বৈষ্ণবদের দ্বারা নৃসিংহপূর্বতাপনী উপনিষদের মন্ত্রের অপব্যাখ্যার খণ্ডন ও শিব পরমতত্ত্ব প্রমাণ



॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥

নৃসিংহপূর্বতাপনী উপনিষদের বেদ মন্ত্রে মূলত পরমেশ্বর শিব কেই বর্ণনা করা হয়েছে । কিন্তু বৈষ্ণব দের তা দেখে বড় গাত্র দহন হয় । ফলে তারা এই নৃসিংহপূর্বতাপনী শ্রুতির অপব্যাখ্যা করে নিজেদের ইচ্ছে মত অর্থ বের করেছে। যার ফলে বেদের অপমান হয়েছে। পরমেশ্বর শিবের মহিমাকে ধামা চাপা  দেওয়ার মতো নিকৃষ্ট কার্যকলাপ করে বৈষ্ণবেরা সমস্ত অপকর্মের সীমা পেড়িয়ে গিয়েছে । তাই আমি শ্রী শম্বরনাথ শৈব , এই বেদ ও শিবের অপমানের বিরুদ্ধে শাস্ত্র প্রমাণ সহ মীমাংসা উপস্থাপন করে যোগ্য জবাব দিয়ে পবিত্র বেদ ও পরমেশ্বর শিবের সম্মান অক্ষুন্ন রাখতে সচেষ্ট হলাম।


বৈষ্ণবেরা নৃসিংহপূর্বতাপনী উপনিষদের  যে বেদ মন্ত্র নিয়ে কাটাছেড়া করেছে, সেই বেদ মন্ত্র টি হল এই প্রকার - 

 "ঋতং সত্যং পরং ব্রহ্ম পুরুষং নরকেশরিবিগ্রহং কৃষ্ণপিঙ্গলম্।ঊর্ধ্বরেতং বিরূপাক্ষং শঙ্করং নীললোহিতম্। উমাপতিঃ পশুপতিঃ পিনাকী হ্যামিতদ্যুতিঃ। ঈশানঃ সর্ববিদ্যানামীশ্বরঃ সর্বভূতানাং ব্রহ্মাধিপতির্ব্রহ্মণোহধিপতির্য়ো বৈ যজুর্বেদবাচ্যস্তং হি সাম জানীয়াদ্যো জানীতে সোহমৃতত্বং চ গচ্ছিতি।।"
(অথর্ববেদ/নৃসিংহপূর্বতাপনি উপনিষদ ১/১২)

___________________________________________________

🚫 বৈষ্ণবদের মূর্খতাপূর্ণ দাবী — ১

'ঋত' শব্দটি মূলত √ঋ্ ধাতু থেকে উৎপত্তি যার অর্থ হলো "ঋ গতৌ"(পাণিনিধাতুপাঠ ৩/১৭)- জ্ঞাত। 'ঋ' ধাতুর সহিত 'ক্ত' প্রত্যয় যোগ হয়ে ঋত শব্দ নিপাতিত হয়। যিনি সর্বগতঃ অর্থাৎ সকল কিছু সম্বন্ধে জানেন তিনি ঋতঃ। শ্রুতি বলেন সেই পরব্রহ্ম সবকিছু সম্বন্ধে জ্ঞাত। তাই তিনি সর্বজ্ঞ। "যঃ সর্বজ্ঞ সর্ববিদ্" (মু০ উ০ ১/১/৯)- যিনি সর্বজ্ঞ, সবকিছু সম্বন্ধে অবগত রয়েছেন। ভগবান বিষ্ণু তিনি সর্বজ্ঞ বলিয়া ব্রহ্মাণ্ডের সকল লোকসম্পর্কেও তিনিই অবগত আছেন। কিন্তু তিনি জীবের সামর্থ্য ব্যতীত নিজেকে প্রকাশ করলে জীব তাহাকে জ্ঞাত হতে পারেন না।সে সম্পর্কে বেদে বলা হয়েছে-
"পরো মাত্রয়া তত্ত্বা বৃধান ন তে মহিমন্বশ্ববস্তি।
উভে তে বিঘ্ন রজসী পৃথিব্যা বিষ্ণো দেব ত্বং পরমস্য বিৎসে।।" (ঋগ্বেদ ৭/৯৯/১)
অনুবাদ:হে বিষ্ণু। তুমি মাত্রার অতীত শরীরে বর্ধমান হলে তোমার মহিমা কেউ জ্ঞাত হতে পারে না, পৃথিবী হতে আরম্ভ করে উভয় লোক আমরা জানি, কিন্তু তুমিই কেবল, হে দেব। পরমলোক অবগত আছ।
ভগবান নারায়ণই যে সর্বগতঃ অর্থাৎ ঋতঃপুরুষ ইহা প্রতিপাদিত। তাছাড়া ভগবান কৃষ্ণও গীতায় একই কথা বলেছেন-
"বেদাহং সমতীতানি বর্তমানানি চার্জুন৷
ভবিষ্যাণি চ ভূতানি মাং তু বেদ ন কশ্চন৷৷" (গীতা ৭/২৬)
অনুবাদ: হে অর্জুন! ভগবানরুপে আমি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সম্পূর্ণরুপে অবগত। আমি সকলকেই জানি কিন্তু আমাকে কেহই জানে না।

🔥 শৈব পক্ষ থেকে বৈষ্ণবদের দাবীর খণ্ডন —

ঋতং সত্যংঃ— এই দুটি পদ বিশেষণ। এই দুটি পদ সত্যার্থের প্রতিপাদক হওয়াতে 'ঋতং' এই পদের ব্যবহারিক সত্য আর 'সত্যং' এই পদের পারমার্থিক সত্য, এমন কিছু ব্যক্তি অর্থ করেন। কিন্তু এই অর্থ শক্তিবিশিষ্টদ্বৈত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধ। অতঃ এই সম্প্রদায়ের ভাষ্যকার এই পদের আলাদা অর্থ স্বীকার করেন। যেমন কি প্রপঞ্চের সব মনুষ্য অল্পমতি হওয়ার কারণে নিজের নিজের বাণীতে, নিজের নিজের মনের বিচারে বৈবিধ্য রাখে। ব্রহ্মশব্দবাচ্য পরশিব সেই বাগ্বিপর্যাসের আস্পদ নয়, এই অর্থ 'সত্যং' এই পদে ব্যক্ত হয় আর 'পুরুষং' এই পদে "পুরি শেত ইতি পুরুষঃ" এই ব্যূৎপত্তির অনুসারে অর্থ সমস্ত প্রাণির হৃদয়ে ভাসিত হয়। ব্রহ্মপদের "বৃহত্বাদ্ বৃহণত্বাচ্চ" এই ব্যূৎপত্তির অনুসারে এটি ব্যাপক থেকে ব্যাপক হয়ে নিজে নিজে প্রপঞ্চের রূপে বদলে যায়।।

ঋতংঃ— অর্থাৎ যিনি সর্বজ্ঞ, যিনি সব জানেন।
শ্রীকৃষ্ণ বলছেন যে—
মাসার্দ্ধমাসা ঋতবঃ সন্ধ্যে সংবৎসরশ্চ সঃ।
সধাতা স বিধাতা চ বিশ্বকর্মা স সর্ব্ববিৎ ॥৪০॥

[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩৮/৪০]
তিনি মাস, পক্ষ, ঋতু, সন্ধ্যা ও সংবৎসর, তিনি ধাতা, তিনি বিধাতা, তিনি বিশ্বকর্মা, মহাদেবই সর্বজ্ঞ।
এই ছাড়াও শ্রুতিতেও পরমেশ্বর শিবকেই সর্বজ্ঞ বলা হয়েছে— "বিশ্বাধিপা রুদ্র মহর্ষি" [শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৪/১২] অর্থাৎ যিনি সর্বজ্ঞ রুদ্র। এমনকি শব্দকোষ অভিধানে পরমেশ্বর শিবকে সর্বজ্ঞ সর্বজ্ঞ বলা হয়েছে এবং সর্বজ্ঞ বলতে কেবল শিবকেই বোঝায়- "সর্ব্বজ্ঞো ধূর্জটিনীললোহিতঃ" [অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/২১] অর্থ করলে দাঁড়ায় যে, জটাজুটধারী নীললোহিত শিবই সর্বজ্ঞ।

👉বেদ এবং পুরাণ অনুযায়ী বিষ্ণুর অসর্বজ্ঞতার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেখানে বিষ্ণুজী বলছেন ভস্মের মাহাত্ম্য জানেন না। তাই যিনি পরমেশ্বর পদবাচ্য, তার অজানা কিছুই নেই তিনি সবকিছুর জ্ঞাতা। কিন্তু পক্ষান্তরে বিষ্ণুজীর না জানার একটা ব্যাপার শ্রুতি এবং পুরাণে বিশেষ ভাবে পরিলক্ষিত হয়।

ন শক্যং ভস্মনো জ্ঞানং প্রভাবং তে কুতো বিভো ।

নমস্তেঽস্তু নমস্তেঽস্তু  ত্বামহং শরণং গতঃ ।। ১০

[বৃহজ্জাবাল উপনিষদ/৬ষ্ট ব্রাহ্মণ/১০]
হে মহেশ্বর! হে প্রভু! আমি এই ভস্মের শক্তি ও প্রভাব ( মহিমা ) কে বুঝতে অসমর্থ হচ্ছি , তবে আমি তোমার মহিমা কিভাবে বুঝতে সমর্থ হই বলো । আমি সর্বদায় তোমার পূজা করে থাকি ও সর্বদায় তোমার শরণে থাকি এবং সদাসর্বদার জন্যে তোমার ওই চরণদ্বয়ে যেনো আমার অচল ভক্তি থাকে।।
👉পুরাণেরও একই বাক্যর সমর্থন রয়েছে —

হরিরুবাচ—
ন শক্তিং ভস্মনো জানে প্রভাবং তে কুতো বিভো।
নমস্তেহস্তু নমস্তেহস্তু ত্বামেব শরণং গতঃ।।২৩৮
[পদ্মপুরাণ- পাতালখণ্ড- অধ্যায়- ৬৪]
হরি বলিলেন,-প্রভো!(সদাশিব) আমি ভস্মেরই মহিমা জানি না, আপনার মহিমা কিরূপে জানিব? (আপনাকে আর অধিক কি বলিব) আপনারই শরণাপন্ন হইলাম।।২৩৮
যদা দেবা ন বিজানস্তি ব্রহ্মবিষ্ণুপুরোগমাঃ।
[স্কন্দমহাপুরাণ/প্রভাসখণ্ড/ক্ষেত্রমাহাত্ম্য/অধ্যায় ৭/১০০]
ব্রহ্মা, বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতাও শিব তত্ত্ব জ্ঞাত নন।।

ন তো গিরিত্রাখিললোকপাল বিরিঞ্চবৈকুণ্ঠসুরেন্দ্রগম্যম্। জ্যোতিঃ পরং যত্র রজস্তমশ্চ সত্ত্বং ন যদ্ ব্রহ্ম নিরস্তভেদম্ ।।৩১ [ভাগবত পুরাণ/অষ্টম স্কন্দ/অধ্যায় ৭/৩১]

ভগবান্‌! আপনার পরম জ্যোতির্ময় স্বরুপ হলো স্বয়ং ব্রহ্ম। তাতে রজোগুণ,তমোগুণ এবং সত্ত্বগুণ কিছুই নেই, তাতে কোনোপ্রকার ভেদাভেদও নেই। আপনার সেই স্বরূপকে সমস্ত লোকপাল-এমনকি ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং দেবরাজ ইন্দ্রও জানতে পারে না ।।
👉মহাভারতে বলা আছে—
ব্রহ্মা শতক্রতুব্বিষ্ণুব্বিশ্বেদেব! মহর্ষয়ঃ।
ন বিদুস্ত্বাং
তু তত্ত্বেন কুতো বেৎস্যামহে বযম্ ॥১৬৷৷ [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৫/১৬]
মহাদেব! ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র, বিশ্বদেবগণ এবং মহর্ষিরাও আপনাকে যথার্থ-রূপে জানেন না, সুতরাং আমরা জানবো কি ভাবে ? ॥১৬৷৷
এসব ছাড়াও বহু শাস্ত্র প্রমাণ আছে যেখানে বলা আছে বিষ্ণু আদি দেবগণ শিবতত্ত্ব জ্ঞাত নন। তাই যার মধ্যে অল্পজ্ঞতার ভাব পরিলক্ষিত হয়, তিনি কদাপি সর্বজ্ঞ নন। তাই বিষ্ণুর অসর্বজ্ঞতার প্রমাণিত হল । বৈষ্ণবীয় দাবী খণ্ডিত হল ।

__________________________________________________

🚫 বৈষ্ণবদের মূর্খতাপূর্ণ দাবী — ২

'সত্যম্" অর্থ নির্বিকার যার বিকার হয় না বা যিনি নিত্য। অর্থাৎ ভগবান নারায়ণের কোনো জন্মমরণাদি বিকার প্রাপ্ত হয় না যার ফলে তিনি নিত্য সর্বদা বর্তামান। তাই তিনি প্রকৃতই সত্য। "যঃ পূৰ্ব্ব্যায় বেধসে নবীয়সে" (ঋ০ বে০ ১/১৫৬/২)- যে বিষ্ণু পূর্ব থেকে বিদ্যমান এবং জগৎসৃষ্টিকর্তা সদা নিত্যনতুন। ভগবান বিষ্ণু নিত্য নতুন এবং কালের দ্বারা নিঃশেষ নেই বিধায় তিনি সত্য।

🔥 শৈব পক্ষ থেকে বৈষ্ণবদের দাবীর খণ্ডন —


সত্যম্‌ঃ— সত্যম্‌ কথার অর্থ নিত্য যা পরিবর্তনীয় নয়। আর সত্য যে সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিব তা আলাদা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। কেননা বিষ্ণু যদি সত্যই হতো তাহলে, শাস্ত্রের মধ্যে বিষ্ণুর মৃত্যু এবং পরমেশ্বর শিব দ্বারা বিষ্ণুকে হনন করার শব্দ প্রমাণ থাকতো না। পক্ষান্তরে শাস্ত্রের মধ্যে বিষ্ণু যে অনিত্য তার প্রমাণ স্পষ্ট ভাবেই পাওয়া যায়।
বিষ্ণু যে কালের অধীন হন তার প্রমাণ শাস্ত্রের মধ্যেই রয়েছে—
শম্ভুরুবাচ্ -
" ব্রহ্মাধিকবলোবিষ্ণুরায়ুষি ব্রহ্মণোহধিক ॥ ৬৯
ব্রহ্মাংডমালাভরণে মহেশস্যমমৈবতু।
চতুর্নিঃশ্বাসমাত্রেন বিষ্ণোরায়ুরুদাহৃতম্ ॥ ৭০ "
[তথ্যসূত্র - পদ্মপুরাণ/ পাতাল খণ্ড/ ১০৮ নং অধ্যায়]

ব্রহ্মার চেয়ে বিষ্ণুদেবের আয়ু ও ক্ষমতা উভয়ই বেশি। তবে মহেশ্বরের এবং আমার (শম্ভুর) চারটি নিঃশ্বাসের সমান বিষ্ণুদেবের পুরো আয়ুষ্কাল।

👉মহেশ্বর, রুদ্র, শম্ভু, শ্রী বিষ্ণু ও ব্রহ্মা সকল সাকার দেবগণই কালের অধীনে আবদ্ধ। প্রত্যেকেরই একটি নির্দিষ্ট আয়ু আছে। কিন্তু সদাশিব কালাতীত। তাঁর কোনো সময়ের মাপকাঠি নেই। জগৎ চরাচরের সকল কিছুই তাঁর মধ্যে বিলীন হয়। তিনি কোথাও বিলীন হন না।

👉শ্রুতিতেও একি কথায় বলা আছে একমাত্র শিবই নিত্য, বিষ্ণু আদি দেবতা অনিত্য—

এক এব শিব নিত্যস্ততোহন্যৎসকলং মৃষা।
তস্মাৎ সর্ব্বানপরিত্যজ্য ধ্যায়েন্বিষ্ণুবাদিকান্সুরান্‌”।।
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/শরভ উপনিষদ/৩০]

একমাত্র শিবই নিত্য বাদবাকী সব কিছুই মিথ্যা, এজন্য বিষ্ণু আদি সকল দেবতাকে পরিত্যাগ করে এক মাত্র শিবকেই ধ্যেয় বলে জানা উচিত।।

এর একই সমর্থনে ভগবান বিষ্ণুজীও বলেছেন যে—

শিবো গুরুঃ শিবো বেদঃ শিবো দেবঃ শিবঃ প্রভুঃ।
শিবোহম্ম্যহং শিবঃ সর্বং শিবাদন্যত্র কিঞ্চন ॥৩২
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/বরাহ উপনিষদ/তৃতীয় অধ্যায়]

শিব গুরু, শিব বেদ, শিব দেব, শিব প্রভু, আমি (নারায়ণ নিজেও) শিবস্বরূপ, সমস্তই শিবস্বরূপ, শিব ব্যতীত আর কোথাও অন্য কিছুই নেই ॥ ৩২

👉একমাত্র পরমেশ্বর শিবই নিত্য সত্য তাই শ্রুতিতে বলছে—

অহমেবাস্মি সিদ্ধোহস্মি শুদ্ধোহস্মি পরমোহস্ম্যহম্।
অহমস্মি সদাসোহস্মি নিত্যোহস্মি বিমলোহ স্ম্যহম্।। 
[সামবেদ/মৈত্রেয়ী উপনিষদ/৩/২]

আমিই সিদ্ধ, আমিই শুদ্ধ তথা পরম তত্ত্ব আমিই। আমি সর্বদা বিদ্যমান থাকি, আমি নিত্য এবং মলরহিতও আমিই।

👉শ্রুতি, পুরাণ, ইতিহাস, তন্ত্র আদি শাস্ত্র অধ্যয়ন করলে বিষ্ণুর অনিত্যতার শব্দপ্রমাণ পাওয়া যায়। বিষ্ণু মহাপ্রলয়ে শিবের মধ্যেই লীন হয় তারও বহু প্রমাণ শাস্ত্রে রয়েছে। তাই একমাত্র নিত্য হলো শিব। এবং পরমেশ্বর শিবই যে বিষ্ণুকে হরণ করেন তার সত্যতা— ‘হরি হরন্তমনুয়ন্তি দেবাঃ ।
বিশ্বস্যেশানং বৃষভং মতীনাম্ ” [কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/ তৈত্তিরীয় আরণ্যক/ 3.15.1], “হরিং হরস্তং বৃষভং বিবেশানন্ত ঈশ্বরঃ” [শিব মহাপুরাণ 3.12.16], “হরিং হরন্তং পাদাভ্যামনুযান্তি সুরেশ্বরাঃ” [কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/শরভ উপনিষদ/৫] ইত্যাদি শাস্ত্র প্রমাণের দ্বারা সিদ্ধ হয়। তাছাড়াও উক্ত শাস্ত্রের মধ্যে কোনো পরস্পর বিরোধও দেখা যায় না, তাই যেখানে নিত্যতার প্রশ্ন আসে সেখানে পরমেশ্বর শিবই একমাত্র নিত্য, “সদানন্দং পরমানন্দং শান্তং শাশ্বত সদাশিবং” [বৃহজ্জাবাল উপনিষদ(শৈবউপনিষদ)/ অষ্টম ব্রাহ্মণ/৬ মন্ত্র] সদানন্দময়,পরমানন্দময় পরম ধামই হল সাক্ষাৎ শান্ত, শাশ্বত, চিরন্তন, সচ্চিদানন্দ সদাশিব।

👉যিনি নিত্য, প্রণব, পরম, পুরুষোত্তম, সাক্ষাৎ ওঙ্কার এবং পরমাত্মা তিনিই শিব—

প্রযতঃ প্রণবো নিত্যং পরমং পুরুষোত্তমম্ ।
ওঙ্কারং পরমাত্মনং তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু ॥ ২০
[ঋগ্বেদোক্ত শিবসংল্পসূক্ত/ঋগ্বেদ সংহিতা/খিলানি/চতুর্থ অধ্যায়/১১ নং খিলা] [ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১]


___________________________________________________

🚫 বৈষ্ণবদের মূর্খতাপূর্ণ দাবী — ৩

'পরং ব্রহ্ম পুরুষ কৃষ্ণপিঙ্গম্' অর্থ যে পরব্রহ্ম পুরুষ ভগবান নারায়ণের বর্ণ কৃষ্ণপিঙ্গল। কৃষ্ণ শব্দে শ্যাম বর্ণ এবং পিঙ্গল শব্দে কদ্রুপিঙ্গল বর্ণ। কৃষ্ণ শব্দে শ্যাম অর্থকে বুঝায়। কৃষ্ণবর্ণবাচক শব্দ সম্বন্ধে অমরকোষ(১ম কান্ড/ধীবর্গ/১৪) বলা হয়েছে-
"কৃষ্ণে নীলাসিতশ্যামকালশ্যামলমেচকাঃ"- কৃষ্ণ, নীল, অসিত, শ্যাম, কাল, শ্যামল, মেচক।
আর পিঙ্গল বর্ণে স্বর্ণবৎ বর্ণকে বোঝায়। অমরকোষ অভিধানে (১ম কাণ্ড/ ধীবর্গঃ /১৬) বলা হয়েছে- "কড়ারঃ কপিলঃ পিঙ্গপিশঙ্গৌ কদ্রুপিঙ্গলৌ।পিঙ্গলবর্ণবাচক শব্দ: কড়ার, কপিল, পিঙ্গ, পিশঙ্গ, কদ্রু, পিঙ্গল।
অমরার্থচন্দ্রিকার টীকা পিঙ্গলবর্ণের বিভিন্ন ধরণ তুলে ধরা হয়। "কড়েতি। ষট্ পিঙ্গলবর্ণে। অন্যস্ত্বাহ--- পিঙ্গলং যাবৎ দ্বয়ং দ্বয়ং সমং, তত্র নীলপীতঃ কপিলঃ, রোচনাভঃ পিশঙ্গঃ, কনকপিঙ্গলঃ কদ্রু
কনকের ন্যায় পিঙ্গলবর্ণকে বলা হয় কদ্রু। সেই ভগবান নারায়ণের পিঙ্গলবর্ণ হলো কদ্রু অর্থাৎ কনকপিঙ্গল। কারণ শ্রুতি শাস্ত্রে বলা হয়েছে- "যদা পশ্যঃ পশ্যতে রুক্মবর্ণং" (মু০ উ০ ৩/২/৩), "অন্তরাদিত্যে হিরণ্ময়ঃ পুরুষো দৃশ্যতে" (ছা০ উ০ ১/৬/৬)। এই হিরণ্ময় পুরুষ ভগবান নারায়ণের সূবর্ণবর্ণ হচ্ছে তার আভাস্বরূপ। "রুক্মাভং স্বপ্নধীগম্যং বিদ্যাত্তং পুরুষং পরম" (মনুস্মৃতি ১২/১২২)- যিনি হিরণ্য আভার ন্যায় দীপ্তিমান, স্বপ্নের মতো কেবল বুদ্ধির দ্বারাই যাকে অনুভব করা যায় এভাবে পরমপুরুষকে ধ্যান করবে। অর্থাৎ হিরণ্ময় পিঙ্গলবর্ণ হলো ভগবান নারায়ণের আভা/জ্যোতি/দীপ্তি। তাই শ্রুতিতে ভগবান বিষ্ণুর রূপকে দীপ্তিময় বলা হয়েছে। "প্র বিষ্ণুরস্তু তবসস্তবীযান্ত্বেষং হ্যস্য স্থবিরস্য নাম" (ঋ০ বে০ ৭/১০০/৩)- প্রবৃদ্ধ অর্থাৎ যিনি প্রাচীন থেকেও প্রাচীন বিষ্ণু আমাদের স্বামী হোন, যিনি প্রাচীন সেই বিষ্ণু রূপ দীপ্তিযুক্ত। মহাভারতেও বিষ্ণুসহস্রনামের ৭৩৭|৭৩৮ নং নামে ভগবান বিষ্ণুকে "সুবর্ণবর্ণ হেমাঙ্গ" বলা হয়েছে। হিরণ্যপিঙ্গল ভগবতী মহালক্ষ্মীর প্রতীক। কারণ শ্রীসুক্তে বলা হয়েছে মাতা লক্ষ্মীদেবীর বর্ণও হিরণ্যবর্ণ ও পিঙ্গলময়। "হিরণ্যবর্ণাম্ হরিণীং সুবর্ণরজতস্রজাম্।চন্দ্রাং হিরণ্ময়ীং লক্ষ্মীং" (ঋক্ খিলসংহিতা ২/৬/১)। "আর্দ্রাং পুষ্করিণীং পুষ্টি পিঙ্গলাং পদ্মমালিনীম্। চন্দ্রাং হিরণ্ময়ীং লক্ষ্মীং" (ঋক্ খিলসংহিতা ২/৬/১৩) অর্থাৎ ভগবতী মহালক্ষ্মীই স্বয়ং হিরণ্ময়ী এবং পিঙ্গলা। ভাগবমে বলা হয়েছে ভগবান নারায়ণের অঙ্গে লক্ষ্মীর নিবাস। "শ্রিয়োধামাঙ্গমচ্যুতম্" (ভা০ পু০ ১/১১/২৫)। তাই উক্তমন্ত্রে পিঙ্গলবর্ণ হচ্ছে সেই ভগবতী মহালক্ষ্মী যিনি ভগবান নারায়ণের অঙ্গে বিরাজমান থেকে দ্যুতি বা হিরণ্ময় পিঙ্গলজ্যোতি প্রকাশ করেন। আর কৃষ্ণ শব্দে ভগবান নারায়ণের গাত্রবর্ণকে নির্দেশ করে। অভিধান থেকে পূর্বেই দেখনো হয়েছে যে কৃষ্ণবর্ণবাচক শব্দ হলো শ্যামবর্ণ। এবং ভগবান নারায়ণের গাত্রবর্ণ হচ্ছে অতসীপুষ্পের ন্যায় শ্যামবর্ণ। সে সম্পর্কে মহাভারতে বলা হয়েছে- "অতসীপুষ্পসঙ্কাশং পীতবাসসমচ্যুতম্" (মহা০ শা০ ৪৬/১২২)। "অতসীপুষ্পসঙ্কাশঃ পীতবাসা জনার্দনঃ" (মহা০ উদ্যো০ ৯৪/৬৫) এবং শব্দকল্পদ্রুম অবিধানে বলা হয়েছে অতসী নীলপুষ্পিকা। তাই ভগবান নারায়ণের কৃষ্ণবর্ণ বলতে অতসীপুষ্পের ন্যায় নীলশ্যামবর্ণকেই বোঝায়। অর্থাৎ শ্রুতিমন্ত্রের অর্থ দাড়ায়- যে পরব্রহ্মপুরুষের দেহ স্বর্ণাভাযুক্ত শ্যামবর্ণ।

🔥 শৈব পক্ষ থেকে বৈষ্ণবদের দাবীর খণ্ডন —

কৃষ্ণপিঙ্গলমঃ— এই বিশেষণের দ্বারা অগ্নিতে যেমন দাহকত্ব শক্তি বিদ্যমান থাকে, তেমনি শক্তির বিকাশে শিব প্রপঞ্চের রূপে পরিবর্তন হয়ে যায়। "সর্বে বৈ রুদ্রঃ" [তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/২৪/১] এই প্রকারের শ্রুতিবাক্য এই অর্থকে প্রতিপাদিত করে। এই প্রকারে শক্তি সাথে পরশিব অনেক (চিত্র) বর্ণের দ্বারা যুক্ত হওয়ার কারণে ডান পাশে কালো এবং বাম পাশে পিঙ্গল বর্ণ যুক্ত হয়। সায়ণাচার্য উনার ভাষ্যে কৃষ্ণপিঙ্গল অর্থে বলেছেন— "তত্র দক্ষিণে মহেশ্বরভাগে কৃষ্ণবর্ণঃ, উমাভাগে বামে পিঙ্গলবর্ণঃ"।
"কৃষ্ণপিঙ্গল" [তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/১২] [মহানারায়ণ উপনিষদ/২১ নং অনুবাক], [ভস্মজাবাল উপনিষদ/২/৩] যা অর্ধনারীশ্বর বিগ্রহকে প্রতিপাদিত করে।
শিবমহাপুরাণে বলা হয়েছে
অম্বিকাপতিরীশানঃ পিনাকী বৃষবাহনঃ । একো রুদ্রঃ পরং ব্রহ্ম পুরুষঃ কৃষ্ণপিঙ্গলমঃ ।।

[শিবমহাপুরাণ/বায়বীয় সংহিতা/উত্তর খণ্ড/৬ অধ্যায়/১৩ নং শ্লোক]

যিনি অম্বিকাপতি, ঈশান, পিনাকী, বৃষবাহন, সেই রুদ্রই একমাত্র পরম ব্রহ্ম পুরুষ কৃষ্ণপিঙ্গল(অর্ধনারীশ্বর) বলে বিখ্যাত।

সুতরাং, এই পদের অপব্যাখ্যা করে লক্ষ্মী দেবীকে টেনে এনে বিষ্ণুকে জোরপূর্বক হিরণ্যবর্ণ প্রমাণ করা অর্থহীন ।
কারণ, পরমেশ্বর শিব ই একমাত্র হিরণ্যবর্ণ — 

নমো হিরণ্যবাহবে হিরণ্যবর্ণায় 

হিরণ্যরূপায় হিরণ্যপতয়ে অম্বিকাপতয় 

উমাপতয়ে পশুপতয়ে নমো নমঃ॥

(কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০ম প্রপাঠক/২২ অনুবাক)

অর্থ — যার হিরণ্যবর্ণের অর্থাৎ সোনার মতো উজ্জ্বল বর্ণের আভাযুক্ত বাহু রয়েছে, যার দিব্যদেহের বর্ণ সোনার মতো উজ্জ্বল, যিনি সোনার মতো উজ্জ্বল রূপধারী, যিনি অম্বিকা অর্থাৎ শিবাদেবীর স্বামী, যিনি উমা অর্থাৎ পার্বতী দেবীর পতি সেই পশুপতি পরমেশ্বর শিবের প্রতি নমস্কার  । 

আরও দেখুন,

অথর্ববেদ -এর অন্তর্গ‌ত ভস্মজাবাল উপনিষদে

পরমেশ্বর শিবের সাকার দিব্যদেহের বর্ণনা করে বলা হয়েছে 👇

কৈলাসশিখরাবাসমোঙ্কারস্বরূপিণং মহাদেবং উমার্ধকৃতশেখরং সোমসূর্যাগ্নিনয়ন মনন্তেন্দুরবিপ্রভং ব্যাঘ্রচর্মাম্বরং মৃগহস্তং ভস্মোদ্ধূলিতবিগ্রহং তির্যক্ ত্রিপুণ্ড্ররেখা বিরাজমানভালপ্রদেশং  স্মিতসম্পূর্ণ পঞ্চবিধ পঞ্চাননং বীরাসনারূঢ়মপ্রমেয়মনাদ্যনন্তং নিষ্কলং নির্গুণং শান্তং নিরঞ্জনমনাময়ং হুং ফট্ কুর্বাণং শিব নাম অন্যনিশমুচ্চরন্তং হিরণ্যবাহুং হিরণ্যরূপং হিরণ্যবর্ণং হিরণ্য নিধিং অদ্বৈতং চতুর্থং ব্রহ্মবিষ্ণুরুদ্রাতীতমেকমাশাস্যং ভগবন্তং শিবং প্রণম্য মুহুর্মুহুরভ্যর্চ্য শ্রীফলদলৈস্তেন ভস্মনা চ নতোত্তমাঙ্গঃ কৃতাঞ্জলিপুটঃ

[অথর্ববেদ/ভস্ম জাবাল উপনিষদ /১/১]


অতএব, বৈষ্ণব দের অপব্যাখ্যা এইখানেও খণ্ডিত হয়ে গেল।
___________________________________________________

🚫 বৈষ্ণবদের মূর্খতাপূর্ণ দাবী — ৪

'উর্ধ্বরেতং' শব্দের রঙ্গরামানুজাচার্য ভাষ্য করেছেন- "বিকাররহিতোবীর্য। বিকারাৎ উত্তীর্ণতয়াক্তউর্ধ্বরেতম্"। রেতস্ অর্থ বীর্য বা বিকার। কারণ যখন কোনো জীব রেতঃপাতের দ্বারা জন্মপ্রাপ্ত হয় তখন তার বিভিন্ন বিকারের ক্রিয়া ঘটে এবং একসময় লয়প্রাপ্ত হয়। এমনকি বিশ্বও ভগবানের রেতঃপাতের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় তাই মহাভারতে বিষ্ণুসহস্রনামে ভগবান বিষ্ণুকে "বিশ্বরেতা" বলা হয়েছে। এই বিশ্ব রেতঃপাতে সৃষ্টি হয়ে প্রলয়ে ভগবানে লয় প্রাপ্ত হয় তাই এই রেতঃপাতে যাহার জন্ম বা প্রকাশ তার লয় অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু ভগবান নিজেকে রেতঃপাতের দ্বারা প্রকাশ করেন না।কারণ রেতঃপাতে জন্ম দ্বারা বোঝায় তার থেকে যিনি রেতঃদাতা তিনি সাতিশয় কিন্তু ঈশ্বর নিরতিশয়। অর্থাৎ তার থেকে বৃহৎ বা শ্রেষ্ঠ আর কিছু নেই।
"নাস্তি নারায়ণসমং ন ভূতং ন ভবিষ্যতি" (মহা০ আদি০ ১/৩৪),
"পরং হি পুণ্ডরীকাক্ষান্ন ভূতং ন ভবিষ্যতি" (মহা০ ভীষ্ম০ ৬৭/১৭),
"ন পরং পুণ্ডরীকাক্ষাদ্দৃশ্যতে ভরতর্ষভ" (মহা০ ভীষ্ম০ ৬৭/২),
"নাস্তি তস্মাৎপরতরঃ পুরুষাদ্বৈ সনাতনাৎ" (মহা০ শান্তি০ ৩৪৭/৩১)
"নারায়ণপরো দেবো ন ভূতো ন ভবিষ্যতি" (মহা০ হরিবংশ, ভবিষ্যপর্ব, ৩৩/৩৮)
যেহেতু ভগবানের থেকে শ্রেষ্ঠ আর কিছু নেই এমনকি ভগবান নারায়ণের সমতুল্য বা তার থেকে শ্রেষ্ঠ বর্তমানে নেই না ভবিষ্যতে কেউ হবে। অর্থাৎ তার তুল্য বা তার থেকে শ্রেষ্ঠ কেউ নেই তিনিই একমাত্র পরতত্ত্ব তাই ভগবান নিজেকে রেতঃদ্বারা প্রকাশ না করে স্বয়ং প্রকাশ করে তাই তিনি রেতঃ জনিত বিকার আদি থেকে রহিত অর্থাৎ রেতঃ এর উর্ধ্বে তাই ভগবানকে উর্ধ্বরেতঃ বলা হয়।

🔥 শৈব পক্ষ থেকে বৈষ্ণবদের দাবীর খণ্ডন —

ঊর্ধ্বরেতং — এই পদকে কিছু ভাষ্যকার এমন অর্থ করে যে, যোগবলের কারণ ঊর্ধ্বরেতা। কিন্তু এখানে "কৃশানুরেতাঃ সর্বজ্ঞঃ" [অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/২১] এই প্রামাণিক বাক্য দ্বারা শিবের রেতস্ অগ্নিরূপ সিদ্ধ হয়। এইজন্য "কৃশানুরেতাঃ" এমন বলা হয়েছে। এই প্রকারের অগ্নিরূপ তেজ তো লম্বাকৃতি প্রকাশযুক্ত রেখা, অতঃ পরমেশ্বর শিবকেই ঊর্ধ্বরেতা বলা হয়েছে।
শ্রুতিতে এ প্রসঙ্গে কি বলা আছে তা দেখে নেব—
"বৃষভারূঢ়ং হিরণ্যবাহুং হিরণ্যবর্ণং পশুপাশবিমোচকং পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলম্‌ ঊর্ধ্বরেতং বিরুপাক্ষং বিশ্বরূপম্‌" [ভস্মজাবাল উপনিষদ/২/৩]।
মহাভারতে বলা হয়েছে—
তুম্ববীণো মহাক্রোধ ঊর্দ্ধরেতা জলেশয়ঃ॥ [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৬/৯৯] পরমেশ্বর শিবকেই ঊর্ধ্বরেতা বলা হয়৷

___________________________________________________

🚫 বৈষ্ণবদের মূর্খতাপূর্ণ দাবী — ৫
'বিরূপাক্ষ' শব্দটি মূলত বি-রূপ-অক্ষি নিয়ে গঠিত। বি অর্থ ভিন্ন বা বিপরীত -রূপ অক্ষি। অর্থাৎ যাহার অক্ষি বিপরীত বা ভিন্নময়। বেদে বলা হয়েছে সূর্যচন্দ্র হচ্ছে ভগবানের চক্ষুদ্বয়।
"যস্য সূর্যশ্চক্ষুশ্চন্দ্রমাশ্চ পুনর্ণব" (অ০ বে০ ১০/৭/৩৩)- সূর্য এবং পুনঃ পুনঃ নতুনরূপে প্রকাশিত হয় সে চন্দ্র যাহার অক্ষি। মহাভারতেও বলা হয়েছে চন্দ্রসূর্য ভগবান নারায়ণের চক্ষুদ্বয়। "অগ্নীষোমৌ তু চন্দ্রার্কৌ নয়নে তস্য বিশ্ৰুতে" (মহাভারত, শান্তিপর্ব, ১৭৬/১৮)- অগ্নীযোম- যজ্ঞের দেবতা চন্দ্র ও সূর্য্য তাঁহার নয়নযুগল। সূর্য আমাদের তাপ প্রদান করে এবং চন্দ্র শীতলতা প্রদান করে। অর্থাৎ বিপরীতধর্মী তাই ভগবানের চক্ষুদ্বয়কে বিরূপাক্ষ বলা হয়েছে। শাস্ত্রে ভগবান নৃসিংহদেবকে ত্রিনেত্রও বলা হয়েছে চন্দ্রসূর্যঅগ্নি ভগবান নৃসিংহদেবের নয়ন তাই ত্রিনেত্র। এই রূপ অদ্ভুত-বিরূপ অক্ষির জন্য ভগবান বিরূপাক্ষ।

🔥 শৈব পক্ষ থেকে বৈষ্ণবদের দাবীর খণ্ডন —
বিরূপাক্ষ, ত্রিলোচনঃ— এই পদে "মহাদেবো বিরূপাক্ষস্ত্রিলোচনঃ" [অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/২১] এই কোষ বাক্যের অনুসারে, মহাদেব সম্পূর্ণ জগতের আধারভূত সূর্য, চন্দ্র আর অগ্নি নেত্র সম্পন্ন
বেদের ভস্মজাবাল উপনিষদ/১/১ -মন্ত্রে পরমেশ্বর শিবের ত্রিনয়ন কে সূর্যচন্দ্র অগ্নি বলা হয়েছে — “কৈলাসশিখরাবাসমোঙ্কারস্বরূপিণং মহাদেবং উমার্ধকৃতশেখরং সোমসূর্যাগ্নিনয়ন মনন্তেন্দুরবিপ্রভং ব্যাঘ্রচর্মাম্বরং মৃগহস্তং ভস্মোদ্ধূলিতবিগ্রহং..
পুরাণেও একই সমর্থন—
"অগ্নিঃ সোমশ্চ সূর্য্যশ্চ লোচনেষু ব্যবস্থিতাঃ"
[স্কন্দমহাপুরাণ/প্রভাস খণ্ড/ক্ষেত্রমাহাত্ম্য/অধ্যায় ৯/১২]
পরমেশ্বর শিবের লোচনে অগ্নি, চন্দ্র ও সূর্য অবস্থিত।।
ত্রিলোচন-পুং ত্রি (তিন) লোচন ইহার। অর্থাৎ যিনি তিন চোখ বিশিষ্টি।
"তথাদিউমাসহাযং পরমেশ্বরং প্রভুং ত্রিলোচনং নীলকণ্ঠং প্রশান্তম্"
[কৈবল্য উপনিষদ/১/৭]
কৈলাসশিখরাভাসা হিমবদিগরিসংস্থিতা ।
নীলকন্ঠং ত্রিনেত্রং চ তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমন্ত্র ॥২৫
"
(সর্বদেবাত্মক কৈলাসবাসী) শিবের প্রতি মন সংকল্পিত হউক। যিনি হিমগিরি কৈলাস শিখরে বাস করেন, যিনি (সাকারে) নীলকন্ঠ, যিনি ত্রিনেত্র সেই শিবের প্রতি মন সঙ্কল্পিত হউক।
সিদ্ধান্ত - এক শিবই ত্রিদেবরূপে প্রকট হয়েছেন। মূল সত্ত্বা সেই শিবই, যার প্রত্যক্ষ সাকার রূপ হল- ত্রিনেত্রধারী ও নীলকন্ঠ (সদাশিব)।
[ঋগ্বেদোক্ত শিবসংল্পসূক্ত/ঋগ্বেদ সংহিতা/খিলানি/চতুর্থ অধ্যায়/১১ নং খিলা] [ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১]
জগৎ সৃষ্টান্তকর্তারমজমব্যক্তরূপিণম্
আধারং সর্বলোকানামারাধ্যং পরমং গুরুম্।। ২
তে সমেতা তু কামারিং ত্রিপুরারিং ত্রিলোচনম্।
উচুঃ প্রাঞ্জলয়ো দেবা ভয়গদগদভাষিণঃ।।৩

[গীতাপ্রেস/বাল্মিকী রামায়ণ/উত্তরকাণ্ড/৬ষ্ট সর্গ]
যিনি জগতের সৃষ্টি ও সংহারকারী, অজন্মা, অব্যক্ত-রূপধারী, সমগ্র জগতের আধার, আরাধ্য দেব এবং পরম গুরু, সেই কামনাশক, ত্রিপুরবিনাশক, ত্রিনেত্রধারী ভগবান শিবের কাছে গিয়ে এই সকল দেবতাগণ হাত জোড় করে ভয়ে গদগদভাবে বললেন।।
মহাভারতে বলা হয়েছে—
"দশবাহুস্তুনিমিষো নীলকণ্ঠ উমাপতিঃ"।। [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৬/৪১]

এছাড়া নীলকণ্ঠ অর্থে একমাত্র শিবকেই বোঝায় কেননা, "নীলকণ্ঠঃ শিবেহপি চ" [অমরকোষ/নানার্থ-বর্গঃ/১২৪] উক্ত কোষ প্রমাণ দ্বারা নীলকণ্ঠ পদ দ্বারা শিবকেই বোঝায়, অন্যকোনো দেবতাকে নয়।
"লোচনং নয়নং নেত্রমীক্ষণং চক্ষুরক্ষিণী। দৃগদৃষ্টী চা" [অমরকোষ/মনুষ্য-বর্গঃ/২৭১]। এই কোষ বাক্য দ্বারা লোচন হলো এমন বস্তু যার দ্বারা অন্যবস্তু দৃষ্টিগোচর হয় অর্থাৎ তাহা দেখা যায়। যা সরাসরি চোখকেই নির্দেশ করে। আর ত্রি কথার অর্থ তিন। ত্রিলোচন অর্থাৎ যিনি তিন চোখ বিশিষ্ট।

এছাড়া,
মহানারায়ণ উপনিষদ/ অনুবাক ২৩
ঋতং সত্যং পরং ব্রহ্ম পুরুষং কৃষ্ণ পিঙ্গলম্‌।
ঊর্ধ্বরেতং বিরূপাক্ষং বিশ্বরূপায় বৈ নমো নমঃ।।

পরবর্তী অনুবাকে বলা হয়েছে—

সর্বো বৈ রুদ্রস্তস্মৈ রুদ্রায় নমো অস্তু।
পুরুষ বৈ রুদ্রঃ সন্মহো নমো নমঃ।।

এবার ঋত, কৃষ্ণপিঙ্গল, উর্ধ্বরেত, বিরূপাক্ষ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে বৈষ্ণবদেরই ভাবার বিষয়। নাহলে , বৈষ্ণবেরা মহানারায়ণ উপনিষদকে প্রক্ষিপ্ত ঘোষণা করে দিক।

এই প্রকারের মন্ত্রে অন্তর্গত ঋত, সত্য, পুরুষ, কৃষ্ণপিঙ্গল, ঊর্ধ্বরেতস্, বিরূপাক্ষ, বিশ্বরূপ এই সব বিশেষণ শিবের মধ্যে অবস্থিত অসাধারণ গুণকে বোধিত করে। অতঃ দেহ পুণ্ডরীকে উপাসনা করা বস্তু শক্তিবিশিষ্ট পরশিবই, না কি দ্বিতীয় কোনো বস্তু, এই বাক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। [যাস্ক নিরুক্ত/৭/৩/১০/১২] অনুযায়ী, দেবতা বোধক রূঢ় নামেরই কর্মবিধায়ক শব্দগুলি বিশেষণ হয়ে থাকে। অর্থাৎ গুণ ও কর্ম দেবতার বিশেষণ। সুবন্তপদের, বিশেষ্যের বিশেষণ অর্থে।
___________________________________________________

🚫 বৈষ্ণবদের মূর্খতাপূর্ণ দাবী — ৬

'শঙ্করং' শব্দটি হচ্ছে (শম্+ কর)। 'শম্ করোতি ইতি শঙ্করঃ'
যিনি শম্ অর্থাৎ শান্তি করেন তিনি শঙ্কর। ভগবান নারায়ণ ভক্তদের শান্তি প্রদান করেন বিধায় তিনি শঙ্কর। সে সম্পর্কে শিবজী হরিবংশে(ভবিষ্যপর্ব ৮৮/৪৫) বলছেন- "শঙ্করোহসি সদা দেব ততঃ শঙ্করতাং গতাঃ"- ভগবান বিষ্ণু আপনি সদা শম্(কল্যাণ/শান্তি) প্রদান করেন তাই শঙ্কর নামে প্রসিদ্ধ।

🔥 শৈব পক্ষ থেকে বৈষ্ণবদের দাবীর খণ্ডন —

শঙ্করম্ — শঙ্কর অর্থাৎ যিনি সবার কল্যাণ করেন। "ঈশ্বর সর্ব্ব ঈশানঃ শঙ্করশ্চন্দ্রশেখরঃ" [অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/২১] পরমেশ্বর শিবই সবার কল্যাণ করেন। যেখানে পরমেশ্বর শিবকে পরম ঈশ্বর, ঈশান, চন্দ্রশেখর বলা হয়েছে। উক্ত কোষ প্রমাণ দ্বারা এটাই সিদ্ধ হয় যে, চন্দ্রশেখর শিবই শঙ্কর, যিনি সবার কল্যাণ করেন।
শ্রুতিতে শঙ্কর বলতে পরমেশ্বর শিবকেই স্পষ্টভাবে বোঝানো হয়েছে—
নমঃ শঙ্করায় চ ময়স্করায় চ। নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ ৷৷
[শুক্ল-যজুর্বেদ/অধ্যায় ১৬/৪১]
কল্যাণকারী শিবকে নমস্কার; শিবস্বরূপকে নমস্কার; অত্যন্ত সুখস্বরূপ রুদ্রকে নমস্কার।।
শ্রুতিতে পরমেশ্বর শিব সম্পর্কে আরও কি বলছে তা দেখে নেব —
"কৈলাসশিখরে রম্যে শংকরস্য শুভে গৃহে।
দেবতাস্তত্র মোদন্তি তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু।।২৪।।
[ঋগ্বেদ সংহিতা/খিলানি/চতুর্থ অধ্যায়/১১ নং খিলা]
কৈলাস পর্বত শিখরে শিব শংকরের ভবনে সমস্ত দেবতাগণ (ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, ইন্দ্রাদি) বিচরণ করছেন। সেই (সর্বদেবাত্মক কৈলাসবাসী) শিবের প্রতি মন সংকল্পিত হউক।।

পুরাণে কি বলা হচ্ছে তাও একবার দেখে নেব—
স এব শঙ্করঃ সাক্ষাৎ সর্বানুগ্রহকারকঃ।
কর্তা ভর্তা চ হর্তা চ সাক্ষী নির্গুণ এব সঃ ॥২৪
[শিবমহাপুরাণ/কোটিরুদ্রসংহিতা/৪২নংঅধ্যায়]
তিনিই সবার ওপর অনুগ্রহকারী সাক্ষাৎ শংকর। কর্তা, ভর্তা, হর্তা, সাক্ষী এবং নির্গুণও তিনিই ॥২৪
মহাভারতে বলা হয়েছে — 
বহুধানিন্দিতঃ শর্বঃ শঙ্করঃ শঙ্করোহধনঃ।।
[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৬/১০২]
টীকা — শং ভক্তানাং মঙ্গলং করোতীতি শঙ্কর।। 

শঙ্কর হলো পরমেশ্বর শিবই, কেননা শঙ্কর শিবের একটা নাম বটে এবং পরমেশ্বর শিব সবার কল্যাণ করেন তাই পরমেশ্বর শিব হলো শঙ্কর। যার উল্লেখ আমি শুরুতেই করেছি। যদি অন্যান্য শাস্ত্র থেকে প্রমাণ দিতে থাকি তাহলে এই প্রমাণের খেলা শেষ হবে না। তাই সাক্ষাৎ শ্রুতি যেখানে শঙ্কর বলতে পরমেশ্বর শিবকে বোধিত করছে সেখানে অন্য কোনো মত মান্যতা পাবে না। কারণ শ্রুতির বচনই সর্বোচ্চ ও অকাট্য।


___________________________________________________

🚫 বৈষ্ণবদের মূর্খতাপূর্ণ দাবী — ৭

'নীললোহিতম্' এখানে নীল শব্দের পর্যায়বাচী শব্দ শ্যাম তা ইতিমধ্যে প্রদর্শিত হয়েছে। লোহিত রক্তবর্ণবাচক শব্দ। "রোহিত লোহিত রক্তঃ" (অমরকোষ/১ম খণ্ড/ ধীবর্গ/ ১৫)। ভগবান নারায়ণের গাত্রবর্ণ যে শুধুই অতসীপুষ্পের ন্যায় শ্যাম বর্ণ এমনটা নয় শাস্ত্রে নবঘনমেঘের ন্যায় শ্যামবর্ণ বলেও বর্ণিত হয়েছে। হরিবংশে(ভবিষ্যপর্ব ৪৭/১২) ভগবান নৃসিংহের বর্ণ সম্পর্কে বলা হয়েছে "জীমূতঘনসঙ্কাশো"- ঘনমেঘের সমান রূপবান। নবঘন মেঘশ্যাম ভগবান নৃসিংহ হিরণ্যকশিপুকে বজ্রনখ দ্বারা উদর বিদীর্ণ করে তাহার রক্তে দেহের উর্দ্ধভাগ মুখমণ্ডল ও কেশদ্বয় রক্তিমবর্ণ ধারণ করেছিলো। " অসৃগলবাক্তারুণকেসরাননো" (ভাগবতম্ ৭/৮/৩০)- ছিটকে এসে পড়া রক্তকণায় তাঁর মুখ ও কেশর রক্তিমবর্ণ ধারণ করেছিল। ভগবান নৃসিংহের নীলমেঘ স্বরূপ হিরণ্যকশিপুর রক্তে রঞ্জিত হয়ে নীল ও লোহিত বর্ণের মিশ্রণে নীললোহিত হয়। এজন্য ভগবান নৃসিংহ নীললোহিত।

🔥 শৈব পক্ষ থেকে বৈষ্ণবদের দাবীর খণ্ডন —

নীললোহিত — "ধূর্জটিনীললোহিতঃ" পুং (নীললোহিত+অৎ, অস্তর্থ্যে) নীল এবং লোহিত বর্ণ আছে ইহার। কণ্ঠে নীলবর্ণ কেশে লোহিত বর্ণ আছে বলিয়া শিবকে নীল লোহিত বলে [অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/২১]। আর ধূর্জটি-পুং ধূ (গঙ্গা) জটাতে ইহার। অথবা ধুরের (শকটাদির অগ্রভাগের) ন্যায় জটা যাহার। অর্থাৎ গঙ্গাকে যিনি জটাতে ধারণ করে তিনিই যে শিব তা আলাদা করে প্রমাণ করতে হয় না। কারণ তা সর্ব শাস্ত্র প্রতিপাদ্য বিষয়। আর শিব যে জটাধারী তারও আলাদা প্রমাণ লাগে না।
তারপরেও ছোট্ট একটা প্রমাণ দিয়ে রাখি —
ত্যুক্তস্তু সুরৈঃ সর্বৈঃ কপর্দী নীললোহিতঃ।
সুকেশং প্রতি সাপেক্ষঃ প্রাহ দেবগণান্ প্রভুঃ। ৯

[গীতাপ্রেস/বাল্মিকী রামায়ণ/উত্তরকাণ্ড/৬ষ্ট সর্গ]
সমস্ত দেবতা একথা বলায় নীল ও লোহিত বর্ণ বিশিষ্ট জটাজুটধারী ভগবান শংকর সুকেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাবশতঃ তাঁদের একথা বললেন।।

মহাভারতে বলা হয়েছে—
ত্বং নো গতিশ্চ শ্রেষ্ঠশ্চ ত্বমেব হৃদয়ং তথা।
ত্বং ব্রহ্মা সর্ব্বদেবানাং রুদ্রাণাং নীললোহিতঃ।।
[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব্ব/অধ্যায়/১৩/৩১৫]
আপনি (মহাদেব) আমার গতি, আপনিই হৃদয়স্থিত জীবাত্মা ও সর্বশ্রেষ্ঠ এবং আপনি সমস্ত দেবতার মধ্যে ব্রহ্মা ও রুদ্রগণের মধ্যে নীললোহিত ॥

শ্রুতিতেও পরমেশ্বর শিবকে নীলবর্ণকেশযুক্ত বলা হয়েছে—

"অস্ত্রা নীলশিখণ্ডেন সহস্রাক্ষেণ বাজিনা" [অথর্ববেদ/১১/১/৫/৭]।।


___________________________________________________

🚫 বৈষ্ণবদের মূর্খতাপূর্ণ দাবী — ৮

'উমাপতি' উমা শব্দটি মূলত 'ঊমম্' শব্দের সাথে বহুবচনে 'আ' যোগ হয়ে উমা শব্দ তৈরি হয়। "উমম্" শব্দের ব্যুৎপত্তি সম্পর্কে উনাদিসূত্রে(১/১৪৪)- "অবিসিবিসিশুষিভ্যঃ কিৎ"- অব, সিব, সি, শুষ এই ধাতুর পরে মন্ প্রত্যয় হয়। তথা সেই প্রত্যয় কৃৎসজ্ঞক হয়। কৃৎকরণের প্রয়োজন গুণনিষেধ।
"অব" ধাতুর সহিত মন্ প্রত্যয় যোগে ঊমম্ শব্দ নিপাতিত হয়। "অব্ কান্তি" (পাণিনি ধাতুপাঠ ১/৬৪৮) অর্থাৎ ঊমম্ অর্থ কান্তি। উমা শব্দের অর্থও ব্যুৎপত্তি অনুসারে কান্তি। তাই অভিধানেও উমা শব্দের অর্থ কান্তি বলা হয়েছে। সেই উমাপতি বলতে কান্তি বা সৌন্দর্যের অধিপতি। কান্তি শব্দ লক্ষ্মী শব্দেরই পর্যায়ভুক্ত শব্দ। কারণ ভগবতী মহালক্ষ্মীই সকল কান্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী। যিনি নারায়ণের অঙ্গকে আশ্রয় করিয়া কান্তি/ দ্যুতি /শোভা প্রকাশ করে। তাই অথর্ববেদে সেই পরমপুরুষ নারায়ণকে কান্তিমান বলা হয়েছে।
"মহদ্ যক্ষং ভুবনস্য মধ্যে তপসি ক্রান্তং সলিলস্য পৃষ্ঠে"
(অথর্ববেদ ১০/৭/৩৮)- এই বিশ্বে একজন পরমপূজ্য রয়েছে, যিনি সলিলের উপরে কান্তিমান হোন এবং তপঃ দ্বারা যাকে প্রাপ্ত করতে হয়।
তাই উমাপতি অর্থে ভগবান নৃসিংহ কান্তির যিনি অধিপতি।

🔥 শৈব পক্ষ থেকে বৈষ্ণবদের দাবীর খণ্ডন —

উমাপতিঃ— "স্থাণুরুদ্র উমাপতিঃ[অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/২১]
স্থাণু-পুং {স্থা+ণু, কর্ত্তৃ} (প্রলয়কালেও) থাকে যে।
রুদ্র-পুং {রুদ্ + রক্, কর্ত্তৃ} (ব্রহ্মার অনুরোধে জন্মগ্রহণ করিয়া) রোদন করিয়াছে যে। অথবা{রুজ্-দ্রু+ড, কর্তৃ} রুজ (কষ্ট) নাশ করে যে। 
উমাপতি-পুং উমার পতি। অর্থাৎ উমার পতি হলো রুদ্র।
তাছাড়া— "উমা কাত্যায়নী গৌরী কালী হৈমবতীশ্বরা। শিৰা ভবানী রুদ্রাণী সর্ব্বাণী সর্ব্বমঙ্গলা। অপর্ণা পার্ব্বতী দুর্গা মৃড়াণী চণ্ডিকাম্বিকা"
[অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/২৮] ইত্যাদি কোষ বাক্য অনুযায়ী উমাপতি অর্থে পরমেশ্বর শিবকেই বোধিত করে। কারণ উমা বলতে মাতা পার্বতীকেই স্পষ্ট ভাবে বোধিত করেছে। এবং শ্রুতিরও এই মান্যতা যে উমাপতি বলতে পরমেশ্বর শিবকেই বোঝায়। অর্থাৎ যিনি মাতা পার্বতীর পতি বা ভর্তা/স্বামী।
উমার্ধদেহং বরদং সর্বকারণ কারণম্।
আকাশধারণাত্তস্য খেচরত্বং ভবেদ্ধ্রুবম্।।১০১

[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/যোগতত্ত্ব উপনিষদ]
যিনি পরাম্বিকা উমাকে নিজের অর্ধদেহে ( বামভাগে ) ধারণ করেছেন , সেই বরদাতা পরমেশ্বর সদাশিবই অখিল চরাচরের সমস্ত কারণের একমাত্র কারণ।৷
"হিরণ্যরূপায় হিরণ্যপতয়ে অম্বিকাপতয়
উমাপতয়ে পশুপতয়ে নমো নমঃ।
"
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০ম প্রপাঠক/২২ অনুবাক]
অর্থ- যার হিরণ্যবর্ণের অর্থাৎ সোনার মতো উজ্জ্বল বর্ণের আভাযুক্ত বাহু রয়েছে, যার দিব্যদেহের বর্ণ সোনার মতো উজ্জ্বল, যিনি সোনার মতো উজ্জ্বল রূপধারী, যিনি অম্বিকা অর্থাৎ শিবাদেবীর স্বামী, যিনি উমা অর্থাৎ পার্বতী দেবীর পতি সেই পশুপতি পরমেশ্বর শিবের প্রতি নমস্কার।
"তথাদিউমাসহাযং পরমেশ্বরং প্রভুং ত্রিলোচনং নীলকণ্ঠং প্রশান্তম্" [কৈবল্য উপনিষদ/১/৭]

মহাভারতে বলা হয়েছে—
ততো ধ্যাত্বা চ ভগবান্ ব্রহ্মা তমমিতৌজসম্।
অযং শ্রেষ্ঠ ইতি জ্ঞাত্বা ববন্দে তম্ উমাপতিম্ ॥৩৪
[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩৮/৩৪]
তাহার পর ভগবান্ ব্রহ্মা ধ্যান করিয়া ইনি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ এইভাবে অমিততেজা সেই বালকটাকে উমাপতি মহাদেব জানিয়া নমস্কার করিলেন ॥৩৪৷৷
আরও বলা আছে—
দশবাহুস্তুনিমিষো নীলকণ্ঠ উমাপতিঃ।।
[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৬/৪১]
পরমেশ্বর শিব সাকারে দশহাত বিশিষ্ট, যিনি নীলকণ্ঠ, যিনি উমার পতি (বর/ভর্তা)।

___________________________________________________

🚫 বৈষ্ণবদের মূর্খতাপূর্ণ দাবী — ৯

'পশুপতি' এখানে পশু শব্দের ব্যুৎপত্তি সম্বন্ধে উনাদিসূত্রে(১/২৭) বলা হয়েছে-
"অর্জিদৃশকম্যমিপংসিবাধামৃজিপশিতুক্ ধুক্ দীর্ঘহকারশ্চ।"
অনুবাদ: অর্জ্, দৃশ্, কম্, অম্, পংস্, বাধ্ এইসকল ধাতু সহিত কু প্রত্যয় হয়। সূত্রোক্ত ধাতু স্থানে ঋজ্, পশ্, তুক্, ধুক্, দীর্ঘ হকার দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে।
এখানে 'অর্জি বাধাম্' যা ষষ্ঠ্যন্ত পদ, যেখানে ষষ্ঠী যোগ। এই স্থানে 'ঋজ্' আদি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহাতে 'ঋজ্, পশ্' দুই আদেশ। দৃশ ধাতু অর্থ "দৃশ প্রেক্ষণে" (পাণিনি ধাতুপাঠ ১/১১৪৩) অর্থাৎ দৃশ ধাতু অর্থ দর্শন করা। দৃশ ধাতুতে পশ্ আদেশে কু প্রত্যয় যোগে পশু শব্দ নিপাতিত হয়েছে। দৃশ কু--- পশ্ উ সু। "যঃ চক্ষুষা পশ্যতি স ইতি পশুঃ"- যে চক্ষু দ্বারা দেখে সেই পশু।(মানুষ, গবাদিপ্রাণী,জীবজন্তু ইত্যাদি)। আবার যাস্কাচার্যও দর্শনার্থে পশু শব্দ উল্লেখ করে- " পশুঃ পশ্যতেঃ"(নিরুক্ত ৩/১৬/১২) তাছাড়া যাস্কাচার্যের(নিরুক্ত ১১/২৯/২) মতে পশু অর্থের আরেক অর্থ হলো-
"দেবীং বাচমজনয়ন্ত দেবাস্তাং সর্ব্বরূপাঃ পশবো বদন্তি ব্যক্তবাচা- ব্যক্তবাচশ্চ"- যে উদকদাত্রী মাধ্যমিকা বাক্‌কে দেবগণ সৃষ্টি করিয়াছেন, সর্ববিধ পশু যা বলে বা উচ্চারণ করে- ব্যক্ত বা পরিস্ফুট বাক্ যাহাদের ঈদৃশ মনুষ্যাদি এবং অব্যক্ত বা অপরিস্ফুট বাক্ যাহাদের ঈদৃশ গবাদি)
যে বাক্ কে দেবগণ সৃষ্টি করিয়াছে, পশুগণ তা বলে উচ্চারণ করে (কথা বলে) ব্যক্তভাবে(মানুষ, দেবগণ, ঋষিগণ, অসুর) এবং অব্যক্তভাবে (গবাদিপশু) ইত্যাদি। অর্থাৎ যাস্কমতে পশু হলো যে উচ্চারণ করে বাক্য দ্বারা পরিস্ফুট বা অপরিস্ফুট মানুষ, গবাদি ইত্যাদি সকল জীবকেই বুঝায়। অন্যদিকে ব্যুৎপত্তি নির্ণয়ের দিক থেকে যে দর্শন করে সেই পশু। অর্থাৎ দেব,মানুষ,গবাদিপ্রাণী সকল জীবই পশু। আর তাদের যিনি স্বামী পতি তিনিই পশুপতি।

🔥 শৈব পক্ষ থেকে বৈষ্ণবদের দাবীর খণ্ডন —

পশুপতিঃ— পুং পশুর (ইন্দ্রাদি কীট পর্য্যন্তের) পতি।
"শম্ভুরীশঃ পশুপতিঃ শিবঃ শূলী মহেশ্বরঃ" [অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/২১] ইত্যাদি কোষ বাক্য অনুযায়ী পরমেশ্বর শিবই হচ্ছেন পশুপতি। এই পশুপতির বিস্তারিত অর্থ পুরাণ, ইতিহাস শাস্ত্রে তো ভুড়ি-ভুড়ি বলা আছে। এবং সব শাস্ত্রের এটাই মান্যতা পরমেশ্বর শিবই পশুপতি। এমনকি শ্রুতিতেও পরমেশ্বর শিবকে পশুপতি নামে স্তুতি করা হয়েছে— "নমঃ শৰ্বায় চ পশুপতয়ে চ" [শুক্ল-যজুর্বেদ/অধ্যায় ১৬/২৮], "উমাপতয়ে পশুপতয়ে নমো নমঃ"
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০ম প্রপাঠক/২২ অনুবাক] "পশুপাশবিমোচকং" [ভস্মজাবাল উপনিষদ/২য় অধ্যায়], "নমো রুদ্রায় পশুপতয়ে স্বাহা" [তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/৬৭] এবং একি মন্ত্র রয়েছে [মহানারায়ণ উপনিষদ/৭৬/১]। তাছাড়া শ্রুতিতে পরমেশ্বর শিবকে দ্বিপদ ও চতুষ্পদ পশুর অধিপতি বলা হয়েছে—
ভবাশবৌ মন্ধে বাং তস্য বিত্তং যয়োর্বামিদং প্রদিশি যদ বিরোচতে। যাবস্যেশাথে দ্বিপদো যৌ চতুষ্পদন্তৌ নো মুঞ্চতমংহসঃ ॥ ১ ॥যাবস্যেশাথে দ্বিপদেরা যৌ চতুষ্পদন্তৌ নো মুঞ্চতমংহসঃ।২।। যাবস্যেশাথে দ্বিপদো যৌ চতুষ্পদস্তৌ না মুঞ্চতমংহসঃ। ৩।। বস্যেশাথে দ্বিপদো যৌ চতুষ্পদন্তৌ নো মুঞ্চতমংহসঃ ৪।।
[অথর্ববেদ/৪র্থ কাণ্ড/৬ষ্ট অনুবাক/৩য় সুক্ত]

আরও কিছু শ্রুতি প্রমাণ দেখে নেবো—
ভবাশবৌ মৃড়তং মাভি যাতং ভূতপতী পশুপতী নমো বাম্। প্রতিহিতামায়তাং মা বি দ্রাষ্টং মা নো হিংসিষ্টং দ্বিপদো মা চতুষ্পদঃ ॥ ১।। মুখায় তে পশুপতে যানি চক্ষুংষি তে ভব। ত্বচে রূপায় সন্দশে প্রতীচীনায় তে নমঃ ॥ ৫।। চতুর্নমো অষ্টকৃত্বো ভবায় দশ কৃত্বঃ পশুপতে নমস্তে।।৯।।
[অথর্ববেদ/১১/১/৫],
"স নো মৃড় পশুপতে নমস্তে পরঃ ক্রোষ্টারো অভিভাঃ" [অথর্ববেদ/১১/১/৫/৬]
"তব যক্ষং পশুপতে অশ্বস্তত্তুভ্যং ক্ষরন্তি দিব্যা আপো বৃধে[অথর্ববেদ/১১/১/৫/৬]
উপরোক্ত শ্রুতিতে পরমেশ্বর শিবকেই পশুপতি বলেছেন। যিনি ব্রহ্মাদিদেবতা থেকে কীট পর্যন্ত সকল পশুর অধিপতি, যিনি সকল জীবকে পশুপাশ থেকে মুক্ত করেন বলে যাকে "পশুপাশবিমোচকং" বলা হয় শ্রুতিতে।
মহাভারতে বলা হয়েছে—
তত ঊচুৰ্ম্মহাত্মানো দেবাঃ সর্বে সমাগতাঃ।
রুদ্র! রৌদ্রা ভবিষ্যন্তি পশবঃ সর্বকর্মাসু ॥২৬৷৷

[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩৮/২৬]
তদনন্তর উপস্থিত মহাত্মা দেবতারা সকলে মহাদেবকে বলিলেন, রুদ্র! রুদ্রই সমস্ত কার্য্যের পশুগণের দেবতা হইবে ॥২৬৷৷

আরও বলা আছে—
সর্বথা যৎ পশূন্ পাতি তৈশ্চ যদ্রমতে সহ।
তেষামধিপতির্যচ্চ তস্মাৎ পশুপতিঃ স্মৃতঃ ॥১৩৷৷
[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩৯/১৩]
যে হেতু মহাদেব সর্বপ্রকারে পশুদিগকে বক্ষা করেন এবং যে হেতু পশুদিগের সহিত ক্রীড়া করিয়া থাকেন; কিংবা যে হেতু তিনি পশুগণের অধিপতি, সেই হেতু তিনি পশুপতিনামে অভিহিত হন ॥১৩৷।
আরও দেখে নেব—
লোককর্তা পশুপতিৰ্ম্মহাকর্তা হানৌষধঃ ॥ [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৬/৭৯] টীকা—"পশূনাং প্রাণিনাং পতিঃ পাতা রক্ষকঃ"

এসব ছাড়াও পরমেশ্বর শিবই যে পশুপতি তার স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় শতপথ ব্রাহ্মণে। যেখানে পরমেশ্বর শিবকে "পশুনাং পতিঃ" বলা হয়েছে [শতপথ ব্রাহ্মণ/১/৬ষ্ট প্রপাঠক/১ম ব্রাহ্মণ/১/২/৩/৮]। তার থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, পরমেশ্বর শিবই 'ব্রহ্মা থেকে কীট' পর্যন্ত সকলে অধিপতি।
আর বেশ কিছু শাস্ত্র প্রমাণ দেখে নেওয়া যাক—
"পশুপতয়ে রুদ্রায়" [আশ্বলায়ণ গৃহ্যসূত্র/৪/১/২০],
"রুদ্রায় পশুপতয়ে" [শতপথ ব্রাহ্মণ/৫/৩/৩/৬],
"রুদ্রায় পশুপতয়ে" [শুক্ল-যজুর্বেদ/মধ্যন্দিন সংহিতা/২৪/৩],
"রুদ্রায় পশুপতয়ে" [মৈত্রায়ণী সংহিতা/৩/১৩/৪],
"রুদ্রায় পশুপতয়ে" [মৈত্রায়ণীসংহিতা/কাণ্ড ২/প্রপাঠক ৬],
"রুদ্রায় পশুপতয়ে" [শাঙ্খায়ন শ্রৌতসূত্রম্‌/অধ্যায় ৯],
"পশুপতয়ে দেবায় স্বাহা রুদ্রায়" [বৌধায়ন গৃহ্যসূত্রম্‌/প্রশ্ন ২] "রুদ্রায় স্বাহা পশুপতয়ে" [সামবেদ/কৌথুমীয়া/ষড়বিংশ ব্রাহ্মণ/অধ্যায় ৬/১১]

উক্ত সমস্ত শাস্ত্র প্রমাণ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় - বিষ্ণু নয়, বরং একমাত্র পরমেশ্বর শিবই পশুপতি পদবাচ্য
___________________________________________________

🚫 বৈষ্ণবদের মূর্খতাপূর্ণ দাবী — ১০

'পিনাকী' শব্দ পিনাক শব্দের সাথে অস্ত্যর্থে 'ইন্' যোগ হয়ে পিনাকী শব্দ সাধিত হয়। "অকম্= দুঃখঃ, তদ্বিরুদ্ধা গুণাঃ নাকম্। নাকম্ ইতি আনন্দঃ সুখঃ। পিবন্তি যে নরা নাকং মুক্তাঃ সংসারসাগরাৎ । তদাধারো যতো বিষ্ণুঃ পিনাকীতি ততঃ শ্রুতঃ।।" - অক শব্দের অর্থ দুঃখ, তার বিরুদ্ধ গুণ নাক। নাক শব্দের অর্থ আনন্দ,সুখ। সংসার সাগর থেকে মুক্ত জীব তাকে আশ্রয় করে ব্রহ্মসুখ আস্বাদন করে তাই তাকে পিনাকী বলা হয়। (নাকং অর্থাৎ ব্রহ্মসুখ, পিবন্তি যে নরা নাকং পিনাকী)
অন্য অর্থে পিনাকী শব্দের ব্যাখ্যা হচ্ছে-
"পিনাক ধারয়তি ইতি পিনাকীঃ"। ভগবান নৃসিংহ পিনাক ধারণ করেন বিধায় তিনি পিনাকী। সে সম্পর্কে নারদীয় পুরাণে (১/৭১/১৩৪) বর্ণিত হয়েছে- " পিনাকপাণে শীতাংশুশেখর রমেশ্বর পাহি বিষ্ণো।"
ব্যুৎপত্তি অনুসারে পিনাক শব্দের অর্থ সম্পর্কে উনাদিসূত্রে (৪/১৬) বলা হয়েছে-
"পিনাকাদ্বয়শ্চ"- আক প্রত্যয় তথা নিৎ অতিদেশ এর প্রকরণ। পিনাকাদি শব্দ আক প্রত্যয়ান্তে নিপাতিত এবং অদ্যুদাত্ত স্বর হয়।
আক প্রত্যয়ের পূর্বে "পা"(পা রক্ষণে ইতি ধাতোঃ ২/৫১) ধাতুর সাথে "আক" প্রত্যয় যোগে নুক আগমে ধাতুকে ইকার অন্তাদেশ এ পিনাক শব্দ নিপাতিত তার সাথে অস্ত্যর্থে 'ইন্' যোগ হয়ে পিনাকী শব্দ গঠিত। অর্থাৎ, ভগবান নৃসিংহ ভক্তদের ও সাধুদের সর্বদা রক্ষা করেন বিধায় তিনি পিনাকী।


🔥 শৈব পক্ষ থেকে বৈষ্ণবদের দাবীর খণ্ডন —


পিনাকী — যাস্ক নিরুক্ত অনুযায়ী,
রস্তঃ পিনাকমিতি দণ্ডস্য [নিঘন্টু/৩/২০/২২] রস্ত ও পিনাক ব্দদয় দণ্ডার্থক। 
[নিঘন্টু/৩/২০/২৬] পিনাকং প্রতিপিনষ্ট্যেনেন" পিনাক শব্দের ব্যুৎপত্তি এই যে এর দ্বারা সংহার বা হনন করা হয়।
ব্যাখ্যাঃ— পিনাক শব্দের ব্যুৎপত্তি প্রদর্শন হচ্ছে। হিংসার্থক 'পিষ' ধাতুর উত্তর 'আর্ক' প্রত্যয় করে পিনাক শব্দের নিষ্পত্তি। পিষাক, পিনাক ইহারা দ্বারা শত্রু সংহার করা হয়।
[নিঘন্টু/৩/২০/২৭] "অবততধন্বা পিনাকহস্তঃ কৃত্তিবাসাঃ
অবরোপিত ধনুর্ধারী বা জ্যামুক্ত ধনুর্ধারী। পিনাহস্ত হাতে ধনুক ধারণ করেন যিনি। কৃত্তিবাসা যিনি চর্মাম্বরপরিহিত। 
বেদে রয়েছে—"মীডুষ্টম শিবতম শিববা নঃ সুমনা ভব। পরমে বৃক্ষ আয়ুধং নিধায় কৃত্তিং বসান আ চর পিনাকং বিভ্ৰদা গহি শিব পিনাকধারী কৃত্তিবাসা [যজুর্বেদ/অধ্যায়/১৬/৫২]। ও যজুর্বেদ ৩/৬১ মতে শিবই পিনাকধারী ও কৃত্তিবাসা। এছাড়া শব্দকোষ অভিধানে বলা আছে যে- "কৃত্তিবাসাঃ পিনাকী" [অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/২১]
কৃত্তিবাসস্-পুং কৃত্তি (চৰ্ম্ম) বাসস্ (বস্ত্র) ইহার [কৃত্তিবাস]।
পিনাকিন-পুং {পিনাক+ইন, অস্ত্যর্থে} পিনাক আছে ইহার।

তাই পিনাকী দ্বারা শিবকেই বোঝানো হচ্ছে তা আর বলা বাকী রাখে না।
মহাভারতেও পরমেশ্বর শিবকেই পিনাকী বলেছে—
ঈশান ঈশ্বরঃ কালো নিশাচারী পিনাকবান্। [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৬/৭৫] টীকা—"ঈশান ঈশ্বরশ্চ ঐশ্বর্য্যবত্বাৎ পিনাকবান্ পিনাকাখ্যধনুর্ণধরঃ"

উণাদিসূত্র কে দৃশ্যমান করে যখন বৈষ্ণবরা, নৃসিংকে রক্ষা কর্তা বানিয়ে দিলো, তবে সেই তথ্যসূত্র অনুযায়ী সঠিক অর্থ দেখে নেওয়া যাক। মূল সূত্রে বলা আছে যে— "পিনাকাদয়শ্চ" [উণাদিকোষ/৪/১৬] পদ০ - পিনাকাদয়ঃ 1.3, চ - অব্য০ ।
সং০ - পিনাকাদয়শ্শব্দা আক্রপ্রত্যয়ান্তা নিপাত্যন্তে । व्याख्या-आक प्रत्यय तथा नित् अतिदेश का प्रकरण चल रहा है। अर्थ-पिनाक आदि शब्द आक प्रत्ययान्त निपातित हैं तथा आद्युदात्त स्वर होता है। स्वा०द० वृ० - पाति रक्षतीति पिनाकः, त्रिशूलं धनुर्वा । उदा०- (1) पिनाकः (= शिव का धनुष) - पाति रक्षति। पा रक्षणे। पा आक्-नुक आगम, धातु को इकार अन्तादेश- पिन् आक सु। উক্ত উণাদিকোষ থেকে পিনাকের অর্থ হয়- ত্রিশুল বা ধনুক। যার দ্বারা রক্ষা করা হয়। এখানে স্পষ্ট শব্দপ্রমাণ দৃশ্যমান, তাই এখানে পিনাকের অর্থ শুধু মাত্র রক্ষা করা দেখানো টা যুক্তি সঙ্গত নয়। বৈষ্ণবরা পিনাকের অর্ধসত্য অর্থকেই তুলে ধরেছে সবার সামনে সম্পূর্ণ সত্য তুলে ধরেনি। কিন্তু, এখন যখন সম্পূর্ণ সত্য তুলে ধরা হলো এখানে পরিস্কার ভাবেই বোঝা যাচ্ছে, পিনাক অর্থ ধনুক বা ত্রিশুল বোঝায়, যা যাস্ক নিরুক্তের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই এখানে পিনাকী অর্থে পরমেশ্বর শিবকেই বুঝিয়েছে, বিষ্ণু কে নয়।

শিবমহাপুরাণে বলা হয়েছে
অম্বিকাপতিরীশানঃ পিনাকী বৃষবাহনঃ । একো রুদ্রঃ পরং ব্রহ্ম পুরুষঃ কৃষ্ণপিঙ্গলমঃ ।।

[শিবমহাপুরাণ/বায়বীয় সংহিতা/উত্তর খণ্ড/৬ অধ্যায়/১৩ নং শ্লোক]

যিনি অম্বিকাপতি, ঈশান, পিনাকী, বৃষবাহন, সেই রুদ্রই একমাত্র পরম ব্রহ্ম পুরুষ কৃষ্ণপিঙ্গল(অর্ধনারীশ্বর) বলে বিখ্যাত।

সুতরাং, এই পিনাকী পদের অপব্যাখ্যা করে বিষ্ণু কে টেনে এনে বিষ্ণুকে জোরপূর্বক পিনাকপাণি প্রমাণ করা অর্থহীন ত বটেই তার চেয়েও বেশি হাস্যকর এটি ।


___________________________________________________

🚫 বৈষ্ণবদের মূর্খতাপূর্ণ দাবী — ১১

'অমিতদ্যুতি' ভগবান বিষ্ণু প্রবল দ্যুতি বা জ্যোতি সম্পন্ন। কারণ- "নারায়ণ পরো জ্যোতিঃ" (তৈত্তিরীয় আরণ্যক ১০/১৩/৭)- ভগবান নারায়ণই পরম জ্যোতির্ময় পুরুষ।

🔥 শৈব পক্ষ থেকে বৈষ্ণবদের দাবীর খণ্ডন —

অমিতদ্যুতির অর্থ হলো যিনি অসীম দীপ্তিবান। শাস্ত্র অধ্যয়ন করলে জানা যায় প্রত্যেক দেবতাকেই অসীম দীপ্তিবান বলা হয়েছে। যার থেকে কোটি সূর্যের তেজ প্রকাশিত হয়। বাহ যিনি নিজেই অসীম তেজোময়। উক্ত বৈষ্ণবীয় দাবীতে "নারায়ণ পরো জ্যোতিঃ" বলতে নারায়ণকেই পরম জ্যোতির্ময় বুঝিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন যে একমাত্র জ্যোতি বলা হয়নি। কেননা [যাস্ক নিরুক্ত/২/১/১৯/২] অনুযায়ী- "ইদং শ্রেষ্ঠং জ্যোতিষাং জ্যোতিরাগমাৎ" অর্থাৎ বলা হচ্ছে যে, জ্যোতি সমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জ্যোতি উষা। [ঋগবেদ সংহিতা/১/১১৩/১] অনুযায়ী উষা'ই জ্যোতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ জ্যোতি, তার বিচিত্র ও জগৎ প্রকাশক রশ্মিও ব্যক্ত হয়ে প্রকাশ হয়েছে। অর্থাৎ উষা'ই নিজ জ্যোতি দ্বারা সমগ্র জগৎ ব্যাপীয়া আছেন। অর্থাৎ দুদিক থেকে নারায়ণ এবং উষা শ্রেষ্ঠ জ্যোতি সম্পন্ন হলেও কিন্তু, একমাত্র জ্যোতির্ময় নয় (যদিও এইখানে নারায়ণ শব্দটি শিব বাচক, তথাপি বৈষ্ণব দের দাবী খণ্ডনের জন্য আমরা নারায়ণ শব্দটি বৈষ্ণব দের দৃষ্টি কোনে রেখেই বিচার করছি)।

[যাস্ক নিরুক্ত/২/১/১/১৪] অনুযায়ী- "জ্যোতির্ঘনো বিন্দুবাট্য ইতি" এখানে জ্যোতিঃ শব্দ 'দ্যুৎ' ধাতু হতে নিষ্পন্ন। [যাস্ক নিরুক্ত/৭/৩/১০] অনুযায়ী- "দ্যোততের্বা" (দিদ্যুৎ শব্দ দীপ্ত্যর্থক 'দ্যুৎ' ধাতু হতে নিষ্পন্ন— দীপ্তি পায়। [অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/১১০] অনুযায়ীও দ্যুতি অর্থ দীপ্তি পায় ইহা দ্বারা। [অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/১৪১] অনুযায়ীও একই কথাকেই বুঝিয়েছে। অর্থাৎ যার থেকে সমস্ত কিছু প্রকাশিত হয় বা যিনি নিজেই অসীম দীপ্তিবান, যার দ্বারা সমস্ত জগৎকে প্রকাশিত করেন।

মহাভারতে এ প্রসঙ্গে বলা আছে—
তেজসামপি যত্তেজস্তপসামপি যত্তপঃ।
শান্তানামপি যঃ শান্তো দ্যুতীনামপি যা দ্যুতিঃ ॥২৬৷
[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৬/২৬]
রমেশ্বর শিব তেজেরও তেজ, যিনি তপস্যারও তপস্যা, যিনি শান্তদিগের মধ্যে প্রধান শান্ত, যিনি দীপ্তিবানের মধ্যে পরম দীপ্তিবান।।

এই প্রসঙ্গে শ্রুতি শাস্ত্রে বলা আছে যে— যেনেদং সর্বং জগতো বভূব যদ্দেবা অপি মহতো জাতবেদাঃ | তদিবাগ্নিস্তপসো জ্যোতিরেকং তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু||১৩|| [ঋগবেদসংহিতা /খিলানি/অধ্যায় ৪/১১ নং খিলা], [আশ্বলায়ণ শাখা/১০/১৭১] পরমেশ্বর শিব দ্বারা সমগ্র বিশ্ব প্রকাশিত হয়েছে; এবং জাতবেদের মতো মহান দেবতারাও, যিনি নিজেই সেই অগ্নি (রুদ্রাগ্নি বা জাতবেদকে বোঝাতে পারেন); যিনি একমাত্র জ্যোতি, সকল তপস্যার ফলস্বরূপ পরমেশ্বর শিবের প্রতি মন সঙ্কল্পিত হোক।। অর্থাৎ শ্রুতিবাক্য দ্বারা এটাই প্রমাণিত হচ্ছে, পরমেশ্বর শিবই একমাত্র জ্যোতি যার থেকে এই সমগ্র জগৎ প্রকাশিত হয়। এমনি একটি শাস্ত্র প্রমাণ পরিলক্ষিত হয় [শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৪/১০], যেখানে বলা হয়েছে পরমেশ্বর শিবের অবয়ব দ্বারাই সমস্ত জগত ব্যাপ্ত। তাই এক্ষেত্রে বলা যায় পরমেশ্বর সর্বব্যাপী শিবই অসীম দীপ্তিবান জ্যোতির্ময় পুরুষ। পরমেশ্বর শিবকেই শ্রুতিতে পুরুষ বলা হয়েছে— "পুরুষো বৈ রুদ্রঃ" [তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/২৪/১]। পরবর্তী শ্রুতি প্রমাণে বলা হয়েছে— অচিন্ত্যং চাপ্রমেযং চ ব্যক্তাব্যক্তপরং চ যৎ | সূক্ষ্মাসূক্ষ্মতরং জ্ঞানসং তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু || ১৪ || [ঋগবেদসংহিতা /খিলানি/অধ্যায় ৪/১১ নং খিলা], [আশ্বলায়ণ শাখা/১০/১৭১] তিনি ধ্যানের ঊর্ধ্বে এবং জ্ঞানের পরিধির ঊর্ধ্বে; তিনি প্রকাশ ও অপ্রকাশের ঊর্ধ্বে; ধ্যানের (অথবা জ্ঞানের) ক্ষেত্রে যিনি সূক্ষ্মতমের চেয়েও সূক্ষ্ম সেই পরমেশ্বর শিবের প্রতি মন সঙ্কল্পিত হোক।।

অর্থাৎ এখানে এই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, যার প্রকাশ থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভব হচ্ছে, সেই পরমেশ্বর শিব প্রকাশেরও ঊর্ধ্বে। অর্থাৎ পরমেশ্বর শিব প্রকাশ, অপ্রকাশ দুই বটে এবং প্রকাশ ও অপ্রকাশেরও ঊর্ধ্বে। কারণ সবকিছু এক শিবই বটে, তিনিই সবকিছুতে প্রকাশিত হচ্ছে। তাই শ্রুতিতে বলা হয়- "সর্বে বৈ রুদ্রঃ" [তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/২৪/১] অর্থাৎ সবকিছুই এক রুদ্রই বটে। তা প্রকাশমান হোক বা অপ্রকাশমান।

শ্রুতিতে আরও বলা হয়েছে যে— যজ্জাগ্রতো দূরমুদৈতি দৈবং তদু সুপ্তস্য তথৈবৈতি। দূরঙ্গমং জ্যোতিষাং জ্যোতিরেকং তন্মে মনঃ শিবসঙ্কল্প মস্তু॥ [ঋগবেদসংহিতা /খিলানি/অধ্যায় ৪/১১ নং খিলা], [আশ্বলায়ণ শাখা/১০/১৭১], [যজুর্বেদ ৩৪/১] দিব্য শক্তি সম্পন্ন যে মন জাগ্রত ও নিদ্রিত উভয়ই অবস্থায় দূর দূর ধাবিত হয়, জ্যোতিসমূহের মধ্যে অন্যতম একমাত্র জ্যোতি পরমেশ্বর শিবের প্রতি মন সংকল্পিত হোক।।

তাই এখানে এই বিষয় টা পরিস্কার হয়ে গেলো যে 'অমিতদ্যুতি' অসীম দীপ্তিবান একমাত্র জ্যোতির্ময় পুরুষ পরমেশ্বরই শিবই। জ্যোতি শব্দের আরও কিছু অর্থ দেখে নেওয়া যাক— যাস্ক নিরুক্তে জ্যোতি শব্দে বিভিন্ন অর্থ বুঝিয়েছে। কখনো বিদ্যুৎ, কখনো রজ (গুণ, যার থেকে সৃষ্টি প্রকাশিত হয়), কখনো অন্ধকার হরণ করে যে এমন কিছু বুঝিয়েছে তো কখনো অগ্নিকে। [যাস্ক নিরুক্ত/৫/৩/১৪] অনুযায়ী জ্যোতি অর্থে বিদ্যুৎকে বোঝায়। আর শ্রুতিতে বিদ্যুৎ বলতে পরমেশ্বর শিবকেই বুঝিয়েছে— "অথ কস্মাদুচ্যতে বৈদ্যুতং যস্মাদুচ্চার্যমাণ এবাব্যক্তে মহতি তমসি দ্যোতয়তে তস্মাদুচ্যতে বৈদ্যুতম্"।। [অথর্বশির উপনিষদ/৪র্থ কণ্ডিকা] (প্রশ্ন) পরমেশ্বর রুদ্র কে ‘বিদ্যুৎ’ কেন বলে ? (উত্তর) কারণ, সকল তমোরূপী অজ্ঞানের অন্ধকারময় স্থিতিতেও পরমেশ্বর রুদ্র হলেন দ্যুতিময় দিব্যদেহধারী জ্ঞানস্বরূপের প্রকাশ, তাই তাকে ‘বিদ্যুৎ’ বলা হয় । শ্রুতিতে পরমেশ্বর শিব সম্পর্কে বলেছে যে- " নমো মেধ্যায় চ বিদ্যুত্যায় চ" [শুক্ল-যজুর্বেদ/১৬/৩৮], অর্থাৎ মেঘ এবং বিদ্যুৎ বলতে পরমেশ্বর শিবকেই বোধিত করে

এবং মহাভারতে বলা হয়েছে— "স বৈ রুদ্রঃ স চ বিদ্যুতঃ" [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩৮/৩৮], অর্থাৎ পরমেশ্বর শিবই বিদ্যুৎ [যাস্ক নিরুক্ত/৪/১৯/৫] "জ্যোতি রজ উচ্চতে" অর্থাৎ জ্যোতি রজস্ বলে অভিহিত হয়। যার থেকে জগৎ প্রকাশিত হয়। [শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৪/১০] অনুযায়ী "মায়ান্তু প্রকৃতং বিদ্যাষ্মায়িনন্তু মহেশ্বরম্" অর্থাৎ ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতির অধীশ্বর পরমেশ্বর শিব। যার থেকেই  গুণ প্রকাশিত হয় এবং সেই গুণ থেকেই  জগৎ প্রকাশিত হয়। [যাস্ক নিরুক্ত/৪/১৯/৬] "জ্যোতির্হরো উচ্যতে" অর্থাৎ জ্যোতি সকল বস্তুর স্নিগ্ধতা হরণ করে, অথবা অন্ধকার হরণ করে। "হর" অর্থাৎ যিনি হরণ করেন। [অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/২১] "হরঃ স্মরহরো" অর্থাৎ যিনি সবকিছু হরণ করেন, (প্রলয়কালে) পরমেশ্বর শিব সকল হরণ করেন। মহাভারতে বলা হয়েছে—"স দদাতি মনুষ্যেভ্য স এবাক্ষিপতে পুনঃ" [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩৯/২৬] পরমেশ্বর শিব সবকিছু দেন, আবার সবকিছুই হরণ করেন। আরও বলা হয়েছে— "হরশ্চ হরিণাক্ষশ্চ সর্বভূতহরঃ প্রভুঃ" [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৬/৩২] পরমেশ্বর শিব ভক্তসকলের দূঃখ হরণ করেন বলেই শিবের আরেক নাম হর।। [যাস্ক নিরুক্ত/৬/২৬/২] "উরু জ্যোতি" অর্থে বিস্তীর্ণ তেজকে বোঝায়। অর্থাৎ যার তেজে সমস্ত কিছু বিস্তৃত হয়ে আছে। [শুক্ল-যজুর্বেদ/অধ্যায় ১৬] অধিকাংশ মন্ত্রে যেখানে পরমেশ্বর শিবকে "তেষাং" বলে অবিহিত করেছেন। যার অর্থ তেজোময়। শ্রুতিতে তেজকে পরমেশ্বর শিবেরই স্বরূপ বলা হয়েছে- "যো বৈ রুদ্রঃ স ভগবান যশ্চ তেজো তস্মৈ বৈ নমো নমঃ" [অথর্বশির উপনিষদ/২/১৯]। মহাভারতে বলা হয়েছে— "তস্য ঘোরাণি রূপাণি দীপ্তাণি চ বহূনি চ" [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩৯/২০], মহাদেবের ভয়ঙ্কর ও তেজস্বী বহুতর রূপ আছে। [যাস্ক নিরুক্ত/৮/১২/১] "প্রাচীনং জ্যোতিঃ" অর্থে অগ্নিকে বোঝায়। আর শ্রুতিতেও বলা হয়েছে পরমেশ্বর শিবই অগ্নি রূপে প্রকাশিত হন- "যোবৈ রুদ্রঃ স ভগবান যশ্চ অগ্নি তস্মৈ বৈ নমো নমঃ" [অথর্বশির উপনিষদ/২/৫]। মহাভারতেও বলা হয়েছে— "চ শিবঃ সোহগ্নি"  [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩৯/২০] পরমেশ্বর শিবই অগ্নি। [যাস্ক নিরুক্ত/১০/৭/৭] "অগ্নিরপি রুদ্র উচ্যতে" অগ্নিও রুদ্র বলিয়া অবিহিত হন বা রুদ্রের অপর অর্থ অগ্নি।  [শতপথ ব্রাহ্মণ/৬ষ্ট প্রপাঠক/১ম ব্রাহ্মণ/৮] অনুযায়ী, অগ্নিকে রুদ্রের সাথে অভিন্ন বলা হয়েছে। আর শ্রুতিমতে অগ্নি রূপটাই পরমেশ্বর শিব ধারণ করেন— "যো অগ্নৌ রুদ্রো যো অন্বন্তর্য ওষধীবীরুধ আবিবেশ। য ইমা বিশ্বা ভুবনানি চালূপে তস্মৈ রুদ্রায় নমো অস্ত্রগ্নয়ে"।। [অথর্ব্ববেদ- ৭ম কাণ্ড- ৮ম অনুবাক- ৬ষ্ট সুক্ত- ১ নং মন্ত্র], পরমেশ্বর রুদ্র যজ্ঞার্হরূপে অগ্নিতে, বরুণরূপে জলে এবং সোমরূপে লতাসমূহে প্রবিষ্ট, তিনি এই নামরূপাত্মন পরিদৃশ্যমান সকল ভুবন ও ভূতসমূহকে সৃষ্টি করতে সমর্থ। সেই সর্বজগৎস্রষ্টা, সর্বজগতে অনুপ্রবিষ্ট রুদ্রাত্মক অগ্নিকে নমস্কার। অথবা অঙ্গনাদিগুণবিশিষ্ট 'রুদ্রায় নমোস্তু' ।।১॥

মহাভারতে বলা আছে— "যন্নির্দ্দহতি যত্তীক্ষ্ণো যদুগো যৎ প্রতাপবান" [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩৯/৭], অর্থাৎ পরমেশ্বর শিব প্রলয়কালে অগ্নিরূপে সমগ্র জগৎ দগ্ধ করেন।আরও বলা হয়েছে—
উগ্রতেজা মহাতেজা জন্যো বিজয়কালবিৎ।
জ্যোতিষামযনং সিদ্ধিঃ সর্ববিগ্রহ এব চ ॥৫৭৷৷
[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৬/৫৭]
উগ্রতেজা, মহাতেজা, জন্য, বিজয়, কালবিৎ, জ্যোতিষাময়ন, সিদ্ধি, সর্ব্ববিগ্রহ ॥৫৭॥
অর্থাৎ জ্যোতিঃ/দ্যুতি'র যেকোনো অর্থে পরমেশ্বর শিবকেই বোধিত করে। কারণ পরমেশ্বর শিবই হল সবকিছু "সর্বে বৈ রুদ্রঃ" [তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/২৪/১]।।

___________________________________________________

🚫 বৈষ্ণবদের মূর্খতাপূর্ণ দাবী — ১২
'ঈশানঃ সর্ববিদ্যানাম্' ঈশান শব্দ মূলত "ঈশ" ধাতুর সাথে "চানশ্" প্রত্যয় যোগ হয়ে ঈশান শব্দ নিপাতিত হয়। "ঈশ্ ঐশ্বর্যে" (পাণিনি ধাতুপাঠ ২/১০) ঈশ ঐশ্বর্য প্রকাশে প্রভুত্ব অর্থে। চানশ্ প্রত্যয় সম্পর্কে পাণিনিসূত্রে(৩/২/১২৯) বলা হয়েছে-
"তাচ্ছীল্যবয়োবচনশক্তিষু চানশ্।"
[ তাচ্ছীল্য-বয়ো-বচন-শক্তিষু-৭।৩, চানশ্—১]
অনুবাদ—তাচ্ছীল্য, বয়োবচন এবং সামর্থ্য অর্থে ধাতুর উত্তর 'চানশ্” প্রত্যয় হয়। এটি বিধিসূত্র। যথা—ভোগং ভুঞ্জানঃ। কবচং বিভ্রাণঃ। শত্রুন নিম্নানঃ।।
অর্থাৎ, প্রভুত্ব-সামর্থ্য প্রকাশার্থে ঈশান শব্দ সাধিত।
সর্ববিদ্যা অর্থ সমস্ত বিদ্যা। বিদ্যা সম্পর্কে যাজ্ঞবল্ক্য মুনি বলছেন-
"পুরাণন্যায়মীমাংসা ধর্ম্মশাস্ত্রাঙ্গমিশ্রিতাঃ।
বেদাঃ স্থানানি বিদ্যানাং ধৰ্ম্মস্য চ চতুৰ্দ্দশ।।" (যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা ১/৩)
অনুবাদ: পুরাণ, ন্যায়, মীমাংসা, ধৰ্ম্মশাস্ত্র, বেদাঙ্গ (শিক্ষা, কল্প ব্যাকরণ, নিরুক্ত, জ্যোতিষ, ছন্দ, এই ছয় প্রকার) এবং চারি বেদ, এই চৌদ্দটী, পুরুষার্থ-সাধন বিদ্যা(জ্ঞান) এবং ধর্ম্ম প্রবৃত্তির কারণ।
এই সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রই হচ্ছে সর্ববিদ্যা বা পুরুষার্থ সাধন জ্ঞান। এই সকল বিদ্যার অধিপতি ভগবান নারায়ণ। কারণ সমস্ত শাস্ত্র বিদ্যা তাহার থেকেই প্রকাশিত হয় সে সম্পর্কে শ্রুতি বচন রয়েছে যে-
"স যথাদ্রৈধাগ্নেরভ্যাহিতাৎ পৃথগধূমা বিনিশ্চরন্ত্যেবং বা অরেহস্য মহতো ভূতস্য নিঃশ্বসিতমেতদ্ যদৃগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোঽথর্বাঙ্গিরস ইতিহাসঃ পুরাণং বিদ্যা উপনিষদঃ শ্লোকাঃ সূত্রাণ্যনুব্যাথ্যানানি ব্যাথ্যানান্যস্যৈবৈতানি নিঃশ্বসিতানি।।" (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ২/৪/১০)
অনুবাদ: এই—যেমন আর্দ্র কাষ্ঠের দ্বারা প্রজ্বলিত অগ্নি হইতে নানাবিধ ধূম বিনির্গত হয়, তেমনি ' ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, ইতিহাস, পুরাণ, বিদ্যা, রহস্যবিদ্যা, শ্লোক সকল, সূত্রসমুদয়, অনুব্যাখ্যা সকল, ও ব্যাখ্যাসমুহ –এই সমস্তই এই পরমাত্মার নিঃশ্বাস ( সদৃশ )।এই সকল ইহারই নিঃশ্বাস ( সদৃশ )।
অর্থাৎ, পরমেশ্বর ভগবান নৃসিংহই সমস্ত বিদ্যার অধিপতি, সমস্ত বিদ্যা তার থেকেই প্রকাশিত হয়।

🔥 শৈব পক্ষ থেকে বৈষ্ণবদের দাবীর খণ্ডন —

[নিঘন্টু/৬/২০/১] অনুযায়ী ঈশান অর্থ ঈশ্বর বা পরমেশ্বকেই বোঝানো হয়েছে। "শম্ভুরীশঃ" [অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/২১] ঈশ/ঈশান একই শব্দ, এর দ্বারা পরমেশ্বর শিবের ঐশ্বর্যকে প্রতিপাদিত করে।

"ঈশ্বর সর্ব্ব ঈশানঃ" [অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/২১] অর্থাৎ পরমেশ্বর শিবের ঐশ্বর্যকে প্রতিপাদিত করে। তাই শাস্ত্রের মধ্যে পরমেশ্বর শিবকে ঈশ/ঈশ্বর/ঈশান এসব নামে আখ্যায়িত করা হয়।
মহাভারতে এব্যাপারে বলা হয়েছে যে— ঈশান ঈশ্বরঃ কালো নিশাচারী পিনাকবান্। [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৬/৭৫] টীকা—"ঈশান ঈশ্বরশ্চ ঐশ্বর্য্যবত্বাৎ" "পিনাকবান্ পিনাকাখ্যধনুর্ণধরঃ"।। পরমেশ্বর শিব পরম ঐশ্বর্যবান তাই পরমেশ্বর শিবকে ঈশ্বর/ঈশান নামে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
আরও বলা হয়েছে— স এব ব্যাপৃতো নিত্যং ত্রৈলোক্যনস্ত্য শুভাশুভে। ঐশ্বর্য্যাচ্চৈব কামানামীশ্বরঃ পুনরুচ্যতে ॥২৭৷৷ [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩৯/২৭] সে মহাদেবই সর্বদা ত্রিভুবনের মঙ্গল ও অমঙ্গল বিধানে ব্যাপৃত আছেন এবং তিনি সমস্ত অভীষ্ট বিষয় দান করিতে সমর্থ বলিয়া ঈশ্বর নামে অভিহিত হন ॥২৭।।
পুরাণে ব্রহ্মাজী বলেছেন— ব্রহ্মোবাচ— জানে ত্বামীশং বিশ্বস্য জগতো যোনিবীজয়োঃ। শক্তেঃ শিবস্য চ পরং যত্তদব্রহ্ম নিরন্তরম ।। [ভাগবত পুরাণ ৪/৬/৪২] ব্রহ্মা বললেন, হে মহাদেব! আমি জানি আপনি সমগ্র বিশ্বের অধীশ্বর, কারণ জগতের যোনিস্বরূপ যে শক্তি (প্রকৃতি) এবং বীজস্বরূপ যে শিব (পুরুষ) আপনি এই উভয়েরই কারণ এবং এতদুভয়ের অতীত নির্বিকার একরস পরব্রহ্ম স্বরূপ।
এই প্রসঙ্গে শ্রুতিতে বলা আছে যে— তমীশ্বরাণাং পরমং মহেশ্বরং ত্বং দেবতানাম পরমঞ্চ দৈবতম্ ।

পতিং পতিনাং পরমং পরস্তাদ বিদাম্ দেবম্ ভুবনেশমীড্যম্।। [শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৬/৭] তুমি ঈশ্বরদেরও ঈশ্বর মহেশ্বর। দেবতাদেরও পরম দেবতা। তুমি অধিপতিদেরও অধিপতি মহাধিপতি। তুমি পরমেরও পরম। তুমিই ভূবনের একমাত্র পূজনীয় ঈশ্বর।
পরমেশ্বর শিবের ঐশ্বর্য সম্পর্কে শ্রুতিতে বলা হয়েছে— "শ্রেষ্ঠো জাতস্য রুদ্র শ্রিয়াসি" [ঋগবেদ/শাকল শাখা/১/৩৩/৩] হে রুদ্র! তুমি ঐশ্বর্যে সকলের শ্রেষ্ঠ।।
অর্থাৎ পরমেশ্বর শিবই পরম ঐশ্বর্যবান এবং একি কথা সমর্থন করে মহাভারতও— ভগবত্যুত্তমৈশ্বর্য্যং ব্রহ্মবিষ্ণুপুরোগমম্।। [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩/২০৩] ব্রহ্মা ও বিষ্ণু থেকে অধিক ঐশ্বর্য্যবান হলেন মহাদেব।। হ্যাঁ একদম ঠিক কথা পরমেশ্বর শিবই হলো পরম ঐশ্বর্যবান কারণ শ্রুতিতেও একি শব্দপ্রমাণ পাওয়া যায় যেখানে পরমেশ্বর শিবকে ঐশ্বর্য্যপতি বলা হয়েছে। শ্রুতিতে বলা হয়েছে- "ভগেশং" [শ্বেতাঃ উঃ/৬/৬] অর্থাৎ পরমেশ্বর শিবই ঐশ্বর্য্যপতি।।
এই প্রসঙ্গে শ্রুতিতে রয়েছে— পরাৎপরতরো ব্রহ্মা তৎপরাৎপরতো হরিঃ | তৎপরাৎপরতো হ্যেষ তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্ত || ১৮ || [ঋগবেদসংহিতা /খিলানি/অধ্যায় ৪/১১ নং খিলা], [আশ্বলায়ণ শাখা/১০/১৭১] সর্বোপরি হলেন ব্রহ্মা তার থেকে ঊর্ধ্বে হলেন বিষ্ণু এবং এদের থেকেও সর্বোচ্চ হলেন ঈশ/ঈশান, সেই পরমেশ্বর ঈশান শিবের প্রতি মন সঙ্কল্পিত হোক।।
পরমেশ্বর শিবকে কেন ঈশান বলা হয় তা শ্রুতি থেকেই দেখে নেব— অথ কস্মাদুচ্যতে ঈশানঃ যঃ সর্বান্ দেবান ঈশতে ঈশনীভির্জননীভিশ্চ পরম শক্তিভিঃ। অভি ত্বা শূর নোনুমো দুগ্ধা ইব ধেনবঃ। ঈশানমস্য জগতঃ স্বদৃ শং ঈশানং ইন্দ্র তম্বুষ ইতি তস্মাদুচ্যত ঈশানঃ।[অথর্বশির উপনিষদ/৫] (প্রশ্ন) পরমেশ্বর রুদ্র কে 'ঈশান কেন বলে? (উত্তর) এ কারণেই বলা হয়, যে, তিনি সমস্ত দেবতা ও তাদের শক্তির ওপরে নিজের ঈশানীশক্তির মাধ্যমে প্রভুত্ব (ঈশত্ব)-এর শাসন রাখেন। হে মহান (শূর) প্রভু শিব! যেভাবে গাভীর কাছে দুগ্ধ প্রার্থনা করা হয় (আপনি সেই গাভীস্বরূপ শিব, যার থেকে দুধস্বরূপ ভক্তি লাভ হয়), আপনার প্রতি সেই পরম শিবভক্তি লাভের জন্য আমরা আপনার স্তুতি করি, যাতে আপনি প্রসন্ন হন। আপনিই ইন্দ্রস্বরূপধারী, স্থাবর-জঙ্গমরূপী সমগ্র সংসার ই দিব্যদৃষ্টিকোণের বিচারে ঈশস্বরূপ (ঈশ্বর) অর্থাৎ সকল পদার্থ শিবস্বরূপ শিবময়। এই কারণে আপনাকে 'ঈশান' নাম দ্বারা সম্বোধন করা হয়।
আর শাস্ত্রে ঈশান যে সাক্ষাৎ শিব, তা স্পষ্ট ভাবেই উল্লেখ করায় আছে— তৎ পরং ব্রহ্ম যৎ পরং ব্রহ্ম স একঃ যঃ একঃ স রুদ্রঃ যো রুদ্রঃ স ঈশানঃ যঃ ঈশানঃ স ভগবান মহেশ্বর।।৩ [অথর্ববেদ/অথর্বশির উপনিষদ/৩] অর্থঃ— তিনি (শিব) পরব্রহ্ম, যিনি পরব্রহ্ম তিনি অদ্বিতীয়, যিনি অদ্বিতীয় তিনি রুদ্র, যিনি রুদ্র তিনি ঈশান, যিনি ঈশান তিনিই ভগবান মহেশ্বর।। ৩।।
“ঈশানস্য জগতঃ স্বদর্শমীশানমিন্দ্রতস্থুর্য ইতি তস্মাদুচ্যতে ঈশানঃ”।। [অথর্ববেদ/অথর্ব্বশির উপনিষদ/৪] অর্থঃ—স্থাবর জঙ্গমাত্মক জগতের অদ্বিতীয় অধীশ্বর রুদ্ররূপী ভগবান'ই সাক্ষাৎ ঈশান।।
শ্রুতিতে পরমেশ্বর ঈশান শিবকেই একমাত্র পরব্রহ্ম বলেছেন— "একো রুদ্রো ন দ্বিতীয়ায় তস্মৈ য ইমাল্লোকানীশত ঈশানীভিঃ"।। [অথর্ববেদ/অথর্বশির উপনিষদ- ৫] সেই এক রুদ্রদেব ঈশানীশক্তিদ্বারা এই অনন্তভুবনের সর্ব্বকর্তৃত্ব করিতেছেন। তিনি অদ্বিতীয় কাহারও সাহায্যের অপেক্ষা করেন না। রুদ্রদেবই এই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র অধীশ্বর, তিনি ভিন্ন জগৎকর্তা আর কেহ নাই।
এর একই প্রমাণ রয়েছে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে— একো হি রুদ্রো ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য ইমাল্লোকানীশত ঈশনীভিঃ। প্রত্যঙ জনাংস্তিষ্ঠতি সঞ্চুকোপান্তকালে সংসৃজ্য বিশ্বা ভুবনানি গোপাঃ।।২ [শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৩/২] পরমেশ্বর মহারুদ্রই অদ্বিতীয় পরমেশ্বর দ্বিতীয় কোনো সত্ত্বা নেই। এক অদ্বিতীয় পরমেশ্বরই নিজশক্তি সকল দ্বারা এই বিশ্বসংসারকে নিয়মিত করিতেছেন। অতএব ব্রহ্মজ্ঞ সকল তাঁহার দ্বিতীয় স্বীকার করেন না (অর্থাৎ দ্বিতীয় কোনো সত্ত্বা নেই, শিবই অদ্বিতীয় পরমেশ্বর)। তিনি সর্বজনের অন্তরে অবস্থান করিতেছেন। তিনি সমুদয় ভুবন সৃষ্টি করিয়া উহাদিগকে পালন করিতেছেন এবং অন্তকালে রুদ্রমূর্তিতে উহাদের সংহারকার্য্য সাধন করিতেছেন।।২৪।।
শ্রুতিতেই বলা আছে যে- “একমেবাদ্বিতীয়মঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয় [ছাঃ উঃ/৬/২/১], আর উক্ত শ্রুতি প্রমাণ ইহাকেই প্রতিপাদিত করে যে, সেই একমাত্র অদ্বিতীয় ব্রহ্ম হলো পমেশ্বর ঈশান শিব।
মহাভারতে বলেছেন— “ঈশানায় ভবঘ্নায় নমোহস্ত্বন্ধকঘাতিনে। নমো বিশ্বায় মায়ায় চিন্ত্যাচিন্ত্যায় বৈ নমঃ[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩/৩১৪] আপনি ঈশান, ভক্তের সংসারনিবর্তক, অন্ধকাসুরহন্তা, বিশ্বরূপী, মায়াবী, চিন্তনীয় ও অচিন্তনীয়; আপনাকে নমস্কার ॥৩১৪।।
এখানে ঈশান শব্দে যে সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিবকেই বোঝাচ্ছে তা আর আলাদা করে প্রমাণ করতে হবে না। অহেতুক শাস্ত্রের অর্থের অনর্থ ঘটিয়ে, শাস্ত্রবাক্যকে বিকৃত করার কোনো মানেই হয় না। আর বৈষ্ণবদের জন্মগত অভ্যাস শাস্ত্রকে বিকৃত করা। আসলে অর্থের অনর্থ না ঘটলে পাখণ্ডী বৈষ্ণবরা পরমেশ্বর শিবের মাহাত্ম্যকে ছোট করতে পারবেনা, তাই অর্থের অনর্থ করে পরমেশ্বর শিবের পরমত্বকে ছোট করে।
শাস্ত্রের মধ্যে "ঈশ/ঈশান" বলতে পরমেশ্বর শিবকেই প্রতিপাদিত করে। কেননা পরমেশ্বর শিব পরম ঐশ্বর্যবান। উনার থেকে ঐশ্বর্যবান শক্তিশালী আর কেই নেই। তাই পরমেশ্বর শিবকেই সর্বোচ্চ বলা হয়।
তাই এই প্রসঙ্গে শ্রুতিতে বলা হয়েছে— যঃ শুক্র ইব সূর্যো হিরণ্যমিব রোচতে। শ্রেষ্ঠো দেবানাং বসুঃ ॥ ৫ ॥ [ঋগবেদ সংহিতা/১/৪৩/৫] প্রভু রুদ্র সূর্যসম দীপ্তিমান এবং স্বর্ণসম উজ্জ্বল প্রভাযুক্ত, তিনি সকল দেবতার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রভু, তিনিই সকলের একমাত্র মাত্র আশ্রয়, তাই তার মধ্যে সকলে নিবাস করেন॥৫॥
ভালো করে লক্ষ্য করুন এখানে বলছে "তিনি সকল দেবতার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রভু"। অর্থাৎ পরমেশ্বর শিবই সর্বোচ্চ সত্ত্বা তার চেয়ে ঊর্ধ্বে আর কেউ-ই নেই, পরমেশ্বর শিবই সর্বোচ্চ গতি "শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্ চতুর্থং মন্বন্তে স আত্মা স বিজ্ঞেয়" [মাণ্ডুক্য উপনিষদ/৭], “সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্ৰহ্ম[তৈত্তি-২/১] উক্ত শ্রুতিবাক্য এরই সমর্থন করে।

শ্রুতিতে আরও বলা আছে যে— অহর্ন্নিদং দয়সে বিশ্বমভুং ন বা ওজীয়ো রুদ্রত্বদস্তি। ১০॥ [ঋগবেদ সংহিতা/২/৩৩/১০] হে পরমেশ্বর রুদ্র! আপনি সমস্ত বিস্তীর্ণ জগৎকে রক্ষা করছেন; আপনার অপেক্ষা অধিক বলবান্ আর কেউ নেই ॥ ১০৷।
শ্রুতি নিজেই বলছে যে পরমেশ্বর শিব থেকে অধিক বলবান/ঐশ্বর্যবান আর কেউ-ই নেই। তাই তো ঐশ্বর্যের ক্ষেত্রে পরমেশ্বর শিবকে "ভগেশং" [শ্বেতা:উ/৬/৬] অর্থাৎ ঐশ্বর্য্যপতি বলা হয়েছে। তাই শাস্ত্রের মধ্যে পরমেশ্বর শিবকে ঈশ/ঈশ্বর/ঈশান ইত্যাদি নামে সংজ্ঞায়িত করা করা হয়।
তাই "ঈশানঃ সর্ববিদ্যানাং" বলতে এটাই বোঝায় পরমেশ্বর শিবই সকল বিদ্যার অধিপতি। তৈত্তিরীয় সংহিতায় সায়ণাচার্য উনার ভাষ্যে বলেছেন যে — "যস্য নিঃশ্বসিতং বেদা যো বেদেভ্যোহখিলং জগৎ। নির্মমে তমহং বন্দে বিদ্যাতীর্থ মহেশ্বরম্"॥ যার নিঃশ্বাস থেকে সমগ্র বেদ প্রকাশিত হয়েছে, বেদসমূহ থেকে আরম্ভ করে অখিল বিশ্বচরাচর সবকিছু যার স্বরূপ, যিনি সকল বিদ্যার তীর্থ (সর্ব বিদ্যার ঈশ্বর), সেই পরমেশ্বর মহেশ্বরকে আমি বন্দনা করি।।
শিবমহাপুরাণেও বলা হয়েছে যে বেদ পরমেশ্বর শিবের নিশ্বাস থেকেই প্রকট হয়েছে— নিগমং শ্বাসরূপেণ দদৌ তস্মৈ ততো হরঃ।।৫ [শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/সৃষ্টিখণ্ড/৯নং অধ্যায়/৫] অর্থাৎ বেদ পরমেশ্বর শিবের নিশ্বাস স্বরূপে নির্গত হয়েছে। [বৃহদারণ্যক উপনিষদ/২/৪/১০] উক্ত শাস্ত্রবাক্যকে প্রতিপাদিত করে।

এছাড়াও পদ্মপুরাণে বলা আছে যে—
সদাশিব উবাচ্ - "মদ্বাক্যাদখিলংশুদ্ধ্যেন্মদ্বাক্যাদমৃতং বিষম্ | মদ্বাক্যাদখিলাবেদা মদ্বাক্যাদ্দেবতাদয়ঃ || ২২৭ || মদ্বাক্যাদ্ধর্মবিজ্ঞানং মদ্বাক্যান্মোক্ষ উচ্চত্যে | পুরাণন্যাগমাশ্চৈব স্মৃতয়ো মম বাক্যতঃ || ২২৮ || [পদ্মপুরাণ/পাতাল খন্ড/১১৪ নং অধ্যায়] সদাশিব বললেন — আমার বাক্য মাত্রই অখিল বিশ্বসংসার শুদ্ধ হয়ে যায়। আমার বাক্যে বিষও অমৃত হয়ে যায়। আমার বাক্যই সমগ্র বেদ স্বরূপ। আমার বাক্যেই দেবতারা দেবত্ব প্রাপ্ত হন। আমার বাক্যই সাক্ষাৎ ধর্ম ও বিজ্ঞান স্বরূপ। আমার বাক্যেই জীব মোক্ষলাভ করে। সমগ্র পুরাণ, আগম এবং স্মৃতিশাস্ত্র সবই আমার বাক্য।।

___________________________________________________

🚫 বৈষ্ণবদের মূর্খতাপূর্ণ দাবী — ১৩

'ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাম্' ভগবান নারায়ণ সমস্ত ভূতসমূহের ঈশ অর্থ নিয়ন্ত্রক বা প্রভু বিধায় তিনি ঈশ্বর। সে সম্পর্কে মহাভরতের হরিবংশে(ভবিষ্যপর্ব ৮৮/৫৪) শিবজী বলছেন-
"ঈশস্ত্বং সর্বভূতানামীশ্বরোহসি ততো হরেঃ"- হে হরে! আপনি সমস্ত ভূতের ঈশ্(প্রভু) তাই আপনাকে ঈশ্বর বলা হয়।

🔥 শৈব পক্ষ থেকে বৈষ্ণবদের দাবীর খণ্ডন —

" ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং" উক্ত শ্রুতি বাক্য দ্বারাও পরমেশ্বর শিবকেই বোঝানোর হয় যে, পরমেশ্বর শিবই সকল ভূতের ঈশ্বর। "ভূতেশঃ" [অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/২১] যিনি সমস্ত ভূতের (তত্ত্বের) ঈশ বা অধিপতি। তাই শাস্ত্রে "আত্মা চ সর্বভূতানাং" [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩/৩১৬], "বাহিতা সর্বভূতানাং" [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৬/১১৩]  ইত্যাদি বাক্যে পরমেশ্বর শিবের স্তুতি করা হয়েছে। ইতিহাস শাস্ত্র মহাভারতে পরমেশ্বর শিব নিয়ে কি বলা আছে তা অতি সংক্ষিপ্ত ভাবে দেখে নেব— "যুগান্তে সর্বভূতানি গ্রসন্নিব ব্যবস্থিতঃ" ॥৩৪৭৷৷ [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩/৩৪৭] মহাপ্রলয়ে পরমেশ্বর শিব সর্বভূতকে গ্রাস করে নিজের মধ্যেই ব্যবস্থিত থাকেন।।

আরও দেখে নেব— সর্ব্বগঃ সর্বভূতাত্মা সর্বভূতভবোদ্ভবঃ। আস্তে সর্বগতো নিত্যমদৃশ্যঃ সর্ব্বদৈবতৈঃ ॥৩৪৯৷৷ [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩/৩৪৯] আপনি সর্বগামী, সর্বব্যাপী, সর্বভূতের অন্তরাত্মা এবং ব্রহ্মারও সৃষ্টিকর্তা; এইরূপে সমস্ত দেবতারও সর্বদাই অদৃশ্য হইয়া রহিয়াছেন॥ আরও বলা আছে— স্বত্তো জাতানি ভূতানি স্থাবরাণি চরাণি চ। ত্বয়া সৃষ্টমিদং কৃৎস্নং ত্রৈলোক্যং সচরাচরম্ ॥৪০৬৷৷ [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩/৪০৬] ভগবন্! স্থাবর ও জঙ্গম সমস্ত প্রাণী আপনি হইতে জন্মিয়াছে এবং আপনিই এই সমগ্র সচরাচর ত্রিভুবন সৃষ্টি করিয়াছেন ॥ সম্পূর্ণ অখিল ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি কর্তা বলেই পরমেশ্বর শিব সকল ভূতের অধিপতি বা ভূতেশ/ভূতনাথ ইত্যাদি নাম দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়।

তাছাড়াও শ্রীকৃষ্ণ জী পরমেশ্বর শিবকে বলছে যে— হৃদয়ং সর্বভূতানাং ক্ষেত্রজ্ঞত্ত্বমূষিস্তুতঃ। সর্বতঃ পাণিপাদস্তুং সর্ব্বতোহক্ষিশিরোমুখঃ ॥৪১৫৷ সর্বতঃ শ্রুতিমাল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠসি। ফলং ত্বমসি তির্গ্মাংশোনিমেষাদিষু কৰ্ম্মসু ॥৪১৬৷৷ [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩/৪১৫/৪১৬] ঋষিস্তুত আপনি, সমস্ত প্রাণীর হৃদয়স্থিত জীবাত্মা। জগতে সকল দিকেই আপনার হস্ত ও পদ, চক্ষু, মস্তক ও মুখ এবং সকল দিকেই  আপনার বৰ্ম্ম রহিয়াছে; আর আপনি সমস্ত ব্যাপিয়া অবস্থান করিতেছেন।  বিশেষতঃ জীবাত্মার স্পন্দনাদি দিকেই কার্য্যের ফল জীবনও আপনিই ॥

পরমেশ্বর শিবই সমগ্র ভূতের অধীশ্বর। শিব থেকে সকল কিছু জাত হয় আবার শিবের মধ্যেই লীন হয়। পরমেশ্বরর শিবই হলো সেই বিরাট পুরুষ তাই শ্রুতিতে শিবকে "পুরুষঃ বৈ রুদ্রঃ" [তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/২৪/১] বলা হয়েছে। সেই বিরাট পুরুষ শিবই সকল ভূতের মধ্যে স্থিত আত্মা হয়ে বিভিন্ন যোনিতে বিচরণ করেন। [অথর্বশির উপনিষদ/৫] [শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৩/২] অনুযায়ী পরমেশ্বর ঈশান শিবই অদ্বিতীয় পরমেশ্বর যিনি কারো সহায়তা ছাড়া মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ও সংকোচন করেন। জগতের সৃষ্টি হলো পরমেশ্বর শিবের সম্প্রসারণ আর জগতের ধ্বংস হলো পরমেশ্বর শিবের সংকোচন। জগৎ সৃষ্টির জন্য পরমেশ্বর শিবের কারোর সাহায্য লাগে না কারো উপর নির্ভর করতে হয় না। কেননা পরমেশ্বর শিব পরম স্বতন্ত্র সকল তত্ত্ব পরমেশ্বর শিব থেকেই তো প্রকাশিত হয়। এবার এই প্রসঙ্গে শ্রুতিতে কি বলা আছে তা দেখে নেব— सर्वो वै रुद्रस्तस्मै रुद्राय नमो अस्तु। पुरुषो वै रुद्रः सन्महो नमो नमः।

विश्वं भूतं भुवनं चित्रं बहुधा जातं जायमानं चयत्। सर्वो ह्येष रुद्रस्तस्मै रुद्राय नमो अस्तु॥

कद्रुद्राय प्रचेतसे मीढुष्टमाय तव्यसे। वोचेम शंतम हृदे। सर्वोह्येष रुद्रस्तस्मै रुद्राय नमो अस्तु ॥ [যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/২৪/১ ও ১০/২৫/১] সবকিছুই বাস্তবে এক রুদ্রই। সেই রুদ্রকে আমরা নমস্কার করি। সেই পুরুষ, রুদ্রকে আমরা বার বার নকস্কার করি। এই ভৌতিক জগৎ, সৃষ্ট প্রাণী তথা ভূতকালে তথা বর্তমানে সংসারের রূপে যা কিছু অনেক প্রকারের তথা প্রচুর মাত্রায় নির্মিত রয়েছে, সেই সবকিছুই বাস্তবে এক রুদ্রই বটে। সেই রুদ্রকে নমস্কার করি। আমরা সেই রুদ্রের উদ্দেশ্যে স্তোত্র করি, যা আমাদের সর্বোচ্চ স্তরে সুখ প্রদান করে, যিনি স্তুতির যোগ্য, যিনি সর্বোচ্চ জ্ঞান দ্বারা সম্পন্ন, যিনি ভক্তদের উপর উত্তম প্রকারে বিভিন্ন বস্তুর বর্ষা করেন, যিনি অধিক শক্তিশালী তথা যিনি হৃদয়ে নিবাস করেন। বাস্তবে সেই সবকিছুই হলো রুদ্র। সেই রুদ্রকে নমস্কার।।

এ প্রসঙ্গে ঋগবেদে বলা আছে যে— ঈশানাদস্য ভুবনস্য ভুরে র্ন বা উ যোষদ্রুদ্রাদসূর্যম্।।৯॥ [ঋগবেদ সংহিতা/শাকল শাখা/২/৩৩/৯] পরমেশ্বর ঈশান রুদ্র সমস্ত ভুবনের অধিপতি এবং ভর্তা; তাঁর বল পৃথকৃত হয় না ॥৯।। আরও বলা আছে— ভুবনস্য পিতরং গীর্ভিরাভী রুদ্রং দিবা বর্ধয়া রুদ্রমক্তৌ।। [ঋগবেদ/শাকল শাখা/৬/৪৯/১০]

হে স্তবকারী! তুমি দিবাভাগে এ সমস্ত স্তোত্র দ্বারা ভুবন পালক রুদ্রকে বর্ধিত করো, তুমি রাত্রিকালে রুদ্রের সম্বর্ধনা করো।

উপরোক্ত শাস্ত্রের বিশ্লেষণ থেকে প্রমাণিত হয় শিবই সমস্ত ভূতের অধিপতি এবং জগতের সর্বকারণেরও কারণ তাই শ্রুতিতে বলা হয়েছে- "উমার্ধদেহং বরদং সর্বকারণ কারণম্" [কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/যোগতত্ত্ব উপনিষদ/১০১] যিনি পরাম্বিকা উমাকে নিজের অর্ধদেহে ( বামভাগে ) ধারণ করেছেন , সেই বরদাতা পরমেশ্বর সদাশিবই অখিল চরাচরের সমস্ত কারণের একমাত্র কারণ।

ভগবান রুদ্র শ্রীহরি কে ঈশ্বর বলেছেন , তাতেও শিবের পরত্ব খণ্ডন হয়না। কারণ বিষ্ণু কে প্রসংশা মাত্র করেছেন রুদ্র দেব। প্রমাণ দেখুন -

পরতত্ত্বৈকতাবুদ্ধ্যা ব্রহ্মাণং বিষ্ণুমীশ্বরম্‌ ।

পরতত্ত্বতয়া বেদা বদন্তি স্মৃতয়োঽপি চ ।। ২০

[তথ্যসূত্র - স্কন্দমহাপুরাণ/সূতসংহিতা/যজ্ঞবৈভবখণ্ড/উপরিভাগ/(সূতগীতা)  অধ্যায় ২/শ্লোক ২০]

অর্থ - বেদ বা  অন্য শাস্ত্রের মধ্যে কোথাও কোথাও ব্রহ্মা বা বিষ্ণু কে পরমেশ্বর বলা হয়েছে , কিন্তু তা তাদের ঔপাধিক রূপের দৃষ্টিতে নয় বরং তাদের অন্তরস্থ সত্ত্বা পরতত্ত্ব - এই দৃষ্টিতে বলা হয়েছে মাত্র ।

এই পরতত্ত্ব যে পরমেশ্বর শিব তা উপরেই শাস্ত্রগত ভাবে প্রমাণ করা হয়ে গেছে । 

___________________________________________________

🚫 বৈষ্ণবদের মূর্খতাপূর্ণ দাবী — ১৪

'ব্রহ্মাধিপতি' অর্থাৎ সেই ভগবান নারায়ণ হিরণ্যগর্ভ ব্রহ্মার যিনি নিয়ন্ত্রক। কারণ হিরণ্যগর্ভ ব্রহ্মা ভগবান নারায়ণ হতেই জাত এবং তাই ভগবান নারায়ণ ব্রহ্মাকে প্রতিষ্ঠিত করেন সে সম্পর্কে শ্রুতির বচন-
"হিরণ্যগর্ভ পরমমনত্যুদ্যং জনা বিদু।
স্কম্ভস্তদগ্রে প্রাসিঞ্চদ্ধিরণ্যং লোকে অন্তরা।।" (অথর্ববেদ ১০/৭/২৮)
অনুবাদ: যে হিরণ্যগর্ভকে মানুষ অবর্ণনীয় জানেন, সেই হিরণ্যগর্ভকে এই লোকে প্রথমে জগতাধারস্বরূপ পরব্রহ্মই প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

🔥 শৈব পক্ষ থেকে বৈষ্ণবদের দাবীর খণ্ডন —

"ব্রহ্মাধিপতি" এই শব্দের অর্থকেই বিকৃত করেছে বৈষ্ণবরা। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে ১০ম প্রপাঠকে উক্ত মন্ত্রের ভাষ্যে সায়ণাচার্য বলেছেন- ব্রহ্মাধিপতি; "বেদস্যাধিকত্বেন পালকঃ" অর্থাৎ যিনি বেদের পালন কর্তা। উক্ত একি বাক্যের সমর্থন পাওয়া যায় মহানারায়ণ উপনিষদেও যেখানে "ব্রহ্মাধিপতি" বলতে পরমেশ্বর শিবকে চতুর্বেদের পালক বলা হয়েছে [মহানারায়ণ উপনিষদ/২১ নং অনুবাক]। তাহলে ব্যাপারটা এমন হয়ে যাচ্ছে না যে, শাস্ত্রের অর্থকেই পালটে দিলো বৈষ্ণবরা, শাস্ত্রকেই খণ্ডন করে দিলো। আর যদি ব্রহ্মাধিপতি বলতে ব্রহ্মার অধিপতি হয় তাহলে তিনিও শিব প্রতিপাদিত হয়। অর্থাৎ যিনি ব্রহ্মাদি দেবতারও অধিপতি তিনিই পরমেশ্বর শিব। ব্রহ্মা হলো পরমেশ্বর শিবের সংকুচিত একটা সত্ত্বা যার মাধ্যমে পরমেশ্বর শিব জগতের সৃষ্টিকার্য পরিচালনা করেন। যা সদাশিবের সদ্যোজাত মুখ থেকে প্রকট হয়। পঞ্চধা বর্তমানং তং ব্রহ্মকার্যমিতি স্মৃতম্। ব্রহ্মকার্যমিতি জ্ঞাত্বা ঈশানং প্রতিপদ্যতে ॥২৭॥ [পঞ্চব্রহ্ম উপনিষদ/২৭ নং মন্ত্র] জগতের যে কৃত্য রয়েছে তা পাঁচটি ভাগে বর্তমান থাকে, তাকেই ব্রহ্ম কার্য বলে, তাই পরমেশ্বর শিব পঞ্চকৃত্যকারী। পরমেশ্বর ঈশান সদাশিবই পাঁচটি কৃত্য প্রতিপাদন করেন।।২২।। ব্যাখ্যাঃ— জগতের পাঁচটি কৃত্য গুলো হলো- সৃষ্টি, স্থিতি, লয়, তিরোভাব ও অনুগ্রহ। জগৎ সৃষ্টির পূর্বে পরমেশ্বর শিব ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্রকে যথাক্রমে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় এই তিনটা কার্যের দায়িত্ব দেন৷ এবং পরমেশ্বর শিবের নির্দেশেই জগতের তিনটা কৃত্য সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ত্রিদেব পালন করেন। আর দুটো কৃত্য তিরোভাব এবং অনুগ্রহ তা স্বয়ং পরমেশ্বর শিবই প্রতিপাদন করেন। এই তিনটা কৃত্যকে পরিচালনা করার প্রয়োজনে পরমেশ্বর শিব ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্রকে উৎপন্ন করেন তার প্রমাণ শ্রুতি শাস্ত্রেই আছে—
কার্যং বিষ্ণুঃ ক্রিয়া ব্রহ্মা কারণং তু মহেশ্বরঃ। প্রয়োজনার্থং রুদ্রেণ মূর্তিরকা ত্রিধা কৃতা।।১৪ [রুদ্রহৃদয় উপনিষদ/১৪ নং মন্ত্র]
অর্থঃ— সদাশিবই, কার্যরূপ বিষ্ণু, ক্রিয়াময় ব্রহ্মা আর কারণরূপ মহেশ্বর। এই প্রকারে পরমেশ্বর মহারুদ্র(সদাশিব), প্রয়োজন অনুসারে নিজেকে তিন রূপে প্রকাশিত করে।। ১৪।।
একই ভাবে ভস্মজাবাল উপনিষদের ২য় অধ্যায়েও বলা আছে—
যেখানে পরমেশ্বর শিবকে “হরি-হর-হিরণ্যগর্ভস্রষ্টা” বলা হয়েছে। অর্থাৎ বিষ্ণু, রুদ্র ও ব্রহ্মার সৃষ্টিকর্তাই হলো পরমেশ্বর শিব
একই ভাবে পরম পবিত্র শিবমহাপুরাণে বলা আছে— त्रिया भिन्नो ह्यहं विष्णो ब्रह्मविष्णुहराख्य । सर्गरक्षालयगुणैर्निष्कलोहं सदा हरे ॥ [শিবমহাপুরাণ/রুদ্র সংহিতা/সৃষ্টি খণ্ড/অধ্যায় 9/28] সত্যই, হে হরি, আমি চিরকালের জন্য নিষ্কলা (নির্গুণ)। সৃষ্টি, রক্ষণাবেক্ষণ ও বিলুপ্তির ক্রিয়াকলাপের জন্য আমি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও হর এই তিন রূপে নিজেকে প্রকাশ করি।।
এ প্রসঙ্গে শৈব তন্ত্রে বলা আছে— শ্রীভৈরব উবাচ্- "অকারশ উকারশ মকার তৃতীয়কঃ | বর্ণত্রয়মিদং প্রোক্তং ব্রহ্মাদ্যা দেবতাস্ত্রয়ঃ” || ২৩ || [স্বচ্ছন্দ তন্ত্র (কাশ্মীর শৈব তন্ত্র) / ষঠ পটল] অ কার— স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা— অর্থাৎ সদ্যোজাত বক্ত্র উ কার— স্বয়ং স্থিতিকর্তা বিষ্ণু— অর্থাৎ বামদেব বক্ত্র ম কার— স্বয়ং লয়কর্তা রুদ্র— অর্থাৎ অঘোর (বহুরূপ)
“সদ্যোজাত— মাটিতত্ত্ব— অ কার- সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা” চতুরস্রং ধরণ্যাদৌ ব্রহ্মা তত্রাধিদেবতা।।১৭৬ [যোগশিখা উপনিষদ/১ম অধ্যায়] সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা হলো পৃথ্বীতত্ত্বের অধিপতি।।
सद्योजातमुखात्मा यः पृथिवीतत्त्वनायकः ॥ ३० [শিবমহাপুরাণ- কৈলাস সংহিতা- অধ্যায়—১৫] ব্রহ্মা হলো সদ্যোজাত নামক পরমেশ্বর শিবের মুখস্বরূপ এবং পৃথিবীতত্ত্বের নায়ক।।
যোহসৃজদ্দক্ষিণাদঙ্গাদ্ ব্রাহ্মণং  লোকসম্ভব।।৩৪৫ [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩/৩৪৫] পরমেশ্বর শিব জগতের সৃষ্টির জন্যই ব্রহ্মাকে নিজের দক্ষিণপাশ থেকে উৎপন্ন করেন।।
এইজন্য শ্রুতিতে বলা হয়েছে— “যো বৈ রুদ্রঃ স ভগবান যশ্চ ব্রহ্মা তস্মৈ বৈ নমো নমঃ”।। [অথর্বশির উপনিষদ/২ নং অনুবাক/২ নং মন্ত্র] যিনি ব্রহ্মা রূপ ধারণ করে অখিল ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করছেন, সেই পরমেশ্বর রুদ্রকে পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি।।
“রুদ্রো ব্রহ্মা উমা বাণী তস্মৈ তস্মৈ নমো নমঃ”।।১৮ [রুদ্রহৃদয় উপনিষদ/১৮ নং মন্ত্র]
ব্রহ্মারূপ ধারণকারী রুদ্রকে ও সরস্বতী রূপধারণকারী পরা-উমাকে প্রণাম।।১৮
এই প্রসঙ্গে ঋগবেদে বলা আছে— আব্রহ্মস্তম্বপর্যন্তং ত্রৈলোক্যং সচরাচরম্ | উৎপাতিতং জগদ্ব্যাপ্তং তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্ত ||২৬ || [ঋগ্বেদ সংহিতা /খিলানি/ ৪ নং অধ্যায় / ১১নং খিলা] যিনি ব্রহ্মা থেকে শুরু করে ঘাসের গুচ্ছ পর্যন্ত সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর বস্তুর সাথে ত্রিলোক সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি সমগ্র বিশ্বকে ব্যাপ্ত করেছেন; সেই সর্বব্যাপী পরমেশ্বর শিবের প্রতি মন সঙ্কল্পিত হোক।।
অর্থাৎ পরমেশ্বর সদাশিবের সদ্যোজাত মুখ থেকে ব্রহ্মার উৎপত্তি। বা এটাও বলা যায় যে পরমেশ্বর শিবই নিজেকে ব্রহ্মা স্বরূপে প্রকাশিত করেন। তাই পরমেশ্বর শিবকে ব্রহ্মার জনয়িতা বলা হয় “হিরণ্যগর্ভং পশ্যত জায়মানং[শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৪/১২], "হরিহরহিরণ্যগর্ভ স্রষ্টার অপ্রমেয়ং" [ভস্মজাবাল উপনিষদ/২/৩]। আর পরমেশ্বর শিবই ব্রহ্মাকে প্রকটিত করে জগতের সৃষ্টি কার্য সঞ্চালন করেন৷ এটা পঞ্চকৃত্যের প্রথম কৃত্য।।

___________________________________________________

🚫 বৈষ্ণবদের মূর্খতাপূর্ণ দাবী — ১৫

'ব্রহ্মণোহধিপতি' ব্রহ্মের যিনি অধিপতি। এখানে লক্ষ্যনীয় যে ব্রহ্ম শব্দ মূলত ঈশ্বর পদবাচ্য। তাই এখানে ব্রহ্মের অধিপতি বলতে ঈশ্বরের অধিপতি বোঝানো হয় নি।কারণ ঈশ্বরের অধিপতি হয় না। তাই এখানে ব্রহ্ম বলতে প্রকৃতিতে বোঝানো হয়েছে কারণ মুণ্ডক শ্রুতিতে (১/১/৯) প্রকৃতিকে স্থান বিশেষে ব্রহ্ম বলা হয়েছে। তাই ভগবান কৃষ্ণ গীতা বলছেন সেই প্রকৃতি রূপ ব্রহ্মের তিনি আশ্রয়।
"ব্রহ্মণো হি প্রতিষ্ঠাহমমৃতস্যাব্যয়স্য চ৷
শাশ্বতস্য চ ধর্মস্য সুখস্যৈকান্তিকস্য চ৷" (গীতা ১৪/২৭)
অনুবাদ: আমিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা বা আশ্রয়। অমৃতত্ত্ব, অব্যয়ত্ত্ব, নিত্যত্ত্ব‌, নিত্য ধর্ম এবং ঐকান্তিক সুখের আশ্রয় আমিই।
তাই ভগবান নৃসিংহই প্রকৃতিরূপ ব্রহ্মের অধিপতি বা আশ্রয়।

🔥 শৈব পক্ষ থেকে বৈষ্ণবদের দাবীর খণ্ডন —

"ব্রহ্মণঃ অধিপতি" অর্থাৎ যিনি ব্রহ্মের (এখানে ব্রহ্ম বলতে প্রকৃতিকে বুঝিয়েছে) অধিপতি এমনটা বৈষ্ণবদের মান্যতা। কিন্তু, তৈত্তিরীয় আরণ্যক ১০ প্রপাঠকে সায়ণাচার্য উনার ভাষ্যে বলেছে যে- ব্রহ্মণঃ অধিপতি; "হিরণ্যগর্ভস্য অধিপতিঃ" অর্থাৎ যিনি ব্রহ্মার অধিপতি। তার একই কথাকে সমর্থন করে মহানারায়ণ উপনিষদ যেখানে "ব্রহ্মণোধিপতি" অর্থাৎ ব্রহ্মার বা ব্রহ্মাদি দেবতার যিনি অধিপতি [মহানারায়ণ উপনিষদ/২১ নং অনুবাক]
"ব্রহ্মণস্পতির্ব্রহ্মণঃ পাতা বা পালয়িতা বা" [যাস্ক নিরুক্ত/১০/১৫/৫] যিনি পালয়িতা তিনিই ব্রহ্মণঃ। ব্রহ্মণঃ অর্থাৎ পালন কর্তা ব্রহ্মা
"ব্রহ্মন্" [অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গঃ/৮] অর্থাৎ ব্রহ্মা। আর সেই পালন কর্তা ব্রহ্মার অধিপতি হলো পরমেশ্বর শিব। যা উপরে আমি বিস্তারিত ভাবে বিশ্লেষণ করেই দিয়েছি। আবার [নিঘন্টু/২/৭] অনুযায়ী "ব্রহ্মন্" এর অর্থ হয় অন্ন অন্নের পালক। অন্নের দ্বারা জীবলোকের প্রাণশক্তি বজায় থাকে। আর শ্রুতিতে অন্নের পালক অর্থে বলা হয়েছে- "নমো বভ্লুশায় ব্যাধিনে হন্নানাং পতয়ে নমঃ" [শুক্ল-যজুর্বেদ/১৬/১৮] বৃষভারূঢ় শত্রুধ্বংসী রুদ্রকে নমস্কার। অন্নের পালক রুদ্রকে নমস্কার।
"রাস্বা নো অমৃতং মর্তভোজনং ত্মনে তোকায় তননায় মৃল" [ঋগবেদ/১/১১৪/৬], হে মরণরহিত রুদ্র! হে অন্নের পালক! মনুষ্যদের ভোজন স্বরূপ অন্ন আমাদের প্রদান করো এবং আমাকে আমার পুত্রকে ও তার তনয়কে সুখ দান করো।

"অস্মে সোম শ্রিয়মধি নি ধেহি শতস্য নৃণাম্। মহি শ্রবস্তুবিনৃণাম্।। "মা নঃ সোম পরিবাধো মারাতয়ো জুহুরন্ত। আ ন ইন্দ্রো বাজেভব" [ঋগবেদ/১/৪৩/৭/৮] হে সোম! আমাদের প্রচুর পরিমাণে শত মানুষের ধন দান করো এবং মহৎ প্রভূত বলযুক্ত অন্ন দান করো।। সোমপ্রতিবন্ধকেরা ও শত্রুগণ আমাদের যেন হিংসা না করে। হে সোম! আমাদের অন্ন দান করো।

"উন্মা মমন্দ বৃযভো মরুত্বান্ত্বক্ষীয়সা বয়সা নাধমানম্" [ঋগবেদ/২/৩৩/৬], আমি প্রার্থনা করছি, অভীষ্টবর্ষী মরুৎবিশিষ্ট রুদ্র আমাকে দীপ্ত অন্ন দ্বারা তৃপ্ত করুক।

"ইমা রুদ্রায় স্থিরধন্বনে গিরঃ ক্ষিপ্রেষবে দেবায় স্বধারে। অষাড়হায় সহপমানায় বেধসে তিগ্ময়ুধায় ভরতা শৃণোতু নঃ" [ঋগবেদ/৭/৪৬/১], স্থিরকার্মুক, শীঘ্রগামী, বাণবিশিষ্ট, অন্নবান, কারও দ্বারা অনভিভূত, সকলের অভিভবকর এবং তীক্ষ্ণাস্ত্র বিধানকারী রুদ্রের উদ্দেশ্যে স্তুতি করো। তাহলে এবার "ব্রহ্মণঃ অধিপতি" বলতে ব্রহ্মার অধিপতি হোক বা অন্নের অধিপতি দুই ক্ষেত্রেই তা পরমেশ্বর শিবকেই প্রতিপাদিত করে।

আমরা যদি এটাও মেনে নিই যে প্রকৃতির অধিপতিকেই ব্রহ্মণোধিপতি বলা হয়েছে তাহলেও শাস্ত্রে সেই প্রকৃতির অধিপতি শিবকেই বলা হয়। শ্রুতিত বলা আছে যে— মহতঃ পরমব্যক্তং অবক্তাৎ পুরুষঃ পরঃ। পুরুষাৎ ন পরং কিঞ্চিৎ সা কাষ্ঠা সা পরাগতিঃ ॥১১ [কঠ উপনিষদ/১ম অধ্যায়/৩য় বল্লী] হিরণ্যগর্ভ অপেক্ষা প্রকৃতি শ্রেষ্ঠ, প্রকৃতি অপেক্ষা পরমাত্মা শ্রেষ্ঠ, পরমাত্মা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নাই, উহাই গতির চরম সীমা, উহাই শ্রেষ্ঠ গতি।।১১।।
শ্রুতিতে প্রকৃতিকে মায়া বলা হয়েছে, আর যিনি মায়ার থেকে শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ মায়ার অধীশ্বর তিনিই পরমেশ্বর। আর শ্রুতিতে মায়ার অধীশ্বর কাকে বলা হয়েছে তা দেখে নেব — মায়ান্তু প্রকৃতং বিদ্যাষ্মায়িনন্তু মহেশ্বরম্। তস্যাবয়ভূতৈস্তু ব্যাপ্তং সর্ব্বমিদং জগৎ।। ১০ [কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৪/১০] মায়াকেই প্রকৃতি ও মায়াধিষ্ঠাতাকে মহেশ্বর জানিবে।মহেশ্বরের অবয়ব দ্বারাই এই সমস্ত জগৎ ব্যাপ্ত।।১০
এই প্রসঙ্গে শ্রুতিতে আরও কি বলা আছে তাও দেখে নেব —
যো বেদাদৌ স্বরঃ প্রোক্তো বেদান্তে বেদানো চ প্রতিষ্ঠিতঃ।
তস্য প্রকৃতিলীনস্য যঃ পরঃ স মহেশ্বরঃ।। [তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/১১/৩], [মহানারায়ণ উপনিষদ/অনুবাক/১২] অকার, উকার ও মকারে যথাক্রমে বিরাট, হিরণ্যগর্ভ ও অব্যাকৃতরূপে ধ্যান করিয়া অকার বিরাটকে উকারে লয় করিয়া পরে হিরণ্যগর্ভরূপ উকারকে মূলঃ প্রকৃতিরূপ মকারে লয় করিবে। সেই প্রকৃতিলীন প্রণবের যে উৎকৃষ্ট ধ্যাতব্য বস্তু, তাহাকেই মহেশ্বররূপে জানিবে।
অর্থাৎ প্রকৃতির যিনি অধিপতি তিনিই পরমেশ্বর শিব।
এই প্রসঙ্গে মহাভারতে বলা আছে যে— অষ্টৌ প্রকৃতযশ্চৈব প্রকৃতিভ্যশ্চ যঃ পরঃ। অস্য দেবস্য যদ্ভাগং কৃৎস্নং সম্পরিবর্ততে ॥৫৫৷ [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৫/৫৫] প্রকৃতি, মহৎ, অহঙ্কার ও পঞ্চতন্মাত্র এই যে, আটটা প্রকৃতি এবং এই সকল প্রকৃতি হইতে শ্রেষ্ঠ যে পুরুষ, সে সমস্তই এই মহাদেব; আর ইহার অংশ যে সমগ্র জগৎ চলিতেছে, তাহাও ইনি ॥৫৫॥
পরমেশ্বর শিবকে কেন মহেশ্বর বলা হয় তা নিয়ে শ্রুতি কি বলছে তা একবার দেখে নেব— অথ কস্মাদুচ্যতে ভগবান্ মহেশ্বরঃ যস্মাদ্ ভক্তাজ্ঞানেন ভজন্ত্যনুগৃহ্বাতি চ বাচং সংসৃজতি বিসৃজতি চ সর্বান্ডাবান্ পরিত্যজ্যাত্মজ্ঞানেন যোগৈশ্বর্যেণ মহতি মহীয়তে তস্মাদুচ্যতে ভগবান্ মহেশ্বরঃ। তদেতৎ রুদ্র চরিত্রতম্ ॥ ৪ [অথর্বশির উপনিষদ/৪] (প্রশ্ন) পরমেশ্বর রুদ্রকে 'ভগবান মহেশ্বর' বলে সম্বোধন করা হয় কেন? (উত্তর) কারণ, যখন কোনো শিবভক্ত ব্যক্তি শিবজ্ঞান লাভের জন্য পরমেশ্বর শিবের ভজনা করেন, তখন পরমেশ্বর শিব তার উপর অনুগ্রহ করে কৃপাবর্ষণ করেন, বাক্ শক্তি (বেদ বিদ্যা)-র প্রাদুর্ভাব ঘটান, তার দ্বারা ভক্তের হৃদয়ে সেই ভাবের উদয় করেন- যা সর্ব দৈহিক ধর্মের ভাব পরিত্যাগ করে যোগের দ্বারা আত্মজ্ঞানে স্থিত হয়ে নিজেকে আত্মা বলে জানা যায় (যা বেদের বেদান্তরূপ আত্মজ্ঞান বলে বিখ্যাত, সেই ভক্ত তখন সর্বত্র আমিরূপী নিজ আত্মাকে সকল কিছুর মধ্যে দেখেন), সকলের মধ্যে আত্মারূপে বিদ্যমান ঐশ্বর্যসম্পন্ন সেই মহান ঈশ্বর শিবই যেহেতু স্থিত, তাই তাকে ভগবান মহেশ্বর বলা হয়।।
অর্থাৎ যিনি প্রকৃতির ঊর্ধ্বে তিনিই মহেশ্বর অর্থাৎ পরমেশ্বর শিব। বলে রাখা ভালো প্রকৃতি অর্থাৎ মায়াকে ত্রিগুণাত্মিকা বলা হচ্ছে, আর পরমেশ্বর শিব ত্রিগুণাতীত, অর্থাৎ ত্রিগুণের (সত্ত্ব,রজ,তম) ঊর্ধ্বে। ইতিহাস শাস্ত্র মহাভারতে বলেছে— যাস্য ঘোরতমা মূর্তির্জগৎ সংহরতে তথা। ঈশ্বরত্বান্মহত্ত্বাচ্চ মহেশ্বর ইতি স্মৃতঃ ॥৬॥ [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩৯/৬] মহাদেবের অতি ভীষণ যে মূর্ত্তি, তাহাই প্রলয়কালে জগৎ সংহার করে; আর তিনি ঈশ্বর ও মহান্ বলিয়া মহেশ্বর॥৬॥
আরও বলা আছে— মহেশ্বরশ্চ লোকানাং মহতামীশ্বরশ্চ সঃ।। [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩৯/২৮] তিনি (পরমেশ্বর শিব) প্রধান লোকদিগের ঈশ্বর বলেই শিব মহেশ্বর।।২৮।। এবার শ্রুতিতে বলা হচ্ছে পরমাত্মা থেকে শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নেই, পরমাত্মা এক ও অদ্বিতীয় "একমেবাদ্বিতীয়ম" ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয় [ছান্দোগ্য উপনিষদ/৬/২/১]
তাহলে বেদানুযায়ী সিদ্ধান্ত দেখলে এটাই মান্যতা পাই পরমেশ্বর এক, দুজন পরমেশ্বর হতে পারে না। কেননা পরমেশ্বর যদি দুজন হয়, তাহলে তা শ্রুতি বিরুদ্ধ হয়ে যাবে। তাহলে এখন দেখার বিষয় হলো বেদ অনুযায়ী সেই অদ্বিতীয় পরমেশ্বর কে। আর শ্রুতিতে অদ্বিতীয় পরমেশ্বর বলতে বলেছে,
"এক হি রুদ্র ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য" রুদ্রই (পরশিব) অদ্বিতীয় পরমেশ্বর দ্বিতীয় কোনো সত্ত্বা নেই [কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৩/২] 
"শিব এব কেবলঃ" একমাত্র শিব ছিলেন [কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৪/১৮] "একো রুদ্রো ন দ্বিতীয়ায় তস্মৈ য ইমাল্লোকানীশত ঈশানীভিঃ" [অথর্ববেদ/অথর্বশির উপনিষদ- ৫] সেই এক রুদ্রদেব ঈশানীশক্তিদ্বারা এই অনন্তভুবনের সর্ব্বকর্তৃত্ব করিতেছেন। তিনি অদ্বিতীয় কাহারও সাহায্যের অপেক্ষা করেন না। রুদ্রদেবই এই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র অধীশ্বর, তিনি ভিন্ন জগৎকর্তা আর কেহ নাই। একই কথা বিষ্ণুজীও বলেছেন যে শিব ভিন্ন অন্য কেউ নেই- "সর্বং শিবাদন্যত্র কিঞ্চন" সবই শিব, শিব ভিন্ন অন্য কেউ-ই নেই [কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/বরাহ উপনিষদ/তৃতীয় অধ্যায়/৩২] একই কথার সমর্থন পাওয়া যায় ন্যায় শাস্ত্রের মধ্যেও যেখানে রুদ্রকে (পরশিবকে) অদ্বিতীয় পরমেশ্বর বলা হচ্ছে "এক এব রুদ্র অবস্ততে ন দ্বিতীয় " অর্থাৎ রুদ্র ভিন্ন দ্বিতীয় কোনো সত্ত্বা নেই [নিঘন্টু/১/২/৪/৯]। শ্রুতির সামঞ্জস্যতা ন্যায় শাস্ত্রের সাথে সম্পূর্ণ এক হয়। তাই শ্রুতি এবং ন্যায় শাস্ত্র মতে এটা দৃষ্টান্তের লক্ষণ। আর দৃষ্টান্তের কোনো খণ্ডন হয় না। সর্বশেষ এটাই বলতে চাই বৈষ্ণবরা পরমেশ্বর শিবের প্রতি সমর্পিত মন্ত্রকে অর্থের অনর্থ করে বিকৃত করলো এবং পুরো মন্ত্রটাকে নৃসিংহ বাচক করে দিলো।
তাহলে এবার দেখে নেওয়া যাক মূল মন্ত্রটার অর্থ কি দাঁড়ায়— ॐ ঈশানঃ সর্ববিদ্যানাং ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ব্রহ্মাধিপতির্ব্রহ্মণোহধিপতির্ব্রহ্মা শিবো মে অস্তু সদাশিবোম্।। [কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরন্যক/১০ম প্রপাঠক] অর্থঃ— পরম ঈশ্বর হল- ঈশান-শিব সর্বশক্তিমান, সবকিছুর মধ্যেই তিনি(শিব) আছেন, ঈশানই সকল বিদ্যা (৬৪ কলা) ও ভূতের অধীশ্বর (স্থাবরজঙ্গম এর একমাত্র ঈশ্বর)। যিনি বেদের পালন কর্তা, যিনি ব্রহ্মাদিদেবতার (ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্রাদি দেবতার) অধিপতি সেই পরমেশ্বর সদাশিব আমাদের সদা মঙ্গল বিধান করুক।। অর্থাৎ সদাশিবই একমাত্র পরমেশ্বর যিনি সর্বভূত ও বিদ্যার অধীশ্বর যিনি বেদ তথা ব্রহ্মাদিদেবতারও অধীশ্বর। এখানে যখন স্পষ্ট শব্দ প্রমাণ রয়েছে যে সদাশিবই সবকিছু, তাহলে কীভাবে এটা নৃসিংহ বাচক হয়? আর যদি আমি ধরেও নিই এটা নৃসিংহ বাচক তাহলে কোনো ক্ষতি নেই, কেননা নৃসিংহ রূপটাও পরমেশ্বর শিবের যা ভগবান বিষ্ণু পরমেশ্বর শিব থেকে প্রাপ্ত করেছিলো।

আসুন তাহলে সেই প্রমাণ টাও দেখে নিই— কালাগ্নিরুদ্র রূপস্য ভীষণস্য মহেশিতুঃ। আকারো নরসিংহস্য যথা তস্য তথৈব চ। ॥ ৭০৩ জ্বালামালী নৃসিংহেতি তস্য নাম নিগদ্যতে। স এত্র ভগবান রুদ্রঃ সিংহরূপেণ সংস্থিতঃ ॥ ৭০৪ সিংহরূপমতস্তস্যাঃ পতি রুদ্রং প্রপূজয়েৎ। দেব্যা দক্ষিণভাগে তু সর্বদা স্থিতমীশ্বরম্ ॥ ৭০৫ চিন্তয়িত্বার্চয়েৎ সর্বোপচারৈরম্বিকাং যথা। [মহাকাল সংহিতা/গুহ্যকালীখণ্ড/১০ম পটল]
মাতা উমার ইচ্ছা পূরন করার জন্যই পরমেশ্বর শিব নৃসিংহ রূপটা প্রকট করেছিলো। এবং সেখানে ভগবান বিষ্ণু এসে পরমেশ্বর শিব থেকে সেই নৃসিংহ রূপ টা চেয়ে নেয়। পরবর্তী হিরণ্যকশিপু বধের পর ভগবান বিষ্ণু যখন নৃসিংহ রূপের তেজ সহ্য করতে অসমর্থ হয়, তখন পরমেশ্বর শিব শরভেশ্বর রূপ ধারণ করে ভগবান বিষ্ণুকে উদ্ধার করেন। তাহলে মীমাংসা এটাই যে নৃসিংহের রূপটাও যেহেতু পরমেশ্বর শিবের তাহলে, এই মন্ত্রটা যদিও নৃসিংহ বাচক হয়, তাহলেও তা পরমেশ্বর শিবের প্রতিই সমর্পিত। তাহলে উক্ত শ্রুতি প্রমাণ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে এই সম্পূর্ণ শাস্ত্র বাক্য পরমেশ্বর সদাশিবকেই প্রতিপাদিত করে। আর যেহেতু শ্রুতির বচনই সর্বোচ্চ তাই অহেতুক ব্যাকরণ এর মারপ্যাঁচ দিয়ে অর্থের অনর্থ করা ন্যায় সঙ্গত নয়। তাই শ্রুতিতে যা বলা আছে তাই মান্যতা পাবে, কারণ শ্রুতি অকাট্য।।

___________________________________________________

🚫 বৈষ্ণবদের মূর্খতাপূর্ণ দাবী — ১৬

'যজুর্বেদবাচ্য' পরব্রহ্ম ভগবান নৃসিংহই যজুর্বেদ বাচ্য। কারণ বেদ সকল নারায়ণই। "বেদো নারায়ণঃ সাক্ষাৎ" (ভাগবতম্ ৬/১/৪০) যেহেতু বেদ ভগবান নারায়ণেরই প্রকাশ তাই বেদবাচ্য শব্দও নারায়ণই।
"তং হি সাম জানীয়াদ্যো জানীতে সোহমৃতত্বং চ গচ্ছিতি"- এইরূপে সাম(নৃসিংহ ব্রহ্মবিদ্যা মন্ত্র) জানিবে । যে ব্যক্তি উক্ত প্রকারে সাম জানিতে পারেন, তিনি অমৃতত্ব, অর্থাৎ মুক্তিলাভ করিয়া থাকেন।
অনুবাদ: যিনি সর্বগতঃ, নিত্য, পরব্রহ্মপুরুষ ভগবান নরকেশরীর বিগ্রহ হিরণ্যাভাযুক্ত শ্যামবর্ণ, যিনি সমস্ত পরিবর্তনের অতীত নির্বিকার, সূর্যচন্দ্র তার চক্ষু বলিয়া বিরূপাক্ষ, তিনি শান্তি ও কল্যাণ করেন তাই শঙ্কর, হিরণ্যকশীপুকে বধ করিয়া তার রক্তে শ্যাম ভগবান রঞ্জিত হোন তাই নীললোহিত। সমস্ত কান্তি ও সৌন্দর্যের অধিপতি তাই উমাপতি, সমস্ত প্রাণীর স্বামী তাই পশুপতি, তিনি পিনাকপাণি, অমিত দ্যুতি সম্পন্ন, সমস্ত বিদ্যার অধীশ্বর, সমস্ত ভূতের ঈশ্বর, ব্রহ্মার অধিপতি, প্রকৃতিরূপ ব্রহ্মের আশ্রয়, যজুর্বেদ বাচ্য, এইরূপে সাম (মন্ত্রগান) জানিবে । যে ব্যক্তি উক্ত প্রকারে সাম জানিতে পারেন, তিনি অমৃতত্ব, অর্থাৎ মুক্তিলাভ করিয়া থাকেন।

🔥 শৈব পক্ষ থেকে বৈষ্ণবদের দাবীর খণ্ডন —

যজুর্বেদবাচ্যঃ— শুধু যজুর্বেদ বেদবাচ্য নয়, সকল শাস্ত্র যাকে প্রতিপাদিত করে, যিনি শাস্ত্রের জ্ঞানস্বরূপ, সকল শাস্ত্র অধ্যয়ন করলে যাকে জানা যায়, যাকে উপলব্ধি করব যায় তিনিই হলো পরমেশ্বর শিব। শাস্ত্রের প্রতিটা অক্ষর পরমেশ্বর শিবের প্রতিই সমর্পিত।
বৈষ্ণব রা পুরাণ থেকে এই যজুর্বেদবাচ্যঃ পদের ব্যাখ্যা করেছে, অথচ বেদেই এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা রয়েছে, আর যখন বেদেই এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা উপস্থিত তাহলে সেখানে তার ব্যাখ্যা শুধু মাত্র নিজেদের মনের মতো দেখাবার জন্য়ে বেদ মন্ত্রের উপরে উঠে পুরাণ দিয়ে বিচার করাকে বেদের অপব্যাখ্যা বলা হয় । যাই হোক, দেখুন শ্রুতিতে বলা আছে যে — বেদৈরনেকৈরহমেব বেদ্যো বেদান্তকৃদ্বেদবিদেব চাহম্। [কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/কৈবল্য উপনিষদ/২২] সমস্ত বেদ-বেদান্ত দ্বারা আমিই (জ্ঞাতব্য) জানার যোগ্য। আমি বেদান্ত কর্তা এবং বেদবেত্তাও স্বয়ং আমিই (শিবই)।। অর্থাৎ বেদ অধ্যয়ন করলে যাকে জানা যায়, যাকে উপলব্ধি করা যায় তিনিই সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিব। সকলেই এটা জানেন যে বেদ পরমেশ্বর শিবের নিশ্বাস থেকে প্রকট হয়েছে। তাই যিনি বেদের কর্তা, তিনিই সমস্ত বেদ জুড়ে জ্ঞাত হন। কিন্তু সাধারণ মানুষ মায়ার দ্বারা আবদ্ধ হয়ে এই পরমসত্য জানতে পারেন না। এ প্রসঙ্গে শ্রুতিশাস্ত্র বলছে— "যোহসৌ সর্বৈষু বেদেষু পঠতে হ্যজ ঈশ্বরঃ | অকায়ো নির্গুণোহধ্যাত্মা তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু ||২৩||" [ঋগ্বেদ সংহিতা/ খিলানি/ চতুর্থ অধ্যায়/ ১১ নং খিল], [ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১] ‘সোহহং’ ‘প্রজ্ঞানম্ ব্রহ্ম’ ‘চৈতন্যম্ আত্মা’ ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ ‘প্রজ্ঞানাত্মা’ ব্যাখ্যাঃ— সকল জীবের অভ্যন্তরে যে এক নিরাকার চৈতন্য সত্ত্বা বর্তমান, তিনিই আসলে সেই ব্রহ্ম। ব্রহ্ম আর জীবাত্মা অভিন্ন। এই ব্রহ্মই সাক্ষাৎ পরমশিব। তাঁকে আত্মজ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করতে হয়, এই জ্ঞান লাভের উত্তম মার্গ হল বেদ শাস্ত্র/ বেদান্ত। এই বেদ দ্বারা সেই নির্গুণ পরমেশ্বর শিবই বাচিত হন। যোগীগণ তাই নিজ আত্মাকে সেই শিবের সাথেই একাত্ম মনে করে অদ্বৈত ভাবে উত্তীর্ণ হন। তাই সেই এক শিবের প্রতিই অর্থাৎ আত্ম স্বরূপের প্রতিই মন সংকল্পিত হওয়া উচিৎ প্রত্যেকের। ইহাই আসলে মানস পূজা। সেই জন্য মান্য যোগশাস্ত্র, আগম, তন্ত্র এর জ্ঞান কাণ্ড সর্বদাই শ্রুতি শাস্ত্রের জ্ঞানকাণ্ডকে সমর্থন করে চলে। উভয়েই সেই এক শিবেরই প্রতিপাদক। এবং শ্রুতিশাস্ত্র আরও বলছে যে— যো বৈ বেদাদিষু গায়ত্রী সর্বব্যাপীমহেশ্বরাৎ | তদ্বিরুক্তং তথাদ্বৈশ্যং তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু ||২১||" [ঋগ্বেদোক্ত শিবসংল্পসূক্ত/ঋগ্বেদ সংহিতা/খিলানি/চতুর্থ অধ্যায়/১১ নং খিলা] [ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১] যিনি সাক্ষাৎ সমগ্র বেদের গায়ত্রীস্বরূপ, যিনি সর্বব্যাপী মহেশ্বর বলে উক্ত হয়েছেন, সেই অদ্বিতীয় শিবের প্রতি মন সংকল্পিত হউক।।  সকল শাস্ত্রের মধ্যে যা অত্যন্ত গোপনীয় জ্ঞান তা হলো শিবজ্ঞান। তাই গীতার মধ্যে যে জ্ঞানটা রয়েছে তা মূলত পরমেশ্বর শিবেরই। কারণ শাস্ত্রেই বলা আছে শ্রুতি-স্মৃতি, ব্যাকরণাদি অঙ্গশাস্ত্র, পুরাণ ও অধ্যাত্মশাস্ত্রের মধ্যে যিনি অতীব গুহ্যভাবে আছেন তিনিই হচ্ছেন সাক্ষাৎ মহাদেব। 

এবার ইতিহাস শাস্ত্র থেকে দেখাবো ,
ব্যাস উবাচ— বেদাঃ সাঙ্গোপনিষদঃ পুরাণাধ্যাত্মনিশ্চয়াঃ । যদত্র পরমং গুহ্যং স বৈ দেবো মহেশ্বরঃ ॥৮৯ [মহাভারত/দ্রোনপর্ব/অধ্যায় ১৭০/৮৯] অর্থঃ— ব্যাসদেব বলিলেন! ব্যাকারণাদি অঙ্গশাস্ত্র ও উপনিষদের সহিত সমস্ত বেদ এবং পুরাণ ও অধ্যাত্মশাস্ত্র এই গুলির মধ্যে যাহা অত্যন্ত গোপনীয়, তাহাই মহেশ্বর মহাদেব ॥৮৯।।

মহাভারতে আরও বলা আছে যে—
যজুঃপাদভুজো গুহ্যঃ প্রকাশো জঙ্গমস্তথা।।
[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৬/৯২]
টীকা— "যজুর্ব্বেদঃ পাদভুজৌ"।। অর্থাৎ যজুর্বেদ যার চরণ ভজনা করেন তিনিই পরমেশ্বর শিব। তাই এখানে স্পষ্ট যে, যজুর্বেদ তথা সমগ্র বেদের বাচ্য হলেন শুধুমাত্র প্রভু পরমেশ্বর শিব।

পরমেশ্বর শিব সম্পর্কে বেদ স্বয়ং কি বলে তা দেখে নেওয়া যাক—
ঋগুবাচ—
যদন্তঃস্থানি ভূতানি যতঃ সর্ব্বং প্রবর্ততে।
যদাহুস্তৎপরং তত্ত্বং স রুদ্রত্ত্বেকএব হি ॥ ২৪।
যজুরুবাচ—
যোযজ্ঞেরখিলৈরীশো যোগেন চ সমিজ্যতে।
যেন প্রমাণংহি বয়ং স একঃ সর্ব্বদৃক শিবঃ ॥ ২৫।
সামোবাচ—
যেনেদং ভ্রাম্যতে বিশ্বং যোগিভির্যোবিচিন্ত্যতে।
যদ্ভাসা ভাসতে বিশ্বং সএক্যুম্বকঃ পরঃ ॥ ২৬।
অথর্ব্বোবাচ—
যং প্রপশ্যন্তি দেবেশং ভক্ত্যানুগ্রহিণো জনাঃ।
তমাহুরেকং কৈবল্যং শঙ্করং দুঃখতস্করম্ ॥২৭।।

[স্কন্দপুরাণ/কাশীখণ্ড/অধ্যায় ৩১]
ঋগবেদ কহিলেন—প্রলয়কালে সমস্ত ভূত যাঁহার অন্তস্থিত হয় এবং যাঁহা হইতে সৃষ্টিসময়ে পুনর্ব্বার প্রকটিত হয়, সকলে যাঁহাকে পরম তত্ত্ব বলিয়া কীর্ত্তন করেন তিনিই একমাত্র রুদ্র জানিবেন || ২৪ ৷।
যজুর্ব্বেদ কহিলেন— যিনি অখিলযজ্ঞ ও যোগদ্বারা আরাধিত হইতেছেন এবং যাঁহার দ্বারা আমরা প্রমাণ বলিয়া পরিগণিত হইতেছি, সেই সর্ব্বদর্শী অদ্বিতীয় শিবই পরমতত্ত্ব জানিবেন ॥ ২৫ ৷।
সামবেদ কহিলেন— যাঁহা কর্তৃক এই বিশ্ব ভ্রাম্যমাণ হইতেছে, যোগিগণ যাঁহাকে নিয়ত চিন্তা করিতেছেন, এই বিশাল জগৎ যাঁহার প্রভাবে প্রভান্বিত হইতেছে, সেই অদ্বিতীয় ত্রিলোচনই পরমতত্ত্ব ॥ ২৬৷।
অথর্ব্ববেদ কহিলেন— অনুগৃহীত ভক্তজনেরা ভক্তি দ্বারা যে দেবদেবকে নিরন্তর দর্শন করিতেছেন এবং লোকে যাঁহাকে সৰ্ব্বদুঃখ নাশন, কৈবল্যরূপী শঙ্কর বলিয়া কীর্ত্তন করিতেছে, তিনিই পরমতত্ত্ব জানিবেন।।২৭৷।


এবার দেখে নেব বেদ অনুসরণকারী ব্রাহ্মণেরা(বিদ্বানেরা) পরমেশ্বর শিব সম্পর্কে কি বলেন —
দিব্যাদিব্যঃ পরো ভাবো হ্যয়নে দক্ষিণোত্তরে।
এনং প্রজাপতিঃ পূর্ব্বমারাধ্য বহুভিঃ স্তবৈঃ ॥৪৭৷৷
প্রজার্থং বরযামাস নীললোহিতসংজ্ঞিতম্।
ঋগ্ ভিমনুশাসন্তি তত্ত্বে কৰ্ম্মণি বন্ধু চাঃ ॥৪৮৷৷
যজুভিং ত্রিধা বেদ্যং জুবত্যধ্বর্য্যবোহধ্বরে।
সামভির্যঞ্চ গাযন্তি সামগাঃ শুদ্ধবুদ্ধষঃ ॥৪৯৷
খাতং সত্যং পরং ব্রহ্মস্তুবন্ত্যার্থর্ব্বণা দ্বিজাঃ।
যজ্ঞস্য পরমা যোনিঃ পতিশ্চায়ং পরঃ স্মৃতঃ ॥৫০॥

[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৫/৪৮-৫০]
এই মহাদেবই সুখময় অবস্থা, দুঃখময় অবস্থা, দক্ষিণায়ন ও উত্তরায়ন এবং ব্রহ্মা পূর্ব্বে বহুতর স্তবদ্বারা এই মহাদেবের আরাধনা করিয়া, লোকসৃষ্টির নিমিত্ত তাঁহার নিকট বর গ্রহণ করিয়াছিলেন। ঋগবেদীয়গণ মন্ত্রদ্বারা আরদ্ধকার্য্যে যাঁহার স্তব করেন ॥৪৭-৪৮৷৷
যজুর্ব্বেদীযগণ যজ্ঞে মন্ত্রদ্বাবা দক্ষিণাগ্নি, গার্হপত্য ও আহবনীয়রূপ জ্ঞাতব্য যে মহাদেবের উদ্দেশে হোম করিয়া থাকেন এবং শুদ্ধবুদ্ধি সামবেদীয়েবা সামগানদ্বারা যাঁহার স্তব করেন ॥৪৯৷৷
অথর্ব্ববেদীয় ব্রাহ্মণেরা ধ্যানপ্রাপ্ত ও সত্যস্বরূপ যে পরব্রহ্মেব স্তব করেন; এই সেই মহাদেব যজ্ঞের পরম কারণ ও যজ্ঞের প্রধান পতি ॥৫০॥

আশা এসবের আর বিস্তারির ব্যাখ্যা করতে হবে না, এখন বোঝায় যাচ্ছে বেদবাচ্য বলতে যে, পরমেশ্বর শিবকেই বোঝায় তা আর আলাদা করে প্রমাণ করতে হয় না।।

___________________________________________________

তাহলে মূল মন্ত্রটার সঠিক অনুবাদ কি হয় তা দেখে নেবো—

ঋতং সত্যং পরং ব্রহ্ম নরকেসরিবিগ্রহং কৃষ্ণপিঙ্গলম্। ঊর্ধ্বরেতং বিরূপাক্ষং শঙ্করং নীললোহিতম্। উমাপতিঃ পশুপতিঃ পিনাকী হ্যমিতদ্যুতিঃ। ঈশানঃ সর্ববিদ্যানাং ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ব্রহ্মাধিপতিব্রহ্মণোহধিপতিয়ো বৈ যজুর্বেদবাচ্যস্তং হি সাম জানীযাদ্যো জানীতে সোহমৃতত্বং চ গচ্ছতি ॥ ১৩
[অথর্ববেদ/নৃসিংহ পূর্বতাপনী উপনিষদ/প্রথমোপনিষদ]
নরসিংহবিগ্রহ হল মূলত সেই ঋত সত্য সর্বোচ্চ সত্ত্বা পরমব্রহ্ম পরমপুরুষ কৃষ্ণপিঙ্গল অর্থাৎ অর্ধনারীশ্বর শিবেরই স্বরূপ, যিনি ঊর্ধ্বরেত বিরূপাক্ষ পরমেশ্বর শঙ্কর, নীলকন্ঠ ও লোহিত বর্ণের আভাযুক্ত জটাজুটধারী, তিনি উমার পতি, তিনি পাশরূপী মায়ার দড়িতে আবদ্ধ সকল জীব অর্থাৎ পশুদের স্বামী পশুপতি, তিনি পিনাক ধনুকধারী, তিনিই অমিত দ্যুতি সম্পন্ন।
সেই ঈশান শিবই সমস্ত বিদ্যার অধিপতি, সেই ঈশ্বর সদাশিবই সমস্ত ভূত পদার্থের অধিশ্বর, অধিপতি ব্রহ্মারূপী হিরণ্যগর্ভের যিনি অধিপতি (অর্থাৎ বিষ্ণু), সেই বিষ্ণুরও যিনি অধিপতি শিব। তার এই বিষয়ে যজুর্বেদ বিস্তারিত বাচ্যার্থ প্রকাশ করেছে, সামবেদও একই কথা বলে। এভাবে যিনি নৃসিংহ কে পরমেশ্বর শিবের থেকে উৎপন্ন হওয়া একটি স্বরূপ বলে জানতে পারেন তিনিই অমৃত তত্ত্ব লাভ করতে সক্ষম।
উক্ত নৃসিংহ পূর্বতাপনী উপনিষদের মন্ত্র অন্য যে শ্রুতি বাক্যের সাথে সামঞ্জ্যতা রাখে তাও দেখে নেবো—
ঋতং সত্যম্ পরব্রহ্ম পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলম্। ঊর্ধ্বরেতং বিরূপাক্ষং বিশ্বরূপায় বৈ নমো নমঃ।। [কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/১২], [মহানারায়ণ উপনিষদ/২৩] যিনি বাণীর অবিষয়, মনের দ্বারা অগম্য যিনি নিত্য শাশ্বত, সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাপক থেকে ব্যাপক, যিনি নিজেই প্রপঞ্চ রূপে পরিণত হয়, সর্বোৎকৃষ্ট পুরুষ যিনি সকল প্রাণীর হৃদয়ে বাস করেন, যিনি ডানপাশে কৃষ্ণবর্ণ ও বামপাশে পিঙ্গলবর্ণ দ্বারা যুক্ত অর্ধনারীশ্বর উমা-মাহেশ্বরাত্মক বিগ্রহ। যিনি অগ্নিলিঙ্গের ন্যায় দ্যুলোক পর্যন্ত দেদীপ্যমান, যার ত্রিনেত্র সূর্য, সোম ও অগ্নি স্বরূপ সেই জগৎস্বরূপ পরব্রহ্ম শিবের নিমিত্তে নমস্কার করি।।
পরবর্তী শ্রুতি বাক্য হলো—
ॐ ঈশানঃ সর্ববিদ্যানাং ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ব্রহ্মাধিপতির্ব্রহ্মণোহধিপতির্ব্রহ্মা শিবো মে অস্তু সদাশিবোম্।। [কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরন্যক/১০ম প্রপাঠক] অর্থঃ— পরম ঈশ্বর হল- ঈশান-শিব সর্বশক্তিমান, সবকিছুর মধ্যেই তিনি(শিব) আছেন, ঈশানই সকল বিদ্যা (৬৪ কলা) ও ভূতের অধীশ্বর (স্থাবরজঙ্গম এর একমাত্র ঈশ্বর)। যিনি বেদের পালন কর্তা, যিনি ব্রহ্মাদিদেবতার (ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্রাদি দেবতার) অধিপতি সেই পরমেশ্বর সদাশিব আমাদের সদা মঙ্গল বিধান করুন।।
এর থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, উক্ত নৃসিংহ শ্রুতি বাক্য পরমেশ্বর শিবের প্রতিই সমর্পিত। কেন সমর্পিত তা আমি ইতিমধ্যেই বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছি। উপরোক্ত শ্রুতি বাক্যের মধ্যে অবস্থিত শব্দ প্রমাণ থেকেই প্রমাণিত হয়ে যায় ইহা পরমেশ্বর শিববাচক। কেননা শ্রুতির মধ্যে ত্রিনেত্র, নীলকণ্ঠ, নীললোহিত, উমাপতি, পিনাকী, বিরুপাক্ষ, কৃষ্ণপিঙ্গল, ঊর্ধ্বরেতা, বিশ্বরূপ, ঈশান, সদাশিব উক্ত শব্দ প্রমাণ দ্বারা পরমেশ্বর শিবই বোধিত হয়। তাই অহেতুক ব্যাকরণ দ্বারা অর্থের অনর্থ করলেও তাতে এই প্রমাণিত হয় না যে, উক্ত শ্রুতি বাক্য দ্বারা নৃসিংহ প্রতিপাদিত হয়।
উক্ত শ্রুতিবাক্যের সামঞ্জস্যতা পাওয়া যায় নারদ পুরাণেও—
ধনের অভিলাষী মানুষের সর্বদা পূর্বোক্ত প্রকারে শুক্ল বর্ণযুক্ত পাপহারী নৃসিংহের ধ্যান করা উচিত, যার বামাঙ্কে পদ্ম হস্তা লক্ষ্মী (কমলা অম্বিকা) আলিঙ্গন করে রয়েছেন। বিষ অপমৃত্যু রোগ এবং নিখিল উপদ্রবের শান্তির জন্য কালানল এর সমান প্রভাযুক্ত, যিনি সুন্দর মালা ধারণ করেছেন, মহা ভয়ংকর রুদ্র রূপ, কন্ঠে হার দ্বারা সুশোভিত, সর্পের যোগ্য ও পবিত্র দ্বারা ভূষিত, যিনি পাঁচ মুখ যুক্ত, চন্দ্রমৌলি নীলকণ্ঠ, প্রত্যেক মুখে তিনটি করে নেত্র ধারণকারী পরিদ তুল্য দশ এবং বান ধারণকারী, ইন্দ্রগোপা, নীলমণি, চন্দ্রমা তথা স্বর্ণের সদৃশ কান্তি সম্পন্ন পূর্ব দিক থেকে শুরু করে হস্তে সুশোভিত রুদ্রাক্ষমালা, গদা, পদ্ম, গাভীর দুধের সমান শ্বেত বর্ণের শঙ্খ, ধনুক, মুশল, চক্র, খড়গ, ত্রিশূল উত্তর দিক পর্যন্ত ঊর্ধ্ব বিস্তৃত মুখসম্পন্ন আর সর্বালঙ্কারে ভূষিত নৃসিংহের ধ্যান করুন। [নারদপুরাণ/পূর্বভাগ/অধ্যায় ৭১/৫০-৫৬ শ্লোক]
এখানেও উক্ত পুরাণ বাক্য দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় উক্ত নৃসিংহ শ্রুতি বাক্য শিবকেই প্রতিপাদিত করে।
এবার নৃসিংহ শ্রুতির পরবর্তী শ্রুতিবাক্যে কি আছে তাও একবার দেখে নেব —
তদ্বা এতৎপরমং ধাম মন্ত্ররাজাধ্যাপকস্য যত্র ন সূর্যস্তপতি যত্র ন বায়ুর্বাতি যত্র ন চন্দ্রমা ভাতি যত্র ন নক্ষত্রাণি ভান্তি যত্র নাগ্নির্দহতি যত্র ন মৃত্যুঃ প্রবিশতি যত্র ন দুঃখং সদানন্দং পরমানন্দং শান্তং শাশ্বতং সদাশিবং ব্রহ্মাদিবন্দিতং যোগিধ্যেয়ং পরমং পদং যত্র গত্বা ন নিবর্তন্তে যোগিনঃ ॥ ২০ [অথর্ববেদ/নৃসিংহ পূর্বতাপনী উপনিষদ/পঞ্চমোপনিষদ]
এই মন্ত্ররাজ জপ করে জপকারী ব্যক্তি সেই পরমধাম প্রাপ্ত করেন, যেখানে বায়ু গমন করে না, যেখানে সূর্য তাপ দেয় না, যেখানে চন্দ্রের প্রকাশ নেই, সেখানে নক্ষত্র চমকায় না, যেই স্থানে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয় না তথা যেখানে মৃত্যুর প্রবেশ নেই, যে স্থান সর্বদা দুঃখরহিত, যেখানে সর্বদাই আনন্দ বিরাজ করে, যা পরমানন্দদায়ক স্থান, শান্ত, শাশ্বত, যেখানে স্বয়ং প্রভু সদাশিব বিরাজমান, সেই প্রভু শিবই ব্রহ্মা সহ সকল দেবতাদের দ্বারা বন্দনীয় হন, তিনি যোগীব্যক্তিদের একমাত্র পরম লক্ষ্যবস্তু, যা পরমপদ নামে বিখ্যাত, যেখানে সাধকেরা পৌঁছে গেলে সংসার থেকে মুক্ত হয়ে যায়, আর কখনো সংসারে ফিরতে হয় না।।
অর্থাৎ নৃসিংহ শ্রুতি অনুসারে সদাশিবই সর্বোচ্চ সত্ত্বা যার মাধ্যমে জীবগণ সদাশিবের পরমপদ প্রাপ্ত করে। তাহলে এই শ্রুতি প্রমাণ থেকেই  এটি সিদ্ধ হয় জীবগণ যদি নৃসিংহ মন্ত্র জপ করে তাহলে সেই জীবের গতি হবে পরমেশ্বর সদাশিবের কাছে গিয়ে। তাহলে বৈষ্ণবগণ যে এখানে যে একটা অনর্থের খেলা রচনা করেছিলো তা, নৃসিংহ শ্রুতি প্রমাণ অনুযায়ী খণ্ডিত হয়ে যায়। এবং এটাও প্রমাণিত হয় যে, নৃসিংহ রূপে পরমেশ্বর শিবই বিদ্যমান রয়েছে।
উক্ত শ্রুতি বাক্যের সামঞ্জস্যতা পাওয়া যায় বৃহৎজ্জাবাল উপনিষদে। তাহলে উক্ত শ্রুতি প্রমাণ দেখে নেওয়া যাক—
যত্র ন সূর্যস্তপতি যত্র ন বায়ুবাতি যত্র ন চন্দ্রমা ভাতি যত্র ন নক্ষত্রাণি ভান্তি যত্র নাগ্নিদহতি যত্র ত মৃত্যুঃ প্রবিশতি যত্র ন দুঃখানি প্রবিশ্যন্তি সদানন্দং পরমানন্দং শান্তং শাশ্বতং সদাশিবং ব্রহ্মাদিবন্দিতং যোগিধ্যেয়ং পরং পদং যত্র গত্বা ন নিবর্তন্তে যোগিনস্তদেতদৃচাত্যুক্তম্ । তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ দিবীব চক্ষুরাততম্ ॥ ৬ [বৃহজ্জাবাল উপনিষদ / অষ্টম ব্রাহ্মণ]
যেখানে সূর্য তাপ দেয় না, যেখানে বায়ু বয়না, যে স্থানে চন্দ্রও আলোক প্রদান করে না, যেখানে নক্ষত্রদেরও উপস্থিতি থাকে না, যে স্থানে অগ্নি দ্বারা কোনো কিছুরই দহন সম্ভবপর হয়না, যেখানে মৃত্যু নেই, দুঃখ নেই সেই সদানন্দময়, পরমানন্দময় পরম ধামই হল সাক্ষাৎ শান্ত, শাশ্বত, চিরন্তন, সচ্চিদানন্দ সদাশিব পদ, যে পদ ব্রহ্মাদি দেবগণ (অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র) দ্বারা বন্দিত। সেই পদই সমস্ত যোগীগণের দ্বারা ধেয়। পরমেশ্বর সদাশিবের সেই পরমপদে পৌছানোর পর যোগীগণকে আর ইহলোকে ফিরে আসতে হয় না। হে সর্বব্যাপী পরমেশ্বর আমাকে এমন দিব্য জ্ঞানচক্ষু প্রদান করুন যাতে আমি আপনার সেই পরমধাম, পরমপদকে সর্বদা নিজের মধ্যেই প্রত্যক্ষ করতে পারি।
তাহলে বিষয় টা দিনের আলোর মতো পরিস্কার। ঋতং, সত্যম্, কৃষ্ণপিঙ্গল, ঊর্ধ্বরেতং, বিরুপাক্ষং, ত্রিলোচন, নীলকণ্ঠ, উমাপতি, নীললোহিত, পিনাকী, ঈশান ইত্যাদি শব্দ দ্বারা একমাত্র কেবল পরমেশ্বর শিবকেই বোঝায়। আমরা আগেও বলেছিলাম এখনো বলছি, শ্রুতিকে কখনো খণ্ডন করা যায় না, কেবল বিশ্লেষণ করা যায়। কিন্তু, বৈষ্ণবগণ উক্ত শ্রুতিকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে খণ্ডন করে দেবার মতো মূর্খ চেষ্টা করে বসেছে। কেননা এখানে অর্থকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সঠিক অর্থের খণ্ডন হয়ে গেলো।
যেমন সাধারণ একটা উদাহরণ দিই- উক্ত শ্রুতিতে বলা আছে ত্রিলোচন, নীলকণ্ঠ, উমাপতি। তাহলে এখানে বোঝার বিষয় হলো উক্ত শব্দ দ্বারা প্রতিপাদিত্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন কে রয়েছে! সাধারণ ভাবেই যদি কোনো মানুষকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, নীলকণ্ঠ, ত্রিলোচন, উমাপতি বলতে কি বোঝায়? তাহলে সেই ব্যক্তি এটাই বলতে এসব দ্বারা শিবকেই বোঝায়। কেননা শিবই তিনচোখ, নীল কণ্ঠ ও পার্বতীর স্বামী। তাহলে এখানে সাধারণ বোধগম্য বিষয়কে অহেতুক ব্যাকরণ প্রয়োগ করে অনর্থ করাটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ব্যাপার। কারণ একাধিক শ্রুতি যেখানে, ত্রিলোচন, নীলকন্ঠ, উমাপতি বলতে পরমেশ্বর শিবকেই প্রতিপাদিত করে সেখানে, অহেতুক ব্যাকরণ দ্বারা অর্থকে ঘোরানো বৃথা চেষ্টা মাত্র। আপনাদের ব্যাপারপটা ভালো করে চিন্তা করা দরকার যে কেন, নৃসিংহকে ঋতং, সত্যম্, কৃষ্ণপিঙ্গল, ঊর্ধ্বরেতং, বিরুপাক্ষং, ত্রিলোচন, নীলকণ্ঠ, উমাপতি, নীললোহিত, পিনাকী, ঈশান ইত্যাদি দ্বারা স্তুতি করা হলো!
শুক্রনীততে বলা আছে যে—
সমাসব্যূহহেত্বাদিকৃতেচ্ছার্থং বিহায় চ।
স্তুত্যর্থবাদান্ সন্ত্যজ্য সারং সংগৃহ্য যত্নতঃ।।৩৮
ধর্ম্মতত্ত্বং হি গহন মতঃ সৎসেবিতং নরঃ।
শ্রুতিস্মৃতিপুরাণানাং কর্ম্ম৷ কূর্য্যাৎ বিচক্ষণঃ।।৩৯

[শুক্রনীতি/৩য় অধ্যায়/৩৮/৩৯]
ধর্মতত্ত্ব নির্জন কানন স্বরূপ অতি দুরভিগম্য, অতএব বিচক্ষণ লোকেরা বেদ, স্মৃতি, পুরাণ ইত্যাদি শাস্ত্রের নানা প্রকার সমাসের দ্বারা ও নানা প্রকার কারণ ঘটিয়ে তার দ্বারা নিজের অভিমতসিদ্ধ অর্থ করা পরিত্যাগ করবে। এরূপ অর্থ ঘটালে লোকে প্রসংশা করবে সেই প্রশংশাবাদ ত্যাগ করবে এবং সৎলোকেরা যেরূপ আচরণ করে সেরূপ কার্য'ই করবে।।
তাই শ্রুতিকে নতুন অর্থ প্রদান করতে গিয়ে এমন কোনো কিছু করবেন না যাতে তা নিন্দনীয় হয় এবং শ্রুতিকেই খণ্ডন করে বসে থাকে। আপ্ত পুরুষ বাক্যও প্রামাণ্য, তাই আপ্তপুরুষেরা যেরূপ অর্থকে স্বীকার করে গেছেন, সবাই সেই অর্থকেই অধিক প্রাধান্য দিবে। বৈষ্ণবগণেরা যতই অর্থকে বিশ্লেষণ করুক না কেন তা কদাপি শৈবমহলে তথা সনাতন ধর্মে মান্যতা পাবেনা।
🔶আর হ্যা বেদবচনকে যেন বৈষ্ণবেরা আবার পুরাণ দিয়ে খণ্ডানোর মতো মূর্খচেষ্টা না করে বসে। যদি বৈষ্ণবেরা ঐ কাজটিই করবে আমরা জানি, তথাপি পুরাণ থেকেও খণ্ডন করে রেখেছি আমরা ।

সিদ্ধান্ত

১. নৃসিংহ রূপটা পরমেশ্বর শিবের দ্বারা প্রকাশিত।
২. উক্ত নৃসিংহ শ্রুতিতে থাকা শব্দ প্রমাণ দ্বারা পরমেশ্বর শিবই প্রতিপাদিত হয়।
৩. অহেতুক ব্যাকরণ প্রয়োগ দ্বারা অর্থের অনর্থ করা ন্যায় সঙ্গত নয়।
উপরোক্ত শাস্ত্রের বিশ্লেষণ এবং শাস্ত্র প্রমাণ অনুসারে, বৈষ্ণবদের দ্বারা নৃসিংহ শ্রুতির উপর আরোপিত অপপ্রচার শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডিত করা ও দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হলো।।


নমঃ শিবায় 🙏🚩 ॐ সাম্বসদাশিবায় নমঃ 🚩🙏 ॐ দক্ষিণামূর্তয়ে নমঃ 🙏🚩

শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে ✊🚩

হর হর মহাদেব ✊🚩

✍️অপপ্রচার দমনেঅন্তিক ভট্টাচার্য্য (শম্বরনাথ শৈব)

বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ— আমার গুরু শ্রী নন্দীনাথ শৈবাচার্য জী ও শ্রী রোহিত কুমার চৌধুরী শৈবজীকে 🙏

কপিরাইট ও প্রচারেঃ— International Shiva Shakti Gyan Tirtha (আন্তর্জাতিক শিব শক্তি জ্ঞান তীর্থ)
বিঃ দ্রঃ— লেখাটি কপি করলে সম্পূর্ণ কপি করবেন, কোনো রকম কাটাছেঁড়া করা যাবে না।



মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ