শিবসংকল্প সূক্ত সমন্বিত আশ্বলায়ণশাখা ঋগ্বেদেরই শাখা — বলছেন মহাভাষ্যকার মহর্ষি পতঞ্জলি শৈবাচার্য
॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥
আমরা সনাতনী রা বর্তমানে এমন একটি সময়ে বসবাস করছি, যে সময় কালে সনাতনীদের প্রত্যেকটি বিষয়কে প্রমাণসহ উপস্থাপন করবার প্রয়োজন পড়ছে। তার কারণ হল সমাজে অনেক ধরণের বিভ্রান্তকারী ব্যক্তিবর্গের উদয় হয়েছে, যারা নিজেদের বানানো মতবাদ সমাজে প্রচার করবার জন্য বিভিন্ন রকমের অপপ্রচার করে বেড়াচ্ছে।
আর্য সমাজ তথা বিভিন্ন অসনাতনীরা বলে বেড়াচ্ছে যে, ঋগ্বেদের শাখা শুধু মাত্র শাকল শাখা, আর অন্য কোনো শাখা নেই । তারা ঋক্ বেদের আশ্বলায়ণশাখা কে অবার্চিন ও প্রক্ষিপ্ত বলে প্রচার করেন, আশ্বলায়ণশাখার মধ্যে রয়েছে “শিবসংকল্পসূক্ত”, তার মধ্যে পরমেশ্বর শিবের সাকার হবার স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। আর্যসমাজীরা হল প্রতিমাপূজার বিরোধী ও ঈশ্বরের সাকারবাদে অবিশ্বাসী। তাই যেহেতু আশ্বলায়ণশাখার মধ্যে রয়েছে “শিবসংকল্পসূক্ত” রয়েছে একারণে সাকারবাদকে অস্বীকার করবার জন্য আর্যসমাজীরা আশ্বলায়ণশাখা কে ঋগ্বেদের শাখা বলে মানতে অস্বীকার করেন।
কিন্তু ঋগ্বেদের শিবসংকল্পসূক্ত কে অর্বাচীন বলা মূর্খের কাজ । কারণ শিবসংকল্পসূক্ত ঋগ্বেদের আশ্বলায়ন শাখার অন্তর্ভুক্ত বেদের সূক্ত।
আর্যসমাজী রা শাকল শাখা ছাড়া ঋগ্বেদের আর কোনো শাখা নেই বলে প্রচার করে বেড়ায় ।
কিন্তু শাকল শাখা ছাড়াও ঋগ্বেদের আরো বিভিন্ন শাখা ছিল,
সে সম্পর্কে মহর্ষি পতঞ্জলি শৈবাচার্য তার “ব্যাকরণ মহাভাষ্য” -এর পস্পশাহ্নিকের ১ম আহ্নিকের বর্ণন করেছেন —
"একশতমধ্বর্যশাখাঃ, সহস্রবর্ষা সামবেদঃ,
একবিংশতিধা বাহবৃচ্যম্, নবধার্থর্বণো বেদঃ।"
(ব্যাকরণ মহাভাষ্য/ পস্পশাহ্নিকম্/ প্রথমাহ্নিকম্)
❃ অর্থ - একশত একটি(১০১ টি শাখায় বিভক্ত) যর্জুবেদের শাখা, সহস্র(হাজার) পথযুক্ত সামবেদ, ঋগ্বেদ হল একবিংশ প্রকার (২১ টি শাখায় বিভক্ত), অথর্ববেদ নয় প্রকার (৯টি শাখায় বিভক্ত)।
☑ ঋগ্বেদের ২১টি শাখার কথা মহর্ষি পতঞ্জলি স্বীকার করেন।
🟦 মুক্তিকা উপনিষদ বলছে —
ঋগ্বেদস্য তু শাখাঃ স্যুরেকবিংশতিসঙ্খ্যকাঃ ।
নবাধিকশতং শাখা যজুষো মারূতাত্মজ ॥১২॥
[তথ্যসূত্র : শুক্ল-যজুর্বেদ/মুক্তিকা উপনিষদ/অধ্যায় ২৬/৬]
❃ অর্থ — ঋগ্বেদের একুশটি শাখা রয়েছে। পবনতনয় ! যজুর্বেদের একশো নয়টি শাখা
আবার,
শৌনক ঋষি তার “চরণব্যূহসূত্রম্” -এ ঋগ্বেদের বিভিন্ন শাখার মধ্যে “আশ্বলায়ন” শাখার অস্তিত্ব কে মান্যতা দিয়েছেন —
আশ্বলায়নী শাঙ্খায়নী শাকলা বাষ্কলা মাণ্ডুনাকায়নাশ্চেতি ॥ ৮
(তথ্যসূত্র — চরণব্যূহসূত্রম্/ প্রথম ঋগ্বেদখণ্ড/ ৮নং সূত্র)
সুতরাং, ঋগ্বেদের আশ্বলায়ন শাখা যে প্রাচীন ও ঋগ্বেদের অন্তর্ভুক্ত তা মহর্ষি পতঞ্জলি, উপনিষদ ও ঋষি শৌনকের বচনে প্রমাণিত ।
☑ শিবসংকল্পসূক্ত যে ঋগ্বেদের অন্তর্ভুক্ত বৈদিক সূক্ত, তাতে আর কোনো দ্বিমত রইল না ।
------------------------------------------------------------------------------------
এবার দেখুন,
শিবসংকল্পসূক্ত পাঠ ও মাহাত্ম্য কে অনান্য ধর্মসূত্র, স্মৃতি, পুরাণ শাস্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে -
✅ বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র বলছে —
সক্শঞ্জপ্ত্বাস্য বামীয়ং শিবসংকল্পমেব চ ।
সুবর্ণমপহত্যাপি ক্ষণাদ্ভবতি নির্মলঃ ॥ ৬
[তথ্যসূত্র : বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র/অধ্যায় ২৬/৬]
❃ অর্থ — অস্যবামীয় (অস্য বামস্য পলিতস্য) এই সূক্ত একবার জপ করে ও শিবসংকল্প মন্ত্র (অনুতপ্ত হয়ে) পাঠ করে (ব্রাহ্মণের) স্বর্ণাপহারক ক্ষণেকের মধ্যে নির্মল হয় ।
✅ মনু সংহিতা তে বলা হয়েছে —
সকৃজ্জপ্ত্বাস্য
বামীয়ং শিবসংকল্পমেব চ ।
অপহৃত্য সুবর্ণন্তু
ক্ষণাদ্ভবতি নির্মলঃ ॥ ২৫১
[তথ্যসূত্র : মনু সংহিতা/১১ অধ্যায়/২৫১ নং শ্লোক]
❃ অর্থ — অস্যবামীয় (অস্য বামস্য পলিতস্য) এই সূক্ত একবার জপ করে ও শিবসংকল্প মন্ত্র (অনুতপ্ত হয়ে) পাঠ করে (ব্রাহ্মণের) স্বর্ণাপহারক ক্ষণমধ্যে নিস্পাপ হয় ।
✅ লিঙ্গ মহাপুরাণ -এ বলা হয়েছে —
ততস্তস্য বসিষ্ঠস্য
নিয়োগাচ্ছক্তিনন্দনঃ ।
রাক্ষসানামভাবায়
মতিং চক্রে মহামতিঃ ॥ ৭৪
অদৃশ্যন্তীং বসিষ্ঠং
চ প্রণম্যারুন্ধতীং ততঃ
কৃত্বৈকলিঙ্গং
ক্ষণিকং পাংসুনা মুনিসন্নিধৌ ॥ ৭৫
সম্পূজ্য শিবসূক্তেন
ত্র্যম্বকেন শুভেন চ ।
জপ্ত্বা ত্বরিতরুদ্রং
চ শিবসংকল্পমেব চ ॥ ৭৬
নীলরুদ্রং চ শাক্তেয়স্তথা
রুদ্রং চ শোভনম্ ।
বামীয়ং পবমানং
চ পঞ্চব্রহ্ম তথৈব চ ॥ ৭৭
হোতারং লিঙ্গসূক্তং
চ অথর্বশির এব চ ।
অষ্টাঙ্গমর্ঘ্যং
রুদ্রায় দত্ত্বাভ্যর্চ্য যথাবিধি ॥ ৭৮
[তথ্যসূত্র : লিঙ্গমহাপুরাণ/পূর্বভাগ/অধ্যায় ৬৪/৭৪-৭৮ নং শ্লোক]
❃ অর্থ — এরপর সেই বসিষ্ঠের আজ্ঞায় মহাবুদ্ধিমান শক্তিপুত্র রাক্ষসদের বিনাশের জন্য নিশ্চয়ই করলেন । অদৃশ্যন্তী, বসিষ্ঠ তথা অরুন্ধতীকে প্রণাম করে অনন্তর মুনির সমীপে মাটির দ্বারা একটি ক্ষণিকেই পার্থিবলিঙ্গ বানিয়ে শুভ শিবসূক্ত তথা ত্র্যম্বক মন্ত্রের দ্বারা বিধি অনুযায়ী পূজা করে ত্বরিতরুদ্র, শিবসংকল্পসূক্ত, নীলরুদ্র, উত্তম রুদ্র, বামীয়, পবমান, পঞ্চব্রহ্ম, হোতৃসূক্ত, লিঙ্গসূক্ত তথা অথর্বশীর্ষ — এই মন্ত্রগুলি জপ করে পরমেশ্বর রুদ্রের অষ্টাঙ্গ অর্ঘ্য প্রদান করে যথাবিধি অভ্যর্চন করে সেই শাক্তেয়(শক্তিপুত্র পুত্র পরাশর) প্রার্থনা করতে লাগলেন ॥ ৭৪-৭৮
✅অগ্নি মহাপুরাণ -এ বলা হয়েছে —
বক্ষ্যে রুদ্রবিধানন্তু পঞ্চাঙ্গং সর্বদং পরম্ ।
হৃদয়ং শিবসংকল্পঃ শিরঃ সূক্তন্তু পৌরুষম্ ॥ ১
[তথ্যসূত্র : অগ্নিপুরাণ/২৯৬ অধ্যায়]
❃ অর্থ — আমি পঞ্চাঙ্গ রুদ্রের উপাসনা বর্ণনা করবো। যা পরম উত্তম তথা সকল কিছু প্রদানকারী। শিবসংকল্প এটির হৃদয়, পুরুষসুক্ত এটির মস্তক।
অতএব, উপরিউক্ত শাস্ত্রপ্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিপাদিত হয় যে ঋগ্বেদোক্ত আশ্বলায়ন শাখা ও তার অন্তর্গত শিবসংকল্পসূক্ত বেদেরই প্রাচীন সূক্ত ও প্রাচীন বিভিন্ন ঋষির বানী ও পুরাণ শাস্ত্রে "পরমেশ্বর শিবের উদ্দেশ্যে উক্ত হয়েছে বেদে" বলে প্রমানিত করেছে ।
----------------------------------------------------------------------------------
সিদ্ধান্ত
আর্যসমাজীদের তথা অসনাতনীদের ভ্রান্ত মতবাদ খণ্ডিত হল, শিবসংকল্পসূক্ত অর্বাচীন নয় বরং প্রাচীন বৈদিক সূক্ত যা অন্যান্য শাখার বেদমন্ত্রের ন্যায়ই প্রামাণ্য ও গ্রহণীয়, যেমন ঋগ্বেদের আশ্বলায়ন শাখা যে প্রাচীন ও ঋগ্বেদের অন্তর্ভুক্ত তা মহর্ষি পতঞ্জলি, উপনিষদ ও ঋষি শৌনকের বচনে প্রমাণিত ।
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে
হর হর মহাদেব
লেখনিতে - শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
কপিরাইট ও প্রচারে - International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন