
"চৈতন্যমাত্মা"
[শিবসূত্র/১ম উন্মেষ/শাম্ভবোপায়/১]
চৈতন্য মাত্র যিনি চেতনা প্রদান করেন। চেনতার ভাবই চৈতন্য আর তাই হলো আত্মার স্বরূপ। শরীর, প্রাণ, মন ইন্দ্রিয় সমুদায় অথবা পৃথক পৃথক এই সব ভাব আত্মা হতে পারে না, অপিতু যেখানে এই সবকিছুর প্রতিভাস হয়, অর্থাৎ যেখানে এইসব ভাসিত হয়, তাই হলো আত্মা। যে সবকিছুকে প্রকাশিত করে তথা এই সবকিছুর ঊর্ধ্বে চৈতন্যস্বরূপ।
যিনি সকলকে চেনতা প্রদান করে সবার হৃদপুণ্ডরীকে আত্মারূপে অবস্থান করেন তিনিই শিব। তাই শ্রুতিতে বলা হয়েছে— “ওঁ আত্মায় নমঃ। আত্মলিঙ্গায় নমঃ” [তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/১৬] এবং আরও বলা হয়েছে যে— “वोचेम शंतम हृदे” [তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/২৫] অর্থাৎ পরমেশ্বর শিবই সকলের হৃদয়ে নিবাস করেন। তাই উক্ত সকল শ্রুতি প্রমাণ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, যিনি সকল জীবের মধ্যে আত্মরূপে অবস্থান করেন তিনিই হলো পরমেশ্বর শিব। একি কথা বলা আছে শুক্ল-যজুর্বেদে- “নমো হৃদয়্যায় চ” [শুক্ল-যজুর্বেদ/অধ্যায় ১৬/৪৪] অর্থাৎ, আত্মারূপে জীবের হৃদয়ে বাস করা রুদ্রকে নমস্কার। এই প্রসঙ্গে শ্রুতিতে বলছে—
আত্মসংজ্ঞঃ শিবঃ শুদ্ধ এক এবাদ্বযঃ সদা।
ব্রহ্মরূপতযা ব্রহ্ম কেবলং প্রতিভাসতে।। ১।।
[অথর্ববেদ/আত্ম উপনিষদ/১]
আত্মা বলতেই স্বয়ং শিবই , যিনি শুদ্ধ , সদা এক ও অদ্বিতীয় । যিনি সদা নিজেই ব্রহ্মস্বরূপ ও ব্রহ্মরূপেই সর্বত্র প্রতিভাসিত হন বা প্রকট বা বিরাজিত হন ।
দেখুন প্রথমেই বলেছি ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। আর সেই অদ্বিতীয় ঈশ্বর হলো পরমেশ্বর শিব। কেননা এখানে নারায়ণ বলতে শিবই প্রতিপাদিত হয়। আর যদি এমনটা না হয়, অর্থাৎ নারায়ণ স্বতন্ত্র পরমেশ্বর হয় তবে তা শ্রুতি বিরুদ্ধ হয়ে যাবে। কেননা শ্রুতিতে অদ্বিতীয় পরমেশ্বর হলো সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিবই। আর যিনি সর্বজীবের মধ্যে আত্মরূপে অবস্থিত তিনিও পরমেশ্বর শিব। দেখুন কিছু মীমাংসা বোঝার আছে, কেননা এখানে নারায়ণকে জীবের আত্মা বলা হয়েছে, এবং জ্ঞেয় বস্তুও বলা হয়েছে। কিন্তু, এখানে একটা প্রশ্ন হলো- তাহলে শ্রুতিতে বিষ্ণু আদি দেবতাকে ত্যাগ করে একমাত্র শিবের শরণ নিতে কেন বলা হয়েছে? তাহলে এখানে কি শ্রুতির একটা পরস্পর বিরোধ হয় না? দেখুন তবে শ্রুতিতে কি বলা আছে —
তস্মাৎসর্বাপরিত্যজ্য ধ্যেযান্বিষ্ণবাদিকান্সুরান্॥”
[অথর্ববেদ/শরভ উপনিষদ/৩০ নং মন্ত্র]
শিবই একমাত্র নিত্য, অন্য সকল কিছুই মিথ্যা। এই কারণে বিষ্ণু আদি সকল দেবতাকে পরিত্যাগ করে শিবকেই ধ্যেয় বলে জানা উচিত॥৩০
তাহলে শ্রুতিতে এমন কেন বলা হলো যে বিষ্ণুকে ত্যাগ করতে? তার মানে বিষ্ণু কি অনিত্য? তাহলে এখানে মীমাংসা কি?
শংকা নিবারণ — দেখুন শ্রুতিতে বলা হয়েছে, সেই এক পরশিবই বিভিন্ন স্বরূপে ভাসিত হয়। চন্দ্রের প্রতিবিম্ব যেমন বিভিন্ন জলাশয়ে অনেক গুলি সংখ্যায় দেখায় কিন্তু, চন্দ্র প্রকৃতপক্ষে একটিই। সেভাবেই এক পরশিবই বিভিন্ন সত্ত্বাতে ভাসিত হতে থাকে কিন্তু, ব্রহ্ম সেই এক পরশিবই। দেখুন শ্রুতিতে বলছে—
এক এব হি ভূতাত্মা ভূতে ভূতে ব্যবস্থিতঃ।
একধা বহুধা চৈব দৃশ্যতে জলচন্দ্রবত।।১২
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/অমৃতবিন্দু উপনিষদ/১২]
এক আত্মাই সর্বভূতে (সকল পদার্থ রূপে) বিরাজ করে। চন্দ্রের প্রতিবিম্ব যেমন বহু জলাশয়ে দেখা যায় কিন্তু চন্দ্র একটিই হয় তেমন এক অখণ্ড আত্মাই বহুরূপে দর্শিত হয়।। ১২
তাই এবার এখানে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, উক্ত সুবল উপনিষদে বলা অদ্বিতীয় নারায়ণ টা শিব অর্থেই ব্যবহৃত। কেননা শ্রুতিই তো বলছে শিব ছাড়া দ্বিতীয় কোনো সত্ত্বা নেই। তাই যদি দ্বিতীয় কোনো সত্ত্বাই না থাকে তবে নারায়ণকে স্বতন্ত্র পরমেশ্বর মানলে তা শ্রুতি বিরুদ্ধ হবে। কেননা— “এক হি রুদ্র ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য” [শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৩/২] অর্থাৎ, শিবই অদ্বিতীয় পরমেশ্বর, দ্বিতীয় কোনো সত্ত্বা নেই। তাই এক্ষেত্রে উক্ত নারায়ণ পদটা শিববাচ্য মানাটাই শ্রুতি সম্মত হবে। কেননা শ্রুতিতে বহু প্রমাণ দৃশ্যমান যেখানে বলা হচ্ছে পরমেশ্বর শিবই বিষ্ণুরূপে ভাসিত হচ্ছে—
“যো বৈ রুদ্রঃ স ভগবান যশ্চ বিষ্ণু তস্মৈ বৈ নমো নমঃ”।।
[অথর্বশির উপনিষদ/২ নং অনুবাক/ ২ নং মন্ত্র]
যিনি বিষ্ণুরূপ ধারণ করে অনন্ত জগতকে পালন করছেন সেই পরমেশ্বর রুদ্রকে পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি।।
“রুদ্রো বিষ্ণুরুমা লক্ষ্মীস্তস্মৈ তস্মৈ নমো নমঃ” ॥ ১৮ ॥
[রুদ্রহৃদয় উপনিষদ]
বিষ্ণুরূপ ধারণকারী রুদ্রকে প্রণাম, লক্ষ্মীরূপ ধারণকারী পরা-উমাকে প্রণাম।।১৮।।
পরমেশ্বর শিবই বিষ্ণুকে বামদেব মুখ থেকে প্রকট করেন। অর্থাৎ শিবের বাম ভাগ থেকেই বিষ্ণুর উৎপত্তি৷ বা এটাও বলা যায় পরমেশ্বর শিবই বিষ্ণুরূপ ধারণ করে পঞ্চকৃত্যের, দ্বিতীয় কৃত্য স্থিতিচক্রকে পরিচালিত করে। তাই শিবকে বিষ্ণুর রূপধারী বলা হয় “নমো গিরিশয়ায় চ শিপিবিষ্টায়” [শুক্ল-যজুর্বেদ/অধ্যায় ১৬/২৯]।।
তাই উপরোক্ত সুবল শ্রুতিতে বলা জীবের অন্তরে বাস করা নারায়ণটা মূলত পরমেশ্বর শিবই বটে। কেননা নারায়ণ দ্বারা পরমেশ্বর শিবকেই বোঝানো হচ্ছে। এছাড়াও জগতের সব নাম পরমেশ্বর শিবেরই-
“সর্বাণি হ বা অস্য নামধেয়ানি”।।
[আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র/৪/৯/২৭]
অনুবাদ — সকলই এই রুদ্রেরই নাম।।
বিবৃতি — জগতের যত নাম তা বস্তুত রুদ্রেরই নাম, রুদ্র সর্বব্যাপী।
তাই এখানে মীমাংসা এটাই দাঁড়ায় যে সকল জীবের মধ্যে আত্মারূপে বিরাজমান বস্তু হলো পরমেশ্বর শিব।
——————————————————————————————————————————
অহমাত্মা হি লোকানাং বিশ্বেষাং পাণ্ডুনন্দন।
তস্মাদাত্মানমেবাগ্রে রুদ্রং সংপূজয়াম্যহম্।।
(মহাভারত/শান্তিপর্ব/২৩৭/২২)
অর্থ:- পাণ্ডুনন্দন! আমিই সমস্ত কিছুর আত্মা। অতএব আমি প্রথমে আমার আত্মস্বরূপ রুদ্রের পূজা করে থাকি।
--ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে বলছেন তিনিই সমস্ত কিছুর আত্মা। উপরে মহাভারতের রেফারেন্স দিয়ে বলা আছে তিনি রুদ্র বা শিবেরও আত্মা। তাই এখানে আত্মস্বরূপ শিবের পূজা বলতে বুঝানো হচ্ছে, শিবের অন্তঃস্থিত পরমাত্মারূপী শ্রীকৃষ্ণ বা নারায়ণের পূজা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ করছেন। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং নিজেরই পূজা করছেন।
ইতি সঞ্চিন্ত্য মনসা পুরাণং রুদ্রমীশ্বরম্।
(মহাভারত/শান্তিপর্ব/২৩৭/২৭)
অর্থ:- ইহা মনে মনে চিন্তা করিয়া, আমি পুত্রলাভের নিমিত্ত নিজেই নিজস্বরূপ সনাতন ও ঈশ্বর শিবের আরাধনা করিয়াছিলাম।
-- এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন তিনি মূলত পুত্র লাভের জন্য, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং যার আত্মাস্বরূপ সেই শিবকে পূজা করেন। শ্রীকৃষ্ণ শিবের মধ্য দিয়ে মূলত শিবের আত্মা স্বরূপ স্বয়ং নিজেরই পূজা করেন। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, শ্রীকৃষ্ণ কেন পরমেশ্বর হয়েও সামান্য পুত্র লাভের আশায় শিবের পূজা করেন?
উত্তর: গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে ভগবান বলেছেন ত্রিভুবনে তাঁর কোন কর্মও না প্রাপ্যও নাই তবুও তিনি লোকশিক্ষার জন্য কর্ম করেন,
ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন৷
নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি৷৷
(গীতা-৩/২২)
অর্থ: হে পার্থ, এই ত্রিজগতে আমার কিছুই কর্তব্য নেই। আমার অপ্রাপ্ত কিছু নেই এবং প্রাপ্তব্যও কিছু নেই তবুও আমি কর্মে ব্যাপৃত আছি।
তিনি লোকশিক্ষা হিসেবে সকলকে দেখিয়ে গেছেন কেও সুপুত্র লাভের জন্য এভাবে শিবের মাধ্যমে শিবাত্মক বিষ্ণুর পূজা করতে পারে।
ভগবানের সকল লীলা দিব্য,
জন্মকর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ৷
ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোর্জুন৷৷
(গীতা-৪/৯)
অর্থ: হে অর্জুন, যিনি আমার এই প্রকার দিব্য জন্ম এবং কর্ম যথাযথ ভাবে জানেন তাকে আর দেহত্যাগ করার পর পুনরায় জন্ম গ্রহণ করতে হয় না তিনি আমার নিত্যধাম লাভ করেন।
ন হি বিষ্ণুঃ প্রণমতি কস্মৈচিদ্বিবুধায় চ।
ঋত আত্মানমেবেতি ততো রুদ্রং ভজাম্যহম্।।(মহাভারত/শান্তিপর্ব/২৩৭/২৮)
অর্থ:- বিষ্ণু আত্মভিন্ন অন্য কোনো দেবতাকেই প্রণাম করতে পারেন না, ইহা বিবেচনা করিয়াই আমি শিবের পূজা করিয়া থাকি।
-- অর্থাৎ যে রুদ্রের পরমাত্মা স্বরূপে বিষ্ণু অবস্থিত, শ্রীকৃষ্ণ, যিনি স্বয়ং বিষ্ণু, সেই বিষ্ণুকেই মূলত প্রণাম করেন রুদ্রের পূজার মাধ্যমে।
সব্রহ্মকাঃ সরুদ্রাশ্চ সেন্দ্রা দেবাঃ সহর্ষিভিঃ।
অর্চ্চয়ন্তি সুরশ্রেষ্ঠং দেবং নারায়ণং হরিম্।।
(মহাভারত/শান্তিপর্ব/২৩৭/২৯)
অর্থ:- ব্রহ্মা, শিব, ইন্দ্র ও ঋষিগণের সহিত সমস্ত দেবতা দেবশ্রেষ্ঠ হরি নারায়ণের পূজা করিয়া থাকেন।
-- এই ২৮ ও ২৯ নং শ্লোক থেকে এটাই স্পষ্ট বুঝা যায় যে শ্রীহরি নারায়ণ শিবাদি সকল দেবতারই পূজণীয়। আর তিনি নিজ ভিন্ন অন্য করো পূজা করেন না। এজন্যই তিনি শিবের মধ্য দিয়ে শিবের আত্মা স্বরূপ পরমাত্মা বিষ্ণুরই পূজা করেন।
পদ্মপুরাণে উত্তর খণ্ডের ৭১ অধ্যায়ের ১০৫-১০৬ নং শ্লোকে বর্ণিত আছে, নারায়ণই শিবকে বর প্রদান করেন যে, কৃষ্ণ রূপে তিনি শিবের পূজা করবেন এবং তার থেকে বর গ্রহনরূপ লীলা করবেন।
সুতরাং শ্রীকৃষ্ণের শিব পূজা মূলত শিবরূপী দেবতার পরমাত্মা রূপে স্থিত শ্রীকৃষ্ণেরই পূজা। উপমন্যুর কাছে শিব মন্ত্রে দীক্ষা ও শিব পূজা মূলত লোকশিক্ষার জন্য। কেও যদি সুপুত্র লাভ করতে চায় তাহলে সে শ্রীকৃষ্ণের মত করে শিবাত্মক নারায়ণের পূজা করতে পারে। শ্রীকৃষ্ণ শৈব ছিলেন সারাজীবন ধরে শিবের পূজা করে গেছেন, মোটেই এমন বিষয় না। উপমন্যুর কাছে দীক্ষার পূর্বেও তার একাধিক গুরুর কথা পাওয়া যায় বিভিন্ন শাস্ত্রে। লোকশিক্ষার্থে শ্রীকৃষ্ণ পুত্রলাভের জন্য উপমন্যুর কাছে দীক্ষা নিয়ে শিব পূজার শিক্ষা দিয়ে গেছেন। উপমন্যুর দীক্ষা গ্রহনের পূর্বেও তার গুরু ছিল এবং পুত্র সন্তানও ছিল, এমনও না যে তিনি শিব পূজা ব্যাতীত পুত্র সন্তান জন্মদানে অক্ষম ছিলেন। তিনি এই পুত্র লাভ লীলার অংশ টুকুতেই কঠোর আরাধনা করেন লোকশিক্ষা হেতু। আর শ্রীকৃষ্ণ মূলত শিবের অন্তঃস্থিত পরমাত্মারূপী শ্রীকৃষ্ণের অর্থাৎ নিজেরই পূজা করেছিলেন অন্য কারো নয়।
✅শৈব পক্ষ থেকে বৈষ্ণবদের দাবীর খণ্ডন—
এসব অবান্তর দাবীতে বৈষ্ণবদের খণ্ডন করবো নাকি হেসে উড়িয়ে দেবো তাই ভাবছি। কেননা বৈষ্ণবদের ধূর্ততা ভণ্ডাসুরের চেয়েও ১০ কদম বেশি। আর চাটুকার চাকলাবাজি এবং অর্থের অর্ধসত্য ও অনর্থ করার দিকে এরা আর্যসমাজীদের চেয়েও বহু উপরে উঠে গেছে। এসব বলার পিছনে বিশাল একটা কারণ আছে। আর কারণটা হলো— বৈষ্ণবরা যে শ্লোক গুলোকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করলো, সেই শ্লোক গুলোর সাথে উক্ত তথ্যসূত্রের কোনো মিল নেই। এখানে উল্লেখ্য মহাভারতের শান্তিপর্বের ২৩৭ নং অধ্যায়ের এমন কোনো শ্লোক পাওয়া যায় না। উক্ত শ্লোক গুলো রয়েছে শান্তিপর্বের ৩২৭ নং অধ্যায়ে। এবং ওখানে পরিস্কার ভাবে বলা আছে যে, নারায়ণ এবং রুদ্র হলো একই তত্ত্ব্ব তাদের মধ্যে বিন্দু পরিমাণও ভেদ নেই। রুদ্রের পূজা করলে নারায়ণের পূজা হয় আর নারায়ণের পূজা করলে রুদ্রেরই পূজা হয়। এবং এই কথাটা রুদ্রহৃদয় উপনিষদেও দৃশ্যমান। শ্রীকৃষ্ণ এখানে বলেছে নিজের আত্ম ভিন্ন অন্য কারো পূজো করতে পারেনা বলেই শ্রীকৃষ্ণ নিজের আত্মস্বরূপ রুদ্রের পূজা করে। এবং রুদ্র থেকেই পুত্র প্রাপ্তির বর প্রাপ্ত করেছিলো। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ সাক্ষাৎ বিষ্ণুতত্ত্ব তাই শ্রীকৃষ্ণ আর রুদ্রের মধ্যেও কোনো ভেদ নেই দুজনেই পারমার্থিকভাবে এক সত্ত্বা। তাই শ্রীকৃষ্ণ রুদ্রের পূজা করেন। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হলো উক্ত অধ্যায়ে যে প্রসঙ্গ টা বলা হয়েছে তা অন্য একটা কল্পের ঘটনা। কেননা সেখানে বলা হয়েছে যে, সেসময়ে নারায়ণ থেকে বাকী দুই দেব প্রকট হয়। এবং সেই কল্পে নারায়ণই ত্রিদেবের মধ্যে প্রধান হিসেবে লীলাবশত প্রদর্শিত হন। কিন্তু এটা শুধু মাত্র একটি কল্পের জন্য। কারণ কল্পভেদে ত্রিদেব পরস্পর থেকে উৎপন্ন হয়। যাইহোক! এখানে বিষয়টা বুঝতে হবে রুদ্র আর শ্রীকৃষ্ণের মাঝে কোনো ভেদ নেই ঠিক কিন্তু, সদাশিব এদের ঊর্ধ্বে। সদাশিবই ত্রিদেব এর জনক, এবং সদাশিব নিজেই বলেছে রুদ্র আর বিষ্ণুর মাঝে কোনো ভেদ থাকবে না। এবং বিষ্ণু রুদ্রের আরাধ্য হবে ও রুদ্র বিষ্ণুর আরাধ্য হবে। কেননা দুজনেই এক শিবতত্ত্ব। তাইতো শ্রীকৃষ্ণ নিজের আত্মস্বরূপ রুদ্রের পূজা করেন। যাইহোক এবার আসা যাক মূল প্রসঙ্গে—
বৈষ্ণবদের প্রথম দাবী হলো শান্তিপর্বের ২৭৩ নং অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর হয়েও শিবের পূজা করার বিষয়ে উল্লেখ করছেন। আসলে উল্লেখিত ২৭৩ নং অধ্যায়ে নারায়ণের পরমত্ব নিয়েই বলা আছে এখন ওখানে এটাও বলা আছে যে শ্রীকৃষ্ণ হলো নারায়ণের অষ্টমাংশ লীলাবতার। এবং ওখানেও মহারথি ভীষ্ম এটাও বলেছে যে নারায়ণ আর শিব একই তত্ত্ব। এরা দুজনই হলো জগতের মূল। চলুন তবে দেখে নেওয়া যাক উক্ত শ্লোক—
ভীষ্ম উবাচ—
মূলস্থায়ী মহাদেবো ভগবান্ স্বেন তেজসা।
তৎস্থঃ সৃজতি তান্ ভাবান্ নানারূপান্ মহামনাঃ॥
[মহাভারত/শান্তিপর্ব/অধ্যায় ২৭৩/৬০]
ভীষ্ম বলিলেন— ইনিই সেই মূল কারণরূপে অবস্থিত ভগবান্ নারায়ণ; এই মহাদেব ও মহামনা নারায়ণ মূলকারণরূপে থাকিয়া আপন প্রভাবে নানাপ্রকার সেই সকল পদার্থ সৃষ্টি করেন ॥৬০।।
অর্থাৎ বৈষ্ণবদের যে দাবী ছিলো যে, শিবের মধ্যে আত্মারূপে শ্রীকৃষ্ণই অবস্থান করছেন, সেই দাবীটা একপাক্ষিক হওয়ার কারণে অযৌক্তিক হিসেবেই মান্য করা হচ্ছে। কেননা এখানেও নারায়ণ এবং শিবকে এক দেখানো হয়েছে, অর্থাৎ দুজনেই একই তত্ত্ব। এবার দেখে নেওয়া যাক পরবর্তী শ্লোকে কি বলা আছে তা—
তুরীয়ার্দ্ধেন তস্যেমং বিদ্ধি কেশবমচ্যুতম্।
তুরীয়ার্দ্ধেন লোকাং স্ত্রীন্ ভাবয়ত্যেব বুদ্ধিমান্॥
[মহাভারত/শান্তিপর্ব্ব/অধ্যায় ২৭৩/৬১]
অর্থ — যুধিষ্ঠির! তুমি ইহা অবগত হও যে, সেই ভগবান্ নায়ায়ণের অষ্টমাংশ স্বরূপই ' এই কৃষ্ণ; এই বুদ্ধিমান কৃষ্ণ সেই অষ্টমাংশ দ্বারাই ত্রিভুবন সৃষ্টি করেন ॥৬১।।
অর্থাৎ এর থেকে বিষয়টা পরিস্কার হয়ে গেলো যে, শ্রীকৃষ্ণ স্বতন্ত্র পরমেশ্বর নয়। শ্রীকৃষ্ণ হলো নারায়ণের একটা লীলামূর্তি মাত্র৷ তাই এখানে গুটিকয়েক শ্লোকের জের ধরে শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর দাবী করাটা মোটেও যৌক্তিক নয়। এবং এর থেকে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ নিজের বাহ্যিকদিক নিয়ে নয় মূলত অভ্যন্তরীণ সত্ত্বা নিয়েই সব বলেছেন। আর শ্রীকৃষ্ণের অভ্যন্তরীণ সত্ত্বা যে পরমেশ্বর শিব তা পরবর্তীতে প্রমাণ হয়ে যাবে।
এবার আসা যাক পরবর্তী প্রসঙ্গে—
বৈষ্ণবরা শান্তিপর্বের ৩২৭ তম অধ্যায়ের ২২ আর ২৭ নং শ্লোক দেখিয়ে এটাই প্রমাণ করতে চাইছে যে, শ্রীকৃষ্ণই হলো সকলের অন্তঃস্থিত আত্মা। তাই শ্রীকৃষ্ণ নিজের আত্মস্বরূপ রুদ্রের পূজা করেন। এই বৈষ্ণবদের মহাধূর্ত বলার আরেকটা কারণ হলো- উক্ত অধ্যায়ে যে প্রসঙ্গে বলা আছে তা সম্পূর্ণ বিচার না করেই কেবল কয়েকটি শ্লোককে হাইলাইট করে শ্রীকৃষ্ণের পরমত্বকে জোড়পূর্বক স্থাপন করে ও রুদ্রকে শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত বানিয়ে অপপ্রচার করার জন্যই এদের মহাধূর্ত উপাধি দেওয়া হয়েছে। এর আগে পরের শ্লোককে না দেখিয়ে, সেই প্রসঙ্গে কিছুই না বলে কেবল যেটুকু দেখালে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ হবে ঠিক ততটুকু গুটিকয়েক শ্লোকের মাধ্যমে সম্পূর্ণ প্রসঙ্গকে বিচার করাটা ধূর্ততাই বটে। উক্ত অধ্যায়ে যেখানে রুদ্র ও নারায়ণের অভেদ অবস্থা দেখানো হয়েছে তা তো এই ধূর্ত বৈষ্ণবরা সবার সামনে উপস্থাপন করেনি৷ কারণ তা যদি উপস্থাপন করে তবে, বৈষ্ণবদের মিথ্যাচারের পর্দা ফাঁস হয়ে যাবে যে। তাই তো এই পাখণ্ডী বৈষ্ণবরা সবসময় সত্যকে লুকোতে মরিয়া।
যাইহোক! মূল বিষয়ে আসা যাক। উক্ত অধ্যায়ের ২২ নং শ্লোকের আগে পরে কি বলা আছে তা একবার দেখে নেবো—
তস্মিন্ হি পূজ্যমানে বৈ মহাদেবে মহেশ্বরে।
সংপূজিতো ভবেৎ পার্থ! দেবো নারায়ণঃ প্রভুঃ॥
পাণ্ডুনন্দন! প্রত্যেক যুগেই রুদ্রকে নারায়ণস্বরূপ জানিবে। অতএব পৃথানন্দন! সেই দেবদেব মহেশ্বরের পূজা করিলে প্রভু নারায়ণের পূজা করা হয়।।
এবার দেখে নেওয়া যাক পরবর্তী শ্লোকে কি বলছে—
যস্তং বেতি স মাং বেত্তি যোহনু তং সহি মামনু।
রুদ্রো নারায়ণশ্চৈব সত্ত্বমেকং দ্বিধাকৃতম্ ॥২৫॥
যে লোক রুদ্রকে জানে, সে লোক আমাকেও জানে এবং যে লোক রুদ্রকে লক্ষ্য করিয়া থাকে, সে লোক আমাকেই লক্ষ্য করিয়া থাকে; সুতরাং রুদ্র ও নারায়ণ একই ব্যক্তি, কিন্তু কার্য্যবশতঃ দুই আকারে বিভক্ত করা হইয়াছে।।২৫।।
অর্থাৎ এখানে এই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে রুদ্রদেব আর নারায়ণের মধ্যে কোনো ভেদ নেই। তারা একই তত্ত্ব কিন্তু, জগতের কার্য প্রতিপাদিত করার জন্য বাহ্যিক ভাবে আলাদা হন মাত্র। এবং এখান থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে রুদ্র নারায়ণের আরাধ্য এবং নারায়ণ রুদ্রের আরাধ্য। তাই এখানে বলা হচ্ছে যে শ্রীকৃষ্ণ নিজের আত্মস্বরূপ রুদ্রের পূজা করেন। এই যে রুদ্রদেব ও নারায়ণের অভেদ অবস্থা তার সমর্থন পাওয়া যায় শিবমহাপুরাণেও। চলুন তবে দেখে নেওয়া যাক—
रुद्रध्येयो भवांश्चैव भवद्ध्येयो हरस्तथा।
युवयोरन्तरं नैव तव रुद्रस्य किञ्चन ॥ ६
वस्तुतश्चापि चैकत्वं वरतोऽपि तथैव च।
लीलयापि महाविष्णो सत्यं सत्यं न संशयः ॥ ७
বিষ্ণু রুদ্রের আরাধ্য হবে আর রুদ্র বিষ্ণুর আরাধ্য হবে। বিষ্ণু আর রুদ্রের মধ্যে কোনো ভেদ নেই।।
দেখুন শিবমহাপুরাণে পরমেশ্বর সদাশিব শ্রীহরি বিষ্ণুকে বলছেন যে, রুদ্রদেব ও বিষ্ণু পরস্পরের আরাধ্য হবে এবং এদের মধ্যে কোনো ভেদ থাকবে না। তাই তো শ্রীকৃষ্ণ রুদ্রদেব থেকেই বর প্রার্থনা করেছেন। কেননা রুদ্র হলো শ্রীহরি বিষ্ণুর আরাধ্য। তাই শান্তিপর্বের পরবর্তী শ্লোকে বলছে যে—
লোকে চরতি কৌন্তেয়! ব্যক্তিস্থং সর্ব্বকৰ্ম্মনু।
নহি মে কেনচিদ্দেয়ো বরঃ পাণ্ডবনন্দন! ॥২৬
পাণ্ডুনন্দন! নারায়ণ ও রুদ্র এক হইয়াও ভিন্ন ভিন্ন রূপে থাকিয়া, জগতে সমস্ত কার্য্যে বিচরণ করেন। অন্য কোন দেবতাই আমাকে বর দিতে পারেন না ॥২৬॥
ইতি সঞ্চিন্ত্য মনসা পুরাণং রুদ্রমীশ্বরম্। পুত্রার্থমারাধিতবানহুমাত্মানমাত্মনা ॥২৭॥
ইহা মনে মনে চিন্তা করিয়া, আমি পুত্রলাভের নিমিত্ত নিজেই নিজস্বরূপ সনাতন ও ঈশ্বর রুদ্রের আরাধনা করিয়াছিলাম ॥২৭॥
ন হি বিষ্ণুঃ প্রণমতি কস্মৈচিদ্বিবুধায় চ।
ঋত আত্মানমেবেতি ততো রুদ্রং ভজাম্যহম্।।
বিষ্ণু আত্মভিন্ন অন্য কোন দেবতাকেই প্রণাম করিতে পারেন না, ইহা বিবেচনা করিয়াই আমি রুদ্রের পূজা করিয়া থাকি॥২৮॥
দেখুন এখানে যারা ত্রিদেব এর তত্ত্ব সম্পর্কে অবগত নন, কেবল তারাই এসব ভুলভাল প্রচার করে। অধিকাংশ পুরাণশাস্ত্র, মহাভারত, উপনিষদ, বেদ অধ্যয়ন করলে জানা যায় যে এক সদাশিব থেকে ত্রিদেব এর উৎপত্তি হয়। কিন্তু, কল্পানুসারে কখনো কখনো ত্রিদেব পরস্পর থেকেই প্রকট হোন। কখনো নারায়ণ থেকে বাকী দুই দেবতা প্রকট হন , আবার কখনো ব্রহ্মা থেকে বাকী দুইদেব প্রকট হোন বা কখনো রুদ্রদেব থেকে বাকী দুইদেব প্রকট হোন। কিন্তু, সবাই মূলত এক শিব তত্ত্বই। তাই ত্রিদেব পরস্পরের আরাধ্য হোন। এবং ত্রিদেব পরস্পর থেকে বরও যাচনা করে থাকেন। তাই এখানেও বিষয়টা পরিস্কার যে, নারায়ণ আর রুদ্র যেহেতু এক তত্ত্ব এবং পরস্পরের আরাধ্য তাই, শ্রীকৃষ্ণ নিজের আত্মস্বরূপ রুদ্রের পূজা করেন। কেননা আত্মস্বরূপ তত্ত্বটাই হলো শিব তত্ত্ব৷ দেখুন মহাভারতে বলা হয়েছে যে—
যোহসৃজদ্দক্ষিণাদঙ্গাদ ব্রাহ্মণং লোকসম্ভবম্।
বামপার্শ্বাত্তথা বিষ্ণুং লোকরক্ষার্থমীশ্বরঃ ॥৩৪৫৷৷
যুগান্তে চৈব সম্প্রাপ্তে রুদ্রমীশোহসৃজৎ প্রভুঃ।
অর্থ — যে ঈশ্বর (মহাদেব) দক্ষিণপার্শ্ব হতে জগতের সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করেছেন এবং লোকরক্ষার জন্য বামপার্শ্ব হতে বিষ্ণুকে উৎপাদন করেছেন ॥৩৪৫৷৷
এবং আরও বলা আছে—
নমস্ত্রিরূপধরায় সর্ব্বরূপধরায় চ ॥৩১১।।
অর্থ— আপনি ত্রিদেব - ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্রের রূপ ধারণ করেন এবং সকলের রূপই ধারণ করিয়া থাকেন আপনাকে নমস্কার ॥৩১১৷।
এই একি প্রমাণ পুরাণেও আছে শ্রুতিতেও আছে এবং তন্ত্রেও আছে। কিন্তু, মূল প্রসঙ্গ যখন মহাভারতের তাই কেবল মহাভারতের প্রমাণটাই উপস্থাপন করলাম। দেখুন এখানে কি বলাছে হয়েছে- সেই এক সদাশিব থেকেই ত্রিদেব এর উৎপত্তি হচ্ছে। কিন্তু মহাভারতের কোথাও এমন বলা নেই যে, নারায়ণ থেকেই ত্রিদেব এর উৎপত্তি হচ্ছে। ওখানে কেবল এটাও বলা আছে যে, শুধু মাত্র বাকী দুইদেব প্রকট হয়েছে। কিন্তু, ত্রিদেব এর জনক একমাত্র সদাশিব। তাই তত্ত্বগত দিক থেকে নারায়ণ আর রুদ্র এক শিব তত্ত্বই। তাই তো পরমেশ্বর সদাশিব বলেছেন যে, রুদ্র ও নারায়ণ অভেদ। এবং এটাই সেই কারণ যার জন্য শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে আমি আমার আত্মস্বরূপ রুদ্রের পূজা করি। কারণ সবার হৃদয়ে সেই এক সদাশিবই আত্মস্বরূপে বিরাজমান। তাই শ্রীকৃষ্ণ নিজের আত্মস্বরূপ রুদ্রের পূজা করেন। এবং একি কথা মহাভারতেও স্পষ্ট ভাবে বলা আছে যে শ্রীকৃষ্ণ হলো শিবতত্ত্ব—
স এস রুদ্রভক্তশ্চ কেশবো রুদ্রসম্ভবঃ।
সর্ব্বরূপং ভবং জ্ঞাতা লিঙ্গে যোহর্চ্চয়ত প্রভুম্।।
যিনি জগদীশ্বর শিবকে সর্বভূতে ব্যাপ্ত জেনে তার লিঙ্গ স্বরুপে তার পুজা করতেন সেই নারায়ণ এই কৃষ্ণ, তিনি শিবাংশজাত ও শিবভক্ত।
অর্থাৎ এর থেকে পরিস্কার হওয়া গেলো শ্রীকৃষ্ণ হলো সাক্ষাৎ শিবতত্ত্ব। তাই তত্ত্বগত ভাবে শ্রীকৃষ্ণ ও রুদ্রের মধ্যে কোনো ভেদ নেই। তাই যেহেতু, শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে আত্মরূপে শিবই বিরাজমান, তাই শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন আমি আমার আত্ম ভিন্ন অন্য কারো পূজা করতে পারি না। এখানে বৈষ্ণবরা এই ভুলটাই করেছে যে প্রত্যেকটা শ্লোকের তাত্ত্বিক বিষয়কে অবজ্ঞা করে কেবল, ঔপাধিক বিষয়কেই ধরে নিয়েছে। এটাই পার্থক্য জ্ঞানমার্গ আর ভক্তিমার্গের মধ্যে। এরা ভক্তিতে এতটাই লীন হয়ে যায় যে, ভক্তিটা যে অন্ধভক্তিতে পরিণত হয়ে গেছে তা আর মাথায় থাকে না। তাই যেমন খুশী তেমন অপপ্রচার করতে থাকে। তার মানে এই নয় যে ভক্তিমার্গ অনুচিত পথ, এমনটা নয়। ভক্তি যাতে অন্ধভক্তিতে পরিবর্তন না হয়, যদি অন্ধ ভক্তি হয় তাহলে সেটিই হবে অনুচিত পথ।
এবার আসা যাক সিদ্ধান্তের দিকে। দেখুন শুরু থেকেই এটাও একের পর এক শাস্ত্র সম্মত ভাবে যৌক্তিক ভাবে প্রমাণ করেছি যে, সকল জীবের মধ্যে যিনি আত্মরূপে অবস্থান করেন তিনি হলো পরমেশ্বর শিব। যেহেতু পরমেশ্বর শিব নিজেকে বিভিন্ন স্বরূপে পরিবর্তন করেন, তাই তত্ত্বগত ভাবে সকল দেবতা এক শিবই বটে৷ তাই শ্রীকৃষ্ণও মূলত শিবতত্ত্ব যা সম্পূর্ণ শাস্ত্র সম্মত। দেখুন শান্তিপর্বের ৩২৭ নং অধ্যায়ে এটাও বলা আছে যে, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছে আমি ধর্মকে রক্ষার জন্য শরীরটা ধারণ করেছি মাত্র। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণকে বাহ্যিকভাবে বিচার করলে হবে মূর্খতা। কেননা শ্রীকৃষ্ণ সম্পূর্ণ মহাভারতে আমি বলতে নিজের আত্মতত্ত্ব পরমেশ্বর শিব নিয়েই বলেছেন।
দেখুন নারায়ণ নিজ হৃদয়ে কেবল পরমেশ্বর শিবেরই উপাসনা করেন এই কথাটা বামণপুরাণ, ভগবদগীতা দ্বারাই স্পষ্ট হয়ে যায়। বামন পুরাণে বলেছে যে—
ततोऽव्ययात्मा स हरिः स्वहृत्पङ्कजशायिनम्।
दर्शयामास देवानां मुरारिर्लिङ्गमैश्वरम्॥
[বামনপুরাণ/অধ্যায় ৬২/২৩]
অব্যয়াত্মা মুরারি নারায়ণ দেবতাদের নিজের হৃদয়কমলে অবস্থিত লিঙ্গরূপী পরমেশ্বর শিবের দর্শন করিয়েছিলেন।
এবং ভগবদগীতাতে বলেছে যে—
"तमेव चाद्यं पुरुषं प्रपद्ये यतः प्रवृत्तिः प्रसृता पुराणी"
[ভগবদগীতা/১৪/৪]
হে অর্জুন! জগতের আদিতে যার কৃপাতে জগতনির্মাণরূপ প্রবৃত্তি হয়েছে, সেই আদিপুরুষের আমি আশ্রয় নিই।
এই প্রকারে শ্রীকৃষ্ণ যার উপাসনা করেন সেই বস্তুর অর্জুনের নিমিত্তে উপদেশ দিয়ে নিজের জন্য উপাস্য কি, সেই উপাস্য বস্তুকে নিজে নিজেই আক্ষেপ করে পরবর্তী বলেছে যে—
"उत्तमः पुरुषस्त्वन्यः परमात्मेत्युदाहृतः ।
यो लोकत्रयमाविश्य बिभर्त्यव्यय ईश्वरः ।।"
[ভগবদগীতা/১৫/১৭]
"ईश्वरः सर्वभूतानां हृद्देशेऽर्जुन तिष्ठति"
[ভগবদগীতা/১৮/৬২]
হে অর্জুন! আমার দ্বারা যার উপাসনা হয় সেই পুরুষই সর্বোত্তম। তাকেই পরমেশ্বর বলে। নাশরহিত যে ঈশ্বর স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল নামক ত্রিলোকের অন্তর্যামীরূপে অবস্থিত থেকে রক্ষা করেন, সেই সর্বনিয়ামক ঈশ্বর হৃদকমলে নিবাস করেন।
এই প্রকারে শ্রীকৃষ্ণ নিরন্তর নিজ হৃদকমলে নিজের দ্বারা উপাসনা করা পুরুষ পরমেশ্বর শিবই, এমন উপদেশই অর্জুনকে দিয়েছেন। এর অতিরিক্ত এখানে কেবল শিবেই রূঢ় ঈশ্বর পদের প্রয়োগ শ্রীকৃষ্ণ করেন সম্পূর্ণ মহাভারত জুড়ে। এই জন্য এই ঈশ্বর শব্দ “ঈশ্বরঃ শর্ব ঈশানঃ” [অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/২১] এই কোষের প্রামাণিক বাক্য দ্বারা শিবেই শক্তিসম্পন্ন হওয়াতে শাস্ত্রে উল্লেখিত হৃদয়ে উপাসনা করা পুরুষ শিব আর উপাসক নারায়ণ এমনটা স্পষ্ট হয়ে যায়। এবং এছাড়াও নারায়ণের যে বাহ্যিক শরীর রয়েছে তা কিন্তু মায়াময় কিন্তু, নারায়ণের আত্মা হলো পরমেশ্বর শিব। তাই পদ্মপুরাণে বলেছে যে—
প্রিয়ঃ শ্রুত্বা বচো যুক্তমিতিহাসপুরঃসরম্।
আত্মানুগামিনীং দৃষ্টিং গীতাং বোধিতবান প্রভুঃ।।২১
অহমাত্মা পরেশানি পরাপরবিভেদতঃ।
দ্বিধা ততঃ পরঃ সাক্ষী নির্গুণো নিষ্কলঃ শিবঃ।।২২
অপরঃ পঞ্চবক্ত্রোহহং দ্বিধা তস্যাপি সংস্থিতিঃ।
শব্দার্থভেদতো বাচ্যো যথাত্মাহং মহেশ্বরঃ।।২৩
অর্থ — প্রভু মুরারি লক্ষ্মীর এই যুক্ত বাক্য শ্রবণ করিয়া আত্মানুগামিনী দৃষ্টিস্বরূপা গীতা ইতিহাসপুরঃসর বুঝাইতে লাগিলেন; বিষ্ণু বলিলেন, হে পরেশানি! আমি আত্মা পর-অপর ভেদে দ্বিবিধ।
অপর — স্থুল-সুক্ষ্মরূপ ভেদে দ্বিবিধ, অহস্পদবাচ্য পঞ্চবক্ত্র এবং অহংপদবাচ্য পরমাখ্যরূপ মহেশ্বর।।২১-২৩।।
মায়াময়মিদং দেবি বপুর্মে ন তু তাত্ত্বিকম্ । সৃষ্টিস্থিত্যুপসংহারক্রিয়াজালোপবৃংহিতম্ ॥১৬
অর্থ — ভগবান কহিলেন— হে দেবি! এই যে বিষ্ণুদেহ দেখিতেছ ইহা তাত্ত্বিক নহে, ইহা মায়াময়; এই দেহ সৃষ্টি স্থিতি ও ধ্বংস ক্রিয়াসমূহে উপবৃংহিত।।১৬
অতোহন্যদাত্মনো রূপং দ্বৈতাদ্বৈতবিবর্জিতম্।
ভাবাভাববিনিম্নক্তমাদ্যন্তরহিতং প্রিয়ে।। ১৭
অর্থ — হে প্রিয়! ইহা ভিন্ন আমার অন্য যে আত্মরূপ, তাহা দ্বৈতাদ্বৈতবর্জিত, ভাবাভাববিরহিত ও আদ্যন্তহীন - এরূপ শুদ্ধ সংবিৎপ্রভাদ্বারাই জ্ঞেয়।।১৭
এখানে এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ নিজের আত্মস্বরূপ বলতে পরমেশ্বর শিবকেই বলেছে। কেননা নারায়ণের শরীরও তো মায়াময় একটা সময়ের পর ধ্বংস প্রাপ্ত হবে, এবং মহাভারতে বেশ কিছু স্থানে দেখা যায় শ্রীকৃষ্ণের শরীরও মায়াময় অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের দেহ ত্যাগের পর সেই শরীরের অন্তিম সংস্কার করেন। তাই শ্রীকৃষ্ণ বা নারায়ণের ক্ষেত্রে এখানে বিষয় গুলো ঔপাধিভাবে বিচার করলে হবে না। কেননা আত্মারূপে পরমেশ্বর শিবই বিরাজমান। এবং একি কথা কঠ উপনিষদেও বলা হয়েছে যে হৃদয়ে নিবাস করা সেই অঙ্গুষ্ঠ মাত্র পুরুষ পরমেশ্বর শিবই বটে—
অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষো মধ্য আত্মনি তিষ্ঠতি।
ঈশানো ভূতভব্যস্য ন ততো বিজুগুপ্সতে॥১২৷৷
অর্থঃ— অঙ্গুষ্ঠপরিমাণ পুরুষ আত্মার মধ্যে অবস্থান করেন, পরমেশ্বর ঈশান অতীত ও ভবিষ্যতের প্রভু। তাঁহাকে জানিবার পর আর গোপন করিতে ইচ্ছা করে না।।
অর্থাৎ পরমেশ্বর শিবই সকলের আত্মস্বরূপ তত্ত্ব। সকলে নিজ হৃদয়কমলে সেই পরমেশ্বর শিবেরই উপাসনা করেন। শ্রীকৃষ্ণও নিজ হৃদয়কমলে সেই পরমেশ্বর শিইবেরই উপাসনা করেন।
শংকা—এবার হয়তো এখানে বৈষ্ণবরা পুনরায় চাটুকারিতা করে ঈশান পদকে পরমেশ্বর বাচক করে দিতে পারেন। অর্থাৎ নির্গুণ পরমেশ্বরের ঐশ্বর্য প্রতিপাদন করার জন্য ঈশান নামে অভিহিত করা হয়। তাই এখানে ঈশান বলতে শিবকে নয় বরং নির্গুণ পরমেশ্বরকে বোঝাচ্ছে।
সমাধান— তাহলে সেই বৈষ্ণবদের বলে রাখি, আমি শুরুতেই শিবের দুইটি অবস্থা সম্পর্কে ধারণা দিয়েই দিয়েছি। যে পরমেশ্বর শিব নিরাকারের অকায়ো নির্গুণ ব্রহ্ম এবং সাকারে কৈলাস নিবাসী, নীলকন্ঠ, ত্রিনেত্রধারী শিব। তাই এখানে কেবল নিরাকারের খেলাটা চলবে না। এছাড়া উক্ত ঈশান পদ টা শিবের মধ্যেই রূঢ় যা কোষ বাক্য দ্বারা প্রমাণিত, তাই ঈশান বলতে পরমেশ্বর শিবের ঐশ্বর্যকেই প্রতিপাদিত করে। এমনকি তৈত্তিরীয় আরণ্যকে ঈশান বলতে কেবল সদাশিবকেই বুঝিয়েছে—
ॐ ঈশানঃ সর্ববিদ্যানাং ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ব্রহ্মাধিপতির্ব্রহ্মণোহধিপতির্ব্রহ্মা শিবো মে অস্তু সদাশিবোম্।।
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরন্যক/১০ম প্রপাঠক]
অর্থঃ— পরম ঈশ্বর হল- ঈশান-শিব সর্বশক্তিমান, সবকিছুর মধ্যেই তিনি(শিব) আছেন, ঈশানই সকল বিদ্যা (৬৪ কলা) ও ভূতের অধীশ্বর (স্থাবরজঙ্গম এর একমাত্র ঈশ্বর)। যিনি বেদের পালন কর্তা, যিনি ব্রহ্মাদিদেবতার (ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্রাদি দেবতার) অধিপতি সেই পরমেশ্বর সদাশিব আমাদের সদা মঙ্গল বিধান করুক।।
এবার সবদিক থেকেই এটা দিনের আলোর মতো পরিস্কার হয়ে গেলো যে, শ্রীকৃষ্ণ নিজের আত্মস্বরূপ বলতে কাকে বুঝিয়েছে। যেহেতু শ্রুতি যখনই এই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে হৃদকমলে যার উপাসনা করা হয় সেই বস্তুটি হলো পরমেশ্বর শিব, তাই পূর্বমীমাংসা মতে-
"বিরোধে ত্বনপেক্ষ্যং স্যাদ্ অসতি হ্যনুমানম্ "
[পূর্বমীমাংসা সূত্র/১.৩.৩]
অর্থ - শ্রুতি আর স্মৃতির বিরোধ বাঁধলে স্মৃতিশাস্ত্র অপেক্ষার যোগ্য নয় অর্থাৎ স্মৃতিকে প্রমাণ হিসেবে ধরা যাবে না, এক্ষেত্রে স্মৃতি শাস্ত্র অপ্রমাণ হিসেবে পরিগণিত হবে। শ্রুতি আর স্মৃতির বিরোধ (অসতি) না হলে তবেই তা (স্মৃতি) অনুমানের যোগ্য অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য।
তাই শ্রুতি যখন এই প্রমাণ দিচ্ছে যে হৃদয়কমলে উপাসনা করা বস্তুটি সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিব। তাই তা স্মৃতি শাস্ত্রের অপব্যবহার দ্বারা খণ্ডন করা ন্যায় সঙ্গত নয় এবং এতে দোষ আরোপিত হয়। তাই মীমাংসা অনুযায়ী সকলের হৃদয়ে সেই পুরুষটা হলো পরমেশ্বর শিব। যার উপাসনা নারায়ণ করেন সর্বদা।
অস্মিন্ত্রহ্মপুরে বেশ্ম দহরং যদিদং মুনে।
পুণ্ডরীকং তু তন্মধ্যে আকাশো দহরোহস্তি তৎ।
স শিবঃ সচ্চিদানন্দঃ সোন্বেষ্টব্যো মুমুক্ষিভিঃ ॥৪০॥
অযং হৃদি স্থিতঃ সাক্ষী সর্বেষামবিশেষতঃ।
তেনাযং হৃদয়ং প্রোক্তঃ শিবঃ সংসারমোচকঃ।॥৪১৷৷
অর্থ- হে মুনে! এই অবিনাশী ব্রহ্মার আবাসস্থল যে দেহে, সেখানে দহর (হৃদয়ে) নামে একটি স্থান রয়েছে, যাকে পুণ্ডরিক (পদ্ম) ও বলা হয়, একই স্থানে দহরাকাশ অবস্থিত। কেবলমাত্র সেই ক্ষেত্রেই, মোক্ষলাভের সন্ধানকারীদের সেই শিবকে অনুসন্ধান করা উচিত যিনি সত্য, চেতনা এবং আনন্দের মূর্ত প্রতীক। এই শিব সর্বদা হৃদয়ের পদ্মে বাস করেন এবং অ-নির্দিষ্ট (সাধারণ) দৃষ্টিকোণ থেকে, তিনি সবকিছুর সাক্ষী। এই কারণে, হৃদয়কে শিবের রূপ বলা হয় এবং এটি (হৃদয়) জগতের মুক্তিদাতা বলা হয়, অর্থাৎ, যিনি জগৎ থেকে মুক্ত করেন। ॥৪০-৪১
একি কথার সমর্থন পাওয়া যায় তৈত্তিরীয় শ্রুতিতে—
দহরং বিপাপং বরবেশভূতং যৎ পুণ্ডরীকং পুরমধ্যসংস্থম্।
তত্রাপি দহে গগনং বিশোকং তস্মিন যদন্তস্তদুপাসিতব্যম্।।
যো বেদাদৌ স্বরঃ প্রোক্তো বেদান্তে বেদানো চ প্রতিষ্ঠিতঃ। তস্য প্রকৃতিলীনস্য যঃ পরঃ স মহেশ্বরঃ।।
অল্প, পাপ রহিত, পরমাত্মার উপলব্ধিস্থানভূত, শরীরের মধ্যে অবস্থিত অষ্টদল পুণ্ডরীক বিদ্যমান। সেই ক্ষুদ্র পুণ্ডরীকে সুক্ষ্ম আকাশবৎ ব্রহ্ম বিরাজিত। যদ্যপি ব্রহ্ম ব্যাপক, তথাপি ঘটাকাশতুল্য পুণ্ডরীকস্থানকে অপেক্ষা করিয়া অল্প বলা হইয়াছে। ব্রহ্ম শোকমুক্ত, আকাশ শব্দবাচ্য, সেই পুণ্ডরীকমধ্যে ব্রহ্মতত্ত্বের উপাসনা করিবে। বেদের আদিতে যে প্রণব রূপ বর্ণ উক্ত হইয়াছে, সেই প্রণব ধ্যানকালে অব্যাকৃত জগৎকারণে লীন হয়। অকার, উকার ও মকারে যথাক্রমে বিরাট, হিরণ্যগর্ভও অব্যাকৃতরূপে ধ্যান করিয়া অকার বিরাটকে উকারে লয় করিয়া পরে হিরণ্যগর্ভরূপ উকারকে মূলঃ প্রকৃতিরূপ মকারে লয় করিবে। সেই প্রকৃতিলীন প্রণবের যে উৎকৃষ্ট ধ্যাতব্য বস্তু, তাহাকেই মহেশ্বররূপে জানিবে।।
শ্রীকৃষ্ণ কেন নিজের আত্মস্বরূপ রুদ্রের পূজা করেন তা এবার সবার কাছেই স্পষ্ট হয়েছে আশা করি। যদিও যাদের বুঝতে এখনো সমস্যা হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্যে খুবই সহজ ভাষাতেই বলি— দেখুন সনাতন একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। আর শ্রুতিতে একমাত্র অদ্বিতীয় ঈশ্বর বলতে পরমেশ্বর শিবকেই বুঝিয়েছে। শিব ছাড়া দ্বিতীয় কোনো সত্ত্বা নেই তাও শ্রুতির বচন। সেই এক অদ্বিতীয় পরমেশ্বর শিব, মায়ার ঊর্ধ্বে, গুণের ঊর্ধ্বে, কালের ঊর্ধ্বে থাকার কারণে, উনি সরাসরি জগতে প্রবেশ করেন না। তাই জগৎ পরিচালনার জন্য পরমেশ্বর শিব নিজের ডানপাশ থেকে ব্রহ্মাকে, বামপাশ থেকে বিষ্ণুকে ও হৃদয় থেকে রুদ্রকে উৎপন্ন করেন। এবং জগৎ পরিচালনার তিনটি কাজ সৃষ্টি, স্থিতি, লয় যথাক্রমে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্রের মধ্যে ভাগ করে দেয়। এই হলো ত্রিদেব এর উৎপত্তির রহস্য। তাই এবার তত্ত্বগত ভাবে কিন্তু ত্রিদেব এক শিবতত্ত্বই বটে, কিন্তু ব্যবহারিক ভাবে একটু ভিন্ন। ত্রিদেব এর ঊর্ধ্বে যদি কেউ থেকে থাকে, তাহলে তিনি হলো সদাশিব। তাই ত্রিদেব হলো সদাশিবের লীলামূর্তি। তারা যা-ই করেন তা সদাশিবের ইচ্ছেতেই করেন। এবং সদাশিব স্বয়ং রুদ্র আর বিষ্ণুকে বলেছে যে, তোমরা একে অপরের আরাধ্য হবে। রুদ্রের হৃদয়ে বিষ্ণু বাস করবে এবং বিষ্ণুর হৃদয়ে রুদ্র বাস করবে। তাই সেহেতু শ্রীকৃষ্ণ নিজের হৃদয়ে অবস্থান কারী রুদ্রের পূজা করেন। কেননা শ্রীকৃষ্ণ তো সাক্ষাৎ বিষ্ণুর লীলামূর্তি। তাই এক্ষেত্রে বিষ্ণু আর শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে কোনো ভেদ নেই। তাই রুদ্র এবং বিষ্ণু একে অপরের আরাধ্য হওয়ার কারণেই বিষ্ণু রুদ্রের আরাধনা করেন। এই সামান্য বিষয়টাকে বৈষ্ণবরা অহেতুক কুযুক্তি লাগিয়ে তিল থেকে তাল বানিয়ে দিলো। ওদের বোঝা দরকার সবকিছু এক শিবই বটে তাই তৈত্তিরীয় শ্রুতিতে “সর্বে বৈ রুদ্রঃ” [তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/২৪/১] বলা হয়েছে।
আরেকটা হাস্যকর দাবী বৈষ্ণবদের তা হলো- শ্রীকৃষ্ণ নাকি সারাজীবন ধরে শিবের পূজো করেননি। আসলেই কি এমনটাই ঠিক? তবে দেখে নেওয়া যাক সঠিক প্রমাণ—
প্রয়তঃ প্রাতরুত্থায় যদধীয়ে বিশাংপতে।
প্রাঞ্জলিঃ শতরুদ্রীয়ং তন্মে নিগদতঃ শৃণু।।
[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩৮/৪]
শ্রীকৃষ্ণ বলছেন! হে যুধিষ্ঠির আমি প্রতিনিয়ত প্রাতঃকালে গাত্রোত্থান করে সংযম ও কৃতাঞ্জলি হয়ে শতরুদ্রীয় পাঠ করে থাকি। সেই প্রবদ্ধ আপনার নিকট বলছি, আপনি শ্রবণ করুন।।
ভালো করে লক্ষ্য করে দেখুন কি বলছেন শ্রীকৃষ্ণ। এখানে বলছেন- “প্রয়তঃ প্রাতরুত্থায়” অর্থাৎ প্রতিদিন প্রাতঃকালে ঘুম থেকে উঠে। অর্থাৎ এটা প্রতিনিয়ত চলছিলো। শ্রীকৃষ্ণের নিত্যকর্ম ছিল এটিই যে, প্রতিদিন ব্রহ্মমূহুর্তে ঘুম থেকে উঠে শতরুদ্রীয় পাঠ দ্বারা পরমেশ্বর শিবের পূজা করা। আর বৈষ্ণবরা বলছে, শ্রীকৃষ্ণ নাকি কেবল নির্দিষ্ট একটা সময়ের জন্যই পরমেশ্বর শিবের পূজা করেছেন৷ এমন কথা তারাই বলে যারা বিশিষ্টাদ্বৈত রামানুজী বা ইসকনি তথা বৈষ্ণব। যারা নিজের আরাধ্যকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে গিয়ে অন্যান্য সকল দেবতাকে অপমান করতেও দ্বিধাবোধ করে না। আর শ্রীকৃষ্ণকে কেন পরমেশ্বর শিব বরদান দিয়েছেন সেই গূঢ় অর্থ বোঝার সামর্থ্য বৈষ্ণবদের নেই।
যৎ ব্রহ্মণঃ পরং জ্যোতিঃ প্রবিষ্টাক্ষরমব্যয়ম্ |
যোন্তরাত্মা পরং ব্রহ্ম স বিজ্ঞেয়োমহেশ্বরঃ ||
এষ দেবো মহাদেবঃ কেবলঃ পরমং শিবঃ | "
[পদ্মপুরাণ/স্বর্গখণ্ড/৬০/৩৪-৩৫]
--- অব্যয়, অক্ষর, পরম জ্যোতি স্বরূপ ব্রহ্মই সকলের অন্তর আত্মা। তিনিই পরম ব্রহ্ম, তাঁকেই মহেশ্বর আখ্যায় আখ্যায়িত করা হয়। তিনিই মহাদেব, তিনিই পরমশিব।
________________________________________________
১. ত্রিদেবের অন্তর্গত বিষ্ণু আর রুদ্র পরস্পর আরাধ্য ও একে অপরের হৃদয়ে নিবাসকারী।
২. ব্যবহারিক ভাবে বিষ্ণু ও রুদ্র আলাদা হলেও তত্ত্বগত ভাবে এক শিব তত্ত্ব।
৩. নারায়ণের বাহ্যিক শরীর অনিত্য কিন্তু আত্মারূপে শিবই বিদ্যমান, তাই সুক্ষ্মশরীর নিত্য।
৪. দেবতা থেকে কীট পর্যন্ত সকলের মধ্যে আত্মরূপে অবস্থানকারী হলো পরমেশ্বর শিব।
৫. সকলের হৃদকমলে উপাসনা করা পুরুষটি হলেন পরমেশ্বর শিব।
আশা করবো এবার অন্তত বৈষ্ণবদের লাফালাফি একটু কমবে। এদের স্বভাবে পরিনত হলো শাস্ত্রের অর্ধসত্যকে তুলে ধরা। তার সাথে অর্থের অনর্থ করা। আর এদের লাজ-লজ্জা বলতে কিছুই নেই। বারবার শৈবদের কাছে অপমানিত হওয়ার পরেও বেহায়া মুখটা নিয়ে আবার শৈবদের সামনে চলে আসবে। আর ভুজুংভাজুং কিছু একটা লিখে অর্থের অনর্থ করে বলবে শৈবদের খণ্ডন হয়ে গেছে। বলছি কিছু স্তুতি লিখে দিলে তার খণ্ডন হয় না। বৈষ্ণবরা শৈবদের খণ্ডন করতে আবার পুনর্জন্ম নিয়ে আসতে হবে, তবুও পারবে না, কারণ সত্য সর্বদা অপরিবর্তনীয় থাকে।
হর হর মহাদেব ✊🚩
ওঁ সাম্বসদাশিবায় নমঃ 🚩🙏
ওঁ দক্ষিণামূর্তয়ে নমঃ 🙏🚩
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে ✊🚩
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ— আমার গুরু শ্রী নন্দীনাথ শৈবাচার্য জী ও শ্রী রোহিত কুমার চৌধুরী শৈবজীকে 🙏
কপিরাইট ও প্রচারেঃ— International Shiva Shakti Gyan Tirtha (আন্তর্জাতিক শিব শক্তি জ্ঞান তীর্থ)
বিঃ দ্রঃ— লেখাটি কপি করলে সম্পূর্ণ কপি করবেন, কোনো রকম কাটাছেঁড়া করা যাবে না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন