জাভা দ্বীপের মাতরম রাজ্যের শৈব ইতিহাস (সঞ্জয় বংশ)
ভূমিকা —
পরমেশ্বর শিবের শৈবধর্ম ছড়িয়ে আছে সমগ্র বিশ্বের সর্বত্র। বর্তমানে সনাতন ধর্মের সেই শৈব ইতিহাস কে তুলে ধরে শৈবদের প্রাচীনত্বকে ক্রমশ প্রকাশিত করবার উদ্দেশ্যেই এই প্রবন্ধ টি উপস্থাপন করেছি। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া দেশের অন্তর্গত জাভা দ্বীপ ৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১১০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিল একটি শৈব রাজ্য, সঞ্জয় রাজা ছিলেন সেই শৈব মাতরম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি সহ তার বংশধরদের কৃতিত্ব সম্পর্কে অল্প কিছু তথ্য উপস্থাপন করে শৈবধর্মের প্রাচীনত্ব বিশালতার বিষয়ে সকলকে জানাবার প্রয়াস করা হয়েছে এই প্রবন্ধে ।
জাভা দ্বীপের মাতরম রাজ্যের শৈব ইতিহাস (সঞ্জয় বংশ)
জাভার প্রাচীন মাতারাম রাজ্য (Mataram Kingdom), যা বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে অবস্থিত ছিল, তার প্রথম রাজবংশ ছিল সঞ্জয় বংশ (Sanjaya dynasty)। এই বংশের রাজারা মূলত শৈব ধর্ম (Shaivism) অনুসরণ করতেন, অর্থাৎ তাঁরা ভগবান শিব-কে পরমেশ্বর রূপে পূজা করতেন এবং শৈব দর্শন ও উপাসনা প্রচলন করতেন।
সঞ্জয় বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা সঞ্জয়, যিনি খ্রিস্টীয় ৮ম শতকে শাসন করতেন। তাঁর রাজত্বকালে বহু শিব মন্দির নির্মিত হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জাভার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে নির্মিত দিয়েং (Dieng) মালভূমি-তে অবস্থিত প্রাচীন শৈব মন্দিরসমূহ। এছাড়াও, প্রম্বানন মন্দির (Prambanan Temple) — যা জাভার সবচেয়ে বৃহৎ হিন্দু শিব মন্দির — এটিও শৈব উপাসনার এক অনন্য নিদর্শন।
এই রাজারা শৈব ধর্মের প্রসার ও প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষা, বেদ, আগম ও সনাতন ধর্মের দর্শনের চর্চা করতেন এবং দক্ষিণ ভারতের শৈব মঠ ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের প্রভাব তাঁদের ওপর পড়েছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিক দলিল থেকে জানা যায়।
সুতরাং, জাভার সঞ্জয় বংশীয় রাজারা ছিলেন একজন বিশিষ্ট শৈব রাজা, যাঁরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় হিন্দু শৈব ধর্মের প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
মাতারাম রাজ্য ছিল একটি শৈব রাজ্য, যা খ্রিস্টীয় ৮ম থেকে ১১শ শতাব্দী পর্যন্ত জাভা দ্বীপে (বর্তমান ইন্দোনেশিয়া) বিস্তার লাভ করেছিল।
সোজোমের্তো প্রাচীন মালয় শিলালিপি (Sojomerto Old Malay Inscription) একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ, যা দেখায় যে সঞ্জয় (Sanjaya) ছিলেন একজন শৈব রাজা।
__________________________________________________________________________________
⚫ সঞ্জয় বংশ ও শৈলেন্দ্র বংশ : শৈবধর্ম থেকে বৌদ্ধধর্ম ও পুনরায় শৈবধর্মে প্রত্যাবর্তন
মহান সঞ্জয় রাজা ছিলেন একজন পরম শৈব (শিব-ভক্ত) রাজা এবং তাঁর বংশের রাজারা প্রথমে শৈবধর্ম অনুসরণ করতেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরের চারজন রাজা (৮ম থেকে ৯ম শতাব্দী) ছিলেন শৈলেন্দ্র বংশীয় এবং তাঁরা বৌদ্ধধর্ম (বিশেষ করে মহাযান বৌদ্ধ) অনুসরণ করতেন।
⚫ প্রম্বানন মন্দির ও শৈবধর্মের পুনর্জাগরণ
পরবর্তীকালে সঞ্জয় বংশের একজন বংশধর, যারা আবার শৈব ধর্মে অনুগত ছিলেন, তিনি নির্মাণ করেন প্রম্বানন শিব মন্দির — এটি জাভার এবং সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ শিব মন্দির।
⚫ রতু ই হালু (Ratu i Halu): এক গৌরবময় শৈব রাজা
কিছু শিলালিপি অনুযায়ী, একজন শৈব রাজা রতু ই হালু, যিনি সম্ভবত প্রথম বা দ্বিতীয় আম্রাতি রাজার সমসাময়িক ছিলেন, তিনি এসেছিলেন আখণ্ডলপুর (ইন্দ্রপুর) থেকে — যা সম্ভবত বর্তমান সুমাত্রা বা মালয় উপদ্বীপের কোনো অংশে অবস্থিত ছিল। তিনি এসে বসতি স্থাপন করেন সরগভব (সম্ভবত ‘স্রোতস্বিনী ভূমি’ অর্থাৎ নদীর ধারে)। সেখানেই তিনি তাঁর "খুদা (মুষল)" আকৃতির রাজপ্রাসাদ (Kraton) প্রতিষ্ঠা করেন।
এই ঘটনাটি অনেকাংশে শৈলেন্দ্রদের অভিবাসনের মতো হলেও পার্থক্য এই যে — এই রাজা ছিলেন একজন শৈব ভক্ত। তাঁর প্রপৌত্র (great-grandson) ৮৫৬ ও ৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে কিছু শিলালিপি খোদাই করেন, যেখানে এই বংশীয় ঐতিহ্যের উল্লেখ আছে।
মন্দির কমপ্লেক্সটি ৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের রাজা লোকপাল কর্তৃক প্রকাশিত শিবগৃহ শিলালিপির সাথে যুক্ত , যেখানে প্রম্বাননের মতো একটি শিব মন্দির প্রাঙ্গণের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এই শিলালিপি অনুসারে, শিব মন্দিরটি ৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ নভেম্বর উদ্বোধন করা হয়েছিল।
প্রম্বানন শিলালিপি
শিবগৃহ শিলালিপি, ৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ
সারকথা:
সঞ্জয় বংশের সূচনা ছিল শৈবধর্মনির্ভর;
মাঝে শৈলেন্দ্র বংশ এসে বৌদ্ধধর্ম প্রচলন করে;
পরবর্তীতে পুনরায় শৈব বংশ ফিরে এসে নির্মাণ করেন প্রম্বানন শিব মন্দির;
এটি ছিল একটি শৈব পুনর্জাগরণ — যার সাথে রতু ই হালুর মতো শৈব রাজাদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
___________________________________________________________________________________
🔱 রাকাই পিকাতন (Rakai Pikatan) ও জাভায় শৈবধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা
পিকাতন রাজা, যিনি সঞ্জয় বংশের একজন বংশধর ছিলেন, তিনি:
শৈবধর্ম (শিব-উপাসনা) পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেন;
সঞ্জয় বংশের শাসন ক্ষমতা জাভাতে পুনরুদ্ধার করেন;
এবং এরপর থেকে মাতরম রাজ্য আবার শৈব শাসনাধীনে চলে আসে।
🛕 প্রম্বানন মন্দির ও লোরা জংগ্রাং (Loro Jonggrang)
৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে একটি গুরুত্বপূর্ণ ওল্ড জাভানিজ ভাষায় শিলালিপি পাওয়া গেছে — এটিই ওল্ড জাভানিজ ভাষার প্রথম কাব্যিক নিদর্শন।
এই শিলালিপি এক শিবমন্দির (শিবগৃহ) নির্মাণকে কেন্দ্র করে লেখা — যা পরে প্রম্বানন মন্দির কমপ্লেক্সের অংশ হয়।
মন্দির নির্মাণের পেছনে একজন মহান রাজা "জাতিনিংরত" (Jāti-ning-rat)-এর অনুপ্রেরণার কথা বলা হয়েছে — সম্ভবত সংস্কৃত "জগৎ-কারণ" (Jagatkāraṇa)-এর জাভানীকৃত রূপ।
তিনি যুদ্ধজয়ের পর শান্তি ও প্রায়শ্চিত্তমূলক কর্মকাণ্ডে নিজেকে উৎসর্গ করেন।
তার মধ্যে একটি প্রধান কাজ ছিল শিবমন্দির নির্মাণ।
🏯 মেদাং ও মাম্রাতি রাজ্য
এই রাজা তার রাজপ্রাসাদ (Kraton) পুনর্নির্মাণ করেন মেদাং-এ, যা অবস্থিত ছিল মাম্রাতি রাজ্যে।
তিনি ছিলেন একজন শৈব ভক্ত, যদিও রাণী ছিলেন অন্য ধর্মাবলম্বী।
এই ঘটনা জাভায় শৈবধর্মীয় নবজাগরণ এবং শৈব ঐতিহ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রমাণ বহন করে।
🕉️ ঈশান বংশ এবং মাতারাম রাজ্যের শৈব ঐতিহ্য
সঞ্জয় বংশের পর, জাভার মাতরম রাজ্যে শাসনভার গ্রহণ করে ঈশান বংশ (Ishana dynasty)। এই বংশের নামই এসেছে পরমেশ্বর শিবের এক বিশেষ রূপ “ঈশান” থেকে, যা তাদের স্পষ্টভাবে শৈবধর্মে নিষ্ঠা বোঝায়।
🔸 ঈশান বংশের বৈশিষ্ট্য:
"ঈশান" শব্দের অর্থই — “উত্তর-পূর্ব দিকের অধিপতি”, যা শিবের এক রূপ।
এই বংশ শিব-উপাসক অর্থাৎ শৈব (Shaivite) ছিল, এবং তাদের শাসনকালে শৈবধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করে।
এই রাজারা প্রম্বানন সমভূমিতে শৈব মন্দির নির্মাণ ও সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
🛕 শৈলেন্দ্র বনাম শৈব পুনরুত্থান
ঈশান বংশের একজন রাজা বা রাজপুত্র নিজেকে "শৈব শৈলেন্দ্র (Śivaitic Sailendra)" হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিলেন।
তার উদ্দেশ্য ছিল প্রম্বানন অঞ্চলে আবার শৈবধর্মকে ফিরিয়ে আনা, মূলত মন্দির নির্মাণ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে।
তিনি তার পূর্বপুরুষ "হালু"-র (Halu) বংশধারাকে স্মরণ করিয়ে দেন — সম্ভবত সুমাত্রা থেকে আগত এই পূর্বপুরুষ ছিলেন একজন শৈব রাজা।
অগস্ত্য (Agastya) নাম গ্রহণের প্রসঙ্গও এসেছে — এটি শিবের দক্ষিণ ভারতীয় বৈদিক সংযোগকেও ইঙ্গিত করে।
📜 উপসংহার
পিকাতন ছিলেন জাভার শৈব ধর্মীয় রাজত্বের পুনরূত্থানের মূল কেন্দ্রবিন্দু।
তাঁর নেতৃত্বেই মাতারাম রাজ্য আবারও শৈব রাজতন্ত্রে প্রবেশ করে, এবং পরবর্তীতে প্রম্বানন মন্দির নির্মাণের মাধ্যমে এই ঐতিহ্য স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
ঈশান বংশ মাতারাম রাজ্যের ধারাবাহিক শৈব রাজতন্ত্র বজায় রাখে।
এই বংশের নীতিগুলি শিবতন্ত্র ও মন্দিরভিত্তিক ধর্মীয় সংস্কৃতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিকে ছিল।
তারা শৈলেন্দ্র বৌদ্ধ রাজবংশের ধর্মীয় প্রভাবের মোকাবেলায় শৈব ঐতিহ্যের জাগরণে ভূমিকা রাখেন।
________________________________________________
এই প্রবন্ধটি এখানে সমাপ্ত হল ।
নন্দী মহারাজের জয়
পরমেশ্বর শিবের জয়
পরমশৈব মহারাজ সঞ্জয়ের জয়
পরমশৈব রাকাই পিকাতনের জয়
পরমশৈব ঈশান রাজের জয়
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
লেখনীতে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন