বঙ্গাব্দ কে প্রচলন করেছিলেন ? আকবর নাকি মহাশৈব মহারাজাধিরাজ শশাঙ্ক ? জানুন সত্যতা




 ॐ নমঃ শিবায় 


প্রাচীন বঙ্গে বিক্রম সংবৎ প্রচলিত ছিল, যাতে চন্দ্রকলা ও চন্দ্রের নাক্ষত্রিক অবস্থান হিসাব করে  বর্ষগণনা হতো। এই বৎসর শুরু হত চৈত্রমাসের(চিত্র পক্ষ) অমাবস্যার পরের দিন থেকে অর্থাৎ শুক্লাপ্রতিপদ থেকে(অমান্ত গণনা)। এখন এই ক্যালেন্ডার এর আদিবীন্দু চৈত্র ধরা হতো এই কারণেই যে চৈত্র মাসেই বসন্ত বিষুব দেখা যায় (21 মার্চ) এরপর Ecliptic পথ Celestial Equator এর থেকে ওপরে সরে যায় তথা সূর্য ক্রমশ উত্তর দিকে সরতে থাকে। কিন্তু এই ক্যালেন্ডার এর সমস্যা এই যে এটার গণনা পদ্ধতি ছিল সূর্য সিদ্ধান্ত ভিত্তিক কিন্তু গণনার উদ্দেশ্য ছিল একটা ট্রপিক্যাল বর্ষপঞ্জি এর মত অর্থাৎ ঋতু গুলো কে স্থির রাখতে যা সম্ভব নয়। 


অতঃপর রাজা শশাঙ্ক ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ই এপ্রিল  বাংলা সনের প্রচলন শুরু করেন যা ছিল সৌর চন্দ্র ভিত্তিক।এই বর্ষ পঞ্জি এর মূল ভিত্তি ছিল সূর্য সিদ্ধান্ত ভিত্তিক গণনা কেই প্রাধান্য দেওয়া তথ্য মেষ অর্থাৎ রাশি কেই আদি বিন্দু ধরে বৎসর গণনা করা তথা বৈশাখ মাস থেকে বৎসর শুরু করা। সূর্য মেষ রাশি তে প্রবেশ করে বৈশাখ মাসেই আর মেষ হচ্ছে প্রথম রাশি তাই এই গণনা। অনেকে বলেন এটা নাকি সৌর বর্ষপঞ্জি। যারা স্বল্প বিস্তর জানেন তাদের বলে রাখি যে এই বর্ষপঞ্জি তে মাস গণনা হতো আর বৎসর গণনা হতো সূর্য এর নক্ষত্র গত অবস্থান দেখে, মাস এর নাম হতো চন্দ্র এর তিথি থেকে (পূর্ণিমান্ত) আর তার নক্ষত্র গত অবস্থান থেকে।আর তিথি নির্ধারণ হতো চন্দ্র কে দেখে। কাজেই এই বর্ষ পঞ্জি নক্ষত্র সূর্য চন্দ্র ভিত্তিক।



৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল এই ব্যাপারে শ্রীসুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, "বঙ্গাব্দের উৎস কথা‍" শীর্ষক একটি পুস্তিকায় বলেছেন, 


"সৌর বিজ্ঞান ভিত্তিক গানিতিক হিসাবে ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল, সোমবার, সূর্যোদয় কালই বঙ্গাব্দের আদি বিন্দু।‍"


তাছাড়া বহু ভাষাবিদ ‘রহমতুল্লাহ বাঙ্গালী’ তাঁর ‍"বঙ্গাব্দের জন্মকথা‍" গ্রন্থেও ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গাব্দের সূচনা এবং রাজা শশাঙ্কই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক বলে মত প্রকাশ করেছেন।


এছাড়াও বাংলা বার ও মাসের নামগুলো এসেছে ভারতীয় জ্যোতিষ বিজ্ঞানের দেওয়া বিভিন্ন গ্রহ ও নক্ষত্রের নাম থেকে। রবি, সোম বা বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ-এই নামগুলো বহু প্রাচীন জ্যোতিষ শাস্ত্রেই উল্লেখ আছে। বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারে বৈশাখ বা চিত্রা নক্ষত্রের নামানুসারে চৈত্র মাস এগুলো হিন্দু পরম্পরায় জ্যোতিষ শাস্ত্রের অংশ যেগুলো আকবর নয় বরং হিন্দু রাজা শশাঙ্কের পক্ষেই বেশি যুক্তিযুক্ত। উপরন্তু আকবর এর তারিখ ই ইলাহী এর মাস এর নাম কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। 


🚩আকবরের বিপক্ষে যুক্তিঃ


১/ দাবী করা হয় কৃষকদের ফসল তোলার সময় সম্পর্কে জানার সুবিধার জন্য এই সাল চালু হয় বলে এর আরেক নাম নাকি আবার ফসলী সন! সমগ্র ভারতে ফসল হওয়া সত্ত্বেও এবং আকবর সমগ্র ভারতের সম্রাট হওয়ার পরেও কেনো শুধু বাংলা এলাকার জন্য সে বাংলা সন চালু করতে যাবে?বাংলা ছাড়া অন্যান্য রাজ্যের খাজনা বা কর কি তার প্রয়োজন ছিলো না?


২/ আরো বলা হয়, হিজরি ৯৬৩ সালের সাথে মিল রেখে, ঐ সালকেই বাংলা ৯৬৩ হিসেবে ঘোষণা ক‌'রে বাংলা সনের চালু করা হয়। কিন্তু এখন ত চলছে ১৪৪৬ হিজরি। আরেকটা হিসেব করে নেওয়া যাক আকবর সিংহাসনে আরোহন করে ১৫৫৬ খ্রিস্টাবে। অর্থাৎ আজ থেকে (২০২৫-১৫৫৬) = ৪৬৯ বছর আগে৷ এই হিসেবেও ত আকবরের রাজ্যাভিষেকের সময় বঙ্গাব্দের আদিবিন্দু হতে প্রায় হাজার বছর পিছিয়ে। 


৩/ বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে সম্রাট আকবরকে তারই আমলের রচিত ইতিহাসে স্বীকৃত দেওয়া হয় নি। "আইন-ই-আকবরী" নামে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালের সময়ের একটি বিখ্যাত গ্রন্থ আছে, কিন্তু এই গ্রন্থে বাংলা সন বা ফসলী সন চালুর ব্যাপারে কোনো কথার উল্লেখ নেই। কিন্তু আকবর, ১০৭৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ইরানে প্রচলিত ‍"জেলালি সৌর পঞ্জিকা‍" অনুসরণে ভারতে ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে "তারিখ-ই-ইলাহী‍" নামে একটি সৌর পঞ্জিকা চালু করেছিলো সে বিষয়ে ঠিকই উল্লেখ আছে। তবে কয়েক দশক পর এই ‍"তারিখ-ই- ইলাহী‍" পঞ্জিকার ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।


৪/ আকবরের রাজস্ব সচিব টোডরমলের ‘আসল- ই-জমা তুমার’ গ্রন্থেও আকবর কর্তৃক উল্লিখিত অব্দ বা সন প্রবর্তনের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। 


৫/ পৃথিবীর সকল সাল শুরু হয়েছে ১ থেকে এবং এটাই যুক্তিসঙ্গত। আকবর যদি বঙ্গাব্দের শুরু করেই থাকেন তবে সেটা কোন যুক্তিতেই প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। কিছু লোক জোর করে হিসেব মিলিয়ে দেয় কিভাবে? 

২০২৫-১৫৫৬=৪৬৯ আবার ১৪৩২-৯৬৩= ৪৬৯. অথচ যে সামান্য অংক ও জানে সে বলে দিতে পারে যে একক এক হলে তবেই যোগ বিয়োগ করা যায়।দশ কিলোমিটার থেকে তিন মিটার বিয়োগ হয় না তবে ১০,০০০ মিটার থেকে ৩ মিটার বিয়োগ হয়। তেমনি পরবর্তী বিয়োগ খেয়াল করুন একটা বঙ্গাব্দ যাতে বৎসর অবধি Sidereal হয় তথা ৩৬৫.২৫ দিনের হয় আর একটি হিজরী অব্দ যাতে বৎসর অবধি ৩৫৪ দিনের হয় অর্থাৎ এদের একক সম্পূর্ণ ভিন্ন। এদের এক এককে আনলে হয় (১৪৩২×৩৬৫.২৫)-(৯৬৩×৩৫৪)= ১৮২১৩৬ দিন অর্থাৎ প্রায় ৫০০ বৎসর। আশা করি এই সামান্য হিসেব সেই সকল বুদ্ধিজীবী রা বুঝবে।  


এবার আসি আকবর এর গল্পে আবার। আপনি গণনা শুরু করলে 1 থেকে করবেন নাকি 100 থেকে? আর ধরেও যদি নেই ৯৬৩ হিজরী কেই ৯৬৩ বঙ্গাব্দ করা হলো তবে সে বছর হিজরী Rabi al Thani মাস যাচ্ছিল এপ্রিল মাসে যা মোটেও হিজরী এর প্রথম মাস না। তারিখ ই ইলাহী এর সূচনা ১৫৮৪ তে ধরলেও সেই বছর এপ্রিল এ Jumada al Thani মাস যাচ্ছিল আবারো এটা হিজরী প্রথম মাস না আর না আকবর এর সিংহাসন আরোহণ কাল। তবে এপ্রিল এ হিজরী মাস এর অর্ধেক থেকে গণনা শুরু করার আবার বৎসর মান কে হিজরী রাখার কোনো কারণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না।




৬/ ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি আকবরের রাজ্যভিষেক হয় বলে ধরা হয়। তাহলে সেই সময় থেকে বাংলা সন চালু হলে পহেলা বৈশাখ ১৫ এপ্রিল না হয়ে তো ১৪ ফেব্রুয়ারি হওয়ার কথা কিন্তু সেটা হচ্ছে না। অন্যদিকে রাজা শশাঙ্ক প্রবর্তিত বাংলা সনের আদি বিন্দু ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল। পরে বেশ কয়েকবার পঞ্জিকা সংস্কারের কারণেই মনে হয় এই ১২ এপ্রিল, বর্তমানের ১৫ এপ্রিলে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু সম্রাট আকবরের নামে চালানো বাংলা সনের আদি বিন্দু ১৫৫৬ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি তো কিছুতেই ১৫ এপ্রিলে এসে পৌঁছতে পারে না। 


৭/ সম্রাট আকবর পূর্ববর্তী বহু স্থানেই বঙ্গব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার দিহারগ্রাম ও সোনাতপন গ্রামের হাজার বছরেরও প্রাচীন মাটির টেরাকোটা খচিত দুটি পুরাতাত্ত্বিক শিব মন্দিরে সম্রাট আকবর পূর্ববর্তী বঙ্গাব্দের উল্লেখ রয়েছে। খ্যাতিমান প্রশাসক অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘বাঁকুড়ার মন্দির' গ্রন্থে '১০২ বঙ্গাব্দ'-এর উল্লেখ আছে। 


৮/ ১৩২০ বঙ্গাব্দে বরিশাল থেকে প্রকাশিত ও বৃন্দাবনচন্দ্র পুততুণ্ড-রচিত ‘চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাস' গ্রন্থে বঙ্গাব্দ ৬০৬ সাল উল্লেখ পাওয়া যায়। 


৯/ বিবিসি বাংলার সাথে আলোচনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক ইসলামের বিশেষজ্ঞ কিংশুক চ্যাটার্জির বলেন, "শশাঙ্কর আমলে তো বাংলা ভাষাটাই চালু হয়নি। কাজেই তিনি বাংলার জন্য আলাদা অব্দ বা সাল চালু করেছিলেন এটা ভাবাটা বেশ বাড়াবাড়ি🤣"


এটা খুবই হাস্যকর যুক্তি দিলেন তিনি কারণ সেই যুগে বাংলা চালু না হলেও 'বঙ্গ' ঠিকই চালু হয়েছিল। অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ এগুলো বহু প্রাচীন সাংস্কৃতিক নাম। শক থেকে যেমন শকাব্দ একইভাবে বঙ্গ থেকে বঙ্গাব্দ চালু হওয়াও যথাযথ। 


১০/ বাংলা বর্ষগননা যে সম্রাট আকবর চালু করেননি তার আরেকটা প্রমাণ রয়েছে দিনাজপুর জাদুঘরে। নাথধর্মের অন্যতম পীঠস্থান ছিলো তৎকালীন অবিভক্ত দিনাজপুর তথা আজকের ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল মহকুমার গুরু গোরক্ষনাথ মন্দির।প্রাচীন এ গোরক্ষনাথ মন্দিরে দুটি বেলে পাথরের উৎকীর্ণ শিলালিপি পাওয়া যায়।বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ শিলালিপির পরিচয় দিয়েছেন এভাবে,  


*প্রথম পাথরে খোদিত লিপিতে ১০ পঙক্তির নিচে একটি রেখা টানা। রেখার নিচে আছে একটি অশ্বমূর্তি ও একটি বরাহের মসত্মকদেশ। সংলগ্ন দ্বিতীয় পাথরে ছিল বরাহের দেহের অবশিষ্টাংশ ও একটি বৃষমূর্তি। অমসৃণ ও নিকৃষ্টমানের বেলে পাথরে খোদিত লিপিটি ক্ষয়প্রাপ্ত ও দুর্বোধ্য হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় পঙক্তির 'খরগাম', নবম পঙক্তির 'রমনসক' ও দশম পঙক্তির '৯২০ তারিখ( বা তারখ) ১৭ মাঘ' এই ক'টি শব্দ ছাড়া এই দুর্বোধ্য ও ক্ষয়প্রাপ্ত শিলালিপির আর কোনো পাঠ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।*


এই শিলালিপিটি এখন দিনাজপুর জাদুঘরে সংরক্ষিত।এখানে স্পষ্টত বাংলা সালের উল্লেখ পাওয়া যায় যা আকবরের সময়ের চেয়ে অনেক অনেক আগের।



১১/ আকবর যদি ১৫৫৬ সালেও বঙ্গাব্দের শুরু করে থাকেন তবে তার আগে অর্থাৎ ৪৬৯ বছর আগে বঙ্গাব্দের কোন অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু ১৩২৪ বঙ্গাব্দে শিলচর থেকে প্রকাশিত ও অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি-রচিত ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত' (উত্তরাংশ: তৃতীয় ও চতুর্থ ভাগ) গ্রন্থে ‘সন ৯০৬ বঙ্গাব্দ'-র উল্লেখ আছে। ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা সম্বলিত ও প্রবোধচন্দ্র বসু (প্রবুদ্ধ) রচিত 'ভগবানপুর থানার ইতিবৃত্ত' গ্রন্থে বাঙলা ৯৭৩ সালের উল্লেখ সালের উল্লেখ রয়েছে। 


১২/ ২৬ ডিসেম্বর ১৯১১ সালে খুলনা জেলার বিছট বাসুদেবপুর গ্রামে সন্ধান করার সময় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় জ্ঞানেন্দ্রনাথ রায়ের অধিকারে থাকা একটি মুদ্রায় ১৩৩৯ সম্বৎ ও ৬০৬ সাল দেখতে পান। ৬০৬ বঙ্গাব্দ ধরলে মুদ্রাটি ৮২৩ বছর আগের অথচ আকবরের জন্ম ৪৮০ বছর আগে।


জয় বঙ্গ জয় শশাঙ্ক 

শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 

হর হর মহাদেব 


লেখনীতে — শ্রী অভিরূপ ঘোষ শৈব জী

কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ