সনাতন ধর্মের সমস্ত শাস্ত্রের প্রকটকর্তা কে ?




॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥


সনাতন ধর্মের সমস্ত শাস্ত্র-বিদ্যা কার থেকে এসেছে ?

শাস্ত্র কি বলছে এবিষয়ে ? 


জেনে নিন সনাতন ধর্মের পবিত্র শাস্ত্র কি বলছে জেনে নেওয়া যাক।


পরমপবিত্র শিবমহাপুরাণের বায়বীয় সংহিতার পূর্বখণ্ডের অন্তর্গত ১ম অধ্যায়ের ২৫ থেকে ২৭ নং শ্লোকে বলা হয়েছে - 

অঙ্গানি বেদাশ্চত্বারো মীমাংসা ন্যায়বিস্তরঃ । 

পুরাণং ধর্মশাস্ত্রং চ বিদ্যাশ্চৈতাশ্চতুৰ্দশা ॥২৫

আয়ুর্বেদো ধনুর্বেদো গান্ধর্বশ্চেত্যনুক্রমাৎ ।

অর্থশাস্ত্রং পরং তস্মাদ্বিদ্যা হ্যষ্টাদশ স্মৃতাঃ ॥২৬ 

অষ্টাদশানাং বিদ্যানামেতাসাং ভিন্নবর্ত্মনাম্ ।

আদিকর্তা কবিঃ সাক্ষাৎ শূলপাণিরিতি শ্রুতিঃ ॥২৭

[তথ্যসূত্র - শিবমহাপুরাণ/বায়বীয়সংহিতা/পূর্বখণ্ড/১ম অধ্যায়]

অর্থ - ছয় বেদাঙ্গ, চার বেদ, মীমাংসা, বিস্তারিত ন্যায়শাস্ত্র, পুরাণ এবং ধর্মশাস্ত্র - এই চোদ্দটি হল বিদ্যা। এরই সাথে আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গন্ধর্ববেদ(অর্থাৎ সঙ্গীতশাস্ত্র) ও অর্থশাস্ত্রকে - একত্রে ধরে এই বিদ্যা আঠারোটি হয়। এগুলি পরস্পর ভিন্ন, এই সব বিদ্যার আদিকর্তা অর্থাৎ প্রকাশকারী হলেন সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শূলপানি শিব, তিনি মহান কবি - ইহাই শ্রুতির বক্তব্য ॥২৫-২৭


এছাড়াও..

 শিবমহাপুরাণের রুদ্র সংহিতার ২য় খণ্ড‌(অর্থাৎ সতীখণ্ডের) ২৩নং অধ্যায়ের ৫১ থেকে ৫৪ নং শ্লোকে বলা হয়েছে -

তন্ত্রশাস্ত্রং সযন্ত্রং হি সপঞ্চাঙ্গং মহেশ্বরঃ ।

বভাষে মহিমানং চ তত্তদ্দেববরস্য বৈ ॥৫১

সেতিহাসকথাং তেষাং ভক্তমাহাত্ম্যমেব চ ।

সবর্ণাশ্রমধর্মাংশ্চ নৃপধর্মান মুনীশ্বর ॥৫২

সুতস্ত্রীধর্মমাহাত্ম্যং বর্ণাশ্রমমনশ্বরম্ ।

বৈদ্যশাস্ত্রং তথা জ্যোতিঃশাস্ত্রং জীবসুখাবহম ॥৫৩

সামুদ্রিকং পরং শাস্ত্রমন্যচ্ছাস্ত্রানী ভূরিশঃ ।

কৃপাং কৃত্বা মহেশানো বর্ণয়ামাস তত্ত্বতঃ ॥৫৪

[তথ্যসূত্র - শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতার/সতীখণ্ড/২৩নং অধ্যায়]

অর্থ - মহেশ্বর পাঁচ অঙ্গসহিত তন্ত্রশাস্ত্র, যন্ত্রশাস্ত্র তথা ভিন্ন ভিন্ন দেবতাদের মহিমা রহস্য বিষয়ক তত্ত্ব উদ্ঘাটন করে শোনালেন। তিনি দেবতাদের ভক্তদের মহিমা, ইতিহাস, বর্ণাশ্রমধর্ম, রাজধর্ম নিরূপন করলেন। পুত্রধর্ম, স্ত্রী ধর্মের মাহাত্ম্য সহিত বর্ণাশ্রমের অবিনাশী গাথা শোনালেন, তিনি জীবেদের সুখপ্রদানকারী বৈদ্যক শাস্ত্র (অর্থাৎ চিকিৎসাশাস্ত্র) ও জ্যোতিষ শাস্ত্র প্রদান করলেন, প্রভু পরমেশ্বর শিব কৃপাবশত উত্তম সামুদ্রিক শাস্ত্র সহ অনান্য আরো বহু শাস্ত্র প্রকাশ করলেন ॥৫১- ৫৪  


এর‌ই সাথে.....

 শিবমহাপুরাণের বায়বীয় সংহিতার উত্তর খণ্ডের ৭নং অধ্যায়ের ৩৯ নং শ্লোকে বলা হয়েছে -

শ্রীকন্ঠেন শিবেনোক্তং শিবায়ৈ চ শিবাগমঃ ।

শিবশ্রিতানাং কারুন্যাচ্ছ্রেয়সামেক সাধনম্ ॥৩৯

[তথ্যসূত্র শিবমহাপুরাণ/বায়বীয়সংহিতা/ উত্তরখণ্ড/৭নং অধ্যায়]

অর্থ - পরমেশ্বর শ্রীকন্ঠ শিব ভগবতী শিবা(পার্বতী) দেবীকে যে জ্ঞানের উপদেশ করেছেন তা শিবাগম (অর্থাৎ শৈব আগম) নামে বিখ্যাত । শিবের আশ্রিত মার্গে যে সকল ভক্ত আছেন, তাদের প্রতি কৃপা করে কল্যানের একমাত্র সাধন এই শৈব আগমের জ্ঞান উপদেশ করেছেন মহেশ্বর ॥৩৯


শিবমহাপুরাণের রুদ্র সংহিতার ১ম খণ্ড‌(অর্থাৎ সৃষ্টিখণ্ডের) ৯নং অধ্যায়ের ৫ থেকে ৬ নং শ্লোকে বলা হয়েছে -

নিগমং শ্বাসরূপেণ দদৌ তস্মৈ ততো হরঃ।

বিষ্ণবে চ প্রসন্নাত্মা মহেশঃ করুণাকরঃ ॥৫

ততো জ্ঞানমদাত্তস্মৈ রহস্যং পরমাত্মনে।

পরমাত্মা পুনর্মহ্যং দত্তবান্ কৃপয়া মুনে ॥৬ 

[তথ্যসূত্র - শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/সৃষ্টিখণ্ড/৯নং অধ্যায়]

অর্থ - ব্রহ্মা বললেন, সেই সময় করুণাকর পরমেশ্বর শিব প্রসন্নচিত্তে শ্রীবিষ্ণুকে শ্বাসরূপে বেদ প্রদান করেছেন। হে মুনে ! এরপরে পরমাত্মা শিব শ্রীহরিকে এই বেদের গুহ্য জ্ঞান প্রদান করার পর আমাকে (অর্থাৎ ব্রহ্মাকেও) সেই বেদ প্রদান করেছিলেন ॥৫-৬ 


শিবমহাপুরাণের কোটিরুদ্র সংহিতার ৪২নং অধ্যায়ের

২২ থেকে ২৩ নং শ্লোকে বলা হয়েছে -

যেনৈব বিষ্ণবে দত্তাঃ সর্বে বেদাঃ সনাতনাঃ ।

বর্ণামাত্রা হ্যনেকাশ্চ ধ্যানং স্বস্য চ পূজনম্ ॥২২

ঈশানঃ সর্ববিদ্যানাং শ্রুতিরেষা সনাতনী ।

বেদকৰ্ত্তা বেদপতিস্তস্মাচ্ছং ভুরুদাহৃতঃ ॥২৩

[তথ্যসূত্র - শিবমহাপুরাণ/কোটিরুদ্রসংহিতা/৪২নং অধ্যায়]

অর্থ - যিনি বিষ্ণুকে সনাতন বেদের উপদেশ দিয়েছেন। অনেক বর্ণ, অনেক মাত্রা, ধ্যান তথা নিজের(অর্থাৎ শিবের) পূজার রহস্য বলেছেন। সেই ঈশান শিব সম্পূর্ণ বিদ্যার অধিপতি – এটি সনাতনী শ্রুতি অর্থাৎ বেদ এই কথা বলে, এই কারণে পরমেশ্বর শিবকে ‘বেদের প্রকটকর্তা’ তথা ‘বেদপতি’ বলা হয় ॥২২-২৩


কৃষ্ণ-যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যক -এর ১০ম প্রপাঠক-পরিশিষ্ট ভাগের ২১নং অনুবাকে

বলা হয়েছে,

ॐ ঈশানঃ সর্ববিদ্যানাং ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং

ব্রহ্মাধিপতির্ব্রহ্মণোঽধিপতির্ব্রহ্মা শিবো মে

অস্তু সদাশিবোম্ ॥

[তথ্যসূত্র - কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০ম প্রপাঠক-পরিশিষ্ট ভাগ/২১নং অনুবাক]


অর্থাৎ, যিনি সমস্ত বিদ্যার প্রকটকারী ঈশান, যিনি সমস্ত চরাচর জগতের ঈশ্বর, যিনি স্বয়ং ব্রহ্মার‌ও সৃষ্টিকর্তা, ব্রহ্মার অধিপতি, যিনি সকল কিছুর মঙ্গল বিধান করেন, সেই পরমেশ্বর সদাশিবকে প্রণাম করি ।


তাছাড়াও...

 বেদের অন্তর্গত শরভ উপনিষদের ২য় নং শ্লোকে বলা হয়েছে -

প্রভুং বরেণ্যং পিতরং মহেশং

যো ব্রহ্মাণং বিদধাতি তস্মৈ ।

 বেদাংশ্চ সর্বান্প্রহিণোতি চাগ্র্যং

তং বৈ প্রভুং পিতরং দেবতানাম্ ॥

[তথ্যসূত্র - শরভ উপনিষদ/২নং শ্লোক] 


অর্থ - সেই প্রভু শিবই সর্বপ্রথম প্রজাপতি ব্রহ্মাকে ধারণ করেন। সেই প্রভুই ধরণের যোগ্য, তিনিই প্রভু, তিনিই পিতা মহেশ্বর, তিনিই শ্রেষ্ঠ। তিনিই বেদের প্রথম প্রেরক পরমেশ্বর, তিনিই সবার প্রভু এবং সমস্ত দেবতাগণেরও পিতা ॥


পদ্মপুরাণের পাতালখণ্ডের ১১৪ তম অধ্যায়ের ২২৭ ও ২২৮ নং শ্লোকে

পরমেশ্বর সদাশিব স্বয়ং বলছেন -

সদাশিব উবাচ্

মদ্বাক্যাদখিলংশুদ্ধ্যেন্মদ্বাক্যাদমৃতং বিষম্ । 

মদ্বাক্যাদখিলাবেদা মদ্বাক্যাদ্দেবতাদয়ঃ ॥২২৭  

মদ্বাক্যাদ্ধর্মবিজ্ঞানং মদ্বাক্যান্মোক্ষ উচ্চত্যে । 

পুরাণন্যাগমাশ্চৈব স্মৃতয়ো মম বাক্যতঃ ॥২২৮

[তথ্যসূত্র - পদ্মপুরাণ/পাতাল খণ্ড/১১৪ নং অধ্যায়]

অর্থ - পরমেশ্বর সদাশিব বললেন, আমার বাক্য মাত্রেই অখিল বিশ্বসংসার শুদ্ধ হয়ে যায়। আমার বাক্যে বিষও অমৃত হয়ে যায়। আমার বাক্যই হল সমগ্র বেদ শাস্ত্র । আমার বাক্যেই দেবতারা দেবত্ব প্রাপ্ত হন। আমার বাক্যই সাক্ষাৎ ধর্ম ও বিজ্ঞান স্বরূপ। আমার বাক্যেই জীব মোক্ষলাভ করে। সমগ্র পুরাণ, আগম এবং স্মৃতিশাস্ত্র সবই আমার বাক্য । 


শ্রীসায়ণাচার্য লিখেছেন,

যস্য নিঃশ্বসিতং বেদা যো বেদেভ্যোঽখিলং জগৎ। 

নির্মমে তমহং বন্দে বিদ্যাতীর্থ মহেশ্বরম্ ॥


অর্থাৎ - যার নিঃশ্বাস থেকে সমগ্র বেদ প্রকাশিত হয়েছে, বেদসমূহ থেকে আরম্ভ করে অখিল বিশ্বচরাচর সবকিছু যার স্বরূপ, যিনি সকল বিদ্যার তীর্থ (সর্ব বিদ্যার ঈশ্বর) স্বরূপ, সেই পরমেশ্বর মহেশ্বরকে আমি বন্দনা করি। 


এবার দেখুন.. শতপথ ব্রাহ্মণের শ্রুতি মন্ত্রে সকল শাস্ত্র কে পরমেশ্বর শিবের দ্বারাই উৎপন্ন হয় - বলা হয়েছে 👇 

স যথার্দ্রৈন্ধাগ্নেরভ্যাহিতস্য পৃথগ্ধূমা বিনিশ্বরন্ত্যেবন্বারেঽস্য মহতো ভূতস্য নিশ্বসিতমেতদ্যদৃগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোঽথর্বাঙ্গারস ইতিহাসঃ পুরাণং বিদ্যা উপনিষদঃ শ্লোকাঃ সূত্রাণ্যনু ব্যাখ্যানানি ব্যাখ্যানান্যস্যৈবৈতানি সর্বাণি নিশ্বসিতনি ॥

(শতপথ ব্রাহ্মণ/১৪ প্রপাঠক/৪কাণ্ড/১০ নং মন্ত্র)

অর্থ — যেমন প্রকারে ভেজা উপাচার বস্তুর সংযোগে অগ্নি থেকে নানা প্রকারের ধোয়া প্রকট হয়ে থাকে সেই প্রকারে সেই পরমাত্মা(শিব)-এর দ্বারা ঋক্, যজু, সাম ও অথর্ববেদ, ইতিহাস, পুরাণ, বিদ্যা, উপনিষদ, শ্লোক, সূত্র, ব্যাখ্যান, অনুরূপাখ্যান এই সমস্ত কিছু তারই শ্বাস থেকে উৎপন্ন হয়েছে।


সিদ্ধান্ত

পরমেশ্বর শিব হলেন সনাতন ধর্মের সকল শাস্ত্রের একমাত্র প্রকট কর্তা, প্রভু শিব ছাড়া আর অন্য কেউ  এই সকল শাস্ত্র প্রকট করেননি, এই সিদ্ধান্ত স্বয়ং সনাতন ধর্মের শাস্ত্র নিজে শব্দ প্রমাণ সহ বলেছে। সুতরাং, যারা প্রকৃত সনাতনী ব্যক্তি হন, তিনি শাস্ত্রের কথা কথা কে কখনোই অমান্য করবেন না । বরং শাস্ত্রের কথাকে মেনে সত্য স্বীকার করে নেবেন ।


শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 

হর হর মহাদেব 

লেখনীতে - শ্রীনন্দীনাথ শৈব জী

কপিরাইট ও প্রচারে - International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT 


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ