পরশুরামকৃত শিবস্তোত্র (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণোক্ত)
॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥
ভূমিকা -
কোনো এক সময়ে জমদগ্নির পুত্র বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম পরমেশ্বর শিবকে দর্শন করতে কৈলাসে উপস্থিত হয়ে স্তব করতে উদ্যত হলেন; কিন্তু স্তব করবার জন্য উপযুক্ত বাক্য জোগাড় না হওয়াতে গদগদ-বাক্যনিঃসরণ হইতে লাগল ; অশ্রুবিন্দুদ্বারা তার চক্ষু পরিপূর্ণ হল। পরশুরাম অতিদীনমনা হয়ে কাতরোক্তি-সহকারে, কৃতাঞ্জলিপুটে, শান্তভাবে, পিতৃমাতৃশোকে পীড়িতচিত্তে শোকাকুল হয়ে পরমেশ্বর শিবের স্তুতি পাঠ করেছিলেন । সেই পরশুরামকৃত শিবস্তোত্র এইখানে উপস্থাপন করা হলো, যা ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের গণেশ খণ্ডের ২৯ নং অধ্যায়ের ৪৩ থেকে ৫৫ নং শ্লোকে বর্ণিত হয়েছে ।
পরশুরামকৃত শিবস্তোত্র
(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণোক্ত)
পরশুরাম উবাচ।
ঈশ ত্বাং স্তোতুমিচ্ছামি সাম্প্রতং স্তোতুমক্ষমঃ।
অক্ষরাক্ষরবীজঞ্চ কিং বা স্তৌমি নিরীহকম্ ॥৪৩
ন যোজনাং কর্তুমীশো দেবেশং স্তোতুমীপ্সিতম্।
বেদা ন শক্তা যং স্তোতুং কস্তাৎ স্তোতুমিহেশ্বরঃ ॥ ৪৪
বুদ্ধের্বাঙ্মনসোঃ পারং সারৎসারং পরাৎপরম্।
জ্ঞানবুদ্ধেরসাধ্যঞ্চ সিদ্ধং সিদ্ধৈনিষেবিতম্ ॥ ৪৫
যমাকাশমিবাসীন-মনন্তমাদিমব্যয়ম্।
বিশ্বতন্ত্রমতন্ত্রঞ্চ স্বতন্ত্রং তন্ত্রবীজম্ ॥ ৪৬
ধ্যানাসাধ্যং দুরারাধ্য মাতসাধ্যং কৃপানিধিম্।
ত্রাহি মাং করুণাসিন্ধো দীনবন্ধোঽতিদীনকম্ ॥৪৭
অদ্য মে সফলং জন্ম জীবিতঞ্চ সুজীবিতম্ ।
স্বপ্নাদৃষ্টঞ্চ ভক্তানাং পশ্যামি চক্ষুষাধুনা ॥ ৪৮
শক্রআদয়ঃ সুরগণাঃ কলয়া যস্য সম্ভবাঃ।
চরাচরাঃ কলাংশেন তং নমামি মহেশ্বরম্ ॥ ৪৯
যং ভাস্করস্বরূপঞ্চ শশিরূপং হুতাশনম্।
জলরূপং বায়ুরূপং তং নমামি মহেশ্বরম্ ॥ ৫০
স্ত্রীরূপং ক্লীবরূপঞ্চ পুংরূপক বিভর্তি যঃ।
সর্বাধারং সর্ব্বরূপং তং নমামি মহেশ্বরম্ ॥ ৫১
দেব্যা কঠোরতপসা যো লব্ধো গিরিকন্যয়া।
দুর্লভস্তপসাং যো হি তং নমামি মহেশ্বরম্ ॥ ৫২
সর্বেষাং কল্পবৃক্ষঞ্চ কামাধিকফলপ্রদম্।
আশুতোষং ভক্তবন্ধুং তং নমামি মহেশ্বরম্ ॥৫৩
অনন্তবিশ্বসৃষ্টীনাং সংহর্তারং ভয়ঙ্করম্।
ক্ষণেন লীলামাত্রেণ তং নমামি মহেশ্বরম্ ॥ ৫৪
যঃ কালঃ কালকালশ্চ কালবীজঞ্চ কালজঃ।
অজঃ প্রজশ্চ যঃ সর্বস্তং নমামি মহেশ্বরম্ ॥ ৫৫
[ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ/গণেশ খণ্ড/২৯ নং অধ্যায়/৪৩-৫৫ নং শ্লোক]
অর্থ —
হে জগদীশ্বর! আপনাকে আমি স্তব করতে ইচ্ছা হচ্ছে, কিন্তু আমার স্তব করবার কোনো ক্ষমতা নেই। আপনি সকল অক্ষরের উৎপত্তিস্থান; আপনার কোন-রূপ কোন কার্য্যের চেষ্টা নাই; অতএব আপনাকে কিরূপে স্তব করবো ? নিজের অভিলাষানুরূপ স্তব করবার বাক্যযোজনা করতে সক্ষম হচ্ছি না ; অতএব কিভাবে স্তব করবো ? বেদচতুষ্টয় যাঁর স্তব করতে সমর্থ হন নাই, সেই দেবদেব মহাদেবকে স্তব করতে কোন ব্যক্তি সক্ষম হতে পারে ?
হে পরমেশ্বর! আপনি বুদ্ধি, বাক্ শক্তি এবং মনের অগোচরপদার্থ ; এই ত্রিলোকমধ্যে যাবতীয় সার বলে যে সব পদার্থ আছে, আপনি তাদের সার পদার্থ এবং যত উৎকৃষ্ট পদার্থ আছে, তাদের থেকেও আপনি উৎকৃষ্ট ; আপনি লোকের (জগতের) জ্ঞানশক্তি ও বুদ্ধিশক্তির অতীত; আপনি সিদ্ধপুরুষ এবং সিদ্ধ-পুরুষনিচয়কর্তৃক সর্বদা সেবিত। আপনি আকাশের ন্যায় সর্বব্যাপী হয়ে অবস্থিতি করছেন। আপনার অন্ত নেই, আদি নেই, এবং বিনাশ নেই ; আপনি ইচ্ছানুসারে কখনো জগতের অধীন, কখনো বা অধীনতা-শূন্য, কখন বা স্বাধীন পুরুষ; আপনিই তন্ত্রশাস্ত্রের উৎপত্তিস্থান। আপনি ধ্যানদ্বারা সাধনীয় বস্তু, আপনার আরাধনা করা দুষ্কর কার্য্য, অতিসাধনাদ্বারা আপনার সাধনা করা যায়; আপনি কৃপা-সমুদ্র। হে করুণাময়! দীনজনগণবন্ধো! আমি অতি দুর্দশাপন্ন ব্যক্তি, আমাকে পরিত্রাণ করুন।
এখন আমার জন্ম সফল হল, এবং আমার জীবন ধারণ করা সার্থক হল। (কারণ) ভক্তগণ যাঁকে স্বপ্নেও দর্শন করিতে সক্ষম হয় না, আমি (শিবকৃপায়) এখন মানবচক্ষুদ্বারাই তাঁকে (পরমেশ্বর শিবকে) দর্শন করলাম ! এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কি আছে ?
হে দেব! যে দেবাদিদেবের অংশ হতে ইন্দ্র প্রভৃতি লোকপালগণ উৎপন্ন হয়েছেন এবং স্থাবর জঙ্গমাত্মক সমস্ত জগৎ যাঁর কলার অংশ, আমি সেই জগদীশ্বর মহাদেবকে নমস্কার করি।
যে দেবাদিদেব মহাদেব ভাস্কর-রূপে কলাকাষ্ঠা প্রভৃতি কালবিভাগ করে জগতের হিত সাধন করছেন, চন্দ্ররূপী হয়ে সুধা বর্ষণ করছেন, বহ্নিরূপী হয়ে পাকাদি কার্য্যদ্বারা জগতের হিতসাধন করে চলেছেন, জলরূপে শস্যোৎপাদন করছেন, বায়ুরূপে জনগণের প্রাণ রক্ষা করছেন, সেই মহেশ্বরকে আমি নমস্কার করি।
যে দেব, স্ত্রী-রূপ, ক্লীবরূপ এবং পুরুষরূপ ধারণ করে, সৃষ্টি বিস্তার করছেন, সকল বস্তুর আধারস্বরূপ এবং সকল বস্তুস্বরূপ হয়ে যে দেব অবস্থিতি করেন, সেই দেবাদিদেব মহেশ্বরকে আমি নমস্কার করি।
গিরিকন্যা পার্বতী কঠোর তপস্যা দ্বারা যাঁকে (স্বামী হিসেবে) পেয়েছেন, বহুকাল তপস্যা করেও যাকে পাওয়া সুকঠিন, সেই দেবাদিদেব মহেশ্বরকে আমি নমস্কার করি।
সকল লোকের কল্পবৃক্ষস্বরূপ হয়ে যিনি লোকের অভিলাষাধিক ফল প্রদান করে থাকেন, যিনি ভক্তগণের প্রতি অল্প-কালমধ্যেই সন্তুষ্ট হন ও ভক্তের প্রতি সর্বদাই স্নেহ-পরতন্ত্র, সেই মহেশ্বরকে আমি নমস্কার করি।
যে দেব অনায়াসে অল্পকালমধ্যে ভয়ঙ্কর কালাগ্নিরূপ ধারণপূর্ব্বক এ অসীম জগৎসংসার বিলোপ করে থাকেন, সেই মহেশ্বরকে আমি নমস্কার করি।
যে দেব কাল-স্বরূপ, যিনি কালের কাল, যে দেব হতে সৃষ্টিকালে কালচক্র প্রবৃত্ত হয়, যিনি কালের বীজস্বরূপ, যে দেবের জন্ম নাই, যিনি পরমাত্মা ; যে দেব দৈত্যাদি নিধন করবার জন্য নানারূপ ধারণ করে অবতীর্ণ হন এবং যিনি সর্বরূপী, সেই মহেশ্বরকে আমি নমস্কার করি।
(পাঠের ফল)
ইত্যেবমুক্ত্বা স ভৃগু পপাত চরণাম্বুজে।
আশিষঞ্চ দদৌ তস্মৈ সুপ্রসন্নো বভূব সঃ ॥ ৫৬
জামদগ্ন্যকৃতং স্তোত্রং যঃ পঠেদ্ভক্তিসংযুতঃ।
'সর্বপাপবিনির্মুক্তঃ শিবলোকং স গচ্ছতি ॥ ৫৭
[ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ/গণেশ খণ্ড/২৯ নং অধ্যায়/৫৬-৫৭ নং শ্লোক]
অর্থ — ভূগুকুলোদ্বহ পরশুরাম মহাদেব সমীপে এইরূপ স্তুতি-বাক্য প্রয়োগ করে তাঁর পাদপদ্মা সমীপে পড়ে রইলেন। ভগবান্ ভবানীপতি ভৃগুবংশজ পরশুরামের প্রতি প্রসন্ন হয়ে আশীর্বাদ করলেন। যে ব্যক্তি ভক্তিভাবে পরশুরামকৃত মহাদেবের এই স্তুতি পাঠ করে, সেই মনুষ্য নিখিল পাপরাশি থেকে মুক্তি লাভ করে অন্তিমে শিবলোক লাভ করে ।
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
তথ্য সংগ্রহে ও লেখনীতে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন