শিবমহাপুরাণে — গুরু মাহাত্ম্য বর্ণনায় গুরু - শিষ্যের পরিচয় ও কর্তব্য নির্ণয়
॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥
গুরু কে ? গুরুর মাহাত্ম্য কি ?
কোনো ব্যক্তি যদি পরমজ্ঞান লাভ করবার জন্য সত্যিই ইচ্ছুক হন, তবে সেই ব্যক্তির আচরণ, ব্যবহার ও মনের ভাব একজন গুরুর প্রতি কেমন হওয়া উচিত ? অর্থাৎ গুরু কে ? শিষ্য কে ?
— এ বিষয়ে যাবতীয় বিষয়ের উপর পরম পবিত্র শাস্ত্র শিব মহাপুরাণের কি মতামত আছে, তা এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে। আপনি যদি শৈব দীক্ষা পেতে চান তবে একজন আদর্শ শিষ্য হয়ে উঠতে চান, তবে তার জন্য আপনার মধ্যে কোন গুণ গুলি থাকা অবশ্যই বাধ্যতামূলক, সেটি জানতে এই সমগ্র প্রবন্ধ টি আপনার জন্য খুবই অধিক গুরুত্বপূর্ণ, চলুন দেখে নেওয়া যাক।
[তবে মনে রাখবেন, একজন প্রকৃত গুরু সর্বদাই পূজ্য, তাই একমাত্র প্রকৃত গুরুদেব যিনি, তার প্রতি শিষ্যের আচরণ যেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে শাস্ত্রীয় উক্তি তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু, গুরু সেজে বসে ভণ্ডামী করতে থাকা ব্যক্তি কখনোই গুরু বলে স্বীকার্য নয় । যার মধ্যে গুরু হবার মতো লক্ষণ ও গুণাবলী উপস্থিত নেই, তিনি যতই সেজে বসে গুরু হবার অভিনয় করুক তিনি প্রকৃত পক্ষে গুরু নন। তাই যেখানে অতি-গুরুবাদীতা বা অন্ধগুরুবাদ প্রচার করার মাধ্যমে সমাজে অরাজকতা ও কুসংস্কার সৃষ্টি হয়েছে, সেই সকল অধর্মের সম্পূর্ণ বিরোধী আমরা। প্রকৃত গুরুর বৈশিষ্ট্য ও শিষ্যের কর্তব্য কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এখানে করা হয়েছে।]
---------------------------------------------------------------------------------------------
প্রথমেই শিবমহাপুরাণের বিদ্যেশ্বর সংহিতার অন্তর্গত ১৮ অধ্যায় — এ গুরু শিষ্য বিষয়ে যা বলা হয়েছে তা উল্লেখ করা হল —
(গুরু কে ?) - এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
— যিনি গুণ(মায়া) সমূহকে রোধ করে দেন, তিনিই গুরু বলে অভিহিত হন — এটিই ‘গুরু’ শব্দের বিগ্রহ বলা হয়েছে। (শ্লোক : ৮৩)
(গুরু প্রকৃত পক্ষে কে ? তিনি নিজের শিষ্যের কোন উপকার করবার কারণে গুরু বলে কথিত হন ? ) - এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
গুনাতীত পরমশিব রাজস আদি সবিকার গুণসমূহকে অবরোধ করেন — দূর করে দেন, এই কারণে তিনি গুরুর রূপের আশ্রয় নিয়েই স্থিত । গুরুর ওপর বিশ্বাসী শিষ্যকে তিনগুণ(সত্ত্ব-রজ-তম) থেকে দূর করে শিষ্যকে শিবতত্ত্বের বোধ করান, এই কারণে তাকে গুরু বলা হয় ॥ (শ্লোক : ৮৪-৮৫)
(শিষ্য প্রকৃত পক্ষে কে ? নিজের গুরুদেবকে কেমন দৃষ্টিতে দেখা উচিত শিষ্যের ? গুরুদেবের সেবা করলে কি হয় ?) - এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
অতএব, বুদ্ধিমান শিষ্যের কাছে এমন গুরুর শরীরকে গুরুলিঙ্গ(শিবের গুরুরূপের প্রতীক) বলে বোঝা উচিত । গুরুদেবের সেবা শুশ্রূষাই গুরুলিঙ্গের পূজা বলে গণ্য হয় । শরীর, মন ও বাণীর দ্বারা করা গুরুসেবার মাধ্যমে অবশ্যই শাস্ত্রজ্ঞান প্রাপ্তি হয় । নিজের সাধ্যমত শক্য অথবা অশক্য যেমনই করবার আদেশ গুরুদেব দেন, সেই আদেশ প্রাণ ও ধন দ্বারা পালন করা উচিত শিষ্যের, এই কারণে এইভাবে অনুশাসিত হয়ে চলা ব্যক্তিকেই ‘শিষ্য’ বলা হয় । (শ্লোক : ৮৬-৮৮)
(শিষ্যের করণীয় কার্য কোনটি ?) - এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
(গুরুর সেবামূলক কর্মে) সুশীল শিষ্যের উচিত কার্য হল, শরীর ধারণের জন্য সমস্ত সাধন গুরুকে অর্পণ করে তথা (গুরুর সমীপে থাকলে) রান্না হওয়া অন্নের প্রথম ভাগ গুরুকে সমর্পিত করে তার আজ্ঞা নিয়ে তারপর শিষ্যের নিজের ভোজন করা । (শ্লোক : ৮৯)
(একজন গুরুর কাছে তার শিষ্যের রূপ কেমন ? শিষ্যের কাছে গুরুর রূপ কেমন ? জন্মদাতা পিতা ও মন্ত্রদীক্ষা প্রদানকারী শিবজ্ঞানী গুরুদেবের মধ্যে পার্থক্য কি ? শিষ্যের কর্তব্য কি ?) - এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
গুরুর সান্নিধ্যে শিষ্য নিরন্তর থাকবার কারণে শিষ্যকে গুরুর পুত্র (সন্তান) বলে অভিহিত করা হয় । (জাগতিক সন্তান উৎপন্ন করবার পদ্ধতিকে আধ্যাত্মিক পর্যায়ে উল্লেখ করে আধ্যাত্মিক মানসিক স্তরের জ্ঞানী সন্তান উৎপন্ন করবার বিষয়ে উপমা ব্যবহার করে বলা হচ্ছে) জিহ্বা রূপী লিঙ্গ(শিবপ্রতিক) মন্ত্ররূপী শুক্র(বীজমন্ত্র)-কে কানরূপী যোনী(শ্রবণগহ্বর) তে আধান করে আধ্যাত্মিক পুত্র অর্থাৎ সন্তান উৎপন্ন হয়, তাকে মন্ত্রসন্তান বলে।
সেই মন্ত্র সন্তানের উচিত পিতা স্বরূপ গুরুর সেবা করা । শরীরকে উৎপন্নকারী পিতা তো সংসার প্রপঞ্চ তে সন্তানকে এনে এই মায়ার সাগরে ডুবিয়ে দেন, জ্ঞানদাতা গুরুরূপ পিতা (শিবজ্ঞান প্রদান করে) সংসার সাগর থেকে উঠিয়ে উদ্ধার করে মায়ার সাগর পাড় করে দেন । এই দুই ধরণের পিতার বিষয় জেনে গুরুরূপী পিতাকেও নিজের উপার্জিত ধন তথা নিজের শরীরের পরিশ্রম দ্বারা বিশেষ সেবা পূজা করা উচিত । পায়ের তলা থেকে চুলের অগ্রভাগ পর্যন্ত গুরু যে শরীর রয়েছে, তার ভিন্ন ভিন্ন প্রকারে, যথা - স্বয়ং অর্জিত ধনের দ্বারা প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রদান করে, শিষ্য নিজের হাতের দ্বারা গুরুর চরণ সেবা শুশ্রূষা করে, গুরুদেবকে স্নান অভিষেক করিয়ে তথা নৈবেদ্য ভজনাদি দিয়ে পূজা করা উচিত ॥ (শ্লোক : ৯০-৯৪)
(গুরুদেবের পূজার দ্বারা মূলত কার পূজা হয়ে থাকে ? গুরুর ব্যবহৃত বস্তুরও কি মাহাত্ম্য রয়েছে ?) - এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
গুরুদেব কে পূজা করাই পরমাত্মা শিবের পূজা বলে জানা উচিত । গুরুর ব্যবহার করা বস্তুর অবশিষ্ট অংশ সবই আত্মশুদ্ধিকারী হয়ে থাকে ॥ (শ্লোক : ৯৫)
হে দ্বিজগণ ! গুরুদেবের ব্যবহৃত বস্তুর অবশিষ্ট অংশ বা জল তথা অন্য আদি দ্বারা তৈরি হওয়া ‘শিবোচ্ছিষ্ট’ শিবভক্ত আর শিষ্যদের জন্য গ্রাহ্য তথা ভোজ্যরূপ গণ্য করবে ॥ (শ্লোক : ৯৬)
-------------------------------------------------------------------------------------
শেষে শিবমহাপুরাণের বায়বীয় সংহিতার অন্তর্গত উত্তরখণ্ডের ১৫ অধ্যায় — এ গুরু শিষ্য বিষয়ে যা বলা হয়েছে তা উল্লেখ করা হল —
(কোনো ব্যক্তি শৈবধর্মের শৈবদীক্ষায় দীক্ষিত হবার জন্য যোগ্য শিষ্য কি না তা কিভাবে পরীক্ষা করবেন গুরু ? ) - এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
শক্তিপাতের(কৃপা প্রদানের) অনুসারে একজন শিষ্য তার গুরুর অনুগ্রহের(কৃপার) যোগ্য হয়। শৈবধর্ম অনুসরণ শক্তিপাতমূলক ; অতএব সংক্ষেপে সেই বিষয়ে নিবেদন করা হচ্ছে। যে শিষ্যের উপর গুরুর শক্তিপাত(কৃপা) হয়নি, তার মধ্যে শুদ্ধি আসে না এবং তার মধ্যে বিদ্যা, শিবাচার, মুক্তি বা সিদ্ধি কোনোটিই আসে না, সুতরাং প্রচুর শক্তিপাতের(কৃপা পাবার যোগ্য) লক্ষণ দেখে গুরু জ্ঞান অথবা ক্রিয়া দ্বারা শিষ্যকে শোধন করেন। (শ্লোক : ১২-১৪)
________________________________________________
(যদি গুরু কোনো অযোগ্য ব্যক্তিকে শৈবদীক্ষা প্রদান করে শিষ্য বানিয়ে ফেলেন তবে সেই মূর্খ গুরুর কি হতে পারে ? ) — এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
যে মূর্খ গুরু মোহবশতঃ এর(উপরোক্ত নিয়মের) বিপরীত আচরণ করেন, সেই দুর্বুদ্ধি ব্যক্তি নাশ হয়ে যায়; অতএব গুরু সর্বপ্রকারে শিষ্যকে পরীক্ষা কে করবেন। (শ্লোক : ১৫)
________________________________________________
(কোনো ব্যক্তি কে গুরু হিসেবে গ্রহণ করবার পূর্বে শিষ্যের কি কর্তব্য ?) — এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
শিষ্যও শিবপূজা ইত্যাদিতে গুরুর সান্নিধ্য লাভ করে অথবা গুরুর সঙ্গে থেকে তাঁর মধ্যে প্রকট হওয়া আচরণ কে এই (শিবজ্ঞান, শৈবাচার ইত্যাদি) লক্ষণগুলির দ্বারা বিচার করে দেখবে উভয়ের মধ্যে মিল আছে কি না - এভাবে গুরুকে পরীক্ষা করবে (যদি মিল থাকে তবেই সেই ব্যক্তিকে গুরু হিসেবে বরণ করবে, অন্যথায় তাকে পরিত্যাগ করবে, কিন্তু শিষ্য দ্বারা প্রকৃত গুরুকে বরণ করে নেবার পর আর তার নির্দেশ অমান্য করা যাবে না)। (শ্লোক : ১৮)
________________________________________________
(গুরুর যাতে সন্তোষ লাভ হয় , শিষ্যের তেমন কার্য করা উচিত) — এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের মতামত 👇
যদি গুরুর শিক্ষায় শিষ্য সঠিকভাবে শিক্ষণীয় হয় তবে সেই শিষ্যের জন্য গুরুর গৌরব হয়। তাই সর্বতোভাবে চেষ্টা করে শিষ্য সর্বদা এমন আচরণ করবে, যা গুরুর গৌরবের অনুকূল হয়।(শ্লোক : ১৯)
________________________________________________
(গুরু প্রকৃত পক্ষে কে ? গুরুদেবের প্রতি শিষ্যের কেমন আচরণ হওয়া উচিত ? ) — এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
যিনি গুরু, তাঁকে শিব বলা হয় এবং যিনি শিব, তাঁকে গুরু মানা হয়। বিদ্যার আকারে শিবই গুরু হয়ে বিরাজমান। যেমন শিব, তেমনই বিদ্যা। যেমন বিদ্যা, তেমনই গুরু। শিব, বিদ্যা এবং গুরুর পূজার দ্বারা সমান ফল পাওয়া যায়। শিব সর্বদেবাত্মক এবং গুরু সর্বমন্ত্রময়। সুতরাং সম্পূর্ণ যত্নসহকারে গুরুর আদেশ শিরোধার্য করা উচিত। (শ্লোক : ২২)
________________________________________________
(শিষ্য যদি নিজের কল্যাণ চান, তবে তার কোন কার্য উচিত আর কোন কার্যগুলি থেকে বিরত থাকা উচিত ?) — এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
শিষ্য যদি নিজের কল্যাণের ইচ্ছুক হন, তবে তিনি যেন মন থেকেও গুরুর আজ্ঞা কখনো উল্লঙ্ঘন না করেন ; কারণ গুরুদেবের দেওয়া আজ্ঞা পালনকারী ব্যক্তিই জ্ঞানরূপী সম্পদ প্রাপ্ত করতে সক্ষম হয় ।
চলতে চলতে, বসে থেকে, শয়ন করে তথা ভজন করবার সময়ও গুরু আজ্ঞার বহির্ভূত অন্য কোনো কর্ম করা উচিত নয় । যদি কখনো গুরুদেবের সামনে কোনো কার্য করেন তবে সেক্ষেত্রে গুরুর কাছে আজ্ঞা নিয়ে করা উচিত। গুরুদেবের গৃহে অথবা তার সামনে নিজের ইচ্ছেমতো গুরুর সমান বা উচ্চ আসনে বসবে না (এটি গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধার দৃষ্টিভঙ্গির দরুন বলা হয়েছে), কারণ গুরু হলেন সাক্ষাৎ দেবতা আর গুরুদেবের গৃহ হল দেবমন্দির । (শ্লোক : ২৩-২৫)
________________________________________________
(গুরুদেবের সান্নিধ্য লাভের দ্বারা শিষ্যের কি উপকার হয়?) — এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
যেমন পাপীদের সঙ্গ করলে মানুষ পাপে জর্জরিত হয়ে পতিত হয়, যেমনভাবে অগ্নির সংস্পর্শে সোনা তার তার মল(বর্জ্য পদার্থ) কে ছেড়ে দেয়, তেমনভাবেই গুরুর সংস্পর্শে এসে মানুষ পাপ থেকে মুক্ত হয়ে যায় ।
যেমনভাবে অগ্নির পাশে স্থিত ঘড়াতে রাখা ঘৃত গলে যায়, ঠিক তেমনভাবেই আচার্যের সংস্পর্শে শিষ্যের পাপ গলে যায় । যেমনভাবে প্রজ্বলিত অগ্নি শুকিয়ে যাওয়া অথবা ভেজা বস্তুকে জ্বালিয়ে দেয়, তেমনভাবেই গুরু প্রসন্ন হলে ক্ষণকালের মধ্যে শিষ্যের সমস্ত পাপ জ্বালিয়ে দেন । (শ্লোক : ২৬-২৮)
________________________________________________
(গুরুর অপ্রিয় কার্য করে গুরুকে ক্রোধিত হতে বাধ্য করলে তার পরিণাম কি ?) — এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
মন, বচন তথা কর্মের দ্বারা কখনোই গুরুকে কুপিত হতে বাধ্য করা উচিত নয়, গুরুর যদি ক্রোধ হয় তবে শিষ্যের আয়ু, শ্রী, জ্ঞান তথা সৎকর্ম দগ্ধ হয়ে যায়। যে ব্যক্তি গুরুকে ক্রোধ করতে বাধ্য করেন সেই ব্যক্তির করা যজ্ঞ, যম তথা সকল নিয়ম পালন নিষ্ফল হয়ে যায়, এতে কোনো সন্দেহই নেই । (শ্লোক : ২৯-৩০)
________________________________________________
(গুরুর বিরোধী বচন বলে শিষ্যের কি গতি হয় ?) — এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
শিষ্যের কখনোই সেই সমস্ত বাক্য বলা উচিত নয় যা গুরুর বিরোধী বচন (অর্থাৎ গুরুর অপমানকারী বাক্য বলা অনুচিত), কখনোই তা উচিত নয়। যদি সেই শিষ্য মহামোহের কবলে পড়ে গুরুকে অপমান করবার বচন বলে, তবে সেই শিষ্য রৌরব নরকে গিয়ে পড়ে । যদি শিষ্য নিজের কল্যাণ চায় এবং বুদ্ধিমান হয় তাহলে সে গুরুর প্রতি মন, বাক্য ও ক্রিয়ার দ্বারা কখনও গুরু কাছে কোনো রকম মিথ্যাচার-কপটপূর্ণ ব্যবহার করবে না। গুরু আদেশ দিন বা না দিন, শিষ্য সর্বদা এমন কাজ করবে যা করলে গুরুর প্রিয় ও গুরুর হিত হয়। (শ্লোক : ৩১-৩৩)
________________________________________________
(শৈবধর্মের শৈবদীক্ষা পাবার জন্য শিষ্যের কোন গুণ থাকা উচিত ?) — এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
গুরুর সামনে বা পশ্চাতেও গুরুর দেওয়া নির্দেশনামূলক কার্য করতে থাকবে। এরূপ আচারযুক্ত গুরুভক্ত-যে ব্যক্তি সর্বদা মনে উৎসাহী, গুরুর প্রিয়কাজকারী, সেই শিষ্যই শৈব ধর্মের উপদেশ(শৈবদীক্ষা) লাভ করবার অধিকারী। (শ্লোক : ৩৪-৩৫)
________________________________________________
(প্রকৃত গুরু আর গুরু হয়ে সেজে বসে থাকা নকল গুরুর মধ্যে পার্থক্য কি ? কাকে গুরু হিসেবে বরণ করা উচিত ? ) — এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
গুরু যদি গুণবান, বিদ্বান, পরমানন্দের প্রকাশক, তত্ত্ববেত্তা ও শিবভক্ত হন তবে সেই গুরু ই একমাত্র মুক্তিদাতা হন, অন্য কেউ নয়। জ্ঞান উৎপন্নকারী যে পরমানন্দজনিত পরমতত্ত্ব রয়েছে, সেই পরমতত্ত্ব বিষয়ে যে ব্যক্তি জেনে নিয়েছেন, তিনিই আনন্দের সাক্ষাৎকার করাতে সক্ষম(তিনিই প্রকৃত গুরু)। জ্ঞানহীন নামমাত্রের (নকল) গুরু এরূপ করতে পারেন না।
(উদাহরণ হিসেবে) নৌকাগুলি একে অপরকে পার করতে পারে, কিন্তু কোনো পাথর অন্য পাথরকে কী পার করতে পারে? নামমাত্রের গুরুর দ্বারা নামমাত্র মুক্তিই প্রাপ্ত হতে পারে (অর্থাৎ নকল গুরুর দ্বারা মানুষ মুক্তির নামে প্রতারিত হয়ে পায় ব্যর্থতা)। যে ব্যক্তির তত্ত্বজ্ঞান আছে, তিনিই স্বয়ং মুক্ত হয়ে অন্যকে মুক্ত করতে সক্ষম। তত্ত্বহীন ব্যক্তির কী করে জ্ঞানের বোধ হবে, আর বোধ বিনা কী করে 'আত্মা'র অনুভব হবে ?।
যে ব্যক্তি নিজে আত্ম অনুভব করেননি, তাকে 'পশু' বলা হয় (মায়ার পাশে আবদ্ধ জীব)। পশুর প্রেরণায় অন্য কেউ পশুত্ব লঙ্ঘন করতে পারে না ; অতএব তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিই 'মুক্ত' এবং 'মোচক' হতে পারে, অজ্ঞ ব্যক্তি কখনোই উদ্ধারকর্তা নয়। (শ্লোক : ৩৫-৪১)
________________________________________________
(শুধুমাত্র শাস্ত্রের বিধিবিধানের জ্ঞাতা ব্যক্তি এবং শাস্ত্র সহ আত্মতত্ত্বের জ্ঞাতা ব্যক্তির মধ্যে প্রকৃত পক্ষে কোন ব্যক্তি গুরু হবার যোগ্য ?) — এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
(আত্ম জ্ঞানহীনের লক্ষণ) সমস্ত শুভলক্ষণ দ্বারা যুক্ত, সমস্ত শাস্ত্রের জ্ঞাতা এবং সর্বপ্রকার উপায়-বিধানের জ্ঞানী হলেও যে ব্যক্তি তত্ত্বজ্ঞানহীন, তাঁর জীবন নিষ্ফল।
(আত্ম জ্ঞানী ব্যক্তির লক্ষণ) যে পুরুষের বুদ্ধি(বিচার বিবেচনা করবার চিন্তা, শিবকে) অনুভব করা পর্যন্ত তত্ত্বের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়, সেই পুরুষের দর্শন, স্পর্শ ইত্যাদির দ্বারা অন্য ব্যক্তির পরমানন্দ প্রাপ্তি হয়। সুতরাং যাঁর সম্পর্ক - দ্বারাই উৎকৃষ্ট বোধস্বরূপ আনন্দ প্রাপ্তি সম্ভব, বুদ্ধিমান - পুরুষ তাঁকেই গুরু করবে, অন্য কোনো ব্যক্তিকে নয়। (শ্লোক : ৪১-৪৪)
________________________________________________
(শিষ্য দ্বারা গুরুর সেবা করবার উদ্দেশ্য কি ?) — এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
যোগ্য গুরুর দ্বারা যতক্ষণ না শিষ্যের ভালোভাবে জ্ঞান উদয় হচ্ছে, বিনয় আচার-চতুর মুমুক্ষু শিষ্যদের উচিত ততক্ষণ গুরুর সেবা করা উচিত। এভাবে সেবা করতে করতে গুরুর কৃপায় ভালোভাবে জ্ঞান -এর সম্যক্ পরিচয় হলে জ্ঞান সহ গুরুকে সুস্থির ভাবে সর্বদা ভক্তি করবে। যতক্ষণ তত্ত্ববোধ(আত্মজ্ঞান) প্রাপ্ত না হয়, ততক্ষণ গুরুসেবায় ব্যাপৃত থাকবে। তত্ত্ব(আত্মজ্ঞান) বোধকে কখনও ত্যাগ করবে না এবং কোনোভাবে আত্মজ্ঞান ও তত্ত্বজ্ঞানী গুরুকে উপেক্ষা করবে না। (শ্লোক : ৪৪-৪৬)
________________________________________________
(যদি বছরখানেক কোনো ব্যক্তির সান্নিধ্যে থেকে কোনো বোধ বা আনন্দ উৎপন্ন না হয় তবে কি করা উচিত ? ) — এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
যে ব্যক্তির সান্নিধ্যে প্রায় এক বছর থেকেও স্বল্প আনন্দ আর বোধের উপলব্ধি না হয়, সেই শিষ্য ঐ ব্যক্তিকে ছেড়ে অন্য গুরুর আশ্রয় নিতে পারে ।
অন্য গুরুর শরণাগত হয়েও কখনোই পূর্ববর্তী গুরু, গুরুর ভ্রাতা-ভগিনী, গুরু পুত্র-কন্যা সন্তানাদি পরিবার তথা উপদেষ্টা বা প্রেরণাকারীকে অপমানিত করা উচিত নয়। (শ্লোক : ৪৬-৪৭)
________________________________________________
(গুরু কাছে শিষ্য সর্বপ্রথম কি কি করবেন ? শৈব হবার জন্য কি করা বাধ্যতামূলক ? ) — এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
সর্বপ্রথম ‘ব্রহ্মজ্ঞান লাভের মার্গে চলমান’ এমন বেদের পরম জ্ঞানসম্পন্ন, সুন্দর প্রজ্ঞাসম্পন্ন, যার দর্শনে চিত্তে শুভ ভাব উৎপন্ন হয় এমন প্রিয়দর্শন, সর্বপ্রকারে অভয় প্রদানকারী করুণাময় চিত্তযুক্ত গুরুর সান্নিধ্যে গিয়ে তার আরাধনা সেবা করা উচিত আর তা যেন শিষ্য মন থেকে করেন, মুখের সত্য বচনের মাধ্যমে ও নিজের কর্মের দ্বারা প্রকাশ করেন, গুরুর প্রতি একজন শিষ্যের এমনই করা উচিত ।
শিষ্যের উচিত ততক্ষণ গুরুর আরাধনা করা, যতক্ষণ না তিনি প্রসন্ন হয়ে যান । গুরু প্রসন্ন হলে শীঘ্রই শেষের পাপ নাশ হয়ে যায় । অতএব, ধন, রত্ন, ভূমি-জমি, গৃহ, আভূষণ, বস্ত্র, বাহন(যাতায়াতের যন্ত্র), শয্যা, আসন — এসব ভক্তিপূর্বক(এর মধ্যে থেকে) নিজের সামর্থ্য অনুসারে গুরুদেবকে প্রদান করা উচিত। যদি শিষ্য নিজের পরম গতি চান তবে গুরুর সেবায় নিজে (ধনবান হলে সেক্ষেত্রে) ধনের কৃপণতা করা উচিত নয় ।
শিষ্যের জন্য গুরুই পিতা, মাতা, পতি, বন্ধু, ধন, সুখ, সখা তথা মিত্র , এই কারণে (নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী) গুরু কে সবকিছু অর্পণ করে দেওয়া উচিত। এই প্রকারে নিবেদন করে পরবর্তীতে পরিবার তথা বন্ধু জনসহিত নিজেকেও সংকল্পপূর্বক গুরুর কাছে সমর্পণ করে সদা সর্বদা জন্য গুরুর অধীন হওয়া উচিত।
যখন মনুষ্য শিবস্বরূপ গুরুর নিমিত্তে নিজেকে সমর্পণ করে দেন, একমাত্র সেই মুহূর্ত থেকে তিনি ‘শৈব’ হয়ে যান আর এরপর তার কখনো পুনর্জন্ম হয় না । (শ্লোক : ৪৮-৫৫)
________________________________________________
(গুরু কোনো ব্যক্তিকে শিষ্য বানাবার আগে কিভাবে সেই ব্যক্তিকে পরীক্ষা করবেন ?) — এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
(গুরু তার শিষ্যকে পরীক্ষা করবার জন্য, গুরু কাছে শৈবদীক্ষায় দীক্ষিত হতে আসা যে কোনো ব্যক্তিকে পরীক্ষা করবেন এভাবে) সে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বৈশ্য অথবা যে ব্যক্তিই হোক তাকে এক,দুই,তিন বছর পর্যন্ত (প্রয়োজন অনুসারে) পরীক্ষা করবেন ।
তার প্রাণ-সংকটের আশঙ্কা হবে তেমন আজ্ঞা দিয়ে সেবা করতে বলে এবং বেশি অর্থ দেওয়া ইত্যাদি অনুকূল-প্রতিকূল আদেশ দিয়ে, উত্তম ব্যক্তি বলে সমাজে পরিচিত এমন ব্যক্তিকে নিকৃষ্টতম কাজে লাগিয়ে এবং নিকৃষ্ট বলে সমাজে পরিচিত এমন ব্যক্তিকে উৎকৃষ্ট কাজে নিযুক্ত করে তাদের ধৈর্য ও সহনশীলতা পরীক্ষা করবেন।
গুরু তিরস্কার ইত্যাদি করলেও যে ব্যক্তি বিষাদগ্রস্ত হয় না, সে ব্যক্তিই প্রকৃতপক্ষে সংযমী, শুদ্ধ এবং শিব-সংস্কার কর্মের যোগ্য ও অধিকারী ব্যক্তি। যে ব্যক্তি কাউকে হিংসা করে না(অধার্মিক দের ছেড়ে), সকলের প্রতি দয়ালু হয়, সর্বদা হৃদয়ে উৎসাহ রেখে সর্ব কর্ম করতে উদ্যত থাকে; অভিমানশূন্য, বুদ্ধিমান এবং স্পর্ধারহিত হয়ে প্রিয়বাক্যভাষী; সরল, কোমল, স্বচ্ছ, বিনয়শীল, সুস্থির চিত্ত, শৌচাচারযুক্ত ও শিবভক্ত হন — এইরূপ আচার-ব্যবহারযুক্ত ব্যক্তিকেই দ্বিজ বলে জানবে এবং তাকে মন, বাণী, শরীর আর ক্রিয়া দ্বারা যথোচিত রীতির দ্বারা শুদ্ধ করে আত্মতত্ত্বের বোধ করানো উচিত, এটিই হলো শাস্ত্রের নির্ণয় । (শ্লোক : ৫৬-৬১)
________________________________________________
(পরমেশ্বর শিবের ভক্তদের জন্য গুরুর করণীয় কি ?) — এ প্রশ্নের বিষয়ে শিব মহাপুরাণের উত্তর 👇
এই বিষয়ে অধিক আর কি বলা যেতে পারে, যদি কোন ব্যক্তি পরমেশ্বর শিবের আশ্রয় নিয়ে থাকে আর গুরুর অনুগত হয়ে যান তবে গুরুদেবের উচিত সেই ব্যক্তিকে শৈব দীক্ষা আদি সংস্কার সম্পন্ন করা । (শ্লোক : ৭১-৭২)
________________________________________________
(শিষ্যের প্রতি গুরু প্রসন্ন হলে শিষ্যের কি লাভ হয় ?)
শিষ্যকে যদি গুরুদেব কৃপাপূর্বক দেখেন, স্পর্শ করেন অথবা বার্তালাপ করেন, তবে তাতেই সেই শিষ্যের নির্মল বুদ্ধির উদয় হয় আর সেই ব্যক্তি কখনো পরাজিত হন না । (শ্লোক : ৭২-৭৩)
________________________________________________
সিদ্ধান্ত
একজন প্রকৃত গুরুর প্রকৃত শিষ্য হওয়াই কাম্য । এতে প্রকৃত ধার্মিক শৈব সনাতনী তৈরি হবে সনাতন সমাজে। প্রকৃত শৈব ব্যক্তির মাধ্যমেই ধর্মের নামে যেসব ভণ্ডামী ও অরাজকতা তথা কুসংস্কার প্রচলিত আছে তা নির্মূল হয়ে সনাতন ধর্মের প্রকৃত আত্মজ্ঞান প্রকাশের মাধ্যমে সমাজে ধর্ম স্থাপন হবে।
শাস্ত্র বিধান প্রত্যেক সনাতনীর জন্য অবশ্যই মান্য, তাই গুরু সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে পরমপবিত্র শিবমহাপুরাণে যা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তা তুলে ধরলাম।
আশা করি, পাঠকবৃন্দ আপনার কাছে এই তথ্যগুলি অতি মূল্যবান বলে গৃহীত হবে।
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
✍লেখনীতে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
Ⓒকপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন