বিষ্ণুর অস্ত্র হিসেবে পরিচিত সুদর্শন চক্রের উৎপত্তি হবার অজানা কাহিনি




ভূমিকা — সুদর্শন চক্র হল ভগবান বিষ্ণুর হাতে শোভিত থাকা অত্যন্ত শক্তিশালী অস্ত্র, যা নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই, যার দরুন আমদের মনে প্রশ্ন আসে যে, 

এই সুদর্শন চক্রের উৎপত্তি কীভাবে হলো ? কীভাবে শ্রীবিষ্ণুর হাতে এই সুদর্শন চক্র এলো ?

এই বিষয়ে পুরাণ, বেদ, মহাভারত ও মহাশ্রুতি শৈব আগম শাস্ত্র থেকে প্রমাণ সহ সকল উত্তর এই প্রবন্ধে উপস্থাপন করেছি।


সুদর্শন চক্রের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল ?


উত্তর  — সুদর্শন চক্র দিয়ে অশুভ শক্তির বিনাশ করে শ্রীবিষ্ণু অধর্মী দের উপযুক্ত শাস্তি দেন, এই বিষয়টিকে নিয়ে বৈষ্ণবেরা সর্বদা অহংকার করতে থাকেন, কিন্তু শাস্ত্রে এই সুদর্শন চক্রের উৎপত্তি সম্পর্কে অধ্যয়ন করলে প্রকৃত সত্য বে হয়ে আসে। চলুন বৈষ্ণবদের শাস্ত্র থেকেই সেই সত্য প্রকাশ করে দেখাই।

 

বৈষ্ণব পুরাণ থেকে প্রমাণ — (১)

ত্রিভুবনমূর্তে বেদপুরাণমূর্তে যজ্ঞমূর্তে স্তোত্র-মূর্তে শাস্ত্রমূর্তে, স্বধামূর্তে নারায়ণমূর্তে সর্ব্ব দেবতামূর্তে ত্রয়ীময় ত্রয়ীপ্রমাণ ত্রয়ীনেত্র সামপ্রিয় বসুধারাপ্রিয় ভক্তিপ্রিয় ভক্তসুভাভক্তবিদূরস্তুতিপ্রিয় ধূপপ্রিয় দীপপ্রিয় ঘৃতক্ষীরপ্রিয় দ্রোণকবরবীরপ্রিয় শ্রীপত্রপ্রিয় কমলকহলারপ্রিয় নন্দ্যাবর্তপ্রিয় বকুলপ্রিয় যূথিকাপ্রিয় কোকনদপ্রিয় গ্রীষ্মজলাবাসপ্রিয় যমনিয়মপ্রিয় নিয়তেন্দ্রিয়প্রিয় জপপ্রিয় শ্রাদ্ধপ্রিয় গানপ্রিয়, গায়ত্রীপ্রিয় পঞ্চব্রহ্মপ্রিয় সদাচারপ্রিয় গোত্রোৎসাদিকমলভবহরিহরনয়নসমর্চ্চিতপাদকমলজয়প্রদ হরিপ্রার্থিতজলোৎপাটিতচক্রপ্রদর্শকৃৎস্মৃতিযুক্তিপ্রদ স্মৃতিমঙ্গল প্রদমহ্যাং জয় নমস্তে নমস্তে ॥ ১০০

ইতি স্তোত্রমাকর্ণ্য ভগবান ভবো রাজন মুরাচ বরদোঽহং বরং বৃণু ॥ ১০১

[তথ্যসূত্র : পদ্মপুরাণ/পাতালখণ্ড/৭১ অধ্যায়]

অর্থ — (রাজা জনক বললেন) হে মহাদেব ! আপনি লোক মূর্তি, আপনি ত্রিভুবনমূর্তি বেদ-পুরাণ আপনার মূর্তি। আপনি যজ্ঞমূর্তি, স্তোত্র-মূর্তি, শাস্ত্রমূর্তি, স্বধামূর্তি ও নারায়ণের মূর্তি রূপে বিরাজমান রয়েছেন, সমস্ত দেবতা আপনার মূর্তি। আপনি বেদমন্ত্র, আপনি বেদ-সমূহের প্রমাণ এবং বেদসমূহও আপনাকে প্রমাণ করিয়া থাকে। তিন বেদ আপনার তিন নেত্র। আপনি সামপ্রিয়, বসুধারাপ্রিয়, ভক্তিপ্রিয়, যাহা ভক্তজনের সুলভ, অভক্তের পক্ষে নিতান্ত দুর্লভ, তাদৃশ স্তুতি আপনার প্রিয়, আপনি ধূপপ্রিয়, দীপপ্রিয়, আপনি ঘৃতদুগ্ধপ্রিয়, আপনি দ্রোণকরবীরপুষ্পপ্রিয়, বিল্বপত্রপ্রিয়, কমলকহ্লার পুষ্প-প্রিয়, নন্দ্যাবর্তমণ্ডল-প্রিয়, এবং বকুল, যূথিকা ও কোকনদ-পুষ্পপ্রিয়। গ্রীষ্মকালে জলে বাস আপনার প্রিয়। আপনি যমনিয়মপ্রিয়; জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি আপনার প্রিয়। আপনি জপপ্রিয় । শ্রদ্ধাপূর্বক প্রদত্ত দ্রব্যে আপনার প্রীতি। গানে আপনার প্রীতি। গায়ত্রীতে আপনার প্রীতি। আপনার নিজের পঞ্চব্রহ্মস্বরূপেই প্রীতি। আপনি সদাচারে তুষ্ট হন। সকল দেবতা সহ ব্রহ্মা আপনার পূজা করেন, শ্রীহরি বিষ্ণু নিজ চক্ষু তুলে আপনার হরের(শিবের) পাদপদ্মে সমর্পণ করে পূজা করিয়াছেনশ্রীহরির প্রার্থনায় আপনি আপনার চরণাঙ্গুল দিয়ে জল হতে লীলামাত্রেই সুদর্শনচক্র উৎপাদন করেছিলেন। আপনিই পৃথিবীতে স্মৃতি-শাস্ত্রোক্ত যুক্তি, এবং স্মৃতিশাস্ত্রোক্ত শুভকৰ্ম্ম সকলের প্রচার করিয়াছেন। আপনার জয় হউক। আপনাকে পুনঃপুনঃ নমস্কার। এইরূপ স্তব শ্রবণ করে ভগবান্ মহেশ্বর সেখানে আবির্ভূত হয়ে রাজাকে বলিলেন,- আমি বর দিতে এসেছি, তুমি বর প্রার্থনা করো।


🔷 লক্ষ্য করুন — 

(১) বৈষ্ণব দের পুরাণ হল পদ্ম পুরাণ, সেই পুরাণের মধ্যে স্বীকার করা হয়েছে যে, শ্রীহরি শিবপূজা করবার জন্য নিজের চোখ তুলে পরমেশ্বর শিব কে অর্পণ করেছিলেন ভক্তিভরে ।

(২)  বৈষ্ণব দের পদ্ম পুরাণের মধ্যে স্বীকার করা হয়েছে যে, শ্রীহরি নারায়ণের প্রার্থনা শুনে জলে নিজের পা দিয়ে লীলা মাত্রেই পরমেশ্বর শিব সুদর্শন চক্র উৎপন্ন করেছিলেন। যা তিনি হরিকে দিয়ে দেন। কারণ, হরি নারায়ণ পরমেশ্বর শিবের কাছে ঐ সুদর্শন চক্র টি পাবার জন্য শিব আরাধনা করেছিলেন।

________________________________________________

শিবমহাপুরাণ শাস্ত্র থেকে প্রমাণ — (২)

কোপং কৃত্বা পরং শূলী পাদাঙ্গুষ্ঠেন লীলয়া।
মহাম্ভসি চকারাশু রথাঙ্গং রৌদ্রমদ্ভুতম্ ॥২৬॥ 

কৃত্বার্ণবাম্ভসি শিতং ভগবান্ রথাঙ্গং
স্মৃত্বা জগত্ত্রযমনেন হতং পুরারিঃ।
দক্ষান্ধকান্তকপুরত্রয়যজ্ঞহন্তা
লোকত্রযান্তককরঃ প্রহসন্নুবাচ ॥২৭॥

মহারুদ্র উবাচ।
পাদেন নির্মিতং চক্রং জলন্ধর মহাম্ভসি।
বলবান্যদি চোদ্ধর্তুং তিষ্ঠ যোদ্ধং ন চান্যথা ॥২৮॥

সুদর্শনাখ্যং যচ্চক্রং পাদাঙ্গুষ্ঠবিনির্মিতম্।
জগ্রাহ তৎকরে রুদ্রস্তেন হন্তুং সমুদ্যতঃ ॥৪৫॥

সুদর্শনাখ্যং তচ্চক্রং চিক্ষেপ ভগবান্ হরঃ।
কোটিসূর্যপ্রতীকাশং প্রলয়ানলসন্নিভম্ ॥৪৬॥

প্রদহদ্রোদসী বেগাত্তদাসাদ্য জলন্ধরম্।
জহার তচ্ছিরো বেগান্ মহদায়তলোচনম্ ॥৪৭॥

[শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/যুদ্ধখণ্ড/২৪ অধ্যায়]

অর্থ — 

সেই সময় ক্রোধ করে নিজের লীলার দ্বারা ত্রিশূলধারী ভগবান শংকর মহাসমুদ্রে নিজের পায়ের বৃদ্ধ আঙুল দিয়ে শীঘ্রই ভয়ানক তথা অদ্ভুত রথ চক্রের নির্মাণ করলেন ॥ ২৬

তিনি সেই মহাসমুদ্রে অত্যন্ত জাজ্বল্যমান রথচক্রের নির্মাণ করে তথা এটি স্মরণ করে নিশ্চয় করে দিলেন যে এই চক্রের দ্বারা ত্রিলোক বধ করা সম্ভব। দক্ষ, অন্ধক, ত্রিপুর তথা যজ্ঞের বিনাশকারী পরমেশ্বর শঙ্কর হাসতে হাসতে বললেন ॥ ২৭

মহারুদ্র বললেন, হে জলন্ধর ! আমি মহাসমুদ্রে নিজের পায়ের বৃদ্ধ আঙ্গুল দ্বারা এই চক্রের নির্মাণ করেছি।, যদি তুমি বলবান হয়ে থাকো তবে এই চক্রকে জল থেকে বাইরে বের করে এনে আমার সাথে যুদ্ধ করবার জন্য উপস্থিত হও, নচেৎ পালিয়ে যাও ॥ ২৮

(এরপর জলন্ধর কটু বাক্য বলেন) 

পরমেশ্বর মহারুদ্র নিজের পায়ের বৃদ্ধ আঙ্গুল দ্বারা যে সুদর্শন নামক চক্র নির্মাণ করেছিলেন, তার নিজের হাতে নিলেন এবং তা দিয়ে জলন্ধরকে বধ করবার জন্য ভগবান রুদ্র উদ্যত হলেন ॥ ৪৫

ভগবান হর প্রলয় কালের অগ্নির সদৃশ এবং কোটি সূর্যের সমান দেদীপ্যমান সেই সুদর্শন চক্রকে তার ওপর ফেললেন । তখন যেন আকাশ তথা ভূমিকে প্রজ্জ্বলিত করতে করতে সেই চক্র অতি গতিবেগের সাথে জলন্ধরের মস্তক বেগপূর্বক কেটে ফেললেন ॥ ৪৬-৪৭


🔷লক্ষ্য করুন —  বৈষ্ণব দের পদ্ম পুরাণ ও শিবমহাপুরাণের মধ্যে একই কাহিনী কে স্বীকার করা হয়েছে যে, নিজের পা দিয়ে লীলা মাত্রেই পরমেশ্বর শিব সুদর্শন চক্র উৎপন্ন করেছিলেন।

________________________________________________

🔲এছাড়া, এই সুদর্শন চক্র শ্রীহরি নারায়ণ বিষ্ণু কোথা থেকে পেলেন ?

                        — এ বিষয়ে 

🔸 শিবমহাপুরাণের ১ম মতামত দেখুন ।

দধীচ ঋষি ও ভগবান বিষ্ণুর মধ্যে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাদের মধ্যে হ‌ওয়া কথোপকথনের প্রসঙ্গে —

দধীচ উবাচ 

ভগবন্ ভবতা লব্ধং পুরাতীব সুদারুণম্ ।

সুদর্শনমিতি খ্যাতং চক্রং বিষ্ণোঃ প্রয়ত্নতঃ ।

ভবস্য তচ্ছুভং চক্রং ন জিঘাংসতি মামিহ ॥ ১৮

[শিবমহাপুরাণ/রুদ্র সংহিতা/সতীখণ্ড/৩৯ অধ্যায়/১৮নং শ্লোক]

অর্থ — দধীচ ঋষি বললেন, হে ভগবন্ ! আপনি পূর্ব কালে তপস্যার দ্বারা পরমেশ্বর শিব কে প্রসন্ন করে সুদর্শন নামে বিখ্যাত এই চক্রকে লাভ করেছিলেন। পরমেশ্বর শিবের সেই শুভ চক্র আমাকে কখনোই বধ করবে না । 


 🔸 শিবমহাপুরাণের ২য় মতামত দেখুন —

বীরভদ্র নৃসিংহরূপী নারায়ণকে বলছেন, 

চক্রং বিক্রমতো যস্য চক্রপাণে তব প্রিয়ম্‌ ।

কুত প্রাপ্তং কৃতং কেন ত্বয়া তদপি বিস্মৃতম্‌ ॥ ৫৪

[শিবমহাপুরাণ/শতরুদ্রসংহিতা/১২ অধ্যায়/৫৪নং শ্লোক]

অর্থ — হে চক্রপাণি! আপনি যে চক্রের সহায়তায় আপনার বীরত্ব (পুরুষার্থ) প্রকাশ করেন, সেই চক্র কোথা থেকে এবং কার দ্বারা প্রাপ্ত হয়েছিল — আপনি কি তা ভুলে গেছেন? ॥৫৪॥

(ভাবার্থ ঃ ভগবান বীরভদ্র বলতে চেয়েছেন যে, হে বিষ্ণু আপনি সুদর্শন চক্র নিয়ে বীরত্ব দেখিয়ে বেড়ান,  তা তো আপনি পরমেশ্বর শিবের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এই কথা তা কি আপনি ভুলে গিয়েছেন ?)


🔸  শিবমহাপুরাণের ৩য় মতামত দেখুন —

দেবতারা দৈত্যদের দ্বারা পীড়িত হয়ে বিষ্ণুর কাছে রক্ষা করবার প্রার্থনা করলে, বিষ্ণু সেই দৈত্য দের বধ করবার জন্য কোন অস্ত্র অবশিষ্ট নেই দেখে, অস্ত্র পাবার আশায় পরমেশ্বর শিবের তপস্যা করেন। একটি একটি করে  ১ হাজার টি পদ্মফুল দিয়ে শিবসহস্র নাম পাঠ করে বিষ্ণু শিব আরাধনার দ্বারা পরমেশ্বর শিব কে সন্তুষ্ট করেন, পরমেশ্বর শিব বিষ্ণুর ভক্তির পরীক্ষা নেবার জন্য ১ হাজার টি পদ্ম ফুল থেকে একটি পদ্মফুল সরিয়ে নেন। বিষ্ণু একটি পদ্মফুলের অভাবে নিজের চোখ তুলে দিয়ে দেন। তা দেখে পরমেশ্বর শিব খুবই প্রসন্ন হয়ে দেখা দেন  ও বিষ্ণুকে বরদান চাইতে বলেন, তখন বিষ্ণু প্রভু শিবের কাছে সুদর্শন চক্র প্রার্থনা করলে তা শুনে পরমেশ্বর শিব তাকে সুদর্শন চক্র প্রদান করেন — 

ইতি শ্রুত্বা বচো বিষ্ণোর্দে‌বদেবো মহেশ্বরঃ ।

দদৌ তস্মৈ স্বকং চক্রং তেজোরাশিং সুদর্শনম্‌ ॥ ৩০

[শিবমহাপুরাণ/কোটিরুদ্রসংহিতা/৩৪ অধ্যায়/৩০নং শ্লোক]

অর্থ — বিষ্ণুর এই বাক্য শুনে দেবাধিদেব মহেশ্বর তাঁকে তাঁর মহাতেজস্বী সুদর্শনচক্র প্রদান করলেন।


🔸  শিবমহাপুরাণের ৪র্থ‌ মতামত দেখুন —
বাণের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে শিবের ইচ্ছে অনুসারেই শ্রীকৃষ্ণ বাণের সকল হাত সুদর্শন চক্র দিয়ে কেটে ফেলেন, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ যখন বাণের মস্তক কাটবার জন্য সুদর্শন চক্র কে উদ্যত হলেন, ঠিক তখনই পরমেশ্বর রুদ্রদেব সেখান প্রকট হয়ে শ্রীকৃষ্ণ কে আটকে দিলেন। পরমেশ্বর বললেন যে, শিবের ইচ্ছেতেই সুদর্শন চক্র বাণের হাত কেটেছে, কিন্তু শিব তার ভক্ত বাণের মস্তক কাটবার ইচ্ছা করেননি, তাই সুদর্শন চক্রও বাণের মস্তক কাটতে যাবে না। 
 পরমেশ্বর শিব শ্রীকৃষ্ণ কে সুদর্শন চক্র দিয়ে শুধুমাত্র বাণের হাত কেটে শিক্ষা দেবার আদেশ দিয়ে ছিলেন, মস্তক কাটবার আদেশ দেন নি, তাই শ্রীকৃষ্ণ সুদর্শন চক্র দিয়ে বাণের মস্তক কাটবার বৃথা চেষ্টা করতে উদ্যত হয়েছেন দেখে পরমেশ্বর রুদ্র এসে শ্রীকৃষ্ণ কে থামিয়ে দেন।
প্রমাণ দেখুন,


রুদ্র উবাচ 

ভগবন্দেবকীপুত্র যদাজ্ঞপ্তং ময়া পুরা।
তৎকৃতং চ ত্বয়া বিষ্ণো মদাজ্ঞাকারিণা সদা ॥ ৩৩

মা বাণস্য শিরশিঞ্ছধি সংহরস্ব সুদর্শনম্।
মদাজ্ঞয়া চক্রমিমমমোঘং মজ্জনে সদা ॥ ৩৪

দত্তং ময়া পুরা তুভ্যমনিবার্য রণে তব।
চক্রং জয়ং চ গোবিন্দ নিবর্তস্ব রণাত্ততঃ॥ ৩৫

দধীচে রাবণে বীরে তারকাদিপুরেষ্বপি।
বিনা মদাজ্ঞাং লক্ষ্মীশ রথাঙ্গং নামুচঃ পুরা ॥ ৩৬


[শিবমহাপুরাণ/রুদ্র সংহিতা/যুদ্ধখণ্ড/৫৫ অধ্যায়/৩৩-৩৬ শ্লোক]
অর্থ — 
রুদ্র বললেন- ওহে ভগবন্ দেবকীনন্দন!  আমি তোমাকে যে আদেশ দিয়েছিলাম, আমার আদেশ পালনকারী তুমি তেমনই কার্য করেছো ॥ ৩৩
 এখন তুমি বাণের মস্তক কেটে ফেলবার ব্যর্থ চেষ্টা কোরো না, আমার আজ্ঞার আদেশে তোমার এই সুদর্শন চক্র ফিরিয়ে নাও ; কারণ আমার ভক্তের উপর এই চক্র সর্বদাই নিষ্ফল হবে ॥ ৩৪
ওহে গোবিন্দ! সংগ্রাম কালে আমি এই সুদর্শন চক্র অনিবার্য কারণে তোমাকে প্রদান করেছিলাম, সেই কারণে সকলকে জয়কারী এই চক্রকে এই যুদ্ধভূমি থেকে ফিরিয়ে নাও এখনি ॥ ৩৫
হে লক্ষ্মীশ ! পূর্ব কালেও তুমি এই সুদর্শন চক্র দিয়ে দধীচ, রাবণ ও বীরত্ব প্রদর্শনকারী তারকাসুরের‌ও নাশ করতে পারোনি (সুতরাং, আমার আদেশ পালনকারী এই চক্রকে আমার ভক্তকে বধ করবার জন্য বৃথা চেষ্টা করিও না) ॥ ৩৬


🔷লক্ষ্য করুন —   এইখান থেকে প্রমাণ হয় যে, শ্রীকৃষ্ণ যতই চেষ্টা করুন না কেন, সুদর্শন চক্রকে মূলত পরমেশ্বর শিব ই নিয়ন্ত্রণ করেন, শিবের দেওয়া এই চক্র কখনোই কোনো শিবভক্তের অনিষ্ট করতে পারেনি, কারণ শিবের ইচ্ছে ছাড়া শিবের কোন অস্ত্র শিবভক্তদের ক্ষতি করেনা। কারণ, এই চক্র পরমেশ্বর শিবের দ্বারাই সৃষ্টি করা হয়েছে।

________________________________________________

সৌরপুরাণ শাস্ত্র থেকে প্রমাণ — (৩)


ঋষয় উচুঃ।

কথং জালন্ধরো দৈত্যো নিহতঃ শূলপাণিনা।

সুদর্শনেন চক্রেণ বক্তুমর্হত সাম্প্রতম ॥ ১

শ্রুত্বাথ দৈত্যবচনং পাদাঙ্গুষ্ঠেন শঙ্কর।

চকার লীলয়া চক্রমম্বুধৌ দিব্যমায়ুধম্ ॥ ১৪

যদিদং নিৰ্মলং চক্রং জালন্ধর ময়াম্বুধৌ।

বলং তে যদি চোদ্ধর্ত্তুং তিষ্ঠ যোদ্ধুঞ্চ নান্যথা ॥ ১৫

অথ শম্ভোর্বচঃ শ্রুত্বা মদান্ধো দৈত্যপুঙ্গবঃ।

দোর্ভামাস্ফোট্য বেগেন লেখামুদ্ধর্ত্তুমুদ্যতঃ ॥২৭

সুদর্শনাখ্যং যচ্চক্রং কৃচ্ছ্রেণ মহতা দ্বিজাঃ।

স্কন্ধে বৈ স্থাপয়ামাস দ্বিধাভূতে ততঃ ক্ষণাৎ ॥ ২৮

নিপপাত ততো দৈত্যো মেঘাচল ইবাপরঃ।

তস্য দেহস্য রক্তেন সম্পূরিতমভূজ্জগৎ ॥২৯

[সৌরপুরাণ/৩৭ অধ্যায়]

অর্থ — ঋষিগণ বললেন,-শূলপাণি শিব সুদর্শনচক্র দ্বারা কিভাবে জলন্ধর দৈত্যকে নিহত করেছিলেন, এক্ষণে তাহা আমাদের বলুন ॥ ১ 

(সূত মুনি বলতে শুরু করলেন)

শিব দৈত্যের কথা শুনিয়া পরমেশ্বর শিব লীলাক্রমে পাদাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে সমুদ্রে দিব্য চক্রায়ুধ অঙ্কন করলেন এবং বললেন, হে জলন্ধর! আমি সমুদ্রে এই যে নিৰ্ম্মল চক্র উৎপন্ন করলাম, এটি উত্তোলন করবার সামর্থ্য যদি তোমার মধ্যে থাকে, তবেই যুদ্ধের জন্য এখানে থাকো, নতুবা নয় ॥ ১৪-১৫

অনন্তর মদান্ধ দৈত্যরাজ জলন্ধর, পরমেশ্বর শম্ভুর বাক্য শ্রবণ করে সবেগে বাহ্বাস্ফোটন পূর্ব্বক সেই রেখারূপী চক্র উত্তোলনে উদ্যত হলেন। সেই রেখাই সুদর্শনচক্র। 

হে দ্বিজগণ! মহাকষ্টে দৈত্যরাজ সেটি নিজের কাঁধে স্থাপন করলেন; তৎক্ষণাৎ ঐ চক্র দ্বারা তার কাঁধ (মুণ্ডসহ) ও দেহ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল, এর ফলে সেই দৈত্য দ্বিতীয় কৃষ্ণপর্ব্বতের ন্যায়, নিপতিত হইল। তার শরীরের রক্তে জগত যেন পূর্ণ হয়ে গেল ॥ ২৭-২৯


🔷লক্ষ্য করুন —   বৈষ্ণব দের পদ্ম পুরাণ ও শিবমহাপুরাণের মতো সৌর পুরাণও স্বীকার করেছে যে, পরমেশ্বর শিবই সুদর্শন চক্র উৎপন্ন করেছেন।

________________________________________________

ইতিহাস শাস্ত্র থেকে প্রমাণ — (৪)

বিষ্ণোশ্চক্রঞ্চ তঘোরং বজ্রমাখণ্ডলস্য চ।

শীর্ণং পুরাভবত্তাত! গ্রহস্যাঙ্গেযু কেশব! ॥৭৪৷৷

যত্তদ্ভগবতা পূর্ব্বং দত্তং চক্রং তবানঘ।।

জলান্তরচরং হত্বা দৈত্যঞ্চ বলগব্বিতম্ ॥৭৫॥

উৎপাদিতং বৃষাঙ্কেন দীপ্তজ্বলনসন্নিভম্।

দত্তং ভগবতা তুভ্যং দুর্দ্ধর্ষং তেজসাজু তম্ ॥৭৬৷৷

ন শক্যং দ্রষ্ট মন্যেন বর্জ্জযিত্বা পিনাকিনম্।

সুদর্শনং ভবত্যেবং ভবেনোক্তং তদাতু তৎ ॥৭৭॥

সুদর্শনং তদা তস্য লোকে নাম প্রতিষ্ঠিতম্।

তজ্জীর্ণম ভবত্তাত ! গ্রহস্যাঙ্গেষু কেশব ! ॥৭৮৷৷

গ্রহস্যাতিবলস্যাঙ্গে বরদত্তস্য ধীমতঃ।

ন শস্ত্রাণি বহন্ত্যঙ্গে চক্রবজ্রশতান্যপি ॥৭৯৷৷

[মহাভারত/অনুশাসন পর্ব/১৩ অধ্যায়]

অর্থ — (মহর্ষি উপমন্যু বললেন) হে বৎস কৃষ্ণ! বিষ্ণুর সেই ভয়ঙ্কব চক্র এবং ইন্দ্রেব বজ্র পূর্বকালে সেই মন্দার পর্বতের অঙ্গে পতিত হয়ে বিশীর্ণ হয়ে গিয়েছিল ॥৭৪॥

হে নিষ্পাপ কেশব! ভগবান্ মহাদেব সেই যে চক্র আপনাকে (বিষ্ণুকে) দিয়েছিলেন। তিনি বলগর্বিত জলাভ্যন্তবস্থিত জলন্ধরাসুরকে বধ করতে সেই চক্র উৎপাদন করেন, পবে আবার তিনি তেজে অদ্ভুত ও প্রজ্জ্বলিত অগ্নিব তুল্য সেই দুর্ধর্ষ-চক্র আপনাকে দান করেছেন ॥৭৫-৭৬৷৷

মহাদেব ব্যতীত অন্য কেউই সেই চক্র দেখতেও সক্ষম হতো না। তখন মহাদেব বলিয়াছিলেন, ‘এই চক্র সুদর্শন হবে’ ॥৭৭৷৷

তখন থেকে জগতে সেই চক্রটীর 'সুদর্শন' নাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বৎস কৃষ্ণ! সেই সুদর্শনচক্র মন্দার পর্বতের অঙ্গে পতিত হয়ে বিশীর্ণ হয়েছিল ॥৭৮৷৷

🔷লক্ষ্য করুন —  

(১)পরমেশ্বর শিব জলন্ধরাসুরকে বধ করবার জন্য  সুদর্শন চক্র  উৎপাদন করেছিলেন।

(২) মহাভারত ইতিহাস শাস্ত্রেও স্বীকার করা হয়েছে যে, পরমেশ্বর শিব ই বিষ্ণুকে সুদর্শন চক্র দিয়েছিলেন।

(৩) পরমেশ্বর শিব ছাড়া আর কেউ দেখতে পেতো না এই চক্র, কিন্তু যখন থেকে পরমেশ্বর শিব বললেন যে এই চক্র এবার থেকে দৃশ্যমান হবে, তখন থেকে তা দেখা যেতে শুরু করেছিল, তাই এই চক্রের নাম - সুদর্শন চক্র নামে পরিচিত হতে শুরু করেছিল ।

________________________________________________

বেদ শাস্ত্র থেকে প্রমাণ — (৫) 

যো বামপাদাচিতবিষ্ণুনেত্রস্তস্মৈ দদৌ চক্রমতীব হৃষ্টঃ |

তস্মৈ রুদ্রায় নমো অস্ত্র ॥ ১০ ॥

(অথর্ববেদ/শরভ উপনিষদ/১০ নং মন্ত্র)

অর্থ — যে প্রভুর বাম পাদপদ্মে বিষ্ণু নিজ নেত্র (চক্ষু) সমর্পিত করে দিয়েছেন, তার ফলস্বরূপ যে প্রভু প্রসন্ন হয়ে বিষ্ণুকে চক্র (সুদর্শন) প্রদান করেছিলেন, সেই পরমেশ্বর ভগবান রুদ্র কে আমি নমস্কার করি।


🔷লক্ষ্য করুন —  স্বয়ং বেদ নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন যে, বিষ্ণু শিবভক্তি করে শিবপূজা করতে গিয়ে শিবের পূজায় একটি পদ্মফুলের অভাব হওয়ায় নিজের চোখ তুলে পরমেশ্বর শিবের বাম চরণে অর্পণ করেছিলেন। পরমেশ্বর শিব প্রসন্ন হয়ে বিষ্ণুকে নিজের সুদর্শন চক্র দিয়েছিলেন। সুতরাং, আর কোনো সংশয়ের অবকাশ থাকে না এই বিষয়ে ।

________________________________________________

শৈব আগম শাস্ত্র থেকে প্রমাণ — (৬)

                  ৷৷ জলন্ধর বধ ৷৷

পুরা জলন্ধরো নাম রাক্ষসোঽভূত সুদারুণ।

লোকত্রয়ং মহাদেবী ববাধে বরদর্পিত ৷৷ ৩২

তথাবিধং মহাদৈত্যং পাদাঙ্গুষ্ঠকৃতেন বৈ।

চক্রেনাশয়েদ্দেবো ররক্ষ চ জগৎত্রয়ম্।

ততো হি প্রথিতো লোকে জলন্ধরহরঃ শিবঃ ৷৷ ৩৩

(মহাশ্রুতি সূক্ষ্মাগম, দ্বিতীয় পটল, ৩২-৩৩ নং মহামন্ত্র)

অর্থ — হে মহাদেবী ! পুরাকালে জলন্ধর নামে এক রাক্ষস বর প্রাপ্ত হয়ে অহংকারবশত তিন লোকের উপর অত্যাচার করতে লাগলো। ভগবান শিব নিজের পদাঙ্গুষ্ঠ দ্বারা জলে চক্র সৃষ্টি করে সেই চক্র দ্বারা তাকে বধ করে ত্রিলোকের রক্ষা করেছিলেন  এবং তখন থেকে শিব জলন্ধরহর নামে খ্যাত হন।


🔷লক্ষ্য করুন — মহাশ্রুতি শৈব আগম শাস্ত্র পর্যন্ত এই সুদর্শন চক্রের উৎপত্তি পরমেশ্বর শিবের থেকে হয়েছে বলে স্বীকার করে নিয়েছে। সুতরাং, আর কোন রকমের সংশয়ের স্থান নেই।

________________________________________________

 Chakra Tirtha/Chakreshwar Mahadev (Location)


পরমেশ্বর শিবের তপস্যা করে বিষ্ণু যে স্থানে সুদর্শন চক্র লাভ করেছিলেন, যা গোদাবরী নদীর তীরে অবস্থিত, ব্রহ্ম মহাপুরাণে এই স্থানের নাম   চক্র তীর্থ , এটি চৌখাম্বা প্রকাশিত 'ব্রহ্ম মহাপুরাণ/১০৯-১১০ অধ্যায় - এ বলা হয়েছে। আবার এই স্থান চক্রেশ্বর মহাদেব মন্দির নামেও বিখ্যাত। এই স্থান পিপ্পলেশ্বর তীর্থ নামেও পরিচিত, কারণ সেখানে পরম শৈব মহর্ষি দধীচের পুত্র পিপ্পলাদ শিব আরাধনা করেছিলেন।  আমাদের সনাতনী শৈবদের বৃষভধ্বজ উড়ছে সেখানে, একটি চিত্র দেখুন 👇 




বর্তমানে ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যে গোদাবরী নদীর তীরে অবস্থিত এই চক্রতীর্থের অবস্থান দেখুন সরাসরি Google Map থেকে, 

এইখানে ক্লিক করে দেখুন 👉 Chakra Tirtha,

👉 Chakreshwar Mahadev

________________________________________________

সিদ্ধান্ত 

(১)  পরমেশ্বর শিব সুদর্শন চক্রের উৎপন্ন করেছেন, জলন্ধর কে বধ করবার উদ্দেশ্যে।

(২) সেই চক্রকে দৃশ্যমান করে পরমেশ্বর শিব তার নাম সুদর্শন রেখেছিলেন। 

(৩) সেই চক্র লাভ করবার জন্য শ্রীহরি নারায়ণ পরমেশ্বর শিবের পূজা করেছিলেন।

(৪) শিবভক্তি করে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র লাভ করেছিলেন।

(৫) শিবের দেওয়া সুদর্শন চক্র কখনোই শিবভক্ত শৈবদের বধ বা অনিষ্ট করে না।



এখানেই এই প্রবন্ধ টি সমাপ্ত হল ।


সুদর্শন চক্র রূপে শিবকৃপা প্রাপ্তকারী পরমশৈব শ্রীনারায়ণের জয়

সুদর্শন চক্র উৎপন্নকারী পরমেশ্বর শিবের জয়

শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩 

হর হর মহাদেব 🚩 


লেখনীতে — ©শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী 

কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ