পরাক্রমী আলচোন হূণ রাজারা ছিলেন শিবভক্ত শৈব



🔷 ভূমিকা: আলচন হূণ জাতি

পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে যেসব বিদেশি শক্তি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করেছিল, তাদের মধ্যে আলচন হূণ (Alchon Huns) অন্যতম। এই জাতি মূলত মধ্য এশিয়া থেকে আগত হেপথালাইট হূণদের (Hephthalites) একটি শাখা ছিল, যারা ইরান ও আফগানিস্তান অতিক্রম করে উত্তর-পশ্চিম ভারতভূমিতে প্রবেশ করে।

আলচন হূণদের নেতৃত্বে প্রথম যে কয়েকজন শাসকের নাম পাওয়া যায়, তারা হলেন — খিংলা, জাভুকা, মেহমা ও তোরমান। এদের মধ্যেই তোরামাণা ও তাঁর পুত্র মিহিরকুল ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী। আলচন হূণরা কেবল যুদ্ধবাজ জাতিই ছিল না, বরং তারা একসময় ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে।

এই জাতির প্রথম দিকের ধর্মীয় আচরণ ছিল মিশ্র প্রকৃতির , অর্থাৎ তারা বিভিন্ন ধর্মের সমন্বয়বাদী চর্চা করত। তারা একদিকে তারা যেমন কট্টরভাবে শৈব ধর্ম পালনের সাথে সাথে সূর্যোপাসনা করতো, যা শৈব ধর্মের‌ই রীতিনীতি বটে। অন্যদিকে, প্রথম দিকে হূণ দ্বারা বৌদ্ধ ধর্মীয় স্থাপনায় দান করার কথাও শোনা যায়। তবে শৈব হূণ রাজারা পরবর্তীতে বৌদ্ধদের আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে বৌদ্ধদের নাশ করেছিলেন তারা। কেউ কেউ বলেন প্রথমে জরাথুষ্ট্র ধর্মের প্রভাবও তাঁদের মধ্যে লক্ষ্য করা গিয়েছে। এর ফলে আলচোন হূণদের ধর্মীয় নীতি কে বিচিত্র ও সমন্বয়ভিত্তিক বলা হয়ে থাকলেও। হূণদের মূল তথা প্রধান ধর্ম ছিল -  শৈবধর্ম । এটি প্রমাণ করবার জন্যেই এই প্রবন্ধ টি উপস্থাপন করা হল ।


পরাক্রমশালী আলচোন হূণ রাজারা ছিলেন শিবভক্ত শৈব 





________________________________________________

অনেকেই বলেন যে, তোরমান বৈষ্ণব ছিলেন । কিন্তু এই দাবী বাস্তবে সত্য নয়।


 তোরমানের এরান বরাহ পাথরের শিলালিপি এবং এর অনুবাদ দেখানো হয়েছে, যেখানে তোরামণকে একজন বৈষ্ণব বা বিষ্ণু ভক্ত হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, যদিও লেখাটিতে দাবি করা হয়েছে যে এটি বাস্তবতা ছিল না।

শিলালিপিটি শুরু হয় বিষ্ণুর বরাহ (শুকর) অবতার রূপের প্রার্থনা দিয়ে।

এরপর এটি গৌরবময় মহারাজাধিরাজ তোরমানের রাজত্বের কথা উল্লেখ করে।

শিলালিপিতে ধন্যবিষ্ণুর বিবরণ রয়েছে, যাকে মাতৃবিষ্ণুর ছোট ভাই হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যিনি ঈশ্বরের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন এবং অনেক গুণ ও কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন।

এই লেখাটি শিলালিপিতে তোরমানকে একজন বিষ্ণুভক্ত হিসেবে চিত্রিত করা এবং প্রকৃত ঐতিহাসিক বাস্তবতার মধ্যে একটি অসঙ্গতি নির্দেশ করে।

_________

হূণ রাজা তোরমান ভারতীয় গুপ্ত রাজা সমুদ্রগুপ্তের অনুকরণ করে বিষ্ণু সম্পর্কিত একটি শিলালিপি লিখেছিলেন মাত্র । এটিই তার প্রমাণ 👇


_____________________________________________________________________________


🔱 মিহিরকুল ছিলেন তোরমাণের পুত্র এবং একজন কট্টর শৈব (শিবভক্ত)

১. শিলালিপির প্রমাণ
 গোয়ালিয়র শিলালিপি (Gwalior Stone Inscription) অনুযায়ী —
এই শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, মিহিরকুল অন্তত ১৫ বছর রাজত্ব করেছিলেন। এই শিলালিপিতে তাঁর নাম উল্লিখিত আছে এইভাবে :

"मिहिर कुलेतिख्यातो (S) भगोयः पशुपतिम्।"
বাংলা অর্থ:
“মিহিরকুল নামে প্রসিদ্ধ এই রাজা ভগবান পশুপতিকে (অর্থাৎ শিবকে) উপাসনা করতেন।”

🔍 এই ‘পশুপতি’ শব্দটি শিবের একটি বিশেষ উপাধি। অতএব এটি একেবারে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় যে মিহিরকুল ছিলেন একজন শৈব ধর্মাবলম্বী রাজা


📜 চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ (Xuanzang)-এর বিবরণ

হিউয়েন সাঙ, যিনি ৭ম শতকে ভারতে ভ্রমণ করেন, তাঁর বিবরণে উল্লেখ করেন :

  • কাশ্মীর অঞ্চলে হূণ শাসক মিহিরকুল ছিলেন এক উগ্র শৈব

  • তিনি বৌদ্ধ ধর্মকে ঘৃণা করতেন এবং তাঁর আদেশে প্রায় ১৬০০টি বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করা হয় এবং হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষু ও অনুগামীকে হত্যা করা হয়।

এটি প্রমাণ করে, মিহিরকুল শৈবধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের বিরোধী নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন।


🛕 ধর্মীয় নীতি ও তার প্রভাব

মিহিরকুলের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একাধারে :

  • উগ্র শৈববাদী (Shaivite zealot)

  • বৌদ্ধ-বিরোধী

  • এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদের প্রবক্তা যিনি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেননি।


📌 সারাংশ:

মিহিরকুল তোরমাণের পুত্র ছিলেন।
তিনি গোয়ালিয়র শিলালিপি অনুসারে ‘পশুপতি’ (শিব) -এর উপাসক ছিলেন।
চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণে মিহিরকুলের বৌদ্ধ-বিরোধিতা ও শৈবত্বের প্রমাণ আছে।
তাঁর শাসনকাল ছিল ন্যূনতম ১৫ বছর (গোয়ালিয়র শিলালিপি অনুসারে)।





_____________________________________________________________________________

🔷 মিহিরকুল ও শৈবধর্মের প্রসার

আলচন হূণ রাজা মিহিরকুল ছিলেন ইতিহাসের এক বিশেষ ব্যক্তিত্ব, যিনি একদিকে যেমন বৌদ্ধ ধর্মের বিরোধিতা করেন, অপরদিকে তেমনি শৈব ধর্মকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় উন্নীত করেন। ইতিহাসবিদদের মতে, মিহিরকুল তাঁর শাসনামলে (৬ষ্ঠ শতাব্দী) কাশ্মীর ও পাঞ্জাব জুড়ে অসংখ্য শিবমন্দির নির্মাণ করেন এবং শৈবধর্মকে রাজধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।

তিনি বিশেষভাবে কাশ্মীর উপত্যকায় গন্ধার দেশ থেকে বহু ব্রাহ্মণ এনে বসতি স্থাপন করান এবং তাদের মাধ্যমে শৈব ধর্মচর্চা প্রচার করেন। তাঁর নির্মিত বিখ্যাত শৈবমন্দিরগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:

  • শ্রীনগরের শিবমন্দির – যেটিকে পরবর্তীতে 'মিহিরেশ্বর মন্দির' (Mihireshvara) বলা হয়।

  • হালদা-তে মিহিরেশ্বর মন্দির – Stein-এর মতে, এটি ছিল এক বিশেষ ঐতিহাসিক শৈবপীঠ।

  • মিহিরপুরা নামক একটি নগরও মিহিরকুল নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন, যা তাঁর শৈবচিন্তাধারার স্মারক।

📜 ঐতিহাসিক ও সাহিত্যমূলক সূত্র:

  • Gwalior Stone Inscription-এ উল্লেখ আছে:
    "मिहिर कुलेतिख्यातो (S) भगोयः पशुपतिम् ।"
    অর্থাৎ, "মিহিরকুল পঁশুপতির (শিব) একজন বিখ্যাত ভক্ত।"

  • রাজতরঙ্গিণী (Kalhana) অনুসারে, মিহিরকুল এক 'প্রতাপশালী কিন্তু নির্মম' রাজা ছিলেন, যিনি শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত অভিযান করেছিলেন। এই গ্রন্থে তাঁর পিতার নাম কখনো 'মুকুল' আবার কখনো 'বাসুকুল' বলা হলেও, গোয়ালিওর লিপি অনুসারে তাঁর পিতা তোরমান

  • Xuanzang (Hsuan Tsang) উল্লেখ করেন যে, মিহিরকুল ছিলেন একাধারে বৌদ্ধ-বিরোধী এবং ব্রাহ্মণ (শিবজ্ঞানী) পৃষ্ঠপোষক রাজা।

🔎 ঐতিহাসিক গুরুত্ব:

মিহিরকুলের এই শৈব নীতিই ভারতীয় উপমহাদেশে হূণদের এক আদর্শ "হিন্দু জাতিতে" রূপান্তরের পথ প্রশস্ত করে। যদিও তিনি ইতিহাসে নির্মম বৌদ্ধ-নিধনের জন্যও পরিচিত, তবু তাঁর মাধ্যমে কাশ্মীরে শৈব ধর্মচর্চা এক নতুন মাত্রা পায়।



🔷 মিহিরকুল-পরবর্তী হূণ রাজারা ও কাশ্মীরে শৈব ধর্মচর্চা

🔶 ১. প্রবরসেন (Pravarasena II) – মিহিরকুলের পুত্র

মিহিরকুলের পরে কাশ্মীর ও গান্ধার অঞ্চলের উত্তরাধিকারী হিসেবে যিনি রাজত্ব করেন, তিনি ছিলেন প্রবরসেন দ্বিতীয় (Pravarasena II)। সাধারণভাবে তাকে মিহিরকুলের পুত্র বলা হলেও, কিছু ঐতিহাসিক মতে তিনি ছিলেন তোরমানের (Toramana) পুত্র ও মিহিরকুলের উত্তরাধিকারী

  • প্রবররসেনের রাজত্বকাল : আনুমানিক খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময় (৫৩০-৫৯০ শতক)।

  • তিনি প্রবরসেনপুর নামে এক শহর প্রতিষ্ঠা করেন, যা আধুনিক শ্রীনগর (Srinagar) হিসেবে পরিচিত।

  • এই শহরে তিনি নির্মাণ করেন 'প্রবরেশ মন্দির' (Pravaresha Temple), যা ছিল একটি বিশাল শৈবমন্দির

  • তিনি শিবভক্ত ছিলেন এবং তাঁর রাজত্বকালে শৈবধর্মের প্রচার ও প্রসার লাভ করে।

🔹 “Pravarasena… built the great temple of Pravaresha and named Srinagar after himself as Pravarasenapura.”

🔶 ২. গোকর্ণ (Gokarna) – শিবভক্ত রাজা

প্রবরসেনের পরে যিনি কাশ্মীরে সিংহাসনে বসেন, তিনি ছিলেন গোকর্ণ, যিনি শৈবধর্মে নিজের জীবন উৎসর্গীকৃত করেছিলেন।

  • তিনি প্রতিষ্ঠা করেন গোকর্ণেশ্বর শিবমন্দির (Gokarneśvara)

  • গোকর্ণের কিছু মুদ্রা (coins) এখনও পাওয়া গেছে, যা প্রমাণ করে তিনি একটি শক্তিশালী রাজবংশের অংশ ছিলেন।

🔶 ৩. নরেন্দ্রাদিত্য খিংখিলা (Narendraditya Khinkhila)

গোকার্ণের পুত্র ছিলেন নরেন্দ্রাদিত্য, যার আরেকটি নাম ছিল খিংখিলা। তিনি ছিলেন একজন প্রজানুকূল ও শৈব রাজা।

  • তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ভূতেশ্বর শিবমন্দির (Bhūteśvara)

  • ধারণা করা হয় যে তিনি কাশ্মীর থেকে কাবুল পর্যন্ত বিস্তৃত একটি বৃহৎ অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।


📚 ঐতিহাসিক গুরুত্ব

এই ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে যে :

  • মিহিরকুলের পরেও হূণ রাজারা কাশ্মীর ও গান্ধার অঞ্চলে শৈবধর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।

  • এই রাজারা কেবল মন্দির নির্মাণ করেননি, নগর স্থাপন, ব্রাহ্মণ বসতি স্থাপন, এবং সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

  • হূণদের মধ্যে শুরুতে ইরানীয় ও কেন্দ্র-এশীয় বৈচিত্র্য থাকলেও, ভারতে এসে তারা ধীরে ধীরে সনাতন শৈব ধর্মে একীভূত হন




________________________________________________

এই প্রবন্ধটি এখানে সমাপ্ত হল ।


নন্দী মহারাজের জয়

পরমেশ্বর শিবের জয়


শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩 

হর হর মহাদেব 🚩 


লেখনীতে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী 

কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ