শৈবধর্ম ছিল প্রাচীন বাংলার একমাত্র ধর্ম ও সংস্কৃতি - যার স্বাধীন রাজাধিরাজ ছিলেন গৌড়াধিপতি মহাশৈব শশাঙ্ক মহারাজ
॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥
ভূমিকা ঃ
বর্তমান ভারতের পশ্চিমবাংলায় যে ধর্মনিরপেক্ষতার রোগ ছড়িয়েছে , তার উপর ভিত্তি করে সাধারন হিন্দু সনাতনীরাই নিজেদের গৌড়বঙ্গের ইতিহাস বিস্মৃত হয়েছে। বর্তমান বাংলাতে ইতিহাসের কথা বলে নাস্তিক রা সনাতনীদেরই অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আস্তিক সনাতনী দের মধ্যে বৈষ্ণব ব্যক্তিবর্গ বলেন এই বাংলাতে নাকি সর্বদাই বৈষ্ণব দের রাজত্ব ছিল, আবার কোনো শাক্ত ব্যক্তি এসে বলেন এই বাংলা শাক্ত ভূমি, অতীতেও সকল বাঙালিরা নাকি শাক্ত ছিল। প্রকৃতপক্ষে, সমগ্র বাংলাতে কোন সংস্কৃতি ছিল তা হল এই উপস্থাপনের মূল বিষয় বস্তু ।
প্রাচীন বঙ্গ শৈব ভূমি ও বঙ্গরাজ মহাশৈব শশাঙ্ক
সমগ্র বাংলার প্রথম ও একমাত্র স্বাধীন রাজাধিরাজ ছিলেন গৌড়াধীপতি মহাশৈব শশাঙ্ক মহারাজ । অনেকেই হয়তো এই মহান ব্যক্তির সম্পর্কে অবগত আছেন । আবার অনেকে এনার সম্পর্কে অবগত নন। কিন্তু এটা খুব কম লোকই জানেন যে তিনি বাংলার একজন মহাপ্রতাপশালী শৈব রাজা ছিলেন। কারণ বর্তমান বঙ্গাব্দ ১৪৩১ সালের বাংলায় শৈব সনাতন সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলবার মতো কোনো শৈব দের প্রভাব দেখা যায় না। শিব ভক্ত প্রচুর রয়েছে, তবে তারা মূল শৈবধারার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে। ফলে একজন মফান শিবভক্ত শৈব মহারাজার সম্পর্কে জানাবার মতো ব্যক্তির অভাব পড়েছে সমাজে । গৌড়াধীপতি মহারাজ শশাঙ্কের বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দেখুন ।
বিহার এর রোহতাস কেল্লা তে শশাঙ্ক এর সিল থেকে সেটা সুস্পষ্ট হয়। এখানে উনি মহাসামন্ত বলেছেন নিজেকে আর সনাতন শৈব ধর্মের ধর্মীয় প্রতীক বৃষভ চিহ্ন কে ব্যবহার করেছেন। এই বৃষভ হচ্ছে সনাতনী তথা শৈব দের ধর্মের একমাত্র প্রতীক।
🏛️ শাসনকাল ও রাজ্য বিস্তার 🏛️
মহারাজ শশাঙ্ক ৭ম শতাব্দীতে রাজত্ব করেছিলেন, কিছু ঐতিহাসিক তাঁর রাজত্বকাল ৬০০ থেকে ৬৩৬/৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্ধারণ করেছেন, অন্যান্য সূত্র তাঁর রাজত্বকাল ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্ধারণ করেন ।
আমাদের বর্তমানের বাংলাকে প্রাচীনকালে বঙ্গ নামে সম্মোধন করা হতো। গঙ্গা নদী দুটি শাখাতে বিভক্ত হয়ে দুদিক থেকে বঙ্গোপসাগরে এসে মিশেছে, এই দুটি শাখার মাঝখানে বিরাট ভূখণ্ড ‘ব’ আকৃতির হওয়ার কারণে এই ভূখণ্ডকে বঙ্গ শব্দে অভিহিত করা হয়েছে।
বঙ্গ নামটি বহু প্রাচীন, রামায়ণ তথা অনান্য সনাতন শাস্ত্রের মধ্যে এই বঙ্গ নামটি উল্লেখ আছে বহু প্রাচীন কাল থেকে।
বাংলার অন্য আরেকটি নাম গৌড় হবার পেছনে কারণ হল, বঙ্গের নিয়ম ছিল, বাড়িতে অতিথি এলে ‘গুড় জল’ দিয়ে আপ্যায়ন করা। সেই গুড় শব্দ থেকে গৌড় শব্দ এসেছে, একারণে এই বঙ্গদেশকে গৌড়দেশ বলা হত, যার অর্থ ‘গুড়ের দেশ’।
মহাশৈব শশাঙ্ক মহারাজের গৌড় রাজ্যের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার চিরুটি রেল স্টেশনের কাছে)। তিনি সেখানে থেকে রাজ্য শাসন করতেন। তিনি বাংলার বিভিন্ন ক্ষুদ্র জনপদকে একত্রিত করে গৌড় রাজ্য গঠন করেন । তার রাজ্য উত্তর বঙ্গ, দক্ষিণ বঙ্গ, মগধ, উড়িষ্যার কিছু অংশ এবং কামরূপ (বর্তমান আসাম) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
🕉️ ধর্মীয় অবস্থান 🕉️
মহারাজাধিরাজ শশাঙ্ক একজন কট্টর শৈব সনাতনী ছিলেন । তাই তিনি পরমেশ্বর শিবের প্রতি গভীর ভক্তি পোষণ করতেন। তিনি কট্টর শৈব হবার কারণে অসনাতনী বৌদ্ধ মতের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না, কারণ বৌদ্ধরা সাধারণ মানুষ কে নাস্তিক বানানোর কার্যক্রম চালাতেন । চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর বিবরণে উল্লেখ আছে যে, শশাঙ্ক বৌদ্ধ মতাবলম্বীদের শাস্তি দিয়েছিলেন এবং বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।
মহাশৈব শশাঙ্ক মহারাজ মহাবোধি বৃক্ষ উপড়ে ফেলেছিলেন, । তিনি বিধর্ভের বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। জনসাধারন কে ভুল বুঝিয়ে ধর্মচ্যুত করে নাস্তিক বানাবার কারণে তিনি কুশীনগরে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন ।
তাম্রলিপ্ত লিপি যেটা পাঞ্চারোল নামক (এগ্রা) স্থান থেকে প্রাপ্ত সেখানেও মহারাজাধীরাজ শশাঙ্ক কে পরমা-মহেশ্বরা বা পরম শৈব বলা আছে।
তিনি তার রাজধানী গৌর এ প্রতি পাঁচ ক্রোশ দূরে দূরে চার টি শিব মন্দির স্থাপন করেছিলেন। যথা-- কপিলেশ্বর, মুকুটেশ্বর,দাহুকেশ্বর ও শিবেশ্বর। এমনকি তিনি লিঙ্গরাজ মন্দির স্থাপন করেছেন ।
📜 বঙ্গাব্দের সূচনা 📜
মহারাজ শশাঙ্কের শাসনকাল থেকেই বঙ্গাব্দ (বাংলা সন) গণনা শুরু হয় । তিনি এই বর্ষপঞ্জি চালু করেন বলে ধারণা করেছিলেন । এই বঙ্গাব্দ মুঘল সম্রাট আকবরের তৈরি করা বলে প্রচার করেন বহু নাস্তিক, মুসলিম সহ অনান্য অসনাতনী ব্যক্তিবর্গ, কিন্তু তা ভিত্তিহীন। বঙ্গাব্দ (বাংলা সন) শব্দটি আকবর যুগের থেকে বহু শতাব্দী পুরনো দুটি শিব মন্দিরেও পাওয়া যায়, যা থেকে জানা যায় যে আকবরের সময়ের অনেক আগে থেকেই বাংলা ক্যালেন্ডার বিদ্যমান ছিলো।
চরক ও গাজন তিন দিনের পূজা ও উৎসবের পরের দিন থেকে শুরু হয় পাশুপত শৈব উৎসব। বাঁকুড়ার দিহারগ্রাম এবং সোন্তপাল নামে দুটি শিব মন্দিরের শিলালিপিতে বঙ্গাব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রমাণ দেখুন 👇
বর্তমানে মহাসামন্ত মহারাজ শশাঙ্কের দ্বারা প্রচলিত বঙ্গাব্দটি ১৪৩২ সালে চলছে। বাংলা নববর্ষ বাঙ্গালিরা পালন করে, পয়লা বৈশাখ থেকে নতুন বছর শুরু হয়, পয়লা শব্দটি হিন্দি পহেলা/প্যাহেলা শব্দ থেকে এসেছে। যেহেতু মহারাজ শশাঙ্ক একজন কট্টর শৈব ছিলেন, তাই শৈব সংস্কৃতির বিধি অনুসারে এই নতুন বর্ষপঞ্জির শুভারম্ভের সময় পহেলা বৈশাখের দিন তিনি বৃষভধ্বজ অবশ্যই উত্তোলন করেছিলেন, তিনি যে শৈবধর্মের একনিষ্ঠ ধারক বাহক ছিলেন তা তার প্রচলিত মুদ্রা ইত্যাদি দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায় ।
⚔️ হর্ষবর্ধনের সঙ্গে সংঘর্ষ ⚔️
মহারাজ শশাঙ্কের সময়ে উত্তর ভারতের শক্তিশালী রাজা হর্ষবর্ধনের সঙ্গে তার সংঘর্ষ হয়। রাজ্যবর্ধন (হর্ষের ভাই) শশাঙ্কের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন । এরপর হর্ষবর্ধন শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও সকল আক্রমণ প্রতিহত করে শশাঙ্ক তার রাজ্য রক্ষা করতে সক্ষম হন ও নিজের গৌরব বজায় রাখেন ।
🏺 প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন 🏺
শশাঙ্কের শাসনকাল সম্পর্কিত তথ্য বিভিন্ন শিলালিপি, তাম্রশাসন এবং মুদ্রা থেকে পাওয়া যায়। মেদিনীপুর, খড়গপুর এবং উড়িষ্যার গঞ্জাম থেকে প্রাপ্ত লিপি ও মুদ্রা তার শাসনকালের প্রমাণ বহন করে।
শশাঙ্কের কোনো সমসাময়িক প্রতিকৃতি বা চিত্র পাওয়া যায়। তবে তার নামানুসারে নির্মিত বিভিন্ন স্থাপনা ও স্মারক রয়েছে, যেমন মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে রাজা শশাঙ্ক সেতু।
মহারাজাধিরাজ মহাশৈব শশাঙ্কের শাসনকাল বাংলা ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন রেখেছে।
🔥 সিদ্ধান্ত 🔥
প্রাচীন বঙ্গের সংস্কৃতি ছিল শৈবধর্মের সংস্কৃতি, পরমেশ্বর শিবের সংস্কৃতির ভূমি এই বাংলা । এই বাংলা না কোনো শাক্ত ভূমি ছিল, না কোনো বৈষ্ণব ভূমি আর না অন্য কোনো সংস্কৃতির ভূমি ছিল এই গৌড়বঙ্গ, শুধুমাত্র সনাতন শৈব ধর্মের ভূমি ছিল । তাই বর্তমানের তথাকথিত বাংলাপ্রেমী যারা সনাতন ধর্ম তথা শৈবধর্মের থেকে এই বঙ্গভূমিকে ভিন্ন সংস্কৃতির বলে দাবী করে তারা কাল্পনিক ধারণায় জীবন অতিবাহিত করছে মাত্র।
ISSGT পুনরায় এই বাংলাতে সেই শৈব সনাতন ধর্ম সংস্কৃতি কে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে।
জয় বঙ্গ
জয় শশাঙ্ক
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
লেখনীতে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য
বিশেষ সহযোগিতায় — শ্রী অভিরূপ ঘোষ শৈবজী
কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন